আমরা ক-ভাই লিখি

amora k bhaiঅনেকেই রসিকতার ছলে বলেই ফেলেন, আপনাদের হায়দার পরিবার তো জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের চাইতেও এগিয়ে আছে। উত্সাহী যুবক-যুবতীসহ বয়েসিদেরও বলতে শুনি, আপনাদের পরিবারের ভাইবোন সকলেই যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তাহলে নিশ্চয়ই সবাই কবি, নাট্যকার, গল্পকার, শিল্পী হতে পারতেন। তখন তারা উত্সাহেই জানতে চায় পিতামাতা লেখক ছিলেন কিনা? দাউদ হায়দার কি আপনার বড়ো? না, বলতেই, উত্সাহীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ জানিয়ে দেন, আরো একটি পরিবার বাংলাদেশে আছে, তাদের তিন ভাই-ই লেখক। হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং আহসান হাবিব। তবে উনারা পাঁচ ভাই- সাত ভাই হলে নিশ্চয়ই আপনাদের ছাড়িয়ে যেতেন। আমি সম্মতি জানাই।

৮০-এর দশকে সাবেক সচিব মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনসহ জনাকয়েক রাষ্ট্রযন্ত্রী গিয়েছিলেন আমাদের দোহার পাড়ার বাড়িতে। তিনিসহ অনেকেই জানতে চেয়েছিলেন, একই পরিবারের পাঁচ-সাত ভাই কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক হয় কীভাবে? আমাদের বাবা-মা কি গল্প-কবিতা, নাটক-উপন্যাস লিখতেন? আমরা বলি, না। শুধু বলি, আমাদের ছোট কাকা আবুল কাশেমের স্পর্শে এসেই হয়তো আমরা নাট্যকার, কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার হতে পেরেছি। এই একই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় আমাকে সমগ্র বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের অনুষ্ঠানে যোগ দিলে। তখনি শুনি তাদের প্রশ্ন। ওই একই প্রশ্ন করেছিল, দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক মাইনুল শাহিদ এবং কবি অতনু তিয়াস।

গত কয়েক বছর আগে বাংলা একাডেমীর একুশের বইমেলায় প্রায় প্রতিদিনই ওই একই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। একজন প্রশ্নকারী বললেন, আপনার সব ভাই তো লেখাপড়া শেষ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, শুধু ভাই-ই নয়, বোনদের ভেতর থেকে দুই জন চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে বিয়ে থা করেছেন, অন্যান্য বোনদের স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করতে করতেই বিয়ে হয়ে গেছে। প্রশ্নকারী জানতে চাইলেন, বিদেশেও কি আপনারা কোনো ভাই স্কলারশিপ নিয়ে—পড়ালেখা করেছেন? ‘হ্যাঁ’ বলায় উত্সাহী যুবকের এক বান্ধবী তার বন্ধুদেরসহ এলেন আমার সঙ্গে পরিচিত হতে। নবাগতদেরও ওই একই প্রশ্ন, আপনাদের পিতামাতা কি লেখক ছিলেন? ‘না’ বলায় তারা প্রায় সমস্বরেই বললেন, এটা কী করে সম্ভব! পাবনার দোহারপাড়া গ্রামের একই পরিবারের! আপনারা তো হায়দার পরিবার নামে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে পরিচিত, বিশেষত শিক্ষিত সমাজে। তখুনি তাদের একজন বললেন, অনেকেই আবার ঘৃণার চোখেও দেখে থাকেন, বিশেষত যারা মৌলবাদে বিশ্বাসী।

আমি চুপচাপই ছিলাম, ওদেরই আরেকজন সেই সুশ্রী মেয়েটি বলল, গত ঈদসংখ্যায় আপনাদের লেখা ছাপা হয়েছে, তবে জনাকয়েক নাকি আপনাদের ভাই নন। এমনও শুনছি, আজকাল অনেক তরুণ কবি-গল্পকার, তাদের নামের পিছে ‘হায়দার’ যুক্ত করার সুবাদে সাহিত্যের পাতায় তাদের লেখা ছাপা হচ্ছে, তারা নাকি আপনাদের ভাই? মেয়েটির কথায় না হেসে পারিনি। হতেও পারে, যিনি ওই কর্ম করছেন তিনি যে তার পারিবারিক নাম আকিকার সময় মৌলানা সাহেবের দেয়া নাম না লিখে যদি নিজ নামের সঙ্গে ‘হায়দার’ শব্দটি যুক্ত করেন, অসুবিধাটি কোথায়? মেয়েটি জানাল, আমরা পাঠকেরা গুলিয়ে ফেলি, আপনাদের পরিবারে এই নবম বা দশম ভাইটির আগমন হলো কোথা থেকে, এরা কি সত্যিকারেই আপনাদের ভাই, নাকি ভূঁইফোড় হায়দার। যেমন—এবারকার অনেকগুলো ঈদসংখ্যায় সেইসব ভূঁইফোড় হায়দারদের লেখা দেখলাম।

দুই

আমাদের ছোটকাকা আবুল কাশেম যেদিন একটি নতুন তানপুরা কিনে নিয়ে কলিকাতা থেকে দোহার পাড়ার বাড়িতে এসেছিলেন, সেদিন নাকি বাড়ির কোনো স্বজনই জানতে পারেনি। শ্রাবণের সেই মাঝরাতে আবুল কাশেম একটি দামি তানপুরা কিনে সরাসরি কলিকাতার পার্কস্ট্রিটের বাস থেকে শিয়ালদহে দাঁড়িয়ে থাকা আসাম বেঙ্গল মেলে চেপে ঈশ্বরদী ইস্টিশনে নেমে, বিশ্বাস মোটর কোম্পানির খাঁচাওলা বাসের ফার্স্বক্লাসের দুটি সিট ভাড়া নিয়ে নতুন তানপুরাটাকে পাশের সিটে রেখে, পাবনা, ঈশ্বরদীর সেই ষোল-সতেরো মাইল রাস্তা পাড়ি দিতে তার মনে হয়েছিল, তিনি যেন অনন্ত যাত্রায় পাড়ি দিচ্ছেন নতুন কেনা তানপুরাটিকে সঙ্গে নিয়ে।

মাঝরাতে শহরের বাসস্ট্যান্ডে নামতেই পেয়ে গেলেন পাড়ার এক রিকশা, রিকশার চালক খোরশেদ, আবুল কাশেমের হাতে ওই বিশাল বাদ্যযন্ত্রটি দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে জেনে নিল যন্ত্রটির নাম, চালক খোরশেদ তার রিকশায় প্রথমে আবুল কাশেমকে বসিয়ে, পরে তানপুরাটি অতি যত্নসহকারে হাতে তুলে দেবার আগে নিজের গামছা দিয়ে তানপুরার গায়ে জড়ানো কাপড়টাকে ভালো করে মুছে তানপুরার মালিকের হাতে তুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, লাল কাপড় দিয়ে জড়িয়ে কলিকাতা থেকে কী আনলেন তিনি।

আবুল কাশেম খোরশেদের কথায় যেন খুশি হয়েই জানালেন, কাপড়ে জড়ানো যন্ত্রটির নাম তানপুরা। গান গাইবার সময় বাজাতে হয়। তাড়াতাড়ি চালিয়ে যাবি, বৃষ্টির দিন। খোরশেদ আলী নিজের সাধ্যমতো চালালেও আবুল কাশেমের বারবারই মনে হতে লাগল, শহর থেকে দোহারপাড়ার দূরত্ব মাত্র দুই-আড়াই মাইল হলেও, এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, দোহারপাড়াটি যেন পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরের অথবা আরো অধিক দূরে তাদের বাড়ি। আবুল কাশেমের বারবার মনে হতে লাগল বাদ্যযন্ত্রটি যদি বৃষ্টিতে ভিজে যায়। অথচ, বৃষ্টিতে ভিজবার কথা ছিল যেদিন তানপুরাটিকে বিডন স্কয়ার থেকে কিনে বাড়ি ফিরবার পথে। সঙ্গে নাট্যকার অভিনেতা সুরজিত তলাপাত্র ছিল, ওকে সঙ্গে নিয়েই তো হ্যারিসন রোডের ত্রিপুরা বর্মন মিউজিক্যাল সেন্টার থেকে অনেক দরাদরি করে কিনে যখন মিনার্ভা নাট্যমঞ্চের দিকে যাচ্ছিলাম আমি আর আমার বন্ধু তলাপাত্র, তখুনি শুরু হয়েছিল আষাঢ়ের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ইলশে গুঁড়ি, সেই ইলশে গুঁড়িতে না ভিজে, তাড়াতাড়ি মিনার্ভায় ঢুকতেই দেখি আমাদের নাট্য নির্দেশক সুনীলদা, তিনিই প্রথম তানপুরাটিকে দেখে নেড়ে চেড়ে প্রশংসা শেষে বলেছিলেন, যেন তানপুরাটিতে বৃষ্টির ছাঁট না লাগে, আর একটি কথা বলেছিলেন, ‘তোমাদের মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতরে নাচ, গান, শিল্প-সাহিত্য হারমনিয়াম, ডুগি, তবলা এমনকি তানপুরা বাজানো ও নাকি ধর্মীয় দিক থেকে…’। নাট্যনির্দেশক সুনীলদাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন আবুল কাশেমের বন্ধু সুরজিত তলাপাত্র। তলাপাত্রের বাড়ি এই পাবনা শহরের গোপালপুরে, তিনি হেসেই নাট্য নির্দেশককে জানিয়ে দিলেন, মুসলিম পরিবার হলেও, কাশেমের বড়দাদা হাকিমদা, কিছুদিন আগে আমাকে আর কাশেমকে সঙ্গে নিয়ে হাকিমদার বড়মেয়ে জোসনার জন্য, হারমনিয়াম আর ডুগি তবলা কিনেছিলেন গড়িয়া হাটের ‘সেনকো মিউজিক্যাল হল’ থেকে। সুনীলদা একটু যেন লজ্জা পেয়েই জানালেন, পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা, নাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-এর পরিবারও নাকি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার, নিজেকে একটু থামিয়ে সুনীলদা আরো বললেন, শুনেছি, আজকাল হিন্দুদের দেখাদেখি মুসলিম পরিবারেও নাচ-গানের প্রচলন শুরু হয়েছে। এমনকি নাটকে অভিনয়সহ দু-একজন নাকি নাটকও লিখছেন, তবে কাশেম, তোমার তানপুরাটি সযত্নে রেখো।

খোরশেদের রিকশা যখন গোপালপুর মহল্লা অতিক্রম করছিল, তখুনি মনে পড়েছিল নাট্য নির্দেশকের কথাগুলো এবং একই সঙ্গে বন্ধু তলাপাত্রের কথা। এখন তার বাড়ির সামনে দিয়েই চলছে রিকশা। ভেজা বাতাস, আর বৃষ্টি শুরু হবার আগ দিয়ে। আবুল কাশেম আরো জোরে রিকশাটিকে চালাবার কথা বলে, সিগ্রেট ধরাবার জন্যে পকেটে হাত দিতেই মনে হলো, সিগ্রেট কেনা হলেও ম্যাচবাক্স কেনা হয়নি। এরকম কলিকাতাতেও অনেকবারই হয়েছে, বিশেষত, মিনার্ভায় নাটকের রিহার্সাল দিতে গিয়ে। সিগ্রেটের আর ম্যাচবাক্সের কথা না ভেবে বরং তিনি সেই মুহূর্তে হঠাত্ যেন দেখতে পেলেন তারই অগ্রজ হাকিম ভাইয়ের সেজমেয়ে জোসনাকে। দোতলা বাড়ির একটি রুমে বসে তারই নিকট থেকে তানপুরা বাজানোর তালিম নিচ্ছে, পাশে দাঁড়িয়ে আছে বড়োভাই, ভাবি, আর রউফ, ঝর্ণা। নিজের কল্পনায় নিজেকে কিছুটা ভাসিয়ে দিতে না দিতেই, শুনতে পেলেন সদর গোরস্থানের ভেতরে লুকিয়ে থাকা একদল শেয়ালের হাঁক। ছোট-বড়ো বাবলা গাছের নিচে জোনাকিদের জটলা দেখতে পেলেন, ভাঙা সাঁকোর কাছে আসতেই, খোরশেদই আবুল কাশেমকে রিকশা থেকে নামার অনুরোধ জানাতেই, একদল কুকুর ডেকে উঠল, হান্নান ফকিরের বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে। সযত্নে তানপুরাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা সাঁকোটা পাড়ি দিয়ে, সদার গোরস্থানটাকে হাতের বামে ফেলে রেখে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছুটা ইটসুড়কির দোগাছি ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা পাড়ি দিয়ে নিজেদের ফজলি আম বাগানের নিকট আসতেই তার মনে হলো, পার্কস্ট্রিটের বাড়িতে ভুল করে ফেলে এসেছেন জোসনার জন্য কেনা এক জোড়া ঘুঙুর। এবার রিকশায় চেপে কিছুটা এগুতেই দেখতে পেলেন, তাদের বাড়ির কাচারি ঘরের হ্যারিকেন বাতির আলোয় জায়গির মাস্টার পড়াশোনা করছে।

সেই আষাঢ়-শ্রাবণের শিয়াল ডাকা রাত, জোনাকিদের আনাগোনা, এবং বৃষ্টি আসবে আসবে করেও যখন এল না তখন আবুল কাশেম ভাবলেন, এত রাতে, মা, বড়োভাই কাউকে সে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে কিনা? নাকি রাতটা কাচারিঘরের জায়গির মাস্টারের চকিতে কাটিয়ে দেবে। নাকি গল্প-সল্প করবে। নিজেকে হয়তো আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন, এমন সময় তারই মেজোভাই, হাবিবভাই সাঁথিয়া থেকে মেজোভাবিকে নিয়ে দোহারপাড়ায় এসে নামলেন ঘোড়া গাড়ি থেকে, রাত প্রায় তিনটের দিকে।

এত রাতে ভাবি আর মেজোভাইকে ঘোড়া গাড়ি থেকে নামতে দেখে ছোটভাই আবুল কাশেম একটু বিস্মিতই হয়েছিলেন। কাচারিঘর থেকে দু-এক পা এগিয়ে যেতেই মেজো ভাবি ও কৌতূহলবশতই জানতে চাইলেন, আরে আবুমিয়া, তুমি কখন কলিকাতা থেকে এলে? এসেছি ঘণ্টাখানেকেরও কম সময়, মেজো ভাবি, ভাই হাবীবুর রহমানও জানতে চাইলেন, ঘণ্টাখানেক আগেই যদি এসে থাকিস তাহলে বাড়ির ভেতরে না গিয়ে কাচারি ঘরে জায়গির মাস্টারের সঙ্গে বসে বসে… মেজোভাবি মেজোভাইকে কথা বাড়াতে দিলেন না, না দিয়ে বাড়ির বড়দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই ঘোড়া গাড়িওলা বললেন, আমাকে বিদায় করেন, মিয়া ভাই। মেজদেবর বার দুয়েক ডাকতেই বড়ো বাড়ির বড় গেটের দরজা বড়োভাবি এসে খুলতেই জোসনার হাতে হ্যারিকেনের আলো দেখে, আবুল কাশেম সেই মাঝরাতে প্রায় চিত্কার করেই বললেন, কাচারিঘরের সামনে থেকে, জোসনা, দরজা বন্ধ করিসনে। এই মাঝরাতে জোসনার প্রিয় ছোটকাকার কথা শুনে বড়োভাবি আর জোসনা প্রায় একই সময় জানতে চাইল, কলিকাতা থেকে কখন এলে? ভাবি এবং ভ্রাতুষ্পুত্রীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে লালকাপড়ে জড়ানো তানপুরাটিকে নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে বড়োভাবি, মেজোভাই, মেজোভাবি এবং জোসনার কাছাকাছি আসতেই প্রিয় ছোটকাকাকে জোসনাই জিজ্ঞেস করল, তোমার লাল কাপড়ে জড়ানো ওটা কী? ওই একই প্রশ্ন করতে হয়তো চেয়েছিল অন্য তিনজনই, তার আগেই জোসনাকে জানাল, লালকাপড়ের ভেতরে তানপুরা, কাল সকালে…, ছোটকাকাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, জোসনা বলল, আমি আজ সারারাত জেগে থাকব কাল সকালে আমিই লালকাপড়টাকে প্রথম খুলব, রউফ, ঝর্ণা—এরা কেউ যেন না খোলে, ছোটকাকাকে সাবধান করে দিয়ে নিজেদের ঘরের দিকে ফিরে যাবার সময় জোসনা জানাল, কথাটি যেন মনে থাকে ছোটকাকু।

রহিমা খাতুন, বড়ো ভাবি আগে থেকেই জানতেন, রাত আটটা-নয়টার ভেতরেই সাঁথিয়া থেকে হাবিব আর নূরজাহান আসবে, কলিকাতা থেকে যে আবু আসবে সেটি না জানলেও যে পরিমাণ মতো ভাত-মাছ আছে তা দিয়ে তিন জনের রাতের আহার হয়ে যাবে, এমনকি হয়েও গেল তা-ই, আহার শেষ হবার পরেই, মেজোভাই উত্সাহ ভরেই জানতে চাইলেন, তোর ওই তানপুরার দাম পড়ল কত? আবু খুশি হয়েই জানাল, প্রায় তিনশো টাকার কাছাকাছি, মেজোভাবি রসিকতা করেই বললেন, তিনশো টাকা দিয়ে খুব ভালো সীতাহার পাওয়া যায়। মনি’র মাকে কিনে দিয়েছে ওই তরফের বড়ো ভাশুর। হারটির ওজন নাকি প্রায় তিন ভরি। শহরের সোনা পট্টির বসন্ত স্বর্ণকারের দোকান থেকে কেনা। হাবিবুর রহমান স্ত্রী নূরজাহানকে বললেন, মশারি-বিছানা ঠিক করগে। মেজোভাবির পিছু পিছু আবুও ঘুমাতে দোতলার ঘরে যাবার জন্যে দু-এক পা এগিয়ে যাবার সময়ই মেজোভাই আবুর নিকট থেকে জানতে চাইল, ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের ফাইনাল কবে? উত্তরের অপেক্ষা না করে ছোটভাই আবুকে বলল, কলিকাতার ফুটবল, পৃথিবী বিখ্যাত খেলা, গত বছর ইতালির মাঠে অল্পের জন্য ইস্টবেঙ্গল ১ গোলে হারল, সেটিও আবার মোহামেডানের সামাদের গোলে, নাকি বাচ্চি খানের গোলে, আবু শুধরে দেবার পরে মেজোভাই প্রসঙ্গক্রমে জানতে চাইল, কানন বালার নতুন কোনো ‘টকি’ মুক্তি পেয়েছে কি না? আবু সেই মধ্যরাতেই জানাল, কানন বালার কি যেন একটি সিনেমা রিলিজ হবে, আরেকটায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নাকি ‘সাপুড়িয়া’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন, ওই দুই সিনেমারই পোস্টার দেখলাম, নায়িকা বোধ হয় কানন বালা নাকি সরজু বালা মনে নেই, তবে হ্যারিসন রোডের মোড়ে অনেক লোককে দেখলাম পোস্টারের দিকে তাকিয়ে আছে, আমিও তাকালাম। মেজোভাই জানতে চাইলেন, ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কোন কোন ফুটবল ক্লাবের খেলা পড়েছে তুই জানিস নাকি? ছোটভাই আবু কিছু একটা বলার আগেই মেজোভাই জানাল, এবার কলিকাতা গিয়ে সব ক’টি দলের খেলা দেখতেই হবে, মনে হয় এবার ইস্টবেঙ্গল ফাইনাল জিতবে, হারবে মোহনবাগান। ছোটভাই জানালেন, আমার মনে হয় মোহামেডান ক্লাবই জিতবে, এমন সময় আবুর মেজোভাবি নূরজাহান বেগম এসে জানালেন, রাত অনেক হয়েছে। ছোটকাকার আদরের জোসনার চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু করলেও মাকে সাথে নিয়েই তবে ঘুমোতে যাবে। জোসনার বাবা, তিনি গিয়েছেন বগুড়াতে। বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাহেবের বাড়ির পেছনে নতুন একটি ভবন হচ্ছে তারই কন্ট্রাক্ট পেয়েছেন, হাবীব আর আবুল কাশেম আবুর বড়ো ভাই শেখ মোহাম্মদ হাকিমউদ্দিন। যিনি এই ছোট্ট শান্তশিষ্ট জিলা শহরে হাকিমউদ্দিন ঠিকাদার নামেই সর্বাধিক পরিচিত। বিত্তশালী হলেও তিনি শিল্পরসিক, বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে নাটক, এমনকি গানের জলসাতেও তার সহযোগিতার হাত প্রসারিত, এমনকি পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল খেলাতেও তিনি তরুণদের উত্সাহিত করে থাকেন।

সেই শিল্পরসিক বড়ো ভাইয়ের প্রভাব যে শুধু দোহার পাড়ার শেখ পরিবারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়, তিনি একাধারে দোগাছি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট এবং পাবনা শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, অর্থশালী, প্রভাবশালী, এবং একই সঙ্গে পাবনা শাখার মুসলীম লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তার নিজ গ্রামেই কয়েকটি ইটের ভাটা, প্রচুর সহায়সম্পদ, ইট ভাঙ্গানোর কয়েকটি মেশিন, সুড়কির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আরো একটি মেশিনের অর্ডারের সঙ্গে গোটা দশেক ‘পাগমিল’-এর নাকি অর্ডার দিয়ে এসেছেন কলিকাতার খিদিরপুরের ডক ইয়ার্ডে। তারই বন্ধু শচীন চৌধুরী আর তিনি দুজনই সামনের পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনে দাঁড়াবেন মেম্বার পদে। ইতিমধ্যে অনেকেই জেনে গিয়েছে শচীন চৌধুরী দাঁড়াবেন কংগ্রেসের পক্ষ থেকে, আর তারই বন্ধু হাকিমউদ্দিন দাঁড়াবেন মুসলীম লীগের হয়ে। দোগাছি ইউনিয়নের সকলেই জানেন, তিনি অত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হবার অনেক আগেই কলিকাতার দমদম এলাকায় জায়গাজমি কিনেছেন, ভবিষ্যতে বাড়িঘর বানাবেন। বন্ধু শচীন চৌধুরীর সুপরামর্শে পার্কসার্কাসেও অনেক আগেই বাড়ি কিনেছেন। শচীন বাবু নাকি বলেছিলেন, পাবনার অনেক ধনী লোকের বাড়িঘর কলিকাতায় আছে, ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শিক্ষা, সাহিত্য বিশেষত তোমার ছোটভাইয়ের যেহেতু গান-বাজনার শখ আছে, সিনেমা এবং পূরবী থিয়েটার হলে পাবনার দুই-তিনজন ছেলে নাকি নিয়মিত অভিনয় করে, তার ভেতরে তোমার ভাইও নাকি আছেন। পার্কসার্কাস হোক, পার্কস্ট্রিট হোক, বাড়ি তোমাকে কিনতেই হবে। বন্ধু শচীনের কথা রেখেই যে বাড়িটি পার্কসার্কাসে কিনেছেন, সেই বাড়িতে গিয়েই তো সুজানগরের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার আবদুল হালিম দিন দশেক থেকে, ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়কে হালিম তার বউকে দেখিয়েছিল, সেই বাড়িতেই একদিন আবুল কাশেমের সাথে দেখা, কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে কাশেমেরই লেখা ‘মোহমুক্তি’ নাটকের রিহার্সল করছিলেন সেইদিন। সেইদিনই প্রথম শুনলাম শুনে ভালোও লাগল, কাশেমের বড়ো ভাই হাকিমউদ্দিন নাকি সাঁথিয়ায় অনেক জায়গাজমি কিনেছেন, নিলামে। বলেছিলেন আমার মামা শ্বশুর, হলুদঘর প্রাইমারি স্কুলের রজব আলী মোল্লার নিকট থেকে আরও শুনলাম নিলামে কেনা জমি থেকে ওই এলাকায় গরিবদের মধ্যে তিন কাঠা করে দেবেন, যাদের জমি নিলামে উঠেছিল, এমনকি একটি প্রাইমারি স্কুলের জন্যেও বিঘে চারেক জমি দেবার ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন।

অনেকেই বিশেষত হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের দুটি দাবি ছিল হিন্দুদের মন্দিরের জন্য, এবং মুসলমানদের মসজিদ বানানোর জন্য জায়গা দিতে হবে, তিনি দুই সম্প্রদায়ের কথাই রেখেছিলেন, অথচ নিজের নামে প্রাইমারি স্কুল হোক, তিনি সেটা চাননি। সেই হাকিমউদ্দিন শেখ, সাঁথিয়ার হিন্দুদের মন্দির বানানোর জন্য জমি দিয়েছেন, এবং মসজিদ বানানোর জন্যেও দিয়েছেন বেশ কয়েক বিঘা জমি, ‘হলুদগড়’, ‘টলট’ ওই দুইগ্রামে প্রাইমারি স্কুলের জন্যে জমি দান করেছেন। মন্দির, মসজিদ, স্কুলের নামে জায়গা দিলেও কোথাও তিনি বলেন নাই, স্কুলটি… মসজিদটি আমার নামে হবে, আরো শুনলাম হাকিম শেখের ছোটভাই নাকি কলিকাতার কোথায় নাকি চাকরি করে আর নাটক করে বেড়ায়, পাড়ায় পাড়ায় কিছুদিন আগে কলিকাতা গিয়ে শুনলাম, তিনি নাকি এখন মঞ্চের নামকরা অভিনেতা, তবে ভদ্রলোকের বড়ো ভাইয়ের রুচির প্রশংসা করতে হয়, তাদের দোহারপাড়ার বাড়িতে নাকি লক্ষ্মীর পূজাও হয়, আবার বিশেষ বিশেষ দিনে মিলাদ মাহফিলও হয়।

যিনি কথাগুলো বলছিলেন তিনিই শেষে জানালেন, হাকিম উদ্দিনের ছোটভাই, হাবীব আমার বন্ধু, ওর সঙ্গে ওই পার্কস্ট্রিটে নাকি পার্কসার্কাসের বাড়িতে আমিও বেশ কয়েকবার গিয়ে থেকে মোহামেডান, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, ইংরেজদের এরিয়ান ক্লাবের ফুটবল খেলা অনেকদিন দেখেছি ইডেনের মাঠে। এমনকি পূরবী সিমেনা হলে আমি আর হাবীব কিছুদিন আগেও দেখে এলাম, কানন বালার সিনেমা, নায়ক মনে হয় ছিল প্রমথেশ বড়ুয়া। কলিকাতা থেকে পাবনায় ফেরার দিন দেখি, অনেকগুলি বই আর বিভিন্ন পত্রিকা কিনে নিয়ে এসেছে কাশেম। কাশেমকে বললাম, রবীন্দ্রনাথের এত বই কিনলে কেন, কাশেম জানিয়েছিল, বড়ো ভাই এর নির্দেশ দিয়েছেন, এবার পাবনায় যখন আসবি, তখন অবশ্যই রবীন্দ্ররচনাবলী, মাসিক বসুমতী, পূজো সংখ্যা দেশ, সব কিছু কিনেই তবে আমাদের জন্য পাজামা, পাঞ্জাবি, মায়ের জন্য দুটি শাড়ি, বাড়ির বউদের জন্য ওয়াসেল মোল্লার দোকান থেকে গরদের দুটি শাড়ি কিনবি, সঙ্গে জোসনার জন্যে ভালো একটি তানপুরা, কথাগুলো শেষ করেই কাশেম জানাল, রিহার্সেলে যেতে হবে ধর্মতলায়। মিত্র বাবুর বাড়িতে। মিত্র বাবুর বাড়িতে রিহার্সেলে গিয়ে আরো জনাকয়েকের সাথে দেখা। এমনকি নতুন দু-একটি মুখ। সেদিনের সেই রিহার্সেল শেষে প্রশান্ত মিত্র আড্ডায় জানালেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে শান্তি আসবে না, আজকেই শুনলাম ইংরেজরা নাকি ভারত ছেড়ে চলে যাবে। যদি হিটলারের বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়, ইতিমধ্যে নাকি আমাদের ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা সুভাষচন্দ্র বসু জাপান আর জার্মানীর নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। রিহার্সেলে নতুন আসা এক ছেলে জানাল, বাবার মুখে শুনলাম দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হবার সম্ভবনা আছে। সেই দুর্ভিক্ষের পর পরই হাজার হাজার লোক মারা যাবে, ইংরেজদের নাকি এটি একটি কূটচাল। যদি যুদ্ধে জিতে যায় ইংরেজরা তাহলে ভারতকে স্বাধীনতা টাধীনতা কিছুই দেবে না, সেই দিন রাতে আবুল কাশেম তাদের পার্কস্ট্রিটের বাড়িতে ফেরার পথে ভাবলেন, সবেমাত্র রাত এগারোটা, যাই গিয়ে দেখি মিনার্ভায় ‘শকুন্তলা’ নাটকটি শেষ হয়েছে কিনা। এক পা-দু’পা করে মিত্র বাবুর বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল বর্মনদের তানপুরার দোকানটির দিকে। তখুনি আবুল কাশেম স্থির করলেন জোসনার জন্য কালকেই তানপুরা কিনে দিন দুয়েকের ভেতরে পাবনায় যাবেন।

শেখ মোহাম্মদ হাকিম উদ্দীন, শেখ মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান ও অন্যান্য শরিকদের বাড়িঘর, পুকুর, আম-কাঁঠালের বাগান সকলেরই ভিন্ন ভিন্ন হলেও হাকিম, হাবিব আর কাশেম—এরা সকলেই একান্নভুক্ত পরিবার। এই পরিবারটির যতটা অর্থবিত্ত আছে, সেই অর্থে লেখাপড়া নিতান্তই কম, শেখ মোহাম্মদ হাকিমউদ্দিন, তত্কালে এন্ট্রার্ন্স পাশ না করেই ব্রিটিশ আমলেই পূর্ব ভারতের রেলওয়েতে চাকরি নিয়েছিলেন মুসলিমদের কোটায়। শেখ মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান ছিলেন শৌখিন ইটের ভাটার ব্যবসায়ী। মাঝে মাঝেই ব্যবসা-বাণিজ্য ফেলে চলে যেতেন কলিকাতায়, ফুটবল খেলা দেখতে। তিনি সেই ৩০-এর দশকে, এমনকি ৪০-এর দশকেও, দেশভাগের আগে, তার প্রিয় নায়িকা কানন বালার টকি কলিকাতায় রিলিজের খবর পাবনায় এলেই হাবীবকে অন্তত এক সপ্তাহ পাবনা শহরে কেউ দ্যাখেনি, এমনও শোনা গেছে, কলিকাতার ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান, এরিয়ান, কিম্বা মোহামেডানের যতগুলো ফুটবল খেলা তার পক্ষে দেখা সম্ভব, সবগুলো শৌখিন হাবীবুর রহমান দেখেই ফিরতেন আসাম বেঙ্গল রেলে, ঈশ্বরদীতে। ওই দুই ভাইয়ের আদরের অনুজ শেখ আবু সাইদ মোহাম্মদ আবুল কাশেম, তিনিও একদিন কলিকাতায় পাড়ি জমালেন, বন্ধু আবদুল গনি হাজারী আর সরদার জয়েন উদ্দিনের সঙ্গে। পার্কসার্কাস, পার্কস্ট্রিটে স্বজনেরাই ওই তিন জনকেই জুটিয়ে দিয়েছিলেন শিক্ষাগত যোগ্যতানুসারে চাকরি। কিংবা সাংবাদিকতায় শিক্ষানবীশি। আবুল কাশেমের লক্ষ্য ছিল, তিনি নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, এমনকি অভিনেতা হবেন, হয়েও ছিলেন তা-ই, মিনার্ভায় বেশ কয়েকটি নাটকও করেছিলেন দেশ ভাগের আগে।

শেখ হাবীব আর শেখ কাশেমের অগ্রজ শেখ মোহাম্মদ হাকিমউদ্দিন, আমাদের পিতা। তিনি ২০-এর দশকেই রেলওয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলিকাতা এবং পাবনায় শুরু করেছিলেন ব্যবসা। ২০-এর দশকেই বিয়ে করেছিলেন দোহারপাড়ার মাইল চারেক পূর্বের লড়িবাটা গ্রামের নাহার বানুকে। নাহার বানু ছিলেন আমাদের বড় মা, তিনি বউ হয়ে দোহারপাড়ায় যখন এসেছিলেন তখন নাকি তার বয়স চোদ্দও পেরোয়নি। আমাদের পিতার সংসারে মাত্র বছর তিনেক থাকতেই সেকালের ম্যালেরিয়ায় কয়েক মাস পরেই তাকে ছাড়তে হয়েছিল সংসারের মায়া। তার মৃত্যুর কয়েক মাস আগে জন্ম দিয়েছিলেন আমাদের পরিবারের সবার বড়ো বোন রিজিয়া খাতুনকে। বড়ো মায়ের মৃত্যুর পরে পিতা সহসাই বিয়ে করতে না চাইলেও শিশু রিজিয়াকে দেখভালের জন্য, আমাদের দাদিমা, উম্মে কুলসুমের চাপে তিনি রাজি বিয়ে করতে হয়েছিলেন, দোহারপাড়ার পশ্চিম দিকের মাইল তিনেক দূরের কেষ্টপুর মহল্লার মৌলানা খোন্দকার আবু তালেবের তৃতীয় কন্যা রহিমা খাতুনকে। রহিমা খাতুন পিতার দ্বিতীয় স্ত্রী। আমাদের আট ভাইবোনের মা।

আমার মায়ের তিন কন্যা, পাঁচ পুত্র। বড়ো কন্যা জোসনা, পরে রৌফ, ঝর্ণা, দুলাল, রোকন, হেনা, খোকন, স্বপন। জোসনার জন্মগ্রহণের পরেই পিতার ব্যবসার প্রভূত উন্নতি হবার সুবাদে ৩০-এর দশকেই কলিকাতার পার্কস্ট্রিটের পার্কসার্কাসে এবং দমদম এয়ারপোর্টের আশেপাশে অনেক জায়গা-জমি কিনেছিলেন, এবং জোসনা ও রৌফকে নিয়ে কলিকাতায়ই স্কুলে ভর্তির বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন, যদিও তারা দু’জনেই ছোট থাকলেও রৌফের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ তার শৈশব থেকে লক্ষ করেছিলেন পিতা, আর জোসনার গানের গলা ছোটকাল থেকেই শ্রুতিমধুর হবার সুবাদে ছোটকাকা আবুল কাশেম তখন থেকেই স্থির করেছিলেন, জোসনাকে একদিন ভালো করে গান শেখাবেন। কলিকাতার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবাধ যাতায়াতের সুবাদে তার স্বপ্ন ছিল তারই আদরের ভ্রাতুষ্পুত্রীর কণ্ঠে একদিন কলিকাতার আকাশবাণীতে শোনা যাবে রবীন্দ্র, নজরুল সংগীত।

সেই কলিকাতাতেই ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায় অনেকেই নিঃস্ব হলেন, হারালেন জীবন। শুধু অল্পের জন্যে জোসনার ছোটকাকা রক্ষা পেয়েছিলেন মিত্র বাবুর অশেষ দয়ায়। এবং তিনিই তার ভবানীপুরের বাড়িতে দিন পাঁচেক লুকিয়ে রেখে শহর শান্ত হলে রাতের গভীরে তুলে দিয়েছিলেন আসাম বেঙ্গল মেলে, হাওড়া স্টেশন থেকে। নিজের জীবন হাতে নিয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরে এসেছিলেন আমাদের ছোটকাকা, নাটকপ্রিয় মানুষ আবুল কাশেম। ফেরেনি মেজোকাকা হাবিবুর রহমান। সকলেই ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি হয়তো না-ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন, তিনি ফিরলেন আতাইকুলার রহমান কাকার সঙ্গে প্রায় মাসখানেক পরে। ধুতি এবং দামি পাঞ্জাবি ও জুতা চকচক করলেও মুখটি মলিন হলেও যেদিন তিনি কাচারিঘরের সামনে এসে নামলেন সকলেই দেখলেন, তার হাতে কানন বালার ঠোঁটে রোজ লিপস্টিক লাগানো একটি গনগনে সুন্দর বাঁধানো ছবি আর একটি ছবি সেই যাত্রায় তিনি এনেছিলেন কলিকাতার মোহামেডানের সেই দুর্ধর্ষ ফুটবল খেলোয়াড়দের। সামাদ, বাচ্চিখান, হাবীবসহ ছিলেন টিমের অন্য সকলেই, যে ছবি দুটো আমাদের বাড়ির মধ্যের ঘরে ছিল ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত। আমাদের বাড়ি পাকিস্তানি আর্মিরা পোড়ানোর আগে মেজোকাকার ঘরে ঢুকে ওরা কানন বালার ছবিটিকে দেখে হয়তো পছন্দ করেছিল, সঙ্গে ফুটবলের ওই সকল কৃতী খেলোয়াড়দের। ১৯৭১ সালের পরে অনেকের অনেক কিছু গেলেও, মেজোকাকার একটিই মাত্র দুঃখ ছিল, তার ওই প্রাণপ্রিয় ছবি দুটির জন্য। প্রিয় নায়িকার জন্য।

নিঃস্বাবস্থায় ছোটকাকা আবুল কাশেম ফিরে এলেও তিনি তার সংস্কৃতিকে সঙ্গে নিয়েই এসেছেন। আমাদের জোসনা আপার বিয়ের আগে ছোটকাকার একান্ত চেষ্টায় তিনি রপ্ত করেছিলেন তানপুরা বাদন এবং কিছু রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত। সে বছর দেশব্যাপী শুরু হয়েছিল, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ। আমাদের পিতা যেহেতু ছিলেন মুসলীম লীগের প্রভাবশালী সদস্য, তাই তিনি একদিন স্থির করলেন, শহরের জিলাপাড়ার নিজের দোতলার বাড়িতে এলে, তার রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধে হবে। যেহেতু রাত-বেরাতে দোহারপাড়ায় ফেরাটাও ছিল দুষ্কর। যেদিন আমাদের দাদিমা জানতে পারলেন তার বড়ো ছেলে দোহারপাড়া ছেড়ে চলে যাবে জিলাপাড়ার দোতলা বাড়িতে, সেই দিনই নাকি বলেছিলেন, আমি মারা গেলে তুই জিলাপাড়ায় গিয়ে উঠবি।

দোহারপাড়ায় আষাঢ়-শ্রাবণ- ভাদ্র মাসে রামানন্দপুর, পার গোবিন্দপুর, রাজাপুর, ব্রজনাথপুর এবং আরিফপুর থেকে আউশ, আমন, রূপশালী ধানের গাড়ি বেশ কয়েকদিন ধরে আসতেই থাকত। বাড়ির কাজের মেয়েরা ধান শুকিয়ে সিদ্ধ করে, মুড়ি, মুড়কি এবং খাবার চাউলের ভাঙ্গানোর ব্যবস্থা করত। আশে-পাশের কোথায়ও কোনো ধানের কল না থাকায় বাড়ির ভেতরকার ঢেঁকিতেই সেকালে ধান ভাঙতে হতো। একদিন শখের বশবর্তী হয়ে, আমাদের মা, রহিমা খাতুন সেই ঢেঁকিতে পাড় দিতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়ে বুকের হাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছিলেন এবং প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়েছিল নাক দিয়ে। পিতা শহর থেকে ফিরে এসে সেই রাতেই কলিকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন মাকে, ডাক্তার বিধান রায়ের নিকট। ডাক্তার বিধান রায় পিতাকে বলে দিয়েছিলেন, আপনার স্ত্রী যেন কোনোদিন আগুনের নিকট না যায়, রান্নাবান্নার জন্যে, সংসার দেখার জন্য প্রয়োজনে অন্য একটি দ্বার গ্রহণ করতে পারেন। পিতা ডা. বিধান চন্দ্রের কথা রেখেছিলেন, বিশাল এই সংসার দেখবার জন্যে আমাদের ছোটমা মাজেদা খাতুন তৃতীয় মা হিসেবে এলেন আমাদের সংসারে, দেশ ভাগ হবার আগে। আমরা তিন মায়ের ১৪ ভাইবোন। মেয়ের সংখ্যা ৭, ছেলের সংখ্যা ৭।

একদিন পিতা দাদিমাকে জানালেন, রৌফ, ঝর্ণা, দুলাল রোকনকে লেখাপড়া শেখাতেই জিলাপাড়ার বাড়িতে গিয়ে থাকা দরকার। উম্মে কুলসুম পুত্রের কথায় রাজি হয়ে গেলেন একটি শর্তসাপেক্ষে, আবুকে একটা কিছু করে দিতে হবে। আমাদের ছোটকাকা সরকারি চাকরি পেলেও তিনি কখনোই তার সেই শিল্প-সাহিত্যের উঠোন থেকে নিজেকে বিচ্যুত্ করেননি। বরং তার সেই তানপুরা, হারমনিয়াম, তবলা-চর্চা এবং নিয়মিত নাটক প্রতিবছর চালিয়ে যাচ্ছিলেন পাবনার বনমালী ইনস্টিটিউটে। তারই রচিত ‘মোহমুক্তি’ নাটকটি প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ৫০ এবং ৬০-এর দশকে। দেশভাগ হবার পরে ১৯৫২ সালে আমাদের পরিবারে প্রথম মাধ্যমিক পাশ করলেন, আবদুর রউফ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার, ঢাকা বোর্ড থেকে, দ্বিতীয় শ্রেণিতে। সেদিন আমাদের পিতা জিলাপাড়ার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন লক্ষ্মী ঘোষের বড়ো বড়ো রাজভোগ। ছোটকাকা আবুল কাশেম একদিন আমার মাকে এসে বলেছিলেন, রৌফ যে ‘ক্যারিকেচার’ দেখায় আমি জানতাম না, জিলা স্কুলের হেড মৌলানা কসিমউদ্দিন বললেন। আমার মা, যার বিদ্যা, ক্লাশ থ্রি-ফোর, তিনি যে সেদিন ‘ক্যারিকেচার’ শব্দটির বাংলা অর্থ কী হবে সেটি না জেনেই বলেছিলেন, ও নাকি জিন্নাপার্কে গিয়ে ফুটবলও খেলে গতকালকেই শুনলাম, চুনু, নান্নুর মায়ের নিকট থেকে। ছোট দেবর আবুল কাশেম তখুনি জানালেন—তোমার ছেলে তো পদ্যও লেখে, ‘সাপ্তাহিক পাক হিতৈষী’ নামের এক সপ্তাহিক খবরের কাগজে। ওই পত্রিকার সম্পাদক আজিজুল হক আমার বন্ধু মানুষ, তিনিই জানালেন রৌফের অত বিশাল নাম কেটে ‘জিয়া হায়দার’ বানিয়ে দিয়েছি। জিয়া হায়দারকে আমার সাপ্তাহিক পাক হিতৈষীর সাহিত্য সম্পাদকও বানিয়েছি। ইতিমধ্যে দৈনিক আজাদে, ইত্তেফাকে, মিল্লাতে তোমার ছেলের নাকি পদ্য ছাপা হয়েছে।

আনন্দে, স্বল্পবিদ্যার মা হয়তো খুশিই হয়েছিলেন, ছেলের কবি হবার সুসংবাদে। ইতিমধ্যে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রদের বার্ষিক নির্বাচনে সে বছর কামাল লোহানীদের একজন সাহিত্য সম্পাদক প্রার্থীকে হারিয়ে সাহিত্য সম্পাদকের পদে জিয়া হায়দার জয়লাভ করেছিলেন। তিনিই একমাত্র জয়ী হয়েছিলেন কামাল লোহানীদের বিপক্ষে। সেই ১৯৫২-৫৩ শিক্ষাবছরে আবার ১৯৫৩-৫৪ সালের ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রনেতাদের ভেতরে ৫৩, ৫৪ সালে কিম্বা আগে পরে ওই কামাল লোহানীর সঙ্গেই ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে জেলেও ঢুকেছিলেন। রাজশাহী কলেজ থেকে অনার্স পাশ করে ১৯৫৯ সালে ঢাকায় এসে আবদুল গনি হাজারীর সঙ্গে দেখা করলে হাজারী সাহেব তার ঘনিষ্ট বন্ধু আবুল কাশেমের বড়ো ভাইয়ের ছেলেকে অবজারভার গ্রুপের ‘পল্লী বার্তায়’ চাকরি দিয়েছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে সেকালের জনপ্রিয় সিনে পত্রিকা ‘চিত্রালী’তে। ছাত্রাবস্থায় চাকরির সময়েই ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম বর্ষে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলেও ১৯৬১ সালে ফাইনাল পরীক্ষায় তাকে প্রথম করা হয়নি, একজন শিক্ষকের ইচ্ছায়। ইতিমধ্যে জিয়া হায়দার কবি এবং গীতিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, এবং ওই ১৯৬১ সালেই বাংলা বিভাগে, নারায়ণগঞ্জের তুলারাম কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দেওয়ায়, চিত্রালীর সেই শূন্য পদে আবদুর রশীদ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দারকে চাকরি দিয়েছিলেন চিত্রালীর সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ (এস.এম. পারভেজ)। ইতিমধ্যে পিতার ব্যবসায় ধস নেমেছিল, ১৯৫৮ সাল থেকেই। কেননা দেশভাগের পর, অনেক অর্থ-সম্পদ ভারতে হারিয়ে আমাদের পিতা বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। ইতিমধ্যে রিজিয়া আর জোসনার বিয়ে হলেও, হয়নি রৌফ এবং ঝর্ণার। ১৯৬১ সালেই আমাদের জিয়া ভাই আর রশীদ ভাই পুরাতন ঢাকার বেচারাম দেউড়ি এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। সেই বাড়িতে মা-পিতা মাঝে মাঝে এসে থাকতেন। তখনকার দিনে পাবনা থেকে ঢাকায় আসতে একদিন একরাত একদিন সময় লাগত। তার আগে ১৯৫৯ সালে আমি আমার পিতার সঙ্গে আমাদের বড়ো বোন জোসনার বাসায় কমলাপুরে ছিলাম দিনকয়েক। পরে ১৯৬২ সালে, ঢাকা থেকে আমি আর বড়ো বোনের মেয়ে শিউলী ২২ টাকায় প্লেনে চড়ে ঢাকা থেকে ঈশ্বরদী গিয়েছিলাম। টিকিট দিয়েছিলেন আমাদের জিয়া ভাই, যাকে আমরা সোনা ভাই বলে এখনো ডাকি। সেই তিনি, ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমীতে এসে যোগ দিয়েছিলেন কালচারাল অফিসার পদে। বছর দুয়েকের মধ্যে তিনি একটি স্কলারশিপ জোগাড় করলেন আমিরকায় হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যশাস্ত্রের উপর উচ্চতর ডিগ্রির জন্যে। পেয়েও গেলেন ১৯৬৬ সালে। তিনিই তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমেরিকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে এ বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান লাভ করেন। এরপর দেশে ফিরলেন ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে। যোগ দিলেন সিনিয়র প্রোডিউসার হিসেবে পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা শাখায়। তখন আমরা ১৪/২ মালিবাগের একটি বাসায় ভাড়া থাকি। সেই সময়ে ওই বাড়িরই ড্রয়িংরুমে জিয়া হায়দার প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ নামটির প্রস্তাব দিলেন খোকন (দাউদ হায়দার)। সেদিনের সেই আলোচনায়—ফজলে লোহানী, আতাউর রহমান, এনামুল হকসহ আরো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। ইতিমধ্যে জিয়া হায়দারের প্রথম একটি নাটক, ‘শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ’ বাজারে এসেছে। প্রথমে রেডিওতে এবং পরে টেলিভিশনে প্রচারিত হবার পর একদিন পাবনা থেকে আমাদের ছোটকাকা আবুল কাশেম এসে আশির্বাদ জানালেন। সেদিন সকলেই লক্ষ করলাম, ছোট কাকার দুই চোখে জল। আনন্দাশ্রু। তিনি হয়তো নীরবেই বলেছিলেন, তোদের সব ভাইয়েরা শিল্প-সাহিত্যে একদিন সুনাম অর্জন করবি। ছোটকাকার সেই আশীর্বাণী আমাদের ক-ভাইয়ের শিল্প-সাহিত্যের জীবনে পাথেয় হয়ে আছে। আমাদের ছোটকাকা আবুল কাশেমের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়েই আমরা ক-ভাই শিল্প-সাহিত্যের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম নিজেদের অজান্তে।

আমাদের মেজোভাই আবদুর রশীদ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার দুলাল (রশীদ হায়দার)। তিনি সাপ্তাহিক চিত্রালীতে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৬১ সালে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে পাশ করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেন এবং ওই ছাত্রকালীন সময়েই চাকরির সুবাদে সেই সময়ের বিখ্যাত শিল্প-সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে আসার পথটা প্রশস্থ করলেন, তার মেধা এবং মনন দিয়ে।

রশীদ হায়দার আমাদের মেজোভাই। যখন তিনি স্কুলের শেষ ধাপের ছাত্র তখন তার কয়েকটি গল্প স্বনামেই বেরিয়ে ছিল, এমনকি তখনকার দিনের মহিলাদের প্রিয় পত্রিকা ‘বেগম’-এ তিনি মেয়েদের নামেও দুই-একটি গল্প লিখেছিলেন, শুনেছি অগ্রজের মুখেই। যখন তিনি পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র, তখনই ওই স্কুল থেকে একটি ম্যাগাজিন বের করেছিলেন, স্কুলের বাংলার শিক্ষক বিমলবাবুর আন্তরিক প্রচেষ্টায়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মথুর চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, এম.এস.সি. (ক্যাল)সহ অন্যান্য শিক্ষকেরা উত্সাহিত করলেও বাধাও নাকি দিয়েছিলেন দু-একজন। তার পরেও বিমল স্যার এবং প্রধান শিক্ষকের ইচ্ছায়ই প্রকাশিত হয়েছিল স্কুল ম্যাগাজিনটি। সম্ভবত ১৯৫৭-৫৮ শিক্ষাবছরে। রশীদ হায়দারকে আমরা দাদুভাই নামে সম্বোধন করি। সেই দাদুভাই, ১৯৫৮ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় শুধুমাত্র অঙ্কে অকৃতকার্য হবার কারণে পরবর্তী সময়ে ১৯৫৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক, ১৯৬১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। এবং চিত্রালীতে চাকরিরত অবস্থায় তাঁর অনেকগুলো বিখ্যাত গল্প বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও মাসিকে প্রকাশিত হতে থাকলে, রশীদ হায়দার তরুণ গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে ঝর্ণাপার বিয়ে হয়েছে। আমাদের দোহার পাড়ার বিশাল বাড়িটা ফাঁকা হতে শুরু হয়েছিল। ৬০-এর দশকের গোড়া থেকে মেজোকাকার তিন মেয়ে, মিনাপা, রীনাপা এমনকি কনাপার বিয়ে তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়ায়, বাড়িটার প্রাণস্পন্দন এমনই কমে এলেও, আমি আবদুল মাকিদ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার রোকন, যেন এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়ে গেলাম।

লেখাপড়ার চেয়ে মারামারি, ফুটবল, গুলতি দিয়ে এমনকি পিতার দোনলা বন্দুক দিয়ে পাখি মারি। আশ্বিন মাসে শারদীয় উত্সবের আগমন উপলক্ষে দোহারপাড়া বাড়ির দোতলায় আমাদের ছোট ভাইবোন—বাবলু, রাজা, রতন, মানিক, খোকন, স্বপন, তপন, হেনা, হাস্না, বীণা, বিলকিস, অঞ্জু, মঞ্জু, ঝরা, হীরা এবং আমি শেষরাতের আগেই ধান, দূর্বা, কলা, শিউলি ফুল, বাতাসা, খাগড়াই, মুড়ি, মুড়কি ইত্যাদি দিয়ে পূজোর থালার মতো সাজিয়ে রেখে পরদিন ১লা আশ্বিনের ভোরেই সূর্য ওঠার আগেই আমাদের অন্যান্য কাকার ছেলেমেয়েসহ সেই আশ্বিনের গাশ্বিনী খেয়ে পাঠখড়ির মাথায় আগুন ধরিয়ে বেরিয়ে পড়তাম বড়ো রাস্তায়। কী যে আনন্দ ছিল সেই কৈশোরের দিনগুলোতে। কিন্তু পড়ালেখায় ছিলাম লবডঙ্কা। জিয়া ভাই আমেরিকা যাবার আগে প্রতি মাসে কুড়ি টাকা পাঠাতেন ঢাকা থেকে। ওই কুড়ি টাকা থেকে পনেরো টাকায় কোচিং পড়তে যেতাম, গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনেরই অঙ্কের শিক্ষক মাজাহার আলী স্যারের নিকট। অঙ্ক দেখলেই শরীরে আমার জ্বর এসে যেত। পরে কিছুদিন সিরাজুল ইসলাম সিরু ভাইয়ের নিকট ইংরেজি পড়েছিলাম ১৯৬৪ সালে। উক্ত ক্লাসের দুটি বিষয়ই খুব কঠিন ছিল আমার কাছে, ইংরেজি এবং অঙ্ক।

ইতিমধ্যে ১৯৬৩ সালে পাবনায় যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল। শহরের লাহিড়ী পাড়ায় ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস (ইফা) এবং অল পাকিস্তান ওমেন্স অ্যাসোসিয়েশন স্থাপন করলেন তত্কালীন পাকিস্তান সরকার (আপওয়া)। একদিন আমাদের বাড়ির জায়গির মাস্টার আবু মুসার বুদ্ধিতে দু’জনই গিয়ে ভর্তি হলাম ইফাতে। মাত্র তিন টাকায়। ইচ্ছে ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো একদিন বড় গায়ক হব। তখনকার দিনে উত্তম-সুচিত্রা জুটির সিনেমাগুলোতে হেমন্তের গান বেশি শোনা যেত। গান শেখাতেন নারায়ণ বসাক। মাঝে মাঝে আসতেন বিখ্যাত বারীন মজুমদার, থানা পাড়ার শিবানী দিদি, গোপালপুরের অনিমা দিদি। আমাদের গানবাজনা ভালোই চলছিল। এমন সময় ছোটদের পাতায় বেশকিছু ছড়া ও গল্প ছাপা হলো আমার। আমাদের তৃতীয় বোন সেলিনা হায়দার ঝর্ণা আমার দীর্ঘ নামটি সংক্ষিপ্ত করে দিলেন। আমি হয়ে গেলাম মাকিদ হায়দার। আবু দাউদ মোহম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার খোকন হয়ে গেল দাউদ হায়দার। অনুরূপভাবে আবু জাহিদ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার, তিনি হলেন জাহিদ হায়দার এবং ছয় নম্বর ভাইটির নাম দিলেন আবিদ হায়দার, সপ্তমের নাম হলো আরিফ হায়দার।

১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই চলে এসেছিলাম ঢাকায়। সেই ১৪/২ মালিবাগের বাসায়। তার আগে আমাদের অগ্রজ জিয়া হায়দার এবং রশীদ হায়দার ১৯৬৪ সালে ওই বাসাতেই আমাদের মা রহিমা খাতুনসহ দাউদ, জাহিদ, ফরিদা এবং আফরোজাকে নিয়ে এসেছিলেন। সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ ও গার্লস স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন দাউদ, জাহিদ, ফরিদা এবং আফরোজাকে। আমি ৬৫ সালে মাধ্যমিক পাশ করে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই, আমি আর দাউদ পাল্লা দিয়ে শুরু করলাম কবিতা, গল্প, ছড়া লেখা। দাউদের লেখা ঘন ঘন ছাপা হতে শুরু করেছিল ওর স্কুলজীবন থেকেই। আমারও দৈনিক আজাদে, ইত্তেফাকের ছোটদের পাতায়। কলেজে ভর্তি হবার পরে প্রতিমাসেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গল্প-কবিতা ছাপা হতেই একদিন কবিতা নিয়ে বংশাল রোডের সংবাদ অফিসে গেলে রনেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তখনকার দিনে দৈনিক সংবাদে তরুণদের লেখা প্রায়ই ছাপা হতো। উত্সাহিত করবার জন্য। যেমন—বরিশালের মাসুদ আহমদ মাসুদ এবং আমিসহ অনেকেরই। ১৯৬৫-৬৭ সালে নিয়মিত কবিতা ছাপা হতো, এবং ওই সময়েই অধ্যাপক অজিত গুহ, শামসুজ্জামান খান, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রাহাত খান—এরা তখন ছিলেন জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তাদের সাহচার্য্য পেয়েছিলাম আমি, গল্পকার, উপন্যাসিক বুলবুল চৌধুরী, প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুর রহমানসহ আরো জনাকয়েক। এখন আমাদের সেইসব বন্ধুর ভেতরে বুলবুল, আমি আর আজিজই লেখালেখিতে আছি। দাউদের স্কুলজীবন থেকেই তার অবাধ যাতায়াত ছিল বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের দপ্তরে। তত্কালীন দৈনিক পাকিস্তানের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন বিখ্যাত কবি আহসান হাবীব। হাবীব ভাইয়ের সাহচার্য্যে অনেকেই কবি হতে পেরেছিলেন, পেরেছেন আমার অনুজ দাউদ। দৈনিক সংবাদের মালিক আহমেদুল কবীরের স্নেহধন্য হবার সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই দৈনিক সংবাদের যুক্ত ছিল এবং পরবর্তীকালে সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিল আমার আরেক অনুজ জাহিদ হায়দার। আবিদ হায়দার লেখালেখি শুরু করেছিল ১৯৭২ সালের পর থেকে।

দাউদ হায়দার ১৯৭৪ সালে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক থাকাকালে ওর একটি বিতর্কিত কবিতা ছেপেছিল সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে। তখন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। সেই কবিতাটি নিয়ে সমগ্র দেশে মৌলবাদীদের উত্কণ্ঠায় জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তাকে ভারতের কলিকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তত্কালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করে একটি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আরো সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। আমাদের হায়দার পরিবার তাঁদের নিকট চিরকৃতজ্ঞ।

আমি পড়ালেখা শেষ করে বিদেশ পাড়ি দেবার চেষ্টায় ছিলাম। ইংল্যান্ডে। দাউদ আগেই চলে গিয়েছিল কলিকাতায়। জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে এদিক-সেদিক চাকরি-বাকরি শেষে আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি পাবার সুবাদে পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশ ইতিমধ্যে ঘুরে ফেললেও—আমরা কোনো ভাইই লেখালেখি ভুলে যাইনি। এমনকি অগ্রজ জিয়া ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক থাকাকালে তার বিখ্যাত পাঁচটি নাটক সম্পর্কিত বই প্রকাশিত হয়েছে। সুখের বিষয়, জিয়া ভাই, রশীদ ভাই ইতিমধ্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং একুশে পদক পেয়েছেন তাদের সাহিত্যকর্মের জন্য। আমাদের বাড়ির সাহিত্যের আবহ সৃষ্টিকারী ছোটকাকা আবুল কাশেমের পরিচালনায় ’৬০-এর দশকেই দোহারপাড়ার বাড়ির বিশাল উঠোনে স্টেজ বানিয়ে শীতের শুরুতেই প্রতিবছর রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্যক্ষতি’, ‘দুই বিঘে জমি’ এবং কবি জসিমউদ্দিনের ‘কবর’ কবিতাটির নাট্যরূপ দিয়ে আমাদের বোন ফরিদা, আফরোজা এবং মেজোকাকার মেয়ে বীণা, ছোট কাকার মেয়ে বিলকিস এবং অন্যান্য কাকার ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাটক, গান, নাচ, ক্যারিকেচার হতো। এবং আমাদের ভাগ্নী আরা, নীরা এবং আশা—এরা প্রায়শই ওইসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত। ’৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে সুকুমার রায়ের ‘ষোল আনাই মিছে’ কবিতাটির নাট্যরূপে দাউদ হায়দার ‘মাঝি’ আর ছোট কাকার ছেলে হাসনাত মোশারফ রতন ‘বাবু’র চরিত্রে অভিনয় করেছিল। এই অভিনয় করে তত্কালীন পাবনার জেলা প্রশাসকের নিকট থেকে পুরস্কৃত হয়েছিল। পাবনা বনমালী ইনস্টিটিউটে, তখনকার দিনে ২৩ মার্চ তারিখে পাকিস্তান দিবস উদ্যাপিত হতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে। শান্তশিষ্ট পাবনা শহরে।

১৯৬০ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের এবং বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত লোকেরা গিয়েছিলেন দোহারপাড়ার বাড়িতে। আবদুল গনি হাজারী, সরদার জয়েনউদ্দিন, গায়িকা ফেরদৌসি বেগম (তখন তিনি রহমান হননি), প্রফেসর কবির চৌধুরী, এস.এম. পারভেজ, সৈয়দ শামসুল হক ও আবু হেনা মুস্তফা কামাল। স্বাধীনতার পরে গিয়েছেন অভিনেতা আলী যাকের, খায়রুল আলম সবুজ, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, তসলিমা নাসরিনসহ অনেক কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক।

ঢাকার রামপুরায় মেজোভাই রশীদ হায়দারের বাসায় বিখ্যাত গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, প্রফেসর কবি নরেশ গুহ, কবি শামসুর রাহমান, পশ্চিমবঙ্গের আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান, জাহানারা ইমাম এবং ১৯৮৬ সালে পৃথিবী বিখ্যাত ঔপন্যাসিক নোবেল বিজয়ী গুন্টার গ্রাস এবং ১৯৯৬ সালে অন্নদা শংকর রায় এসেছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য গুন্টার গ্রাস এবং অন্নদা শংকর রায়ের সঙ্গে রাতান্নের সুযোগ হয়েছিল। দাউদ বাদে আমাদের ছয় ভাইয়ের। কলিকাতায় এবং জার্মানীতে দাউদের আশ্রয়দাতা ওই দুই মহান ব্যক্তিকে আমরা সচিত্তে মনে রাখব, আজীবন শ্রদ্ধা জানাবে আমাদের হায়দার পরিবার।

জিয়া ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছিল ২০০৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর। জিয়া ভাইয়ের প্রিয় ছাত্র ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ কবি আসাদ মান্নান (আব্দুল মান্নান)। সেই কবি আসাদ মান্নান রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার হয়ে প্রথম দিনে আমাকে জানালেন তার নতুন পোস্টিং-এর কথা, এবং একই সঙ্গে জানালেন, এবং পাবনা সদর গোরস্থানে যাবেন তার প্রিয় স্যারের কবর জিয়ারত করতে। তিনি যথারীতি পাবনা ভিজিটের কিছুদিন পরে আমাকে পুনরায় জানালেন, জিয়া স্যারের নামে পাবনা শহরে একটি সড়ক/রোড হওয়া বাঞ্ছনীয়। তিনি এবং তত্কালীন পাবনার জেলা প্রশাসক মুস্তাফিজুর রহমান, পৌর মেয়র কামরুল হাসান মিন্টুর সদিচ্ছায় ‘জিয়া হায়দার’ সড়কটি অনুমোদিত হবার পরে, বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান (কবি আসাদ মান্নান) তার প্রিয় স্যারের নামে নতুন সড়কটির উদ্বোধন করেছিলেন ২০১২ সালের ১০ নভেম্বর, শুক্রবার। শহরের পূর্ব দিকের প্রধান সড়কটির নাম এখন জিয়া হায়দার সড়ক। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক এবং পাবনা জেলা প্রশাসনের প্রায় সকলেই আমাদের দোহারপাড়ার বাড়িতে একাধিকবার এসেছেন। কেউ কেউ ইচ্ছা প্রকাশও করেছেন সারাদিন পুকুরের পোষা মাছ ধরতে। বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নানের একান্ত প্রচেষ্টায় আমাদের অনুজ আরিফ হায়দারকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে নিতে বাধ্য হয়েছিল। আরিফ, কলিকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যকলায় পড়ালেখা শেষ করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে যোগ দেবার আগেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে নিয়োগ পেলেও তাকে যোগ দিতে দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থি ছাত্র-শিক্ষকেরা। কেন দেয়নি? দেয়নি আরিফ নাস্তিক দাউদ হায়দারের অনুজ, সেই বিঘ্ন দূর করলেন বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান (কবি আসাদ মান্নান)।

২০০৫ সালে কলিকাতায় দাউদ এসেছিল বার্লিন থেকে, ও কলিকাতা এলে আমরা সব ভাইবোনই ওর সঙ্গে গিয়ে দেখা করি। কোনো সরকারই ওকে অনুমতি দেয়নি, বাংলাদেশের তার পৈতৃক বাড়ি দোহারপাড়ায় যেতে। আজ দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে তাকে থাকতে হচ্ছে প্রবাসজীবন নিয়ে। কলিকাতায়, অন্নদা শংকর রায়ের বাড়িতে প্রায় ১২ বছর, পরবর্তী সময়ে গুন্টার গ্রাসের সহায়তায় ঠাঁই পেয়েছে জার্মানীর বার্লিনে। ২০০৮ সালে আমাদের হায়দার পরিবারের অগ্রজ জিয়া হায়দার পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেবার আগে ২০০৫ সালে কলিকাতায় বলেছিলেন, আমাদের ভাইদের লেখক হবার পেছনে ছোটকাকার অবদান তো রয়েছেই, তবে প্রভাব থাকে যেকোনো শিল্পী, কবি-সাহিত্যিকদের জীবনে তাদের নিকটজনদের সংস্পর্শে এলে। যদি তিনি নিজে লেখক, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক হয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রেই লেখার জগত্টায় প্রবেশ করতে হয়তো বা সুবিধেই হয়। তিনি যে ভীষণ ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন সে কথা পুনর্বার আমাদের ক-ভাই-কে স্বীকার করতেই হয়। তবে সৃষ্টিশীলতা, মননশীলতা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে যেকোনো লেখকেরই প্রয়োজন হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রয়ের। যেটি স্বয়ং ঈশ্বরেরই প্রদত্ত। এই হচ্ছে আমাদের পঞ্চপাণ্ডবের কথা, কবি-নাট্যকার হবার উত্তর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কেনা আমাদের পরিবারের সেই তানপুরা, হারমনিয়াম, সেতার এবং তবলা—সবই চলে গিয়েছিল লুটেরাদের হাতে ১৯৭১ সালের সেই দিনগুলোতে। এমনকি আমাদের বাবা, মা, মেজো কাকা, ছোট কাকা, দুই কাকিমা, বড় দুই বোন এবং অগ্রজ জিয়াভাই—তারা ছেড়েছেন পৃথিবীর যাবতীয় মায়া। তারপরেও আমরা যে ক-ভাই বেঁচে আছি লিখব, লিখবই। আর সেই লেখাগুলোকে কে যেন লিখিয়ে নেন, কখনো দিনে, কখনো মাঝরাতে। তবে কোনো প্রাপ্তির আশায় নয়। লেখক লিখবেন, যেমন আমরা ক-ভাই লিখি।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
মাকিদ হায়দার- র আরো পোষ্ট দেখুন