কেরানিও দৌড়ে ছিল

image_1278_318525
১৭.
জীবন কী? মৃত্যুই বা কী? জীবন তো বেঁচে থাকা। অবিরাম বেঁচে থাকার চেষ্টা। আর মৃত্যু? কারো জন্যে চিতার আগুন, কারো জন্যে মাটির ঘর। আহা, তখন তাহারা আপনাকে লইয়া যাইবে। কবরে শোয়াইয়া রাখিবে। তারপর তাহারা আপনাকে মাটির অন্ধকার ঘরে রাখিয়া চলিয়া যাইবে। চলি্লশ কদম দূরে তাহারা চলিয়া গেলেই কবরে আসিবে ফেরেশতা। পুছ করিবে_ বোল তেরা রব কৌন? ভাই নাই বন্ধু নাই স্ত্রী নাই সন্তান পরিজন নাই, মাটির ঘরে আপনার সঙ্গী সাথী নাই, যাহাদের সহিত জিন্দিগি গুজরান করিয়াছেন, তাহারা কেহ নাই। হায়, কোথায় গেলো সাধের সংসার, কোথায় গেলো মহব্বতের ঘর! দুইদিনের সংসার। দালানে থাকেন, কোঠায় থাকেন, আজ আপনার মাটি ভিন্ন ঘর নাই।
হ্যাঁ, মৃত্যুর কথা আমরা পরপর কয়েকটি শুনবো। প্রথমেই পিতার কথা। আমাদের কেরানি সুরাচ্ছন্ন হয়ে টলমল পায়ে বিছানায় গিয়েছিলো গভীর রাতে। আজকাল নিত্য সন্ধ্যায় খাম্বা সামাদের সঙ্গে সে বোতল খুলে বসে। বোতলের সোনালি পানিতে সে দিগন্তরে ভেসে যায়। তার আর এখন প্রশ্ন নাই যে কেন খাম্বা সামাদ তাকে এত যত্নে রেখেছে, কেন টাকা-পয়সার ভাবনায় তাকে আর রাখে নাই। অঢেল এত খরচ করছে কেন তার পেছনে, কেরানি আজকাল আর প্রশ্ন করে না। সে এখন এক প্রকার শক্তি অনুভব করে। নিশ্চয় তার ভেতরে একটা কিছু আছে যা খাম্ভাইয়ের নাই। এখন সে খাম্বা সামাদকেই বরং তার ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করে। কিন্তু এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো হদিস পায় নাই যে তাকে তৈরি করা হচ্ছে কোন উদ্দেশ্যে। আমরা আর কিছুকাল পরেই তা জানতে পারবো।
আপাতত আজ এই_ গভীর রাতে সে মদের ঘোরে মাতাল কি ঘুমঘোরে। ফোন বেজে ওঠে। খাম্বা সামাদ তাকে যে ফোনটা দিয়েছিলো তার রিং টোনে ফিরোজ সাঁইয়ের সেই গান_ এক মিনিটের নাই ভরোসা! প্রথম যেদিন এই রিং টোন খাম্বা সামাদ লাগিয়ে দেয়, কেরানি বলেছিলো, এমন একটা গান দিলেন ভাই, পরাণ চমকে ওঠে।
ক্যান? মানুষের তো মরার দিকেই পা। এই আছেন এই নাই! বিষয়টা স্মরণে থাকা ভালো। শোনেন নাই, ভরা আসরে ফিরোজ সাঁই গান গায়া উঠলো_ এক মিনিটের নাই ভরোসা! গায়া সারতেও পারে নাই, আসর থিকা ভিত্রে যায়াই ধুপ! শ্যাষ! এক মিনিটও গ্যালো না তার।
আজকাল মাঝে মাঝে জীবন-মৃত্যুর কথা ভাবে আমাদের কেরানি। চিন্তা-ভাবনা তার ধাতে নাই, আগেপরে কখনোই সে মন দিয়ে ভাবে নাই, কিন্তু কিছুদিন থেকে সে ভাবতে শুরু করেছে। বিশেষ করে মদ যখন তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার ভেতরটা হুহু হাহাকার করে ওঠে। এক মিনিটের নাই ভরোসা! শুধু কি জীবনের? এই যে খোয়াবের মতো একটা জগত এখন তার, এই আরাম, এই বিলাস, এই টাকা পয়সার দুশ্চিন্তাহীন জীবন, নিউ ঢাকা বোর্ডিংয়ে সুখবিলাসী শয্যা, ময়নার সেবাযত্ন, দু’বেলা রুই চিতল ইলিশ মুরগী খাসি, এরও কি আছে এক মিনিটের ভারোসা? যদি একদিন ঘুম থেকে উঠে সে দেখে আবার সেই রাস্তার মানুষ সে?
মদের ঘোরেও আমাদের কেরানি কাতরে ওঠে একেকদিন। যদি সব মিথ্যা হয়ে যায় ভোজবাজির মতো? আবার তবে ময়লা জামা! আবার তবে অনাহার! আবার তবে ভিকিরি! তার ভেতরটা কাতরে ওঠে বাবার জন্যে। প্রথমেই বাবার জন্যে। বাবার চিকিৎসা চলছে রংপুরে। একটা অপারেশন হয়েছে। এখন সেরে উঠছে। আর কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়ি যেতে পারবে বলে ডাক্তার বলেছেন। কেরানির আশা হয়, স্বপ্ন জাগে, বাবাকে সে দালান তুলে দেবে, হস্তিবাড়িতে তার বাবা মান্যগণ্য একজন হয়ে বাকি জীবনটা নির্বাহ করতে পারবে।
কিন্তু রাতে ফোন বেজে ওঠে। বড়বুবুর ফোন। মাঝরাতে।
হ্যালো।
হাইমাউ করে কান্নার শব্দ ভেসে আসে।
বুবু!!
আবার সেই কান্না।
বুবুজান!
নাই!
কী! কী! বুবুজান, কথা কও।
বাজান নাই।
নাই মানে? নাই মানে কী!
আর নাই! আইজ সইন্ধাকালে! হঠাৎ!
আমি আসছি, আমি সকালেই রওনা দিয়া আসছি।
টালমাটাল পায়ে কেরানি বোর্ডিংয়ের রুমের দরোজা খুলে বাইরে আসে। বারান্দার শেষ মাথায় কাচের জানালা। জানালার ওপারে বুড়িগঙ্গা। ছলছল করে বয়ে চলেছে। কী নির্জন! কী নির্জন এখন সদরঘাট। সার সার লঞ্চ। নৌকো। পানির ওপরে আলোর ঝিলিমিলি। শব্দ নাই। বাতাসের শোসানি নাই। মানুষের চলাচল নাই।
কখন সে ঘরে ফিরে আসে কেরানির জানা নাই। মাথার ভেতরে নদীর পানিতে আলোর ঝিলিমিলি বইতে থাকে সারা রাত। ভোরে ঘুম ভাঙে হরিবোল ধ্বনিতে। বোর্ডিংয়ের নিচে কারা যেন সমস্বরে বলছে_ হরিবোল! কেরানির জানা নাই হিন্দু মৃতের জন্যে এই ধ্বনি_ হরিবোল! হরিবোল!
ভোরের চা এনে ময়না ডাকে, ওঠেন! ওঠেন!
এত ভোরে তুই!
শোনেন নাই নিত্যা মরছে।
নিত্যা? হে ক্যাঠা?
গামছা ব্যাচে। দ্যাখেন নাই? অর নামই তো নিত্যা। কেরানির মনে পড়ে শীর্ণ সেই ছোকরার কথা। হাঁ, তার নাম নিত্যানন্দ। মুহূর্তে কেরানির মনে পড়ে যায় ছেলেটা গামছা ফেরি করতো সদরঘাটে, আর ঘুমোতো বোর্ডিংয়ের বারান্দায়। বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার জগদীশবাবু দয়া করে তাকে ঠাঁই দিয়েছিলো। আহা, কী হলো নিত্যানন্দের? এই তো গতকাল সন্ধ্যাকালেও তো কেরানি তাকে দেখেছে গামছা ফেরি করতে!
রাতে বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলো কেরানি। রাত না কাটতেই আরেক মৃত্যু! জীবনের ছবি মুছে যায় কেরানির চোখ থেকে। জীবন যেন সত্য নয় আর, এখন মৃত্যুই মহারাজ!
নিচে নেমে কেরানি দেখতে পায় নিত্যানন্দের লাশ। বোর্ডিংয়ের সমুখের বারান্দায় শুইয়ে রাখা হয়েছে তাকে। বড় একটা গামছা দিয়ে ঢাকা। নতুন কড়কড়ে গামছা। তারই গাঁটরি থেকে গামছা খুলে তাকে এখন ঢেকে রাখা হয়েছে। তার লাশ ঘিরে কয়েকজন মানুষ। শীতের দিন। চাদরে মাফলারে ঢাকা মানুষগুলোর মুখ। চোখ দুটো শুধু দেখা যায়। থেকে থেকে তারা হরিধ্বনি দেয়। কেরানিকে দেখে হঠাৎ চুপ করে যায় তারা।
জীবন একটা দৌড়। সেই দৌড় থেকে তবে মুক্তি পেয়েছে নিত্যানন্দ!
ডোম এসেছে। ডোমেরা নিত্যানন্দকে নিয়ে যেতে এসেছে। দাহ করবে কি? নিত্যানন্দের মতো হত গরিবকে দাহ করবার খরচ আসবে কোথা থেকে? ময়না সব জানে। সেই শেষরাতেই ময়না উঠে লাশের পাশে ঘুরঘুর করেছে। ময়না বলে, অরে পোড়াইবো না। ডোমেরা লয়া যায় ভাসায়া দিবো গাঙে।
ভেতরটা চিৎকার করে ওঠে কেরানির। না না করে ওঠে তার অন্তরাত্মা। আমাদের কাছে অবাক মনে হলেও সে এখন তার বাবার মৃত্যুর সঙ্গে নিত্যানন্দের মৃত্যুকে আর আলাদা করে দেখতে পারে না। তার ভেতরে যে এই বোধে জেগে ওঠার সম্ভাবনা ছিলো, সে নিজে অবাক না হলেও আমরা হই। তার ভেতরে আমরা এমন জাগরণ আমরা আগে দেখি নাই। এতটা মানবিক বোধ আগে সে অনুভব করলে মদিনাকে সে তালাক দিতে পারতো না, এটা আমাদের এই মুহূর্তে মনে হতেই পারে।
কেরানি খাম্বা সামাদকে তৎক্ষণাৎ ফোন করে।
বিষয়টা শুনে খাম্বা সামাদ বলে, আপনে অ্যাতো উতলা হন কিল্লা? আমি লোক পাঠায়া দিতাছি।
আরো একটা কথা আছে, খাম্ভাই।
কয়া ফালান।
মাই ফাদার হ্যাজ ডায়েড লাস্ট নাইট।
কন কি!!
রাতে ফোন পাইছি। আমি বাড়ি যাবো।
যাইবেন।
আজকেই! টু ডে!
ঠিক আছে। লগে মানুষ দিমু?
টাকাও লাগবে। প্রপার কবর হতে হবে। কুলখানি আছে।
চিন্তা কইরেন না।
নিত্যানন্দের দাহ হয় ঘটা করে পোস্তগোলা শ্মশানঘাটে। কেরানি নিজে উপস্থিত থাকে না, থাকতো সে যদি না তাকে ভোরেই রওনা হতে হতো হস্তিবাড়ির পথে। খাম্বা সামাদ এক যুবককে তার সঙ্গে রওনা করে দিয়েছে। একটা জিপ। না, বাসে তাকে যেতে দেয় নাই খাম্বা সামাদ। রেন্ট-এ-কার থেকে ভাড়া করা গাড়ি এনেছে নাসির, খাম্বা সামাদের পাঠানো সেই যুবক।
সারা রাস্তা নির্বাক হয়ে থাকে আমাদের কেরানি। মৃত্যু! মৃত্যু তাকে ভাবায়। এক মিনিটের নাই ভরোসা। কিন্তু ওহে কেরানি তুমি ভুলে যেয়ো না খাম্বা সামাদের কথাটা_ জীবন একটা দৌড়। লাইফ ইজ আ রান! দৌড়ের পথে পিছল খেয়ে পড়ো না। একবার পড়ে গেলে আর উঠতে পারবে না। ইউ মাস্ট রান! তোমাকে দৌড়ূতে হবে। জোরে আরো জোরে। এই দৌড়ে যে প্রথম হতে পারবে জীবনে জিৎ তারই।
অতএব সে এই ভাবনা নির্বিশেষে মুছে ফেলে। একটা কর্তব্য সম্পাদনের মতো বাবার শেষ কাজ সে সমাধা করে। কবরস্থানে সে একটা বড় জায়গা খরিদ করে বাবার দাফনের জন্যে। জলেশ্বরীর বড় মসজিদের ইমাম সাহেবকে আনায় কুলখানের জন্যে। বড় বোনের হাতে দশ হাজার টাকা দেয় চলি্লশা বাবদ।
বুবু, গ্রামের সকল মানুষকে দাওয়াত দিবেন। ট্যাকা যা দিয়া গেইলোম, ইয়াতে তো হবার নয়। ঢাকা যায়া আরো পাঠামো। চিন্তা না করেন।
তুই আসিবি না?
চ্যাষ্টা তো থাকিবেই। ঢাকায় হামার ম্যালা কাম। বড় ব্যাস্তো।
হস্তিবাড়ির মানুষেরা অবাক হয়ে যায় কেরানির মুখে দেশি বোল শুনে। আর দাফন থেকে শুরু করে তামাম আয়োজন দেখে তারা হতবাক হয়ে যায়। হস্তিবাড়ির মানুষেরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে কেরানির দিকে। তাদের আশা হয় তাদের সন্তানেরাও একদিন ঢাকা গিয়ে এমন বড় মানুষ হয়ে দেশে ফিরে আসতে পারবে_ হোক না তা বাবা বা মায়ের মৃত্যু সংবাদের মতো দুঃখের খবর পেয়েও।
আমরাও মুগ্ধ হবো কেরানির মনে আরো একটি ভাবান্তর দেখে। মদিনার কথা তার মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় কি সারাক্ষণ তার মন জুড়ে থাকে যে তিনটি দিন সে হস্তিবাড়িতে থাকে। তার চোখ কেবলি সন্ধান করতে থাকে মদিনার বাবা কি এসেছে কুলখানিতে। হস্তিবাড়ির এত মানুষ যে এসেছে, সবাইকে যে আসতে বলা হয়েছে, মদিনার বাবা কি চাচা কি মামা কেউ আসে নাই?
না, কাউকে তার চোখে পড়ে নাই। এতই সে হতভাগা তবে? মদিনাকে না হয় তালাকই সে দিয়েছে, না হয় মদিনা এখন তার কেউ নয়, তবু তারই সঙ্গে তো একদিন তার বাসর হয়েছিলো, না হয় সে বাসর সে স্বামীর অধিকারে পালন করতে পারে নাই, তবু তো একটা বিয়ে হয়েছিলো, একটা মানুষ আরেকটা মানুষের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে নিয়েছিলো একদিন, কবুল কবুল কবুল বলেছিলো তিনবার! হাহাকার করে ওঠে কেরানির ভেতরটা।
সঙ্গের যুবক নাসির বলে, খাম্ভাই ফোন করছিলেন। জিগাইলেন আর কয়দিন থাকবেন।
দেখি।
রাতে চাঁদ ওঠে। গোল চাঁদ। পূর্ণিমার চাঁদ। উঠান ভেসে যায় জ্যোৎস্নার ধবধবে আলোয়। এমন জ্যোৎস্না সে কত দেখেছে ঢাকা থেকে বরিশাল, বরিশাল থেকে ঢাকার পথে, লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে। জলেশ্বরীতে বাবা কুতুবুদ্দিনের মাজার মসজিদ আবদুর রহমান জুট মার্চেন্ট শাদা মার্বেল পাথরে মুড়ে দিয়েছিলো একদিন। দিনের বেলাতেও জ্যোৎস্না ধোয়া মনে হতো তার গম্বুজ আর দেয়াল। পূর্ণিমার আলো দেখলে কখনো কখনো আমাদের কেরানির মনে হতো সেই গম্বুজের কথা।
বাবাকে কবর দিতে এসে, কবর হয়ে যাবার পর রাত যখন নামে, চাঁদ যখন ওঠে, যখন সব কিছু ধবধব করে ওঠে, কেরানি উঠানে নেমে আসে।
জ্যোৎস্নার আলোয় বড়বুবুকে চোখে পড়ে তার, বসে আছে পাকঘরের সমুখের বারান্দায় একটা খুঁটি ধরে, যেন আর কোনো অবলম্বন নাই তার এই ঘুণে ধরা বাঁশটি ছাড়া।
হেথায় বসিয়া আছো।
বড়বুবু সাড়া দেয় না। তখন তার পাশে গিয়ে বসে কেরানি। বুবুর গায়ে হাত রাখে। শীতের দাপটে তার শাড়িটিও হিম শীতল। দুই ভাইবোন অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে আকাশভরা জ্যোৎস্নার আলোয়।
অকস্মাৎ কেরানি প্রশ্ন করে, মদিনার খবর কিছু নাই?
বড়বুবু চমকে ওঠে।
তার কথা পুছ করো?
না, এমনেই মনে পড়িলো। ভালো আছে? আর কোনো? আর কেউ?
না। বিয়া সে করিবে না। নিকা বসিবে না।
বুবু, একখান কথা কই। তার কাছে সম্বাদ দিও, যদি কোনো দরকার হয় টাকার কি পইসার, চিন্তা ঝ্যান না করে। তার বাপের অবস্থা ভাল্ নয়। নত্তুন সংসার যদি করিতে চায়, চিন্তা না করে। যা লাগে পাঠায়া দেমো।
দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বড়বুবু তখন বলে, ঝে জিনিস দূর করি দিছো তাকে নিয়া ভাবনা রাখা ঠিক নয় রে। তাঁই তোর কেউ আর নয়। তার কথা মনে আনিলেও পাপ হয় তোর।
কেরানি আর কিছু বলে না। ধীরে সে উঠে আসে বড়বোনের পাশ থেকে। তার গলার লম্বা মাফলার ঝুলছিলো, মাফলারে টান পড়ে। কেরানি ঘুরে দাঁড়ায়।
বড়বুবু বলে, একখান কথা। পুছ না করিলে নয়। অ্যাতো যে খরচ করিলি, ছোটজনার বিয়া দিলি, টিনের ঘর তুলি দিলি, পানির টিপকল করিয়া দিলি, অ্যাতো পাইসা তোর?
হয়, হয়।
আসিলো কী পর্কারে? কী কাম করিস তুই? হঠাৎ অ্যাতো টাকা তোর, মোর মনে কথাটা কাকের মতো ঠোকরায়। আমাকে সত্য করিয়া তুই কয়া যা, কোনো অন্যায় কামে তো তুই নাই?
কেরানির মনে পড়ে যায় খাম্বা সামাদের একটা কথা। খাম্ভাই একদিন সোনারগাঁও হোটেলের দোতলার বারে বসে বলেছিলো, কীভাবে হলো সেটা কোনো কথা নয়, কী হলো সেটাই আসল। পাপ আর পুণ্য? বড় কঠিন প্রশ্ন। ন্যায় আর অন্যায়? বড় জটিল এর উত্তর।
সেদিন পিস্তলের গুলি ছুড়ে একটা বড় টেন্ডার ভণ্ডুল করে দিয়ে খাম্বা সামাদ তাকে নিয়ে বসেছিলো মদের আসরে সোনারগাঁওয়ে। প্রশ্নটা কেরানি করেছিলো, ভাই, এই যে ছিনতাই করে টেন্ডারটা নিলেন, কাজটা কি ভালো করলেন?
মুহূর্তে মুখের রঙ পালটে গিয়েছিলো খাম্বা সামাদের। চোখ সরু করে তাকিয়ে ছিলো কেরানির দিকে অনেকক্ষণ। আর তখন আমাদের কেরানি ভীষণ ভয় পেয়েছিলো_ এই বুঝি তাকে সোনার দালান থেকে এক ধাক্কায় ফেলে দেবে খাম্বা সামাদ। এক নিমেষে তার পতন ঘটবে, তার বাদশাহী জীবন মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু না। একটু পরেই হেসে ফেলেছিলো খাম্বা সামাদ। বলেছিলো, যারে নিয়া আমি বড় একটা কাজের ভাবনায় আছি, তার মুখে এই কথা! আরে, মিয়া, দৌড়ের মুখে এত ভাবলে চলে না। ভালো মন্দ নিয়া তারা ভাবে যারা দৌড়ে নাই, দৌড়ের রাস্তার কিনারে বইসা যারা গীত গায় তারাই চিন্তা করে কোনটা ন্যায় করলাম আর কোনটা অন্যায় হইলো।
কেরানি এই জ্যোৎস্নাভরা রাতে বড়বুবুর মুখখানা বড় স্বর্গীয় বলে অনুভব করে ওঠে। অনেকক্ষণ সে তাকিয়ে থাকে বোনের মুখের দিকে। তারপর বলে, এগুলা কথা ছাড়ি দ্যান। এ নিয়া চিন্তা না করেন। তোমার ভাই ঠিকে আছে ঠিক পথে আছে। জীবন তো একখান লম্বা রাস্তা বুবু। সেই রাস্তায় বিপদও আছে বন্ধুও আছে। একঝনা হামাকে ভাই বলিয়া বুকে টানি নিছে। তারে সাথে মুই আছোঁ। আর মদিনার কথা পুছ করিলোম, অন্যায় যদি বলেন তো মদিনার উপ্রে হামার বড় অন্যায় হয়া গেইছে। তাকে সুখে শান্তি দিতে পারিলে পাপ হামার খানিক মোচন হইবে।
এরপর কেরানি শোবার ঘরে যায় না। ঘর এখন টিনের নতুন ঘর। খাট। বিছানা। বিজলি বাতি। না, সে শুতে যায় না।সে বাইরে যায়। বাড়ির বাইরে পথঘাট গাছপালা খেতমাঠ জ্যোৎস্নায় ধবধব করছে। বাড়ির সমুখে বাগান এখন। গাঁদা ফুল। গাঁদা ফুলের ঝাড়। তারই একপাশে সঙ্গে আসা যুবক নাসির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।
কেরানিকে দেখেই সে সিগারেট পায়ের নিচে পিষে ফেলে। সবটা পারে না। সিগারেটের মুখ থেকে তখনো লাল অঙ্গার ধিকিধিকি করে। নাসির বলে, ভাই, গেরামে আমি আগে আসি নাই জিন্দিগিতে। ছিনেমার মতো লাগতাছে।
কেরানির মনটা উদাস। কথাটা শুনে
নীরবে সে হাসে।
নাসির বলে, মন চায় আর কয়ডা দিন থাইকা যাই। কিন্তুক বড়ভাই ফোনের পর ফোন করতাছে। কইতাছেন কবে আমরা ঢাকা যামু।
ফোনটা লাগাও তো। কথা বলি।
ফোনের ওপার থেকে থাম্বা সামাদ বলে, কী ভাই, সব ঠিকঠাক মতো হইছে তো?
পরশু কুলখানিটা হলেই চলে আসবো।
আয়া পড়েন। আহমদউল্লাহরে আমি ফিট করছি।
ফিট? কেরানি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
খাম্বা সামাদ বলে, আসেন, আপনের তো সেই কামটা বাকিই আছে। তার হোগায় লাত্থি মারবেন কইছিলেন। এইবার মারবেন! সক্কলের ছামনেই! ছদরঘাটে! দুনিয়া দেখবো।
সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের সেই অপমানটা মনে পড়ে যায় কেরানির_ পাগলিকে গর্ভবতী করার মিথ্যে সেই অপবাদ। বাঘের মতো তার ভেতরে গর্জে ওঠে প্রতিশোধের হালুম।
ইয়েস, খাম্ভাই। আমি আসতাছি।
[চলবে]