দ্বন্দ্ব

একটানা কাজ করার পর চেয়ার থেকে উঠতেই কোমরে টান লাগে। ঠোঁট কুঁচকে পিঠ টান করে শ্বাস ছাড়ে সুজয়। বয়স কি বাড়লো? নাকি পরিশ্রম বেশি হচ্ছে? নিজেকেই প্রশ্ন করে। তারপর মৃদু হাসি দিয়ে দুটো জিজ্ঞাসাই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। দুর কিছুই হয়নি, মাঝে মাঝে এমন রগড় করা শরীরের অভ্যেস। এ হলো মনের সঙ্গে শরীরের ভালোবাসার খেলা। এসবকে পাত্তা দিতে নেই।

ও উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে এতো বড়ো যার চাকরি, তার কি বয়স বাড়তে আছে? মোটেই না। এখন তো চোখ বুজলেই শৈশব দেখতে পায় ও। যে শৈশব দেখতে পায় তার আর যাই হোক বয়স বাড়বে কেন? আর শরীর? ওটা নিয়ে ভাবা শোভা পায় না। দুর্বলচিত্তের লোকরাই ওটা নিয়ে ভাবে। ও নিজেকে ঝাঁকুনি দিয়ে ফিট করে নেওয়ার জন্য ঘরের এমাথা ওমাথা দুবার পায়চারি করে। দামি কার্পেটে চকচকে দামি জুতো ডুবে যায়। না, এভাবে পায়চারি হয় না। জুতো ডুবে গেলে শরীর টান হবে কি করে। লম্বা বারান্দায় হাঁটলে যুৎসই হতো। কিন্তু হাঁটতে পারবে না। কর্মচারীরা অবাক হয়ে তাকাবে। তারপর ফিসফিস কণ্ঠস্বরে নানা গল্প তৈরি করবে। ও আবার নিজের চেয়ারে এসে বসে। গা এলিয়ে দেয়। রিলাক্সড মুড। নাহ, কোমরে ব্যথা নেই। হাত ওঠায় ও, আজগুবি, আসলে ব্যথা বোধহয় ওর ভাবনায় ছিলো। ও মাথা নেড়ে নিজেকেই বললো, হ্যাঁ, মাঝে মাঝে ভাবনাটাই ব্যথা করে।
কতো বয়স হলো ওর? পঞ্চান্ন? হবে হয়তো। মা ভালো জানে, চল্লিশের দশকের মধ্যভাগের কথা। ওর জন্মের সময়টা মায়ের দারুণ স্মৃতি, নেড়েচেড়ে রোদে দেয় প্রতিনিয়ত। সেসব কথা বলতে মা খুব ভালোবাসে। সুজয়ের সময় কই এতো কথা শোনার? তবু শুনতে হয়, সময় বের করতে হয়। তাছাড়া, নিজের শৈশবের কথা শুনতে কার না ভালো লাগে। কতো যোজন যোজন দূরত্ব আজকের এই অবস্থানের সঙ্গে ওর শৈশবের সময়ের। ও চোখ বুজে চেয়ারে পিঠ হেলান দেয়। মুহূর্তে হো হো করে হেসে উঠে বলে, সুজাউদ্দিন কেমন আছো? শৈশবে ওকে সুজাউদ্দিন নামে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিলো। ভালো তো সুজাউদ্দিন? আবার হো হো করে আপন মনে হেসে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। একদৃষ্টে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।
অনেক সময়েই বারো তলা ভবনের দশ তলা থেকে নিচে তাকালে সবকিছু ছবির মতো লাগে না। উঁচু-নিচু ভবনগুলোর দিকে তাকালে একটি এবড়ো-খেবড়ো মাঠের মতো মনে হয়। বস্তিগুলো যেন বিশাল গর্ত, পাঁকেভরা, পুতিগন্ধময়। আর রাস্তাগুলো? নদী ভাবা যেতো, যায় না। ওগুলো নদী নয়, নর্দমা। আর মানুষগুলো? পোকা, পোকা কিলবিল করছে। সুজয়ের মাথা ঝিমঝিম করে। এই সবকিছু সুন্দর করার স্বপ্নে ওর বাবা-মা জীবনপাত করেছিলো। সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এখন ওর মায়ের বিরাশি বছর বয়স। মায়ের বয়সটা ও ভোলে না। তার জন্ম তারিখও ভোলে না। ঘটা করে জন্মদিন পালন করে। বন্ধু-বান্ধব, আÍীয়স্বজন ডেকে ঘর ভরিয়ে ফেলে। ওর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা এই জন্মদিন পালন করতে বেশি মজা পায়। নিজেদের জš§দিন ওরা ঘরোয়াভাবে পালন করে। আসলে ওরা সবাই মনে করে ওর মায়ের জন্মদিনের সঙ্গে একটি বিশেষ সময়ের ইতিহাস জড়িত। সুজয়ের মনে হয় এটাই এ জন্মদিনের প্রধান আকর্ষণ। ওর জন্মদিন নিয়েও এ বাড়িতে একটা উৎসব হতে পারতো, কিন্তু ও নিজেই হতে দেয় না। কেবলই মনে হয় মায়ের জন্মদিনের মধ্যে যে একটা গৌরব আছে, ওর সেটা নেই। ও ভিন্ন সময়ের ভিন্ন উপলব্ধির মানুষ। ওর শৈশবের সঙ্গে যৌবনের প্রবল বিরোধ। বার্ধক্যের সূচনায় সে বিরোধ দৃঢ় হয়েছে। এটা আর নিষ্পত্তি হবার নয়।
বাবা বেঁচে নেই। কমিউনিস্ট বাবা মানুষের জন্য কিছু করার আদর্শে লড়েই মারা গেলেন। তাঁর ছেলের এই বিত্ত-বৈভব দেখার সুযোগ হয়নি তাঁর। সুজন এক মুহূর্ত পিছিয়ে গিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে, ভালো হয়েছে, না খারাপ? উত্তর সুজয়ের জানা নেই। এটা নিয়ে ও বেশিদূর গড়াতে চায় না। একদিন মাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় মা বললো, নিউ মার্কেটের কাঁচা বাজারের কাছ দিয়েই তো যাবো। গাড়ি থামিয়ে কিছু সবজি কিনে নিয়ে আয়।
সুজয় ড্রাইভারকে পাঠালো না। নিজেই সবজি কিনতে গেলো। নানা রকম সবজির সঙ্গে একগাদা তাজা কলমি শাক কিনে এনেছিলো। ও জানে কলমি শাক না কিনলে মা আবার পাঠাবে। বলবে, দুমুঠো কলমি শাক নিয়ে আয়। বাজার করে গাড়িতে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সেই একই জিজ্ঞাসা, কলমি শাক পেয়েছিস তো?
হ্যাঁ, সুজয়ের মৃদু উত্তর। ও জানে এখন কি হবে। যথারীতি মায়ের চোখ ভিজে ওঠে। তারপর কাঁদতে শুরু করে। আঁচলে চোখ মোছে। অসংখ্য দিন শোনা ঘটনাটি মা বিড়বিড় করে বলতে থাকে : তখন তোর বয়স ছিলো ছয়। পুলিশ কমিউনিস্টদের খুব ধরপাকড় করছিলো। তোর বাবা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিলো। আমি নারায়ণগঞ্জে মহিলা কলেজে চাকরি করছিলাম। তোকে নিরাপদে রাখার জন্য ডেমরার এক তাঁতির বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলাম। ওরা ভীষণ গরিব ছিলো। তখন তোর জন্য আমাদের একটি জায়গা দরকার ছিলো। কি খেতে দেবে, কোথায় ঘুমোতে দেবে এতো কিছু ভেবে দেখার সময় ছিলো না। আমি সপ্তাহে একদিন তোকে দেখতে যেতাম একটা সেদ্ধ ডিম আর দুটো কমলা নিয়ে। তুই ওই দুটো জিনিসের জন্য হাঁ করে বসে থাকতি বাড়ির সামনে। আমি গেলে ঝাঁপিয়ে পড়তি আমার কোলে। কি যে সব দিন ছিলো আমাদের। একদিন তোকে দেখতে গিয়েছি, আমাকে জড়িয়ে ধরে তোর সে কি কান্না। আমার নেওয়া ডিম আর কমলা ছুঁড়ে ফেলে দিলি। তোর কান্না আর থামে না। তাঁতি আর তাঁতির বউ তো অবাক। গরিব মানুষ, কতো আদর করেছে তোকে, কি হয়েছে বুঝতেই পারছে না। শেষে তুই কাঁদতে কাঁদতে বললি, সাত দিন ধরে দুপুরে ভাত খেয়েছি শুধু নুন দিয়ে আর রাতে ভাতের ফেন আর কলমি শাক। আমি আর এখানে একদিনও থাকবো না। তুমি আমাকে আজই এখান থেকে নিয়ে যাও।
তাঁতি আর তাঁতির বউয়ের মুখ শুকিয়ে গেছে। আমার দুহাত জড়িয়ে ধরে বলে, দিদি আমাদের যে আর কিছু নেই। তোমার ছেলেকে কি খাওয়াবো? তুমি কিছু মনে করো না দিদি।
আমি তাঁতি বউকে জড়িয়ে ধরে বলি, তুই কি পাগল হয়েছিস বুলু। তোরা যে আমার ছেলেকে যত্ন করে রেখেছিস এই তো ঢের। এখন ও যেতে চাইছে আমি আজ নিয়ে যাই, আবার অন্য সময়ে নিয়ে আসবো। তোরা কিছু মনে করিস না।
তোকে নিয়ে ফিরে এলাম। এরপর তুই বড়ো হওয়া পর্যন্ত আর কোনোদিন তোকে কলমি শাক খেতে দেই নি।
এক সময়ে মায়ের কণ্ঠ থেমে যায়। সুজয় জানে মা এখনও কাঁদে কেন- মায়ের স্বপ্ন ছিলো সব শিশুদের মুখে ভাত-মাছ দেওয়ার, সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মায়ের কান্না তো ওর জন্য নয়। কান্না স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার যন্ত্রণার। কলমি শাক মায়ের জীবনে একটি প্রতীক এখন।
আবার বর্তমানে ফিরে আসে ও। কে যেন ঠাট্টা করে বলেছে, তুমি বাড়ি যাবে না সুজাউদ্দিন? না, আজ আমার বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই। আজ আমি নিজের সঙ্গে খেলছি। বাড়ি গেলে খেলা ফুরিয়ে যাবে।
কলিংবেল চাপে ও। পিয়ন এসে দাঁড়ালে বলে, কফি দাও। সঙ্গে মাছের কাটলেট। পিয়ন চলে যায়। আবার মায়ের কথায় ফিরে আসে ও। মা বলতেন, যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরতাম তখন মাঝে মাঝে মাছের তেলে সলতে ডুবিয়ে প্রদীপ জ্বালাতাম।
ঢাকা জেলা মহিলা আÍরক্ষা সমিতির সম্পাদিকা ছিলেন মা। কাজ করতেন দিনরাত। বলতেন সকালে দুধ মুড়ি খেয়ে সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার পর পার্টির ক্যাম্পে ফিরে ডাল-ভাত অথবা খিচুড়ি খেয়ে ঘুম লাগাতাম। এ সময়ে পুলিশ বেশ উৎপাত শুরু করায় কৃষক-বউ সেজে লুকিয়ে ছিলাম গ্রামে। আস্তে আস্তে রটে গেলো দেখতে সুন্দর একটা বেশ্যা এসেছে গাঁয়ে। পরদিনই অতি কষ্টে বোরখা পরে লুকিয়ে অন্য গ্রামে চলে গেলাম।
হো হো করে হেসে ওঠে সুজয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেছিলো। ওর হাসির মুখে পিয়ন মাছের কাটলেট আর চা নিয়ে ঢোকে। থমকে যায় সুজয়। মুহূর্তে মনে হয়, লোকটি ওকে পাগল ভাবলো। ওর রাগ হয়, ও কেন এমন সময় ঢুকলো। ও চা রেখে ফিরে যাবার সময় সুজয় ওকে ডাকে, এই শোন।
লোকটি থমকে দাঁড়ায়, ভয় পায়। মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ।
তুমি মাছের কাটলেট পছন্দ করো?
আমি কখনো খাইনি, স্যার।
তাহলে এটা খাও, নাও।
ও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন? নাও।
ও ভীরু হাতে প্লেটটা উঠিয়ে চলে যেতে চায়।
উঁহু, আমার সামনে দাঁড়িয়ে খাও।
স্যার!
লোকটি লজ্জায় মাথা নিচু করে।
খাও বলছি।
ও চিৎকার করে ধমক দেয়।
স্যার…
লোকটির চোখ ছলছল করে। ও মাথা নিচু করে মাছের কাটলেটে কামড় দেয়।
আমার দিকে তাকিয়ে খাও।
লোকটি সরাসরি ওর দিকে তাকায় এবং খেতে থাকে। এক মুহূর্তের জন্যও ওর দৃষ্টি অন্যদিকে যায় না। তখন সুজয়ের ওর অসম সাহসী বাবার কথা মনে হয়। তিনি কাজ করছেন এক নম্বর ও দুই নম্বর ঢাকেশ্বরী মিলের শ্রমিকদের মধ্যে। একটি ইউনিয়ন গড়ে তুলতে হবে তাঁর। অল্পদিনের মধ্যেই অর্ধেকেরও বেশি শ্রমিক কটন মিলস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সদস্য হয়ে গেলো। তাঁর এই সাংগঠনিক ক্ষমতা দেখে মিলের মালিকরা তো শঙ্কিত। ছুটে যায় ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে। তার কাছ থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়ে আনে যে তিনি এক নম্বর ও দুই নম্বর মিলের প্রোপার্টির ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন না। শ্রমিকদের কোয়ার্টারে যেতে পারবেন না। শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তুলতে পারবেন না। সবাই ভাবলো এখন তিনি কি করবেন? কিন্তু সাহসী মানুষটির কোনো ভাবনা ছিলো না। ঢাকেশ্বরী মিলের এলাকায় যেতে পারবেন না তো কি হয়েছে, তাই বলে তো সাংগঠনিক কাজ বন্ধ থাকতে পারে না। তিনি কখনও চিত্তরঞ্জন কটন মিলের পাশ থেকে, কখনও লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের পাশ থেকে ডিঙি নৌকা ভাড়া করে শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে চলে যেতেন ঢাকেশ্বরী দুই নম্বর কটন মিল ও এক নম্বর কটন মিলের খেয়া পারাপারের জায়গায়। সেখানে গিয়ে নৌকা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তেন জলে। সাঁতার কেটে আরও খানিকটা দূরে গিয়ে বড়ো বাঁশ পুঁতে দিতেন। দুই মিলের শ্রমিকরা খেয়া পারাপার করার সময়ে তিনি বাঁশ ধরে অনর্গল বক্তৃতা করে যেতেন। এভাবে মাসের পার মাস কেটেছে। জলে থাকতে থাকতে তিনি জলের মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়ন।
স্যার?
সুজয় চমকে ওর দিকে তাকায়। এতোক্ষণ তো ও ওর সামনে ছিলো না, ছিলো একটি ছবি- একজন অসাধারণ মানুষের অসম সাহসিকতার একটি রঙিন ছবি। জলরঙে আঁকা।
স্যার, আমি যাবো? খাওয়া শেষ।
একটু দাঁড়াও। তোমাকে আমি আমার বাবার একটা চিঠির একটুখানি পড়ে শোনাবো।
লোকটি অবাক হয়। সুজয় সেটা দেখে না। ও স্টিলের আলমারি খুলে একটি ফাইল থেকে চিঠিটা বের করে। অনেক দিনের পুরনো চিঠি। নরম হয়ে গেছে কাগজ। ও সন্তর্পণে ভাঁজ খোলে। তারপর লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা সে সময়ে আÍগোপন অবস্থায় ছিলো।
আÍগোপন কি স্যার?
সুজয় থমকে তাকায়, তারপর ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, প্রশ্ন করো না। শুনে যাও। সে সময়ে বাবার পেটে ভীষণ ব্যথা হয়। বাবার কিডনিতে পাথর হয়েছিলো। ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে বাবা এই চিঠিটি লিখেছিলো। তুমি মন দিয়ে শোন। সুজয় পড়তে থাকে : জীবন-মৃত্যুর এই সন্ধিক্ষণে নিজেকে জিজ্ঞাসা করিতেছি- আমার জীবনে কি কোনো আফসোস আছে?- আছে। তাহা হইতেছে আদর্শকে যথাযথভাবে রূপ দিতে পারি নাই। পার্টির প্রতি ভালোবাসা অটুট আছে- সব চাইতে প্রিয় পার্টি। অগাধ বিশ্বাস, আমার আশা পূর্ণ হইবেই- এই দেশেও প্রতিষ্ঠিত হইবে সাম্যবাদী সমাজ। অনাগত ভবিষ্যতের কমরেডদের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা থাকিল। আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে আমার আদর্শকে আরো শক্তিশালী করিয়াছে। তাহাদের কথা গভীরভাবে ভাবিতেছি। তাহারা আমার অপূর্ণ ইচ্ছাকে পূর্ণ করার কাজেই জীবন উৎসর্গ করিবে। তাহাদের মধ্য দিয়া আমি চিরঞ্জীবী কমিউনিস্ট বিপ্লবী হইয়া বাঁচিয়া থাকিব। অসংখ্য কমরেডের মুখ ভাসিতেছে। সবাইর প্রতি আমার বিপ্লবী অভিনন্দন থাকিল।”
কাগজটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুজয়। বুকের ভেতরে কেমন অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। লোকটি একটুক্ষণ চুপ থেকে বলে, শেষ স্যার?
হ্যাঁ, ও মাথা নাড়ে।
আপনার বাবার কি আদর্শ ছিলো স্যার?
বলেছি না প্রশ্ন করবে না।
আপনি কি সেই আদর্শ পূরণ করেছেন স্যার?
আর একটি কথা বললে তোমাকে এই বারো তলার ওপর থেকে নিচে ফেলে দেবো।
লোকটি পিছু সরতে সরতে বলে, আমার তো অনেক প্রশ্ন। আপনার বাবার চিঠির কিছুই যে আমি বুঝিনি।
সুজয় দুপা এগিয়ে গেলে ও দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায়। দরজাটা এতো জোরে বন্ধ করে যে ঘরের ভেতর ঝমঝম শব্দ হতে থাকে। ও দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর মনে হয় শব্দ বুঝি কোনো এক পুরনো কুয়ো থেকে উঠে আসছে। কুয়োর পানি সবুজ হয়ে গেছে, পচা পাতার ঘ্রাণ আসছে। দশ বছরের সুজয় দাঁড়িয়ে আছে সেই কুয়োর ধারে। খবর এসেছে যে কোনো সময় পুলিশ রেইড করতে আসবে এই বাড়ি। পালাতে হবে সবাইকে। বাবা একগাদা কাগজ দড়ি দিয়ে বেঁধে ওকে বলছে কাগজগুলো ভীষণ জরুরি। রক্ষা করতে হবে। কাগজগুলো কুয়োর ভিতরে নামিয়ে দিলাম। তুই এই দড়িটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবি। পুলিশ যদি তোর কাছে আসে, কিছু জিজ্ঞেস করতে চায় দড়িটা ছেড়ে দিবি। তেমন কিছু না ঘটলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি। মন্টু এসে এসব কাগজসহ তোকে নিয়ে যাবে।
ওকে একটা কঠিন দায়িত্ব দিয়ে সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো। ও রশিটা হাতে না রেখে জামার নিচে কোমরের সঙ্গে বেঁধে ফেলে, পাছে কোনো ভয়ে রশিটা হাত থেকে ছুটে না যায়। তারপর কুয়োর ধারে বসে লাটিম ঘোরায়, ভীষণ আনন্দে। পুলিশ ওর দিকে আসেই না। ও একা একা কতোটা সময় ছিলো ও জানে না। মাঝে মাঝে মাথাটা কুয়োর দিকে ঝুঁকিয়ে জল দেখে, পচা পাতার ঘ্রাণ টানে। আকাশ দেখে। পাখির ডাক শোনে। আলো কমতে দেখে। তখন ওর ভীষণ কান্না পায়। ও কাঁদতে থাকে। তারও অনেকক্ষণ পর মন্টু খান আসে। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, কি রে কাঁদছিস কেন? ভয় করছে?
ও কাঁদতে কাঁদতে বলে, হ্যাঁ।
তুই একটা বোকা। সাহসী বাবার ছেলেদের কি ভয় থাকতে আছে? নে বাদাম খা। বাব্বা কেমন বুদ্ধিমানের মতো রশিটা কোমরে বাঁধা হয়েছে। তুই একটা লক্ষ্মী ছেলে। চল বাড়ি যাই। কদিন তোকে আমার কাছে থাকতে হবে। সুন্দর একটা ছবির বই কিনে দেবো তোকে।
মা থাকবে তোমার বাড়িতে?
পরে আসবে।
মিথ্যে বলছো? মা আসবে না। লুকিয়ে থাকতে গেছে।
এখন চল না।
মা না থাকলে আমি থাকবো না তোমার বাড়িতে।
দেখছিস কেমন আঁধার হয়ে এসেছে। আমারও ভয় করছে।
সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি ওর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে।
তখন ও শুনতে পায় ফোনের শব্দ। একটানা অনেকক্ষণ বাজে। ও ফিরে আসে নিজের চেয়ারে। বাবার চিঠিটা ঢুকিয়ে রাখে ফাইলে। ফোনটা আবার বেজে ওঠে। অপর প্রান্তে মায়ের কণ্ঠ, কি করছিস খোকা? বাড়ি ফিরবি কখন? আজ না বৌমার জন্মদিন? আমরা বাইরে খেতে যাবো। ভুলে গেছিস?
ভুলি নি মা। আমি ভীষণ ব্যস্ত। তোমরা চাইনিজ রেস্তোরাঁয় চলে যাও। আমি নয়টার দিকে ওখানে চলে আসবো।
মায়ের উত্তর না শুনে ও ফোনটা রেখে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে ওর বিপ্লবী মায়ের কণ্ঠের রেশ জেগে থাকে ওর ভেতরে- যেন বাবা বলে যাচ্ছে একটানা কথা, এখানে নয় নারায়ণগঞ্জে বসে। বলছে, দেশের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন আনতে হলে সশস্ত্র বিপ্লব করতে হবে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে। গড়ে তুলতে হবে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন।
ফোন বেজে ওঠে। এবার ফোনের অপর প্রান্তে স্ত্রী। কণ্ঠে অভিমান, আজই তোমার কাজের চাপ পড়লো?
হ্যাঁ, মানে হঠাৎ করে…
আজ আমার জন্মদিন।
শাড়িটা কিনেছো? সবচেয়ে দামি শাড়িটা।
কিনেছি।
ওটা পরে তুমি রেস্তোরাঁয় যাও। ভালো দেখে খাবার অর্ডার দাও। আমি আসছি।
দেরি করলে কিন্তু তুমি রাতে আমাকে ছুঁতেও পারবে না।
আহ্, এভাবে বলতে হয় না। সুন্দর করে বলো কিছু। আমি তো সকালে বলেছি, আবারও বলছি, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
অপর প্রান্ত থেকে কোনো জবাব নেই। শুনতে পায় সশব্দে ফোন রেখে দেওয়ার আওয়াজ। সুজয় নিজেও রিসিভারটা রেখে দিয়ে মৃদু হাসে। আজ ওর নিজের সঙ্গে লড়াই। কেউ তা বুঝবে না। এমন মাঝে মাঝে হয়। তখন ও নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায়। কিন্তু সব সময় তা হয়ে ওঠে না।
ও আবার জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়। নিচের দিকে তাকালে মনে হয় শহরটা অনেক কাল আগের পুরনো একটি কুয়ো। পচা পাতার ঘ্রাণ আসছে ওখান থেকে। বুকের ওপর হাত রেখে নিজেকেই বলে, এখন আমি হৃদয়টা সুতোয় বেঁধে কুয়োর ভেতর রেখে দাঁড়িয়ে আছি। যে কোনো সময়ে হাত থেকে সুতোটা ছুটে গেলে ওটা টুপ করে কুয়োর ভেতরে পড়ে যাবে। নাকি আমি সুতোটা ছেড়ে দিয়েছি? হৃদয়টা আর কখনো টেনে তুলতে পারবো না। আমি সুজয় নই, সুজাউদ্দিনও নই। আমার কৈশোর নেই, শৈশব নেই। মেশিনে টানা মানুষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হাত বাড়ালে দেখতে পাই ওটা স্টিলের হাত। যা কিছু ছুঁই না কেন ওই হাতে সাড়া জাগে না। আমার স্পর্শের অনুভব লোপ পেয়েছে।
অনেকক্ষণ পরে নিজের মার্সিডিজ কারে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় শহরের কোথাও কোনো ক্ষুধার্ত মানুষ নেই।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সেলিনা হোসেন- র আরো পোষ্ট দেখুন