তাহেরার চাকরি

শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে মানুষের গলার স্বর  শোনা যাচ্ছে। তারা স্বর উঁচু করে ডাকাডাকি করছে। সব কিছু মিলিয়ে সন্ধ্যা সশব্দে এগিয়ে আসছে এই গ্রামে। তারপর নামবে নিñিদ্র
স্তব্ধতা।
সারা দিন মাঠে কাজ করে জব্বার বেশ কাহিল বোধ করছে। তার সারা গায়ে ঘাম। খড়ের ঘরের মাটির দাওয়ায় বসে সে আধছেঁড়া গামছা দিয়ে গা মুচছে। কপাল বেয়ে ফোটা ফে ঁ াঁটা ঘাম
ঝরে পড়ছে নিচে উদোম গায়ে। তার বউ জহুরা এসে প্লাস্টিকের গ্লাসে পানি দিল খাওয়ার জন্য। জব্বার ঢক ঢক করে পানি খেয়ে গ্লাস ফেরত দিল। তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। একটা বড়
শ্বাস ফেলে সে তার বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আজিজ মিয়া আইছিল?
না। জহুরা উত্তর দিয়ে গাস হাতে ঘরের ভেতর  ঢুকল।
জব্বার নিজের মনেই বলল, আসপে। সকালে কয়ি গ্যাছে।

ঘরের ভেতর থেকে জহুরা প্রশ্ন করল, সে কি মাজেদার খবর আনবে? তার স্বরে ব্যগ্রতা আর আকুলতা।
আশা তো করতিছি। বললেও জব্বারকে খুব আস্বস্ত মনে হয় না। সে নিজের মনে বিড়বিড় করে কিছু বলে।
জহুরা ভেতর থেকে জিজ্ঞাসা করে, কী তা কও?
কিছু না। জব্বার আর একটা বড় শ্বাস ফেলে।
আজিজ মিয়া আসে। বাইরে যখন ঘন অন্ধকার। অন্ধকার এতই নিকষ কালো যে কাছে থেকেও তার শরীর স্পষ্ট করে দেখা যায় না। প্রথমে একটা ছায়ার মতো মনে হয়, নিরেট কিছু না যেন। সে সাবধানে খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢোকে। কুপির কাঁপা আলোয় তার মুখে আলো-ছায়ার বুনট তৈরি হয়। সেই ছায়া একটু কাঁপে। তার চোখ অন্ধকারের মধ্যে চকচক করে,
তীরের মতো ধারাল দৃষ্টি। মেঝেতে একটা পিঁড়িতে বসে সে চারদিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে। না, দেখার মতো নতুন কিছু নেই। এই ঘরে সে আগেও এসেছে। বাঁশের বেড়াটা
একদিকে ঝুঁকে আছে। খড়ের চাল এক কোণে প্রায় ঝুলে পড়েছে। ফাঁকফোকর দিয়ে অন্ধকার ঢুকছে ঘরের ভেতর। বাইরে একটানা ঝিঁঝিঁ
পোকার ডাক। সে ডাকে রাতের স্তব্ধতা বিদ্ধ হচ্ছে। আজিজ মিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, সে সময় একটা শেয়ালের ডাক তাকে চমকে দিল।
ডাকটা শোনা গেল খুব কাছ থেকে। গ্রামে এ ডাক নতুন কিছুই নয়, কিন্তু আজিজ মিয়া চমকে উঠল। সে বিরক্তির সঙ্গে বাইরে তাকাল আধভেজা দরজা দিয়ে। সেখানে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আজিজ মিয়ার কপালে ভাঁজ পড়ল কয়েকটা।
জব্বার আলাপ শুরু করল। আজিজ মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, মাজেদার কোনো খপর পাওয়া গেল? তার স্বরে উদ্বেগ।
না। এ্যাহোনো পাই নাই। কিন্তু তার খপর শিগগির পাবা। ভালো খপর।
আজিজ মিয়া নড়েচড়ে উৎফলুø হয়ে বলে। কিন্তু অনেক দিন তো হইল হে বিদেশে গ্যাছে। এতদিনেও খপর পাওয়া যায় না ক্যান?
জব্বারের স্বরে অসন্তুষ্টি আর আশঙ্কা।
আজিজ মিয়া মোলায়েম করে হাসে। তারপর শান্ত স্বরে বলে, বিদেশ যাইতে সময় লাগে। অনেক দূর তো। সময় নেয়। বলে সে একটু থামে। তারপর বলে, বিদেশ পৌঁছানো হইল
পয়লা ধাপ। আসল কাম হইল চাকরি জোগাড় করা। হেইড্যা সময় নেয়। তারপরই না একটা ঠিকানা পাওন যাইব। চিঠিপত্র হেই ঠিকানা থেইক্যা লেখা হইব। টাকাও পাঠাইব। এইসব কাম কি তাড়াতাড়ি হয়? সবুর কর জব্বার।
মাজেদার খপর আইল বইলা। ঢলের লাহান টাকা আসন শুরু করব। তোমার এই বাড়ির চেহারাই বদলাইয়া যাইব। হে হে। বলে সে চুক চুক করে হাসে। তার খোশমেজাজে স্বস্তি আর অভয়।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জব্বার বলে, কত টাকা পাঠাইব হে?

আজিজ মিয়া বলে, সে তুমি ভাবতেও পারবা না। অনেক টাকা। সে তো যেখানে সেখানে চাকরি করব না। খুব বড়লোকের বাড়িতে থাকব। তারা অনেক টাকা বেতন দেয়।
এহানকার মতো না।
আজিজ মিয়ার মেজাজ বেশ ফুরফুরে।
জব্বার চুপ করে থাকে। তার চোখ ঘরের মেঝের দিকে। সেখানে কুপির আলো কাঁপছে থরথর করে। জব্বারের বুকের ভেতর কলিজাটা হঠাৎ লাফাতে থাকে। অনেক টাকা। সে বিভোর হয়ে থাকে।
আজিজ মিয়া তার মুখ জব্বারের কাছে এনে খুব মোলায়েম সুরে বলে, তাহেরার ব্যাপারে কিছু ঠিক করছ? সে বড় হইছে। মাশাল্লাহ, চেহারাডাও ভালা। তার ভবিষ্যৎ নিয়া ভাবা
লাগে। ভাবছ কিছু?
জব্বার মাথা তুলে তাকায়। তারপর বলে, না। তাহেরার লাগি অহনও কিছু ভাবতাছি না। তবে ভালা জামাই পাইলে বিয়া দিমু। সংসারে খাওনের একটা পেট কমব।
আজিজ মিয়া জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলে, না, না। এই ভুলটা কইর না। আজকালকার বিয়ার মানে বোঝ তো? জামাই টাকা চাইব, সাইকেল দিতে হইব। যৌতুক দিতে গিয়া
তোমারে ধারকর্জ করতে হইব। তা ছাড়া জামাই যদি পড়ে তালাক দিয়া দেয় তাইলে সে আবার তোমার ঘাড়ে আইসা পড়ব। না, না। এই ভুল কইর না।
তা হইলে কী করুম? তারে ঘরে বহাইয়া রাখতাম পারি না। আমি সামান্য মজুর। সংসারের বোঝা কমান লাগে।
আজিজ মিয়া হেসে বলে, কেডা কয় তাহেরারে ঘরে বহাইয়া খাওয়াইতে হইব। তারেও মাজেদার লাহান বিদেশে পাঠাও। সেও চাকরি পাইব। তোমারে টাকা পাঠাইব। দুই দুইটা
মাইয়ার পাঠানো টাকায় তোমার সংসারের চেহারা বদলায়া যাইব। এই চালাঘরের জায়গায় উঠব দালান। তোমার দিনমজুরি করতে হইব না। দুই মাইয়ার পাঠানো টাকায় পায়ের উপর পা তুইলা দিন কাটাইবা।
জব্বার থতমত খেয়ে যায়। আজিজ মিয়ার কথা তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে ওঠায় যেন। তার মাথা ঘুরতে থাকে। সে আস্তে আস্তে বলে,তাহেরা বিদেশে যাইব?
আজিজ মিয়া উৎফুল্ল হয়ে জব্বারের পিঠে হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা দেয়। তারপর বলে, আমি পাঠানের ব্যবস্থা করব। ঠিক মাজেদারে যেমনে পাঠাইছি। তারপর হেসে বলে, তাহেরার
চেহারা-সুরত ভালা। সে বিদেশে লগে লগেই চাকরি পাইব। এমন হইতে পারে দুই বোন একই জায়গায় থাকব। খুব আনন্দে থাকব তারা। তোমরাও সুখী হইবা। দুই বোনে মিলা
অনেক টাকা পাঠাইব। এক বছরেই পাকা দালান উইঠা যাইব। মনে হইব খোয়াব দেখতাছ। কিন্তু খোয়াব না, হাচাই হইব। তুমি শুধ রাজি হও। আমি ব্যবস্থা করতাছি।
জব্বার চুপ করে থাকে। যেন কিছু ভাবছে সে।তাকে অন্যমনস্ক মনে হয়।
আজিজ মিয়া পকেট থেকে কয়েকটা ৫০০ টাকার নোট বার করে জব্বারের হাতে দিয়ে বলে, নাও।
জব্বার বলে, টাকা কিসের?
আজিজ মিয়া হেসে বলে, মনে কর তোমার তাহেরা বিদেশ থেইকা পাঠাইছে।
জব্বার তার হাতে ৫০০ টাকার নোটগুলোর দিকে তাকায়। তার যেন বিশ্বাস হতে চায় না। সে হতভম্বের মতো হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজিজ মিয়া তার ঘাড় চাপড়ে বলে, কী মিয়া, কী বুঝতাছ? এই তো শুরু। আরো টাকা আসন শুরু করব। দালানে থাকবা। হুঁ। দালান। আয়েশ ফুর্তি করবা। লোকে তাজ্জব হইয়া যাইব।

আজিজ মিয়া চলে যাওয়ার পর জব্বার মাজেদাকে হাতের টাকা দেখায়। তারপর বলে,
আজিজ মিয়া ভালা মানুষ। তাহেরা বিদেশে গিয়া চাকরি পাওনের আগেই আগাম টাকা দিয়া গেল। এমন ভালা মানুষ হয় না। আল্লাহ তার ভালা করুক।
তাহেরাও বিদেশে যাইব? মাজেদা বুঝতে না পেরে বলে।
হ, হ। কইতাছি কী এতক্ষণ? তাহেরাও বিদেশ যাইব। আজিজ মিয়া কইয়া গেল। বিদেশে বড়লোকের বাড়িতে চাকরি করব। টাকা পাডাইব মাসে মাসে দুই বোনে। আমাদের অবস্থা
ফিরা যাইব।
কিন্তু আমরা তো মাজেদার খবরই পাইতাছি না অহন পর্যন্ত। তার খবর না পাওন তক দেরি করন যায় না? মাজেদা আমতা আমতা করে
বলে।
তার আর দরকার কী? আজিজ মিয়া কইয়া গেল সব ঠিকঠাক আছে। চাকরি পাইলেই মাজেদা চিঠি পাঠাইব। লগে লগে টাকা। আজিজ মিয়া সব জানে। না জাইনা হুইনা কথা কয় না। আর এই যে আগাম টাকা? এইডা দেইখাও কি বিশ্বাস হয় না? তুমি যে কেমন মানুষ!
মাজেদা বিড়বিড় করে। বলে, তাহেরা অহনও ছোড। আর একট বড় হইয়া নিক। তখন দেখা যাইব।
জব্বারের মেজাজ হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। সে মাজেদাকে চুপ করতে বলে ধমকের স্বরে।
তারপর বলে, ঘরে মাইয়া থাকার কী যন্ত্রণা তার তুমি কী বুঝবা? বাপ হইলে টের পাইতা। একটা তো না, দুই-দুইডা মাইয়া বিয়াইছ। বলে জব্বার বিরক্তির সঙ্গে ঘর থেকে হুঁকো হাতে বাইরের দাওয়ায় গিয়ে বসে। ঝিঁঝি পোকার ডাকের সঙ্গে তার তামাক খাওয়ার শব্দ মেশে।
তাহেরা জলিলকে বলে তার বাপ তাকে দূরে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। জলিলের বাবা আজিজ মিয়ার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। সব কিছু এখন প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। সে বিদেশে গিয়ে চাকরি করবে।
জলিল বিলের পাশে ডাঙায় দাঁড়িয়ে শালুক ফুল ছঁড়ে বিচিগুলো খাচ্ছিল। তাহেরার কথা শুনে সে হতবাক হয়ে গেল। হুঁশ ফিরে এলে সে বলল,
তোমার বড় বোন মাজেদার মতো? বাপজানের চোখ তোমার ওপরও পড়ছে?
হ। আমার বোনের মতো আমিও বিদেশে যামু গিয়া। কী করুম এখানে থাইকা? তাহেরার স্বর দৃঢ়। একট যেন বেপরোয়া। তা হইলে আমাদের কী হইব? আমাদের পিরিতের? প্রায় ছেলেমানুষের মতো কথাগুলো বলে জলিল।
জলিলের কথায় চটে যায় তাহেরা। সে ক্ষুব্ধ স্বরে বলে, পিরিতের টান থাকলে তাড়াতাড়ি কিছু কর। পিরিত শুধু মুখের কথা কইয়া রাখলে চলব না।
কিন্তু, কিন্তু আমার আব্বা… জলিল তোতলাতে থাকে। মুখের কথা শেষ হয় না।
তোমার আব্বারে কইয়া আমার লগে পিরিত করছ? যদি না কইরা থাহ, তা হইলে তোমার বাপের কথা ভাববা ক্যান? তারে ডরাইবা ক্যান? তিনি মত দিলে ভালা, না দিলেও তুমি আমারে বিয়া করবা। তারপর একটু থেমে বলে, যদি আমার লগে সত্যি সত্যি পিরিত কইরা থাহ,তা হইলে তাই করবা। আছে সেই সাহস?
তাহেরা কঠিন স্বরে বলে।
আমার এ্যাহোনো বিয়ার বয়স হয় নাই। বাপে রাজি হইব না। তা ছাড়া তোমার লগে শাদির কথা হুনলে খুন কইরা ফেলাইব।
জলিল অপরাধীর মতো বলে।
তাহেরা বিদ্রুপের স্বরে বলে, শাদির বয়স হয় নাই, কিন্তু পিরিতের বয়স হইছে। তাই না? গরিবের মাইয়ার লগে পিরিত করণ যায়, তারে শাদি করণ যায় না। হাচা কতা কও না ক্যান?
জলিল বলে, গরিব-বড়লোকের কথা হইতাছে না। বয়সের কথা কইতাছি। কথা ঘুরাইও না। বয়স না, গরিব হওনের লাগি তুমি এমন ভাবতাছ। পিরিতের সময় আমি গরিবের মাইয়া এই কথা ভাব নাই ক্যান?
তাহেরা রুষ্ট স্বরে বলে। তারপর একট থেমে বলে, তুমি সত্যি সত্যি আমার লগে পিরিত করলে বাপের কথা ভাবতা না। পিরিত মানুষরে অন্ধ কইরা দেয়। তোমারে করে নাই। তুমি হিসাব-নিকাশ ঠিকই মনে রাখছ।
জলিল ব্যস্ত হয়ে বলে, আমারে ভুল বুইঝ না। আমি হাচাই তোমারে ভালোবাসি। এর মধ্যে মিথ্যা নাই।
তয় শাদি করতে বাধা কই? তাহেরা জলিলের দিকে তাকায়। বাপজান রাজি হইব না।না হইলে না হইল। আমরা পলায়া গিয়া বিয়া করুম। পলায়া গিয়া!
জলিল ঢোক গেলে। তারপর মটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
হ। পলায়া গিয়া। পিরিত কইরা অনেকে এমুন কইরা শাদি করে। শোনো নাই?
জলিল আতঙ্কিত স্বরে বলে, বাপজান মাইরা ফেলাইব।
বাপজান, বাপজান! তুমি কেমুন মরদ পোলা? তোমার সাহস নাই?
জলিল তাহেরাকে শান্ত করার জন্য বলে, তা হইলে বাপজানরে কইয়া দেখতে পারি।
বাপরে কইবা তুমি? হুইনা তিনি খুশি হইয়া কইবেন, হ, তাহেরারে শাদি কর। তুমি কি পাগল হইছ, না ইচ্ছা কইরা পাগল সাজতাছ?
তা হইলে কী করতে কও তুমি? জলিল তাহেরার পথ আটকে রেখে বলে। তাহেরা বিল থেকে তোলা শালুকের বোঝা দুই হাতে নিয়ে বাড়ি
যেতে উদ্যত হয়।
আমারে নিয়া পলায়া শাদি করা ছাড়া তোমার আর কোনো রাস্তা নাই। এইডা যদি বইঝা না থাক তা হইলে তোমার কোনো বুদ্ধি হয় নাই।
পলায়া শাদি করলে…। জলিল কথা শেষ করতে পারে না।
তাহেরা বিদ্রপের স্বরে বলে, বাপ মাইরা ফালাইব। তাই না? থাহো তোমার বাপরে নিয়া। আমার পথ ছাড় বাড়ি যামু।

পুলিশ উত্তরার একটা বাড়ি রেইড করে। গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর পেয়েছিল তারা। একটা বাড়ির নিচ তলায় এক ঘরে দশজন অল্পবয়সী মেয়েকে রাখা হয়েছে। সবাই গ্রাম থেকে
এসেছে। তাদের আনা হয়েছে মাইক্রোবাসে করে রাতের অন্ধকারে। পুলিশের অভিযান শুরু হওয়ার আগেই দালাল ভেগে গেছে, ধরা পড়েছে দারোয়ান। পুলিশ পাচার করার উদ্দেশ্যে শহরে আনা মেয়েদের কাছ থেকে তথ্য সংগহের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। প্রশ্নের আগেই মেয়েরা কাঁদতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে একদল সাংবাদিক এসে যায়। তারা মেয়েদের সম্পর্কে জানতে চায়। হাতে রাখা নোটবইতে দ্রুত লেখে। কেউ কেউ ফটো তোলে। মেয়েরা হাত সামনে দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে। সাংবাদিকরা আরো একটা নারী পাচার সম্পর্কে রিপোর্ট লিখতে থাকে। একটা এনজিও থেকে দুজন মহিলা আসেন। তারা আইনি পরামর্শ দেবেন বলে জানান। পুলিশের সঙ্গে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়েও আলাপ হয় তাদের। যেসব মেয়ে গ্রামে ফিরে যেতে চায় তারা তাদের পাঠানোর দায়িত্ব নেবেন বলে জানান। যারা ঢাকায় থেকে চাকরি করবে তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা হবে বলে জানানো হয়। শোনার পর বেশির ভাগ মেয়েই গামে ফিরে যেতে চায়। কিছু মেয়ে শহরে থেকে চাকরি করার পক্ষে মত দেয়। এনজিওর মহিলারা পুলিশের কাছে বন্ড দিয়ে মেয়েদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
পোস্টম্যান যখন জব্বারকে চিঠি এবং মানি অর্ডার দেয় তখন সে অবাক হয়। কে পাঠাল?সে পড়তে পারে না। গ্রামের স্কুলশিক্ষক তাকে চিঠিটা পড়ে শোনালেন। চিঠি তাহেরা লিখেছে। নিজে না, অন্য একজনকে দিয়ে। সে ঢাকায় ভালো আছে বলে জানিয়েছে। চাকরি করছে। চাকরির টাকা থেকে কিছু টাকা বাড়িতে পাঠিয়েছে।
তাহেরা চাকরি করে? কী চাকরি? জব্বার জানতে চায়। শিক্ষক জব্বারকে বলেন তাহেরা
গার্মেন্টে চাকরি পেয়েছে।
জব্বার শিক্ষককে বলে, গার্মেন্টে চাকরি কি বিদেশে বড়লোকের বাড়িতে চাকরির চেয়ে ভালো?
হ্যাঁ ভালো।
ক্যান ভালো?
শিক্ষক বলেন, এজন্য ভালো যে দেশে থেকেই চাকরি করছে। ছুটিছাঁটায় বাড়িতে আসতে পারবে।
জব্বার বলে, ভালো বেতন দেয়?
শিক্ষক বলেন, সবাই দেয় না।
জব্বার বলে, তা হইলে?
শিক্ষক বলেন, ভালো বেতনের জন্য তারা মাঝে মাঝে আন্দোলন করে।
জব্বার বলে, আন্দোলন! সেটা আবার কী?
শিক্ষক বলেন, দাবি-দাওয়া নিয়ে দেনদরবার করে। সরকারের লগে কথা কয়।
জব্বার বলে, তাতে লাভ হয়?
শিক্ষক বলেন, কিছু তো হয়ই।
জব্বার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। সে হাতের মুঠোয় ধরা টাকার দিকে তাকায়। তার মুখে ধীরে হাসি ফুটে ওঠে।

[গল্প শুরুর আগে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘এক পুরুষ’ গল্পের ঝাল একটু খেতে হবে। নইলে জমবে না মোতি আর গুল বাহাদুরের প্রজন্ম সমাচার তথা
পরম্পরার গল্প। এ গল্প শেষের সময় লেখক বলেন, ‘বইখানা তিন পুরুষ-এ সমাপ্ত করার বাসনা ছিল; কিন্তু আমার গুরুই ‘তিন পুরুষ’ লিখতে গিয়ে এক
পুরুষে সমাপ্ত করে সেটিকে ‘যোগাযোগ’ নাম দিলেন তখন যার কৃপায় ‘মূক বাচাল হয়’ তারই কৃপায় এস্থলে ‘বাচাল মূক হলো’।’
আমি মূঢ়। অর্বাচীন। গুল মোতির গোপন প্রেমকাহিনী শুধ শুনলামই না, লেখার স্পর্ধাও হলো। বীর মুক্তিযোদ্ধা গুলের প্রজন্মধারার জন্য কেমন এক গর্ব এবং
মায়ার টানে তুলে নিলাম লেখনী। হতেও তো পারত এমন। প্রমিত বাংলার বাংলা বানানই লিখতে চাই আমি। মিশ্রণও ঘটেছে। তাই ধাক্কা
লাগবে চোখে এবং সংস্কারে। কিছু করার নেই। বাংলার আধনিক বানান এমনই সরল। মনে গভীর বিশ্বাস, প্রমিত বাংলা বানান একসময় এরকমটাই হবে।
সেদিন আমি থাকব না।]