মানুষের ডেরায় স্বপ্নের খুঁটি

untitled-4_202849ছোট ক্যানভাসটিকে নানা রঙে ভরিয়ে তুলছে আমিনউদ্দিন। গাছের নিচে বসে আঁকা ওর প্রিয় অভ্যাস। এমন একটি অভ্যাসের ভেতরে ঢোকার দিন-তারিখের হিসাব আমিনের মনে নেই। শুধু মনে আছে, যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরলে এমন একটি চিন্তা ওর ভেতরে ভোরের অলোর মতো ছড়ায়। ক্যানভাসের

রঙের মধ্যে ফুটে থাকবে শহীদের মুখ। গ্রামের স্কুলে চাকরি করতে এসে এমন একটি ছায়াঘেরা জায়গা

পেয়ে সিদ্ধান্তটি এমনই হয়েছিল।

ও বুকভরে বাতাস টেনে চারদিকে তাকায়। তখনো সূর্য ওঠেনি। বাতাসে শীতের মৃদু আমেজ। নিজেকেই বলে, দেখ কেমন মনোরম স্নিগ্ধতা। বড় করে শ্বাস টেনে এক ফুঁয়ে জীবনটা উড়িয়ে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে। ক্যানভাসে নীল রঙের আঁচড় টেনে বলে, মৃত্যু আমার কাছে সৌন্দর্য। এই ক্যানভাসের উজ্জ্বল রঙের মতো। জলরঙে গড়িয়ে যায় আঁকাবাঁকা রেখা। ফুটে উঠতে থাকে একটি মুখের আদল।

একদিন এ দেশে যুদ্ধ হয়েছিল। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ।

আমিনউদ্দিনের বয়স তখন তিরিশের কোঠায়। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে আর মনের আনন্দে ছবি আঁকে। প্রকৃতি আর মানুষ মিলেমিশে যেন চারদিকে রং ছড়ায়। কখনো প্রকৃতির মাঝখানে বিন্দুসম মানুষ, কখনো ক্যানভাসজুড়ে শুধু একটি মুখের ওপর বিন্দুসম প্রকৃতি। এভাবে কাটছিল দিন। এক ধরনের মগ্নতা জীবনের অন্যদিক ভরিয়ে রেখেছিল। ভাবত, ঘাটতি নেই কোথাও। এমন এক গভীর সময়ে ওর সামনে তখন স্বাধীনতার ডাক। যুদ্ধ করবে বলে একদিন নদী পার হয়ে চলে গেল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। যুদ্ধ মানে তো রক্ত আর মৃত্যু। কত অসংখ্য মৃত্যু দেখতে হয়েছে। এখন সেই সব শহীদের মুখ নানা রঙে ক্যানভাসে উঠে আসে। কাউকে চিনে বা না চিনে, কেউ দৃশ্যমান, কেউ অদৃশ্য মানুষ তাতে কিছু এসে যায় না। আমিনের ক্যানভাসে শহীদের মর্যাদায় ফুটে ওঠে সব মুখ। যেসব ছেলেমেয়েকে ছবি আঁকা শেখায় তাদের কেউ কেউ মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করে, এত মানুষের মুখ আঁকেন কেন স্যার?

শহীদদের চিনতে হয় না সোনামানিকরা। ত্রিশ লাখ শহীদের মুখ বুকের ভেতর আছে। যাঁদের দেখিনি তাঁদেরও মুখ আঁকি।

আমরাও আঁকব। আমরা যদি একটা বড় ফুল আঁকি সেটা কি শহীদের মুখ হবে?

পাশের জন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে, ধুত! কেমন করে হবে? ফুল কি মানুষের মুখ!

তাহলে আমি নদী আঁকব।

আমি একটা পাকা ধানের শিষভরা ক্ষেত আঁকব। তার ওপর দিয়ে উড়ে যাবে বুলবুলির ঝাঁক।

আমি আমাদের সবার মুখ আঁকব। একটা কাগজে ছোট ছোট করে সব ছেলেমেয়ের মুখ।

ছেলেমেয়েরা নিজেরা নিজেরা কথা বলে, তখন আমিনউদ্দিন নিজের স্বপ্নের ভেতরে ডুবে যায়। স্বপ্নের ভুবন একটি যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝ দিয়ে হেঁটে যায় ও। ওর সামনে ক্যানভাস নেই। হাতে অস্ত্র। চারপাশে ধ্বংস এবং মৃত্যু। আছে বুকের ভেতরের বড় ইজেলে স্বাধীনতার বিচিত্র রং। রঙের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। চোখে দেখা রঙের বাইরেও অজস্র আলোর ফুলকি ঝলকায়। হেঁটে যেতে যেতে দেখা হয় প্যাট্রিক হেনরির সঙ্গে। আমিন হাসিমুখে স্বাগত জানিয়ে বলে, প্যাট্রিক হেনরি আপনি?

হ্যাঁ, আমি। যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাকে দেখতে এসেছি। স্বাধীনতার লড়াই সহজ কথা নয়। তুমি ইতিহাস ভালো করে জানো।

আমি জানি আপনি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া রাজ্যের শাসক ছিলেন। ব্রিটিশ উপনিবেশের শিকল ভাঙতে চেয়েছিলেন। সেইন্ট জর্জ চার্চের সমবেত মানুষের সামনে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।

হ্যাঁ, সেদিন বলেছিলাম আমাকে স্বাধীনতা দাও, নয়তো মৃত্যু।

আপনার এই সাহসী ভাষণ পড়ে আমি নিজেকে স্বাধীনতার যোদ্ধা ভাবতে শিখেছিলাম। আপনার ভাষণ আমাকে লড়াকু হওয়ার প্রেরণা দিয়েছিল।

সে জন্য এই যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাকে দেখতে এসেছি আমিনউদ্দিন।

আপনি বলেছিলেন জীবন কি এতই প্রিয়, আর শান্তি কি এতই মধুর যে শিকল আর দাসত্বের মূল্যে তাকে কিনতে হবে? আপনার এই লাইন পড়ে আমি বন্ধুদের বলতাম- না, জীবন এত ক্ষুদ্র নয়। জীবনের সীমানা বিশাল। তাকে রক্ত আর মৃত্যু দিয়ে স্বাধীনতার গৌরবে ভরে তুলতে হয়। আপনি যেদিন ভাষণ দিয়েছিলেন সেই তারিখটি আমার মনে আছে ২৩ মার্চ ১৭৭৫।

তোমাদের শুরুটাও মার্চ মাসে। তোমাদের ৭ মার্চ আছে।

ঠিক বলেছ প্রিয় বন্ধু প্যাট্রিক হেনরি। তুমি ইতিহাসের পাতায় চিরঞ্জীব থাকো।

এই মুহূর্তে আমি তোমার পাশে আছি। ছায়ার মতো আছি। সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাও বন্ধু।

তখনই শত্রুর গুলি এসে বিদ্ধ হয় মিজানুরের ঘাড়ে। ও পড়ে যায়। ওহ্, কী নিদারুণ সময় ছিল সেদিন। পড়ে যাওয়া মিজানুরের শরীর টপকে ছুটে গিয়েছিল ও। প্রবল উন্মাদনায় শত্রুর মোকাবিলা করেছিল। ওর বাহিনী পরাজিত করেছিল পাকিস্তানি সেনাদের। শত্রুর একজনও সেদিন জীবিত ফিরে যেতে পারেনি। অপারেশন শেষে মিজানুরের কাছে ছুটে এসেছিল ও। দেখেছিল, মিজানুর তখনো কাতরাচ্ছে। জ্ঞান হারায়নি। ওকে দেখে হাত চেপে ধরে বলেছিল, তুই না বলেছিলি আমাকে স্বাধীনতা দাও, নয় মৃত্যু। আজ স্বাধীনতার জন্য আমার সামনে মৃত্যু। তুই আমার মাকে খবরটা পৌঁছে দিস। বলিস, মা যেন দুঃখ না পায়। এ মৃত্যু গৌরবের।

ওকে সবাই মিলে ধরাধরি করে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যায় মিজানুর।

এখনো থেমে থেমে কথা বলা মিজানুরের কণ্ঠস্বর কানে বাজে আমিনের। ও দুই হাতে মুখ ঢাকে। মাথা ঝাঁকায়। যেন দৃশ্যটি এই মুহূর্তে ওর সামনে, এই গাছতলায়। চারপাশে ভিড় করে আছে শিশুরা। আমিনউদ্দিন গাছের কাণ্ডে পিঠ ঠেকায়। প্যাট্রিক হেনরির কণ্ঠস্বর শুনতে পায় ও- বলেছি না, স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার অর্থ দাসত্বকে মেনে নেওয়া। আমরা তেমন জাতি নই। আমাদের সামনে যুদ্ধ। আমরা তাকে বরণ করব। মরণের বরণডালায় রক্তের জীবন- আমিনউদ্দিন নিজেকেই কথা বলে টের পায় ওরা আসছে। মাটিতে ওদের ছোট পায়ের মৃদু ধ্বনি। ও মুখ থেকে হাত সরায়। দেখতে পায় কাগজ, রং-তুলি নিয়ে ওরা আসছে।

স্যার আপনি মুখ ঢেকে রেখেছিলেন কেন?

আমরা দূর থেকে আপনাকে এভাবে দেখেছি।

স্যার, আপনার কি মন খারাপ?

তোদের মতো ছেলেমেয়েরা যার চারপাশে থাকে, তার কি মন খারাপ হয় রে?

আমরা খুশি, আমরা খুশি।

ওরা হাসতে হাসতে গাছতলা ভরিয়ে তোলে। কাগজ বিছিয়ে বসে। বলে, আজ আমরা আপনার ছবি আঁকব।

কেন, আমাকে কেন?

সবার বড় তেরো বছরের সন্তু বলে, এটাও শহীদের মুখ হবে। শহীদের মুখের ছবি।

ও তাই, আঁক। যেভাবে বসে আছি সেভাবে বসে থাকব?

হ্যাঁ, থাকেন। আমরা কিন্তু যে রকম খুশি সে রকম আঁকব।

আঁকা হলে বুঝতে পারবেন আপনার মুখটা আপনার না।

তবে কার? তোদের কী মনে হয়?

সেই মুখ একজন মুক্তিযোদ্ধার।

মুক্তিযোদ্ধার! ঠিক আছে। লাখ লাখ মানুষ যুদ্ধ করেছে, তাঁদের কারো না কারো মুখের সঙ্গে মিলে যাবে।

হ্যাঁ, যাবে যাবে।

ছোটদের উৎফুল্ল কণ্ঠ ধ্বনিত হয়। আমিনউদ্দিন আনন্দে চোখ বোজে। ভাবে, এ জীবন আনন্দের, এ জীবন উচ্ছ্বাসের। তা-ই কি? আবার ওর ভাবনায় ঢুকে যায় যুদ্ধক্ষেত্র। ওর সামনে এগিয়ে আসেন আব্রাহাম লিংকন। তিনি বলছেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন ছোট করে দেখতে নাই আমিনউদ্দিন।

আপনি তো মাত্র তিন মিনিটের একটি বক্তৃতা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় উঠে এসেছেন। অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। হা-হা করে হাসেন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রের গোলাগুলির মাঝে তাঁর হাসি অমলিন থাকে। গোলার শব্দ ম্লান করে দিয়ে সে হাসি ভরিয়ে তোলে মুক্তিযোদ্ধা আমিনের বুক। ও বলতে থাকে, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গে মাত্র কয়েক দিনের গৃহযুদ্ধে আট হাজার লোক নিহত হয়েছিল। যুদ্ধের চার মাস পর তাদের স্মরণে নির্মিত হয়েছিল স্মৃতিসৌধ। তাদের স্মরণে আয়োজিত সভায় আপনি যে বক্তৃতা করেছিলেন, তা গেটিসবার্গ অ্যাডরেস নামে খ্যাত। আমি মনে করি, ইতিহাস জানা খুব জরুরি। বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতার বিকল্প কিছু নেই। আব্রাহাম লিংকন! আপনি ইতিহাসের অমর মানুষ। স্বাধীন দেশে বাস করার যে ধারণা দিয়েছেন, তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেতনায় সোনার হরফ।

আবার হা-হা হাসিতে ভরে যায় যুদ্ধক্ষেত্র। আমিন শুনতে পায় তার কণ্ঠস্বর- জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন আব্রাহাম লিংকন।

আমার প্রার্থনা- তোমরা যেন যুদ্ধে জয়ী হতে পারো। তোমাদের স্বাধীন দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের সরকার।

তখন সিলেটের ধলই সীমান্তে মুন্সী রউফ তাঁর মেশিনগান থেকে অনবরত গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছেন। পাকিস্তানি সেনারা নানা কৌশলে এগিয়ে আসছে। চারদিক ঘিরে ফেলেছে। মুন্সী রউফ অন্যদের বলছেন, আমি গুলি চালিয়ে শয়তানদের দমিয়ে রাখছি। তোমরা পিছু হটে যাও। অন্যরা পিছু হটে যায়। মেশিনগান থেকে গুলিবর্ষণ করে শত্রুদের ছিন্নভিন্ন করে; কিন্তু একসময় ওদের গোলা এসে পড়ে মুন্সী রউফের ওপর। শহীদ হন তিনি। সে জন্যই নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, স্বাধীনতা অর্জনের কোনো সহজ পথ নেই। স্বাধীনতার দাবি রক্ত আর মৃত্যু। সে জীবন দেয় আপামর জনসাধারণ। আমিনউদ্দিন চোখ খুললে দেখতে পান, ছেলেমেয়েরা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

আমিন সোজা হয়ে বসেন।

একজন ডাকেন, স্যার।

আমিনউদ্দিন ওর দিকে তাকান। ও চিন্তা করতে চায় যে ও কত দিন ধরে এই ছেলেমেয়েদের ছবি আঁকা শেখাচ্ছে। গত পনেরো বছরে অনেকে আঁকা শিখেছে। বড় হয়েছে। চলে গেছে অন্য কোথাও। আমিন ওদের স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা শুনিয়েছে। এখন ওর সামনে একদল ছেলেমেয়ে। এখন ওর সামনে সময় ১৮৬৩ সালের নয়। যখন আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা আমেরিকা মহাদেশ গড়েছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা ও জনগণের জীবনমানের সমতা। এই লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন। গৃহযুদ্ধে আমাদের শত শত মানুষ জীবন দিয়েছিল। মানুষই একটি দেশের শক্তি। তাদের পূর্ণ জীবনের অধিকার দিতে হবে।

স্যার, আপনি দেখবেন না আপনাকে কিভাবে এঁকেছি?

হ্যাঁ, দেখব তো। দাও।

ওরা একটা একটা করে ওর সামনে কাগজ দিয়ে যায়। কাগজগুলো গুছিয়ে আমিন বলে, আজ তোমাদের ছুটি।

কাল আমাদের স্কুল আছে। আপনি কি ক্লাসে স্বাধীনতার কথা পড়াবেন স্যার? আপনি কত সুন্দর করে শহীদদের কথা বলেন। আমরা সেসব গল্প নিয়ে যাই অনেকের কাছে।

নিয়ে যাও অনেকের কাছে?

হ্যাঁ স্যার, তাই তো করি। বাড়ি গিয়ে মাকে বলি সবার আগে। তারপর অন্যদের বলি।

ঠিক আছে, আগামীকাল তোমাদের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের গল্প শোনাব।

সেই সঙ্গে নেলসন ম্যান্ডেলার। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতা লাভ কঠিন। কোনো সহজ পথে স্বাধীনতা হয় না।

ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বলে, কোনো সহজ পথে স্বাধীনতা হয় না।

এই কথাটা বলতে বলতে তোমরা বাড়ি চলে যাও।

যদি আমরা গানের সুরের মতো টেনে টেনে বলি।

বলো, সে তো আরো ভালো।

ওরা চলে যেতে থাকে। দুজন ফিরে এসে বলে, বাড়ি যাবেন না স্যার?

তোমরা যাও। আমি একটু পরেই যাব। পরক্ষণে ভাবে, ওদের বাড়ি যেতে বলা সহজ। নিজেকে বলা সহজ নয়। কখনো ঘর ওকে টানেনি। নিঃসঙ্গতার বোঝা বুকের মধ্যে পর্বত সমান। বেঁচে থাকার আনন্দ-বেদনা যুদ্ধদিনের স্মৃতি। যুদ্ধক্ষেত্র, শত্রুর পরাজয়, আহতদের আর্তনাদ, শহীদের…। এখানে ঘর নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে ঘর থাকে না, ঘরের স্বপ্ন থাকে। আমিনউদ্দিন ওদের চলে যাওয়া দেখে।

ওরা চলে গেলে আমিনউদ্দিন নিজের ক্যানভাসের দিকে তাকায়। ওখানে কি সোহেলির মুখটা ফুটে ওঠে কখনো? যাকে ও স্বাধীনতার পর কামালপুরের বাংকার থেকে উদ্ধার করেছিল। মেঘালয়ের বর্ডারে বিধ্বস্ত সোহেলি ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি কোথায় যাব? আমিনউদ্দিন বলেছিল, আপনার বাড়িতে। উদভ্রান্ত সোহেলি বলেছিল, মৃত্যু কি খুব কঠিন? আপনার রাইফেলে গুলি আছে? আমিন চুপ করে থাকলে সোহেলি আবার বলেছিল, একটি গুলি খরচ করুন আমার জন্য। আমি তো জানি আমার বাড়ি নেই, দেশও নেই। আমি কোথাও যাব না।

আমিন গম্ভীর স্বরে বলেছিল, আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব।

আপনার বাড়িতে? কে আছে?

মা-বাবা, ভাইবোন সবাই আছে। আমি বিয়ে করিনি।

তারা আমাকে মানবে?

মানবে না। আমি মানাব। আমি আপনাকে ভালোবাসা দেব। আপনি তো দেশের জন্য নিজের সব কিছুই দিয়েছেন।

আপনিও যুদ্ধ করেছেন। যা কিছু ঘটেছে তার জন্য আপনার নিজের কোনো দায় নেই। দায় এই জাতির।

সেদিন প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সোহেলি।

আমিনের খুব ইচ্ছা হয়েছিল ওকে গভীর মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু চারপাশে লোক জমে যাওয়ায় সে কাজটি করা হয়নি। একজন ভারতীয় ক্যাপ্টেনকে অনুরোধ করে তার জিপে সোহেলিকে নিয়ে এসেছিল ময়মনসিংহে। ও কিছুতেই ওর বাড়ির ঠিকানা বলেনি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালায় ওকে রাখা হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে ও পালিয়ে গিয়েছিল। পরদিন ওর লাশ পওয়া গিয়েছিল ব্রহ্মপুত্র নদে।

এখনো সোহেলির মুখ ওর ক্যানভাসের একটি বড় জায়গা। ও মনে করে, সোহেলি শহীদ। স্বাধীনতার জন্য যা দেওয়ার তার সবটুকু দিয়েছে। কিছুই বাদ রাখেনি ও। সোহেলির মৃত্যু ক্যানভাসে মৃত্যুর সৌন্দর্য।

ঘরের অলো নিভে যায়। ও বুঝতে পারে লোডশেডিং। ঘরে কেউ কোথাও নেই। ক্যানভাসজুড়ে আঁকা হয়েছে একজন মানুষের রক্তাক্ত শরীর। তিনি কি আব্রাহাম লিংকন নাকি মার্টিন লুথার কিং নাকি বঙ্গবন্ধু? আমিনউদ্দিন চার্জার লাইট জ্বালিয়ে ঘরের আলো ফিরিয়ে আনে। ও জানে, আজ ৭ মার্চ। ১৯৭১ নয়। ২০১৫। স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য। একদিকে বঙ্গবন্ধুর জলদ গম্ভীর কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছে উদ্দীপিত ভাষণ।

সে রাতে ঘরে আর বিজলি বাতি জ্বলল না। আমিন আঁকাজোকা বন্ধ রেখে আলমারির ড্রয়ার থেকে যত্ন করে রাখা চিঠিটি বের করে। মাত্র তিনটি লাইন লিখেছিল সোহেলি : প্রিয় মুক্তিযোদ্ধা, আমি যাচ্ছি। আপনার হৃদয়ের সবটুকু আমি পেয়েছি। স্বাধীনতার এই ভালোবাসা নিয়ে আমি আর দুচোখ ভরে এই দেশটা দেখব না। ইতি সোহেলি। চিঠিটি বুকের ওপর রেখে শুয়ে থাকে আমিন। ঘুম আসে না। দুচোখ ভরে অন্ধকার ভালোবাসার প্রগাঢ় অনুভূতি দেয়। এই মুহূর্তে অন্ধকার ওর কাছে আলোর চেয়ে বেশি। ওর মনে হয়, বঙ্গবন্ধু এই ঘরেই আছেন। বুকে গুলি নিয়ে মানুষের স্বপ্নের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। কোথাও যাননি। ক্যানভাসে ফুটে আছেন।

পরদিন অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডের ক্রিকেট মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলে অধিনায়ক যখন নিজেদের বিজয়কে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করেন, তখন আমিনের মনে হয় ও সোহেলির হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। ওরা এখন অস্ট্রেলিয়ার পথে। আমিন সোহেলিকে বলছে, দেখো ওরা বাংলাদেশকে কোথায় উঠিয়েছে। একদম আকাশের কাছাকাছি। তোমার-আমার যুদ্ধটা এ রকমই ছিল সোহেলি। আমরা পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশ যুক্ত করেছি। ওরা আমাদের মনে করছে। তোমার-আমার যুদ্ধকে। চলো ওদের খেলার মাঠ থেকে ঘুরে আসি। মুক্তিযোদ্ধা সোহেলি তোমার হাতটা বাড়াও। আমি ধরি।

আমিনউদ্দিনের কানে ভেসে আসে উল্লাসধ্বনি। ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে দৌড়াচ্ছে। দুচোখ ভরে ওদের আনন্দ উপভোগ করে ও। নিজের দুই হাত বুকের ওপর চেপে রাখে। শুনতে পায় বিশ্বনেতাদের কণ্ঠস্বর। সবাই মিলে বলছেন, উই হ্যাভ আ ড্রিম …। আমিনের দুচোখ জলে ভরে যায়। বাংকার থেকে বেরিয়ে আসা সোহেলি ওর সামনে। চারদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে বিজয়ের ধ্বনি। ওর ক্যানভাসে বিমূর্ত একাত্তর।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সেলিনা হোসেন- র আরো পোষ্ট দেখুন