উন্মুক্ত পথের স্বচ্ছন্দ যাত্রী

কাজী নজরুল ইসলামকে যদি বিচার করতে হয় তবে তার পটভূমিতেই করতে হবে। নয়তো তার পূর্ণ পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠবে না আমাদের কাছে। আমরা জানতে পারব না তার অসামান্যতাটা কোথায় ও কতটা। নজরুল ইসলাম বড় প্রতিভা ছিলেন- এ কথা বললে সবটা বলা হয় না তার সম্পর্কে। সেই সঙ্গে তার পক্ষে কবি কায়কোবাদ হওয়া যে সহজ ও স্বাভাবিক ছিল- এই কথাটা যোগ করলে নজরুল ইসলামের পরিচয়লিপিটি পূর্ণতর হয়। বৈষয়িক দিক থেকে কায়কোবাদের তুলনায় দরিদ্রতর ছিলেন নজরুল ইসলাম। তিনি কোরেশ বংশের নন; কাজী বংশের। তার বাবা মারা যান যখন তার বয়স মাত্র ৯, মা চলে যান অন্য ঘরে। তারপর গৃহ বলতে কিছু ছিল না নজরুল ইসলামের। সেই কারণেই মনের দিক থেকে অতি বড় গৃহী হবার কথা ছিল তার। সম্ভাবনা ছিল তিনি কেরানী হবেন, আরও বড় হলে সাব-রেজিস্ট্রার। কথা ছিল অন্ন-চিন্তাতেই জীবন কাটবে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিস্থলের অতিপরিমিত পরিসরে। তার পক্ষে সৈনিক হওয়া ছিল অস্বাভাবিক; কবি তার চেয়েও বেশি। কিন্তু তিনি শুধু কবি হলেন না; হয়ে উঠলেন অসামান্য লেখকও। তার কারণ তার প্রতিভা ছিল এবং সেই প্রতিভার একটা প্রধান লক্ষণ ছিল এই যে, তিনি সদগৃহী ছিলেন না। সেই যে তিনি ঘর ছাড়লেন অতি অল্প বয়সে, তারপর ভাগ্যকে গড়লেন নিজ হাতে, কিন্তু আর কোনোদিন ফিরে গেলেন না ঘরে- না চুরুলিয়াতে, না অন্য কোথাও। দারিদ্র্য তার অজানা ছিল না। কায়কোবাদের মতো তিনিও দেখেছেন অনাহার-ক্লিষ্ট শিশুকে তার চারপাশে কাঁদতে। কিন্তু তার মনের মধ্যে সেই হীনম্মন্যতা ছিল না, যা আপন সন্তানকে বলতে শেখায় ‘অপোগ শিশু’; শেখায় করুণা করতে নিজেকে। দারিদ্র্য তাকে দুর্বল করেনি; মহৎ করেছে। তাকে দিয়েছে খ্রিস্টের সম্মান। আত্মকরুণা যে নজরুল ইসলামে নেই- তা নয়। আত্মকরুণা আছে; আছে অশ্রু ও অভিমান; ফুল নেব না অশ্রু নেব- এই প্রশ্ন অর্থাৎ নানা প্রকারের ভঙ্গিমা; কিন্তু সবকিছু নিজের মধ্যে ধারণ করে, সবকিছুকে ছাড়িয়ে-ছাপিয়ে, জীবনের সামান্যতাকে নিচে রেখে অনেক বড় হয়ে উঠেছেন তিনি। তিনি গৃহের কবি নন; কবি তিনি উন্মুক্ত পথের, যদিও গৃহ তার রচনার মধ্যে রয়েছে। আগামী দিনের মানুষ নজরুল ইসলামকে কীভাবে নেবে সেটা তাদের বিবেচ্য, কিন্তু আমাদের পক্ষে নজরুল ইসলামের এই পরিচয়টাই প্রধান যে, তিনি কবি উন্মুক্ত পথের। একেক যুগ একেকভাবে নেয় একই প্রতিভাকে। আমাদের পক্ষে উন্মুক্ত পথে স্বচ্ছন্দপদচারী নজরুল ইসলামই প্রধানতম নজরুল ইসলাম। এই পরিচয়টাই যে বড় করে চোখে পড়ে তার কারণ দুটি। প্রথম কারণ, আমাদের জীবনে পথের অভাব; অভাব পথচারীর। আমরা সকলেই গৃহী, গৃহের বাইরে ছোট ছোট গলি-ঘুঞ্জি আঁক-বাঁক আছে বটে, কিন্তু উন্মুক্ত পথ নেই খুব বেশি। পথ যেখানে বা আছে, অভাব আছে যাত্রীর। দ্বিতীয় কারণ এই যে, গৃহহীন নজরুল ইসলামের পক্ষে গৃহী হওয়াই স্বাভাবিক ছিল; গৃহী না হওয়ার মধ্যে তার অসাধারণত্ব যেমনভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তেমন বোধহয় অন্য কোথাও নয়। সকলেই জানেন, নজরুল ইসলামের ওপর প্রভাব পড়েছিল ওয়াল্ট হুইটম্যানের। সেই প্রভাব একান্ত স্বাভাবিক। কেননা, হুইটম্যানও কবি ছিলেন উন্মুক্ত পথের। উন্মুক্ত পথের পথিক বলেই অতি অনায়াসে সর্বত্রগামী হয়েছেন তিনি। হিন্দু-মুসলমানের মিলন তার লেখার মধ্যে যেমন ঘটেছে, জীবনে রাজনীতিতে, বা সাহিত্যে; তেমন কোথাও ঘটেনি বাংলাদেশের। খ্রিস্টানরাও বাদ যায়নি। সাধারণ মানুষের জীবনে তিনি যেমনভাবে প্রবেশ করেছেন, তার আগে অন্য কোনো লেখক তেমনভাবে প্রবেশ করতে পারেনি। তার অসামান্য গল্প ‘রাক্ষসী’তে তিনি শুধু বাগ্দী মেয়েকে আনেননি; এনেছেন তার মুখের ভাষাকেও। বাগ্দী মেয়েকে ভদ্র সাজে আসতে হয়নি, সাহিত্যে সে এসেছে অকুণ্ঠ পদে, এসেছে নিজের ভাষায় কথা বলতে বলতে। সন্দেহ নেই, নজরুল ইসলামের লেখা নাটকগুলোই তার সাহিত্যের দুর্বলতম অংশ। সেখানে ভাবালুতা অধিক, কিন্তু সেই ভাবালুতার মধ্যেও নারী-শক্তির উদ্বোধন ভিন্ন যে মুক্তি নেই- আমাদের এই কঠিন সত্যটিকে উজ্জ্বল করে প্রকাশ করেছেন তিনি ‘ভূতের ভয়’ নাটকে। ‘ঝিলিমিলি’তে বিএ পাস করা না করার যে প্রাণঘাতী বিতর্ক হত্যা করল ফিরোজাকে, সে শুধু বিতর্ক নয় একটা। সে মুসলমান সমাজের গৃহাভ্যন্তরের যে প্রাণহীনতা, যে আনন্দহীনতা ঘরের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে অন্যায় শাসনের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে তারই কাব্যময় প্রকাশ।

চিরকালের মেয়ে ফিরোজা নজরুল ইসলামের কালে এসে লাঞ্ছিত হয়েছে মুসলমানের গৃহে আটকা পড়েই। বিপ্লবী তরুণকে নজরুল ইসলাম যেমনভাবে বুঝেছেন তেমনভাবে এমনকি রবীন্দ্রনাথও বোঝেননি। ‘চার অধ্যায়’-এর তুলনায় ‘কুহেলিকা’র সাহিত্যিক মূল্য স্বল্প সন্দেহ নেই, কিন্তু ‘কুহেলিকা’র যে সহানুভূতি আছে তরুণ সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি; ‘চার অধ্যায়’-এ তা নেই। ‘কুহেলিকা’র জাহাঙ্গীর সমসাময়িক মুসলিম সমাজে ছিল না। নজরুল ইসলাম নানাদিক থেকে এগিয়ে ছিলেন তার সমাজের তুলনায়। আনসার যখন নতুন রাজনীতিকে গ্রহণ করেছে, কৃষক-শ্রমিকের রাজনীতিকে, তখন বোঝা যায় নজরুল ইসলাম এগিয়ে গেছেন সমসাময়িক লেখকদের অনেককে পেছনে ফেলে। আনসারকে তিনি সব্যসাচী করেননি; কল্পনার আতিশয্যকে পরিহার করার মধ্যে যে বাস্তব বুদ্ধি প্রকাশিত হয়েছে, তা সাধারণ নয়। ‘গোরা’র মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যে একটি অতিশয় তেজস্বী, নিতান্ত অবাঙালি পুরুষ সৃষ্টি করেছিলেন, যার কণ্ঠস্বর মেঘমন্দ্র, আত্মবিশ্বাস প্রচ , সমাজের প্রতি যার দায়িত্বজ্ঞান সর্বদাই অবিচলিত, সেই কল্পনার মানুষটি যেন বই থেকে বার হয়ে শরীর ধরে এসে দাঁড়িয়েছে নজরুল ইসলামের। সংস্কার বিশ্বাসী গোরা নয়, সেই গোরা যে জেল খেটেছিল অন্যের কারণে, কিন্তু মাথা নোয়ায়নি কিছুতেই, বিশেষ করে সেই গোরা উপন্যাসের শেষে যাকে দেখি এসে দাঁড়িয়েছে সুচরিতা ও পরেশবাবুর কাছে; বলছে, তার আর ভয় নেই ব্রাত্য হবার। কেননা তার সমাজ নেই, সংস্কার নেই, সে সকল মানুষের, সে বৃহৎ ভারতবর্ষের। কিন্তু গোরা তো কল্পনার সৃষ্টি। গোরার পিতা-মাতার খোঁজে রবীন্দ্রনাথকে যেতে হয়েছে আয়ারল্যান্ডে, সংগ্রহ করতে হয়েছে আনন্দময়ীর মতো স্নেহশীলা মাতাকে, কৃষ্ণদয়ালের মতো অবস্থাপন্ন গৃহস্বামীকে। নজরুল ইসলাম দরিদ্র বাঙালি পরিবারের ছেলে এবং সেই কারণে আরও বেশি অসামান্য। অসামান্য বলেই সামান্য সমাজ তাকে গ্রহণ করতে পারেনি। মুসলমান সমাজের মুরবি্বরা প্রথমে বলেছেন, নজরুল ধর্মদ্রোহী। পরে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে চেষ্টা হয়েছে তাকে সংস্কৃত করে সামান্য করে নেবার। কিন্তু তিনি অসামান্যই আছেন। উন্মুক্ত পথে তো চলেছেনই; নজরুল ইসলাম আরও একটা কাজ করেছেন। ডাক দিয়েছেন দেশবাসীকে, পথটাকে আরও বড় আরও দীর্ঘ ও প্রশস্ত করে নেবার। এই যাত্রী পথপ্রদর্শক, আবার তিনি নির্মাতাও।