ছদ্মবেশী রাজকুমার

বন্ধুদের দলে সাবলীলভাবে মিশে থাকা সম্পূর্ণ অচেনা একজনকে দেখলাম, তার নাম বেলাল চৌধুরী। সম্পূর্ণ মেদহীন সুগঠিত শরীর, ফরসা রং, নিষ্পাপ, সুকুমার মুখখানিতে ঈষৎ মঙ্গোলীয় ছাপ। এই নিরীহ যুবকটি সম্পর্কে অনেক রোমহর্ষক কাহিনি (হয়তো পুরোটা সত্যি নয়, সব রোমহর্ষক কাহিনিই তো সত্যি-মিথ্যে-গুজব মিশ্রিত হয়ে থাকে) শোনা গেল। তার বাড়ি পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে, পেশা কুমির ধরা। একটা কুমির-শিকারি জাহাজে অনেক সাগর-উপসাগর পাড়ি দিতে দিতে সে হঠাৎ খিদিরপুরে এসে জাহাজ থেকে নেমে পড়েছে এবং পাসপোর্টটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে মিশে গেছে কলকাতার জনারণ্যে। এবং সে একজন কবি, তাই জল যেমন জলকে টানে, সেইভাবে সে যুক্ত হয়ে গেছে কফি হাউসের কবির দঙ্গলে। পাকিস্তানের সঙ্গে তখন ভারতের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে দিনকে দিন, কয়েক মাস পরেই শুরু হবে একটি বালখিল্যসুলভ যুদ্ধ, সে রকম আবহাওয়ায় পাকিস্তানের নাগরিক হয়েও সহায়সম্বলহীন অবস্থায় কলকাতায় বিচরণ করার জন্য প্রচণ্ড মনের জোর ও সাহসের দরকার। অবশ্য বেলালের একটা দারুণ সম্পদ ছিল, সেটা তার মুখের হাসি এবং সহজ আন্তরিকতায় মানুষকে আপন করে নেবার ক্ষমতা। পরে অনেকবার দেখেছি, যেকোনো বাড়িতে গেলে সে পরিবারের বাচ্চা ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বুড়ো-বুড়িরা পর্যন্ত কিছুক্ষণের মধ্যেই বেলালকে ভালোবেসে ফেলে। এর মধ্যে সে কমলদারও খুব চেলা হয়ে গেছে, দুজন অসমবয়সী মানুষের এমন গাঢ় বন্ধুত্বও দুর্লভ।

বেলালের মতন মানুষদের কোনো একটা বিশেষ দেশের সীমানায় গণ্ডিবদ্ধ করা যায় না, এরা সারা পৃথিবীর নাগরিক। বাউন্ডুলেপনায়, বেলাল শক্তিকেও অনেকখানি হার মানিয়ে দিয়েছিল।

বেলালের সঙ্গে পরে অনেকবার অনেক রকম রোমহর্ষক অভিযান করা গেছে, কিন্তু আলাপের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাটি চিরস্মরণীয়। হলো কী, খালাসিটোলায় অত্যুৎসাহে বন্ধুদের সঙ্গে মেতে থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। বছরখানেক ধরে উত্তম স্কচ, বার্বন ও ফরাসি ওয়াইন পান করে আমার অভ্যেস খারাপ হয়ে গিয়েছিল, বাংলা মদের মতন অতি উপাদেয় পানীয় আমার সহ্য হলো না, কোন মুহূর্তে যে চেতনা সম্পূর্ণ লোপ পেল তা টেরও পাইনি। তখন আমার সেই জড় দেহ নিয়ে বন্ধুরা খুবই মুশকিলে পড়েছিল, তাদের তখনো ভালো করে নেশাই জমেনি, বেশি রাতও হয়নি।

আমার জ্ঞান ফিরে এল ভোরবেলা। চোখ মেলে প্রথমে বুঝতেই পারলাম না, কোথায় শুয়ে আছি। রাস্তাঘাটে নয়, শ্মশানে-মশানে, হট্টমন্দিরে নয়, একটা ঘরেই, সে রকম ঘরও কখনো দেখিনি। চ্যাঁচার বেড়া, ওপরে টিনের চাল, ঘরখানা এমনই ছোট যে মাঝখানে একটা তক্তপোশ ছাড়া আর নড়াচড়ার জায়গাই নেই বলতে গেলে। আমার পরনে সোয়েটার-প্যান্ট-শার্ট-জুতা সবই আছে, এখানে এলাম কী করে বা কার সঙ্গে, তা কিছুই মনে নেই। চিত হয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম একটুক্ষণ, পিঠে কিসের জন্য খোঁচা লাগছে, চাদরের তলায় হাত ঢুকিয়ে দেখি, একটা মোটা বই। সে বইটা টেনে সরাতেই সেদিকটা নিচু হয়ে গেল, তারপর ধড়মড় করে উঠে দেখি, তোশক বলতে কিছুই নেই, একটা কাঠের চৌকির ওপর নানান আকারে সাজানো বইয়ের ওপর চাদর পাতা। আমি এতগুলো বইয়ের ওপর রাত কাটিয়েছি? এটা কার ঘর, জায়গাটাই–বা কোথায়? বাইরে যেন কাদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, সবই নারীকণ্ঠ, কান পেতে শুনলাম, কী নিয়ে যেন ঝগড়া চলছে, তার মধ্যে অনেক অশ্লীল গালিগালাজ, তার অধিকাংশই পুরুষদের পক্ষে প্রযোজ্য, অর্থাৎ পুরুষেরা প্রতিপক্ষের মা-বোন সম্পর্কে যেসব কুপ্রস্তাব করে, মেয়েরাই বলছে সেই সব। দরজাটাও চাটাই ও কঞ্চির, টেনে খুলতে গেলে একটুখানি ফাঁক হলো মাত্র, বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। ফাঁক দিয়ে দেখে মনে হলো, বাইরেটা একটা কবরখানা, মাঝে মাঝে বাটনাবাটা শিলের মতন পাথর বসানো।

মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে ভাববার চেষ্টা করলাম, সবটাই কি দুঃস্বপ্ন? এটা বাস্তব হতেই পারে না। মাত্র কদিন আগেই আমি ছিলাম আমেরিকায়, সে ঘরের তিনদিকেই জানলা। আমার বিছানার গদিটি ছিল পালক ভরা, আর কাল রাতে আমি শুয়েছি তোশকহীন তক্তপোশে, উঁচু-নিচু বইয়ের ওপর, চ্যাঁচার বেড়ায় জানলাহীন ঘর, পরিবেশ কবরখানা, স্ত্রীলোকেরা গালাগালি বিনিময় করছে পুরুষদের ভাষায়, দরজায় তালাবদ্ধ, এটা একটা সুররিয়াল দৃশ্য, এটা কারও অবচেতনের সৃষ্টি, আমি সেখানে একটা চরিত্র হয়ে গেছি। পাখি নয়, শুনছি শুধু চিলের ডাক, এ রকম দৃশ্যে এমন আবহসংগীতই মানায়। এখন আমার বসে বসে বইগুলো পড়া উচিত? আস্তে আস্তে মাথা পরিষ্কার হতেই পেটে খিদের কামড় টের পাই। নিশ্চিত কাল বিকেলের পর কিছু খাওয়া হয়নি, খালাসিটোলায় আদা আর ছোলা, কমলদার (কমলকুমার মজুমদার) পরিহাসময় মুখ, এ ছাড়া আর কিছু মনে পড়ে না। এ রকম চেতনা হারানো, এ রকম অ্যামনেশিয়া আমার প্রথম হলো। যে-ই আমাকে এখানে আনুক, দরজায় তালা লাগিয়ে রেখেছে কেন। দরজাটা ধরে ঝাঁকালাম কয়েকবার। কার নাম ধরে ডাকব জানি না। এখানে কে আছে, দরজা খুলে দাও, দরজা খুলে দাও! আমার চিৎকারে স্ত্রীলোকদের ঝগড়া স্তব্ধ হয়ে গেল। কয়েকজন উঁকিঝুঁকি মারল দরজার কাছে এসে। এই দৃশ্যটাও অলীক মনে হয়, একটা অচেনা স্থানে, অচেনা কারোর ঘরে আমি বন্দী, বাইরে কয়েকজন রমণী কৌতূহলী চোখে দেখছে। তারা কেউ ‘এই বন্দিই আমার প্রাণেশ্বর’ বলল না, দৃশ্যটির মধ্যে রোমান্টিকতার ছিটেফোঁটাও নেই, রমণীরা কেউ সুন্দরী তো নয়ই, যুবতীও নয়, মধ্যবয়সী দজ্জাল ধরনের, রমণী শব্দটাই এখানে প্রযোজ্য নয়, একজনের মুখ বন-বিড়ালের মতন, একজনের স্পষ্ট গোঁফ, একজনের হাতে একতাল গোবর। তাদের চোখে বিস্ময় নেই, কোনো মন্তব্যও করল না, একটু পরেই আবার সরে গেল দূরে।

অর্থাৎ আমাকে বন্দীই থাকতে হবে? কতক্ষণ? কী কী অপরাধ করেছি কাল রাতে? কিছু মনে করতে পারছি না বলে অপরাধবোধ আরও তীব্র হয়। অজ্ঞাত অন্যায়ের জন্য অনুশোচনায় শিরশির করে সর্বাঙ্গ। কাল রাতে বাড়ি ফিরিনি, বাড়িতে খবর দেবারও উপায় নেই, তখন টেলিফোনের এত চল ছিল না, মা দারুণ দুশ্চিন্তা করছেন, এটা ভেবেও লজ্জা-পরিতাপে অবশ লাগে। ঘরটায় ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, বই ছাড়া আর প্রায় কিছুই নেই, এখন এ রকম অবস্থায় কি বই পড়ে সময় কাটানো যায়? একটা বাঁশি থাকলেও না হয় সান্ত্বনা পাওয়া যেত, একজন বন্দী-মানুষ বাঁশির সুরে মগ্ন হয়ে আছে, এ দৃশ্যটাও এখানে মানিয়ে যায়।

ইচ্ছে করলে লাথি মেরে মেরে ভেঙে ফেলা যায় চ্যাঁচার বেড়ার দেয়াল। কিন্তু কার ঘর আমি ভাঙব? দরজাটাও তেমন মজবুত নয়, টানাটানি করে সেটা ওপরের দিকে খানিকটা তোলা যায়, তলায় খানিকটা ফাঁক হয়। আমি মাটিতে শুয়ে পড়ে, গড়িয়ে গড়িয়ে দরজার তলা দিয়ে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করলাম বেশ কিছুক্ষণ ধরে, পিঠ ও হাত-পা ছড়ে গেল, দরজাটা পটপট শব্দে হেলে পড়ল একদিকে, তারই মধ্যে কোনোক্রমে নিষ্ক্রান্ত হওয়া গেল। মুক্তি, মুক্তি! একজন বেশ ভালো, বিলেতি জামাকাপড় পরা মানুষ যাকে এখানকার কেউ আগে দেখেনি, সে কেন সারা রাত এই একটা ঘরে তালাবদ্ধ ছিল, কেনইবা সে দরজা প্রায় ভেঙে বেরিয়ে এল, তা নিয়ে পূর্বোক্ত স্ত্রীলোকেরা কোনো প্রশ্ন করল না, ভ্রুক্ষেপও করল না। জায়গাটা একটা কবরখানাই বটে, একদিকে বাঁশ ও দর্মার বেড়া দেওয়া এ রকম আরও কয়েকখানা ঘর রয়েছে, মনে হয় জবরদখল। আরও খানিকটা জমি দখল করার বিবাদে সেই স্ত্রীলোকেরা প্রমত্ত বলেই মনে হলো।

এ কবরখানা আগে দেখিনি, জায়গাটা কোথায়, তা–ও বুঝতে পারছি না। কলকাতা শহরটা আমি তন্নতন্ন করে চিনি, আগে আমার এ রকম শ্লাঘা ছিল, মাত্র এক বছরের প্রবাসে এমন বিভ্রম হয়ে গেল? সে কবরখানার বাইরে এসেও অচেনা মনে হচ্ছে অঞ্চলটি, পথ-ঘাটে মানুষজন প্রায় নেই-ই বলতে গেলে, গাড়ি-ঘোড়াও ক্বচিৎ। একটুক্ষণ উদ্‌ভ্রান্তের মতন আধা দৌড়োবার পর হঠাৎ দেখতে পেলাম, একটা বাড়ির গায়ে লেখা রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেল। আমার চমক লাগল, এ বাড়িটি তো আমার চেনা। আগে কয়েকবার এসেছি। শুধু তা–ই নয়, এ হোস্টেলের সুপার আমাদের অতি প্রিয় ছোটকুদা। কবি ও সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সত্যপ্রসন্ন দত্ত, সবাই বলত, ওঁরা দুজন হরিহর আত্মা। ইনি সেই সত্যপ্রসন্ন দত্তের ছোট ভাই, আমরা ছোটকুদা বলেই ডাকতাম। অতিশয় নরম মনের মানুষ। কলেজ স্ট্রিটে দৈবাৎ তাঁর দেখা পেলে আমাদের মধ্যে উল্লাসের স্রোত বয়ে যেত, শক্তি (শক্তি চট্টোপাধ্যায়) ওঁকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলত, ‘পনেরোটা টাকা দাও না, খুব খিদে পেয়েছে।’ ছোটকুদা কৃত্রিম ধমক দিয়ে বলতেন, ‘না, মোটেই খিদে পায়নি, টাকা নিয়ে তোমরা আজেবাজে জিনিস খাবে!’ শেষ পর্যন্ত দিয়েও দিতেন।

সেই প্রাতঃকালে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো, এখন ছোটকুদা হতে পারেন আমার ত্রাণকর্তা। কারণ, তখন আমি অন্য একটা সমস্যা নিয়ে দারুণ চিন্তিত। কবরখানা থেকে বেরিয়েই নজর করেছি যে আমার প্যান্টের একটা পায়ের পেছন দিকে অনেকখানি ছিঁড়ে গিয়ে ঝুলছে, বেশ খারাপ জায়গায় ছেঁড়া, দেখা যাবেই। সেটা আগের রাত্রেই কখনো হয়েছে, কিংবা দরজার তালা দিয়ে বেরিয়ে আসবার সময়, তা কে জানে। আমার বিদেশি দামি প্যান্ট ছেঁড়ার আফসোসের চেয়েও বড় কথা, এই অবস্থায় আমি বাড়ি ফিরব কী করে? আগের রাত্রে না ফেরার জন্য কোনো মুমূর্ষু বন্ধু সম্পর্কে করুণ কাহিনি না হয় বানানো যায়, কিন্তু এতখানি ছেঁড়া প্যান্টের কী ব্যাখ্যা হতে পারে?

দারোয়ানকে প্রায় ঠেলেই আমি উঠে গেলাম সুপারিনটেনডেন্টের কোয়ার্টারের দোতলায়। ঘড়ি পরার অভ্যেস আমি আগেই ছেড়ে দিয়েছি, ঘুম ভাঙার পর এত কাণ্ড করার পর আমার খেয়ালই হয়নি যে এখন মাত্র পৌনে ছটা বাজে, ছাত্ররাই কেউ জাগেনি, সুপারের এত তাড়াতাড়ি জেগে ওঠার কী দায় পড়েছে? আমার ডাকাডাকিতে ছোটকুদা চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন। এরপর আমি যে কাণ্ডটা করলাম, সেটাও প্রায় সুররিয়ালিস্টিকই বলা যেতে পারে। তখন আমার চিন্তা সম্পূর্ণ একমুখী, ছেঁড়া প্যান্ট! ছোটকুদা জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার হে, এত সকালে? এদিকে কোথায় এসেছিলে? এর উত্তরে ভদ্রতাসূচক যেসব ভণিতা করা উচিত ছিল, তা ভুলে গিয়ে আমি ব্যগ্রভাবে বললাম, ‘ছোটকুদা, একটু সুচ-সুতো দিতে পারেন?’

ছোটকুদা প্রথমে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কইলা? কী চাইলা?’ আমি একইভাবে বললাম, ‘সুচ-সুতো। এই দেখুন প্যান্টটা ছিঁড়ে গেছে, সেলাই করতে হবে।’

ছোটকুদা হতভম্বের মতন তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তাঁরও তো ঘুমের ঘোর কাটতে কিছুটা সময় লাগবে! কিন্তু তিনি জানতেও চাইলেন না প্যান্টটা অমনভাবে কী করে ছিঁড়ল বা কোথা থেকে এসেছি আমি। হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে। বসো, আগে চা খাও। গরম গরম ফিশ ফ্রাই খাবে। আমাদের কুক খুব ভালো ফিশ ফ্রাই বানায়। আর প্যান্টটা ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে একটা তোয়ালে জড়িয়ে এস। সেলাইয়ের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

এবারে আমার হতভম্ব হবার পালা। এত সকালে ফিশ ফ্রাই? কী হচ্ছে আজ ভোর থেকে? সবই অলীক, সবই অবাস্তব। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছোটকুদা, আপনি চায়ের সঙ্গে ফিশ ফ্রাই খান?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের কুক খুব ভালো বানায়, আগের রাত থেকে ম্যারিওনেট করে রাখে।’

সকালে প্রথম কাপ চায়ের সঙ্গে ফিশ ফ্রাই খায়, এমন মানুষ কি ভূ-ভারতে আর দ্বিতীয়টি আছে? ছোটকুদা কি এই পৃথিবীর, না অন্য গ্রহের? কিংবা, এ রকম কিছু কিছু মানুষ আছে বলেই পৃথিবীটা এত বর্ণময়!
পরে জেনেছিলাম, আগের রাতে আমি অকস্মাৎ অচেতন এবং অসাড়-শরীর হয়ে যাবার ফলে বন্ধুরা খুব বিব্রত হয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য তারা যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমার নাগেরবাজারের বাড়ি অনেকেই চেনে না, তা ছাড়া ওই অবস্থায় ট্যাক্সিতে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই, তাতে অনেক ভাড়া। এ রকম পরিস্থিতিতে কেউ কেউ দায়িত্ব এড়িয়ে সরে পড়ে, কেউ কেউ বুক দিয়ে আগলে রাখে। সেই প্রথম পরিচয়ের দিনেই বেলাল আমার দায়িত্ব নিয়েছিল। তখন বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র উৎপলকুমার বসুই নিজের বাড়ি বিক্রি করে সাহেবি কায়দায় আধা সাহেব পাড়া রয়েড স্ট্রিটে একলা ফ্ল্যাটে থাকে, সেখানে অনেকেই হুল্লোড় শেষে রাত্রিযাপন করে। আমাকে সেখানেই শুইয়ে রাখা যেত, কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় তোলার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বেলাল আমাকে নিজের ঘরে রেখে আসে। বাইরে থেকে তালা দেবার কারণ, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার জ্ঞানও আমার ছিল না, দরজা খোলা রাখলে পাশের বস্তির ছেলেরা ভেতরে ঢুকে অনেক কিছু চুরি করে নিতে পারত। চুরি করার মতন সম্পদ বেলালের ঘরে প্রায় ছিলই না বই ছাড়া, তা কে আর নেবে! কিন্তু দেশের চোর-ডাকাতেরা এমনই ছ্যাঁচড়া যে বেলালের চৌকির নিচে রাখা দু-একখানা জামাকাপড় বা থালা-গেলাসও নিতে পারে, তা ছাড়া আমার গায়ের সোয়েটারটা বেশ দামি। নেবার মতো কিছু না পেলে রাগের চোটে চোর-ডাকাতেরা খুনও করে যায়!

জীবনে ওরকমভাবে অচৈতন্য আমি একবারই হয়েছি। পরের বহু বছর ধরে দেখেছি, ও রকম তুরীয় অবস্থায় পৌঁছবার অধিকার আসলে বেলালেরই একচেটিয়া। স্থান-কাল-পাত্র কিছুই সে গ্রাহ্য করে না। এমন অনেকবার দেখেছি, কোনো বাড়িতে সান্ধ্য আড্ডায় আমরা বেলালকে নিয়ে গেছি, হয়তো কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবার, বেলালকে তারা আগে দেখেইনি। কিছুক্ষণ পানাহারের পর কথা বলতে বলতে বেলাল হঠাৎ অজ্ঞান এবং পাথর। তাকে বাধ্য হয়েই সেখানে শুইয়ে রেখে আমরা চলে গেছি, কিন্তু কোনো বাড়িতেই বেলাল সম্পর্কে সামান্যতম অভিযোগও শোনা যায়নি, বরং সেসব পরিবারের সঙ্গে বেলালের দীর্ঘস্থায়ী সুসম্পর্ক হয়ে গেছে। এবং তরুণীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা আমাদের কাছেও ঈর্ষণীয় ছিল।

অন্য দেশের নাগরিক হয়েও কলকাতার এক অজ্ঞাত কবরখানায়, জবরদখল জমির বাড়িতে, তা–ও কুড়ি-পঁচিশ টাকার ভাড়ায় বেলাল যেভাবে দিনযাপন করেছে তাতে মনে হয়েছে, এ ছেলে নিশ্চিত কোনো ছদ্মবেশী রাজকুমার। আমি সে রকমভাবেই বেলালকে গ্রহণ করেছি প্রথম দিন থেকে। এ রকম বেপরোয়া সাহস আমার কোনো দিনই ছিল না। আমি নিজে যা পারি না, তা অন্য কারও সহজসাধ্য দেখলে আমার শ্রদ্ধা হয়।