মেথর
‘আপনারা কী জাত?’ খাওয়া-টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যানার্জিগিন্নি জিজ্ঞেস করলেন।
এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন ঠিক করতে পারলেন না নিতাইবাবু। ফ্যালফ্যাল করে ব্যানার্জিগিন্নির দিকে তাকিয়ে থাকলেন শুধু।
বাংলায় অধ্যাপনা করেই দিন ফুরাচ্ছিলেন নিতাই রাজবংশী। আজকাল ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে কতটুকুই বা আর বিদ্যে লাগে।
কর্ণফুলীর পার দিয়ে এক বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ আবার পড়তে ইচ্ছে জাগল নিতাইবাবুর।
‘পদ্মানদীর মাঝি’র পর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পড়লেন। বিভাগীয় প্রধান আলাউদ্দিন সাহেব বললেন, “জেলেজীবন নিয়ে সমরেশ বসুর একটা উপন্যাস আছে, ‘গঙ্গা’। পড়েছেন?”
নিতাই রাজবংশী ‘গঙ্গা’ পড়লেন। এসব বইয়ে স্বজাতের রূপায়ণ দেখে তিনি উদ্দীপিত হলেন। এক রাতে ঠিক করলেন, জেলেদের নিয়ে তিনি একটা উপন্যাস লিখবেন। সমুদ্রপারের জেলেদের নিয়ে লিখলেন ‘জলখণ্ড’। জনপ্রিয়তা পেল উপন্যাসটি। এরপর দুই-তিন-চার করে বেশ কটি উপন্যাস লিখলেন। নামকরা কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেলেন নিতাই রাজবংশী।
বহু বছর ধরে বরিশালে জীবনানন্দ মেলা নামে উৎসব হয়ে আসছে। উৎসব উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে প্রতিবছর একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিককে জীবনানন্দ মেলা পুরস্কার দেওয়া হয়। এ বছর নিতাই রাজবংশী এই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। নিতাইবাবু স্ত্রী এবং একমাত্র ডাক্তার পুত্রকে নিয়ে পুরস্কার গ্রহণ করতে বরিশালে এসেছেন। কুয়াকাটার সূর্যাস্ত দেখার বাসনাটা মনে লুকিয়ে নিয়ে সপরিবারে বরিশাল এসেছেন নিতাইবাবু।
অনুষ্ঠানাদি চুকে যাওয়ার পর মনোবাসনার কথা তপংকর চক্রবর্তীকে জানালেন তিনি। তপংকরবাবু উৎসব কমিটির সেক্রেটারি। শুনে তপংকরবাবু বললেন, ‘একটা কার ভাড়া করি। কাল সকালে রওনা দেব। দেখেটেখে রাতে ফেরত আসা যাবে। আর হ্যাঁ, দুপুরের খাবারের চিন্তা করবেন না। একেবারে সমুদ্রপারে আমার এক আত্মীয় থাকেন, মিহির ব্যানার্জি। ছোটখাটো ব্যবসা করেন। ওঁকে ফোন করে দিচ্ছি। দুপুরে ওঁর বাড়িতেই খাব আমরা। ’
বেশ উত্ফুল্ল মন নিয়ে হোটেলে ফিরলেন নিতাইবাবু। গিন্নিকে বললেন, ‘কুয়াকাটা যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। শুধু সকাল সকাল রওনা দিতে হবে। ’ তারপর ছেলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি উঠিস বাপ। ’ প্রত্যুষ মৃদু হেসে বাবার দিকে তাকাল।
হালকাভাবে সমুদ্রপার একবার দেখে এসে দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন নিতাইবাবুরা। তপংকর চত্রবর্তী বললেন, ‘কুয়াকাটার সৌন্দর্য বিকেলে। সূর্য ডোবার আগে আগে। কুয়াকাটার বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্র থেকে সূর্য ওঠা আর সমুদ্রে সূর্য ডোবা দেখা যায়। খাওয়া শেষ করেই কিন্তু আমরা জলের ধারে চলে যাব। ’
অনেক ধরনের মাছ রান্না করেছেন ব্যানার্জিগিন্নি। পৃথুলা শরীর তাঁর। কপালজুড়ে সিঁদুর। দুই হাতে মোটা শাঁখা। মিহির ব্যানার্জি থাকতে পারেননি। স্ত্রীর ওপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে তিনি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চলে গেছেন। উঠানের এক কোনায় মাঝারি আকারের মন্দির। সেখানে অষ্টধাতুর নারায়ণ যুক্ত। পুজো সেরে রান্না শেষ করতে করতে গলদঘর্ম অবস্থা ব্যানার্জিগিন্নির। এই অবস্থায় পাতে পাতে খাবার পরিবেশন করতে করতে প্রশ্নটি করেছেন ব্যানার্জিগিন্নি।
নিতাইবাবু এই বাড়িতে ঢুকেই বুঝে গিয়েছিলেন, এ বড় ছুঁতমার্গীয় পরিবার। ব্যানার্জিগিন্নির আচরণ, চোখ-মুখের হাবভাব দেখে নিতাইবাবুর মনে হয়েছে, এ বাড়ির বাতাবরণ কী রকম কী রকম কেন!
নিজেকে সামাল দিয়ে একটা ঢোক গিললেন নিতাই রাজবংশী। হাতের ভাত পাতে রেখে একবার স্ত্রীর দিকে, আরেকবার পুত্রের দিকে তাকালেন তিনি। দেখলেন স্ত্রী খাওয়ায় মগ্ন, ছেলের সারা মুখে বিষণ্নতা। নিতাইবাবু ব্যানার্জিগিন্নিকে উদ্দেশ করে মৃদু স্বরে বললেন, ‘হিন্দু! হিন্দু আমরা। দেখছেন না আমার স্ত্রীর হাতে শাঁখা, কপালে সিঁদুর। ’
‘তা তো বুঝলাম, কিন্তু জাতটা কী?’ ভ্রু কুঁচকে আবার জিজ্ঞেস করলেন ব্যানার্জিগিন্নি।
নিতাই রাজবংশী যদি এখন বলেন, আমরা জেলে, তাহলে লঙ্কাকাণ্ড ঘটাবেন ব্যানার্জিগিন্নি, তাঁর চোখ-মুখ তা-ই বলছে। স্ত্রী-সন্তানের সামনে বড় একটা অপমানের অবস্থা সৃষ্টি হবে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় যাকে বলে, সে রকম অবস্থাই হলো নিতাইবাবুর।
এই অবস্থায় তপংকর চক্রবর্তী অগতির গতি হয়ে বললেন, ‘বউদি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ওঁরা কায়স্থ। ’
আধা বোঝা আধা না-বোঝার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ষাট ছুঁই ছুঁই ব্যানার্জিগিন্নি বললেন, ‘ও আচ্ছা!’ তারপর নিতাইগিন্নির পাতে আরেকটা মাছের টুকরা তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘খান, খান বউদি। যত্ন করে রেঁধেছি। ’
সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। সমুদ্রকিনারা থেকে সবাই ফিরে এসেছে। হাত-মুখ ধুয়ে সবাই ফেরার জন্য প্রস্তুত। ব্যানার্জিগিন্নি মন্দিরে নারায়ণপুজোয় ব্যস্ত। একে একে সবাই ব্যানার্জিগিন্নির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল।
সবার শেষে নিতাই রাজবংশী ব্যানার্জিগিন্নির কাছে এগিয়ে গেলেন। ব্যানার্জিগিন্নি তখন ঘণ্টি বাজিয়ে নারায়ণের আচমনে মগ্ন।
পেছন থেকে নিতাইবাবু বললেন, ‘বউদি, দুপুরে খাওয়ার সময় আমরা কী জাত জানতে চেয়েছিলেন না?’
নিতাই রাজবংশী বললেন, ‘আমরা জাতে মেথর। ’ বলেই উল্টাদিকে ফিরলেন নিতাইবাবু।
ব্যানার্জিগিন্নির হাত থেকে ঘণ্টি পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনলেন কি নিতাই রাজবংশী? ফিরে তাকানোর ইচ্ছে করল না তাঁর।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের যুধিষ্ঠির ‘অশ্বত্থামা হতঃ ইতি গজ’ বলে যে মিথ্যে কথাটি বলেছিলেন, তাতে তাঁর বিরাট রাজনৈতিক কায়দা হয়েছিল, কৈবর্ত নিতাইবাবু নিজেকে মেথর বলে পরিচয় দিয়ে যে মিথ্যেটি বললেন, তাতে তাঁর মনের বেদনা কমল।
কোনো কোনো রাইতে
‘ভাবি, কান ছাড়েন। কান ছাড়েন। ব্যথা পাইয়ের ত। ’
‘তোর কান না মোচড়াই কার কান মোচড়াইয়ম! ভিজা গায়ে ল্যাংটাপোন্দা তুই উডানর মাইঝে তুরুত তুরুত নাচঅরে কীয়ল্লাই? লজ্জা-শরম গিলি খাইছস নিরে তুই?’
ভাবির শেষের কথাটি শুনে থমকে দাঁড়াল কবির। তবে তা সামান্য সময়ের জন্য। তারপর হিহি করে হাসতে শুরু করল। তারপর আগের চেয়ে দ্বিগুণ জোরে লাফাতে লাগল।
একজন মিয়ার দুই ছেলে। সগির আর কবির। সগির জন্মাবার পনেরো বছর পর কবির জন্মায়। তফজল মিয়া সম্পন্ন চাষি নয়। তবে যা জমিজিরাত আছে, তার ফসল-ফলন দিয়ে ভালোভাবেই চলে তফজল মিয়ার সংসার। নিজ হাতে ক্ষেতখামার করে তফজল মিয়া। গোটা দিন ক্ষেতেই পড়ে থাকে সে। হুমাইরা খাতুন দুই হাত দিয়ে সংসার সামলায়।
সগির জোয়ান হয়। তার মাথায় ভূত ঢোকে, বিদেশে যাওয়ার ভূত। কিন্তু বিদেশে যাওয়া তো সহজ ব্যাপার নয়। বিদেশে মানে দুবাই, কাতার, কুয়েত, সৌদি। ওখানে যেতে পাসপোর্ট লাগে, ভিসা লাগে। চাকরি করার জন্য লাগে এনওসি। সগিরের দৌড়ঝাঁপের অন্ত থাকে না। শেষ পর্যন্ত এক ট্রাভেল কম্পানি আশ্বাস দেয়। বাপকে তোষামোদ-খোষামোদ করে এক কানি ধানি জমি বেচিয়ে কুয়েত যায় সগির। যাওয়ার আগে মা আবদার করে, বিদেশ যাওয়ার আগে বিয়ে করতে হবে সগিরকে।
সগির এককথায় রাজি। পাশের গাঁয়ের সুলতান আহমদের বড় মেয়েকে সগিরের বউ করে আনে তফজল মিয়া।
পাসপোর্ট-এনওসির ব্যবস্থা করতে করতে মাস চারেক কেটে যায়। সগির বউয়ের স্বাদে বিভোর হয়। একদিন বিদেশে পাড়ি জমায় সগির। বউ একাকী ঘরে। কবির তখন ন্যাংটা নাচে উঠানে।
এভাবে বেশ কটি বছর কেটে যায়। বছরে-দুবছরে সগির বাড়িতে যাতায়াত করে। মাস-দেড় মাস থেকে আবার কুয়েতে চলে যায়।
একটা সময় সগিরের বাচ্চা হয়। কবির বড় হয়। তফজল মিয়ার সংসারের চেহারা বদলায়। বাড়ির আশপাশে জমিজিরাত বাড়ে। কবির স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে ভাইপোকে নিয়ে বাড়ির উঠানে খেলে। দেখে তফজল মিয়া আর হুমাইরা খাতুনের মন আনন্দে ভরে ওঠে।
বউটিও কাজকামের ফাঁকে ফাঁকে চাচা-ভাতিজার লুটোপুটি দেখে মুগ্ধ হয়। ভাবে, এই বাচ্চাটি তার পেটে ছিল এত দিন। কী সুন্দর, কী ফরসা, নাদুসনুদুস! মনে মনে বলে—নাউজুবিল্লাহ, আল্লা গুনা নিয়ো না। নিজের পোলার দিকে রেনি চাওন নাকি ভালা না। চাইলে আল্লা তুমি নাকি রাগ করো। তারপর কার উদ্দেশে থু থু করে থুতু ছিটায় বউটি। বিড়বিড় করে বলে, আপদ বালাই আঁর পোলার কাছ তোন হাজার মাইল দূরে থাউক।
এরপর বউটির চোখ পড়ে কবিরের ওপর। হায়রে কবির, তুই কত বড্ডা হই গেছস! এই হেদিন তুই ল্যাংটা হইয়া উঠানে নাচতিস। আর অহন যুবক যুবক। এইডে পড়স তুই। ভালা করি অহনো মোচ গজায় নিরে তোর!
মাঝেমধ্যে বউটি কবিরকে নিয়ে বাজারে যায়। সপ্তাহে দুদিন বসে বাজারটি। বাজারজুড়ে চাল-ডাল, কাপড়চোপড়, কসমেটিকস, ওষুধ, ক্রোকারিজের স্থায়ী দোকান। বাজারবার ছাড়াও ওই দোকানগুলোতে কাস্টমারের অভাব হয় না।
সেদিন গর-বাজারবারে কবিরকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে গেল বউটি। হাতে তো অনেক টাকা। শাড়ি, কাপ-পিরিচ, স্নো-পাউডার, লিপস্টিক—অনেক কিছুই কিনল।
সওদা করা শেষে বউটি কবিরের হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট আর একটা ছোট্ট কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘কবির, অই ওষুধের দোকানে যা। জিনিসখান কিনি লই আয়। ’ বলে কেনাকাটা নিয়ে একটেরে দাঁড়িয়ে থাকল বাউটি।
ওষুধের দোকানি কাগজটা হাতে নিয়ে অবাক চোখে কবিরের দিকে তাকায়। ছেলেটাকে চেনা চেনা বলেও মনে হচ্ছে দোকানির। দোকানে এখন কোনো কাস্টমার নেই। দোকানির হাতে সময় অনেক।
দোকানি বলে, ‘তোমারে চেনা চেনা লাইগতাছে। কও তো তুমি কার পোলা? খাড়াও খাড়াও, তুমি তফজল চাচার ছো বেটা না?
কবির সংক্ষেপে বলে, ‘হ। ’
‘তোমার বড় ভাই না বিদেশে?
কবির বলে, ‘হ। ’
বয়সী দোকানি বলে, ‘গত বছর না সগির বিদেশ চলে গেছে?’
কবির বলে, ‘হ। ’
‘তোঁয়ার বড্ডা মিয়া অহনো তো বিদেশেতোন আইয়ে নো। ঠিক কি না?’
কবির বলে, ‘হ। ’
‘তো তোমারে এই ওষুধ কেডা লই যাইতে কইছে?’
‘ভাবি। ’
‘তোঁয়ার ভাবি কোনহানে? বাপের বাড়িত না তোঙ্গ বাড়িত?’
‘আঙ্গ বাড়িত। ওই যে গাছতলাও লড়াই বইছে। ’
‘হুম!’ বলে দোকানি কিছুক্ষণ নীরব থাকল।
‘তা তোমার বড্ডা মিয়া বিদেশও। তোঁয়ার ভাবি এই সময় কনডম দিয়া কী কইরব?’ গ্রাম্য কৌতূহল নিয়া দোকানি জিজ্ঞেস করল।
কবির মাথা নিচু করল।
দোকানি গলায় গরম ঢেলে চাপা গলায় বলল, ‘কও। নইলে কিন্তুক তোঁয়ার আব্বারে আই কই দিয়ম। ’
ভীষণ ভড়কে গেল কবির। ঢোক গিলে, আমতা আমতা করে বলল, ‘ভাবি কোনো কোনো রাইতে আঁরে তাইনের ঘরে ডাকে। ’
খুবসুরত
কম বয়সে খুব ভালো একটা পোস্ট পেয়ে গেছে শাকিল। প্রাইভেট ব্যাংকের উঁচু পদ। মোটা বেতন। পোস্টিংটা ঢাকা থেকে একটু দূরে, নরসিংদীতে। বাংলো টাইপের বাড়ি। অফিস থেকে দেওয়া হয়েছে।
মাস কয়েকে থিতু হলো শাকিল—কর্মক্ষেত্রে, বাংলোতে। তারপর তরুকে আনার সিদ্ধান্ত নিল।
তরু মানে তরুলতা। আসল নাম নাজমা। তরুলতা শাকিলের দেওয়া নাম। সম্পর্ক যখন ঘনিষ্ঠ হলো, শাকিলের মুখে তরুলতা তরু হয়ে গেল। প্রথম চুমুটা লালকেল্লার ভেতরেই খেয়েছিল শাকিল। নাজমা গাছে হেলান দিয়ে শাকিলের চুমুটা উপভোগ করেছিল। ওই দিনই শাকিল বলেছিল, ‘আজ থেকে তুমি তরুলতা, আমার কাছে। ’ নামটা তরু হতে পারত, কেন যে লতা যোগ করেছে শাকিল, বুঝতে পারেনি নাজমা।
তিন বছরের ভালোবাসাবাসি ওদের। ইউনিভার্সিটি লাইফে ওদের দেখে হিংসে করত সহপাঠীরা। বলত, ‘তোদের মতো জুটি দেখিনি। এক্কেবারে রোমিও-জুলিয়েট, শিরি-ফরহাদ। ’
শাকিল মুহূর্তে মুহূর্তে বলত, ‘আই লাভ ইউ তরু। ’
তরুলতা তৃপ্তির হাসি হাসত। বিয়েটাও হয়েছিল ওদের। উভয় পক্ষের গার্জেনদের সন্তুষ্টির সীমা ছিল না।
একদিন তরুলতাকে নিয়ে এলো শাকিল। বাংলো দেখে তরু আনন্দে দিশাহারা। একজন বুয়া রাখল। কাজ শেষ করে সকাল এগারোটা নাগাদ চলে যায়। শাকিল বলে, সব সময়ের বুয়ার দরকার নেই। উটকো কেউ বাংলোতে থাকলে তোমাকে ইচ্ছেমতো সোহাগ করতে পারব না।
শুনে তরু মিষ্টি হাসে।
মাস দুয়েক পেরিয়ে গেল। বুয়া বেরিয়ে গেলে এক দুপুরে ডোরবেল বাজল।
তরুলতা দরজা খুলে দেখল, পঁচিশ-সাতাশ বছরের এক যুবক দাঁড়িয়ে। জিন্সের পকেটে ডান হাতটা ঢোকানো।
তরুলতা প্রশ্নবোধক চোখ দুটো তুলে যুবকের দিকে তাকাল। যুবকটি বলল, ‘নাজমা ম্যাডাম?’
তরুলতা বলল, ‘হ্যাঁ। ’
যুবকটি বলল, ‘আপনি খুব সুন্দর। ’ বলে পেছন ফিরল।
তরুলতা দরজা বন্ধ করে দিল।
কে এই যুবক। তাকে সুন্দর বলে হাঁটা দিল। একসময় মন থেকে উড়িয়ে দিল বিষয়টি। টুকটাক সংসারের কাজ তো কম নয়!
পরদিন একই সময়ে আবার বেল বাজল। তরু একটু আনমনা ছিল। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় শাকিল জড়িয়ে ধরে আই লাভ ইউ বলে। আজ বলেনি। অফিসের তাড়া ছিল বোধ হয়—ভাবল তরু। আনমনেই দরজাটি খুলল তরু। সামনে সেই যুবকটি। বলল, ‘আপনি দেখতে অসাধারণ রূপসী। ’ বলে দাঁড়াল না যুবকটি।
তরুলতা শিহরিত হলো। ভয়ও পেল। পাগল নয়তো যুবকটি। শাকিলকে কথাটা বলবে বলবে করেও বলল না।
কিন্তু একদিন বলল। দিন সাতেক পরের ঘটনা। সেদিন দরজাটা ভেজানো ছিল। বেল বাজল। খোলা পেয়েও ঘরে ঢুকল না যুবকটি। তরু এলে একই ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনি হার্টথ্রব। ’
তিন দিনের ঘটনা শাকিলকে খুলে বলল তরু। শাকিল ক্রোধান্বিত হলো। সংযত হয়ে বলল, ‘কাল চাকরিতে যাব না। তুমি যুবকটিকে বলবে, আমি সুন্দরী জানি। তো?’
‘কাল যে আসবে, তার কোনো গ্যারান্টি আছে?’
‘আসতেও পারে। ’ শাকিল বলল।
সত্যিই পরদিন যুবকটি এলো।
দার খুলল তরুলতা। মারমুখী শাকিল দরজার আড়ালে দাঁড়াল। যুবকটি বলল, ‘আপনার মতো সুন্দরী দেখিনি। আপনার রূপের শেষ নেই। ’
তরুলতা বলল, ‘জানি। তো?’
যুবকটি বলল, ‘আপনি যে ভয়াবহ সুন্দরী, আপনার হাজব্যান্ড জানেন?’
তরুলতা হাসি চেপে রাখতে পারল না। বলল, ‘জানবে না কেন?’
যুবকটি বলল, ‘আপনার হাজব্যান্ডকে আমার বোনের পিছু ছাড়তে বলেন। রূপা ওঁর অফিসে চাকরি করে। ক্লার্ক সে। নাম রূপা হলেও দেখতে সে সুন্দরী না। বোঝান আপনার স্বামীকে। ’ বলে যুবকটি গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
দরজা খোলা রইল। নাজমা খোলা চোখে তাকাল শাকিলের দিকে।
শাকিল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।