স্তম্ভিত ইতিহাস : নজরুল

নিজেকে ‘স্বেচ্ছাচারী’ বলে ঘোষণা করেছিলেন আমাদের কোন্ কবি? বাংলা কবিতা পড়তে যাঁরা অভ্যস্ত, এ-প্রশ্নের উত্তর দিতে তাঁদের কোনো দ্বিধা হবার কথা নয়, তাঁরা নিশ্চয় সঙ্গে সঙ্গেই মনে করতে পারবেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম, তাঁর ‘আমি স্বেচ্ছাচারী’ লাইনটি, বা বিভিন্ন কবিসভায় প্রায় শারীরিক উৎক্ষেপের মধ্যে এই লাইনটি নিয়ে তাঁর নানা ভঙ্গিমার উচ্চারণ। ঠিকই, শব্দটির সঙ্গে শক্তির নাম জড়িয়ে আছে অনেকদিন; কিন্তু তবু বলা যায় তাঁরও আগে বাংলা কবিতার আরো একজন মানুষ ওই একই পরিচয়ে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন নিজেকে, নিজের বিষয়ে বলেছিলেন ‘স্বেচ্ছাচারী উচ্ছৃঙ্খল বাঁধনহারা’।
উদ্ধৃতিচিহ্নের অন্তর্গত ওই শব্দগুলি অবশ্য কোনো কবিতার শব্দ নয়, এ হলো বাঁধনহারা নামে নজরুলের উপন্যাস থেকে নেওয়া এক শব্দগুচ্ছ। সেই উপন্যাসে, কাউকে না বলে ঘর ছেলে সেনাদলে পালিয়ে গেছে যে নায়ক, সেই ‘নূরু’ একবার তার চিঠি শেষ করেছিল এই আত্মপরিচয় দিয়ে : ‘স্বেচ্ছাচারী–নুরুল হুদা’। এক-এক চিঠিতে তার আত্মপরিচয় এক-একরকম। কখনো সে লেখে ‘তোমার কাঠখোট্টা লডুয়ে দোস্ত’, কখনো ‘হতভাগা’ কখনো-বা নরপিশাচ’। কিন্তু ‘স্বেচ্ছাচারী’ কথাটার দিকে লেখকের অতিরিক্ত ঝোঁক টের পাওয়া যায় যখন নূরুল প্রতি স্নেহশীলা এক ব্রাহ্ম মহিলা তাঁর ‘পাগল পথিক’ ওই ‘ভাই’য়ের কথা বলতে গিয়ে তাঁরও চিঠিতে লেখেন : ‘স্নেচ্ছাচারী’ উচ্ছৃঙ্খল বাঁধনহারা সে–অতএব এখন রক্তের তেজে আর গরমে সে কত আরো অসম্ভব সৃষ্টিছাড়া কথাই বলবে।’
উপন্যাসেরই কথা যদি এসব, তাহলে কেন লিখছি নজরুল নিজেকে বলতে চেয়েছিলেন ‘স্বেচ্ছাচারী’? এ তো তাঁর নিজের কথা নয়, এ তো তাঁর তৈরি এক চরিত্রের কথা মাত্র।
চরিত্রেরই কথা; কিন্তু এইখানেই এক সমস্যা তৈরি হয়। কবিরা যখন উপন্যাস লেখেন তখন প্রায়ই তাঁরা–অন্তত তাঁদের প্রথম দু-একটি লেখায়–অনিবার্যভাবেই প্রকাশ করে বসেন নিজেকে, যেমন করেছেন শক্তি অথবা জয়। তখন, সেটা হয়ে দাঁড়ায় যেন তাঁদের আত্মসত্তার কোনো ছদ্মপ্রকাশ। যে-নূরু নামে নজরুল ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলেন অনেকের কাছে, তাঁর গল্পে-উপন্যাসে প্রায়ই নায়ক হয়ে ওঠে সেই নামটি, প্রায়ই আমাদের খুব জানা নজরুল-লক্ষণগুলি আরোপিত হতে থাকে সেই নামের চরিত্রে। বাঁধনহারা যখন ছাপা হতে শুরু করেছিল ‘মোসেলম ভারত’ পত্রিকায়, নজরুলের একুশ বছর বয়সে (বই বেরোয় আরো সাত বছর পরে), তখনই হয়তো সকলের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না লেখকের সঙ্গে নূরুর একাত্মতার পরিমাণ। কিন্তু অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই পাঠকেরা নিশ্চয় বুঝতে পারছিলেন, করাচি সেনানিবাসের ঠিকানা থেকে চিঠি লিখে চলেছে ঘরছাড়া যে বাঙালি যুবাটি, সে তো প্রায় নজরুলেরই প্রতিচ্ছবি। তার নিজের আর তার পরিচিত নানাজনের চিঠিপত্র থেকে নূরুর যে ব্যক্তিছবিটা জেগে উঠতে থাকে সে হলো এক কবির ছবি, এক গাইয়ের ছবি, রবীন্দ্রনাথের গানে কবিতায় যার আনন্দ, সেই কবিতাগান শুনলে যার মনে হয় ‘কে সে কবিশ্রেষ্ঠ যাঁর দুটি কালির আঁচড়ে এমন ক’রে বিশ্বের বুকের সুষুপ্ত ব্যথা চেতনা পেয়ে ওঠে? …তাঁর চরণারবিন্দে কোটি কোটি নমস্কার!’ আমাদের নিশ্চয় মনে পড়বে ‘সঞ্চিতা’র উৎসর্গপাতা, ওই ‘চরণারবিন্দেষু’ লিখেই রবীন্দ্রনাথের কাছে যা পৌঁছে দিয়েছিলেন নজরুল। নূরুর বন্ধুরা তাকে বলে ‘কবি-কিশলয়’; তার ভাবী বলেন, তার ‘সরল অট্টহাস্যের কথা গল্পের রহস্যালাপে ফাঁকা ঘরকে ‘মজলিসের মত সরগরম করে’ তুলবার কথা, ‘প্রাণের অনাবিল সরলতা আর প্রচ্ছন্ন বেদনা’র কথা। তার চরিত্রে আছে ‘ছায়ানটের নৃত্যচপলতা আর শিরায় শিরায় পূর্ণ তেজে নটনারায়ণ রাগের ছন্দপতন হিন্দোল দোল’। তাকে যারা ভালোবাসে তারা জানে ‘স্রষ্টার বিদ্রোহী’ এসব মানুষকে ‘স্রষ্টার ভালোবাসে তারা জানে ‘স্রষ্টার বিদ্রোহী’ এসব মানুষকে ‘স্রষ্টার রাজভক্ত’দের চিনতে পারবার কথা নয়, তারা জানে যে ‘সহজ ঐ ক্ষ্যাপাটাকে; ভালোবাসা যায়। নিজেকে ‘স্বেচ্ছাচারী’ অভিধা দিয়ে নূরু বলে তার বন্ধুকে : ‘আগুন, ঝড়, ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, আঘাত, বেদনা–এই অষ্টধাতু দিয়ে আমার জীবন তৈরি হয়ে যা হবে দুর্ভেদ্য-মৃত্যুঞ্জয়-অবিনাশী! আমার এ পথ শাশ্বত সত্যের পথ; –বিশ্বমানবের জনম জনম ধরে চাওয়ার পথ। আমি আমার আমিত্বকে এ পথ থেকে মুখ ফিরাতে দেবো না।’ কিন্তু এরই সঙ্গে, নিজেকে ‘নরপিশাচ’ নাম দিয়ে তার ভাবীসাহেবকে সে লেখে : ‘মানুষের এতটুকু দুঃখ দেখে সময় সময় আমার সারা বুক সাহাবার মত হা-হা করে আর্তনাদ করে ওঠে।’ সে বুঝতে পারে না, অন্য কেউ বুঝবে বলেও মনে করে না যে ‘হৃদয়ের এই যে দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত দুষ্মনীভাব, এর সূত্র কোথায়’, সে বুঝতে পারে না ‘কি আমায় মাতাল করে তুলেছে আর সঙ্গে সঙ্গে সে কোন অনন্ত যুগের অফুরন্ত কান্না কণ্ঠ পর্যন্ত ফেনিয়ে উঠছে বিষের মত–তীব্র হলাহলের মত!’
‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা হয়নি তখনও কিন্তু ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতুর্য’র নজরুল নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করেছেন তাঁর এই চরিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে, বলতে শুরু করেছেন : ‘নূরুটা ক্রমেই স্রষ্টার প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠছে দেখচি…যেন একটা বিপুল ঘূর্ণীবায়ু হু-হু-হু ক’রে ধুলো উড়িয়ে সারা দুনিয়াটাকে আঁধার ক’রে তুলতে চাইছে’, আবার সেই নূরুই ‘কোথায় কোন গহনপারের বাঁশী যেন…শুনছে আর শুনছে! যখন সবাই শোনে মিলনের আনন্দরাগ, এরা তখন শোনে বিদায়বাঁশির করুণ গুঞ্জরণ!…এ ক্ষ্যাপার কোনটা যে অানন্দ কোনটা যে ব্যথা তাই যে চেনা দায়!’


ব্যথায় আনন্দে জড়ানো, বিদ্রোহে ভালোবাসায় জড়ানো সেই নজরুল ইসলামকে আমরা জানতে শুরু করেছিলাম আমাদের কৈশোর থেকে, প্রায় সকলেই যেভাবে জানে। কিংবা হয়তো ভুল হলো বলা। নজরুল ইসলামকে নয়, আমরা জানতে শুরু করেছিলাম তাঁর আবেগকে, ব্যক্তিপরিচয়হীন আবেগকে। আমার মতো অনেকেই হয়তো আছেন যাঁরা নজরুলের লেখা গান শুনেছেন—শুনে আচ্ছন্ন বা আলোড়িত হয়েছেন–নজরুলের নাম শুনবারও আগে। প্রায় যেন এক লোকসাহিত্য-লক্ষণ লিপ্ত হয়ে আছে তাঁর লেখায়, লেখাটা যেখানে সকলের, তার ব্যক্তিচিহ্নটা যেখানে গৌণ হয়ে যায়।
আমরা ছিলাম পদ্মাপারে, আট-নবছর বয়স তখন, কাকার বাড়িতে পৌঁছল ঝকঝকে একটা গ্রামোফোন। মফস্বল শহরে সেই ১৯৪০-৪১ সালে সে ছিল একটা ঘটনা, ‘কাল মধুমাস’ কবিতায় তারও আগেকার তেমনি এক ঘটনার চমৎকার ছবি এঁকেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। নতুন কল এল, সেই সঙ্গে এল সদ্যপ্রকাশিত কিংবা অদূর-অতীতে প্রকাশিত রেকর্ডের সম্ভার, গানে-নাটকে রীতিমতো মথিত হয়ে উঠল সময়টা। পঙ্কজ মল্লিক, সায়গল, শচীন দেববর্মণদের সঙ্গে সঙ্গে নির্মলেন্দু লাহিড়ীও তখন অবশ্যসংগ্রহযোগ্য উপাদান, রেকর্ড থাকবে আর ‘সিরাজদ্দৌলা’ থাকবে না এ যেন তখন ভাবাই শক্ত। শচীনদেবের গান নিয়ে মশুগুল সবাই, সেসব গানের কথা সুরকে প্রগাঢ়ভাবে বুঝে নেবার তখনও বয়স হয়নি আমাদের, কিন্তু তবু আমাদের মাতিয়ে রাখে ‘চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে’, ‘কুহু কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া’, ‘মেঘলা নিশিভোরে’ কিংবা ‘পদ্মার ঢেউ রে’। পদ্মা তো আমাদেরই নদী, এ তো তবে আমাদেরই গান, আর ওসব পাখিও তো আমাদের পাখি! ‘ওরে বনপাপিয়া, ছিলি কাহার পিয়া, ছিলি আর জনমে/আজও ভুলতে নারিস আজও দূরে গিয়া’–এর ভিতরকার বিরহবাগ ঠিকমতো তখন পৌঁছবার কথা নয় আমাদের মনে, কিন্তু তবুও, সেই কৈশোরে ‘ওরে হারায় তাহার কী পাওয়া যায় না কি রে’ কথাগুলি মনের ভিতর অস্পষ্ট একটা ব্যথাবোধই তৈরি করে তুলত বলে মনে হয়।

কিন্তু এসব তো শচীনদেবের গান। এর সঙ্গে নজরুলের কোনো সম্পর্কের কথা আমরা ভাবিনি তখন। ‘সিরাজদ্দৌলা’য় ‘আমি আলোর শিখা’ বা ‘পথহারা পাখি’কে জানতাম কেবল আলেয়ার গান কিংবা বড়োজোর নীহারবালার গান (কল্পতরু সেনগুপ্ত-র সংকলনে অনবধানে যাঁকে বলা হয়েছে কাননবালা) হিসেবে, তার মধ্যে কোনো নজরুল চিহ্ন তখনও টের পাইনি আমরা। দশ বছর বয়সে দেখা হলো ইস্কুলের ছেলেদের একটা অভিনয়, সে অভিনয়ের অন্য কোনো নাট্যচিহ্ন আর মনে নেই আজ, কিন্তু মনে আছে ব্যান্ড বাজানোর তালে তালে মাতিয়ে দেওয়া এক ‘মার্চিং সং’ : ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল’। আজও এ-গান শুনবার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাই অপটু-হাতে-বাঁধা-মঞ্চের উপর ব্যান্ডবাজানো কয়েকজন উঁচুক্লাসের বন্ধুর মুখচ্ছবি, দেখতে পাই তাদের পদক্ষেপ আর হাতের সঞ্চালন। তখনও জানিনি, জানতে চাইনি, ও-লেখা কার। জানতে চেয়েছি আরো দু-বছর পরে। গেরুয়াধারী একক সন্ন্যাসী এসে আমাদের বৈঠকখানায় একদিন তাঁর ভরাট স্বরে বিপুল উৎসাহে গাইছিলেন কিছু দেশাত্মবোধের গান, সমবেত শ্রোতাদের পিছনে বসে হঠাৎ তখন একটা গানের কথাগুলি আমার লিখে নেবার আগ্রহ হলো। কাগজপেন্সিল জুটিয়ে নিয়ে দ্রুত হাতে লিখতে শুরু করলাম কথাগুলি, গান শুনে শুনে, কেননা কথাগুলি খুব পছন্দ হচ্ছে আমার। সভা সাঙ্গ হয়ে যাবার পর, পরে একদিন, একজন মাস্টারমশাইয়ের কাছে অজানা-এক গানের এমন আহরণের কথা বলছি যখন সগর্বে, মাস্টারমশাই বললেন : সে কী রে, অজানা কেন হবে! এ গান কার লেখা জানিস না? এ তো নজরুলের গান!
গানটি ছিল : জাতের নামে বজ্জাতি সব, জাতজালিয়াত খেলছে জুয়া!
মাস্টারমশাই বললেন : শুনিসনি ‘কারার ঐ লৌহকপাট/ভেঙে ফেল্ কররে লোপাট’? শুনিসনি ‘আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত’? সেইদিন থেকে নজরুল ইসলাম এলেন আমার সচেতনতার মধ্যে। সেইদিন থেকে নজরুলের গানের সঙ্গে কথার সঙ্গে কবিতার সঙ্গে দেখতে শুরু করলাম একজন কবি-নজরুল, একজন ব্যক্তি-নজরুল। সে-নজরুল পাখিদের ডাকে বিরহের চিহ্ন দেখেন, পদ্মার স্রোতে হারানোর ব্যথা দেখেন, বাহিরে-অন্তরে ঝড় উঠলে সে-নজরুল আশ্রয়ের খোঁজ করেন, আবার একইসঙ্গে সে-নজরুল বলেন : ‘মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়’ কিংবা ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব, জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া’।


বাঁধনহারার নূরু, কিংবা তার অগ্রজাতুল্যা সেই ব্রাহ্ম নারী সাহসিকা, এদেরও একটা বড়ো অভিযান ওই জুয়ার বিরুদ্ধে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমাদের দেশের আর কোনো কবি বা নেতার কাছে যে-সমস্যা তখনও খুব প্রত্যক্ষ সংকট হিসেবে দেখা দেয়নি, সেই সম্প্রদায়সমস্যা বাঁধনহারার অন্তর্গত একটা দৃষ্টিভূমি তৈরি করে রেখেছিল বেশ স্পষ্টভাবেই, ১৯২০ সালেই সাহিত্যভূমিতে নজরুলের পৌঁছনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। স্বেচ্ছাচারী বলে নিজেকে তিনি ঘোষণা করেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর স্বেচ্ছাচার এই সংস্কারের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছার জাগরণ। সূচনায় আমরা বলেছি, লেখাটির মধ্যে কীভাবে তৈরি হয়ে উঠেছে নজরুলের চরিত্র। যা তখন বলা হয়নি তা হলো, কী আছে সেই চরিত্রের–কিংবা, সে-বইয়ের চরিত্রাবলির–দৃষ্টিতে। কী তারা দেখছে, কী তাদের বলবার কথা। ‘হ্যাঁ, ধর্ম সম্বন্ধে আমার আর একটু বলবার আছে।…আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খৃষ্টান, আমি বৌদ্ধ, আমি ব্রাহ্ম।’ উপন্যাসে নূরুর কথা এ নয়, এ হলো সাহসিকা নামে চরিত্রটির মুখের কথা। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি যে বাংলাসাহিত্যজগতে পৌঁছবার মুহূর্তে এ হলো সাহসিকার সূত্র ধরে নজরুলেরই আত্মঘোষণা। এই ঘোষণার এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন ছিল সেদিন। এই ঘোষণায়, অথবা এ উপন্যাসের আরেক চরিত্র রাবেয়ার অভিজ্ঞতার-বর্ণনায়, নজরুল যে-আবেগ প্রকাশ করেছিলেন, আমাদের দুভার্গ্য যে প্রায় আশি বছর পরেও সে-আবেগ আমাদের কাছে জেগে থাকে সমসাময়িক বেদনা নিয়ে। বলতে হয় রাবেয়াকে, রাবেয়াদের : ‘এখনো দেশের পনর আনা হিন্দুর সামাজিকতা এইরকম আচারবিচারে ভরা। …পাশাপাশি থেকে এই যে আমাদের মধ্যে এত বড় ব্যবধান, গরমিল্, এ কি কম দুঃখের কথা? আমাদের…অভিমান এতে দিন দিনই বেড়ে চলেছে।…এই ছোঁয়াছুঁয়ির উপসর্গটি যদি কেউ হিন্দুসমাজ থেকে উঠিয়ে দিতে পারেন, তা হলেই হিন্দু মুসলমানের এক দিন মিল হয়ে যাবে। এইটেই সবচেয়ে মারাত্মক ব্যবধানের সৃষ্টি করে রেখেছে, কিন্তু বড় আশ্চর্য্যরে বিষয় যে, হিন্দু-মুসলমান মিলনাকাঙ্ক্ষী বড় বড় রথীরাও এটা ধরতে পারে নি।…দেশকালপাত্র ভেদে সমাজের সংস্কার হওয়া উচিত নয় কি?’
নজরুলের কথা আজ যখনই মনে পড়ে আমাদের, মনে পড়ে মিলনগত এই অসম্পূর্ণতার কথা। আর তখন মনে হয়, বাক শক্তিহারা তাঁর অচেতন জীবনযাপন যেন আমাদের এই স্তম্ভিত ইতিহাসের এক নিবিড় প্রতীকচিহ্ন। যে-সময়ে থেমে গেল তাঁর গান, তাঁর কথা, তার অল্পকিছু আগেই তিনি গেয়েছিলেন ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, জাগায়ো না জাগায়ো না’, কিংবা রবিহীন পৃথিবীর হতাশ্বাসের কথা দরাজ গলায় শুনিয়েছিলেন ‘আমরা ভাগ্যহত’। অনেক সময়ে আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে গাওয়া বা বলা ওই তাঁর কথাগুলি যেন আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি তাঁকেই, যেন আমরাই ওগুলি বলছি নজরুলকে লক্ষ ক’রে, আমাদের ইতিহাসকে লক্ষ ক’রে।
১৯৯৮

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
শঙ্খ ঘোষ- র আরো পোষ্ট দেখুন