রুখে দাঁড়িয়েছে উঠে দাঁড়াবে তো

একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু এখনও যে উঠে দাঁড়াতে পেরেছে তা বলা যাবে না। জাতি হিসেবে উঠে দাঁড়ানোর একটা দৃষ্টান্ত আধুনিক চীন স্থাপন করেছিল আজ থেকে ৫০ বছর আগে। তারাও রুখে দাঁড়িয়েছিল, জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে, বিশ্বাসঘাতক কুওমেনটাঙের বিরুদ্ধে, রুখে দাঁড়িয়ে বিজয় অর্জন করেছে এবং বিজয়ের উৎসবে বেইজিং শহরের তিয়েনমেন স্কোয়ারের বিশাল সমাবেশে দাঁড়িয়ে মাও সে তুং তার চিত্রসমৃদ্ধ ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন, চীনা জাতি উঠে দাঁড়িয়েছে। দাবিটা যে মিথ্যা ছিল না পরবর্তী ইতিহাসে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আমাদেরও উঠে দাঁড়ানোর কথা ছিল। রুখে আমরাও দাঁড়িয়েছিলাম, যুদ্ধ আমরাও করেছি; কিন্তু উঠে দাঁড়ানো হয়নি। ওরা পারল, আমরা কেন পারলাম না? উত্তরটা সহজ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে চীনের মানুষ একটি সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছিল, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা তেমন ঘটনা ঘটাতে পারিনি। পুরনো সমাজ রয়ে গেছে, রয়ে গেছে পূর্বনির্ধারিত বৈষম্যমূলক সামাজিক সম্পর্ক। রাষ্ট্রের আইনকানুন, বিচারব্যবস্থা, বিভিন্ন বাহিনী, সর্বোপরি আমলাতন্ত্র সবই রয়ে গেল, তাদের বজায় রেখেই আমরা স্বাধীন হলাম। সমাজ কাঠামোতে পরিবর্তন না এলে উপর কাঠামোর রাজনৈতিক পরিবর্তন যে ক্ষমতা হস্তান্তরেই পর্যবসিত হয় তার উদাহরণ ব্রিটিশ চলে যাওয়ার সময় তৈরি হয়েছিল, পাকিস্তানিদের চলে যাওয়ার সময় দ্বিতীয়বার তৈরি হল।
বাংলাদেশ যে উঠে দাঁড়াতে পারেনি তার নানা লক্ষণ ও প্রমাণ বিদ্যমান। দেশ ঋণে আবদ্ধ। মৌলিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত দেশের রাজধানীতে নেয়া হয় না, হয় অন্য রাজধানীতে। দারিদ্র্য ঘোচে না, যদিও কিছু লোক রূপকথার নায়কদের মতো অলৌকিক উপায়ে ধনী হয়ে যায়। বাংলাদেশের বহু মানুষ এখন বিদেশে। কঠিন কায়িক পরিশ্রম থেকে শুরু করে নানা পেশায় তারা রয়েছেন এবং যেখানেই কাজ করুন প্রশংসা অর্জন করেন। ছেলেমেয়েরা যারা পড়তে গেছে তারাও ভালো করছে। দেশের উন্নতি হচ্ছে। দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, যানবাহন সবই বেড়েছে; কিন্তু তবু মানুষ সেই মুক্তি অর্জন করতে পারেনি, যেটা মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য অত্যাবশ্যক। অল্প কিছু লোকই ধনী হয়েছে, মধ্যবিত্তের বড় অংশ নেমে গেছে নিচে। গরিব মানুষের দুর্দশা আজ অবর্ণনীয়। বাংলাদেশের জন্য একটি গৌরবের বিষয় হচ্ছে, একুশে ফেব্র“য়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। যে দিবস একান্তভাবে আমাদেরই ছিল হয়তো সেই দিবস এখন সারা বিশ্বে উদযাপিত হবে। বিশ্বব্যাপী এখন আধিপত্য চলছে খোলাবাজারের। এই খোলাবাজার সাম্রাজ্যবাদেরই নতুন রূপ। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা এখন জাতিসংঘের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়বে, গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে। জাতিসংঘ অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ করে সীমিত আকারে, বাণিজ্য সংস্থা করতে পারবে ব্যাপক হারে। বাণিজ্যের এই আধিপত্য পুঁজিবাদী বিশ্বে যে প্রধান নায়ক সেই আমেরিকারই আধিপত্য বটে। এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বও জড়িত রয়েছে; আকাশ সংস্কৃতি কার্যকর হয়েছে, ইন্টারনেট চালু হয়েছে, ইংরেজি ভাষা প্রায় একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। মাতৃভাষা দিবস এই আধিপত্য ছিন্ন করার যে ইচ্ছা তারই প্রকাশ। প্রত্যেকটি জাতি তার মাতৃভাষাকে বিকশিত করতে চায়। এই বিকাশের সঙ্গে তার সংস্কৃতি ও নিজস্বতা জড়িত। মাতৃভাষা দিবস পালনের তাৎপর্যকে তাই কিছুতেই খাটো করে দেখা যাবে না।
আমাদের পক্ষে গৌরবের বিষয় এটা যে, আমরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। পথ দেখিয়েছি বলা যায়। কিন্তু এই গৌরব কী করে অর্জিত হল সেই ইতিহাসটা ভুললে চলবে না। এটা কোনো বিশেষ দলের অর্জন তো নয়ই, এমনকি কোনো শ্রেণীরও অর্জন নয়। হ্যাঁ, মধ্যবিত্ত শ্রেণী শুরু করেছিল। সেই শ্রেণীর সবচেয়ে অগ্রসর অংশ ছিল ছাত্রসমাজ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত এই ছাত্রদের দ্বারাই ঘটেছে। কিন্তু এই আন্দোলন কিছুতেই সফল হতো না, যদি না শ্রমজীবী মানুষ এতে যোগ দিত। রমনার আন্দোলন রমনায় থাকেনি, ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে, মাঠে-ঘাটে গ্রামে-গঞ্জে। সেই জন্যই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন অত বড় একটা কাজ করতে পেরেছে, একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে এবং সারা বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্দোলনের আসল নায়ক কিন্তু ওই সাধারণ মানুষই। কেবল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বলে নয়, আমাদের দেশে যতগুলো আন্দোলন সফল হয়েছে প্রত্যেকটিতেই নায়ক ছিল অপরিচিত মানুষ এবং অসংখ্য মানুষ। নেতারা ছিলেন; কিন্তু তাদের শক্তি ছিল না লক্ষ্য অর্জন করার। জনগণ না এলে তারা এক পা দুই পা এগিয়ে বসে পড়তেন, হতাশ হয়ে। পাকিস্তান আন্দোলন যে সফল হয়েছে তার কারণ ওই জনসাধারণ, তারা ভোট দিয়েছে; সে জন্যই আন্দোলন সফলতা পেয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও একই ঘটনা ঘটেছে। চুয়ান্নর নির্বাচনে মুসলিম লীগ ধরাশায়ী হল, কারণ ওই জনগণই। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানও জনগণেরই রায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আসল শক্তি কোনো দল বা বাহিনী নয়, আসল শক্তি জনগণ। এভাবে বারবার তারা রুখে দাঁড়িয়েছে এবং জয়ী হয়েছে।
একদিকে এটা যেমন সত্য, অন্যদিকে তেমনি নির্মম সত্য এটাও যে, জনগণ আন্দোলন করেছে, দুঃখ ভোগ করেছে, জয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে; কিন্তু বিজয়ের ফল তারা পায়নি। তারা উঠে দাঁড়াতে পারেনি, রুখে দাঁড়ানো সত্ত্বেও এবং পরিচিত দুর্বৃত্তকে আপাতত পরাভূত করতে পারার পরেও। দুর্বৃত্ত হচ্ছে শোষণকারী শক্তি। সেই দুর্বৃত্তকে চিহ্নিত করা গেছে কিন্তু সে আবার ফিরে এসেছে। জয়ী হয়েও জনগণ জয়ী হয়নি, তার দুর্ভোগ কমেনি, বরঞ্চ বেড়ে গেছে। পাকিস্তান এলো; কিন্তু সাধারণ মানুষের মুক্তি এলো না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সফল হল, সারা বিশ্ব তাকে স্বীকার করে নিল, কিন্তু এখনও এদেশের বেশির ভাগ মানুষ অশিক্ষিত, যারা অক্ষরজ্ঞান লাভ করছে তারাও ভাষা ব্যবহার কতে পারে না, তাদের জীবনে স্থায়ী ভাষা হচ্ছে ক্রন্দন ও আর্তনাদের, কখনও নীরবে কাঁদে কখনও সরবে। দেশ স্বাধীন হয়েছে; কিন্তু মানুষ মুক্ত হয়নি। স্বৈরাচার বিদায় হয়নি; কখনও সে নির্বাচিত কখনও বা জবরদখলকারী, এটুকুই বৈচিত্র্য। নব্বইয়ের অভ্যুত্থানেও জনগণ ছিল। ঘটনার দিন সাধারণ মানুষ আসতে পারেনি হয়তো; কিন্তু তারা যে আসবে স্বৈরশাসক সেটা জানত, সে জন্যই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেনি, পদত্যাগ করেছে। শাসক গেছে, শাসন যায়নি এবং সেই শাসনে নিগৃহীত হচ্ছে ওই জনগণই।
দুই.
উঠে দাঁড়াবে কি, পায়ের নিচে তো মাটিই পায় না সাধারণ মানুষ, উৎখাত হয়ে যায়, ভাসতে থাকে, গ্রামবাংলার নদীর কচুরিপানার মতো। তেতাল্লিশের মন্বন্তরে আশ্রয়হীন মানুষের যে ভাসমান অবস্থা ছিল আজও তার অবসান ঘটেছে এমনটা বলার উপায় নেই। মন্বন্তরের সময় মানুষ কলকাতার দিকে চলেছে, খাদ্যের আশায়। সাতচল্লিশে যখন ভাগ হয়ে গেল দেশ তখনও মানুষকে ভাসতে হয়েছে, ব্যাপকহারে। এপারের মানুষ ওপারে গেছে, ওপারের মানুষ এপারে এসেছে। একই রকম ঘটনা আবার ঘটল একাত্তরে, আবার মানুষ দেশ ছেড়ে রওনা হল কলকাতার দিকে। এই প্রবাহগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা, ওরা দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু মানুষের ভাসতে থাকা সব সময়ের জন্যই সত্য হয়ে রয়েছে এই দেশে। ভূমিহীনের সংখ্যা বেড়েছে, ভূমিহীন নয় কেবল, ভিটেমাটিহীনই হাজার মানুষ। উঠবে কোথায়? উঠেছে বস্তিতে। মেয়েদের অবস্থা আরও খারাপ। তারা নির্যাতিত দুইভাবে। এক হচ্ছে গরিব মানুষ হিসেবে আর হচ্ছে মেয়ে মানুষ হিসেবে। পুঁজিবাদের শিকার তারা, শিকার আবার পুরুষতান্ত্রিকতার।
ওই যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অর্জন ও পরিবর্তনগুলোর কথা স্মরণ করলাম, বড় বড় ঘটনা সেগুলো, প্রত্যেকটির পেছনে এসব খেটে খাওয়া মানুষ ছিল। ছেচল্লিশে তারা ভোট দিয়েছে, যার ফলে পাকিস্তান হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তান এই মানুষদের কিছুই দেয়নি, যন্ত্রণা ছাড়া। চুয়ান্নতে তারা আবার ভোট দিয়েছে, এবার ওই পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে। পরিণামে যা তারা লাভ করেছে তা মুক্তি নয়, বরঞ্চ আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। সেই শাসন বাংলাদেশে টাউট, ঠিকাদার এবং নানা ধরনের নিপীড়নকারীকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছে। সত্তরে তারা আবার ভোট দিল, এবার ভোট স্বাধীনতার পক্ষে। এবার কেবল সামরিক শাসন নয়, সামরিক আক্রমণই নেমে এলো। পাকিস্তানি হানাদারেরা মানুষের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যাগুলোর একটি ঘটালো এই বাংলাদেশে।
‘মুক্তির গান’ নাম দিয়ে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ মুক্তিযুদ্ধের ওপর যে একটি প্রামাণ্যচিত্র তুলেছে তাতে গ্রামবাংলার নির্যাতিত মহিলারা একটি খুবই সাধারণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছে, ‘আমরা কী দোষ করেছিলাম?’ তাদের এবং প্রায় সব বাঙালিই ‘দোষ’ তখন ছিল ওই একটাই, তারা স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। যারা অবস্থাপন্ন তারা নানাভাবে আত্মরক্ষা করেছে। কেউ কেউ আপস করেছে, কেউ বা দালালি করেছে, যারা পেরেছে তারা ওপারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। যে সাধারণ মানুষ এসব করতে পারেনি, পড়ে থেকেছে মাটি আঁকড়ে ধরে, তারা শিকার হয়েছে গণনির্যাতনের। মেয়েদের ওপর অত্যাচারটা হয়েছে দ্বিগুণ। যারা নেতা ছিলেন, ভোট নিয়েছিলেন, তারা দেশ ছেড়েছেন সবার আগে। কলকাতায় গিয়ে ভাতা পেয়েছেন, কেউ কেউ স্বাধীনতা যাতে না আসে তেমন তৎপরতাতেও লিপ্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পর তারা ফিরে এসেছেন, ক্ষমতা পেয়েছেন, ধনী হয়েছেন।
আক্রান্ত হয়ে যে সাধারণ মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল, তারা শহীদ হয়েছে হাজারে হাজার। পঙ্গু হয়েছে অসংখ্য এবং ফিরে এসে দেখেছে ঘরবাড়ি কিছুই নেই। স্বাধীনতার ফল গরিব মানুষ সাতচল্লিশে পায়নি, একাত্তরেও পেল না। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ তাদের শত্র“ ছিল, বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে মিত্র হয়েছে এমন নয়। ‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্য চিত্রে ঢাকা শহরের একজন পঙ্গু রিকশাচালকের সাক্ষাৎকার ধারণ করা হয়েছে। একাত্তরে তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তাতে একটি পা হারান। ঢাকা শহরে এখন তাকে এক পা নিয়ে রিকশা চালাতে হয়। তিনি বললেন, ‘একা মানুষ খাটনিদার, ফ্যামেলি মেম্বার পাঁচজন, না চালায়ে উপায় নেই।’
রিকশাচালক সাইদুর রহমান পা হারিয়েছেন বলে দুঃখ করেন না। স্বাধীনতার জন্য আরও কঠিন দুঃখও তিনি সহ্য করতেও তিনি প্রস্তুত ছিলেন। বলেছেন তিনি তার আড়ম্বরহীন সরল ভাষায়। কিন্তু তার আরও একটা বক্তব্য আছে, ‘যে মা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে আমারে পাঠাইল সে স্বাধীনতা দেখতে পেল না। বাড়ি যেয়ে আমার মাকেও আমি দেখতে পেলাম না। আরেকটা ব্যাপার ভাই, সবাই স্বাধীন পাইল কিন্তু আমি পঙ্গু হইয়া পরাধীন হইয়া গেলাম।’ একজন সাইদুর রহমান নয়, হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের জীবনে ঘটেছে ওই ঘটনা। যুদ্ধে গেছে, ফিরে এসে দেখে গৃহ নেই, আপনজনরা মারা গেছে কেউ, কেউ গেছে হারিয়ে। আর ওই যে, ‘পঙ্গু হইয়া পরাধীন হইয়া গেলাম’ এটাও তো সত্য আজ অধিকাংশ দেশবাসী সম্পর্কে।
তিন.
সাতচল্লিশে যাদের সুবিধা হয়েছিল, বাহাত্তরে তাদের আবার সুবিধা হলো। কে কোন পক্ষে ছিল সে প্রশ্ন সাতচল্লিশে ওঠেনি। বাহাত্তরের পরে ওঠলেও টেকেনি। পক্ষ শেষে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেছে ওই দুটিই। বিত্তবান ও বিত্তহীন। সাতচল্লিশ যাদেরকে সাহায্য করেছে বিত্তবান হতে, বাহাত্তরের পর দেখা গেছে তারাই আবার বিত্তবান হচ্ছে। সাধারণ মানুষ সাতচল্লিশে ভোট দিয়েছে মুক্তির আশায়, মুক্তি পায়নি। একাত্তরে যুদ্ধ করেছে মুক্তির ওই আশাতেই, মুক্তি পায়নি।
মুক্তি না পাওয়ার কারণটা ভুললে চলবে না। কারণ হচ্ছে এই স্থূল সত্য যে, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন আসেনি। এটা সেই পুরাতন ব্যবস্থা, যাতে অল্প লোক ধনী হবে অধিকাংশ লোককে গরিব করে। আমাদের আদি সংবিধানে রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির মধ্যে একটি ছিল সমাজতন্ত্র। সেটি এমনি এমনি আসেনি। কেউ করুণা করে বসিয়ে দেয়নি। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল চূড়ান্ত লক্ষ্য। ওই পথে মানুষ মুক্ত হবে, উঠে দাঁড়াবে, এটাই ছিল স্বপ্ন। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে এখন সমাজতন্ত্র নেই। এটিও কোনো দুর্ঘটনা নয়। সমাজ বিকাশের যে পুঁজিবাদী ধারা প্রবহমান রয়েছে তারই আঘাতে সমাজতন্ত্রে অপসারণ ঘটেছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের সঙ্গে এই অপসারণের কোনো সম্পর্ক নেই। বাইরে ঘটার আগেই আমাদের দেশে ঘটনাটা ঘটেছে এবং বাইরে না ঘটলেও এখানে ঘটত। আমাদের শাসকরা কেউই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। যারা মুখে বলেছেন তারাও অন্তরে বিশ্বাস করেননি, পরে যারা এসেছেন তারা সমাজতন্ত্রের কথা মুখেও বলেননি। শাসক বদলেছে, কিন্তু হিসাব করলে দেখা যাবে যে, তারা যে দায়িত্ব মূলত পালন করেছেন সেটা হল পুঁজিবাদী বিকাশের পথটাকে প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর করা।
সমাজতন্ত্রে সমালোচকের অভাব কোনো দিনই ছিল না। এখনও নেই। বলা হয়েছে সমাজতন্ত্র গণতন্ত্র দেয় না, কেড়ে নেয়। যেসব দেশ সমাজতন্ত্রকে ত্যাগ করে পুঁজিবাদকে গ্রহণ করেছে সেখানে এখন গণতন্ত্র কোথায় দেখা যাচ্ছে তার সন্ধান এমনকি কট্টর পুঁজিবাদীরাও দিতে পারছে না। খোদ রাশিয়াতে যখন ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি, মাফিয়া শাসন প্রধান সত্য হয়েছে দাঁড়িয়েছে তখন সমাজতন্ত্রের সমালোচকরা এ কথাটা আর বলতে পারছে না যে, সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরাও ওই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনেই আছি, এখানে যে গণতন্ত্র আছে এই কথা কেউ বলছেন না। বলবেনও না। রাষ্ট্রীয় মূলনীতির বিবরণে ধর্মনিরপেক্ষতাও ছিল। সেটাও আজ নেই। এই অপসারণের সঙ্গেও যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা জড়িত সেটা না দেখলে সত্যদর্শন হবে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আজ বাংলাদেশ বলে নয়, সারা বিশ্বেই আধিপত্য করছে। আর সেই আধিপত্যের দরুন গরিব মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। আশ্রয়হীন হয়ে আদর্শিকভাবে সে যে পুঁজিবাদের কাছে যাবে সেটা তো সম্ভব নয়, পুঁজিবাদই তো তার ওই দশা করেছে; সমাজতন্ত্রের কাছে যেতে পারত, কিন্তু সেই পথ বন্ধ, যাচ্ছে তাই সামন্তবাদ তথা মৌলবাদের কাছে। পুঁজিবাদীরাও এই কাজে সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করছে। কেননা, তারা জানে তাদের আসল শত্র“ সমান্তবাদ নয়; আসল শত্র“ সমাজতন্ত্র, সামন্তবাদের অভিমুখে মানুষ যদি দলে দলে ধাবমান হয় তবে সেটা বরঞ্চ লাভজনক; বিদ্রোহ করবে না, রুখে দাঁড়াবে না, অবনত অবস্থায় অন্ধকারে ঠেলাধাক্কা ও মারামারি করবে।
বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার এই শৃঙ্খল ছিন্ন করতেই হবে, নইলে মানুষ উঠে দাঁড়াতে পারবে না। যেমন পারছে না। কেবলি নত হচ্ছে। পঙ্গু হচ্ছে। শৃঙ্খলটা যে কেবল বৈষয়িক তা নয়, আদর্শিকও বটে। ছিন্ন করা চাই দুই বন্ধনই। কিন্তু পথ দেখাবে কে? দেখানোর কথা বুদ্ধিজীবীদের। সেটা তারা করছেন বলে দাবি করতে পারবেন না। তারা এখন মোটামুটি দুই দলে বিভক্ত, দুই দল আবার একদলও, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমর্থক। বুদ্ধিজীবীরা যদি নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ না দেখে সমষ্টিগত স্বার্থ দেখেন তাহলে তারা অনুপ্রাণিত হবেন জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং সেই ঐক্যই বলে দেবে তাদের কী করণীয়। বুদ্ধিজীবীরা যতই অগ্রসর হোন তারা সফল হবেন না জনগণ সঙ্গে না পেলে, জনগণও এগুতে পারবে না বুদ্ধিজীবীদের সাহায্য না পেলে।
বাংলাদেশের উঠে দাঁড়ানোটা গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে জনগণের ঐক্যের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। বলাবাহুল্য, প্রকৃত গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই; নামেই যা আলাদা নইলে ভেতরে তারা একই।