মৃত মানুষের ডায়েরি থেকে

তকাল হঠাৎ ক-এর মনে হল, তার কিছুই করার নেই।

একটি দুষ্টগ্রহ। সেটি ক অর্থাৎ আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে নৃত্য শুরু করে। ঘণ্টা কয়েক আগ থেকে সেটি আমার পিছু নেয় একেবারে তেঁদরের মতো। হায়া শরম বলতে কিচ্ছু নেই। অনেকক্ষণ ধরে তাকে পাত্তা দিতে চাই নি… চাই নি বলেই যে সে ফিরে যাবে সে বান্দাও সে বুঝি নয়; বরং তাতেই তার শক্তির উল্লাস, সে আমাকে কুঁকড়ে দিতে চায়- তাই আমি যান্ত্রিকভাবে পাশ ফিরলাম, রণে ভঙ্গ দেয়া নয়। কারণ আমার হাত একটি উলঙ্গ ছোরার বাঁট ধরে পড়ে আছে এবং তাতে শরীরে মৃদু শিহরণ খেলছে। বাঁটটি ধরে আছে সেটি আমার হাত, নিচের দিকে আমার পা। বরং কিছু স্পর্শ না করাই ভালো। কী দরকার সারাক্ষণ কিছু স্পর্শ করে থাকা- বস্তু শুধু স্পর্শিত হওয়ার জন্য নয়; তার চেয়ে ভালো বস্তুর মধ্যে মটকা মেরে পড়ে থাকা, অথবা গলিত প্রবাহের মতো মিশে যেতে পারলে। এড়িয়ে থাকতে পারলে আরও ভালো, (কারণ) কোনো কিছু হাতে নিলে তাকে না ফেলা পর্যন্ত কি নিস্তার আছে (এক সময় ফেলতে আমরা বাধ্য)। আসলে সেও বড় কথা নয়। কেমন করে ছোরাটা আমার হাতে নিলাম আমি? নিলাম, নিয়েছি এ জন্য। অথবা, আমি অনুভব করছি যে, আমি যা মনে করি তাই করব; যেমন এই ছোরাটি কারও বুকে অথবা শুধু তার চোখ-দুটোই তুলে নিয়ে তাকে ছেড়ে দেব কোনো মুক্তিপণ ছাড়া। সে কোনো একজন জিয়াউরকে এরকম একটা শাস্তির পর ফেলে দিলে তার চিৎকার… পথ হাতড়ে চলা… লাঠির ঠুক ঠুক শব্দ… তাহলে তার বন্ধুরা আমাকে মুক্তি দেবে না এই তো? ওরা আমাকে মওকা বুঝে বা জাল ফেলে ধরে কিল-ঘুষি-লাথি মেরে দাঁত-কপাটি তুলে নেবে, তাতে আমার রক্ত ঝরবেÑ ওতে কিছু যায় আসে না। আমার মতো মানুষের কাছে মুখে মাখনের মতো স্বাদ আর রক্তের স্বাদে তেমন কিছু তফাৎ নেই। আবার তাতে একটি অবস্থার সৃষ্টি হবে, একটি জটিল অবস্থার জন্ম দেবে, জিয়াউরের অসহায় কান্না, ঘৃণা ও আক্রোশ এবং অন্য সকলের আস্ফালন চমৎকার, এক পরিবেশের জš§ দেবে। কিন্তু সমস্ত কিছুরই পেছনে এমন একটা কিছু আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে, যা আগের থেকেই নির্দিষ্ট হয়ে গেছে- আর সে সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। বাইরের ব্যাপারটি ছিল অনেকটা এরকম : ওরা প্রত্যেকেই আমার দিকে একচক্ষু কড়া নজর রেখেছে; দুটি যুবক একটি শোনা ঘটনার কথা বলে সিগারেট টেনে টেনে আমাকে দেখছে, একটি মেয়ে তার সঙ্গীর কানের পাশ দিয়ে আমাকে বিব্রত করতে চাইছে, ওদিকের আধ বুড়োটিও দেখছে ঘন ঘন। তবু তারা এ কথা ভালো বুঝে থাকবে যে, আমি এমন কিছু অনিষ্টকারী জীবজন্তু নই। যে-কোনো বার-রেস্তোরাঁয় একটা ছোরা এদিক-ওদিকে উল্টেপাল্টে রাখলে বা বিশেষভাবে স্পর্শ করলেও কারুর কিছু মনে করার কথা নয়। কারণ অন্য সব কিছু তখন যথারীতি চলছে। আড়ালে-আবডালে একটু চুমু-টুমু চলতেই পারে, এইটুকু স্বাধীনতা এ ধরনের উচ্চবংশের রেস্তোরাঁয় চলতেই পারে। অন্য সব কিছু যথারীতি চলছে। ঈশ্বরও স্বয়ং এসব নজর রাখেন বলে শোনা যায়, সত্য-মিথ্যে আমি যাচাই করে দেখিনি। শুধু ওয়েটারগুলোই একটু বেশি যেন সতর্কÑ এ কথা আমলে আসতেই ছোরাটা আমি পাতলুনের জেবে ভরে নিলাম চলচ্চিত্রের বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতার মতো, বিশ্বসাহিত্যের কথাও বলতে পারি। সে পরে হবে খন।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এসে আমি অর্থাৎ ক যখন বিখ্যাত মাইকেল জ্যাকসনের চাঁদ-ভ্রমণকারীর (মুন ওয়াকারের) মতো আচ্ছন্ন হয়ে হাঁটছি সেই সুযোগ ছোরাটি লুফে নিল। ছোরাটি আমার ডান হাত হতে বাঁ হাত হয়ে সুরুৎ করে ফুটপাতে ছিটকে পড়ে গেল একটা তীক্ষ ধাতব শব্দ, অন্য সময়ের মতো সচরাচর নয় আর তারপর চুপচাপ নিথর। থর মরুভূমির মতো বলার কথা মনে চলে আসে। কিন্তু আমার হাতের ছোরাটির দৃষ্টি এখন অন্ধ মানুষের মতো। যতক্ষণ ছোরা হাতে থাকে ততক্ষণই শুধু জীবন্ত। ইতিপূর্বে আমি যখন শৌচাগারে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে সরাসরি রেস্তোরাঁয়, রেস্তোরাঁ থেকে রাস্তার জনারণ্যে (আমাদের দেশে অরণ্য নেই; জনারণ্য, লোকারণ্য, সন্ত্রাসারণ্য, রাজনৈতিক দলের অরণ্য আছে)… এভাবে এমনি করে আমি আবার একটা অপরিচিত পরিবেশে গিয়ে পৌঁছলাম। সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য ছোরাটি তার অস্তিত্ব ঘোষণা করে বসল। অথচ সেটি আমি ফেলে এসেছি পেছনে। ছোরাÑ বাস্তবের মতো অবাস্তব অদৃশ্যেও তার আনাগোনা উপেক্ষণীয় নয়। আর সেটি আমার হাতে থাকার সময় ছিল জীবন্ত, এখন পেছনে সরে গিয়ে যেন হয়ে গেছে আরও এক রকম উন্নত জীবন্ত, আরও মারমুখী। সারাক্ষণ সে এখন উন্মুক্ত ফলকে অদৃশ্য থেকেও চেয়ে আছে। বাস্তবতা থেকে অবাস্তবে তার পরাক্রম… এমনকি এখন তাকে কাছে নেই ভাবাও কঠিন।
এসব ব্যাপার কখন কোথায় ঘটেছে তা ক-এর মনে পড়ে না। হয়তো একটা দুঃস্বপ্ন, হয়তো-বা বাস্তব। ক যদি ম-কে হত্যা করে নিজে আÍঘাতী হয়ে বসে তাহলে ব্যাপারটি তো কিছুই হল না। তবু সে আবার ভাবল। ভাবতে ভাবতে কতগুলো প্রশ্ন তুলে ধরল নিজের কাছে। সেগুলো কি? তার মধ্যে একটি হল, ক এখন একজন দৈনিক পত্রিকা সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।
সাক্ষাৎকারের বিষয়টি হবে প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা বিষয়ক, অর্থাৎ এমন একটি সমস্যা যা তাকে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ- এই মৃত্যুকে ক ভয় পায়, কারণ তাকে এড়িয়ে যে মৃত্যু আসতে চায় সে রকম মৃত্যুকে সে ভয় পাবে বৈকি; তার থেকে ক মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়। এসব ভাবতে ভাবতে ক অর্থাৎ আমি রাস্তায় নেমে পড়ি।
রাস্তার মানুষের ভিড় নতুন কিছু ব্যাপার নয়। এই মানুষ, রাস্তায় চলমান বিশৃঙ্খলা লম্ব- জ্যামিতির একটি রেখার ওপর কতগুলো বিন্দুর সমষ্টি, জড়াজড়ি ঠাসাঠাসি, মানুষে মানুষে যেন বিন্দুর লড়াই। রাস্তায়… রাস্তায়- রাস্তায় কীসের এত উচ্ছৃঙ্খলতা? অবশ্য আমিও একটা পাগল, অনেকে ইতিমধ্যে আমাকে পাগল ধরে নিয়ে থাকবে (আমার হাসি পেল, আমি পাগল! এ্যাঁ, আমি কখন পাগল হয়ে গেলাম আবার?)।
এভাবে ক আÍহত্যার প্রেরণা পেয়েছিল : (গতকাল যখন বুঝেছি) আমার কিছুই করার নেই- এরকম বোধ নিয়ে একজন মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই আমার সাক্ষাৎকার-একটা চাই। কার সঙ্গে! জাঁ পল সার্ত্র : আপনি এ কথা কি জানতেন না যে মানুষ খুন করা ছাড়াও আÍহত্যার পথ সুগম? সম্পাদকমণ্ডলীকে : আমার এই চিঠি পাওয়ার আগেই আমি মরে যাব; তখন বুঝতে পারবেন মৃত্যুর দিকে হেঁটে যাওয়ার মধ্যে অন্য রকম একটা বোধ আছেÑ মৃত্যুর আগের কোনো বোধই কি মূল্যবোধে অস্বীকৃত? আমার শক্তি, বেঁচে থাকা, ইচ্ছে, সম্পাদকের সরলতা (আপনাদের সরলতার জয় হোক)- এসব যখন ভাবি এবং কাউকে বলতে চাই তখন তারা আমাকে স্থায়ী নতুন পাগল মনে করে। কিন্তু আপনাদের শুভেচ্ছার (অথবা যদি ঘৃণাও করে থাকেন আমার যায়-আসে না।) জয় সুস্থির। অথবা সুনিশ্চিত নয় কি? কারণ আপনারা সম্পাদক।
এ সময় হাতিরপুল রাস্তায়, পুলের ওপর রাস্তাটি হাতির পিঠের মতো যেখানে উঁচু হয়ে পার হয়ে গেছে সেদিক থেকে একটা বাস তাড়াহুড়ো করে ছুটে আসতে দেখি। আমি রাস্তার ডান পাশ ধরে হাঁটছি, ডান দিকে দেয়াল, বাঁ দিকে কাদা-পানির গর্ত। খুব ছোট রাস্তা, দুটো বাস কোনো মতে যেতে পারে, মাঝে মাঝে আবার টেলিফোন ও বৈদ্যুতিক বাতির লোহার খুঁটি রাস্তার কিছু অংশ ঘুষখোরের মতো গিলে খাচ্ছে। হাতিরপুলের নিচ দিয়ে রেললাইন চলে গেছে আয়েশ করে। বাসটি হেলেদুলে রোগা বড় ইঁদুরের মতো দৌড়ে আসছে দ্রুত এবং গর্জনশীল। আমি এরকম একটি মুহূর্তের কথা কদিন ধরে মনে মনে খুঁজছিলাম কি! না, এরকম যেন নয়, আরও দ্রুতগামী। তবুও চরম ক্ষণ ভেবে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু কোন দিক থেকে যেন একটি মেয়ে-কণ্ঠ আমাকে ডাক পাড়ল, ক…। আমি চকিতে চোখ খুলে নিলাম, প্রতিবর্তী ক্রিয়ার মতো, আমার পাশেই দেখি পুরনো দিনের ছোট ছোট ইটের পাঁজর ভাঙা দেয়াল হাঁ করে আছে, আমাকে সেখানে ঢুকে যেতে বলছে- দৈত্যের মতো বিকট গোঙানি দিয়ে বাসটি আমার শার্ট ঘেঁষে উড়ে গেল।… কিন্তু কে ডাকল আমায়? ও পাশে একটি ছোট ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, মাথায় তার সবুজ রঙের টুপি, পায়ে খেলাধুলোর সাদা জুতো। যেন আমি এই ছেলেটিকেই খুঁজছি তেমন করে দাঁড়িয়ে রইলাম, সে আমার সঙ্গে হয়তো কিছু দূর যাবে। কিন্তু সে হাতিরপুল পাড় হয়ে ওদিকে কোথাও খেলার মাঠের দিকে চলে গেল-আমি ক তখন গাড়ির হাওয়ারোধক সামনের কাচের ভেতরে ঝুলে থাকা পুতুল মাত্র। পুতুল : গাড়ির ঝাঁকুনিতে দুলে মোচড় খেয়ে তুর্কি নাচনদার- সেও বোধহয় কোনো এক অদৃশ্য বোধের তাড়ায় বন্দি হয়ে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে সে হয়তো চায় হারিয়ে যেতে, হারিয়ে গেলে বুঝি শান্তি। পাতালে, নিুমুখী, যেখানে নরক নামক এক সুন্দর জগৎ আছে।
তাই ক যখন সব কথা আÍপক্ষ সমর্থন না করেও বলতে পারে, সে যখন নিজের গন্তব্যের সন্ধানে ছোটে, কিংবা সে যদি আত্মহত্যা নাও করে তবুও পৃথিবী উষ্ণ বা ঠাণ্ডা হওয়া থেকে বিরত হবে না। এভাবে আচ্ছন্নতায় নিজের সঙ্গে এবং অকাল্পনিক শত্র“র সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে কখনও দৌড়ে কখনও হেঁটে একটা ব্যাংকের সামনে দেখতে পেল, এখানে লকার্স পাওয়া যায়। এবার ক মনে করল কিছুই-কি তার সেখানে গচ্ছিত রাখা যায় না? কিন্তু কী রাখতে পারে সে! ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য কিছু জরুরি বার্তা যদি রাখা যায়; একটা চিঠি অথবা মনে করা যাক কিছু ঘৃণা যদি রাখা যেত! অথবা স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয়। অথবা ভারত-ভুটান-নেপাল-শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপ-বার্মার জন্য!
আচ্ছা, গত রাতে কে আমাকে সেই ভয়ঙ্কর স্বপ্নে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেছে? একটা অতিকায় শুঁয়াপোকা তার অজস ছোট ছোট হাত-পা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে এবং আমার সমস্ত সাদা রক্ত শুষে নিয়ে পেটের দিকে শরীরটাকে দোফালা করে ফেলে রেখে গেছে! আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ করেছি, কথা বলেছি, কিন্তু সে আমার কোনো কথা না শুনে আমাকে অনুচ্চারিত ভবিষ্যতে ফেলে চলে গেছে (সেটা গণতন্ত্রবিরোধী)। সেই শূন্য ভয়ার্ত সাদা রক্তহীন শরীরে আমি অনুক্ষণ ঘুরছি : একটি ছোরা ও তার দলবল সব সময় আমাকে শহরের গলাফাটা চিৎকার থেকে নৈঃশব্দতার জ্বলন্ত গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছেÑ এবং স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্নরা।… যদি এমন একজন মানুষের সাক্ষাৎ হয়, যদি এমন এক দিব্য মানুষের দেখা মেলে তবেই বুঝি এই নিুমুখীনতা থেকে হয়তো বাঁচতে পারতাম… কিন্তু তেমন মানুষটা নাকি আছে জ্বলন্ত সুন্দর নরকে।
এভাবে ক যখন কোথাও নিস্তার পেল না, পত্রিকার সম্পাদক স্মৃতি থেকে মুছে গেল, ক সদরঘাটের একটি চাপা গলিতে গিয়ে ঢুকে পড়ল। গলির প্রতিটি ছোট ছোট মোড় এবং অন্ধকার বারান্দার মুখ যেন পথচারীকে গিলে খেতে উন্মুখ। স্যাঁতস্যাঁতে রাস্তা আর ছোট্ট নালা, মাঝে মাঝে দুর্গন্ধের জন্য বন্ধ কপাট ও নিটোল নিস্তব্ধতা কেটে ক এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। সামনে হঠাৎ সন্দেহজনক গোছের একটা মানুষ দেখে ক পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। লোকটির সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই, শুধু পাশ দিয়ে যেতে যেতে একটু মাথা তুলে গোগ্রাসে দেখে নিল। আরও কিছু দূর গিয়ে ক যেন একবার নিঃশ্বাস ফেলল এবং উঁচু ঘরে ঢুকে পড়ল। ঢোকার আগে পেছনটা চকিতে জরিপ করে নিল। সেখানে অন্ধকারময় মাঝ বারান্দা দিয়ে যাওয়ার আগে একটি মেয়ে তার হাত ধরল। কাছে টেনে নিয়ে খেলা, মমতা, আদর, যত্ন, বাসনা সব শুরু করল। তারপর ক বিছানায় বসে মেয়েটিকে একটা লজ্জাকর পরিস্থিতিতে ফেলে যেন এতে ক-এর কিছুই যায় আসে না, পুতুলকে যেন হাঁটতে-নাচতে আদেশ করছে।
লজ্জাকর পরিস্থিতির অর্থ মেয়েটিকে সে উলঙ্গ হাঁটতে বলে, মেয়েটি, যার নাম পাখি কিংবা রানি, বলেই দিল, পারব না। না, ও কাজ আমি করতে পারি না, আমি হাঁটতে পারব না। ওরকম কোনো কিছু আমার জানা নেই।
না পারো উলঙ্গ হয়ে শুয়ে পড়ো এবং কড়িকাঠ গোনো। পাখি তাও পারবে না, তাও করাতে পারেনি ক। কোনো মেয়ে মানুষের সামনে, স্নানঘরে, একাকী দর্পণে বা আবছা আলো ছায়াতেও পারা যেত, কিন্তু একশ বা ষাট পাওয়ারের আলোর নিচে পাখি তা পারে না। ক সেই মুহূর্তে চকচকে ছোরার শৈত্যতা অনুভব করল জোরালোভাবে এবং নিজের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে আনতে গিয়ে আমুল বিঁধে গেল পাখির গলায়, পাখি বা রানি কোনো শব্দ করল না, বরং যেন মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগল। রাগে, বিতৃষ্ণায়, ভয়ে ও হতাশায় ঠাণ্ডা ছোরাসহ পাখির হাতের কমনীয়তাটুকু দেখে নিয়ে ক ব্যাপারটা আর একটু ভাবতে চাইল। কিন্তু অত ভাবার সময় তার নেই! সময়, সময়, সময়। ঘটনাটা এত দ্রুত ও অবিশ্বাস্যভাবে ঘটে গেছে যে, ক নিজেও বোকা বনে গেল, তারপর সে কিছু না ভেবে, কোনো দিকে না তাকিয়ে শুধু ছুটতে লাগল। ও সময় রানি তাকে ডাক্তার ডাকতে বলেছিল। ক কিছুই না শুনে শুধু ছুটতে ছুটতে ছুটতে…
ক ছুটেই চলল… ম্যারাথন দৌড়বিদের মতো, অলিম্পিক মশাল নিয়ে।
ছুটতে ছুটতে কাটরা, নবাবপুর, লালবাগ, গুলিস্তানের কামানটি ছুঁয়ে এক চক্কর দিয়ে মোড়ের বড়-ছোট ভবনগুলো টপকে, একটি সুতনু দেতলা বাস নাকি ঘোড়ার গাড়ি, অথবা পুরোন ঢাকা-টুঙ্গী বাসে করে নিজের কাছে ফিরে এলো। নিজেকে নিজে বলল, নিজের কাছেই ফিরে এলাম শেষ পর্যন্ত।
নিজের কাছে ফিরে এসেও মুক্তি নেই। সাংবাদিকদের কাছে প্রচারকের মতো বক্তৃতা না দিয়ে, মতিনের চোখ না তুলে, শ্রোতাদের কান ইত্যাদি থেকে মুক্তি কোথায়। তাই নিজের সম্পর্কে শোনার সাহস জোগাড় করতে হবে : গর্ব করার মতো কিছু বস্তু বা জনতা থেকে তফাৎ হওয়ার জন্য যা-কিছু করতে হয় তাই করা হয়েছে তার দ্বারা। ক এখন কিছুর ধার ধারে না। ঠিক এই বোধ থেকে তার যত বিপত্তি; পাখিকে সে কী অবস্থায় ফেলে এসেছে? পাখি এখন কি করছে? পাখি এখন কি ভাবছে, তার সাদা বিছানায় পুরোন ঢাকার আমলের বাড়ির দেয়ালে ইটের যে ক্ষুধার্ত মুখ… ক সেই মুখ দেখে ভয় পায়নি কখনও। কিন্তু এই মুহূর্তে করছে। পাখি এখনও হাসছে মুখ টিপে টিপে? পাখি বেঁচে আছে? এখন পাখি হয়তো পাখিটি নেই, পাখিও নয় রানিও নয়, রানি বা পাখি কিছু নয়, না; সবই অবস্থার ঘূর্ণি; সেখান থেকে কারও মুক্তি নেই : নিজেরও। আর নিজেকে বাঁচাতে চাইলেও আজ আর সে ইচ্ছে নেই, তাই ক ভাবল : আমি সব কিছু স্বীকার করব।
আমি সব কিছু স্বীকার করব- ক বলল নিজেকে নিজে। পাখির সঙ্গে পরিচয়, পরিচয় থেকে হৃদ্যতা এবং শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে খেলাচ্ছলে ভেসে উঠল মৃত্যুর ঠাণ্ডা স্বচ্ছ ঠাণ্ডা জমাট অন্ধকার। পুলিশ তাকে সন্দেহ করেনি, একজন সাধারণ বারবণিতার (ভদ্র) মৃত্যুকে নিয়ে এত তোড়জোড় করার মতো দুদণ্ড অবসর হয়তো তাদের কণাটুকুও নেই। তবুও একজন নির্দোষীকে ধরে বিচার চলছে এবং লোকটির শাস্তিও হবে শোনা যাচ্ছে, অথচ ক দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ক ঠিক করল এখন সব স্বীকার করবে। এই স্বীকারোক্তি এ জন্য নয় যে, একজন নির্দোষ মানুষ শাস্তি পাবে তাই। এই স্বীকারোক্তি বাঁচার জন্যÑ সমস্ত অস্থিরতা ও উদ্বেগ থেকে মুক্তির জন্য। ক তাই বলল, আমি মুক্তি চাই, আমার স্বাধীনতা আমাকে একটা অন্ধকার ঘরে নিত্যদিনের জন্য বন্ধনহীন আবদ্ধ করে রাখলে সে স্বাধীনতা আমি চাই না। মুক্তি… হোক মুক্তির অর্থ এক ধরনের মহৎ বন্ধন। আসলে একেকটা মুক্তিই তো একেকটা বড় বন্ধন। একটি দেশের স্বাধীনতার অর্থ তার নিজস্ব স্বাধীন সরকারের অনেকগুলো আইনকানুন মেনে চলা, আর সেটাও পরাধীনতার নামান্তর! তবু মুক্তি চাই, ডানা ভাঙা মুক্তি হোক, তবুও।… পাখি চলে গেছে। পাখি কি এখনও আছে? ওর ঘরখানি এখনও সেখানে আছে? কিন্তু ক-এর দৃষ্টি অত দূরে যেতে পারে না। আর ক যখন সে-ঘর ছেড়ে চলে এসেছে তখন সব কিছু ঠিকঠাক আছে বিশ্বাস করা কঠিন। এখন স্বপ্নেও যদি পাখিকে সে গান করতে বলে তার মুখ থেকে একটা ছায়া অথবা আলোর রেখা ডানদিকে বেয়ে নামবে, সেখান থেকে আরও সরে গিয়ে লম্বমান হয়ে গলার মাঝামাঝি গিয়ে স্থির হবে, অথবা বুকের ঠিক মাঝখানে, তখন যদি কেউ বলে বসে- পাখি, তোমার ওঠার সময় হয়েছে, গাড়ি প্রস্তুত এর অর্থ হচ্ছে আমি আর পাখির গান শুনতে পারব না। পাখির এভাবে পড়ে থাকা, এই নিশ্চল স্থির পড়ে থাকা, যে স্থিরতার শেষ নেই, তবুও যদি উঠে আবার বলে, তুমি সৎ নও এবং একটা পাপী ছাড়া অন্য কিছু নও। আর সত্যি আমি কি পাপী? আমি, নাকি ছোরাটা আমাকে চালিত করেছে? আসলে ছোরা বা বন্দুক পড়ে থাকলে কোনো শক্তি তার থাকে না, একমাত্র মানুষের হাতের স্পর্শেই তার জীবন জেগে ওঠে, তখন ছোরাটি করিৎকর্মা হয়ে মানুষকেই চালিত করে। তাহলে ছোরা নাকি মানুষ দায়ী। মানুষ দায়ী হতে পারে, তবে সে হচ্ছে ছোরার স ষ্টা মানুষটি, যে হাতে নিয়েছে সে নয়।
নিশ্চয়ই নয়, তুমি পাপী হতে যাবে কেন? ছোরাই দায়ী।
ওসব যুক্তি-তর্কের মারপ্যাঁচ। কিন্তু ক এখন সব কিছু স্বীকার করবে। কিন্তু স্বীকার করলেও কি মুক্তি পাবে? পাখিও-বা এভাবে মরবে ক জানত কি? ছোরাটাই তো সে পানশালা থেকে বের হওয়ার পথে ফেলে এসেছে বলে মনে করতে পারছে। তাহলে ছোরাটা এলো কোত্থেকে! তাহলে কি পাখির মৃত্যু অবধারিত ও অবশ্যম্ভাবী ছিল! এখন পাখি তো চুপ, সে তো নেই-এর দলে চলে গেছে। চুপ করে আছে চিরদিনের জন্য। তাই ক-কে সব স্বীকার করতে হবে।
: আমি সব কিছুই স্বীকার করব। ভয় পাচ্ছি বলে আমি স্বীকার করব তা নয়, আইনের শাস্তিকে ভয় পাই বলেও নয়, শাস্তি লঘু করার জন্যও নয়, কিংবা এমনও নয় যে আমি নিজেকে দোষী মনে করছি তাই। কিন্তু কী স্বীকার করব, কাকে বলব সত্যাসত্য এবং যে এ কথা প্রমাণ করতে পারত সে তো বেঁচে নেই। পাখিকে আমি মারিনি। অথচ সে মরে গেছে। সে মরেছে হঠাৎ। হ্যাঁ, আমার সঙ্গে খেলাচ্ছলে সে ফল কাটার ছোরাটা মাঝে-মধ্যে আমার দিকে বাগিয়ে ধরত। অর্থাৎ তখন পাখি এ কথাই মিছিমিছি বোঝাতে চাইত যে, সে আমাকে হত্যা করবে। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব বা সত্য হতে পারে যে, সে সত্যি সত্যি আমার গলায় ছোরা বসাতে পারবে! তবু নানা কথার ফাঁকে একবার মিথ্যে করে হলেও ছোরাটা আমার গলা পর্যন্ত এনে বলেছিল, দেই বসিয়ে! বলো মুখ ফুটে, হ্যাঁ।
পাখি বাঁ হাতে সদ্য কাটা আপেলের টুকরো এবং ডান হাতে ছোরা, ছোরা ও হাতে লেগে আছে আপেলের তাজা মিষ্টি ঘ্রাণ। আমি শুয়ে আছি আর ছোরাশুদ্ধ তার ডান হাতখানি আমার গলার ওপর ধরা। কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র, এলিয়ে পড়া আমার শরীরে তখন কেন জানি না কয়েকটি উষ্ণ অনুভূতির ঢেউ খেলে যায়- এ অনুভূতি কোনো নারীকে প্রথম স্পর্শ করার মতো শিহরণ জাগানিয়া। বয়ে গেল প্রবল শিহরণ। রক্তে জেগে ওঠে জলকম্পের চাঞ্চল্য।
পারবে তুমি পাখি?আমি বললাম ধর্মগ্রন্থ পাঠকারীর মাইক হাতে নিয়ে।
খুউব পারব। বলে অসচরাচর দুর্লভ হাসি ফুটিয়ে তুলল মুখে।
আমি শুয়ে শুয়ে আমার ডান পাশে ওর বুকের স্ফীতির স্পর্শ সুখ-সেবা গ্রহণ করছিলাম, আর ওর কথায় আরও তপ্ত হয়ে যেতে লাগলাম। সঙ্গে সঙ্গে চরম অধীনতার এক অবর্ণনীয় অবস্থায় শুয়ে; পাখি চমৎকার সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে আক্রমণকারী হিসেবে, অর্থাৎ যদি সে সত্যি সত্যি আক্রমণ করে বসে বা সে রকম কোনো পরিকল্পনা যদি আদৌ নিয়ে থাকে। এরকম শূন্য পরিস্থিতিতে আমার মাথা কাজ করছিল না কোন দিকে নড়চড়া করব, বা করলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সেই অসীম শূন্যতার মধ্যে আমার নড়াচড়ার সাধ্যি ছিল না… কয়েক সেকেন্ডকে মনে হয়েছিল কয়েক ঘণ্টা, পাখি যেন আমার কাছে তখন অলঙ্ঘনীয় হয়ে পড়ল, কিন্তু কিছু বাস্তবায়িত করার কোনো ক্ষমতা বা বেরিয়ে আসার পন্থা আমার ছিল নাÑ পালাবার সব পথ বন্ধ, অর্থাৎ আমি আক্রান্ত হওয়ার ছলনা খেলায় পরাজিত হয়ে গেছি। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল পাখি চমৎকার চতুর। তাই সদ্য কাটা এক টুকরো খোসাহীন আপেল আমার মুখে ধরে বলল, ভয় পেলে বুঝি খুউব! তোমাকে আমি নিজের হাতে মারতে পারি এ শক্তি ও বিশ্বাস হয় কী করে! তুমি কি পুরুষ?
কিন্তু মেয়েদের হাতে ছোরাছুরি নিয়ে হত্যা সংক্রান্ত কথাবার্তা আমার… আমার ভালো লাগেনি বলতে পারি। (কিন্তু একজন আÍঘাতী পলায়নী মনোবৃত্তির মানুষের কাছে একপর্যায়ে মৃত্যু ভয় কিছুই না : কথাটা বলতে পারিনি)। ওকে শুধু বলি, মৃত্যুতে আমার ভয় নেই। অন্তত পাখির হাতে।
মিথ্যে বলো না। তোমার মতো ভীতু দ্বিতীয় ব্যক্তিটি আমাকে দেখাতে পারবে? বলতে বলতে সে আমার শরীরের ওপর যেন পাকাপোক্ত হয়ে চেপে বসছে।
তুমি তো আর নিজের হাতে আমাকে মারতে পার না, ভয় পাব কেন? বলে মুখে হাসিটি টেনে ধরি। পাখি আর এক টুকরো আপেল কেটে খোসা ছাড়িয়ে আমার মুখে এগিয়ে দিয়ে বলে, পারি না? খুব পারব। এই দেখো…
বলতে বলতেই দেখি কি পাখি কেমন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে, ছোরাটা আমার গলা বরাবর ধরে বসল। তার হাতের ঠাণ্ডা স্পর্শ, উন্মুখ তীক্ষতার রূপ দেখে ভয়ে মায়াবী দুঃস্বপ্নে তলিয়ে যেতে থাকি- পাখি কি সত্যি সত্যি আমাকে মারতে পারে? এরকম ভাবনা আমার মনে কেন জাগল সেই শংকাতেই আমার হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে যেতে শুরু করল। আমার বুকের বাঁ দিকের শব্দ, স্নায়ুর সঙ্কোচন ও প্রসারণ এবং চিৎপাত শুয়ে থাকা শরীরটিকে কে যেন বিছানার সঙ্গে সেঁটে দিল পেরেক পুঁতে। সে অবস্থায় আমি একবার নড়তে চাইলেও কিছুতেই পেরে উঠলাম না। তবুও একবার জোর করে ছোরার তলা থেকে এক পাশ ফিরে সরে যেতে চেয়েছি। সে খিল খিল নাকি হিস হিস শব্দে হেসে উঠল খেলায় জয়ী হওয়ার মানসে। অথবা যৌন আক্রমণ কিনা তাও সঠিকভাবে ধরতে পারলাম না। অথবা প্রণয়ঘন, নয়তো ক্রোধচ্ছলে ক্রীড়া নিপুণতা! ওর গায়ে শক্তিও ভর করেছে সে রকম প্রবল। একবার জোর করে ছোরার তলা থেকে একটুর জন্য এক পাশ ফিরে সরে যেতে পেরেছি। আরও অনেকবার চেষ্টা করেছি মুক্ত হয়ে ওকে চেপে ধরতে, ছোরাশুদ্ধ হাত থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পাখির চোখের দিকে তাকাতে চেয়েছি ভালোবাসার রণে বশ করতে এবং শেষ পর্যন্ত মনে হতে লাগল আমি শক্তিহীন হয়ে গেছি… এরকম অবস্থা সেই প্রথম আমার। চোখের ওপর পুরনো ইটের দেয়াল দুলে উঠল, পরক্ষণে অপরিচিত হয়ে যেতে শুরু করে, আর কতক্ষণ… আমার শক্তি আমার বশে নেই… …আর বেশি সময় গড়ায়নি। আমি শেষ চেষ্টার আগেই বাঁ হাত ঘুরিয়ে এনে কী এক কঠিন অদৃশ্য শক্তিতে ছোরাশুদ্ধ পাখির হাতটি সরিয়ে দিতে দিতে তার পিঠোপিঠি প্রতিশোধ স্পৃহায় যেন পেয়ে বসল। প্রতিরোধ থেকে প্রতিশোধ, খেলা থেকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে গেলাম, সামনে একবারে বুকের উপরের পাখি আর পাখিটি নেই, যেন অপরিচিত অচেনা এক মানবী, যে সম্মুখসম আমাকে পরাস্ত করতে সক্ষম, রণে এবং রমণে, প্রণয়পাশার খেলাচ্ছলে আমাকে পরাস্ত করতে উদ্যত। মৃত্যুর আগে মরণ উপহার দেবে আমাকে সেই কুহকী আচ্ছন্নতা থেকে মুক্তি পেতে ছোরাসহ পাখির ডান হাতখানা ধরে ওকে পরাস্ত করতে গিয়ে সব শেষ হয়ে যায়। তাই… শুধু তাই… …ও… না। আমি কিছুই স্বীকার করব না।… এটি দুষ্টগ্রহ : সে আমাকে চারদিকে ঘিরে নৃত্য শুরু করেছে। ঘণ্টা কয়েক আগে থেকে সেটি আমার পিছু নেয়। কিন্তু অনেকক্ষণ তাকে আমি ক তাকে পাত্তা দিতে চাইনি… চাইনি বলে ফিরে যাবে এমন বান্দা সে নয়, বরং তাতেই তার শক্তির উল্লাস।