যে ফুলে শিশির জমে

দিল্লি বিমানবন্দর থেকে আনন্দগ্রামের সংস্কৃতি কেন্দ্রে পৌঁছাতে প্রায় রাত বারোটা হয়ে যায়। ‘উইমেন্স ইনিসিয়েটিভ ফর পিস ইন সাউথ এশিয়া’ শান্তি সংগঠনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে শান্তি বিষয়ে সাউথ এশিয়ার দেশগুলোর নারী লেখকদের সম্মেলন। বিমানবন্দরের বাইরে এসে দাঁড়ালে এক ঝলক ঠা-া বাতাস এসে নাকে ঢোকে। যদিও মাসটা এপ্রিল, টি.এস. এলিয়টের ‘ওয়েস্টল্যান্ড’-এর ক্রুরতম মাস।
বিমানবন্দরে ‘উইপসা’ লেখা কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ও পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। গাড়িতে উঠলে টের পাই ওর মুখভরা শক্ত পানীয়ের গন্ধ। পথে ছেলেটি কোন এক জায়গায় থেকে খানিকটা সময় অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে থাকলে ভয় পাই। আলো-আঁধারী জায়গা, রাত বেড়েছে, গাড়িতে বসে আকাশ দেখতে পাই না। শহরটা আমার একদম অপরিচিত নয়, কয়েকবার এসেছি, তবু এই বেশ রাতের অন্ধকার সময় রহস্যময় করে তোলে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার শীর্ষবন্ধু এই শহরটিকে। আমরা কতিপয় নারী লেখক শান্তির আকাক্সক্ষায় এখানে এসেছি, কিন্তু এই শহর এখন একটি ক্রুরতম মাসের বাতাসে ভরপুর। মাথা ঝিম মেরে যায়। মাতাল ট্যাক্সি-চালক ঠিকঠাক মতো সংস্কৃতি কেন্দ্রের গেটে পৌঁছে দেয়।
গেটে দু’জন দারোয়ান ছিল। তারা আমার স্যুটকেসটা আমার জন্য নির্ধারিত ঘরে পৌঁছে দেয়। একঘরে আমরা তিনজন থাকবো। দরজায় সাঁটা কাগজ থেকে জানতে পারি নেপালের দু’জন প্রতিনিধি এ ঘরে থাকবেন। রাত দু’টো বাজে ঘড়ি দেখে বুঝতে পারি ওরা দরজা বন্ধ করে ঘুমুচ্ছে। মৃদু শব্দ করতেই দরজা খুলে দেখে তোয়ে। ওর সঙ্গে আমার আগেই দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আর একটি সম্মেলনে দেখা হয়েছিলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমার সঙ্গে আবার আমার দেখা হলো। ভীষণ ভালো লাগছে। এ ভুবন। ভুবন ডুয়াঙ্গা। গল্প লেখে।
বললাম, বাহ বেশ মজা হলো। তোয়ে অর্থ জল, আর ভুবন তো পৃথিবী। তোমাদের পেয়ে আমি ধন্য। তো আমার বিছানা কৈ?
পাশের ছোট ঘরটি তোমার জন্য রেখেছি। তুমি একলা থাক। আমরা দুই নেপালি পাশাপাশি বেডে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যাবো।
তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে কথা হবে।
আমি পাশের ঘরটিতে ঢুকে জানালায় দাঁড়াই প্রথমে। মাঝখানে ছোট একটি প্রাঙ্গণ। স্বল্প আলোয় অপূর্ব দেখাচ্ছে প্রাঙ্গণের ওপর পড়ে থাকা বড় গাছটির ছায়া। চারপাশে ঘর। মাঝখানে সরু প্যাসেজ। ওই প্যাসেজ দিয়ে এগোলে আনন্দগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্রের বড় গোল মঞ্চ, তার ওপাশে থাক থাক সিঁড়িতে দর্শকদের বসার জায়গা। মনে হচ্ছে ময়ূর ডাকছে। ঠিক শুনছি তো? জানালার কাচে কুয়াশা জমেছে। কুয়াশা ভেদ করে আমার মুখোমুখি বাড়ির রান্নাঘরে কাজ করতে থাকা কিশোরী মেয়েটিকে ধরে গৃহকর্তাকে চুমু খেতে দেখি। মেয়েটি দু’হাতে বাধা দিতে থাকে। কালো, মোটা, থলথলে ভুঁড়িসর্বস্ব লোকটির সঙ্গে পারবে কেন ওই পুঁচকে মেয়েটি। অসহায় বোধে ও কাঁদতে থাকে। লোকটি ওকে বেশিক্ষণ আটকে রাখে না। দ্রুত চুমু খেয়ে ওর মাথায় আলতো করে হাত রেখে চোরের মতো পালিয়ে যায়। মেয়েটি দু’হাতে মুখ ঢাকে। আমি ওর কান্নার শব্দ শুনতে পাই না। কিন্তু ওর আন্দোলিত শরীর দেখে বুঝতে পারি যে ও গৃহকর্তা ওকে গ্রাম থেকে এনেছে। ওর এখনো ফ্রক পরে। সালোয়ার কামিজ ওড়না পরার মতো স্বাস্থ্যবতী হয়নি। মাত্র গতকাল দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রের রাজধানী দিল্লিতে আসার আগে এমন একটি দৃশ্য দেখে আমি ক্রোধান্বিত হইনি। প্রতিবাদের কথা ভাবিনি। পুরুষরা এমনই আচরণ করে এমন এক উদাসীন ভাবনায় আমি নিজেকে গুটিয়ে রাখি। মেয়েটির নাম শান্তি। হাসিখুশি থাকে। অভাব কাবু করেনি ওকে। এসব ভেবে আমার সুবিধাবাদী মানসিকতা শেয়ালের মতো গর্তে ঢুকে যায়। এই মুহূর্তে জানালার কাচের ওপর শান্তির কান্নার দৃশ্যটি দেখে আমার মনে হয় এই সংস্কৃতি কেন্দ্রের কোনো ঘরে কেউ না কেউ নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আনন্দগ্রামে চৌহদ্দীর ভেতরে থাকা অসংখ্য ময়ূর-ময়ূরীর সম্মিলিত সঙ্গম।
আমার ঘুম আসে না। আমি তাকিয়ে থাকি জানালার কাচের দিকে। দেখতে পাই জানালার কাচের ওপরে জমে থাকা শিশির সরু হয়ে নিচের দিকে নামছে। যেন সেটা বেইজিংয়ের একটি রাস্তা। আমি এখন চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের এক অদৃশ্য নারী। আমার সামনে হুয়াংÑধুমসে চুরুট টানছে, চুরুটের ধোঁয়ায় কুচকুচে কালো ঠোঁট, ক্ষুদে চোখের দৃষ্টিতে বয়সের ছাপ। আসলে হুয়াং তো বয়সী নারীই। জীবনের তৃষ্ণায় ওর পথচলা ফুরোয়নি। হুয়াং চুরুটের ধোঁয়ায় জমাট করে রাখে নিজের অতীত। ওর মুখের চামডায় ভাঁজ। বলছে, প্রথমবার ধর্ষণের শিকার হই একুশ বছর বয়সে। বেইজিং থেকে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পথে ট্রাকের ওপরে। খবর আসে মায়ের অসুখের। বাঁচবে কি বাঁচবে না ঠিক নাই ওষুধ দরকার। ওষুধ কেনার পয়সা নেই আমার। ভাবলাম, এ সময়ে মায়ের কাছে গিয়ে থাকা দরকার। আমাকে দেখলে মা খুশি হবে। আমার গায়ের খুব পরিচিত কাছের মানুষ ছিল ট্রাক ড্রাইভার। ওকে অনুরোধ করলে ও বিনে পয়সায় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে রাজি হয়। কিন্তু আমি বুঝিনি ও আমাকে নিয়ে উৎসব করবে বলে বন্ধুদের বলে রেখেছে। গাঁয়ে ফেরার পথে বেশ মৌজ করবে ওরা। আমি আলু বোঝাই ট্রাকের এক কোণায় জায়গা করে নেই। সারা রাত ঘুমিয়ে যেন বাড়ি পৌঁছাতে পারি এভাবেই জায়গা করেছিলাম। ট্রাক ড্রাইভার কুতকুতে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বেশ বানিয়েছো বিছানাটা। আলুর মধ্যে এমন বিছানা হয় আমরা তো ভাবতেই পারি না। চলো শুয়ে পড়ি।’ ওর কথা শুনে আমি বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকি। ও এমন একটি প্রস্তাব দিতে পারে তা ভাবতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। পরক্ষণে বুঝলাম, আমার গাঁয়ের লোক বলে ওকে আমি নির্ভর করেছিলাম, আসলে ওতো পুরুষ। মেয়ে দেখলে হামলে পড়বে। কিন্তু যখন দেখলাম ও একা নয়, আমাকে নিয়ে ফুর্তি করবে বলে ও বন্ধুদের ডেকে এনেছে, তখন আমার সামনে এক ছমছমে ভৌতিক পরিবেশ ঘনিয়ে ওঠে, আমি চিৎকার করার জন্য হা করতেই ওর চারটা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দেয়। দেখলাম, চারজনের পকেট থেকে বের হলো চারটা রুমাল। রুমালগুলো নতুন, ভাঁজও ভাঙেনি। ওরা তৈরি হয়েই এসেছিলো। সব শেষ হয়ে গেলে ড্রাইভার আমাকে বললো ‘আমরা এখন রওনা করবো। তুমি পোশাক পরে নাও।’ ও একে একে রুমালগুলো খুলে দিলো। বললাম, ‘রুমাল কিনতে পারলে তো কনডম কিনতে পারলে না?’ ও হাসতে হাসতে বলে ‘তুমি একটুও ভেবো না। পেট বাধলে আমাদের জানিও। ছেলে বিয়োবে কিন্তু। আমরা চারজনই ওই ছেলের বাপ হবো।’ আমি ওদের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছিলাম। ওরা আমাকে আর কিছু বলেনি। ওই নোংরা বিছানায় শুয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙলে দেখি আমি মায়ের কাছে পৌঁছে গেছি।
দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হই যাকে আমি ভালোবাসতাম তার হাতে। যেদিন আমরা দু’জনে খোলা আকাশের নিচে পার্কের ঘাসের ওপর শারীরিক আনন্দ উপভোগ করি, তার পরদিন থেকে ও উধাও হয়ে যায়। আমি দ্বিতীয়বারে জন্য ওকে আর দেখিনি। আমার বয়স এখন পঁয়ষট্টি। আমি মনে করি আমি বেশ আছি। আমার সংসার নেই, আমি মা হতে পারিনি। তাতে কিছু আসে যায় না। মা হওয়া আমি খুব জরুরি মনে করি না। বেশতো আছি, হা-হা করে হাসতে থাকে হুয়ান। হাসতে হাসতে চুরুটটা দূরে ছুড়ে ফেলে। ভলান্টিয়ারদের কেউ ওটা কুড়িয়ে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে। আমি হুয়ানকে বিশ্ব নারী সম্মেলনের লোগোর মতো দেখি- ওর বুকে পিঠে সম্মেলনের সেøাগানটি আটকে আছে সমতা, উন্নয়ন শান্তি ইত্যাদি। ওর সঙ্গে আমিও হা-হা করে হাসতে থাকি। আমাকে হাসতে দেখে ও চুপ করে যায়। আমি ওকে তর্জনি নাচিয়ে বলি, তুমি এই সম্মেলনের লোগোর শান্তির পায়রা। পায়রার শরীরের সঙ্গে নারী চিহ্নটি মিশে গেছে। আর পায়রার লেজটাকে বানানো হয়ে সমতার আদলে, গাণিতিক চিহ্নে আছে সাম্যের রেখা। হুয়ান তুমিই শান্তি, আমি আমার তর্জনি আরও প্রবলভাবে ওর মুখের ওপর নাড়তে থাকি।
শান্তি কি? হুয়ান আমাকে প্রশ্ন করে এবং উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে, আমার অভিজ্ঞতা আমাকে স্পষ্ট করে দেয়। আমি কোনো পুরুষের সঙ্গে জড়িয়ে আমার জীবন আর যাপন করতে চাইনি। আমি ভালো আছি। যা আয় করি তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন চলে যায়। দিনগুলো যেন সোনার চামচ, চড়ুইয়ের মতো ফুড়ুৎ। সবচেয়ে আনন্দের কি জানো? সমকামীর যৌনসুখে এখন আমি হোয়াংহো নদী আমাকে ঠেকায় কে? হুয়ান কোমর দুলিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। আমার চোখের সামনে পুরো বিশ্ব হুয়াংয়ের মুখ এক নতুন মানচিত্র। নারী অধিকারের লড়াই সে মানচিত্রের হোয়াংহো নদী। আমার শরীর শিউরে ওঠে। আশ্চর্য আমার ভেতরেও সমকামের শিহরণ কখনো অনুভূত হয়। কিন্তু না, আমি সমকামের পথে যাওয়ার মতো সাহসী হতে পারি না। আমার শান্তির ধারণা অনেক বড়। আমার সামনে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ১৯৭৪ এখন। আমেরিকা গমের জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে গেছে বলে ভীষণ দুর্ভিক্ষ। গরিবের ঘরে ঘরে হাহাকার। ইন্দিরা গান্ধী পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের আয়োজন শেষ করেছে। বাংলাদেশের রাস্তায় রাস্তায় ফুলকলিদের শরীর বিক্রির হিড়িক। আমার ঘুম পায় না। আমি আনন্দগ্রামের পুরো আকাশটা দেখবো বলে দরজা খুলে বাইরে আসি।
পরদিন সন্ধ্যায় জমে ওঠে উইপসার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। খোলা মঞ্চ। মঞ্চের সামনে অনেক প্রদীপ রাখা হয়েছে। সাতটি দেশ থেকে আসা প্রতিনিধিরা ওই প্রদীপগুলো প্রজ্বলিত করবে। জ্বলে উঠবে আলো, তেলের মধ্যে ডুবে থাকা সলতে, একটুখানি মাথা উঁচিয়ে রেখে মৃদু আলো ছড়াবে। আমরা সিঁড়ির ওপর বসে আছিÑ আমরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নারী লেখকরা, আমরা এখানে জড়ো হয়েছি শান্তির পক্ষে কথা বলার জন্য। আমাদের বলতে হবে নারী ও শান্তির যোগসূত্রের কথা জীবনের জন্য কতটা অপরিহার্য তা খতিয়ে দেখা। ভেসে আসে রাণী জেঠমালানির কণ্ঠ, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দিচ্ছেন। সংস্কৃতি কেন্দ্রের আকাশের দিকে উড়ে যায়। বুলেটের মতো শব্দ, নাকি কারগিল সীমান্তে গোলাগুলির শব্দে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে নারীদের আটপৌরে জীবনের দেয়ালগুলো। টেলিভিশনের ক্যামেরা তুলে আনে যুদ্ধের নানা চিত্র। নেপথ্যে আড়াল হয়ে থাকে বারুদের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন স্বজন হারানো শেকার্ত নারীরা। গভীর বেদনা নিয়ে কয়েকজন নারী এগিয়ে আসেন সেই সব নারীদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য। যিনি কোনদিন কবিতা লেখেননি, পাঞ্জাবি ভাষায়তো নয়ই, তিনি লেখেন আসমান হায় সাদি শানজিহি সীমা- স্কাই ইজ আওয়ার কমন বাউন্ডারি। এমন গভীর প্রত্যয় থেকে জন্ম নেয় উইমেনস ইনিসিয়েটিভ ফর পিস ইন সাউথ এশিয়া। ছুটে যায় শান্তির বাস দিল্লি থেকে লাহোরে। আমার মনে হয় সেই বাসের চাকার নিচে পিষ্ট হয় সেই দানব যে শান্তির প্রতীক মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী। গান্ধী স্মৃতির সামনে দাঁড়িয়ে সেই সব মহিলারা পরস্পরের হাত ধরে শান্তির পক্ষে কাজ করার শপথ নিচ্ছে। তখন গোধূলি আলোর ম্লান ছাড়া বিছিয়ে আছে চারদিকে, নারীদের হাতে মোমবাতি ও ফুল- এক স্বর্গীয় দৃশ্য যেন। আলো শেষে অন্ধকার নামে। আমি ঢাকায় উর্বশী বুটালিয়ানকে দেখতে পাই, তার লম্বা চুলের গোছার মতো অন্ধকার নামে। সম্পাদনা করেছে বই। ‘স্পিকিং পিস : উইমেনস ভয়েসেস ফ্রম কাশ্মীর।’ আমি উর্বশীর সম্পাদিত বইটি কিনি। উর্বশীর প্রকাশিত বই প্রথমবার কিনেছিলাম ’৯৫ সালে দিল্লি বই মেলা থেকে। একটি বইয়ে শান্তির কথা লিখলে কি শান্তির প্রবক্তা হওয়া যায়? আমি বুঝি না। শুধু জাফস এই সম্মেলনে উর্বশীর সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে। এই নিয়ে তিনবার। কোনো কারণ ছাড়া আমি একজনকে নিয়ে ভাবছি কেন? কাশ্মীরী নারীদের কণ্ঠস্বর জলপ্রপাতের মতো আমার কানে পড়ছে বলে কি? নাকি উইপসার আর একটি বাস নারীদের নিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসছে বলে? বুঝতে পারি শান্তির পক্ষে এতসব আয়োজন আমার বেঁচে থাকার সাধ বাড়িয়ে দেয়। আমি মোহিনী গিরির হাত জড়িয়ে বলি, চলুন যাই। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কোথায়ই? বলি, আপনাদের স্বপ্নের জগতে। যুদ্ধ-মুক্ত পরমাণবিক অস্ত্র-মুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি জনপদে ঘুরে বেড়াবো আমরা দু’জনে। তিনি মৃদু হেসে আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলেন, সত্যি একদিন আমরা এমন জায়গা গড়ে তুলতে পারবো। আমরা না পারলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ঠিকই পারবে। গভীর প্রত্যয়ে উচ্চকিত মোহিনী গিরি আমার সামনে আর একা থাকেন না। শত শত হন। শত শত নারী। তারা দেখতে চায় নিরুপদ্রব জীবনÑ যেখানে হিমালয় পর্বত আছে, অজন্তা ইলোরা আছে, নদীমাতৃক ভূখ- আছে, সাগর-মেখলায় নন্দিত দ্বীপ আছে পাহাড়-বেষ্টিত সমতল ভূমি আছেÑ এসব কথাইতো শুনেছিলাম ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনের মঞ্চ থেকে উচ্চারিত কমলা ভাসিনের কণ্ঠে।
আনন্দগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্রের ছোট সেমিনার কক্ষ নারীদের তুমুল আলোচনায় গমগম করে। প্রত্যেকের ভেতর থেকে নিজস্ব কথাগুলো বুলেটের মতো ছুটে বেড়ায়। কবি আতিয়া দাউদ তাঁর স্মৃতিচারণে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আনে। আতিয়ার স্মৃতিচারণ আমি মোহাবিষ্ট হয়ে শুনি। ১৯৭১। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরে একটি স্বাধীন দেশ অর্জনের লক্ষ্যে যুদ্ধরত। বিজয় সূচিত হয়। বন্ধুরাষ্ট্র ভরত। কোটি শরণার্থী ভারতের মাটিতে। এই যুদ্ধ জীবনের ফুল ফোটানোর যুদ্ধ। আতিয়া তাঁর কিশোরী জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছে একদিন যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু বাবা-মা বলছে, যুদ্ধ শেষ হলেও আমাদের আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা পাকিস্তানের আর একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান হারিয়েছি। আতিয়ার পরিবার বিষণœ হয়ে থাকে। আমার সামনে জেগে ওঠে মার্চের পঁচিশের গণহত্যার রাত। সংস্কৃতি কেন্দ্রে আজ ২৪ মার্চ। পরদিন দুপুর রাতে গণহত্যার সূচনা করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। নয় মাস ধরে ধর্ষিত হয়েছে নারীরা। চারদিকে মৃত্যু, ধ্বংস, কান্না। যুদ্ধশিশু। নীল নকশা প্রণয়ন করে বুদ্ধিজীবী হত্যা, অপারেশন সার্চলাইট। আগুনে পুড়ে যাওয়া ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এলাকা। আমার বুকের ভেতর ক্ষত। মহারাষ্ট্রের পাঁচগণির মরাল রি-আর্মামেন্ট সেন্টারে দাঁড়িয়ে আমি সুশোভা বারবিকে বলছি, আমি কোনো পাকিস্তানির সঙ্গে কথা বলতে ঘৃণা বোধ করি। সুশোভা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ও চেয়েছিলো পাকিস্তান থেকে আসা প্রতিনিধি অরুণা কামালের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে। তখন পর্যন্ত পাকিস্তান শব্দ শুনলে আমার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। আমরা এসেছি সার্ক সম্মেলনে। রাজমোহন গান্ধী আমাদের হোস্ট। আমার এই কথায় সুশোভা বিব্রত হয়ে চলে যায়। বিষয়টি যে শুনেছে তারই খুব প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কারণ কনফারেন্সের মূল থিম ঘৃণা নয়, বিদ্বেষ নয়, শুধু ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে হবে মানুষকে। ফলে বেশ তোলপাড় ওঠে। দুদিন পরে রাজমোহন গান্ধী অন্যদের নিয়ে আমার সঙ্গে বসেন। প্রথমেই বলেন, আপনার ক্ষত মুছে ফেলতে হবে। আমি বলি, ক্ষত মুছে ফেলা তো সম্ভব নয়। এই ক্ষত নিয়েতো আমার স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তিনি মৃদু হেসে বলেন, যুদ্ধ সংঘাত নিরসন হলে ভালোবাসা ছাড়া আর কোন শব্দ থাকতে পারে না। আপনাদের প্রতি অন্যায় করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। সাধারণ মানুষ নয়। আমি একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবো সেখানে অরুণা কামাল ও ওয়াহিদুজ্জামান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে ক্ষমা চাইবে। আমি চমকে তাঁর দিকে তাকাই। তিনি বলেন, আমরা ভালোবাসার আগুন জ্বালাবো। আমাদের বিদায়ের আগে অরুণা ও ওয়াহিদুজ্জামান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে আমাদের কাছে ক্ষমা চায়। অরুণার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। আমরা ফেরার পথে ঐতিহ্যবাহী অজন্তা গুহা ও ইলোরা দেখতে যাই, যে দু’টো পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সমগ্র মানবজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ওখানে দাঁড়িয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলি, এগুলোই আমাদের জীবনে শান্ত ও সৌহার্দ্যরে নিদর্শন। সেমিনার কক্ষে কথা বলছে সুমাথি, সম্মেলনের তরুণ প্রতিনিধি, শ্রীলঙ্কা থেকে এসেছে। একদিন ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরেছে, কিন্তু নিজের আলোচনার দিন শাড়ি পরেছে, সঙ্গে সিøভলেস ব্লাউজ। শ্যামলা ছোটখাটো সুমাথিকে আমার খুব স্নিগ্ধ লাগছিলো। সংঘাতময় শ্রীলঙ্কার বিপরীতে এই সম্মেলনে সুমাথি শিবামোহন আমার চোখের সামনে শান্তির বৃষ্টি। যেভাবে নেপালের মঞ্জুশ্রী থাপাও শান্তি হয়Ñমার্ক্সবাদী গেরিলাদের সংঘাতে বিপন্ন নেপালের কথা যখন ও বলে তখন ওর চমৎকার মুখশ্রীতে আমি হিমালয়ের চূড়ায় বরফের গায়ে বিচ্ছুরিত সূর্যালোক দেখি এবং একইভাবে পাকিস্তানি তরুণ লেখক উযমী ও কামিলার সামরিক শাসনবিরোধী তীব্র কথায় আমার বুকের ভেতর শান্তির বাণী ছায়া বিস্তার করে। ওরা সবাই আমাকে অনুপ্রাণিত করে। ভেসে আসে মীরা খান্নার কণ্ঠ। গোধূলি আলোয় স্নাত মঞ্চ থেকে আলো সরে গেছে। জ্বলে উঠেছে বিদ্যুতের আলো, নৃত্যের তালে মুখর হয়ে উঠেছে মঞ্চ। অপূর্ব ভঙ্গিমায় মঞ্চে নেচে যাচ্ছে রামা, নেপথ্যে মীরা খান্নার কণ্ঠ। ভারতনাট্যমের তরঙ্গছন্দের সঙ্গে মিশেছে যৌনতা ও প্রজনন স্বাস্থ্যে নারীর অধিকার বিষয়ের সমকালীন তীব্রতা। খোলা আকাশের নিচে বসে থেকে মনে হয় ময়ূরীর এখন ডিম পাড়ার সময়। বর্ষা কি দূরাগত ধ্বনি? মীরার কণ্ঠের সুগভীর ব্যঞ্জনা আমাদের মুগ্ধ করে রাখে, আর নৃত্যের জাদুকরী ঝঙ্কারে স্নিগ্ধ হয়ে যায় স্নায়ু। আমার ঘোর কাটে না। বসে থাকি। দু’হাত পেছনে ঠেলে ঘাড় উঁচু করে আকাশ দেখি। পাশে বসে ছিলেন নিয়াজ জামান। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, চমৎকার মীরা দারুণ লিখেছে। তেমন সুন্দর পাঠও করেছে। বলি হ্যাঁ মীরা চমৎকার কাজ করেছে। সমকালীন বিষয়কে শুধু আন্দোলন কর্মীর কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে শিল্পের মাধ্যমেও তুলে ধরেছেন। অপূর্ব।
একে একে সবাই উঠে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান শেষ। আরও কিছুক্ষণ বসে থাকি। জয়া মিত্র এসে বলে, চলুন চারপাশটায় ঘুরে বেড়াই। কেন্দ্রে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিনের বেলায় একরকম, রাতে অন্যরকম। ভাবি, ময়ূরগুলো কোথায় ঘুমিয়ে পড়লো! সংস্কৃতি কেন্দ্রের ঢোকার মুখে রাখা বড় বড় মাটির তৈরি ঘোড়াগুলো বুঝি মাঠে নেমে এসেছে। ঘাস খুঁজছে এবং জোড়ায় জোড়ায় আজ রাতকে নিজেদের কামনায় উৎসবমুখর করবে।
কথা বলি উর্মিলা পাওয়ারের সঙ্গে মুম্বাই থেকে এসেছে। আমার পাশের ঘরে আছে। সকালে রাতে অনেক গল্প হয়। ওর সাদাসিধে আচরণ সহজাত লেখকের ভিন্ন দৃষ্টি এবং কথা বলার স্বচ্ছ দক্ষতায় আমি মুগ্ধ শ্রোতা। ওর কাছে দলিত সাহিত্যের কথা শুনি। নির্যাতিত দলিতদের কথা শুনতে শুনতে বিষণœ হয়ে যাই। ভাবি, আর কতদূর এগুলে এসবের অবসান হবে? নারীর পথ চলা ফুরোবে কবে? সম্মেলন শেষ হওয়ার একদিন আগে উর্মিলা চলে যায়। মুম্বাইয়ে জরুরি কাজ আছে। ও দীর্ঘদিন ধরে দলিত নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। আন্দোলন করছে না কে? এখন থেকে তিন মাস পরেইতো থাইল্যান্ডের মহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটারে বসে সমকামী মেয়েদের অধিকারের দাবিতে যখন পাপুয়া নিউগিনির রুবি কোনকে সরব হতে শুনবো তখন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে একটি হাত। চিদমলের বিশাল সেন্ট্রাল ডিপার্টমেন্ট সেন্টারের সামনে প্লোয়েনচিতের ফুটপাথে পড়ে থাকবে একটি মানুষ। চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। পুরো শরীর ঢাকা। ও নারী না পুরুষ তা বোঝার জন্য আমি একটি সময় দাঁড়াবো। হঠাৎ দেখবো একটুখানি বেরিয়ে থাকা হাতে একটি কালো চুড়ি শোভা পাচ্ছে। মুহূর্তে নারীর অস্তিত্ব টের পেয়ে আমি নিজেকে মূর্খ বলে গালি দেবো এই বলে যে এখন পর্যন্ত আমি নারী-পুরুষের অবস্থানকে বুঝতেই শিখলাম না। ও পুরুষ হলে চাদরের নিচে ঢাকা থাকতো না। ও উলঙ্গ পড়ে থাকতে পারতো- নেতিয়ে থাকা শিশ্ন ওকে পৃথিবী জয়ের আনন্দে অজস্র গাড়ির শব্দের ভেতরও ঘুমিয়ে থাকতে দিতো। আমি সম্মেলনে গৌতম আর নাতাশাকে দেখবো। ওরা যৌনকর্মীদের ওপর পুলিশের নির্যাতন বিষয়ে ছাব্বিশ মিনিটের ডকুমেন্টরি বানিয়ে নিয়ে সম্মেলনে আসবে। লেকচার থিয়েটারে যৌনকর্মী রেহানা নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে থাকলে গৌতম আর নাতাশার ছয় মাসের ছেলেটি তারস্বরে চেঁচাবে। আসলে ও ঘোষণা দিতে থাকবে যে আগামী দিনের পৃথিবী ওর। ও পুরুষ। তখন নিজের চেয়ে দশ বছরের বড় একটি মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনলে নাসিরের মা চিৎকার করে কাঁদবে। চিৎকার করে আমাকে বলবে, ছেলেটা আমাকে শান্তি দিল না। একটি মাত্র ছেলে আমার। আমি আমার বান্ধবী জরিনাকে জিজ্ঞেস করবো, এতো অল্পে তোর শান্তি বিঘিœত হয় কেন? শান্তি কি খুব ছোট জিনিস? জরিনা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। বলবে, আমি কি এখন একটা সিগারেট খাবো? আমি ওকে গালি দেবো। বলবো হারামজাদী নিজেকে নারীবাদী বলে গলা ফাটাস। সবার সামনে সিগারেট খাওয়ার সাহস নেই। আমার মায়ের সঙ্গে তোর পার্থক্য থাকলো কোথায়? সাহস থাকলে সবার সামনে ধোঁয়া ওড়া। তখন থরথর করে কেঁপে উঠবে কারগিলের আকাশ। আমি দেখবো সাহিদোল বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশে কু-ুলি পাকানো ধোঁয়া। পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে ভরে যাচ্ছে আকাশ। আমি আমার গন্তব্যে ফেরার জন্য চিৎকার করবো। দেখবো ঘুটঘুটে অন্ধকারে মোড়ানো রাস্তার দু’ধারে অজস্র ফেরিওয়ালা রামবুতান ফল বিক্রি করছে। পরস্পরকে বলছে, আজকের দিনটায় বেচাকেনা ভালো হয়েছে। চাল আর আলু কিনে ঘরে ফিরতে পারবো। ভীষণ খুশি লাগছে। থাইল্যান্ডের আকাশের কালো ধোঁয়া মেঘ হয়ে বৃষ্টি নামাবে। আমি আমার গন্তব্যের পথ খুঁজে পাবো। দেখবো রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ফুল বিক্রি করছে একটি কিশোরী। বলবে আপা একটা কদম ফুল নেন? জিজ্ঞেস করবো, তোর নাম কী রে? ও হাসিতে উচ্ছল হয়ে উঠে বলবে, শান্তি। আমার মনে হবে হিমালয়ের চূড়া থেকে শীতল বাতাস এসে আমার বুক ভরিয়ে দিচ্ছে। বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত বিশৃঙ্খল শহর ঢাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাববো এই শহরে আমার একটি ঘর আছে। ওখানে ফিরতে হবে। ফেরাটা নিশ্চিত নয়। অনিশ্চিত যাত্রায়। আর আমার শহরের মেয়ে শান্তিরতো কোন ঘরই নাই। ও ফুটপাথে বড় হতে হতে শরীর বিক্রির সবক নেয়। কে যে ওর নাম শান্তি রাখে বুঝি না।
আমি তখন মনোযোগ দিয়ে সম্মেলনের সমাপনী বক্তৃতা শুনি ডক্টর কাপিলা বাৎসায়নের কাছ থেকে। বয়সী নারীর অভিজ্ঞতা এবং প্রজ্ঞা তাঁর কণ্ঠে ধ্বনি হয়। এই সেসনে অন্তরা দেবসেনের সঞ্চালক হওয়ার কথা ছিল। ওর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে মীরা খান্না সঞ্চালকের দায়িত্ব নেয়। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। অন্তরার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় কাঠমান্ডুতে, অন্য আর একটি সম্মেলনে। সেই থেকে ও আমার পছন্দের মানুষ। সভা বেশ খানিকটা চলার পরে অন্তরা আসে এবং ওকে মঞ্চে এসে দায়িত্ব নিতে হয়। ভাবি ওতো তেমনই আছে যেমন দেখেছিলাম আগে। অনুষ্ঠানের র‌্যাপোটিয়ারের দায়িত্বে ছিলেন ড. সাইয়েদা হামিদ। তাঁর কণ্ঠে গত কয়েকদিনের অনুষ্ঠানের বিবরণ শুনতে শুনতে দেখতে পাচ্ছিলাম তামিলনাড়ুর বামাফ স্টিনা কত জোরালো ভাষায় কথা বলছে। যেন আবার সেই বারুদ ফাটা কারগিলের আকাশ কিংবা গুজরাটের দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নাকি কথা বলছে নীলগিরি থেকে আসা মার্সি নাকি কাশ্মীরের নাসিম সাইফ, গুজরাটের স্বরূপ, পাকিস্তানের জাহিদা হিনা, আসামের অরূপা বা মিত্রা, কেরালার কবি সুগাতাকুমারী, কতজনের নাম বলবো। অনন্তকাল ধরে বললে এই নাম বলা শেষ হবে না। আকাশে ঝুলে থাকবে নক্ষত্ররাজি, ধরণীতে ধুলোর পাহাড়। আমরা পিষ্ট হতে থাকবো পায়ের নিচে জননীর মমতা নিয়ে। ছুটে যাবে সুশোভার গাড়ি গুরগাঁওয়ের দিকে। আমি হরিয়ানা সীমান্তে ঢুকে ভাববো আবার কি দেখা হবে। রাজমোহন গান্ধীর সঙ্গে, যাঁর রিভেঞ্জ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন : আন্ডারস্ট্যান্ডিং সাউথ এশিয়ান হিস্টরি, বইটি পড়ে আমিও ভাববো ‘সে দ্য গুড স্পিরিট দ্যাট কুইকেনস দ্য রেইন অ্যান্ড কিনডলস দ্য লাফটার, দ্য ইগারনেস অ্যান্ড দ্য ডেডিকেশন ইউস উইলি উমেন অ্যান্ড মেন টু রিকনসাইল সাউথ এশিয়া’স ইনজেনিয়াস, ইমপসিবল অ্যান্ড লাভেবল ইনহ্যাবট্যাস্টস।’ তখন রাধা চক্রবর্তী আমার বন্ধু, আমার দিকে তাকিয়ে বলে, কবে ফিরবেন ঢাকায়। কেমন হলো সম্মেলন? দিল্লির ত্রিমূর্তি ভবনের উল্টো দিকে ওর বাড়ি। আমরা ডাইনিং টেবিলে বসে কথা বলছি প্রচুর খাবার টেবিলে। ভাবি রাধা যখন পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের লেখকদের গল্প অনুবাদ করে বই প্রকাশ করে সেটাতো শান্তি খোঁজার চেষ্টায় একটি অন্যরকম যাত্রা কিছু মানুষের অনুভব একত্র হলে অন্যরা স্বস্তি পাবে।
রাধা একটি ট্যাক্সি ডাকতে বলে ওর বাড়ির দারোয়ানকে। লোকটি একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস নিয়ে আসে আমার জন্য। আমি যাচ্ছি অন্তরার অফিসে। ওর ‘দ্য লিটল ম্যাগাজিন’ পত্রিকা অফিসে দুজনে কাজ করছিলো। অন্তরা আর প্রতীক কাঞ্জিলাল। যখন চা খাচ্ছি গল্প করছি তখন কলকাতা থেকে ফেন করেন নবনীতাদি। বলেন, শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক ও আরও কিছু জিনিস চুরি হয়ে গেছে। যেন হাইড্রোজেন বোমা ফেটে গেলো এমন একটি খবর। চিড় খেয়ে যায় বুকের ভেতর। কতক্ষণ সময় হাঁসফাঁস করি। প্রতীক গভীর মনোযোগে কম্পিউটারে কাজ করে যাচ্ছে। আমি আর অন্তরা ময়ূরবিহারের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করি, টুকটাক জিনিস কিনি। লোকের ভিড় রাস্তায় হাট বসেছে ভ্যান, রিক্সার ঠেলাঠেলি। আমি নিশ্বাস টানলে মানুষের গন্ধ পাই। এসব মানুষইতো খুঁজি নিয়ত, এদের প্রচ- শক্তি আছে, এরা জাগায় লেখককে। মানুষ নানাভাবে সংগঠিত করে নিজেদের। এই সম্মেলনের সময়ইতো আমি আর জয়া ঠিক করলাম দক্ষিণ এশিয়ার নারী লেখকদের গল্প নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করবো বাংলা ভাষায়। রবীন্দ্রনাথের প্রাণের ভাষা। মানুষেরা তার জীবনদর্শনকে নিজের জীবনে কাজে না লাগিয়ে একটি ধাতব বস্তু নিয়ে সটকে পড়েছে। হায় ঈশ্বর! আমরা, তার উত্তরসূরী নারী লেখকরা এই নগরীতে মাত্র গতকাল নারী শান্তিকর্মীদের আয়োজনে একটি সম্মেলন শেষ করছি। আমাদের বুকের ভেতরে শান্তির বাণী উচ্চারণের প্রতিজ্ঞা। আমার অটো তখন পার হয়ে যাচ্ছে যমুনা নদীর ওপরের নাজিমুদ্দিন সেতু। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আলো ঝলমল শহর। অন্তরা বিদায় দেওয়ার সময় বলেছে ভালো থেকো। আমি যাচ্ছি মনীষার বাড়িতে, আজ রাতে ওর সঙ্গে থাকবো। নিজেকে বলি বেশতো আছি। কত দ্রুত অদ্ভুত সময় পেরিয়ে গেলো একদমই অচেনা একটি নগরীতে। দূর থেকে এই শহরটিকে আমি ভয় পাইÑ কারণ এই শহরে নিয়ন্ত্রিত হয় আমার মতো অসংখ্যজনের নিয়তি।
মনীষার কিশোরী মেয়ে অখিলা রাতের খাওয়ার সময় আমার প্লেটে মুরগির টুকরো তুলে দেয়। কত সহজাত ভঙ্গি অখিলার। এইটুকু বয়সে শিখে গেছে অতিথি আপ্যায়নে নারীর সহজাত মানবিক স্বাচ্ছন্দ্য, তারপরও সমাজের বন্দুকের নল ওর দিকেই তাক করা থাকবে। কারণ ও একটি মেয়ে। যুদ্ধ নারীর স্বামীর জীবন হরণ করেই ক্ষান্ত হয় না, সংসারের সমুদয় দায় চাপে তার ঘাড়ে। অখিলা আমার সামনে সুযোগ্য বালিকা, দায় নেয়ার কায়দা রপ্ত করার যোগ্য হয়ে উঠেছে। ওর চারপাশে অজস্র সাদা ফুল। ওকে ঠেকাবে কে। ওদের বাড়ির বড়সড় তালমেশিয়া কুকুরটি এখন টেবিলের পাশে বসে মনীষার হাত থেকে মুরগির মাংসের টুকরা চিবুচ্ছে। ওর ভঙ্গিতে পুরুষতন্ত্র ফুটে আছে। দীর্ঘদিন ধরে এই একই রকম ভঙ্গি মানুষ ও পশুতে দেখে আসার পরও আমি ভয় পাচ্ছি। ভয় পাচ্ছে না অখিলারা। ওদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ। ওরা ঠিকই মোকাবেলা করতে পারবে। আমার জন্য ঘর ছেড়ে দেয় অখিলা। ওর বিছানায় শুয়ে থেকে আমি অখিলার শরীরের গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করি। ভাবি একদিন নির্মলা দেশপ্রা-ে অখিলার বয়সী ছিলেনÑ এই বয়সকে অতিক্রম করে এসেছেন মোহিনী গিরি পদ্মা শেঠ, সাইয়েদা হামিদ, কমলা ভাসিন, মীরা খান্না। তারা এখন অখিলাদের জন্য স্বস্তিময় পৃথিবী গড়তে চায়। ওদের কণ্ঠে ওম শান্তি ধ্বনি। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার লেখক অলেখক নারীরা ওই শব্দ আঁকড়ে ধরি। ভাবতে চাই আমাদের সামনে কোন পারমাণবিক বোমার হুমকি নেই। পুরুষতন্ত্র নেই। মানুষেরা মানুষ হয়েছে। আখিলা ঘরে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখি। আকাশ দেখা আমার প্রিয় অভ্যাস।
এখন আমি দিল্লি বিমানবন্দরে। সুযুক্তার মুখোমুখি বসে আছি। ও ভীষণ আলাপী মেয়ে। উচ্চতায় পাঁচ ফুটেরও কম, শুকনো শরীর বেগুনি রঙের শাড়ি পরে আছে। গায়ের শ্যামলা রঙে চকচকে আভা, দৃষ্টি উজ্জ্বল। সুযুক্তা তামিলনাড়ুর মেয়ে। ব্যাংককে যাবে আন্তর্জাতিক এইডস সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য। ওর কথা শুনে বুঝতে পারি যে ও ভীষণ উদ্যোগী মেয়ে। চেন্নাইয়ে একটি এইডস গবেষণা কেন্দ্র ও ক্লিনিকের পরিচালক। আমার বিমান ছাড়ার ঘোষণা শুনতে পাচ্ছি। ওর কাছ থেকে বিদায় নেবো। ফিরে যাচ্ছি নিজ দেশে। ওকে বললাম ভালো থেকো। আবার হয়তো কখনো কোথাও দেখা হতে পারে। ও আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললো, তোমার সঙ্গে কথা বলে আমারও ভালো লেগেছে। কিন্তু তোমার সঙ্গে আগামী দিনে কখনো দেখা হবে কিনা আমি জানি না। আমি বিস্ময়ে বলি, কেন? পৃথিবীটা খুব ছোট সুযুক্তা। ও মৃদু হেসে বলে, আমি এইচআইভি ভাইরাস আক্রান্ত। স্বামীকে মনে করেছিলাম বিশ্বস্ত বন্ধু। কখনো টের পাইনি যে অন্য নারীর সঙ্গে ওর দৈহিক সম্পর্ক আছে। ও নিজেও মৃত্যুর দিন গুনছে এবং আমিও। তবে আমি ঘাবড়ে যাইনি। এইডস রোগিদের নিয়ে কাজ করছি। যারা আক্রান্ত হয়নি তাদের সচেতন করার চেষ্টা করছি।
আমি অস্ফুট স্বরে বলি সুযুক্তা!
ও হা হা করে হেসে ওঠে। বলে, তুমি ভয় পাচ্ছো? ভয় পেয়ো না। মানুষের মৃত্যুতো একবারই হবে। সেটা নিয়ে আমি ভাবি না। আমার দুঃখ স্বামীর অবিশ্বস্ততায়। যাকগে। শোনো, আমি আমার বাবার বিরুদ্ধে সম্পত্তির অধিকার নিয়ে মামলা করেছি। মেয়ে বলে বাবা আমাকে বঞ্চিত করবে তা হবে না। তবে এই মামলার রায় আমি হয়তো দেখে যেতে পারবো না। দুঃখ নেই লড়াইটাই সত্য।
আমি বিমূঢ় হয়ে থাকি। আমার মনে হলো সুযুক্তা অনেক বড় জীবনবাদী লেখক। আমি ওর কাছে নগণ্য। ওর এত কথার পরে আমার মুখে কথা জোগায় না। ও বলে, তুমি এবার যাও। তোমার বিমানে ওঠার শেষ কল হয়েছে।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বলি, ওম শান্তি তুমিই আমার শান্তির শক্তি। মনে হচ্ছে আমি নীলগিরি পাহাড়ের কুরুঞ্জি ফুল খুঁজে পেয়েছি।
ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে নিজের ভেতরে আবার নতুন করে শক্তি খুঁজে পায় যুথিকা। এক’দিনে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো। যে আয়োজন করার জন্য এতদিন ধরে তোড়জোড় করছে তার একটি ছবি নিজের ভেতরে স্পষ্ট করে তোলে। বুঝতে পারে যে মিছিলটি করার জন্য ও নিজেকে তৈরি করেছে তার পটভূমি দেখতে পেয়েছে একটি সম্মেলনে সবখানে জাগরণের জোয়ার।
বাড়ি ফিরে এলে ছোটবোন ওকে দেখে বলে, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আপু। দিল্লিতে যে বেশ আনন্দে ছিলে তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।
হ্যাঁ, আনন্দে ছিলাম তা বলতে পারিস। লিখে ডায়েরির পৃষ্ঠা ভরে ফেলেছি। জ্ঞানের সীমা বেড়েছে। দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। নিজেকে ভরাতে পেরেছি রে ময়না পাখি।
ও বাব্বা, তুমি আমাকে একটা নতুন নাম দিয়ে ফেললে।
হা হা করে হাসে যুথিকা। খুশি অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে খালাম্মাÑ
ওরে ছোট্ট খুকি তোমার জন্য একটা সুন্দর জামা এনেছি। তুই দেখলে খুশি হয়ে যাবি।
আমার জামা লাগবে না। আপনাকে চা দেবো?
না, কিচ্ছু দিতে হবে না।
যুথিকা বাথরুমে ঢোকে। খুশি মনে মনে বলে, খালাম্মা এমুনই। নিজের জন্মদিনেও জামা কেনে ওর জন্যÑতারপর সারাদিন ছুটি দেয়। টাকা দেয় ঘোরার জন্য। খালাম্মা বেশি খুশি হয় মামা আসলে। ওর ছোট বয়সের দৃষ্টিতে সেটুকু এড়ায়নি।
বিকেলে অনিমেষ আসে। বাড়িতে যুথিকা একা। দিল্লি থেকে আনা একগাদা ছবি, বই ও কাগজ নিয়ে বসে। যেসব পেপার ওখানে পড়া হয়েছে সেগুলো এখন মনোযোগ দিয়ে পড়বে। কোনটা আগে পড়বে, কোনটা পড়ে পড়বে সেসব বাছাই করে। অনিমেষকে দেখেই বলে, কেমন আছে?
তোমার খবর আগে বলো।
আমি দারুণ কাটিয়ে এসেছি। একটু একটু করে তোমাকে বলবো।
ভালোই হলো, অনিমেষ হো-হো করে হাসে।
কি ভালো হলোÑ
এই, তোমার এখানে রোজ রোজ আসা যাবে।
ভাবটা এমন দেখাচ্ছো যে আমার এখানে আসতে তুমি বাধা পাও? তুমি স্ত্রী মারা যাবার পরেÑ
থাক যুথিকা, আমাদের কাজের খানিকটা এগিয়েছে। পল্লব এসেছে বরিশাল থেকে। ও বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলে এসেছে। শ্যামলী দিনাজপুর থেকে ফিরেছে। মনিরা কুষ্টিয়া থেকে। চারদিকের খবরই ভালো। মিছিলটা বেশ বড় হবে বলে মনে হচ্ছে।
এতো খবর জমেছে আমার জন্য। আমি ভাবতে পারছি না।
দেখি তোমার ছবিগুলো।
অনিমেষ ছবি দেখায় মনোযোগী হয়ে যায়। যুথিকা ওকে চার-পাঁচটা বই দিয়ে বলে, সব তোমার। নাও।
অনিমেষ বই হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, যাচ্ছি। কখন আমার কাজটা নিয়ে বসবো আমাকে জানিও।
চা খাবে না?
না, জরুরি কাজ আছে। মীরপুরে একজন নারীর সঙ্গে কথা বলতে যাবো। বস্তিতে থাকে। খুব অসুস্থ। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে যুথিকা।
কামরাঙ্গিচরের আমেনা ভালো আছে তো?
আছে। তোমাকে যেতে বলেছে। তোমার সঙ্গে নাকি ওর আরও কথা আছে। কাল যাবে?
যাবো। আমি একাই চলে যাবো।
অনিমেষ ভ্রƒ কুঁচকে বলে, পারবে?
মানে? কি বলতে চাও? পুরো দেশ চষে বেড়াচ্ছিÑ
আহা তা বলিনি। ওই ঘুপচি-ঘাপচি খুঁজে বাড়িটা বের করা-
অনিমেষ তোমার এসব শুনতে আমার খুব খারাপ লাগছে।
আমি আসছি।
খুশি চা নিয়ে আসে। সঙ্গে হালুয়া।
মামা চা?
এখন চা খাবো না।
খাবেন না? না, তা হবে না। হালুয়াটা খান মামা। খেতেই হবে।
নাও, এখন বোঝ ঠেলা। বোস অনিমেষ।
অনিমেষ ট্রে থেকে হালুয়ার বাটিটা নিয়ে সোফায় বসে। চটপট খেয়ে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে আসে। যুথিকার মনে হয়, অনিমেষের আসলেই তাড়া আছে।
কিন্তু অনিমেষ চলে যাওয়ার পরে ওর আর কোনো কাজে মন বসে না। মনে হয় অনিমেষের পিছু পিছু ওর ভাবনার অনেকখানি চলে গেছে। ও অনিমেষের ফেলে যাওয়া চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে চুমুক দেয়।
যুথিকার আজ জন্মদিন।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছিল, আজ জামিরুলের সঙ্গে দেখা হতে পারে। পরক্ষণে নিজেকে শাসিয়েছে, বাজে ভাবনা। এই বয়সে এসব মানায় না। মানাবে না কেন? জামিরুলের কথাতো জন্মদিনের সঙ্গেই বেশি জড়িয়ে আছে। অন্যসময় জামিরুলের স্মৃতি ফিকে হয়ে থাকলেও জন্মদিনের সময় জামিরুলের স্মৃতি প্রবল হয়ে ওঠে। ওটা ভুলে থাকার কোনো উপায় নেই যুথিকার। পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে জামিরুল ওর জীবনে নেই।
নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলে, তবুওতো আজ আমার জন্মদিন। আজ স্কুল ছুটি। কাজে যাবার তাড়া নেই। বোনের যে ছেলেটি এখন ওর কাছে থাকে দু’দিন আগে ও দেশের বাড়িতে গেছে। আরও পাঁচদিন পরে ফিরবে।
আলস্য নয়, বিছানা ছাড়তে ভালো লাগছে না অন্য কারণে। আজ ভোরে সূর্য ওঠা ওর জন্য সফল হয়েছে, নাকি? এই মুহূর্তে বিছানাই প্রিয় জায়গা। স্মৃতিচারণের জন্য উপযুক্ত বটে। চিৎ হয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়, উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে রাখা যায়, কাত হয়ে বিছানায় আঁকিবুঁকি টানা যায়, আর স্মৃতিগুলো জড়ো হয়ে আসে। গায়ে গা লাগিয়ে বিছানার আঁকিবুুঁকি রেখায় নিজেদের অদৃশ্য অবয়ব উজ্জ্বল করে তোলে।
স্মৃতির শরীর? হ্যাঁ বটেই তো। আকার ছাড়া নিরাকারকে কি অনুভব করা যায়। স্মৃতি এই মুহূর্তে জামিরুল। ওর সুঠাম শরীর, ঝাঁকড়া চুল, ভোঁতা নাক, মিশমিশে কালো গায়ের রং, সেই সঙ্গে উজ্জ্বল বড় বড় চোখ। আহ্, জামিরুলকে ভাবনায় যতটুকু ধরা যায়, তারচেয়েও বেশি কিছু ছিল ও। তারপরও যুদ্ধের সময় একদিন ক্যাম্পে বলেছিল, এত ছোটখাটো শরীর নিয়ে তুমি আমার চেয়ে বেশি সাহসী যুথি।
হ্যাঁ, সাহস! যুথিকা চিৎ হয়ে ছাদ দেখে। মাকড়সা জাল বানিয়েছে ছাদে। সে জালে ধরা পড়েছে একটি ছোট তেলাপোকা। এটি একটি দৃশ্য। ক্লাসের ছেলেমেয়েদের ইতিহাস পড়ানোর সময় উদাহরণ হিসেবে এই দৃশ্যের কথা বলা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের তৈরি জালে এভাবে ধরা পড়তো পাকিস্তানি সেনারা।
যুথিকা কাত হয়ে তর্জনি দিয়ে বিছানার চাদরে আঁকিবুঁকি কাটে। আজ ওর জন্মদিন। দিনটি ঘুরেফিরে ওর ভেতরে কাজ করছে। জামিরুলের কণ্ঠের সাহস শব্দটি গভীর আনন্দ নিয়ে ওর স্মৃতিতে এখন সঞ্চিত আছে। ওই জায়গাটুকুতে কোনও ক্ষয় হয়নি। কিন্তু সে সময়ে জামিরুলকে বুঝতে পারেনি ও। ওর এই সাহসটুকুই মানতে পারেনি জামিরুল। ওর পৌরুষে বেধেছিল। অথচ সামনে কখনও বলেনি, মেয়েদের এত সাহস ভালো না যুথি। সাহস মেয়েদের মানায় না। জামিরুল সৌজন্য বুঝতো, ভালোবাসার মর্যাদা দিতে জানতো। কষ্ট দিয়েছে নিজেকে। যুথিকার সাহসকে অতিক্রম করতে না পারার কষ্ট। যুদ্ধের সময়ে একজন যোদ্ধার সাহস থাকবে না একথা বলা বড় বেশি বেমানান ছিল। নিজেকে এতখানি খাটো না করার যুক্তি ওর ছিল। ভদ্রতাবোধও ছিল। জানতো কোথায় কখন কিভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। এমন এটি ছেলেকে ভালো না বেসে উপায় ছিল না যুথির। পরিচয়টাতো যুদ্ধের সময়ে হঠাৎ করে হয়নি। যুদ্ধের আগেই পরিচয়ের শুরু, তখনতো জামিরুলের সুযোগ ছিল না যুথিকার সাহস দেখার। সে সাহস না দেখে জামিরুল ওর প্রেমে পাগল ছিল। যুথিকারও সাড়া ছিল। ওর মনে হয়েছিল জামিরুলই ওর খুব কাছের মানুষ হতে পারে। ওর ভালোবাসায় হ্যাঁ না বলে কি উপায় আছে?
একদিন কলেজ থেকে ফেরার সময়ে একলা পেয়ে যুথিকাকে একটা লাল জবা এগিয়ে দিয়ে জামিরুল বলেছিল, তোমার জন্মদিনের উপহার।
জন্মদিন? আজতো আমার জন্মদিন না।
জামিরুল মাথা ঝাঁকিয়ে উজ্জ্বল হাসিতে নিজেকে প্রদীপ্ত করে বলেছিল ভালোবাসার জন্মদিন। প্রেম মানুষকে জন্মের নতুন দিন দেয়।
তাই? যুথিকা বিপুল বিস্ময়ে জামিরুলের দিক তাকিয়েছিল। এখন থেকে তোমার জন্মদিনেও আমি একটি করে ফুল দেবো। সেদিন দেবো বেলি ফুল। তোমার জন্ম তারিখটা আমাকে জানিও।
যুথিকা জামিরুলের হাত থেকে জবাটা নিয়ে ছুট দিয়েছিল। সে কিছু ছুট, এমন করে দৌড়াতে যে পারে তা ওর জানা ছিল না। এতদিন যেভাবে দৌড়িয়েছে এ তার থেকে একদম আলাদা। কোনো কোনো বিষয় নিজের কাছে এতো গোপন থাকে যে টের পাওয়া যায় না। কখন স্পষ্ট হয়ে উঠবে তাও বোধের বাইরে থাকে। ভাবে, এই জানাটা ক্লাসের স্যারের কাছ থেকে জানা হয় না। ক্লাসের স্যার বা আপারা এইসব বিষয় শেখায় না। শেখালে কি ভালো হতো? বোধহয় না, একদম নাÑ যুথিকা নিজেকে উত্তর দেয়। আগে থেকে জানা থাকলে অনুভব গাঢ় হয় না, জানার আনন্দ গভীর হয় না এবং আকস্মিক জানার মজা থাকে না। তারপর নিজের মনে হাসতে হাসতে বাতাসের বিপরীতে থমকে দাঁড়ায় যুথিকা।
পেছন থেকে কে একজন ডেকেছে।
এই মেয়ে এমন করে দৌড়াচ্ছিস কেন? মেয়েটার দস্যিপনা আর গেলো না। কাদের মিয়া মেয়েটাকে মানুষ করতে পারলো না।

ও ভুরু কুঁচকে বলেছিল, মানুষ করা কি?
মানুষ করা হলো, এমন একটা ঢ্যাংগা মেয়েকে বনে বাদাড়ে ঘুরতে না দিয়ে বিয়ে দেওয়া।
বাবাতো বুবুকে বাল্যবিয়ে দিয়েছিল। শ্বশুরবাড়ি থেকে মার খেয়ে ফিরে এসে গলায় দড়ি দিয়ে মরে গেলো বুবু। তখন কি করেছিলেন? পেরেছিলেন মানুষ করতে?
যুথিকা দৌড়ুতে শুরু করে আবার ফিরে এসে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে বলেছিল, বাবা আমাকে মানুষ করতে পারবে না। কারণ আমি বাবার কথা শুনি না। বাবাকেই আমার কথা শুনতে হয়। ও আবার দৌড় দেয়। হাতে টকটকে লাল জবা। আস্তে আস্তে পাপড়িগুলো ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিতে থাকে। সেই জামিরুল এখন ওর জীবনে নেই।
যুথিকা বিছানায় উঠে বসে। না, কোনো বিষাদ নেই। একা থাকার যন্ত্রণাও নেই। হাত বাড়িয়ে পাশের ছোট টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা নিয়ে একটানে পানি খেয়ে শেষ করে। ঘড়ির দিকে তাকায়। কাজের বুয়া আসার এখনও সময় হয়নি। আজ ও লুচি আর আলুর দম খাবে। লুচি বুয়া ভাজবে, দম ও নিজে করবে। বেশতো সময় কেটে যায়। এরপর ছেলেমেয়েদের খাতা দেখবে।
আজ খুশির ছুটি। ও পাশের বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে শিশুপার্কে ঘুরতে যাবে। কিন্তু বিছানা ছাড়তে চাইলেও ছাড়া হয় না যুথিকার। আবার সেই পুরনো দৃশ্য। মনের ভেতরের কুঠুরিগুলো স্মৃতির সঞ্চয়ে পূর্ণ। জামিরুল বলেছিল, যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন তোমার জন্মদিনে একটি করে ফুল দেবো।
ওই একবারের পরে আর ফুল দেয়া হয়নি জামিরুলের। আর একটি জন্মদিন আসার আগেই দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তবে জন্মদিনটা দুটো উল্লেখযোগ্য ঘটনার কারণে ওকে স্মরণ করতে হয়। স্মৃতির কুঠুরি বড় নির্মমভাবে উদোম করে দেয় ক্ষত।
ক্যাপ্টেন হুদা বললেন, আমার সুইসাইড স্কোয়াড দরকার। আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন করতে হবে। তোমাদের মধ্যে কে কে জীবন দিতে রাজি আছ বলো? আমার হাতে বেশি সময় নেই।
ওরা তেরো জন ছেলে এবং সাতজন মেয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতর ধুকপুক ধ্বনি। গতকালই রতœা, জামিরুল আর নেপালকে রেকি করার জন্য পাঠিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা। রেকির স্থান শর্ষীণার পীরের বাড়ির সামনের লঞ্চঘাট আর বাজার। ওরা রেকি করে এসেছে। খবর পাওয়া গেছে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন মুর্তোজা, যে বর্বর, নিষ্ঠুরতার জন্য এলাকার লোকের সামনে ভয়াবহ ত্রাস, সে আসবে ওই পীরের বাড়িতে। ক্যাপ্টেন হুদা তার লঞ্চ আক্রমণ করার সুযোগটা ছাড়তে চান না।
চুপ করে থাকা ছেলেমেয়েদের সামনে হঙ্কার দিয়ে বলেন, এই সাহস নিয়ে তোমরা যুদ্ধ করতে এসেছো? ভীরু কাপুরুষের দল।
সঙ্গে সঙ্গে যুথিকা আর রতœা সামনে এগিয়ে গিয়ে বলে, আমরা অপারেশনে যেতে রাজি আছি। আমাদের ব্রিফ করুন স্যার।
ক্যাপ্টেন হুদা বললেন, তোমরা দু’জন থাক। বাকিরা বাইরে যাও। না, দাঁড়াও। তোমরাও শোন ক্যাপ্টেন মুর্তোজা মাত্র সাতদিন আগে পিরোজপুর ক্যানটনমেন্টে এসেছে। এখানে এসেই ও হিন্দুদের মেরে বিনাশ করেছে। ও একটা আজরাইলের মতো কাজ করছে। এই ঘৃণ্য মানুষটিকে আমি মুক্ত থাকতে দিতে চাই না।
ছেলেরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। মাত্র কয়েকদিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে ওরা এত দুঃসাহসী কাজে যুক্ত হতে সাহস পাচ্ছে না। ওদের কারো কারো ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ওরা ক্যাপ্টেনের সামনে থেকে সরে যেতে চায়। এদের সঙ্গে জামিরুলও আছে।
ও যুথিকার দিকে তাকায় না। মাত্র গত রাতে রাইফেল, গ্রেনেড বহন করে ওরা একদল মুক্তিযোদ্ধা আট মাইল পথ হেঁটে ক্যাম্পে ফিরছে। যুদ্ধের পোশাক পরা যুথিকার কোনো ক্লান্তি ছিল না। বসতে চায়নি কোথাও, চা খাওয়ার কথা বলেনি! গত রাতেও জামিরুল টের পেয়েছে যুথিকার সাহস ও শক্তি দুটো একই রকম। ও হার মানতে শেখেনি।
ক্যাপ্টেনের ইঙ্গিতে ছেলেরা বেরিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন যুথিকা আর রতœাকে বসতে বলেন। তারপর ধীর, গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ক্যাপ্টেন মুর্তোজাসহ লঞ্চটি তোমাদের উড়িয়ে দিতে হবে। তিনটি লঞ্চ কচা নদীর ঘাটে এসে নোঙ্গর করবে। প্রতিটি লঞ্চেই অস্ত্র এবং সেনারা থাকবে। মাঝের ছোট লঞ্চটিতে থাকবে ক্যাপ্টেন মুর্তোজা। তোমরা দু’জনে একটি করে হ্যান্ড গ্রেনেড ও একটি রিভলবার পাবে। রাত নয়টা তোমাদের অপারেশনের টাইম। যাও তৈরি হয়ে নাও। যজ্ঞ ওর নৌকায় তোমাদের চরে নামিয়ে দিয়ে আসবে।
যুথিকা কলিং বেলের শব্দ শুনতে পায়। বুয়া এসেছে হয়তো। এবার ওকে বিছানা ছাড়তেই হয়। আজ ও নিজেই ফুলদানিতে একটি জবা রাখবে। প্রতি জন্মদিনেও তাই করে। এখনও ওর বুকের ভেতরে জামিরুলের জন্যই তৃষ্ণা আর কেউ সামনে এসে দাঁড়াতেই পারলো না। যুথিকা বুয়াকে দরজা খুলে দেয়। দেখতে পায় ড্রইংরুমের কার্পেটের ওপর খুশি ঘুমিয়ে আছে। অন্যদিন ও চিৎকার করে খুশিকেই ডাকতো দরজা খোলার জন্য, আজ ওর জন্মদিন। নিজের আনন্দেই মেয়েটাকে পুরো দিনের ছুটি দিয়ে দেয়।
কেমন আছেন খালা?
ভালো রে। তুই কেমন আছিস?
আমি ভালো। কিন্তু মায়ের জ্বর, কাজে যেতে পারেনি। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মনে হলো জ্বরের ঘোরের মধ্যে আছে।
ওষুধ দিয়েছিস?
দেইনি। আপনার কাছ থেকে দুটো প্যারাসিটামল নিয়ে যাবো ভেবেছি। দেবেনতো খালা?
যুথিকা মৃদু হেসে বলে, দুটো প্যারাসিটামলের জন্য এমন করে বলতে হয়। তোকে দুটো নয়, এক পাতা প্যারারিটামল দেবো।
আজ আপনার মনটা ভালো দেখছি খালা। মর্জিনা মৃদু হাসে। সবসময় খালাকে এমন মুডে পাওয়া যায় না। ও বলে আজতো ইস্কুল ছুটি, আপনি সারাদিন বাড়িতে থাকবেন তো?
হ্যাঁ থাকবো। আজ আমার জন্মদিন মর্জিনা।
ওমা, এই কথা। তা আগে বলবেন তো। আমাকে কি কি করতে হবে?
অনেক কিছু করতে হবে।
আগে ঘরগুলো ঝাড়ু দিয়ে ফেলি।
যুথিকা ওর কথার জবাব না দিয়ে বাথরুমে ঢোকে। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিলে বিশ্বাসই হতে চায় না। যে পঁয়তাল্লিশেরও বেশি বছর পার করে দিয়েছে। কেমন করে কেটে গেলো টেরই পেলো না। জীবনের বোঝাপড়া খুব শক্ত হাতেই করতে পেরেছে। ডানে-বামে মানুষকে উপেক্ষা করে, পাশ কাটিয়ে, ভালোবেসে বেঁচে থেকেছে। কোথাও ঘাটতি রাখতে চায়নি। ঘাটতি নেই এই বিশ্বাসে স্থিত হতে পেরেছে। স্বামী-সন্তান পাওয়ার চেষ্টা করেনি। জামিরুলকেই ধ্রুব সত্য বলে ভালোবাসার আকাশ দেখেছে। এর জন্য ওর নিজের কোনো দুঃখ নেই। তাহলে আর কি? মানুষকে তো নিজের অভাবকেই আমল দিতে হয়। সেটা যে উৎরাতে পারে সেইতো বিজয়ী।
যুথিকা আজ আর তোয়ালে ব্যবহার করে না। নিজের আঁচলে মুখ মোছে। খিদে পেয়েছে। রাতে দুধ রুটি খেয়েছিলো। বোঝা যাচ্ছে তার কনাকুচিও পেটে নেই।
খালা।
বল।
এখন কি করবো?
আমরা লুচি আর আলুর দম বানাবো। খুশি, তুই আর তোর মা আমার জন্মদিনে অতিথি।
ওমা, কি মজা! আপনাকে কি উপহার দেবো?
একটা জবা ফুল।
তাহলে নিয়ে আসি।
পরে। আগে খাওয়া দাওয়া। খিদে পেয়েছে।
মর্জিনা ময়দা মাখতে বসে। যুথিকা আলু কাটে।
খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ওর তেমন বাছ-বিছার নেই। আয়োজনও সামান্যই থাকে। ফল, দুধ এসবেই ওর নির্ভর। আর পায়েস মিষ্টিতে ওর লোভ। ভালোই দিন কাটে। কোনো কিছুতে ওর অতৃপ্তি নেই।
রাতে কিনে আনা বালতির পানিতে রাখা ফুলগুলো ঘরের বিভিন্ন ফুলদানিতে সাজিয়ে খুশি এসে রান্নাঘরে বসে। যুথিকার কিনে দেয়া নতুন জামাটা পরে ও। আনন্দে ওর মুখ জ্বলজ্বল করে। মর্জিনা ওর দিকে একনজর তাকিয়ে বলে, মনে হয় খুশিরই জন্মদিন। নাকি রে খুশি?
খুশি, লজ্জায় মুখ নামায়। বলে, আরেক জনমে আমি খালার মাইয়া হয়ে জন্ম নিবো।
তোরতো মেলা বড় সাধ রে খুশি।
সাধতো থাকবে, একশোবার থাকবে।
খুব ভালো তোর সাধের কথা শুনে আমার খুশি লাগছে। আজ তোকে দুইটা লুচি বেশি দেবো।
হি-হি করে হাসে খুশি। হাসতে হাসতে দু’হাতে মুখ ঢাকে।
মর্জিনা বলে, খালা।
বল।
আপনের জন্মের কথা মনে আছে?
জন্মের সময়ের কথা কি কারো মনে থাকে? ওই সময়ের কথা পরে অন্যদের কাছে শুনছি।
আমার জন্মের কথা মনে করলে খুব মন খারাপ হয়।
কেন রে?
জন্মের পরে বাবা আমার মুখ দেখেনি। মাও অনেক বকাবকি করতো। মা এখনও বলে, তুই আমার একটা বোঝা। মায়ের কাছাকাছি থাকি, সব কাজ করে দেই তারপরেও মায়ের মন পাই না কেন খালা?
তোর এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আমার জন্মসময়ের কথা তোকে বলি মর্জিনা।
শুনবি?
আজ আপনার জন্মদিন। আর জন্মদিনের কথা শুনবো না? বলেন খালা।
যুথিকা খানিকটা আনমনা হয়। খানিকটা বেদনা অনুভব করে। বলে, আমরা পাঁচ বোন এক ভাই। আমি ছিলাম সবার ছোট। আমার জন্মের আগেই আমার বড় বোনকে বাল্যবিয়ে দিয়েছিল বাবা। যথাসাধ্য দিয়েথুয়েই বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন আমার বোনকে। তারপরেও বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে আমার বড় বোন পুরো গায়ে মারধরের চিহ্ন নিয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে আসে। শুধু স্বামী মারতো না, শাশুড়ি-ননদরাও কারণে-অকারণে মেরেছে। খেলতে গেলে চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে কাজে লাগিয়েছে।
বুবু যেদিন বাড়িতে ফিরে আসে সেদিনই আমার জন্ম হয়। বাড়ি এসে বুবু শুনতে পায় মা আঁতুড়ঘরে। এবং মায়ের একটি মেয়ে হয়েছে। মেয়ের কথায় বুবুর মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। বুবু আঁতুড়ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, তুমি আবার একটা মেয়ের জন্ম দিলে মা? সেদিনই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল বুবু। মর্জিনা এই হলো আমার জন্মদিনের গল্প। ছোটবেলা থেকেই বোনদের কাছে এই গল্প শুনেছি। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবার কাছে এই গল্প শুনেছি। শুনতে শুনতে আমার মাথায় ঘূর্ণি উঠতো, সব কিছু ছিঁড়েছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করতো। বুঝলি মর্জিনা দুটো ঘটনা আমার জন্মদিনকে কষ্ট আর আনন্দ দেয়।
আনন্দ কী ছিল?
একজন আমাকে ফুল দিয়ে বলেছিল ওর মরণ পর্যন্ত আমাকে ফুল দিয়ে যাবে। কই আজকে তো ফুল পাঠায়নি। কখন পাঠাবে খালা? কি ফুল পাঠাবে?
ইয়ে, মর্জিনা তাড়াতাড়ি লুচিটা ভেজে শেষ করো। যা খিদে পেয়েছে না।
এইতো হয়ে গেছে। খালা আপনি টেবিলে যান। আমি আনছি।
যুথিকা বাথরুমে ঢুকে আবার হাতমুখে পানি দেয়। ভিজে তোয়ালে দিয়ে ঘাড় গলা মুছে ফেলে। ইদানীং ঘাম বেড়েছে। যখন তখন ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে যায়। আজও তাই হয়েছে যুথিকা টেবিল এসে বসে। মর্জিনা লুচি, আলুর দম আলমারি থেকে কাচের বাটি বের করে সাজিয়ে দিয়েছে। ব্লেন্ডারে আনারসের জুস করেছে। পাকা পেঁপে কেটেছে। দই আছে। ন্যাপকিনও দিয়েছে। মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমতী। কিন্তু এত কিছু আয়োজন সত্ত্বেও যুথিকার খাওয়ার ইচ্ছা উবে যায়। ও একটা লুচি ছিঁড়ে মুখে পোরে। আলুর দম ধরেও না। দুটো লুচি খেয়ে উঠে পড়ে। মর্জিনা ফুল আনতে গেছে। যুথিকা গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। সেই অপারেশনের পরে জামিরুল ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়। শুধু বলে, ইন্ডিয়ায় যাচ্ছি। ওখানে গিয়ে ভালো করে ট্রেনিং নেবো। যুদ্ধ করবো।
যুথিকা হেসে বলেছিল, তুমি কি পালাচ্ছো?
যুথিকা তোমার প্রচ- সাহসের সামনে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। আমি তোমার মতো সাহসী হতে পারবো না। ভেতরেই সেই জায়গা তৈরি হয়নি। তোমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সময় এখন নয়। এখন শত্রু মোকাবেলা করার সময়। আমাদের এক ক্যাম্পে না থাকাই ভালো। আমি অন্য ক্যাম্পে চলে যাচ্ছি। দেশ স্বাধীন হলে আমাদের দেখা হবে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পঁচিশ বছরের বেশি সময়ে জামিরুলের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। যুথিকা আশা ছাড়েনি। ওর বারবারই মনে হয় জামিরুল বেঁচে থাকলে একদিন না একদিন আসবে। ও কোথাও না কোথাও আছে। কেন এমন একটি প্রত্যাশা তার কোনো ব্যাখ্যা নেই যুুথিকার কাছে। এখন এই নিঃসঙ্গ জীবনের জন্মদিনের সকালবেলায় সেদিনটিইতো স্মরণ করার উপযুক্ত সময় যেদিন ও আর রতœা রাত নটায় কোমরে রিভলবার গুঁজে আর গ্রেনেড দুটো নিয়ে যজ্ঞ কাকার নৌকায় উঠেছিল। পীরের বাড়ির সামনে নদীর চর। চর থেকে একটি কাঠের সিঁড়ি গিয়ে মিলেছে কচা নদীর জেটিতে। জেটির কাছে নোঙ্গর করা আছে তিনটি লঞ্চ। লঞ্চের সার্চ লাইট ঘুরছে চারদিকে। রাজাকারদের উৎসাহ বেশি। পাহারার কাজটা ওরা করছে। যেদিকে সার্চ লাইট পড়ছে সেদিকটা আকস্মিকভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। যজ্ঞ খুব সাবধানে সার্চ লাইটের আলোর পাশ কাটিয়ে এগোচ্ছে। মাঝে মাঝে হেঁউলি ঝোপের আড়ালে নৌকা লগি পুঁথে থামিয়ে রাখছে। পাটাতন সরিয়ে ওদের নিচে বসানো হয়েছিল, যাতে সার্চ লাইটের আলোতে ওদের স্পষ্ট দেখা না যায়। যজ্ঞ তার বাচারি নৌকায় এক বাজার থেকে অন্য বাজারে মালামাল পৌঁছে দেয়। চোখে ধুলো দেয়ার জন্য বেশ কয়েকটি বালুর বস্তা রাখা হয়েছে, কয়েক কাঁদি কলাও আছে। তারপরও ভয় কাটে না। ভয় সময়কে, কারণ এখনতো বাজারে যাওয়ার সময় নয়। রাজাকারদের সন্দেহ হতেই পারে। লম্বা বড় নৌকাটায় ওরা মাত্র দু’জন মেয়েÑ মাথার ওপর নির্মেঘ আকাশ। ভাঙ্গা চাঁদ। শুক্লপক্ষের রাত ওদের জীবনে অনেক এসেছে- কিশোরী বয়সে পূর্ণিমা রাতে ছিবুড়ি খেলেছে কত- কিন্তু আজকের রাত অন্য রকম। বেঁচে থাকলে মনে করবে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ রাত, বাসর রাতের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ আর মরে গেলে তো ভাবাভাবির কিছু নেই। স্বাধীনতার অসংখ্য শহীদের মতো তারাও শহীদের কাতারে শামিল হয়ে যাবে। রতœা ফিসফিস করে বলে, যুথি আমার মনে হচ্ছে আমাদের হাতেই শুয়োরটা মরবে। আজ ওর শেষ রাত।
পীরের বাড়ির গলা পর্যন্ত ভোজনÑ
কথা শেষ হয় না। দু’জনে হি হি করে হাসে। যজ্ঞ সঙ্গে সঙ্গে বলে, হাসবেন না দিদিমণিরা।
আপনার ভয় করছে যজ্ঞ কাকা?
ডর? ডর আবার কি? মোর কোনো ডর নাই। মোর জীবনডা তিনকাল গিয়া এককালে ঠেকছে। ডর আপনেগো লাইগা।
আমাদের তো কোনো ভয় নাই।
ডর তো রাজাগাররা। অরা যদি কামডা শ্যাষ করণের আগে আপনেগোরে ধইরা ফালায়। কামডা করবো কেডা? এই রহম সুযোগ কি আর আইবে?
যজ্ঞ কাকা আমাদের চেয়ে বেশি সাহসী।
আমাদের জীবনের জন্যও কাকার কোনো মায়া নেই। কাকা চায় সাকসেসফুল অপারেশন। ব্রেভো কাকা। জয় বাংলা।
চরের উত্তর দিকে বাচারি নৌকা এসে ঠেকে। দু’জনে লাফ দিয়ে নামে। কাদায় পা দেবে যায়। ওরা ঘাবড়ায় না। দ্রুত পা টেনে হেঁউলি বনে ঢুকে যায়। ঘন ঝোপের আড়ালে অবস্থান নেয়। লগির খোঁচায় নৌকাটা সরিয়ে নেয় যজ্ঞ। অল্পক্ষণ মাত্র। এর মধ্যে টহলদার রাজাকারদের ছিপ নৌকা এসে লাগে যজ্ঞের নৌকার সাথে। বাচারি নৌকায় টর্চ মেরে দেখে। একজন নৌকার উপরে উঠে যায়। পাটাতন উল্টায়। তারপর টর্চটা সরাসরি যজ্ঞের মুখের উপর মেরে বলে, মাল কৈ?
বাজারে নামায়ে দিয়া আসছি। বাকিগুলা কাইলকা আবার নিয়া যামু।
তো এখানে কেন আসছিস?
হাগতে।
ওরে শালা হাগার আর জায়গা পাস না।
প্যাডে কামড় দিল যে।
যা ভাগ।
দু’জনে হেঁউলি বনে বসে ওদের কথা শোনে। ওরা বুঝতে পারে ক্যাপ্টেন মুর্তোজার পীরের বাড়িতে আসার কারণে রাজাকাররা জোরদার টহল দিচ্ছে। ওদের উৎকণ্ঠার শেষ নেই। রতœা ফিসফিস করে বলে, রাজাকারগুলো বাঙালি না?
হলে কি হবে, বেজন্মা।
দু’জনে আবার চুপ করে থাকে। হেঁউলি বনে বাতাসের কাঁপন। দুলছে মাথা। হেঁউলি দিয়ে চমৎকার মাদুর বানায় শেফালির মা। এই করে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে দিন চালায়। এখন থেকে পাঁচ বছর আগে স্বামী তাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেছে জানে না। শেফালি জানারও চেষ্টা করেনি। বরং স্বস্তির সঙ্গে বলে, বোঝা নাইমা গেছে। যাক।
শেফালি দিদির কথা মনে হচ্ছে রতœা।
এই হেঁউলি বনে বসে থেকে আমারও তার কথা মনে হচ্ছে। মানুষটা খুব সাহসী।
আবার ওরা চুপ করে। নিজেদের প্রস্তুত করে। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টিতে অন্ধকার গাঢ় হয়। বৃষ্টি দেখে ওরা দু’জনে খুব খুশি হয়। বৃষ্টিতে রাজাকারদের টহল কমে যায়। ছিপ নৌকা দূরে চলে গেছে। ওরা দু’জনে হেঁউলি বনের ভিতরে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের কাছ থেকে এক শ’ গজ দূরে লঞ্চ। টিপটিপে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে শার্ট ট্রাউজার। হেঁউলি বনের কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে যুদ্ধের পোশাক। খানিকটা শীত করছে। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে শরীর। হেঁউলির পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা ঝাঁকুনিতে ওদের আরও বেশি করে ভিজিয়ে দিচ্ছে। কোনো কিছুতে ওদের ভ্রƒক্ষেপ নেই। লক্ষ্য একটাই। মাঝে মাঝে সার্চ লাইটের আলো এসে পড়ে হেঁউলি বনে। তখন ওরা মাটিতে শুয়ে যায়। মিশে থাকে কাদার সঙ্গে। বুকের ভেতর ধুকপুকি। সার্চ লাইটের আলো একটু পরপর বনের ওপর এসে পড়লে বনটা আলোকিত হয়ে যায়। তখন আর এগোনো যায় না। ফলে নদীতে নামতে দেরি হচ্ছে। ওরা নিজেরাও দেরির জন্য উস্্খুস করছে। জলে না নেমে লঞ্চে গ্রেনেড ছোড়া যাবে না। ওরা হ্যান্ড গ্রেনেডের রিং দুটো হাতে নিয়ে আন্দাজ করে নেয়। এক সময় সার্চ লাইটের আলোতে ওরা খেয়াল করে যে কচুরিপানার বড় একটি চাক ভাটির টানে লঞ্চের গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। ওদের লক্ষ্য মাঝের লঞ্চ। ক্যাপ্টেন হুদা বলে দিয়েছেন স্টিল বডির সাদা লঞ্চে থাকবে ক্যাপ্টেন মুর্তোজা। সামনের লঞ্চে আছে অস্ত্রশস্ত্র আর পাকিস্তানি সেনারা। পেছনের লঞ্চে রাজাকার আর মুর্তোজার সিকিউরিটি ফোর্স। দু’জনেই দূর থেকে খেয়াল করলো যে স্টিল বডি সাদা লঞ্চটির ইঞ্জিনের কাছাকাছি জায়গাটা আড়াই ফুটের মতো ভেসে আছে জলে, আর সেখানে শেকলের মতো কি একটা ঝুলে আছে। এটি তোমাদের জীবনের চরমতম পরীক্ষা, বলেছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা। তার শাণিত দৃষ্টি ওদের চোখে আলো ফেলছিলো। ওরা ঘাবড়ায়নি। পিছু হঠার কথা ভাবেনি। মনে মনে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল স্বাধীনতার জন্য। এখন এই মুহূর্তটি অতিক্রম করতে হবেÑ যে কোনো মূল্যে। কৌশল বের করতে হবে। কি করা!
রতœা ফিসফিসিয়ে বলে, সার্চ লাইটের আলোতে জলে নামাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
যুথিকা জোর দিয়ে বলে, ক্যাপ্টেন হুদার নির্দেশ আজকের অপারেশনে সফল হতেই হবে।
কাদার মধ্যে শুয়ে আছে দু’জনে। যুথিকা একটু মাথা উঠিয়ে বলে, দেখ রতœা আলোতে সব জায়গাই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু জেটির সাথে সিঁড়িটা যেখানে মিলেছে সেখান থেকে দশ-বারো গজ পর্যন্ত অন্ধকার। একদম নিচ থেকে আলো না ফেললে ওই জায়গাটাতে কিছুই দেখা যাবে না। আজকের অপারেশনে যদি বেঁচে যাই, ওই জায়গাটা হবে আমাদের আশ্রয়স্থল।
ঠিক বলেছিস। রতœা সায় দেয়।
বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। প্রবল ঝাপটায় কাঁপিয়ে দেয় ওদের। লঞ্চ থেকে রান্নার গন্ধ আসছে। বৃষ্টির কারণে টহলদাররা ঘন ঘন সার্চ লাইটের আলো ফেলছে। রান্নার গন্ধে রতœা বলে, তোর কি খিদে পাচ্ছে যুথি?
ইয়ার্কি করবি না রতœা।
বাহ্্ এত সুন্দর গন্ধ।
ফুঃ শত্রুর রান্না, তার আবার গন্ধ কি? পাদের মতো গন্ধ।
বাব্বা, তুই এত কট্টর।
শত্রুকে আমি শত্রু হিসেবেই বুঝি। তুই আর কথা বাড়াবি না। আমি এখন স্রোতের দিকে খেয়াল রাখছি। ওই দেখ আমাদের পাঁচ-ছয় গজের মধ্যেই ভেসে আসছে দুটো কচুরিপানার চাক। ওগুলোকে মাথার ওপর নিয়ে নিজেদের আড়াল করে আমাদের নেমে পড়তে হবে জলে। এছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই।
যে কথা সেই কাজ। আলো ঘুরবার এক ফাঁকে কচুরিপানা ধরে গলা পানিতে নেমে পড়ে দু’জনে। তারপর সাঁতার কেটে চলে আসে লঞ্চের কাছে। অন্ধকারে মিশে থাকে। কতক্ষণ সময় চলে যায় টের পায় না। অপেক্ষা করে মুর্তোজার। বেশ অনেকক্ষণ পরে পীরের বাড়িতে ভূরিভোজন করে দলবল নিয়ে লঞ্চে ওঠে ক্যাপ্টেন মুর্তোজা।
মুহূর্ত সময় মাত্র। লঞ্চের ইঞ্জিন স্টার্টের ঘর্ঘর শব্দ শুরু হয়েছে। দু’জনের গ্রেনেডের রিং দুটে দাঁতে কামড়ে ধরে এবং ফিতাটা টান মেরে ছুড়ে মারে সঙ্গে সঙ্গে। লঞ্চের একটি অংশ প্রবল শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। অন্য লঞ্চ থেকে গর্জে ওঠে মেশিনগানের হাজার রাউন্ড। নদীর ওপর দিয়ে ছুটে যায় বুলেট। ওরা দুজনের জলে ডুবে জেটির দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে সিঁড়ির নিচে এসে ঢোকে।
রাজাকাররা ছুটোছুটি করে পীরের বাড়ির দিকে দৌড়াতে থাকে। অন্য দুটো লঞ্চ দ্রুত ছেড়ে যায় জেটি। পাড়ে থাকে ধ্বংসপ্রাপ্ত লঞ্চটি। সকালে একটা ব্যবস্থা করবে বলে সবাই এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
গভীর রাত।
যুথিকা আর রতœা খুঁটির সাথে আটকানো শেকল বেয়ে সিঁড়ির পাটাতনের একেবারে তক্তার নিচে গিয়ে সাঁতার কেটে চরের কোণায় ওঠে। কাছাকাছি ছিল যজ্ঞের নৌকা। চারদিক শান্ত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও চরের কাছে চলে আসে। দু’জনে নৌকায় উঠে পড়ে। পাটাতনের ওপর শুয়ে চিৎ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। গভীর করে শ্বাস টানে। ওরা যেন নিজেদের মধ্যে নেই। ওদের অস্তিত্ব বিশাল হয়ে উঠেছে আটঘর কুড়িয়ানার আকাশ-বাতাস-নদী-বন-প্রান্তর লোকালয় এবং হতদরিদ্র মানুষের জীবন ও স্বপ্নের মধ্যে।
যজ্ঞ ফিসফিস করে ডাকে, দিদিমণিরা শয়তানডা কি মরছে?
যুথিকা বলে মুর্তোজা মরেছে কিনা জানি না তো যজ্ঞ কাকা। ওই খবরটা না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই।
তোমরা তো লঞ্চডা উড়াইছ। জীবন লইয়া ফিরা আসছ। এই রহমই তো হওয়ার কথা আছিল। ওই বেডা যদি না মইরা তাহে তাইলে এইবার মুই অরে মারতে যামু।
অন্ধকারের বয়স্ক যজ্ঞের কণ্ঠ ফ্যাসফ্যাস করে। তবু কথাগুলো ওর প্রাণের গভীর থেকে উঠেছে। দু’জনে এই বিশ্বাস নিয়ে উঠে বসে। মনে হয় আর একটি অপারেশন করার জন্য ওদের শক্তি ফিরে এসেছে শরীরে। ওদের ক্লান্তি কেটে গেছে। উত্তেজনা কমেছে। ভিজে ভারি হয়ে যাওয়া পোশাকটি টানতে ওদের আর কষ্ট হচ্ছে না।
ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলো মুক্তিযোদ্ধার দলসহ ক্যাপ্টেন হুদা। ভিজে পোশাকেই ক্যাপ্টেন ওদের জড়িয়ে ধরে বলে, অসাধারণ কাজ করেছো। অসীম বীরত্বপূর্ণ কাজ। তোমরা আমাদের গর্ব। তোমাদের অপারেশনের সাফল্য আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে লেখা হবে।
যুথিকা আর রতœার কণ্ঠে শব্দ নেই। ওরা আনন্দও প্রকাশ করতে পারছে না। নিজেদের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হয় রাতভর ঘটে যাওয়া ঘটনা। আমরাই কি এতকিছু ঘটাতে পেরেছি? তারপরও যুথিকা বিষাদমাখা কণ্ঠে বলে, ক্যাপ্টেন মুর্তোজা মরেছে কিনা আমরা জানি না স্যার।
কালকেই এ খবর পাওয়া যাবে। বেটা যদি বেঁচেও যায় তবু বুঝুক যে ওকে মোকাবেলা করার মতো সাহসী ছেলেমেয়েরা ওর চারপাশে আছে। যে কোনো সময় ওর ওপর নেমে আসবে খ—গ।
স্যার আবার কোনো সুযোগ এলে আমরাই সে অপারেশনে যাবো।
যুথিকার দৃঢ় কণ্ঠ গমগম করে চারদিকে। যেসব ছেলে এই অপারেশনে যায়নি তারা আবার মাথা নিচু করে। যুথিকা একই ভঙ্গিতে জামিরুলকে দেখতে পায়। ও নিজেও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যুথিকার খুব ইচ্ছে করে ওই ভিজে পোশাকটা চেঞ্জ করার আগে জামিরুলের হাত ধরে বলতে, তুমি কিছু বলছো না কেন? তোমার কাছ থেকে একটা কিছু শুনবো বলে আমার প্রাণ ফেটে যাচ্ছে।
কিন্তু কোনো কথাই বলা হলো না। চারদিকে হৈ চৈ-আনন্দÑ ক্যাম্পে আজ উৎসব।
নিজের ঘরে এসে যুথিকার মন খারাপ হয়। সবাই যে যার ঘরে ঢুকলে যুথিকা নিঃশব্দে বাইরে আসে। বাইরের বড় আম গাছটার গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে জামিরুল। কি স্নিগ্ধ বাতাস বইছে চারদিকেÑ বাতাসটা নদী ছুঁয়ে উড়ে আসছেÑ টানটান গন্ধ, কেমন তা বলা যাবে না। শুধুই অনুভবের ব্যাপার। ওর দৃষ্টি এবং মনকে মায়াবী ও প্রত্যয়ী করে তোলে। ও এক ছুটে জামিরুলের কাছে যায়। জামিরুল ওর উপস্থিতি টের পেলেও তাকায় না। ও জোর করে বলে, জামিরুল আমি এসেছি।
জামিরুল তাকায়, কিন্তু তেমন ভালো প্রতিক্রিয়া নেই। বিষাদ ওকে দমিয়ে রাখে। যুথিকার সাহসের কাছে ও পরাজিত হয়ে গেছে। ওর মনোভাব যুথিকা বুঝতে পারে। তারপরও জোরে জোরে বলে, রাত থেকে আমার মনপ্রাণ টানটান হয়ে আছে। তোমার বুকের মধ্যে মাথা রাখতে চাই জামিরুল।
যুথিকা ওপর পাশে বসলে জামিরুল ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। খুব কঠিন এমন একটি অসাধারণ সময়ে ভালোবাসার মানুষকে ছুঁয়ে না দেখাÑ বুকে টেনে তাকে গভীরভাবে উপলব্ধি না করা এবং তার অস্তিত্ব নিজের শরীরে মিশিয়ে না রাখা কী করে সম্ভব। জামিরুল নিজের অতৃপ্তির বোধটুকু ঝেড়ে ফেলে জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণকে অবিনশ্বর করে রাখতে চায়। এ জীবনে এমন একটি সময় আর কখনো আসবে না। এমন একটি রাত আর কোনোদিন তৈরি হবে না। জামিরুল গভীর চুমুতে যুথিকাকে আটকে রাখে নিজের মধ্যে। এভাবে তাদের শেষ সময়টি কেটেছে। আর কখনো দেখা হয়নি জামিরুলের সঙ্গে। স্বাধীনতার পরেও না।
এক গ্লাস জল খেয়ে যুথিকা বলে, একবারই ভালোবেসেছিলাম, একবারই পুরুষকে অনুভব করেছিলাম। আমি আর কাউকে চাইনি। বুবুর মতো এটাও কি পুরুষের অত্যাচার? বুবু আত্মহত্যা করেছিল, আমি করবো না, আমি ভালোবাসার শেষ দেখতে চাই। আমি জামিরুলকে ভালোবাসি। ও একদিন কোথাও না কোথাও থেকে ফিরবেই। যদি বেঁচে থাকে তবে আমার কাছে ওকে ফিরতেই হবে।
জলের গ্লাসটা ঠিক করে টেবিলের ওপর রাখে।
ফুল নিয়ে ফিরে আসে মর্জিনা।
খালা আপনার জন্য জবা ফুল।
টকটকে লাল ফুলটার দিকে তাকিয়ে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যুথিকার। জামিরুলের স্মৃতি, জামিরুলের ভালোবাসা। সেদিন ও প্রতিটি পাপড়ি আলাদা করে বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, আমার ভালোবাসা বাতাসে, আকাশে, মর্ত্য,ে পাতালে সবখানে। দেখবে এ ভালোবাসা অনিঃশেষে। এর ক্ষয় নেই।

পরবর্তী সময়ে ও আর ফুল ছেঁড়েনি। সযতেœ জলে ভিজিয়ে রেখেছে।
মর্জিনা একগাদা বেলী ওর সামনে রেখে বলে, আপনার জন্মদিনে এগুলো মায়ের উপহার। মা বেলী ফুল খুব ভালোবাসে।
তুই একটি দারুণ মেয়ে মর্জিনা। তুই আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ধন্য করেছিস।
আজকে তো আমি আর খুশি ছাড়া আপনের কাছে কেউ নেই। আহারে, এমন দিনে একা একা কি ভালো লাগে?
তোর ফুল পেয়ে আমার খুব ভালো লাগছে।
পারলে আমি রোজ রোজ আপনেকে ফুল দিতাম।
না, না। রোজ আমি ফুল চাই না। শুধু জন্মদিনেই চাই। জন্মদিনে ফুল পেলে আমার বুবুকে স্মরণ করা হয়। আর জামিরুলকে স্মরণ করা হয়।
আচ্ছা। কাজে যাই।
মর্জিনা কাজে যাওয়ার পরেও যুথিকা গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। খবরের কাগজ দিয়ে গেছে। খুলে দেখতে ইচ্ছে হয় না। কাগজের খবরগুলো স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। দুর্ঘটনা, মৃত্যু, সন্ত্রাসী, দুর্নীতি, সরকারের কূটচাল, জনগণের হয়রানি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি কাঁহাতক আর পড়া যায়! এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জঙ্গীদের বোমা হামলা, জঙ্গী প্রশিক্ষণ, বোমা তৈরির কারখানা, ভুয়া মাদ্রাসার খবরÑ অসম্ভবের দেশ হয়েছে এটা। যুথিকার মন খারাপ হলে ও যুদ্ধদিনের কথা স্মরণ করে। সেই দিনগুলো ওকে বাঁচিয়ে দেয়। ওর জীবনে জামিরুলের না থাকার শূন্যতাও ক্ষণিকের জন্য ওকে সব দুঃখ থেকে আড়াল করে দেয়। যুথিকা ভাইবোনদের কথা মনে করে সবাইকে চিঠি লিখতে বসে। এক একজন এক এক দিকে আছে। সেজো বোন ঢাকায়, হয়তো বিকেলে তার সঙ্গে দেখা হবে, তবু ওকেও একটা চিঠি লেখে। জন্মদিনে ভাইবোনের সঙ্গে এই প্রীতিরবন্ধন পালন করতে ওর ভীষণ আগ্রহ জন্মায়। একমাত্র ভাই গ্রামে থাকে। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। গতকাল একটি চিঠি লিখেছে ওকে। বলেছে, ওর দুটো মেয়েকে যেন ওর কাছে রেখে লেখাপড়া শেখায়। ওর মতো সাহসী মেয়ে করে বড় করে তোলে। চিঠি শেষ করে ভাবনায় পড়ে ও। ওর মতো সাহসী মেয়ে? ওর সাহস জামিরুলকে ভীত করেছিল। জামিরুল ওর জীবন থেকে সরে গেছে। আর ওর সাহসকে দমন করার জন্য যুদ্ধের সময় ওর ভাই ওকে মেরেছিল। দুটো ঘটনা একইরকম। নারীর সাহসকে গ্রহণ করতে না পারার পুরুষের মনোভাব। যুথিকা হেসে গাম দিয়ে খামের মুখ আটকায়। পোস্ট অফিস বেশি দূরে নয়। একটু পরে নিজেই বেরিয়ে চিঠিগুলো পোস্ট করবে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে কাগজটা পড়া দরকার মনে করে পাতা ওল্টাতে আবার একই ধরনের একটি খবর ছাপা হয়েছে দেখতে পায়। সদ্যোজাত একটি মেয়েশিশুকে কে বা কারা কাপড়ে জড়িয়ে বাড়ির কার্নিসে ফেলে রেখেছে। হয়েছে কি দেশটার! আর যত বাচ্চা ফেলে দেওয়া হচ্ছে সবই মেয়ে। ছেলে খুব কম। তাহলে অবৈধ ছেলে হলেও কি তার কদর আছে? সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে? হায় ঈশ্বর! যুথিকা কাগজটা ভাঁজ করে রেখে দেয়। কাগজ পড়তে ভালো লাগে না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চিঠিগুলো পোস্ট করে আসে। নিজেকে অনেক কাজ করতে হয়। কাজ করতে ভালোই লাগে। সময় কেটে যায়। ঘরে ফিরে আলমারির কাপড়গুলো নামিয়ে আলমারিটা পরিষ্কার করার কাজ শুরু করে। ছুটির দিনে এমন অনেক কিছুই করে ও। ছোট বোনটা হয়তো যে কোনো সময় এসে পড়বে। বলবে, আপা কি রান্না করেছো? জন্মদিনের জন্য নতুন কিছু? নাকি আসবে না? স্বামী-সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। দু’বোনের কারো বাড়িতেই ফোন নেই। তাই যোগাযোগের সুবিধা নেই। যুথিকা শাড়িগুলো নামিয়ে ঝেড়ে ঝেড়ে ওঠায়। তেলাপোকার কালো কালো দানায় ভর্তি হয়ে আছে আলমারির কোণা-ঘুপচি। যুদ্ধের সময়ের দু’একটি ছবি আছে। স্কুলে এবং কলেজে পড়ার সময়ের দুটি ছবি আছে। বাবা-মায়ের একটি ছবি আছে। কিন্তু জামিরুলের কোনো ছবি নেই। ভীতু জামিরুল সবসময় পেছনের দিকেই থাকতো। যখন অন্যরা বলতো, যুথিকা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েÑ ও একজন প্রকৃত যোদ্ধা। এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয় না যে ও নারী। খাকি পোশাক, কাঁধে এলএমজি, বুকে রকেট লাঞ্চার, কোমড়ে গ্রেনেডসহ কেমন নির্ভীক চিত্তে ভারি অস্ত্র বহন করে মাইলকে মাইল হেঁটে যায়, তখন মনে হয় যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ব্রত নিয়ে ও লড়াইয়ের ময়দানে এসেছেÑ এসব কথা শুনে বিবর্ণ হয়ে যেতো জামিরুল। ও একবারও ভাবেনি সাহসের সঙ্গে ভালোবাসার কোনো বিরোধ নেই। আসলে পুরুষের সাহসে জামিরুল উৎফুল্ল হয়েছে, বাহ্বা দিয়েছে। নারীর সাহস জামিরুল মানতে পারতো না। একদিন ওকে বলেছিল, নারীরা সাহসের বাহাদুরী দেখালে মেজাজ গরম লাগে। ওদের আবার সাহস কি? সাহসী মানুষ হবে পুরুষ।
জামিরুল তুমি খুব একতরফা কথা বলছো। যুদ্ধের সময় নারী-পুরুষ সবারই সমান সাহস থাকতে হয়।
আমি তোমাকে খাটো করছি না যুথিকা।
কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো।
হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি এবং এই ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। মনে রেখো, শুধু ঘর বাঁধলেই ভালোবাসা বাঁচে না।
তারপর জামিরুল ওর জীবন থেকে হারিয়ে যায়। ও জানে না জামিরুল বেঁচে আছে কি না, ঘর বেঁধেছে কিনা, বাবা হয়েছে কিনা। ও একটি কঠিন জ্ঞান দিয়েছে ওকে। একটি মাত্র ফুল দিয়ে ওর জন্মদিনকে অর্থপূর্ণ করেছিল, যে জন্মদিনের কথা কেউ স্মরণ করতে চায়নি। ওর জন্মদিন হয়েছিল বড় বোনের মৃত্যুদিন। এখন তো ও নিজে নিজে জন্মদিনের কথা স্মরণ করে জামিরুলকে মনে রেখে। ওর চোখ ভিজে ওঠে। জামিরুল হয়তো ঠিকই বলেছে। ওদের ঘর হলে এভাবে জামিরুলকে স্মরণ করা হতো না। ওর প্রতিদিনের ভাতের থালার এঁটো ভাত হয়ে যেতো। যুথিকা কাপড় গুছিয়ে জবা ফুলটাকে ফুলদানিতে রাখে। বেলী ফুলগুলো ছড়িয়ে রাখে ওর বাবা-মার ছবির ফ্রেমের নিচে। টেবিলে রাখা ছবিটার সামনে মাটিতে বসে থুঁতনি ঠেকিয়ে বলে, তোমরা আমাকে জন্ম দিয়েছিলে, সে জন্য আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু জন্মের আনন্দ আমি পাইনি। তোমরাও আমাকে আনন্দ দিতে চেষ্টা করোনি। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে বুবুর মৃত্যুর কথা শুনতে শুনতে আমি ভেতরে ভেতরে গোঁয়ার মেয়ে হয়ে বেড়ে উঠেছিলাম। তোমরা সবসময় সেটা টের পেতে না। টের পাওয়ার সময় তোমাদের ছিল না। তোমাদের অনাদরে অবহেলায় বড় হয়েছিলাম আমি। তোমাদের অবহেলা পেয়ে ঠিক করেছিলাম তোমরা যেভাবে চাইবে সেভাবে বড় হবো না। বুবুর মতো বাল্যবিয়ে দিতে চাইলে আমি বিয়েই করবো না। মেজো বোনের মতো খেলাধুলা বন্ধ করে দিলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবো। তারপরের বোনের মতো খেলাধুলা বন্ধ করে দিলে আমি ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল, হা-ডু-ডু খেলবো। কত আমাকে আটকাবে? আমি মাঠে ঘাটে ঘুরবো, পাখির বাসা খুঁজবো, বিলে পলো দিয়ে মাছ ধরবো, শাপলা ছিঁড়তে যাবোÑ এতকিছু করা বাদ রেখে আমি তোমাদের ভাষায় লক্ষ্মী, শান্ত মেয়ে কোনোদিনই হবো না। ঘরে বেঁধে রেখে মারলেও না।
নিষেধের বেড়ি পায়ে আটকে রাখলেও না। তোমরা দেখেছো আমি তা হইনি। কেন হবো? পড়ে পড়ে মার খাবো শুধু? প্রতিবাদ করবো না? আমার বিশ্বাস আমার পায়ে আমি দাঁড়াতে পেরেছিলাম।
যুথিকা বাবা মায়ের ছবিতে চুমু খেয়ে উঠে আসে। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার খাতাগুলো দেখতে বসে। ক্লাস ফাইভে বাংলা পড়ায়ও। দুটি খাতা দেখার পর হঠাৎ মনে হয়, একদিন জামিরুল ওর বৃত্তি পরীক্ষার গল্প করছিল। বলেছিল, বাংলা পরীক্ষার দিন ওর খুব জ্বর হয়েছিল। মাথা ঠিকমতো কাজ করছিলো না। চোখে ঝাপসা দেখছিল। তারপরও যথাসম্ভব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। রচনার বিষয় ছিল, বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও? ষড়ঋতু, ছাত্রজীবনের কর্তব্য-এই সব। ও প্রথমটা লিখেছিলো, বড় হয়ে আমি সাহসী মানুষ হতে চাই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো অন্ধকার রাতে একটি নদী সাঁতার দিয়ে পার হতে চাই- এমন একটি কাজ পারলে আমি জীবনে কোনো কাজে ভয় পাবো না। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছিল জামিরুল।
যুথিকা হাত গুটিয়ে বসে থাকে। ভাবে, রচনা লিখে অনেক নম্বর পাওয়া এবং জীবনের সাহসের পরীক্ষা ভিন্ন জিনিস। জামিরুলের চিন্তা এবং কর্ম একসূত্রে যোগ হয়নি। চিন্তা ও কর্মকে এক করতে পারেনিও। বলেছিল, যুথিকা তুমি যেভাবে অপারেশনে অংশ নিচ্ছ এই দেখে আমার মনে হচ্ছে এখন আর এমন একটি রচনা লিখতে পারবো না।
যুথিকা গভীর দুঃখে বলেছিলো, তোমার জন্মের দিন তো তোমার বড় বোন গলায় দড়ি দিয়ে মারা যায়নি জামিরুল। তুমি আমার দুঃখ বুঝবে না।
তোমার দুঃখ আমি মুছিয়ে দেবো।
দিও, জামিরুল দিও।
যুথিকা প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়েছিলো ওর দিকে। দেখেছিলো জামিরুলের দু’চোখের ভেতরে পুরো আকাশ, আশ্চর্য নীল এবং উজ্জ্বল। মুগ্ধতায় যুথিকা অভিভূত হয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিল, ভালোবাসার আকাশ পেলে ও আর কিছুই চায় না। আকাশ কি ও পায়নি? পেয়েছে তো। জামিরুল তো বলেনি, সম্পর্কটা এখানে শেষ। আর এগোবো না। ওতো ভালোবাসাই বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে। ঘরে আবদ্ধ করতে চায়নি। নিশ্চয়ই ও কোথাও আছে, যেখানে যুথিকার অনুভব ছাড়া ওর জীবনে আর কোনো অনুভব নেই।
যুথিকা দু’হাতে চোখের জল মোছে। তখন ওর মনে হয় জামিরুলও ভীষণ সাহসী। যুদ্ধের সাহস হয়তো ওর ছিল না, কিন্তু জীবনকে বোঝার সাহস ওর কম ছিল না। কৈশোরে যুথিকা যখন স্কুলের শিক্ষকদের বকুনি খেয়ে অবাধ্য হয়ে যেমন খুশি তেমন আচরণ করছে তখন জামিরুল ওর পক্ষে ছিল।
সবচেয়ে কড়া ছিলেন ঝর্ণা দিদি। দৌড়ঝাঁপ বেশি করলে বলতেন, এই মেয়ে এত লাফালাফি কিসের। সামলে চলো। ভুলে যাও কেন যে তুমি একটা মেয়ে।
মেয়ে? মেয়েদের কি দৌড়ঝাঁপ মানা?
মুখে মুখে কথা বলো না। বাবা মা কি তোমাকে কিছুই শেখায়নি?
ছ্যাঁৎ করে ওঠে যুথিকার মেজাজ।
যা বলবার আমাকে বলুন দিদি। বাবা মা তুলে কথা বলবেন না।
মেয়েটা তো ভীষণ বেয়াদব। বেশি বাড়াবাড়ি করলে বুঝবে মজা। যাও বাড়ি যাও।
যুথিকা কথা বাড়ায় না, কিন্তু মনে মনে ফুঁসতে থাকে। পরদিন ফুফুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে দর্জির দোকানে যায়। কাপড় কিনে প্যান্ট শার্ট বানাতে দেয়। তারপর সেই পোশাক পরে পুরো স্কুলে ঘুরে বেড়ায়। অন্য মেয়েরা ওর পিছু নেয়। সবাই মিলে হৈ হৈ করে। এভাবে যুথিকা মেয়ে বলে যে শাসন করে শিক্ষকরা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। টিচাররা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। পুষ্পরানী কর্মকার হাতে একটি বেত নিয়ে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওকে ডাকে। ও প্রধান শিক্ষকের সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। পুষ্পরানী ধমক দিয়ে বলেন, তোমার কি হয়েছে? ও নির্ভয়ে বলে আমি একটি মেয়ে- এটা আমাকে সবসময় মনে করানো হয়।
চমকে যায় পুষ্পরানী। এমন একটি উত্তর ও যুথিকার কাছে আশা করেনি।
তুমি স্কুলের ডিসিপ্লিন নষ্ট করেছো।
আমি ডিসিপ্লিন নষ্ট করিনি দিদি। আমি সব মেয়েকে বোঝাতে চেয়েছি যে শুধু মেয়ে বলে আমাদের আটকে রাখা চলবে না। এটা আমার প্রতিবাদ। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন দিদি।
পুস্পরানীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য টিচাররা এবং যুথিকার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা ওর কথা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। কেউ কেউ পেছন থেকে বলে, ও ঠিক বলেছে। টিচাররাও মনে করে যে ও ঠিকই বলেছে। সবাই ওর বড় বোনের আত্মহত্যার ঘটনাটি মনে করে এবং ভাবে এজন্যই মেয়েটা অন্যরকম হয়েছে। ওকে ওর মতো বড় হতে দিতে হবে। পুষ্পরানী নরম কণ্ঠে বলল, যাও ক্লাসে যাও।
দিদি আমার আর একটা কথা। আমার এইটুকু জীবনে আমি বুঝেছি যে আমরা মেয়ে বলে আমাদের জন্মের সময় বাবা-মায়েরা কাঁদে। আমাদের বিয়ের পরে স্বামীরা অত্যাচার করে। আমাদের লেখাপড়া শিখতে দেয়া হয় না। বিয়ে দিয়ে হাঁড়ি ঠেলতে পাঠানো হয়। আমরাও তো অনেক কিছু করতে পারি দিদি।
ক্লাস নাইনে পড়া যুথিকার কথা শুনে কারো মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। পুষ্পরানী ওকে কাছে ডেকে কপালে চুমু দেয়। বলে, তুমি অনেক বড় হও মা।
আজ ওর কততম জন্মদিন?
সেদিনের কথাগুলো ওর স্পষ্ট মনে আছে। এখন পর্যন্ত ও মেয়েদের নানাভাবে ওদের অধিকারের কথা বোঝায়। দেশের এই শান্ত পরিবেশে মেয়েরা যুদ্ধের সময়ের চেয়ে কম নির্যাতিত হচ্ছে না। যুদ্ধের সময় মেয়েরা নির্যাতিত হয়েছে শত্রুদের হাতে। যুদ্ধ কৌশল হিসেবে নারীরা ধর্ষণ-গণধর্ষণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এখনও তো পরিবর্তন হয়নি মানসিকতা-একইভাবে মেয়েরা শাসনের নিগড়ে বাধা। আগে শিক্ষকদের অতিরিক্ত শাসন ছিল মেয়েদের ওপর। এখন সেটা কমেছে। মেয়েরা খানিকটা মুক্ত হয়েছে। এসব চিন্তার মাঝে পাশের বাসার কণা আসে ওর কাছে। মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বেশ চটপটে, হাসিখুশি। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। মিটিং মিছিল করতে ভালোবাসে। এসেই বলে আপনার জন্মদিন উপলক্ষে আপনার জন্য এই বইটি এনেছি খালা।
বই? কি বই রে? যুথিকা খুশি হয়।
সুকুমারী ভট্টাচার্যের বই। আপনি কি পড়েছেন, নিয়তিবাদ উদ্ভব ও বিকাশ?
নারে পড়িনি। সুকুমারী আমার প্রিয় লেখক। আমি ওর প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য পড়েছি। দারুণ লেখে। তার দেখার চোখই আলাদা। এই বইটি পেয়ে আমার জন্মদিন পূর্ণ হয়ে গেলো।
আপনি এত খুশি হয়েছেন খালা?
সুকুমারীকে আমার খুব আপনজন মনে হয়। আপনি তো তাকে দেখেননি।
দেখবো কি করে? তাছাড়া লেখকদের কি দেখতে হয়? যার লেখা ভালো লাগে তাকে লেখার মধ্য দিয়েই দেখে নেয়া হয় রে কণা।
আমি এমন করে ভাবিনি কখনো। কতজনের লেখাইতো ভালো লাগে। কিন্তু লেখকের কথা মনে হয় না। যা হোক হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ খালা।
যুথিকা ওকে জড়িয়ে ধরে। কপালে চুমু দেয়। লুচি আর আলুর দম খেতে দিলে দু’জনে মুখোমুখি বসে।
কি মজা, কতদিন পর লুচি আর আলুর দম খাচ্ছি। আমার মায়ের হাতে আলুর দম ভাল হয় না। মজা পাই না। আজ নিশ্চয় আপনি রান্না করেছেন?
যুথিকা মৃদু হাসে।
কণা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, ভাগ্যিস আজ আপনার স্কুল ছুটি। আজ আপনার ছোটবেলার একটি গল্প শুনবো খালা। অনেক কিছুইতো শুনেছি। যেটা শোনা হয়নি আজ সেটা বলবেন।
কোনটা যে তোর শোনা হয়নি। যুথিকা এক মুহূর্ত ভাবে। বলে, ছোটবেলাতেই বুঝেছিলাম যে ছেলেশিশু আর মেয়েশিশুর পার্থক্য তৈরি করে বড়রা। আমি যখন ফাইভে পড়ি। আর দাদা সেভেনে, আমাদের পড়াতেন সমীরণ স্যার। সবসময় দেখতাম স্যারের নজর দাদার দিকে বেশি। দাদাকে এটা বোঝায়, ওটা বোঝায়, আমার দিকে খেয়ালই করে না। আমি একটা অঙ্ক বুঝতে চাইলে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়। কিভাবে রচনা লিখবো জানতে চাইলে বলতো, লিখতে না পারলে লিখবে না। গোল্লা পাবে একটা রসগোল্লা। রসগোল্লা চেনো? এসব শুনলে আমার ভীষণ রাগ হতো। রাগে আমি মনে মনে ফুঁসতাম। দাদাকে পড়ানো শেষ হলে তিনি আমার দিকে তাকাতেন। ততক্ষণে তার আবার চলে যাওয়ার সময় হতো। কোনো কোনো দিন আমাকে কিছু না পড়িয়ে তিনি চলে যেতেন। বাবার কাছে নালিশ করলে বাবা পাত্তাই দিতেন না। বলতেন, মাস্টারের বিরুদ্ধে নালিশ করবে না। দুজনে ভাগেযোগে পড়ো, কিন্তু মাস্টার যে সমান করে সময় ভাগ করে না সেটা বাবাকে বোঝাতে পারতাম না। একমাত্র ছেলের প্রতি বাবারও পক্ষপাতিত্ব ছিল। শেষে নিজে নিজেই ঠিক করলাম যে মাস্টারের ওপর প্রতিশোধ নিতে হবে। এমন শাস্তি দেবো যে জীবনে যেন না ভোলে।
কণা হাসতে হাসতে বলে, বাব্বা, ওই বয়সে আপনি এতকিছু চিন্তা করতে পারতেন? লোকে আপনাকে ডাকাত মেয়ে বলতো না?
শুধু ডাকাত? কত কী যে বলতো, তার ঠিক ছিল না। কিন্তু আমি পাত্তা দিতাম না। ছেলেরা এমন করলে কিন্তু ওদের দুষ্টু ছাড়া কিছু বলা হয় না তদের সব ক্ষমা করা হয়।
তো কীভাবে প্রতিশোধ নিলেন?
আমাদেরকে স্কুলে যেতে হতো নৌকায় বড় একটি খাল পার হয়ে। খালটি বেশ চওড়া ছিল। একদিন আমাদের মাস্টারসহ কয়েকজনে মিলে স্কুলে যাচ্ছিলাম। স্রোতের টানে নৌকাটা খালের মাঝখানে চলে যায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে সুযোগটা বুঝে গেলাম। নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে নৌকাটা দোলাতে শুরু করলাম। স্রোতের তোড়ে আর দুলুনির চোটে নৌকা উল্টে গেলো। আমি তো ছিলাম সাঁতার-পটু। আমার সঙ্গে ছেলেরাও সাঁতার কেটে পারতো না। আমি ওদের হারিয়ে দিতাম। আমাদের মাস্টার পরেছিল ধুতি আর পাঞ্জাবি। বেচারা বেশ নাকানি চুবানি খেয়ে কোনোরকমে পাড়ে উঠলো। আমিতো অনেক আগেই পাড়ে উঠে গেছি। দুঃখ একটাই যে আমার বইখাতা সব পানিতে ভেসে গেছে।
হো-হো করে হাসে কণা। বলে বেশ মজার অভিজ্ঞতা। আমার এমন সাহস হবে না। কেউ আপনাকে বকেনি?
মোজো বোন আমাকে খুব মেরেছে। তখন তো বুঝতে পারিনি যে আমার বোন মাস্টারের প্রেমে পড়েছিল।
কণার হাসি থামে না। বলে, আপনার বোনের সঙ্গে মাস্টারের বিয়ে হয়েছিল?
হয়েছিল। বাবাতো যেনতেন বিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। কিন্তু জানিস লোকটি বেশিদিন বাঁচেনি। পাঁচ বছরের মাথায় মারা যায়। ততোদিন তিনটি মেয়ের জন্ম দেয়।
মেয়ে দেখে তো খুশি হয়নি?
অবশ্যই না মুখ কালো করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতো। ওর জন্য আমার খুব মায়া হতো রে কণা। লোকটা একটা গাধা, নির্বোধ লোক ছিল।
আপনি কি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন?
ক্ষমা? না, এসব কথা ভাবিনি। তবে যতদিন বোনের স্বামী ছিল ততদিন আমার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল না। এখন তোর খবর বল।
আমারÑ আমার খবরÑ ইতস্তত করে কণা।
ও বাব্বা ভড়কে গেলি কেন রে মেয়ে? প্রেমে পড়েছিস?
কণা লজ্জায় মাথা নিচু করে। তর্জনি দিয়ে টেবিলের ওপর দাগ কাটে। যুথিকার দিকে তাকাতে পারে না। যুথিকা হাসতে হাসতে বলে, কাকে ভালো লেগেছে তার নামটা বল।
মঈন। মঈন হাসান
তোর সঙ্গে পড়ে?
তিন বছরের সিনিয়র। ফিজিক্সে পড়ে। ও একটা তুখোড় ছেলে। দারুণ বক্তৃতা করে। মিছিলে সবার আগে থাকে।
যুুথিকা মিটিমিটি হাসে। কণা সেটা খেয়াল না করেই বলতেই থাকে, তুখোড় ছেলে না হলে আমি কথা বলে আরাম পাই না। ওকে দেখার পর থেকে আমি প্রেম ও রাজনীতির ভিতরে জীবনের নতুন অর্থ আবিষ্কার করছি। ওকে আমার ভীষণ ভালো লাগে খালা।
বোঝাপড়া হয়েছে?

হয়েছে। কণার লজ্জা কেটে যায়। বলে, আপনার কাছে আমার একটি আবদার আছে। বলে ফেল
মাঝে মাঝে মঈনকে যদি আপনার এখানে নিয়ে আসি তাহলে আমরাÑ
নিরিবিলি কথা বলার সুযোগ পাস এইতো?
হ্যাঁ আপনি সুযোগ দেবেন খালা?
দু’একদিন ভেবে দেখি। তোকে ডাকবো।
তখন হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢোকে স্মৃতি। ও যুথিকার বিল্ডিংয়ের চারতলায় থাকে। একটি চমৎকার মাটির ফুলদানিতে গোলাপ নিয়ে এসেছে।
শুভ জন্মদিন খালা।
তোদের ভালোবাসা আমাকে পূর্ণ করে দিচ্ছে। বেঁচে থাকা ভীষণ সুন্দর মনে হচ্ছে।
আপনি তো সবসময় বেঁচে থাকাকে সুন্দরই বলেন।
আজ অনেক বেশি সুন্দর লাগছে।
দু’জনেই বলে আমরা জানি আপনার জন্মদিনের দুটো দারুণ ঘটনা আছে। জন্মদিনের সঙ্গে এমন ঘটনা খুব কম লোকেরই থাকে।
আমি খুব ভাগ্যবান।
একটু পরে আসে শান্তা, কামরুল হাসানের ছোট্ট একটা পেইন্টিং নিয়ে। হ্যাপি বার্থ ডে খালা।
নাহ, তোরা আজ আমাকে এভাবে মনে করবি জানলে একটা কেক এনে রাখতাম।
আমরা বিকেলে আবার আসবো। তখন কেক খাবো খালা। সঙ্গে পায়েস। আপনি দারুণ পায়েস রান্না করেন। আপনি তো একদম অন্যরকম মেয়ে ছিলেন এমন চমৎকার রান্না কীভাবে শিখলেন খালা?
ইচ্ছা থাকলে সবই হয় রে।
আমার এই ছবিটা আপনার পছন্দ হয়েছে খালা?
হ্যারে, শিল্পীর ‘উঁকি’ ছবিটা আমার দারুণ লাগে। মনে হয়। আমাদের জীবনের ছবি। একটি মেয়ে ঘরের মধ্যে বন্দী, পায়ের কাছে পানির কলস, হাঁড়িকুড়ি- ও জানালার ঝাঁপ সরিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখছে। পৃথিবীকে কি উঁকি দিয়ে দেখা যায়?
যুথিকা নিশ্বাস ফেলে। তারপর বলে আমাকেও ঘরে আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন বাবা। একবার স্কুলে এসএসসি পরীক্ষার আগে নাটক করা হবে ঠিক করা হলো। পুষ্পদি আমাকে নায়িকার রোল দিলেন। আমি তো মহাখুশি। কিন্তু বাবার বকুনির ভয়ে বাড়িতে আর বলতে পারি না। এদিকে সমানে রিহার্সেল করে যাচ্ছি। কারণ ঠিক করেছিলাম, রিহার্সেলের সময় বাবাকে বলবো না। যেদিন নাটক মঞ্চস্থ হবে সেদিন বলবো। তখন যা হয় তা সামলাতে পারবো এই ভরসা ছিল আমার। যদিও আমি জানতাম বাবা রেগে গেলে ভীষণ বকাবকি করেন। সে সময় বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা যায় না।
তখন তিনজনে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
বেশ মজাতো। কি হলো পরে?
নাটকের দিন বাবাকে বললাম, বাবা আজ আমার স্কুলে নাটক হবে। আমার আসতে দেরি হবে।
বাবা রেগে বললেন কোনো কথা শুনতে চাই না।
দেরি করে বাড়ি ফেরা চলবে না।
বাবা নাটকে আমি নায়িকার রোল করছি।
তুমি জানো আমি এসব পছন্দ করি না। বাড়াবাড়ি করলে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখবো তোমাকে। তোমার কারণে আমার অনেক কথা শুনতে হয়। খবরদার আর বাড়াবাড়ি করবে না।
বাঘের মতো হুঙ্কার ছাড়লেন বাবা। আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। চোখ বন্ধ করে বাবার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম।
বাবা, পুষ্পদি আমাকে নায়িকা করেছেন। আমি না গেলে নাটকটি হবে না।
না হলে না হবে।
বাবা, স্কুলের মানসম্মান আছে। অনেক অতিথি আসবেন।
আমি বাবার চোখের দিকে তাকাই না। চোখ বন্ধ করেই কথা বলে যাচ্ছি। আমাকে তো বাবার অনুমতি পেতেই হবে। নইলে হয়তো আমাকে জোর করে আটকে রাখতে পারে। আমি আবার বলি বাবা আপনি অনুমতি না দিলে স্কুলে আপনার সুনামও নষ্ট হবে। অনুষ্ঠান না হলে লোকে আপনাকে দুষবে।
বাবা চুপ করে রইলেন। কারণ আমি বাবার কোনো কথা শুনতে চাচ্ছিলাম না। এদিকে আমি তো চোখ খুলছি না। বুঝতে পারছি না আমার সামনে বাবা আছেন কি নেই। তার চলে যাওয়ার কোনো শব্দ পাইনি বলে জিজ্ঞেস করি। বাবা আমি কি যাবো?
বাবার উত্তর নেই। আমার জেদ চেপে যায়। আমি চিৎকার করে বলি, বাবা, আপনার এক মেয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মরেছে। আমি নদীতে ডুবে মরবো। বাবা, আমি বুঝতে পারছি যে আপনি চান এভাবে আপনার মেয়েরা একে একে আপনার জীবন থেকে সরে যাক। বেঁচে থাকুক আপনার একমাত্র ছেলে। আমাকে নাটক করতে না দিলে আমি নদীতে ডুবে মরবো। আমি বুবুর মতো আপনার বাড়িতে মরবো না।
থামো, থামো বলছি। বাবা হুঙ্কার দিয়ে উঠেন। আমি বাবার হুঙ্কারে ঘাবড়াই না। চোখ বন্ধ রেখেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি।
বাবা বলেন, ঠিক আছে যাও। অনুমতি দিলাম।
আমাকে আর পায় কে। আমি চোখ খুলে দে ছুট। তারপর হঠাৎ করে ছুটে এসে বাবাকে প্রণাম করি। বাবা আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন। বলেন, বড় হ মা। হেসে আমাকে যেতে দেন। বাবার কাছে বড় হওয়া কি আমি বুঝতে চাইনি। অনুমতি যে দিয়েছিলেন সেটাই ছিল আনন্দ।
কণা, স্মৃতি আর শান্তা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। বলে, আপনার এতসব স্মৃতির গল্প শুনে আমাদের ভীষণ মজা লাগে। ভাবতেই পারি না যে, এভাবে ফ্যামিলির সঙ্গে লড়াই করেছেন। আমাদের এত ঝামেলা সইতে হয় না।
যুথিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কেমন ক্লান্তি লাগছে। এই সব মেয়েদের আনন্দদায়ক সঙ্গের পরও মনে হচ্ছে বেঁচে থাকা কঠিন। নিজের আঙিনা তৈরি করার পরও টুকরো টুকরো খড়কুটো পড়ে থাকে। ওগুলো কুড়িয়ে ফেলা হয় না। ওগুলোই যন্ত্রণা। যন্ত্রণা তো কম নয়। হিসেব রাখাও সহজ নয়। মেয়েরা চলে যাওয়ার আগে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। গালে চুমু দেয়। খালাকে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলতে চায় আপনি ভাল থাকুন। কিন্তু বলা হয় না। ওরা দেখতে পায় মাসীর মাথাভর্তি কাঁচা-পাকা চুল। ক্লান্ত দৃষ্টিতে বিষণœতার ছায়া। খালা এখন আগের মতো নেই।
ওরা চলে যেতেই প্রবল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে যুথিকা। এতক্ষণ নিজের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে নিজেকে ধরে রেখেছিল। এখন জামিরুল প্রবল হয়ে উঠেছে। কণা বলেছে মঈন হাসানের কথা। এখন থেকে চল্লিশ বছর আগে জামিরুলও ওকে বলেছিল, আমি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। এ পথে এগুলেই আমরা একদিন সব মানুষের পেটে ভাত দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারবো। দেখবে কত সুন্দর হয়ে গেছে সমাজ।
যুথিকা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, স্বপ্ন আর বাস্তব এক নয়। নিজের জীবন দিয়ে এতবড় অভিজ্ঞতা ওর মতো কে আর লাভ করেছে। তবু জামিরুলই ওর প্রেমÑ আমৃত্যু, আজীবন। যুথিকা চোখ মুছে সোজা হয়ে বসে। মর্জিনা কাজ করে চলে গেছে। খুশিতো আগেই চলে গেছে। বাড়িতে ও এখন একা। ও খাতাগুলো দেখে শেষ করে। নিজের জন্য খিচুড়ি, আলুভর্তা আর একটা কৈ মাছ ভেজে রাখে। সালাদ বানায়। পায়েস আর পুডিং বানায়। অনিমেষ আসবে। কখন আসবে সেটা ও আগে থেকে বলেনি। যে কোন সময় হুট করে চলে আসবে। বলবে, জয়তু জন্মদিন। অনিমেষ ছাড়া আরও কেউ জন্মদিন উপলক্ষে আসতে পারে। কিছু তো আপ্যায়ন করতেই হবে। এসব কাজ শেষ হতে না হতেই একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে আসে অনিমেষ। যথারীতি শুভেচ্ছা জানিয়ে বলে, জয়তু জন্মদিন।
ফুলের সঙ্গে তোমার শুভেচ্ছা বাণী আমাকে ভীষণ ভাবায়।
অনিমেষ ভুরুকুঁচকে বলে, কেন? জামিরুলের এপিসোডের জন্য? জামিরুলকে নিয়ে অনেক বছর পার করলে এবার ছাড়।
উপদেশ দিও না।
উপদেশ মনে করলে আমি সরি যুথিকা। আমি তো জামিরুলকে নিয়ে কথা বলতে পারি। কলেজ জীবনে ও আমার বন্ধু ছিল।
থাক এসব।
থাকবে কেন? যুদ্ধের সময় জামিরুল তোমার সঙ্গে যে আচরণ করলো তা ঠিক করেনি। আমাদের মধ্যে বিষয়টা নিয়ে খুব আলোচনা হতো।
যুথিকা আবার ঠা-া মাথায় বলে, অনিমেষ থাক এসব।
হ্যাঁ থাক। তোমার কাছে সারেন্ডার করলাম।
বছর দুয়েক আগে ক্যান্সারে অনিমেষের স্ত্রী মারা গেছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বিদেশে থাকে। অনিমেষ এখন একা। ভাইয়ের দুটো ছেলে থাকে সঙ্গে। মুখে বলে ভাল আছে, কিন্তু বিবর্ণ চেহারা দীপ্তিহীন। ওর জন্য মায়া হয় যুথিকার। হয়তো স্ত্রীকে ভোলা কষ্ট হচ্ছে। হয়তো একা জীবনের ভার দুর্বিষহ লাগছে। হয়তো সামনের ধূসর দিন ওকে ভীত করে ফেলেছে।
অনিমেষ ওর দিকে ফুলের গুচ্ছ বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আজ তুমি নিশ্চয় খুব ভালো আছ।
খুব ভালো কিনা জানি না। তবে ভালো আছি। দিনগুলো সহজ রাখার চেষ্টা করি। ভালোমন্দ বোধ নিয়ে আমার বেশি ভাবনা নেই অনিমেষ।
জামিরুলের উধাও হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে বিস্ময়।
যুথিকা প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বলে তুমি চা খাবে?
না চা খাই না। রাতে ঘুম আসে না।
তাহলে এসো দু’জনে এক সঙ্গে ভাত খাই।
তুমি রান্না করেছ?
হ্যাঁ, আমার রান্না আমিই করি।
তাহলে খাবো। জামিরুলের সঙ্গে তোমার ঘর হলো না। নইলে অনেক দিন খেতে পারতাম। আমাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব হতো।
সমাজকে তুমি খুব ভয় পাও অনিমেষ?
আমার জন্য পাই না। তোমার জন্য পাই। মেয়েদের দায় বেশি। সমাজ মেয়েদেরকে দাবড়ায়। মনে আছে ক্যাপ্টেন হুদা প্রথমে তোমাকে মুক্তিবাহিনীতে নিতে চায়নি।
সে আর মনে থাকবে না? জীবনের গল্প ভুলবো কেমন করে। এসো খেতে বসি। মাছ কিন্তু একটা। মাছটা তুমি খাবে।
আমি একা খাবো কেন? দু’জনে ভাগ করে খাবো।
আমি কিন্তু মাথার দিকটা খাবো।
আমি তো চাই তুমি আমার মাথাটাও খাও।
কি বললে?
একদমই ঠাট্টা। রসিকতা যুথিকা।
এমন রসিকতা আর করবে না
অনিমেষ বিব্রত হয়ে গম্ভীর হয়। আসলেই তো ও একটু ইঙ্গিত করেছিল নিঃসঙ্গ যুথিকাকে। কিন্তু যুথিকা এক মুহূর্তে বুঝে ফেলেছে। ওর বোঝায় ভুল ছিল না। অনিমেষ লজ্জিত হয়। কিন্তু লজ্জার ভাবটা কাটিয়ে ওঠার তাড়নায় বলে, চলো আমরা খেতে খেতে যুদ্ধের গল্প করি।
প্রথমে যুথিকাই শুরু করে, আমার কলেজে পড়ার সময়ই শুরু হলো একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরে কলেজ বন্ধ হয়ে গেলো। হোস্টেল ছেড়ে ফিরে এলাম বাড়িতে। বাড়িতে রাজনীতির আলোচনা, উত্তেজনা। রেডিওতে খবর শুনে রক্ত গরম করে সবাই। আমরা বুঝতে পারি একটা কিছু ঘটবে। একদিন দাদা স্বরূপকাঠি থেকে দুটো রইফেল যোগাড় করে এনে মাচানের ওপরের একটি ট্রাঙ্কে লুকিয়ে রাখে। লোকমুখে খবর ছড়ায় যে গানবোটে করে পাকিস্তান আর্মি আসবে। অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে- ভয়ে আতঙ্কে রাত কাটে অন্যদের, যারা গ্রাম ছাড়েনি। সোহেল একটা রাইফেল যুথিকাকে দিয়ে বলে, জানি, তোর সাহস আছে যুদ্ধ করার। পাকিস্তান আর্মি আর তাদের দোসর রাজাকাররা যত বড় শত্রুই হোক আমাদেরকে ওদের ঠেকাতে হবে। আমাদের গ্রাম বাঁচাতে হবে।
আমি রাইফেলটা বুকে জড়িয়ে ধরি।
পরদিন ভোরে রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে আসি। বাবা-মা দু’জনেই পথ আগলে দাঁড়ান আামদের। বলেন, যাস না তোরা। গেলে আর ফিরতে পারবি না।
কেন পারবো না। জয়ী হয়ে ফিরবো।
আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে অন্য ছেলেরা। দু’একজন মেয়েও। কিছু পথ হেঁটে, বাকি পথ ট্রলারে করে জ্যোৎস্নায় আলোকিত পথ পার হয়ে আমরা ভোররাতে কুড়িয়ানা হাইস্কুলে পৌঁছি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও অন্য ছেলেরা আমাদের স্বাগত জানায়। ওই স্কুলে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় বৃষ্টি। পরদিন প্রশিক্ষণ শুরু হবে।
পরদিন ক্যাপ্টেন হুদা বলেন, সোহেল প্রশিক্ষণ নেবে যুথিকা নয়। যুদ্ধ মেয়েদের কাজ না। যুথিকা-রতœা ঘরে ফিরে যাও।
না স্যার আমি ঘরে ফিরবো বলে ঘর থেকে বের হইনি। আমি যুদ্ধ করবো। আমাকে প্রশিক্ষণে পাঠান।
ক্যাপ্টেন ওর দৃঢ়কণ্ঠে বিস্মিত হয়। মেয়েদের এমন আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর এর আগে তিনি শোনেননি। দ্বিধা নিয়ে তারপরও বলেন, তুমি বাড়ি যাও যুথিকা।
আমার দাদাও সঙ্গে সঙ্গে বলে, চল, তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
না, কিছুতেই না। আমি বাড়ি যাবো না। যুদ্ধ করবো।
যাবি না? দেখাচ্ছি মজা।
ভাইজান আমাকে কষে চড় মারেন। ক্যাপ্টেন হুদা কোন কিছু না বলে আমাদেরকে রুম থেকে বের করে দেন। পরদিন আমি আর রতœা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই।
ক্যাপ্টেন হুদা আমাদের সঙ্গে দেখা করেন না। তার পরদিনও না। তারপর দেখা করলেন, কিন্তু রেগে বললেন, বলেছি না বাড়ি ফিরে যেতে। আমিও কঠিন স্বরে বলি, বাড়ি ফিরে যাবো না।
তোমরা অকারণে জেদ করছো। যুদ্ধ করতে পারবে না। বাড়ি যাও।
আমি গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। বলি, আমরা ট্রেনিং নেবো। আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করবো। আপনি সুযোগ না দিলে আমরা অন্য জায়গায় গিয়ে সুযোগ নেব। মরতে যদি হয় তাহলে ওদেরকে মেরেই মরবো। পাক-সেনাদের হাতে ধরা পড়তে চাই না।
ক্যাপ্টেন হুদা আমাদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকেন। বলেন, তোমাদের এত সাহস!
এর পরদিন থেকে শুরু হয় আমাদের প্রশিক্ষণ।
হা হা করে হাসে অনিমেষ।
এসব গল্প আমাদের কতবার শোনা। তবু যুদ্ধের সময়ে আমরা এসব গল্প করতেই ভালোবাসতাম। আমাদের অন্য গল্প ছিল না যুথিকা।
একদম যে ছিল না তা নয়। আমরা চাঁদনী রাতে বসে বাড়ির গল্প করতাম, বাবা-মায়ের খবরের জন্য উদগ্রীব থাকতাম। অপারেশনে যাবার জন্য তৈরি হতাম।
মনে আছে, যেদিন তুমি আর রতœা ক্যাপ্টেন মুর্তোজার লঞ্চ ওড়াতে গিয়েছিলে সেদিন বিশ জন পাকিস্তানী সৈন্য মারা গিয়েছিল।
ওহ, সেটা একটা স্মরণীয় দিন ছিল আমাদের জীবনে।
তোমার আরও একটি স্মরণীয় দিন আছে যুথিকা।
তুমি এতকিছু মনে রেখেছো অনিমেষ। নরেরকাঠি অপারেশনের পরে ক্যাপ্টেন হুদা আমাকে বলেছিলেন রাজাকার সুলায়মানকে বেয়নেট চার্জ করে মারতে হবে। আমি তো ওকে বেয়নেট চার্জ করার আগে বলেছিলাম, ওই সুল্যাইমান্যা ‘জয় বাংলা’ বল। ওতো বলে না। ও যতক্ষণ বলে না ততক্ষণ বেয়নেট চার্জ করতে থাকি। এক পর্যায়ে লোকটি চেঁচিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে। আমি আর রতœা তখন ওকে মেরে ফেলি। ওটি ছিল আমাদের সামনাসামনি শত্রু মারার অভিজ্ঞতা।
অনিমেষ পূর্ণ দৃষ্টিতে যুথিকার দিকে তাকায়। দু’জনের চোখাচোখিতে যুদ্ধের সময়টা মূর্ত হয় না, মূর্ত হয়ে ওঠে বর্তমান। ভালোলাগার প্রচ্ছন্ন আবেগ। স্মৃতি সেই আবেগের সহায়ক শক্তি মাত্র।
তোমাকে পায়েস দেই অনিমেষ? যুথিকা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। অনিমেষ আগ্রহ নিয়ে বলে, দাও।
যুথিকা ফ্রিজ থেকে পায়েস বের করে। বুঝতে পারে অনিমেষের উপস্থিতি ওর ভালো লাগছে। অনেক দিন পর একঘেয়ে দিনগুলো থেকে দলছুট হয়ে আজকের দিনটি বেশ অন্যরকম কাটছে। বাটি ভর্তি পায়েস নিয়ে দু’জনে অনেক সময় নিয়ে একটু একটু করে খায়। খেয়ে দেয়ে অনিমেষ বলে, আমি কিন্তু এখনই যাচ্ছি না যুথিকা। গান শুনবো। তোমার রবীন্দ্রসঙ্গীতের কালেকশন ভালো।
বেশ হবে। গান শুনে না খেয়ে বিকালটা কাটিয়ে দেয়া যাবে।
দু’জনে ড্রইংরুমে ফিরে আসে। অনিমেষের আনা ফুল থেকে চমৎকার মিষ্টি গন্ধ আসছে। এতকাল তো জবা ফুল পছন্দ ছিল। আজ কেন গোলাপের সুগন্ধিতে বুক ভরে যাচ্ছে? যুথিকা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখতে চায় না নিজের ভিতরে। ক্যাসেট প্লেয়ার ছেড়ে দিলে গান শুরু হয়।
অনিমেষ সোফার ওপর কাত হয়ে শুয়ে গান শোনে। বার বারই মনে হয় এ বাড়িতে থাকা যদি ওর জীবনে সত্য হতো। যদি যুথিকাকে বুকে নিয়েÑ। না, অনিমেষ এর বেশি ভাবে না। ভাবতে ভয় করে। যুথিকা জামিরুলের জন্য জীবনটা কাটিয়ে দিল। কে জানে যুদ্ধক্ষেত্রে জামিরুল শহীদ হয়েছে কিনা? তবে কিসের প্রত্যাশা যুথিকার?
যুথিকার মনে হয় পরপর কয়েকটি সফল অপারেশনের পর পাকিস্তানী বাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছিল ওদের শেষ করার জন্য। চারদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে। আক্রমণের গতি বেড়ে যায়। এদিকে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র নেই, গোলাবারুদ নেই, খাবার-দাবার নেই। গ্রামগুলো দখলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তোফাজ্জল বলে, আমাদের জায়গা বদল করতে হবে। এখানে আর থাকা সম্ভব হবে না। আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে তখন মধ্যরাত। ঘড়িতে প্রায় দুটো বাজে। আকাশে চাঁদের আলো। সেই আলো ওদের সম্বল। হারিকেন নেই। মোমবাতি নেই। দিয়াশলাই জ্বালায় না কেউ। মিটিংয়ে বসে ক্যাপ্টেন হুদার দল। তিনি সরাসরি বলেন, যে যে জীবন দিতে রাজি আছ তারা আমার সঙ্গে চলো। আমাদের দীর্ঘপথ যেতে হবে। পথটা সরল নয়। কে কে আমার সঙ্গে যাবে তারা হাত ওঠাও। হাত ওঠায় যুথিকা, অনিমেষ, রতœা, পরিমল, আলতাপ, গফুর বাদল, মালেক, ঝর্ণা, কালাম। বাকিরা দল ছেড়ে চলে যায়। জামিরুল এরও আগে ভারতে চলে গেছে।
রাত তিনটায় হুদা তার দল নিয়ে গাবখান নদীর দিকে পাকসেনাদের আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সবার সঙ্গে ভারি অস্ত্র। গভীর রাত। চাঁদের আলো একমাত্র পথের সাথী। একসময় অনিমেষ যুথিকাকে বলে, কষ্ট হচ্ছে? যুথিকা তীক্ষè কণ্ঠে উত্তর দেয়, কষ্ট? সেটা আবার কি?
না, মানে হাঁটতেÑ
যুথিকা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, অনিমেষ আমি তোমার মতো সরাসরি যুদ্ধে যোগ দিতে পারিনি। আমাকে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে যুদ্ধ করে দলে ঢুকতে হয়েছে। মনে রেখো আমার যুদ্ধ দুইমুখী। তাই আমার সাহসÑ
অনিমেষ থমথমে গলায় বলে, জানি তুমি অনেক সাহসী।
সাহসের প্রশ্ন নয়। আমি বোঝাতে চেয়েছি যে, মেয়ে হওয়ার জন্য আমাকে বেশ মূল্য দিতে হয়েছে। আজকের এই চাঁদনী রাতে সবার সঙ্গে অপারেশনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার জন্য অন্যরকম। তোমাদেরও অন্যরকম।
তারপরও দুটো মিলেই আমাদের একসঙ্গে যাত্রা।
আমি এখন একটা গান গাইবো।
গাও। আস্তে গেও। ক্যাপ্টেন শুনলে রাগ করতে পারেন।
তাহলে থাক। শব্দ না করাই ভালো। ক’দিন আগে ভিমরুলীতে যে কয়েকটা ছেলে ঘোরাফেরা করছিল আর লোকজনকে জিজ্ঞেস করছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প কোথায়, আমরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবোÑ ওদের সন্দেহজনক চলাফেরা দেখে ভিমরুলীর ক্যাম্প থেকে একজন যোদ্ধাকে পাঠানো হলো বুঝে আসার জন্য যে, ওরা কারা। গ্রামের সাধারণ মানুষের সাহায্যে ওদের ধরে আনা হলো ভিমরুলী ক্যাম্পে। জিজ্ঞাসাবাদের পরে টের পাওয়া গেল যে, ওরা পাকিস্তান বাহিনীর চর। আরও জানা গেলো যে, ওরা গ্রামের মেয়েদের পাকিস্তানী সৈনিকদের ক্যাম্পে দিয়ে আসতো। যুদ্ধের হাইকমান্ড এদের বিচার করার জন্য বসে। বিচারে কমান্ড সিদ্ধান্ত নেয় গুলি করে ওই চারজন রাজাকারকে হত্যা করা হবে। এদেরকে গুলি করার দায়িত্ব আমাদের ওপর দেওয়া হলো। খালের পাশের আমগাছের সঙ্গে দেশদ্রোহীদের চোখ, হাত, পা বাঁধা হলো। গুলি করলাম আমি, রতœা আর অঞ্জলি।
এই চাঁদনী রাতে হয়তো এমন আর একটি ঘটনা আজ ঘটবে। অনিমেষের কথার সূত্র ধরে যুথিকা বলে, হ্যাঁ, ঘটতেও পারে। আর প্রথম গুলিটা আমি করবো, তোমরা না।
রতœা ফিসফিস করে বলে, তোর কি জামিরুলের কথা মনে হচ্ছে?
হচ্ছে। যুথিকা গলা উঁচু করেই বলে। অনিমেষও শুনতে পায়।
রতœা আবার বলে, ভুলিসনি ওকে?
ভুলবো কেন? ও তো যুদ্ধ করতেই গেছে।
ফিরবে কিনা কে জানে।
আহ্্ রতœা, বাজে কথা বলবি না। এসব আলোচনার সময় এখন নয়। আগে স্বাধীনতা।
যুথিকা গান শুনতে শুনতে হঠাৎ ধড়ফড় করে ওঠে বসে। ভেবেছিলো টানটান শুয়ে থেকে নিঃশ্বাস নেবে। হয় না। পাশের ঘরে অনিমেষ আছে। স্বাধীনতা তো হয়েছে। তাহলে জামিরুল কই? এভাবে কি জামিরুলকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। আজকের জন্মদিনে অনিমেষ ওর বুকের ভিতর ঝড় তুলেছে।
অনিমেষও হঠাৎ করে ওঠে বসে। মনে হয় এমন কাত হয়ে থাকার ভঙ্গি মোটেই সুখপ্রদ নয়। ওঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় যুথিকা কি এখনও জামিরুলকে ভোলেনি? স্বাধীনতার কত কত বছর হয়ে গেছে, এখন যুথিকার জামিরুলকে মনে রাখার কোনো মানে হয় না।
দু’জনে নিস্তব্ধ প্রহর গোনে। সুবিনয় রায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত বেজে যায়। ঘরজুড়ে কেবল রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী আর সুর। দু’ঘরে দু’জনের সামনে এক গভীর জিজ্ঞাসা উত্তরের অপেক্ষায় গুমরে মরে।
বিকেলের দিকে বাড়ির বাইরে হৈ-চৈ শোনা যায়। অনিমেষ দরজা খুলে কি হয়েছে দেখবে কিনা ভাবছে। আবার ভাবে, থাক, দরকার নেই। এ পাড়ায় ও পরিচিত লোক নয়। কথা বলতে গেলে অন্যরা প্রশ্ন করবে, তুমি কে? কি বলবে ও? যুথিকার বন্ধু? অনিমেষের বুক ভার বোধ হয়। ও চুপচাপ বসে থাকে। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে যুথিকা। অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলে, বাইরে কিছু একটা হয়েছে মনে হয়। আমাদের বিল্ডিংয়েই বোধ হয়। যাই দেখি। তুমি ভিতরেই থাকো অনিমেষ।
যুথিকা বেরিয়ে যায়। অনেক লোক জড়ো হয়েছে। জানা গেলো কে বা কারা বাড়ির কার্নিশে তোয়ালে পেঁচিয়ে একটি শিশু ফেলে দিয়েছে। বাচ্চাটা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। এমন একটি আকস্মিক ঘটনায় এবং ভয়ে ও উত্তেনায় মানুষের উদ্বিগ্নতার সীমা নেই। একজন বলে, এমন কা- কে ঘটাতে পারে? সে কি মানুষ? দেশটা লাম্পট্য আর নষ্টামিতে ভরে গেছে। তাই তো বাচ্চাটাকে ফেলে দিয়েছে।
নিশ্চয়ই ওটা একটা মেয়ে বাচ্চা, নইলে ফেলা হতো না।
আপনারা এত কথা বলছেন কেন? আগে বাচ্চাটাকে নামানোর ব্যবস্থা করুন। ওখান থেকে পড়ে গেলে তো বাচ্চাটা মরে যাবে। পুলিশে খবর দেওয়া উচিত।
যুথিকা ততক্ষণে একটা কথাও বলেনি। লোকজনের মন্তব্য শুনছে কেবল। খেয়াল করেছে বাচ্চাটার পজিশন। ওর চিৎকার আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে। ও জড়ো হওয়া মানুষদের বলে, আপনারা শান্ত হন। আমি থানায় ফোন করে দিচ্ছি। পুলিশ আসুক। তবে আপনাদের বলে রাখছি, যদি বাচ্চাটির কোনো দাবিদার না থাকে তাহলে আমি বাচ্চাটিকে গ্রহণ করতে চাই। আমি ওকে লালন-পালন করবো।
জনতা ওর দিকে ঘুরে তাকায়।
আপনি? আপা আপনি বাচ্চাটা নেবেন?
কাউকে না কাউকে তো ওর দায়িত্ব নিতে হবে। ওতো মানুষের সন্তান। ওকে তো আমরা ওভাবে পড়ে থেকে মরে যেতে দিতে পারি না।
ঠিক বলেছেন। আমাদের তো একটা দায়িত্ব আছে। যে অমানুষ কা-টা ঘটিয়ে থাকুকÑ
যুথিকা মৃদু হেসে বলে, আগে থানায় ফোন করি।
পুলিশ এসে বাচ্চাটাকে ওখান থেকে আগে নামিয়ে আনুক।
দিদি ওটা মেয়ে বাচ্চা হলেও আপনি নেবেন?
আমার ধারণা ওটা মেয়ে বাচ্চাই। ছেলে হলে কেউ ফেলতো না। আমার কাছে ছেলে-মেয়ে সমান।
আসলে আপা তো বিয়েই করেনি। এখন একটা বাচ্চা পেলে-পুষে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চায়।
যুথিকা মন্তব্যটা ভালোভাবেই শুনতে পায়। ও আর কথা না বাড়িয়ে থানায় ফোন করার জন্য ঘরে ঢোকে।
অনিমেষ ওকে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে?
যুথিকা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে, পরিত্যক্ত শিশু পড়ে আছে চারতলার কার্নিশে। অবৈধ সন্তানের মহোৎসব। বুঝলে! হলো কি দেশটায়? ক’দিন আগেও কাগজে এমন কয়েকটা খবর পড়লাম।
অনিমেষ উঠে পায়চারী শুরু করে যুথিকা মুখ ঘুরিয়ে বলে, থানায় খবর দিয়েছি। পুলিশ আসছে।
এরপরে ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।
যুথিকা অনিমেষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, বাচ্চাটাকে আমি গ্রহণ করতে চাই অনিমেষ। ও আমার কাছে বড় হবে।
যুথিকা! তুমিÑ
অবাক হচ্ছো কেন? একটা বাচ্চা পেলেপুলে বড় করা কি খুব কঠিন কাজ?
না, তা নয়। তবে একটি বিশাল মানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো। আসলে রাইট টাইমে রাইট সিদ্ধান্ত নিতে তুমি ভুল করো না।
এও আমার আর এক ধরনের যুদ্ধ। যতক্ষণ পর্যন্ত থানা-হাসপাতাল করে বাচ্চাটি হাতে না পাচ্ছি ততক্ষণ তুমি আমার পাশে থেকো। তোমার তো বাড়ি ফেরার তাড়া নেই?
তা নেই। ঘটনাটার শেষটুকু আমিও দেখতে চাই।
অনিমেষ যুথিকার ঘাড়ে হাত রাখে। বলে, আমরা যুদ্ধ করা মানুষ। আমাদের জন্য যে কত ধরনের কাজ তৈরি হয় যুথিকা। মানুষের তৈরি করা অন্যায়টুকুও আমাদের সামলাতে হচ্ছে।
যুথিকা হাসতে হাসতে বলে, আজ আমার জন্মদিন অনিমেষ। জন্মদিনের সঙ্গে আবার একটি ঘটনা। আমি বুবুর মতো বাচ্চাটাকে মরতে দিতে পারি না।
ব্রেভো! তোমার জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার হবে মেয়েটি।
বাইরে পুলিশের গাড়ি আসার শব্দ পাওয়া যায়। বাচ্চাটা নামানো হয়। লোকজন আগ বাড়িয়ে বলে, বাচ্চাটা ওনার কোলে দিন। উনি বাচ্চাটাকে নিতে চাচ্ছেন।
যুথিকা হাত বাড়ায় বাচ্চাটা নেয়ার জন্য। পুলিশ অফিসার বলে, এখন তো দেওয়া যাবে না।
আপাতত কোলে তো রাখি। আমি আপনাদের সঙ্গে যেতে চাই। দেখুন ওর যে নাড়ি কাটা হয়েছে সে নাড়ি থেকে এখনও রক্ত ঝরছে। আপনারা ওকে নিয়ে আগে হাসপাতালে চলুন।
অনিমেষ আর যুথিকা পুলিশের গাড়িতে ওঠে। গাড়ি চলতে শুরু করলে যুথিকা বলে, আমি মেয়েটির একটি নাম ঠিক করেছি।
অনিমেষ বলে, আমিও একটি নাম ঠিক করেছি।
যুথিকা বিস্মিত হয়ে বলে, তুমি কি নাম ঠিক করেছো?
ওর নাম হবে লতিফা।
যুথিকা অস্ফুট স্বরে বলে, আমার বুবুর নামটা তুমি মনে রেখেছো।
মনে না রেখে কি উপায় আছে। তোমার কাছ থেকে অনেকবার শুনেছি।
আনন্দ-বেদনায় যুথিকার চোখ ভিজে যায়। ও বাচ্চাটাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। গাড়ি হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাচ্চাটার কাটা নাড়ির পরিচর্যা করা হয়। ওর মুখে চামচে করে জল দেয়া হয়। ওর কান্না থেমে গেছে। ও চোখ খুলে চারদিকে তাকায়। পুলিশ আর ওকে থানায় নিতে চায় না। বাচ্চাটিকে যুথিকাকে দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে চলে যায়।
বাচ্চাটি যুথিকাকে দেয়ার জন্য কাগজপত্র তৈরি হচ্ছে। টেবিলের অপর প্রান্তে বসে অফিসার জিজ্ঞেস করে, বাচ্চাটির মা হিসেবে আপনার নাম কি লিখবো?
যুথিকা আহমদ।
আর বাবার নাম?
যুথিকা একবারও অনিমেষের দিকে না তাকিয়ে অবলীলায় বলে, অনিমেষ আতিউর খান।
কাগজে খসখস শব্দ। অনিমেষ যুথিকার মুখের দিকে তাকাতে পারে না। পাশের চেয়ারে বসে থেকে ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। যুথিকা একপলক ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। আস্তে করে বলে, আর একটি নতুন জীবনের শুরু।
অনিমেষ বলে, কাগজপত্র তৈরি হোক। আমি ওর জন্য তোয়ালে আর দু’চারটে জামা কিনে নিয়ে আসছি।
হ্যাঁ, যাও।
বাচ্চাটিকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে অনিমেষ নিজের উত্তেজনা ধরে রাখতে পারে না। যুথিকার কোলে ওদের মেয়ে। মানব শরীরের উষ্ণতায় ও ঘুমিয়ে পড়েছে। অনিমেষ ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ভারি সুন্দর মেয়েটি। টানা চোখের দৃষ্টিতে সবটুকু মায়া কেড়ে নেয় যেন।
যুথিকা গম্ভীর হয়ে বলে, আমি অন্যকথা ভাবছি।
কি? অনিমেষ উৎসুক হয়ে ওঠে।
যুথিকা একমুহূর্ত ভাবে। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে, আমরা দু’জন যুদ্ধ করা মানুষ ওকে কি স্বাধীন দেশের একটি বাঙ্কার থেকে বের করে আনলাম? যে অদৃশ্য বাঙ্কারে নারীরা এখনও প্রবলভাবে নিপীড়িত হচ্ছে? যার কোনো বিচার নেই। এখনও যেখানে নারী সমাজ কর্তৃক উপেক্ষিত।
বাঙ্কার? তুমি কি বলছো যুথিকা? বাঙ্কার? অনিমেষ প্রবলভাবে বিব্রত বোধ করে।
ঠিকই বলছি। বাঙ্কার শব্দটি আমি জেনেশুনে ব্যবহার করেছি। কোনো ভুল ব্যবহার করিনি। বলতে বলতে ওর কণ্ঠে বিষাদ ঘনায়Ñ দৃষ্টিতে অন্ধকার। তারপর মুহূর্তে বিষাদ ঝেড়ে ফেলে বলে, লতিফা যেখান থেকে এলো সেটি একটি বাঙ্কারই ছিল। নইলে ওর জন্মদাত্রী মা ওকে ফেলে দিল কেন? আমরা যাদের নিয়ে মিছিল করবো লতিফাকে নিয়ে আমি সেই মিছিলের সামনে থাকবো। তুমিও থাকবে। ওর একজন বাবার দরকার অনিমেষ, যে ওকে ভালোবাসবেÑ যতœ দিয়ে মানুষ হিসেবে গড়বে।
শুধু ওর জন্য বাবা দরকার যুথিকা?
না, আমিও ভালোবাসা চাই। লতিফাকে নিয়ে আমরা একটি সংসার গড়বো। আমরা তো দীর্ঘপথ একসঙ্গে হেঁটেছি। এখন আমাদের সময় হয়েছে গাছের নিচে বসার।
আমিও তোমাকে ভালোবাসি যুথিকা। কখনো তা প্রকাশের সুযোগ হয়নি।
যুথিকা নিঃশব্দে ডান হাত বাড়িয়ে অনিমেষের বাম হাত ধরে। লতিফা চোখ খুলে আবার বন্ধ করে। দু’জনে এই দৃশ্য দেখে হাসে। আশপাশে অসংখ্য গাড়ি, শব্দ, পায়ে-হাঁটা মানুষের ভিড় ফুটপাথে। মাথার ওপরে খোলা আকাশ, রোদ এবং চারপাশে বায়ুম-ল।
অনিমেষ হেসে বলে, তুমি কি এখনো বলবে শহরটা একটা ডাস্টবিন?
যুথিকা মৃদু হেসে বলে, ক্রোধের সময় অবশ্যই বলবো। ভালোবাসার সময় নয়। এখানেও ভালো মানুষ আছেÑ আমাদের চারপাশেই আছে। সব ভালো লোকের মুখ আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু তারা আছে বলে আমরা বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাই।
বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নামলে তরুণ রিকশাওয়ালা ওদের পা ছুঁয়ে সালাম করে। অনিমেষ ভাড়া দেওয়ার জন্য পকেটে হাত ঢোকাতে গিয়ে থমকে যায়। ওর দিকে ভ্রƒকুঁচকে তাকিয়ে বলে, কি হলো?
রিকশাওয়ালা একগাল হেসে বলে, ইচ্ছা হলো, তাই সালাম করলাম। আপনাদের কথা শুনে আমার বুক ভরে গেছে। এমন কথা আমি কখনো শুনিনি।
যুথিকা হাসতে হাসতে বলে, ওতো দেখছি বেশ ইন্টেলেকচুয়াল। তোমার নাম কি?
বশির। কোথায় থাকো?
কামরাঙ্গীর চরে।
কাল একবার আসতে পারবে? সকাল দশটার দিকে?
ও ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলে, পারবো। কোথাও যাবেন?
তোমাকে নিয়ে আমরা কাজী অফিসে যাবো।
যুথিকা কথা বলতে বলতে ঘরে ঢোকে। অনিমেষ ওর ভাড়া চুকিয়ে দেয়। ও চলে যায়।
ঘরে ঢুকে অনিমেষ জিজ্ঞেস করে, ওকে আসতে বললে কেন যুথিকা?
ও আমাদের বিয়ের সাক্ষী হবে।
ব্রেভো, সবকিছু মিলিয়ে যে বিশাল সিদ্ধান্ত নিলে তা কি সেলিব্রেট করতে পারি যুথিকা?
যুথিকা ঘাড় ঘুরিয়ে অনিমেষকে চোখের ভাষায় প্রশ্রয় দিয়ে বলে, পারো। অবশ্যই পারো।

যুথিকার মিছিলের আয়োজন এখন শেষ পর্যায়ে।
সারা দেশের বিভিন্ন শহর-গ্রাম থেকে যুদ্ধ করা নারীরা এসেছে। যুথিকা বুঝতে পারে ওরা যতজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি নারী এসেছে। যে যেখানে ছিল সেখান থেকে, যে অন্যকে চিনেছে তাকে ডেকেছে। যারা ডাক পেয়েছে তারা পায়রার মতো ডানা মেলেছে।
লতিফাকে কাঁকন বিবির কোলে দিয়ে যুথিকা বলে, ওকে এই সময়ের বাঙ্কার থেকে উদ্ধার করেছি। আপনি ওকে দু’হাতে উপরে তুলে মিছিলের নেতৃত্ব দেবেন।
কাঁকন বিবি লতিফাকে নাচাতে নাচাতে বলে, আমাদের জীবনে বাঙ্কারে থাকা শেষ হয় না। আমি এক রকমের বাঙ্কারে ছিলাম। তোর মেয়ে আর এক রকমের।
কাঁকন বিবি হা-হা করে হেসে লতিফাকে যুথিকার কোলে দিতে দিতে বলে, কতদূর, হাঁটবো আমরা?
পুরো দেশ।
যেতে পারবো তো?
নিশ্চয়ই পারবো।
দেশের মানুষ আমাদের পথ আটকাবে রে মেয়ে। সামনে বেড়ি দেবে।
বেড়ি ভাঙতে পারবেন না?
পারলাম কৈ? পারলে কি নতুন বাঙ্কার থেকে তোর মেয়ে টোকানো লাগে!
যুথিকা কিছু একটা বলার আগেই অন্যরা এসে হৈ-চৈ করে কথা বলে। ও চুপ করে যায়। কেউ একজন বলে, আপনার মেয়ে কাঁদছে। ওর বাবা আপনাকে ডাকছে।

যুথিকা শুনতে পায় লতিফা সমানে চেঁচাচ্ছে।
এক একটি কান্নার ধ্বনির সঙ্গে ও একটু করে বড় হয়। অনিমেষ আর যুথিকা ওর এই বড় হওয়া অনুভব করে।
কান্না থামাতে না পেরে অনিমেষ জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে ওর? খিদে পেয়েছে?
মনে হয় না। এই তো এক বোতল দুধ শেষ করলো।
তাহলে ঘুম পেয়েছে?
ঘুমুবে হয়তো।

ঠিক আছে আমি ওকে কোলে নিয়ে হাঁটছি। হাঁটলেই ও ঘুমিয়ে পড়বে।
কিন্তু লতিফার চিৎকার থামে না। মাঝে মাঝে এমন হয়, দু’জনের কেউই ওকে থামাতে পারে না।
অনিমেষ ওকে কাঁধে ফেলে পায়চারি শুরু করে। কিন্তু কাজ হয় না। ও ঘুমে নেতিয়ে পড়ে না। বরং হাত-পা ছুড়তে থাকে। ধৈর্য হারায় না অনিমেষ। ও এমনই, বাচ্চাদের পরিচর্যা করতে পারে। মেয়ের কান্নায় একসময় অবাক হয়ে ভাবে, ও এতো কাঁদছে কেন? কি হলো? ও খুশিকে বলে, আর এক শিশি দুধ বানা তো খুশি। কিন্তু দুধের বোতল ও মুখেই নেয় না। খুশি হাসতে হাসতে বলে, জীবনভর কান্না লাগবে। সে জন্য এখনই কান্না শুরু করছে। ওকে কেউ থামাতে পারবে না খালু। ও নিজে নিজেই থামবে। আপনি ওকে আমার কাছে দেন।
অনিমেষ ওকে খুশির কাছে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে লতিফা চুপ করে যায়। অল্পক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ে। অনিমেষ ওকে বিছানায় শোয়াতে শোয়াতে বলে, থ্যাঙ্কু খুশি।
একটা কথা বলি খালু?
বল।
লতিফা আমার মতো মেয়ে তো। সেজন্য ও আমার কোলে এলেই ঘুমিয়ে পড়ে। ও আমাকে আপন মনে করে।
অনিমেষ বিস্ময়ে খুশির দিকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে। খুশি একটু লজ্জা পেয়ে বলে, আমি কি ভুল বলেছি খালু?
না, ঠিক বলেছিস। আমি ঠিক করেছি তোকে স্কুলে ভর্তি করে দেবো। তোর আলাদা রুম হবে। তুইও আমাদের মেয়ে খুশি।
ও অনিমেষের কথা শুনে একছুটে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে। ওর ভীষণ ভয় করে। ভয়ে ওর হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপে।
যুথিকার ব্যস্ততার শেষ নেই। আগামীকাল মিছিলের শুরু হবে শহীদ মিনার থেকে শেষ হবে প্রেস ক্লাবে গিয়ে। তারপর সংবাদ সম্মেলন হবে। পরদিন দশটা বাসে পতাকা উড়িয়ে পুরো দেশ ঘোরার যাত্রা শুরু করবে। জায়গায় জায়গায় সংবর্ধনা দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। যে কোনো জায়গা থেকে নারীরা এই দলে যোগ দিতে পারবে। অনিমেষ ভীষণ খুশি যে সব জায়গা থেকে নারী-পুরুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছে। সাধারণ মানুষের এই সমর্থন যুথিকাকে আনন্দে উদ্বেলিত করে।
পরদিন সকালে শহীদ মিনার থেকে পতাকা হাতে মিছিল শুরু করে নারীরা। মিছিলের মাথা দোয়েল চত্বরের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পরেও মিছিলের শেষ অংশের নারীদের শহীদ মিনার থেকে নামাই হয় না। দোয়েল চত্বর পার হতেই ওরা দেখতে পায় হাইকোর্টের সামনে কাঁটাতারের বিশাল ব্যারিকেড, প্রায় হাইকোর্টের মাথা সমান উঁচু। কাঁকন বিবি যুথিকার দিকে তাকিয়ে বলে, এখন?
ভাঙবো আমরা।
তাহলে আয় হাত লাগাই।
সবাই মিলে ব্যারিকেড ঠেলতে থাকে। ওটা পিছু হটে, কিন্তু ভাঙে না। যেমন ছিল তেমনই থাকে। আরও ঠেললে আর একটু পিছু হটে। কাঁটাতারের খোঁচায় রক্তাক্ত হয়ে যায় হাতÑ কিন্তু বেশিদূর এগোনো হয় না।
কাঁকন বিবি যুথিকার দিকে তাকিয়ে বলে, ভাঙা না পর্যন্ত ছাড়বো না।
হ্যাঁ, ছাড়বো না।
মনে হয় ব্যারিকেডের পেছন থেকে কেউ কেউ ওটাকে ঠেলে রেখেছে।
যুথিকা শক্ত গলায় বলে, হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি।
পা দেখা যাচ্ছে।
নারী ও পুরুষের পা।
বুট জুতো দেখতি পাচ্ছি।
রাইফেলের বাঁটও।
গর্জে ওঠে শব্দ, হেঁইও। মারো ঠেলা হেঁইও।
জগদ্দল পাথর একটা। কাঁকন বিবি বিরক্তির স্বরে বলে।
আমাদের সময় লাগবে। তবুও আমরা বেড়ি না ভেঙে সরে যাবো না।
যুথিকা সাহসের বাণী শোনায়।
হাজার হাজার নারীর মাথার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। বাতাসে ঝরা পাতা ভনভন ঘোরে। তুমুল বৃষ্টি নামে। পায়ের নিচে বন্যার জল গড়ায়। নদী ভেঙে ঘরহীন হয়। ফেটে চৌচির হয়ে থাকে ফসলের মাঠ। রুক্ষ ভূমিতে ঘাস জন্মায় না। পাথুরে পথে হেঁটে গেলে রক্ত ঝরে পা থেকে। ঋতু ক্রমাগত বদলাতে থাকে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্তÑ কতবার ঋতু বদল হলোÑ সকলে একবাক্যে বলে জানি না। মনে রাখিনি। কতবার ফসল উঠলো ঘরে? জানি না। কতবার মঙ্গায় আক্রান্ত হলাম আমরা? জানি না। কতবার ক্ষমতা বদল হলো দেশের?
আমরা খোঁজ রাখি না। কারণ ক্ষমতা বদলে আমাদের কিছু এসে যায় না। রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বলে না, তোমাদের প্রতি আমরা অন্যায় করেছি। তোমরা আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও।
হা-হা করে হাসে নারীরা। নারীদের হাসি বয়ে যায় বাতাসের বেগে। পৌঁছে যায় বঙ্গোপসাগরে-সুন্দরবনে-কেওক্রাডংয়ের মাথায়। ওরা অফুরান শক্তি নিয়ে কাঁটাতারের বেড়ি ভাঙার কাজে নিজেদের ধরে রাখে।
একদিন কাঁকন বিবি সবাইকে কাঁদিয়ে ঝরে যায় মিছিল থেকে। আদুরজান, মোমিনা, নাসিমনআরার মতো বয়সী নারীরা কাঁকনের পথে চলে যায়। তারামন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দু’চোখ বোজে। বড় হয়ে যায় খুশি। বড় হয়ে যায় লতিফার মতো হাজার হাজার শিশু। যুথিকার সব চুল সাদা হয়ে যায়। একদিন খুশি চিৎকার করে বলে, খালাম্মা দেখেন কাঁটাতারের ব্যারিকেডে ফাটল ধরেছে। ওটা ঝুরঝুরে হয়ে এসেছে। তারগুলো মরচে ধরেছে। আমাদের হয়তো আর বেশিদিন এটা ঠেলতে হবে না। লতিফা ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা আমাদের মিছিলটার শেষটুকু দেখা যায় না। ওটা লম্বা হতে হতে দেশের সব সীমান্ত ছুঁয়ে আছে। মা আমরা কতক্ষণ হাঁটলাম? তুমি কি আর বেশিক্ষণ হাঁটতে পারবে?
যুথিকা আকাশের দিকে তাকায়- ওর চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে, তারপরও একটি নতুন উপন্যাস লেখার ছক করে। ওর মাথায় ছকটা দানা বেঁধে ওঠে।
লতিফা হাত ঝাঁকিয়ে বলে, মা বলছো না কেন আমরা আর কতক্ষণ হাঁটবো?
সময়ের হিসাব কোর না মা। মনে করো আমাদেরকে পঞ্চাশ হাজার দুই সাল পর্যন্ত হাঁটতে হবে।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সেলিনা হোসেন- র আরো পোষ্ট দেখুন