দেবদাস

ফেব্রুয়ারি মাসে দেবদাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফিরে এলেন। দেশ স্বাধীন, কিন্তু দেবদাস নির্বাক। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগ দিলেন না। সহকর্মীরা বলছেন কাজে যোগ দিতে। বাংলার অধ্যাপক বললেন, ‘আগে কাজে যোগ দিন, তারপর অন্য কথা।’
দেবদাস উল্টো প্রশ্ন করে বসলেন, ‘কী হবে কাজে যোগ দিয়ে!’
না, এটি উত্তর নয়। নিজের সঙ্গে নিজের সওয়াল-জবাব। আপন মনে কথা বলা। অথবা আত্মগত ভাবনা। অথবা নিজেকেই প্রশ্ন হয়ত।
সহকর্মীরা দেবদাসের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু বুঝতে পারছেন না, কারণ তিনি তো দেবদাস নন, তিনি দেবদাস হতে যাবেন কেন? তাঁর নাম তো অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, অঙ্কের গুণী অধ্যাপক, সবাই তাঁকে চেনেন। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে বলে তিনিও কি বদলে যাবেন? মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের বেতন পর্যন্ত নেননি, অথচ বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোথায় কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কী যেন হারিয়ে ফেলেছেন।
কী হারিয়েছেন? স্মৃতি? মেধা? মনন? মুক্তিযুদ্ধের আগের দেশ? জন্মভূমি!
বেশিক্ষণ কথা বলতেও কষ্ট। প্রবল জ্বরের বিকারে সব হারিয়ে বসে আছেন কি!
পাক বাহিনীর অসহ্য নির্যাতনে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান হয়ে গেলেন দেবদাস। প্রতিদিনের মতো ২৫ মার্চের রাতেও বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে আড্ডা দিচ্ছিলেন সহকর্মীদের সঙ্গে। সারা দেশ উত্তপ্ত, কখন, কোথায় কী ঘটছে কেউ বলতে পারে না। রাত যে বেড়ে চলেছে সে খেয়াল নেই, কত গভীর হয়েছে তাও মালুম নেই। দেয়ালঘড়িটাও যেন দেয়ালের ঠিক জায়গায় নেই। অন্যদিনের মতো টিকটিকির ডাকটাও কেউ শুনতে পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পেঁচারাও ডেকে প্রহর ঘোষণা করেছে কিনা কেউ জানে না। কে যে আবার চায়ের ফরমাস করেছে সে খেয়ালও নেই। চা এলো।
রাত গভীর হয়ে গেছে। যাঁদের সঙ্গে মুজিবুর রহমান গল্প করছিলেন তাঁদের অনেকেই হিন্দু, অধ্যাপক। এরই মধ্যে সারা দেশে যে সামরিক আঁতাত ও নির্যাতন শুরু হয়ে গেছে কারও তা অজানা নেই। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানে যে বাড়তি সৈন্য এনে জমা করা হচ্ছে তাও জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। সব ক্যান্টনমেন্টের বাঙালী সৈন্যরা জেনে গেছে। গভীর রাত। সে হুঁশ ক্লাবের কারও নেই। কেউ যেন সকলকে সম্মোহিত করে দিয়ে গেছে অলক্ষে।
একদল লোকের সামরিক বুটের শব্দে সবাই আঁতকে উঠলেন। পিলে চমকানোর মতো। যেন প্রত্যেকেই জানতেন, অথবা শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে সবাই জেনে ফেললেন ওরা কারা। কয়েকজন পাক সৈন্য ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে ক্লাবঘরে। আধ্যাপকরা এখনও বসে আছেন। কোনওরকম রীতিনীতি, ভদ্রতার তোয়াক্কা না করে সোজাসুজি প্রশ্ন শুরু করে দিল মিলিটারিরা।
‘তোমার নাম কী?’
‘বশির আহমদ।’
আর একজনকে প্রশ্ন করল, ‘তোমার নাম?’
‘মোহাম্মদ নিজামউদ্দীন।’
‘তোমার?’
‘আফতাব আহমদ।’
হিন্দু অধ্যাপকগণ এভাবে নিজেদের পরিচয় দিলেন।
কিন্তু মুশকিলে পড়লেন অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। তিনি নিজেকে নিজের নামে পরিচয় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলিটারিরা তাঁর ওপর শুরু করে নির্যাতন। বেশ কিছুক্ষণ চলল অকথ্য নির্যাতন। তাঁর একমাত্র দোষ বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে তাঁর নামের মিল। যতক্ষণ তারা নির্যাতন চালালো ততক্ষণ গালাগালি দিয়ে চলল বঙ্গবন্ধুকেও।
ঝড় বয়ে চলল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে। কিন্তু ঘুরে গেল চাকা। ৪ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা হানাদারের হাত থেকে মুক্ত করে নিল। উল্লাসে ফেটে পড়ল মানুষ।
আবার ঘুরে গেল ইতিহাসের চাকা। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর সংঘবদ্ধ আক্রমণের মুখে টিকতে পারল না মুক্তিযোদ্ধারা। ট্যাঙ্ক, কামান, মর্টার ও মেশিনগানের সম্মিলিত আক্রমণে রাজশাহীর পতন হলো। সেদিন ছিল অপয়া ১৩ এপ্রিল। শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানীদের ঠা-া মাথায় কুখ্যাত হামলা। গণহত্যা ও গণনির্যাতন। শিশু, যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কারও রেহাই নেই। হেন কুকর্ম নেই যা তারা করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিষয়ক অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমদ্দারকে নির্মমভাবে হত্যা করল। সেদিন ছিল ১৪ এপ্রিল। ১৫ এপ্রিল আরও নির্মমভাবে হত্যা করল অঙ্কের অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে। তাঁর মৃতদেহ খুঁজেই পাওয়া যায়নি। সুখরঞ্জন সমদ্দারের মৃতদেহের অংশবিশেষ খুঁজে পাওয়া যায় কাজলা গ্রাম থেকে।
মুজিবুর রহমান থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে। ২৫ মার্চের রাতের সেই অমোচনীয় স্মৃতির ভারে তিনি নিজেকে নিয়ে খুব অসহায় বোধ করছিলেন। তাঁর প্রিয় হিন্দু বন্ধুরা সবাই চলে গেলেন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে। তাঁরা বলেছিলেন সঙ্গে যেতে। তিনি পারলেন না, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। জীবনটা হঠাৎ অর্থহীন হয়ে উঠল। ভাবতে ভাবতে ক্রমেই যন্ত্রণা বেড়ে চলল। মানসিক যন্ত্রণা চেপে ধরতে লাগল। বন্ধুরা চলে যাওয়াতে আরও অসহায় বোধ করতে লাগলেন। পাক বাহিনী ধর্মের নামে যে পন্থা অবলম্বন করে চলেছে তাতে তিনি ধর্মের ওপর আস্থা হারাতে বসেছেন। অথচ তিনি একজন খাঁটি মুসলমান ও খাঁটি মানুষ। পাকিস্তানীদের অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে দেখে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়লেন, বিশ্বাসহীন হয়ে গেলেন। ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন অন্যায়-অত্যাচারে।
১০ মে ১৯৭১ সাল। তিনি নিজেকে মুজিবুর রহমানের বদলে ‘দেবদাস’ বলে ডাকলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে লিখিত জানিয়ে দিলেন। এরপর থেকে তাঁকে দেবদাস নামে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানালেন। এই নামে তিনি পরিচিত হয়ে যেতে চান।
‘আমি দেবদাস, আমি দেবদাস, আমি দেবদাস।’
পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ঘটনাটি জানতে পায়।
১২ মে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা অধ্যাপক দেবদাসকে গ্রেফতার করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনের দোতলার একটি ছোট কক্ষে তাঁকে রাখা হয়। এখানে তাঁকে সাধারণ পাকি সৈন্যরা নিয়মিত অকথ্য অত্যাচার করতে থাকে। তাঁর সারা গায়ে, মাথায় বুটের লাথি মারা হতো। দিনে কয়েকবার, কয়েক দফা। ‘দেবদাস ক্যায়সা হায়, ক্যায়সা মালুম’ বলে ঠাট্টা করে আর নির্যাতন চালায়। প্রতিদিন খেতে না পেলেও মার খেতে পেতেন অঢেল, পদ্মার ঢেউয়ের মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সহকর্মী বন্ধু তাঁকে সাহায্য করতে যায়নি বলে তিনি জানান। শুধু দেবদাস নামটি তাঁকে সহানুভূতি বা সাহস জুগিয়েছে। এই একটি বিষয় তাঁর খুব ভাল মনে থাকে, ‘আমি দেবদাস, আমি দেবদাস।’
অতিথি ভবন তখন ছিল পাকি সামরিক অফিসারদের অফিস। দেবদাস দেখতে পান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিদের সহযোগী ড. বারী, ড. মকবুল হোসেন ও ড. মতিউর রহমান সামরিক অফিসারদের কাছে যাতায়াত করে। আর দেবদাস সাধারণ সৈন্যদের পায়ের নিচে পড়ে পড়ে প্লাবনের মতো মার খেয়ে চলেন।
এগারো দিন ধরে দেবদাস মার খেয়ে চলেন নিয়মিত। কিন্তু নিয়মিত খাওয়া জোটেনি। এখন অনেক কিছু দেবদাসের মনে নেই, কিন্তু অত্যাচারের কথা মনে আছে ‘আমার সোনার বাংলা’র মতো। অনেক ঘটনার কথা আর মনে করতে পারেন না। কিন্তু ‘শূন্য’ আবিষ্কার কে করেছেন মনে আছে। পিথাগোরাসের উপপাদ্যের কথা মনে আছে, কিন্তু সহকর্মীদের নাম ঠিকমতো মনে করতে পারেন না। কেউ সাহায্য করল না তা রাত্রির মতো সত্যি।
নির্যাতন ও নির্যাতনের স্বপ্নে সমৃদ্ধশালী দেবদাসকে এগারো দিন পরে পাবনায় নিয়ে যাওয়া হয় সামরিক গাড়িতে করে। তিনি দেবদাস এবং একজন উন্নতমানের অত্যাচার-সহিষ্ণু অধ্যাপক। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী সালেহ আহমদকে।
পাবনায় শুরু হলো পাকি সামরিক অফিসারদের দফায় দফায় প্রশ্ন। এখানে দেবদাস বেঁকে বসলেন, অন্যায়-অত্যাচার মাথা পেতে নিতে অসম্মতি জানালেন। ‘আমি দেবদাস, আমি অধ্যাপক, আমি অন্যায় মানি না।’ তাই সামরিক প্রহরায় নিয়ে গেল নাটোরে। সেখানে ঠাঁই হলো পুলিশ লাইনে। এখানে দীর্ঘদিন কাটল সমৃদ্ধ অত্যাচারসহ। রাত্রির মতো নিঃসঙ্গ। সহিষ্ণু। অনমনীয় দেবদাস।
এ সময় থেকে তাঁর মনোজগতের আর এক পরিবর্তন হলো। এসব অত্যাচারের কথা তিনি আর তেমন করে বললেন না কাউকে। দেবদাসের মতো শুধু সহ্য করতে লাগলেন, করে যাবেন। ওসব কথা কাউকে বলে কী লাভ!
তারপর ভেবে নিয়ে বলেন, ‘ওরা আমার সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহার করেছেন।’ তারপর চুপ।
অর্থাৎ তাঁর স্মৃতির ভাঁড়ার বিস্মৃতিতে সমৃদ্ধ হয়ে গেছে। জীবনের মতো সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। অঙ্কের সমাধানের মতো সবকিছু একের পর এক অনিবার্যভাবে আসে না। হঠাৎ হঠাৎ গোল পেকে যায়। সরল অঙ্কের মতো, কিন্তু কঠিন।
নাটোরে একটি ছোট কামরায় তিন মাস বন্দী করে রাখা হয়। বনের দুর্লভ পাখিকেও যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য খাঁচায় পুরে রাখা হয়। শুরু হয়ে গেল সেই পরীক্ষা, মুজিবুর রহমান নামক গিনিপিগের ওপর। এ সময় তাঁকে অনবরত একই প্রশ্ন করা হয়। সব প্রশ্ন তাঁর মনে নেই। স্মৃতির মণিকোঠা সময়মতো খোলা ও বাঁধা যায় না। দু-চারটি মনে আসে। বাকিগুলো হারিয়ে গেছে অতীতের সুদিনের মতো।
‘আপনাকে ছেড়ে দিলে আপনি কি কাজে যোগ দেবেন?’
তার স্পষ্ট জবাব, ‘তোমাদের স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে আমি কাজে যোগ দিতে রাজি নই।’
দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘আওয়ামী লীগকে বাতিল করা সম্পর্কে তোমার মতামত কী?’
‘আওয়ামী লীগ ছয় দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। সুতরাং আওয়ামী লীগকে বাতিল ঘোষণা করতে হলে নির্বাচনের আগেই তা করা উচিত ছিল। নির্বাচনের পরে তাকে বাতিল ঘোষণা করা যায় না। সে অধিকার জনগণ তোমাদের দেয়নি, কাজেই এটা করা মোটেই যুক্তিসঙ্গত হয়নি।’
তৃতীয় প্রশ্ন, ‘পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হলে ভারত একে দখল করে নেবে কিনা?’
ভারতের পাশে, পৃথিবীর বহু বড় বড় দেশের পাশে ছোট ছোট স্বাধীন রাষ্ট্র রয়েছে। বার্মা, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ ও নেপালের মতো রাষ্ট্র রয়েছে স্বাধীনভাবে। ভারত তাদের যদি দখল না করে থাকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তাকে দখল করবে না।
তাঁর মনে নেই বন্দী পাখিও জন্ম থেকে প্রতিদিনের গাওয়া মুখস্থ গান ভুলে যায়।
এখানে বন্দী জীবনে দেবদাসকে খাবার দিয়ে যেতেন এক বাঙালী বাবুর্চি। তিনি বাইরের জগতের খবর এনে দিতেন। আর দিতেন সিগারেট। অন্ধকার বর্তমান-ভবিষ্যতে ওইটুকু ছিল আশার আলো। ধ্রুবতারা। আর নাটোরের ছোট দারোগা ছিলেন বাঙালী। তিনি মাঝে মাঝে গোপনে দেখা করে যেতেন। শুধু ধৈর্য ধরতে বলতেন। মুক্তিযুদ্ধ জোরদার হয়ে উঠছে বলে আশ্বাস দিতেন।
দেবদাস এখানে রাজশাহী ও পাবনা থেকে কিছুটা ভাল ছিলেন। পাকিদের সরাসরি হাত থেকে একটু রেহাই ছিল। জেলখানা বলে এই সামান্য আড়াল-আবরু পাওয়া যেত। অন্যান্য কয়েদি-বন্দীদের গলা শোনা যেত। দু-একজন বাঙালী গার্ডের মুখ দেখতে পেতেন। একটু হাওয়া ঢুকে পড়ত দরজা দিয়ে। পাখির ডাকও ঢুকে যেত। ভয় নিয়ে প্রথম স্বপ্ন দেখলেন এখানে। তবুও তো সবকিছু হারানোর মাঝে একটি কিছু জুটল! ভয়কেইবা আর ভয় কী!
জেলখানার পাশের এক বাসায় আনোয়ার নামে এক ছাত্র ছিল তাঁর পূর্ব পরিচিত। আনোয়ার জানতে পেরে গোপনে তাঁর সঙ্গে দেখা করল। প্রিয় অধ্যাপকের খবর সে পৌঁছে দিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং গ্রামের বাড়িতে। অধ্যাপক বা শুধু দেবদাস কি একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলতে পারলেন?
দুঃখে-সুখে মেশা বুকের দমকে বের করে দিয়ে। নিশ্বাস ফেলে। প্রাক্তন ছাত্রকে দেখে।
মনে পড়ে গেল আবার, ‘দেবদাস, দেবদাস।’
তিন মাস কেটে গেল নাটোরে। বনলতা সেন পড়া অধ্যাপকের কখনও মনে পড়েনি এখানকার বনলতা সেনের কথা। ছাত্রছাত্রীদের কথাও কম মনে পড়ে। চকিতে কখনও স্মৃতির জানালা দিয়ে উড়ে চলে যায়। ধরে রাখার কোনও চেষ্টা করেন না। কোনকিছু মনে করারও চেষ্টা করেন না। যেন ভাবনা-চিন্তাহীন অনন্ত আকাশের ব্ল্যাকহোল তিনি।
তিন মাস পরে ৫ সেপ্টেম্বর। নাটোরের জেলের দরজা খুলে গেল। মুক্ত করে দেয়া হলো অধ্যাপক মুজিবুর রহমানকে। মুক্তি! কে কাকে মুক্তি দিল!!!
কিন্তু দেবদাস!
তিনি জয়পুরহাটে চলে গেলেন। সেই কৈশোর-যৌবনের জয়পুরহাট আর কোথাও খুঁজে পান না তিনি। বোনের বাড়িতে উঠলেন। পূর্ব স্মৃতিরাও আগের মতো ধরা পড়ে না। পাখিরাও আগের মতো গায় কিনা, মেলাতে পারেন না। শুধু কাকেরা দলবদ্ধ, হৃষ্টপুষ্ট আছে মনে হলো। বোনের বাড়ির আশপাশে আগে অনেক কুকুর দেখেছিল বলে আবছা মনে পড়ে। আচ্ছন্নতায় দিন কেটে যায়। ঘোরগ্রস্ত।
জয়পুরহাট কোন তারিখ হানাদারমুক্ত হয়েছে মনে পড়ে না। ১৬ ডিসেম্বরের কথা মনে আছে। তাঁর বোন স্বাধীনতার কথা, বিজয় দিবসের কথা বলতে বলতে কেঁদে দিয়েছে স্পষ্ট মনে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের আনন্দের ফাঁকা গুলির আওয়াজে পাখিরাও ডেকে উঠেছিল মনে আছে। কিন্তু কী কী মনে আছে তা মনে নেই।
ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি চলে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। কোথায় সেই ফেলে যাওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়! এপ্রিল এসে গেল, কোথায় বিশ্ববিদ্যালয়!!
কাজে যোগদানের জন্য তাঁকে প্রশ্ন করলে হেসে বলেন, ‘কী হবে কাজে যোগ দিয়ে।’ জ্বরে ভোগেন মাঝে মাঝে। মাথায় গোলযোগ দেখা দিয়েছে। অসুস্থতা গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের বেতনও নেননি। বলেন, ‘কী হবে কাজে যোগ দিয়ে।’ হয়তো নিজেই বুঝতে পেরে গেছেন, পড়াতে পারবেন না জেনে গেছেন। অথবা কিছুই বুঝতে পারেন না। চিকিৎসাও হয় না। ‘দেবদাস, দেবদাস!’
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান নিজেকে দেবদাস বলে পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।
আমি দেবদাস, দেবদাস!’
[একটি সত্য কাহিনী]