পথে পথে পথের কাব্য

untitled-3_136946একটা পারিবারিক ছককে কেন্দ্র করে আমার মধ্যে জীবন নামক যে শিল্পবস্তুটির বিকাশ ঘটেছে, তার সত্তার ওপর আমারই একচ্ছত্র অধিকার। অন্য যারা আমার জীবনের সঙ্গে জন্মসূত্রে সংশ্লিষ্ট, তাদের প্রতি সময় পেলে এবং সম্ভব হলে আমি আমার বিবেচনামতো কর্তব্য করব; কিন্তু তা আমার জন্য বাধ্যতামূলক হতে পারে না। নশ্বর জীবনের গায়ে কিছুটা হলেও অনশ্বরতার ছোঁয়া লাগানোর সাধনাই হবে আমার সাধনা। আমার পরিবার যদি সে পথের অন্তরায় হয়_ আমি পরিবারকে ত্যাগও করতে পারি। সে অধিকার আমার আছে।
পরিবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাববার ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করেছিল আমার মায়ের অকালমৃত্যুর স্মৃতি। আমার মনে হলো, পরিবার হচ্ছে একটা ছোট জিনিস। ডিমের খোলসের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা পক্ষীশাবকের মতো মানুষকেও একপর্যায়ে পরিবারের খোলসের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে হয়। পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতার ধারণাটি খুবই আপেক্ষিক এবং প্রশ্নসাপেক্ষ বলেই আমার মনে হয়। ভালোবাসা, স্নেহ-মায়া-মমতার ছদ্মবেশে এটি তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের মধ্যে চালু একটি অতিশয় দরিদ্র-ধারণা। এ ধারণা পাল্টাতে হবে। এসব দীন-ধারণার হাত থেকে প্রাচ্যের মানুষের মনকে মুক্ত করতে হবে। পাশ্চাত্যের মানুষদের মধ্যে এ ধারণার অবসান ঘটেছে বলেই তারা বড় কিছু করতে পারছে। আমারও তেমনটিই করার চেষ্টা করা উচিত। _এভাবে নিজেকে বুঝিয়ে, পিতৃআজ্ঞা লঙ্ঘনের পক্ষে নিজের মনের মধ্যে যুক্তি সংগ্রহ করে আমি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। পিতৃআজ্ঞা পালনের জন্য রাম বনে গিয়েছিলেন, আর আমি পিতৃআজ্ঞা লঙ্ঘন করে চললাম ঢাকার পথে। এখানেই বাল্মীকির রামের সঙ্গে আমার রামের পার্থক্য।
ঢাকা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। ঢাকা ক্রমশ বড় হচ্ছে। পাকিস্তানবাদী-সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের ধারাটি তখন আর ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য-আন্দোলনের মূল ধারা নয়। ওই ধারাটি গৌণ ধারায় পরিণত হয়েছিল।
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাস থেকে এটাই দেখা যায় যে, সাহিত্য সর্বদা স্বভূমির রাজধানীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। বিকশিত হয়। সর্বদেশে, সর্বকালেই তা দেখা গেছে। সাহিত্য ক্ষেত্রে কিছু করতে হলে অবশ্যই আমাকে ঢাকায় যেতে হবে। সেখানে থাকতে হবে। মফস্বল শহরে রাজার হালে থেকেও কোনো লাভ নেই। এখানে পড়ে থাকলে আমি সত্যি সত্যিই একদিন ডাকাতে পরিণত হব।
মনে মনে স্থির করলাম, ঢাকায় গিয়ে আমি উঠব বাচ্চু আর মামুনের কাছে। তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট হোস্টেলে। তারপর মামুনকে সঙ্গে নিয়ে কণ্ঠস্বর পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করব। নিশ্চয়ই সেখানে আমার কিছু একটা কাজ জুটে যাবে। না জুটলে রিকশা চালাব।
আমি যখন ঢাকায় পেঁৗছলাম তখন দুপুর। চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ। শোঁ-শোঁ করছে হাওয়া। তেজগাঁও স্টেশনে নেমে পায়ে হেঁটেই পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের হোস্টেলে চলে গেলাম। বাচ্চু আর মামুন আমাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়ে গ্রহণ করল। শুরু হলো আমার ঢাকার জীবন। বাচ্চু আমার পুরনো বন্ধ। কিন্তু সে শুধু আমার বন্ধুই। ঢাকার শিল্প-সাহিত্যের আন্দোলনের সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক ছিল না। ওর জগৎজুড়ে ছিল শিবানী আর শিবানী। ও ছিল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। শিল্প-সাহিত্যের নতুন আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল মামুন। মামুনুর রশীদ। নাটক-পাগল মামুনুর রশীদ। বাচ্চু আমাকে মামুনের হাতে সঁপে দেয়। মামুন পরম বন্ধুর মতো তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে। এই নতুন বন্ধুটিকে পাওয়ার ফলে আমি ঢাকার চাবিটি আমার হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে যাই।
০২.
একদিন সন্ধ্যায় মামুন আমাকে নিয়ে গেল তেজগাঁও ইন্টারমিডিয়েট কলেজের হোস্টেলে। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের খুব কাছেই সেই কলেজটি। কণ্ঠস্বর পত্রিকার সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ওই কলেজে বাংলার অধ্যাপক। হোস্টেলে থাকেন। সায়ীদ ভাইয়ের সঙ্গে মামুনের পরিচয় ছিল। তা ছাড়া গ্রাম থেকে লেখা আমার পত্রের উত্তরে ঢাকায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য সায়ীদ ভাই আমাকে লিখেছিলেন। তাই আমার সম্পর্কেও তাঁর একটা মানসিক প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। পরিচয়মাত্র সায়ীদ ভাই আমাকে তাঁর স্বভাবসুলভ কৌতূকমিশ্রিত হাসিতে আপন করে নিলেন। বললেন, কণ্ঠস্বর পত্রিকার কিছু ছোটখাটো কাজ :যেমন বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা, সম্পাদকের চিঠি নিয়ে লেখক ও বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানের কাছে যাওয়া, বিজ্ঞাপনের টাকা তোলা, বিভিন্ন বুক স্টলে পত্রিকা পেঁৗছে দেওয়া … তাদের কাছ থেকে বিক্রি হওয়া কাগজের টাকা সংগ্রহ করা_ ইত্যাদি কাজের জন্য তাঁর একজন সাহায্যকারী দরকার। আমি চাইলে কাল থেকেই ওই কাজে লেগে যেতে পারি।
আমি সায়ীদ ভাইয়ের প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। সায়ীদ ভাইয়ের একটি পিকআপ ভ্যান ছিল। ব্যবসায়িক কারণে তিনি সেটি ক্রয় করেছিলেন। সেটি কলেজ সংলগ্ন হোস্টেলের মাঠে থাকত। যখন জানলাম ওটি তাঁর, তখন আমি সায়ীদ ভাইকে বললাম, আমি যদি এটি চালাতে শিখে নিই, তাহলে কণ্ঠস্বরের কাজে ওটাকে ব্যবহার করা যায়_ আমারও একটা নিশ্চিত আয়ের পথ হয়। আপনি কী বলেন?
সায়ীদ ভাই মুচকি হেসে বললেন, তার দরকার হবে না, আমার একটি বাইসাইকেল আছে, আপনি ওটাই ব্যবহার করতে পারবেন। সাইকেল চালাতে পারেন তো?
আমি বললাম, হ্যাঁ, পারি। পারি না মানে!
কাল থেকে ওটা আপনার হেফাজতেই থাকবে। লক্ষ্য রাখবেন যেন হারিয়ে না যায়।
আমি বললাম, আমি হারিয়ে যেতে পারি কিন্তু আপনার সাইকেল কখনও হারাবে না।
আমি আমার কথা রেখেছিলাম। সায়ীদ ভাইয়ের সাইকেলটি আমি দীর্ঘদিন ব্যবহার করেছি। সারা ঢাকা শহর আমি চষে বেড়িয়েছি ওই সাইকেলে চড়ে। হারায়নি।
আমি পরদিন থেকেই কণ্ঠস্বরের কাজে লেগে যাই। সায়ীদ ভাই আমার হাতে-পায়ে বাইসাইকেলটি হস্তান্তর করেন।
অঘোষিতভাবে আমার বহুবিড়ম্বিত শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটিয়ে, কণ্ঠস্বর পত্রিকার একজন কর্মী হিসেবে আমার কর্মজীবন শুরু হয়। বেতন অস্থির, মানে তখনও স্থির হয়নি। সায়ীদ ভাই বললেন, নির্ধারিত বেতন না থাকলেও, মাঝে মাঝে আমার কাছ থেকে খাই-খরচ বাবদ কিছু পাবেন এবং আপনি যে সব বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করবেন, তার কমিশন পাবেন শতকরা ১০% হারে। তাতে আপনার কোনোক্রমে চলে যাবে। একটু কষ্ট তো করতেই হবে। হা-হা। তাঁর বিখ্যাত প্রাণ খোলা হাসি।
সাইকেলটি পাওয়াতে আমার খুব লাভ হলো। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার কষ্ট এবং খরচ দুই-ই কমল। তা ছাড়া সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার বিচরণ ক্ষেত্রকে প্রসারিত করার কাজে ওই যন্ত্রটি আমাকে বেশ সাহায্য করতে থাকল। তখন প্রতিদিনই নতুন নতুন কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সংলগ্ন শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের মিলনতীর্থ। সেখানেই দুই আনায় চা, আট আনায় ছোট এক প্লেট খাসির বিরিয়ানি পাওয়া যেত। অতি অল্প দামে পাওয়া যেত ‘মাক্ষণ-মারা’ টোস্ট বিস্কিট। ফলে সেখানে ছিল আঁতেল ছাত্রদের ভিড় এবং নবীন সাহিত্যিকদের আড্ডা।
মলয় ভৌমিকের মাধ্যমে ওই শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনেই আমার পরিচয় হয় আবুল হাসানের সঙ্গে। হাসানের কবিতা আমি আগেই কণ্ঠস্বর পত্রিকায় পড়েছিলাম এবং পড়ে ভালো গেলেছিল। কণ্ঠস্বরে প্রকাশিত হাসানের ‘বন্ধুকে :মনে রাখার কিছু’ কবিতাটি আমার মনে খুব দাগ কেটেছিল।
তিন পর্বে বিভক্ত ওই কবিতার শেষ পর্বটি যেন অমোঘ নিয়তির নির্দেশেই আবুল হাসান রচনা করেছিল, যারা তাঁর বন্ধু ছিল এবং ভবিষ্যতে যারা তাঁর বন্ধু হবে, তাদের কথা ভেবে_

নরক শয্যায় বৃথা আমাদের শূন্য হুতাশন,
আজ মনে হয় :নিরন্তর শোকের হাতের আঙুল আমরা সব!
কিছু-নেই-দুঃখের ভেতর ধ্বংসময় ক্ষণিক পাগল।

যেখানে প্রশান্তি নেই মানুষের লোকক্ষত গাঁথা,
সেখানে মৃত্যু, শুধু মৃতের ঘুমের অন্ধকার;
গ্রীন রোডের পুষ্পিত শাড়ির মতো
মনে হয় না পৃথিবীকে তাই আর,
ইসলামপুরে পুষ্পস্তবকের মতো
পৃথিবীর নারীর হৃদয়!

তাই বলি তোমাদের একমাত্র মৃত্যুই সুন্দর,
চাঁদের মতোন আত্মা আমার মেলে দিতে পারি
আজ অনন্ত মৃত্যুর সম্ভাষণে!

পরিচয়মাত্র আমি আবুল হাসানকে ওই কবিতাটির জন্য ধন্যবাদ জানাই। হাসান ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিল। হাসান জানায় যে, সে-ও আমার কবিতা পড়েছে আজাদ, সংবাদ এবং সমকালে। তবে সেই কবিতাগুলো যে হাসানের কবিতাটির মতো মনে দাগ কাটার মতো ছিল না, তা আমিই বলি। হাসান আমার মুখে ওর কবিতার প্রশংসা শুনে একটু লজ্জা পায়। আবার খুশিও হয়। আমি লক্ষ্য করি, করমর্দনের জন্য আমার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া আবুল হাসানের হাতটি আবেগে কাঁপছে। হাসানের স্নায়বিক দুর্বলতাকে ওর রোমান্টিক আবেগ থেকে পৃথক করাটা কঠিন ছিল। আমি দীর্ঘ সময় হাসানের আবেগ-কম্পিত হাতটিকে আমার মুঠোর মধ্যে বন্দি করে রাখি। হাসানকে আমার খুব ভালো লাগে। মনে হয় আমাকেও তার পছন্দ হয়েছে। তবে আবুল হাসানের মধ্যে যে আমার পরিবর্তীকালের উদ্বাস্তু-উন্মূল যৌবনসঙ্গীটি লুকিয়ে ছিল, তা তখনও আমি বুঝতে পারিনি।
০৩.
১৯৭০_ এর সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসের কোন এক সময় আমি মোতালেব কলোনীর পাট চুকিয়ে দিয়ে নিউ পল্টন লাইনের দীর্ঘ মেসে উঠে যাই। ঐ মেসের প্রধান আকর্ষণ ছিলো জুয়া। দশ পয়সা বিশ পয়সা থেকে শুরু করে চার আনা আট আনা পর্যন্ত চলতো। জুয়া মানে তিন তাসের ফ্লাশ খেলা। রাতদিন আমাদের জুয়ার আসরটি ছিলো জমজমাট।
মেস-সংলগ্ন দক্ষিণের ত্রিতল বাড়িটি শরীয়তুল্লাহ চেয়ারম্যানের, উত্তরে শাহজাহানদের বাড়িটিতে ছিল টিনের ঘর, পশ্চিমে মিলন-রতন-শাহাজাদাদের একতলা দালানবাড়ি এবং পূর্বে শহীদ মানিক স্কুল। একটু দূরেই জহুরদের বাড়ি। গ্রীন লেনের পশ্চিমের সমান্তরাল রাস্তার পাশে জালালদের [জালাল আহমদ চৌধুরী] বাড়ি। নিউ পল্টনে নিজস্ব বাড়ি থাকলেও শরীয়তুল্লাহ সাহেবের শ্যালক, আমাদের মামা, নওয়াব জহুর, শাহজাদা, জালাল আমাদের মেসেই অধিকাংশ সময় কাটাত।
ওই মেসে নিউ পল্টনের বাইরে থেকে যারা নিয়মিত আসত তাদের মধ্যে ছিল সৈয়দ কাশেম আলী, দৌড়বিদ জহুরুল হক রতন, করিমুল হক, বজল, খোকা…।
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এবং কখনও কখনও দিন-রাত্রির ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে আমরা ওই মেসে তিন তাসের মাধ্যমে আমাদের স্ব-স্ব ভাগ্য যাচাই করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতাম। একে কেউ ইচ্ছে করলে নিজ দায়িত্বে জুয়াও বলতে পারেন, কিন্তু আমরা বিষয়টাকে সেভাবে বিবেচনা করতাম না। আমাদের কাছে এর অন্য একটা গভীর গোপন অর্থ ছিল। অর্থটা হচ্ছে এই যে, আমরা শুধু অর্থের জন্য খেলতাম না। ওই খেলাটি ছিল আমাদের নেশা ও উত্তেজনার জোগানদাতা। একটা কম খারাপ কিছুর মধ্যে নিজেদের মত্ত ও মগ্ন রাখার মাধ্যমে। এখনও আমি জুয়াটাকে ওইভাবেই দেখি। কারণ অর্থ আমার অন্বিষ্ট নয়, আমার অন্বিষ্ট আনন্দ।
‘তাসের প্রাণ আছে’_ এই তথ্যটি আমি ওই মেসেই আবিষ্কার করি।
আমার কারণে ওই মেসে পরে ক্রমশ ঢাকার অনেক তরুণ কবি-সাহিত্যিক ও জুয়াড়ির সমাবেশ ঘটে। মহাদেব সাহাও নিউ পল্টনের কাছাকাছি আজিমপুরে এসে তাঁবু ফেলেন। কবরস্থানের উত্তরে আজিমপুর রোডের ১১৩ নম্বর বাড়িটি ভাড়া নিয়ে সেখানে মেস করে কয়েকজন মিলে থাকতে শুরু করে। আমার মেস থেকে মহাদেবের মেসে যেতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগত না।
০৪.
আমাদের খুব জমজমাট একটি আড্ডাস্থল ছিল আজিমপুর সরকারি নিউমার্কেট। নিউমার্কেটের যে দুটো রেস্তোরাঁয় আমরা তখন চুটিয়ে আড্ডা দিতাম সেগুলোর একটিও এখন আর নেই। একটির নাম ছিল মোনিকো। ওখানে খাদ্যদ্রব্যের দাম ছিল অপেক্ষাকৃত সস্তা। ফলে ওখানেই স্বল্প আয়ের তরুণ কবি-সাহিত্যিক ও আঁতেলদের ভিড় হতো বেশি। অন্য রেস্তোরাঁটি ছিল একটু উন্নতমানের। নাম লিবার্টি কাফে। যখন হাতে একটু বেশি পয়সা থাকত, আমরা লিবার্টিতে ঢুকে পড়তাম।
তবে মধ্য-ষাটের পরের কবি-সাহিত্যিক, যারা তখন পর্যন্ত ভালো চাকরি-বাকরি পায়নি, তারা মোনিকোতেই নিয়মিত বসত। উজালা বলে আরেকটি রেস্তোরাঁ ছিল_ ওখানেও আড্ডা হতো,_ তবে আমি ওখানে খুব বেশি বসতাম না। মোনিকোর আড্ডার সদস্যদের মধ্যে ছিল এনামুল কবির ব্র?হ্মা, কবি আবুল হাসান, কবি হুমায়ুন আজাদ, কবির মজুমদার, কবি সানাউল হক খান, কবি হুমায়ুন কবির, কবি মহাদেব সাহা, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি অরুণাভ সরকার, কবি আবুল কাশেম, কবি জাহিদুল হক, কবি শামসুল ইসলাম, গল্পকার বিপ্রদাশ বড়ূয়া, কবি-গল্পকার সুব্রত বড়ূয়া, অনুবাদক আখতার উন নবী, শফিকুর রহমান, কবি-নাট্যকার সেলিম আল দীন, নাট্য সংগঠক মুজিব বিন হক, গল্পকার-সাংবাদিক শেখ আবদুর রহমান, কবি সাযযাদ কাদির, কবি মাহবুব সাদিক, কবি শাহ নূর খান, কবি-ইঞ্জিনিয়ার হাবীবুল্লাহ সিরাজী, কবি-ইঞ্জিনিয়ার সুকোমল বল, কবি মাহমুদ আবু সায়ীদ, কবি হেলাল হাফিজ, কবি-ডাক্তার সুকান্ত চট্টোপাধ্যয়, গল্পকার বিপ্লব দাশ, সাংবাদিক-কবি হীরেন দে, কবি রাজীব আহসান চৌধুরী, সাহিত্য-সমালোচক রফিক কায়সার, কবি রফিক নওশাদ, আবৃত্তিকার আশরাফুল আলম, গীতিকার শহীদুল ইসলাম, আবৃত্তিকার তারিক সালাউদ্দিন মাহমুদ, শিল্পী মুনশী মহিউদ্দিন, শিল্পী কাওসার আহমদ চৌধুরী, ছড়াকার আখতার হুসেন, কবিতানুরাগী বন্ধু শাহ নজরুল ইসলাম, গল্পকার বারেক আবদুল্লাহ, কবি শাহাদাৎ বুলবুল, গল্পকার বুলবুল চৌধুরী, কবি অসীম সাহা, কবি মাকিদ হায়দার, কবি দাউদ হায়দার প্রমুখ।
অসীম খুব ভালো কীর্তন গাইত। আমরা সন্ধ্যার দিকে পাবলিক লাইব্রেরির সবুজ ঘাসের লনে গোল জয়ে বসে অসীমের কীর্তন শুনতাম।
বিকেলের দিকে নিউমার্কেকটি, মোটামুটিভাবে বলা যায় ঢাকার তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের দখলেই চলে যেত। ওই দখল চালু থাকত বেশ রাত অবধি। এখন নিউমার্কেটের ভেতরে যেখানে মসজিদ তৈরি হয়েছে, সেখানে তখন একটি চমৎকার ছোট্ট পার্ক ছিল। আমরা গরমের দিনে মাঝে মাঝে ওই পার্কটিতেও ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বসতাম। আমাদের মধ্যে সমকালীন বাংলা ও বিশ্বের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হতো। দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও আমরা মতবিনিময় করতাম।
তবে আমরা যে ক্রমশ খুব বড় ধরনের পরিবর্তনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে; অল্প কিছু দিনের ব্যবধানেই যে আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকে পরিণত হবো, তা আমাদের অনেকেই বিশ্বাস করতে পারত না। আমি নিজে ওই রকমের একটা পরিবর্তন চাইতাম বলেই আমার প্রত্যাশিত পরিবর্তনের ছবিটি আমার চোখে অকারণেও ভেসে উঠতে পারে বলে আমি তখন মনে করতাম।
আমরা সবাই আমাদের মনের ভেতরে একটা প্রচণ্ড বাঁধভাঙা চঞ্চলতাকে অনুভব করতাম। সেই চঞ্চলতার টানে জীবনের চেয়ে মৃত্যুর আরাধনাই আমাদের অধিকতর কাম্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কেন এমনটি হচ্ছিল, তার কারণ আমাদের জানা ছিল না।
০৫.
এই নগরীতে আমি কত জায়গায় বাস করেছি, হিসেব করে বলা কঠিন। সেই তালিকাটি যদি নির্ভুলভাবে তৈরি করা যেত, তাহলে তা হতো অতিশয় দীর্ঘ। দুর্বল স্মৃতির ওপর নির্ভর করে আমার কোনা আশ্রয়দানকারীকে আমি আহত করতে চাই না। আমি অনেকের কথা ভুলে গেছি। তবে কেউ স্মরণ করিয়ে দিলে একটু একটু করে মনে আসে। থাকা মানে তো থাকা নয় শুধু, খাওয়াও। কত মানুষের অন্ন যে ঢুকিয়েছি এই পেটে। এই যে দেহ এত মানুষের খাদ্যদানে পুষ্ট হয়েছে_ তাকে আমি শুধুই আমার দেহ বলি কেমন করে? আমি তা বলিও না। আমি বলি, আমি একা নই, আমি অনেক।
ফুটপাতে কত মানুষ সংসার গড়ে তোলে। সেখানে তারা খায়-দায়, এমনকি সন্তানেরও জন্ম দেয়। আকাশের তারা গুনতে গুনতে খোলা আকাশের নিচে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। তারা যদি পারে, তো আমি পারব না কেন? রাত কাটানোর ব্যাপারে অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কাটানোর উপায় সন্ধান করতে গিয়ে একদিন আমি ফুটপাতের বাসিন্দাদের দিকে ভালো করে তাকাই। ভাবি, মন্দ কি? নিত্যনব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হোক জীবন। প্রতিভা অনেকেরই থাকে, অভিজ্ঞতাই প্রতিভাবানদের জীবনকে পৃথক করে। আবুল হাসানকে ফুটপাতে থাকার প্রস্তাব দিতে ও রাজি হয়ে যায়। ফলে ঢাকায় আমাদের থাকার জায়গার অভাব দূর হয়। ঘটনাটা ছিল দু’বিঘার পরিবর্তে বিশ্বনিখিল হাতে পাওয়ার মতো।
আমরা আটকে পড়া ট্রেন যাত্রীদের মতো বহু রাত কাটিয়ে দিতে শুরু করি নবনির্মিত কমলাপুর রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুমে। ওখানে জায়গা না পেলে পত্রিকা বিছিয়ে নিজের লেখা কবিতার ওপর শুয়ে পড়ি প্ল্যাটফরমের ঝকঝকে মেঝেতে।
বুড়িগঙ্গার কুলুধ্বনি আর দূরগামী স্টিমারের ভেঁপুর আওয়াজ শুনতে শুনতে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি কুলিদের পায়ের তলায়, সদরঘাটের স্টিমার টার্মিনালে। কন্ডাক্টরের সাথে খাতির জমিয়ে গুলিস্তানের নিকটবর্তী বিআরটিসির বাস ডিপোর বাসের ভেতরে আমরা ঘুমাই। এখন ওই ডিপোটি বঙ্গভবনের সামনের পার্কের ভেতরে মিশে গেছে। পাবলিক লাইব্রেরির [তখন পাবলিক লাইব্রেরিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সংলগ্ন ছিল, পরে তা শাহবাগের নতুন ভবনে স্থানান্তিরত হয়] মোজাইক করা মেঝেতে, নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যের দিকে তাকিয়ে কেটে গেছে আমাদের কত রাত।
পাবলিক লাইব্রেরিতে ঘুমানোর একটা সুবিধে ছিল এই যে, পরদিন সকালের নাশতার জন্য আমাদের খুব একটা ভাবতে হতো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন খুলে যেত এবং আমরা ওখানে বাকিতে নাশতা সারতে পারতাম। পরে আমাদের বন্ধু বা ভক্তদের কেউ এসে নাশতার মূল্য পরিশোধ করত। রমজান ও শরীফ ভাই আমাদের ওই স্ট্র্যাটেজির কথা জানত। তাই তারা আপত্তি করত না। বরং প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমাদের কবি সাব বলে সম্বোধন করে, নবাগতকে স্মরণ করিয়ে দিত যে, উনারা কবি। কবিদের পরিচর্যা করাটা সকলেই দায়িত্ব।
মনে পড়ে, আউটার স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে শুয়ে আকাশের ‘সাতটি তারার তিমির’-এর দিকে তাকিয়ে জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করতে করতে আমরা ঘুমিয়েছি। পরদিন ভোরের সূর্য আমাদের ঘুম ভাঙিয়েছে।
একদিন বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং আর ‘পানিয়ম’-এ অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দেওয়ার পর কোথায় রাত কাটানো যায়_ এই নিয়ে ভাবছিলাম। তখন হাসান বলল, চল নারিন্দায় যাই, ওখানে একটা চমৎকার মসজিদ আছে। ওখানে ঘুমানো যাবে। ওই মসজিদের ভেতরে আছে একটা খুব বড় চৌবাচ্চা। সেখানে টলটল করা জল। আর স্ফটিকস্বচ্ছ জলের ভেতরে নানা রঙের মাছ খেলা করে। চল, আজ ওখানে ঘুমাবো। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। যেতে যেতে হাসান বলল, ওখানে একটাই অসুবিধা, নামাজ ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। কম লোক তো, তাই নামাজ না পড়লে চোখে পড়ে যায়। ভোরের দিকে মুসলি্লরা ডেকে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। তখন কিছুক্ষণের জন্য নামাজের কাতারে শামিল হতে হয়।
আমি বললাম, তাহলে?
হাসান বলল, তাতে কী? ওজু করে তুমিও দাঁড়িয়ে যাবে আমার পাশে। আমার দেখাদেখি তুমিও উঠ-বস করবে। তাতেই হবে। নামাজে দাঁড়িয়ে কে কী বলছে, তা কি কেউ জানে? এটা হচ্ছে মনের একটা শুদ্ধতার ব্যাপার। কবির চেয়ে শুদ্ধ মনের অধিকারী আর কে?
আমরা নারিন্দা মসজিদে যাই। গিয়ে দেখি চমৎকার মসজদিই বটে। চৌবাচ্চার জলে সন্তরণশীল রঙবেরঙের মাছ আমাদের স্বাগত জানায়। ভেতরে লোকজন বেশি নেই। বেশ একটা নির্জন ছিমছাম ভাব। গভীর রাতের কোলাহলহীন নির্জনতা আমার মনকে স্পর্শ করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ওই রাত্রির আলোচনায় আধ্যাত্মিকতা প্রাধান্য পায়। এক সময় আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরের দিকে আমাদের ঘুম ভাঙে আজানের শব্দে। হাসানের দেখাদেখি আমিও মুসলি্লদের সঙ্গে চৌবাচ্চার জলে বিনিদ্র মাছদের নির্মিত দৃশ্যকাব্য দেখতে দেখতে, হাত-পা ও মুখমণ্ডল ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে নিই। তারপর মাথায় রুমাল চাপিয়ে হাসানের পাশে গিয়ে নামাজের সারিতে দাঁড়াই।
আমি ধার্মিক নই। আমি ইহজাগতিকতায় বিশ্বাসী। তবে, এক অজ্ঞাত-শক্তির প্রতি আমার এক ধরনের অব্যাখ্যাত দুর্বলতা রয়েছে। তাঁকে আমি আমার মতো করে ভাবি। আমার ভাষায় আমি তাঁর স্তব করি। আমি তাঁর বন্দনা করি আমার মতো করে। তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। কোনো পূর্বনির্ধারিত পথই কবির পথ নয়। আমার সবকিছুই পৃথক। আমার ভাষা পৃথক। আমার চিন্তা পৃথক। আমি আমার ভাষায় তাঁর সঙ্গে কথা বলি। তাঁর কাছে মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করি। গৌতমবুদ্ধের মতো জরা-ব্যাধি ও জাগতিক যাতনার হাত থেকে মানুষকে ত্রাণ করার জন্য আমি হাত তুলে তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাই। আমি অনুভব করি তাঁর অসীমত্ব। কোনো বিশেষ নামে ডেকে আমি তাঁকে সীমিত করি না, আমি তাঁর নাম দিই ‘তুমি’।
অন্যদের মতো একসময় আমারও নামাজ শেষ হয়, কিন্তু আমার মনের ভেতরে এক অন্তহীন নামাজ চলতে থাকে। মানুষের কল্যাণের জন্য আমার নামাজে কখনও ছেদ পড়ে না। আমি ভুলে যাই আমি কে? শুধু মনে পড়ে, ভিন্ন-ভিন্ন ধর্মে ভাগ হয়ে গেলেও একইভাবে সৃষ্ট, আমি মাতৃগর্ভজাত এক অনাদি-আদিম মানব-সন্তান। এটাই আমার প্রধান পরিচয়।