অভিজিৎ রায় স্মরণে

আমার ওপেন হার্ট সার্জারির কারণে এবার বইমেলায় মাত্র দু’দিন গিয়েছি। ১৮ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি। মেলার শেষ দিনেও যাব মনে করেছিলাম। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারির রাতে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে টিএসসির মোড়ে বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের নৃশংসভাবে নিহত হওয়া এবং ওর স্ত্রী বন্যার অস্ত্রাঘাতে আহত হওয়ার ঘটনাটি সব ভণ্ডুল করে দিল। আগের রাতে ঠিক এই গেট দিয়েই আমি মেলা শেষে তরুণদের সঙ্গে বসে চা খেয়ে, গান শুনে, আড্ডা মেরে বেরিয়ে এসেছিলাম। কোনো আততায়ীর আনাগোনা অনুভব করিনি। ভাবতেও পারিনি, কাল রাতে এই টিএসসির চত্বরে রাজু ভাস্কর্যের পাশে অভিজিৎ রায়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হবে। স্বামীকে বাঁচানোর নিষ্ফল প্রয়াসে ক্ষতবিক্ষত হবে বন্যা। ওর রক্তমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে অক্ষম লজ্জায় মুখ লুকাবে বাংলাদেশ। ভাগ্যিস, ঘটনাটি আগের রাতে ঘটেনি, এ রকম একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অসহায় দর্শক হতে হয়নি আমাকে।
অভিজিৎকে আমি নামে জানি, মুক্তমনায় দু-একটা লেখা পড়েছি। লিখেছিও কিছু দিন। মুক্তমনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ভুলে গিয়েছিলাম মুক্তমনা ও অভিজিৎ রায়কে। ওর নিষ্ঠুরভাবে টিএসসির সামনে নিহত হওয়ার খবরটি টিভির স্ক্রলে দেখে বুঝলাম, অভিজিৎ বইমেলায় সস্ত্রীক ঢাকায় এসেছিল। শুধু আসেনি, হত্যার হুমকি থাকার পরও শুধু স্ত্রীর ওপর ভরসা রেখে গিয়েছিল বইমেলায়, অটোগ্রাফ দিয়েছিল তার নতুন বইয়ে, তারপর নির্বোধ সরল বিশ্বাসে স্ত্রীর হাত ধরে মেলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল পিতা ডক্টর অজয় রায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে ফিরবে বলে।
কিন্তু ঘরে ফেরা হলো না ওদের। অভিজিৎ ফিরল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে, ওর স্ত্রী বন্যা ফিরল ডিএমসি হয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালে।
আর আমাদের জন্য রেখে গেল পথের ওপর বাংলাদেশের মাটি আঁকড়ে ধরে উবু হয়ে শুয়ে থাকা লাল পাঞ্জাবি পরা অভিজিতের মরদেহের একটি চোখ কাঁপানো ছবি। আর স্বামীর মৃতদেহ আগলে সারা গায়ে, চোখে-মুখে রক্ত মেখে বসে থাকা বেহুলার মতো হতবিহ্বল বন্যা। আহা! কী কষ্টই না হলো আমার এই ছবিটি দেখে!
বন্যা হয়তো সেরে উঠবে, কিন্তু এই ছবিটিকে সে কি পারবে চোখ থেকে তাড়াতে কোনো দিন? পারবে না। আমরাও কি পারব?
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই’র তদন্ত প্রস্তাব গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। এই সরকারি সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই।
মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে নিজের নতুন বইয়ে ভক্ত-ক্রেতাকে অটোগ্রাফ দিচ্ছে অভিজিৎ রায়। তার পাশে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি উপভোগ করছে বন্যা। সম্ভবত এটাই ওদের শেষ ছবি।

রাত ২-৪৫ মি.২ মার্চ ২০১৫।