নভেরাকে নিয়ে লেখা

untitled-1_136944নভেরাকে, নভেরা আহমেদকে যখন আমি দেখি সেদিন ভাবতেও পারিনি যে, তাকে নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য একটি উপন্যাস লিখবো এবং সেই উপন্যাস পাঠকপ্রিয় হবে। দেখা গেল অনেকেই নভেরা সম্পর্কে জানতো না, তার নামও শোনেনি। আমার উপন্যাস তাদেরকে এক অসাধারণ নারীর সঙ্গে পরিচিত করালো। তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষ স্পর্শ করলেন। তাকে নিয়ে কৌতূহল আর আগ্রহের অবধি থাকলো না। অনেক প্রশ্ন উঠলো তাকে ঘিরে। সব উত্তর আমার এখনো জানা নেই। পঁচাশি বছর বয়সে একজন মৃত্যুবরণ করার পর সেসব প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে গেল। তিনি হয়ে রইলেন কিংবদন্তির চরিত্র। তাকে নিয়ে মিথ তৈরি হয়েছে। হয়তো আরও হবে ভবিষ্যতে। ইতিহাস আর মিথ_ এই দুইয়ের ভিত্তিতেই পরিচিত হয়ে থাকবেন আমাদের প্রথম ভাস্কর নভেরা আহমেদ।
তাকে আমি প্রথম দেখি উনিশ শ’ ষাট সালে, ঢাকায় চারুকলা কলেজের সামনে। কয়েকজন পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে নিঃসংকোচে ঘুরছিলেন। মুগ্ধ হয়েছিলাম তাকে দেখে। মুগ্ধ হবার মতোই ছিলেন তিনি। দেখতে সুন্দরী, সাজসজ্জা-বেশভূষায় অনন্যা, আচরণে রুচিশীল! সাদা শাড়ির সঙ্গে তার গায়ের রঙ মিশে গিয়েছিল। এমন ফর্সা ছিলেন তিনি। চুলের ঝুঁটি বেঁধে সন্ন্যাসিনীর মতো মাথার ওপর তুলে রেখেছিলেন। গলায় ছিল রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে লম্বা টিপ। সব মিলিয়ে শান্ত সমাহিত তাপসী এক নারীর ছবি। খুব উচ্ছল বা বাচাল মনে হয়নি। বরং ছিল সংযমী, পরিশীলিত এক ব্যক্তিত্বের প্রতিভূ। মুগ্ধতা, প্রশংসার পাশাপাশি জেগে উঠেছিল শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি।
এর কিছুদিন পর তার ভাস্কর্যের একক প্রদর্শনী হলো। আমরা বন্ধুরা গেলাম দেখতে। অভিনব ধরনের সব কাজ। ফিগার নিয়ে কাজ করেছেন কিন্তু সবই অর্ধ বিমূর্ত। মা ও শিশু, গরু, দম্পতি এসব কাজ ছিল ফিগারেটিভ কিন্তু স্টাইলাইজড। মাঝখানে বড় গোলাকার শূন্যতা কাজগুলোকে অভিনবত্ব দিয়েছিল। হেনরি মুরের কিছু প্রভাব ছিল কিন্তু মুরের মূর্তির মতো স্থূল নয়। বেশ নম্র, পাতলা আকার। এক ধরনের নিরিবিলি পথ ছিল সেসব কাজে। আমরা তার কাজ যতটা দেখেছি তার চেয়ে বেশি দেখেছি তাকে। খুব সাধারণ বেশভূষায় অপরূপ দেখাচ্ছিল। সেদিন পরেছিলেন কালো রঙের শাড়ি। চুল মাথার ওপর একইভাবে চুড়ো করে বাঁধা। গলায় সন্ন্যাসিনীর রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে দীর্ঘ কালো টিপ। সেদিন তাকে আরও স্মার্ট দেখাচ্ছিল। স্মার্ট কিন্তু উচ্ছল নয়। বেশ সংযত হয়ে চলাফেরা করছিলেন; কথা বলছিলেন অনুচ্চ স্বরে। সবকিছুতেই পরিমিতি বোধ।
আমরা জানলাম, তিনি ভাস্কর হলেও ঢাকা আর্ট স্কুলের ছাত্রী নন। সবকিছু নিজে শিখেছেন। এতে শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল। বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের একজন মেয়ে শিল্পচর্চা করছেন, তাও আবার রক্ষণশীল সমাজে; আমাদের বিস্ময়ের অবধি ছিল না। তার কাজ, বেশভূষা, আচার-আচরণ বলে দিয়েছিল তিনি সমাজের প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে। নিজের অভিরুচি অনুযায়ী জীবনযাপন করছেন। সেই নৈতিক শক্তি তাঁর ব্যক্তিত্বকে দৃঢ়তা দিয়েছিল, অনন্য করে তুলেছিল।
ফাস্ট ফরওয়ার্ড ১৯৯৪ সাল। এলিফ্যান্ট রোডে ‘অরুণিমা’ নামে সরকারি আমার ফ্ল্যাটে আড্ডা হচ্ছে শিল্পী-সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গে। অন্যান্যের মধ্যে হঠাৎ শিল্পী আমিনুল ইসলাম বললেন, নভেরাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখেন না।
নভেরা! আমি বিস্মিত চোখে তাকালাম।
হ্যাঁ, নভেরা। বাংলাদেশের প্রথম ভাস্কর। শোনেননি তার নাম? বললাম, শুনেছি। দেখেছিও স্বল্প সময়ের জন্য। সে তো অনেক আগের কথা। প্রায় চলি্লশ বছর হবে। কিন্তু তার সম্পর্কে কিছুই জানি না। উপন্যাস লিখবো কেমন করে? কোনো বইপত্র প্যামফ্লেট আছে তার ওপর?
আমিনুল ইসলাম বললেন, তেমন কিছু নেই। শুধু একটা প্রদর্শনীর ব্রোশিউর আছে আমার কাছে। একটা ব্রোশিউর দেখে উপন্যাস লেখা যাবে না। আমি মাথা নেড়ে বললাম।
শুনে আমিনুল ইসলাম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, যারা তাকে চিনত তাদের ইন্টারভিউ নিন। তাদের মুখ থেকে শুনুন তার সম্বন্ধে। এই সব তথ্যের ভিত্তিতে লিখুন। আপনি পারবেন।
কারা কারা চিনতেন তাকে? তাদের মধ্যে ক’জনকে পাব ইন্টারভিউ নেবার জন্য?
আমিনুল ইসলাম নড়েচড়ে বসলেন। হেসে বলেন, প্রথমে আমাকে দিয়েই শুরু করবেন। তার পর আছে নাট্যকার সাঈদ আহমেদ, ফিল্ম ডিরেক্টর খান আতাউর রহমান, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, মুর্তজা বশীর, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, কবি শামসুর রাহমান। তাদের কাছ থেকে আরও অন্যের নাম পেয়ে যাবেন। হবে না? আমি অনিশ্চিতভাবে মাথা নেড়ে বললাম, নির্ভর করবে কতটা খুলে বলবেন তারা!
আমিনুল ইসলাম বললেন, তারা বলবেন। তারা প্রত্যেকেই নভেরার বন্ধু এবং ভক্ত ছিল। নভেরার সঙ্গে কারো তিক্ততার সম্পর্ক ছিল না।
ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু হলো। কথামতো আমিনুল ইসলামকে দিয়েই শুরু। তিনি ফ্লোরেন্সে নভেরার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাটা শোনালেন। যেখানে তিনি পড়ছেন, হঠাৎ একদিন নভেরা তার বন্ধু শিল্পী হামিদুর রহমানকে নিয়ে হাজির। তারা তার সঙ্গে থাকতে চান কয়দিন। আমিনুলের আপত্তি ছিল না, কিন্তু সমস্যা হলো ঘর মাত্র একটা। সেই এক ঘরে একটি নারী, দুটি পুরুষের একসঙ্গে থাকার গল্প যেমন অবিশ্বাস্য, তেমনি চমকপ্রদ। ফ্লোরেন্সে সেইভাবে থাকার সময় নভেরা আত্মমর্যাদা, ব্যক্তিত্ব এবং সম্ভ্রমবোধ বজায় রেখেছিলেন। এর ফলে আমিনুলের কাছে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
আমিনুলের সঙ্গে এর পর নভেরার দেখা এবং সেখানকার অভিজ্ঞতাও চমকপ্রদ। নভেরার সঙ্গে তার এবং অন্যান্য পুরুষ বন্ধুর প্রতিটি সাক্ষাৎই ছিল স্মরণীয়। আমিনুল এমন নিখুঁতভাবে সব বললেন, যেন গতকালকের কথা। সবকিছু স্মৃতিতে ভাস্মর।
আমিনুলের পর খান আতা। তিনি স্পষ্টই বলে ফেললেন যে, তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সম্পর্কটা বন্ধুত্বের পর্যায়েই রেখেছিল। তার সম্বন্ধে খান আতার মধ্যে উন্নাসিকতা বা অশ্রদ্ধার ভাব ছিল না মোটেও।
সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ছিল নাট্যকার সাঈদ আহমদের সঙ্গে আলাপ। তিনি ঢাকাইয়া ভাষায় রসিয়ে রসিয়ে সবকিছু বললেন। একটু পরপরই হাসি। তার কাছে নভেরা ছিলেন একজন কৌতুকের পাত্র। তার বড় ভাই শিল্পী হামিদুর রহমানের নিকট-বান্ধবী হলেও নভেরাকে নিয়ে রসিকতা করতে ইতস্তত করেননি তিনি। কিন্তু নভেরা সম্বন্ধে অশ্রদ্ধার ভাব দেখাননি একটুও।
নভেরার পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেল লুতফুন নামে এক মহিলার কাছ থেকে। তিনি নভেরার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। বোনদের সঙ্গে নভেরার সম্পর্ক নিয়ে তিনি যা বললেন তা বেশ বিশদ। কিছু সমালোচনা ছিল সেই মন্তব্যে ও তথ্যে। নভেরার বোনদের মধ্যে কেউ ঢাকায় ছিলেন না। থাকলে ক্রস চেক করে নেওয়া যেত। ওপরের ব্যক্তিরা ছাড়াও আরো কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হলো।
সব ইন্টারভিউ শেষে তথ্য সময়ের ক্রম অনুসারে সাজিয়ে লিখে ফেললাম। প্রতিটি অধ্যায়ের জন্য ব্যবহার করলাম ভিন্ন আঙ্গিক। সিনেমার স্ক্রিপ্ট, নাটক, ডায়েরি, স্মৃতিকথা, স্বগত সংলাপ_ এই সব ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা হলো অধ্যায়গুলো। তথ্যের অভাবে তার জীবন সম্বন্ধে যতটা বলা গেল, শিল্পকর্ম সম্বন্ধে ততটা বিশদভাবে লেখা গেল না। তবু মোটামুটি একটি ধারণা দেওয়া গেল।
উপন্যাসটি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হওয়ার পর নভেরার বড় বোনের স্বামী এসে জানালেন যে, তার স্ত্রীর বোন সম্বন্ধে যা লেখা হয়েছে তা সঠিক না। তার মন্তব্য আকারে লিখে পাঠাতে বললাম। বই আকারে প্রকাশের সময় সেই মন্তব্য পরিশিষ্ট আকারে সংযোজন করা হলো। শহীদ মিনার নির্মাণে নভেরার ভূমিকা নিয়ে যে বিতর্ক সে সম্পর্কেও পরিশিষ্টে সাঈদ আহমদের মন্তব্য যোগ করা হলো।
উপন্যাসটি প্রকাশের বহু বছর পর জানতে পারলাম, নভেরা জীবিত এবং প্যারিসে বসবাস করছেন। একবার প্যারিসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলাম। তিনি দেখা করলেন না। জানলাম, তিনি কারো সঙ্গে দেখা করেন না। বাংলাদেশের শিল্পী ও সমালোচকদের সম্বন্ধে তার বেশ অভিমান ছিল। একজন স্পর্শকাতর শিল্পী হিসেবে এমন অভিমান থাকা স্বাভাবিক।
আমি নভেরা উপন্যাসটি লিখতে পেরে আনন্দ লাভ করেছি।