রবীন্দ্রনাথের নায়িকা

‘জাপানীযাত্রী’তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বলেছেন, ‘পরাধীনতা সবচেয়ে বড় বন্ধন নয়, কাজের সংকীর্ণতাই হচ্ছে সবচেয়ে কঠোর খাঁচা।’ কোনটা বড় কোনটা ছোট এ নিয়ে তর্ক করাটা অসম্ভব নয়; কিন্তু যাকে তিনি কাজের সংকীর্ণতা বলছেন, সেটার সঙ্গে পরাধীনতার যে যোগ আছে সে আমরা বিলক্ষণ জানি, রবীন্দ্রনাথ নিজেও জানেন, তাঁর সাহিত্যে বহু ক্ষেত্রে প্রমাণ আছে সেই সচেতনতার। বারবার দেখা যাবে পরাধীনতা কেমন করে আটক করছে মানুষকে, সংকীর্ণ করে দিচ্ছে তার কর্মক্ষেত্রটিকে, দিচ্ছে তাকে সামান্য করে।

এই সচেতনতা না থাকলে তাঁর কথাসাহিত্য অত মূল্যবান হতো না, যেমন মূল্যবান হয়েছে। তাতে কল্পনা থাকত; কিন্তু ঘাটতি পড়ত বাস্তবতার। রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস কবির লেখা সন্দেহ কী, কিন্তু তাতে বাস্তবতার ঘাটতি যে নেই তা মানতেই হবে।

ওই পরাধীনতাটা নানা রূপের ও মাত্রার। একটা সাধারণ সত্য এই যে রবীন্দ্রনাথ যে সমাজকে নিয়ে লিখেছেন, সেখানে পুরুষের আধিপত্য ছিল অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত। ওদিকে পুরুষ নিজেও যে স্বাধীন ছিল তা তো নয়, পুরুষ ছিল উপনিবেশের বাসিন্দা, ঔপনিবেশিক শাসন উৎসাহিত করেছে সামন্তবাদকে; আর ওই যে তার বন্ধন, সেটা বড় নির্মমভাবে সংকুচিত করে দিয়েছে পুরুষের কর্মক্ষেত্রটিকে। এই পুরুষের অধীনে যে নারী সে আসলে বন্দির হাতে বন্দি, তার জন্য কর্মের বৃহৎ ক্ষেত্রে না সম্ভব ছিল আত্মপ্রকাশ না অংশগ্রহণ। আমাদের পেছনের ইতিহাসটা যেমন পরাধীনতার, তেমনি কর্মসংকোচনেরও বটে। তারপর একাধিকবার তো স্বাধীন হলাম আমরা; কিন্তু প্রসারিত হয়েছে কি কর্মের স্বাধীনতা, নাকি বৃদ্ধি পেয়েছে বেকারের সংখ্যা এবং কর্মজীবী নারীর জন্য লাঞ্ছনা? হিসাবটা বড় নির্ভুল, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য যেদিকে ইশারা তুলে ধরে, সমাজতত্ত্বও সেই সত্যকেই হাজির করে পরিসংখ্যান ও প্রমাণের সমর্থন নিয়ে। স্বাধীনতা কেবলি পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

দুই

নারীর দ্বৈত চরিত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তিটি সবারই জানা। মেয়েদের তিনি দুই জাতের বলে মনে করেন; এক জাত প্রধানত মাতা, অন্য জাত প্রধানত প্রিয়া! ‘দুই বোন’ (১৯৩৩) উপন্যাসের শুরুতেই লেখক বলছেন ওই দুই জাতের বিশিষ্টতা সম্পর্কে। তাঁর মতে, মা যেন বর্ষা ঋতু, ‘জলদান করেন, নিবারণ করেন তাপ, ঊর্ধ্বলোক থেকে আপনাকে দেন বিগলিত করে, দূর করেন শুষ্কতা, ভরিয়ে দেন অভাব।’ অন্যদিকে প্রিয়া যেন বসন্ত ঋতু, ‘গভীর তার রহস্য, মধুর তার মায়াতন্ত্র, তার চাঞ্চল্য রক্তে তোলে তরঙ্গ, পৌঁছায় চিত্তের সেই মণিকোঠায়, যেখানে সোনার বীণায় একটি নিভৃত তার রয়েছে নীরবের ঝঙ্কারের অপেক্ষায়, যে ঝঙ্কারে বেজে ওঠে সর্বদেহমনে অনির্বচনীয় বাণী।’

এই একই বক্তব্য ভিন্নভাবে আছে ‘বলাকা’ কাব্যে, যেখানে কবি বলছেন- কোন ক্ষণে/সৃজনের সমুদ্রমন্থনে/উঠেছিল দুই নারী/অতলের শয্যাতল ছাড়ি।/একজনা উর্বশী, সুন্দরী,/বিশ্বের কামনা-রাজ্যে রাণী/স্বর্গের অপ্সরী।/অন্যজন লক্ষ্মী সে কল্যাণী/বিশ্বের জননী, তারে জানি,/স্বর্গের ঈশ্বরী।

‘দুই বোনে’র পৃথিবীতে যারা শর্মিলা ও ঊর্মিমালা, ‘বলাকা’র স্বর্গে তারাই ঈশ্বরী ও অপ্সরী।

কিন্তু আরো প্রাথমিক স্তরে একটি পার্থক্য স্বীকার করেন রবীন্দ্রনাথ। সেটি পুরুষ ও নারীর। তারা এক নয়, স্বতন্ত্র। পুরুষ হচ্ছে বাইরের, স্ত্রী ঘরের। পুরুষ বহির্মুখী, মেয়েরা কেন্দ্রানুগ।

রবীন্দ্রনাথের এই দুই মতের কোনটিতে অবশ্য অভিনবত্ব নেই। না থাকুক, কিন্তু তাঁর উপস্থাপনায় একেবারে নতুন হয়ে উঠেছে বক্তব্য। এবং প্রাণবন্ত। বক্তব্যের দিকে থেকে বলতে হয় যে বাইবেলেও আছে মেরি ও মার্থার কথা; দুই বোন তারা, তবে খুবই স্বতন্ত্র তাদের চরিত্র। বিপরীতধর্মী। আর নারী যে পুরুষ নয়, পুরুষ যে নারী নয়, এ তত্ত্ব কে অস্বীকার করেছে কবে, উপায়ই বা কোথায় অস্বীকার করার। যাঁরা সব মানুষের সমতায় বিশ্বাস করেন, তাঁরাও অন্য সাম্যের কথা তত বলেন না, যত বলেন অধিকার ও সুযোগের সাম্যের কথা, ভাবেন সেই ব্যবস্থা প্রয়োজন যেখানে, সব মানুষই সমান হবে অধিকার ও সুযোগের ওই দ্বৈত বিবেচনায়। পুরুষ নারী হবে না, যেমন নারী পরিণত হবে না পুরুষে।

অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে রবীন্দ্রনাথের জগতে প্রকাশ্য আধিপত্য যেটা, সেটা সব সময়ই পুরুষের। যদি তা না হতো, তবে তাঁর রচনা বাস্তবিক নয়, অবাস্তবিক হতো; তাতে ইতিহাস থাকত না, থাকত না ঐতিহাসিক সমাজ এবং ব্যাপারটা গড়াত ইচ্ছাপূরণের।

না, পুরুষই কর্তা। কিন্তু যেখানে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিশিষ্ট, সে হচ্ছে নারীকে জিতিয়ে দেওয়ায়। পুরুষই কর্তৃত্ব করে, বন্দি করে রাখে, সংকুচিত করে দেয় নারীর আবার কর্মক্ষেত্র; কিন্তু পুরুষ আবার হেরে যায়। খুব সাদামাটাভাবে ঘটে না ঘটনাটা, যেমনটা ঘটেছে, ধরা যাক, ‘দর্পহরণ’ গল্পটিতে। এই গল্পে স্বামীর খুবই আত্মবিশ্বাস ছিল যে স্ত্রী নির্ঝরিণী আর কি গল্প লিখবে, যা লিখার সে তো লিখবে তার স্বামীই। কিন্তু প্রতিযোগিতায় দেখা গেল, মাসিক পত্রিকায় স্বামীর ‘বিক্রম নারায়ণ’ ছাপা হয়নি, ছাপা হয়েছে নির্ঝরিণী দেবীর ‘ননদিনী’।

‘সাধারণ মেয়ে’র মালতী সানুনয় অনুরোধ করেছিল শরৎচন্দ্রকে। শরৎচন্দ্র তো আর বিধাতার মতো কৃপণ নন, তিনি জিতিয়ে দিন না কেন সাধারণ মেয়ে মালতীকে, সাত বছর ধরে বিলাত-প্রবাসী গর্বিত নরেশ সেনকে তার বিলেতি মেয়েদের সামনে পরাভূত করে দিক মালতী, অন্য কোনো ক্ষেত্রে নয়, অমেয়েলী অঙ্কশাস্ত্রে। মালতীর ঈপ্সিতভাবে যদিও নয়, তবে রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের ঠিকই বিজয়ী করেছেন, ভিন্নভাবে। প্রিয়া হোক কি মাতাই হোক, অর্ধেক মানবী হোক কি অর্ধেক হোক কল্পনা, মেয়েরাই দেখি জিতে যাচ্ছে, উন্মোচিত হয়ে পড়ছে পুরুষের সামান্যতা। জয়টা কোথাও অন্তপুরচারিণী ধারাপ্রবাহ, কোথাও তা নীরব ধিক্কার-ধ্বনি।

তিন

‘স্ত্রীর পত্রে’র (১৯১৪) মৃণালের হবার কথা ছিল বড়জোর ওই মালতীর মতোই। পূর্ববঙ্গের গরিব ঘরের মেয়ে, পড়ালেখা কিছু আছে, দরখাস্ত লিখতে পারত শরৎচন্দ্রের কাছে। তা তো লিখছে না। লিখছে বরঞ্চ চিঠি, স্বামীর অভিমুখে। ‘শ্রীচরণকমলেষু’ দিয়ে শুরু বটে, কিন্তু ঘোষণা বড় স্পষ্ট; ‘এ তোমাদের মেজো বউয়ের চিঠি নয়।’

মৃণালের স্বামী সাতাশ নম্বর মাখন বড়ালের গলিতে স্থায়ী অধিবাসী। মৃণাল সেখানে ফেরত যাবে না। মৃণালের স্বামী কলোনির বাবু, আপিসের কর্মচারী, শামুকের সঙ্গে খোলসের সম্পর্ক তেমনি তার সম্পর্ক আপিসের সঙ্গে, একেবারে দেহমনের সঙ্গে সেঁটে যাওয়া। সেই বন্দিরা সদলবলে বন্দি করেছিল মৃণালকে তাদের একান্নবর্তী পরিবারের দেয়ালঘেরা চৌহদ্দিতে। ওই বাড়ির বড় বউয়ের রূপের অভাব মেজো বউকে দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা হয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল, মৃণাল তেমনি থাকবে যেমন অন্য বউরা থাকে। কিন্তু সে তা রইল না, মেজো বউয়ের খোলসের ভেতর থেকে মৃণাল নামের মেয়েটি বের হয়ে এলো, অভাগা অনাথিনী বিন্দুর আত্মহত্যার ঘটনা যাকে বলে দিল কী করতে হবে। তা-ই করছে, সে চলে গেছে তীর্থে, শ্রীধামে। সেখান থেকে লিখছে চিঠি- বিজয়ের।

কোনো দিক দিয়েই রবীন্দ্রনাথের এই মৃণাল ইবসেনের নোরা নয়। নোরা আরো আগের ঘটনা (১৮৭৯); ঊনবিংশ শতাব্দীর। কিন্তু আগের হলেও নোরা হচ্ছে স্বাধীন দেশের মেয়ে, মৃণালের জন্ম ও বিকাশ পরাধীন বাংলায়। নোরার গৃহত্যাগ যে রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করেননি, এমন প্রমাণ তাঁর লেখায় আছে; কিন্তু তাঁর মৃণালও তো নোরার কাজটাই করছে, ত্যাগ করেছে গৃহ। দুজনই স্বাধীনতা খোঁজে, কিন্তু দুজনের পথ এক নয়; গৃহত্যাগের কারণ যে অভিন্ন তাও নয়। নোরা তীর্থে যায়নি, শহরেই থাকবে বলে আমাদের অনুমান, জীবিকার ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে, অর্থকরী কাজ করার শক্তি যে আছে আমরা তা জানি। মৃণালকে কিন্তু যেতে হয় তীর্থে, তাকে আশ্রয় নিতে হবে, অনুমান করি, কোনো ধর্মমন্দিরে। সে যে পরাধীন দেশের মেয়ে, তার পক্ষে তো সম্ভব নয় খাঁটি বুর্জোয়া হওয়া। নোরা গৃহত্যাগ করেছে পুঁজিবাদের এবং পুঁজিবাদের অধীনে স্বামীর, নোংরা চেহারাটা দেখে; মৃণালের বিদ্রোহ বিন্দুর ওপর সামন্তবাদী নিপীড়ন দেখে এবং তার ভরসাটাও আবার ওই সামন্তবাদের কাছেই, তীর্থস্থানে। বেচারা যাবে কোথায়, যাওয়ার জায়গা কোথায়? যার থেকে আঘাত পায় ঘুরেফিরে তার কাছেই আশ্রয় চায়। এটাও সত্য যে মৃণাল ঘর ছাড়তে পেরেছে তার সন্তান নেই বলেই, থাকলে পারত না।

কিন্তু তবু মৃণাল বিজয়ী। পতাকা ওড়ায়নি বটে, তবে ঠিকই বিদ্রোহ করেছে। ধিক্কার দিচ্ছে স্বামীর সংসারকে, ধরিয়ে দিচ্ছে কেবল যে তার সামান্যতাকে তা নয়, তার নিষ্পেষণকারী চরিত্রকেও। মৃণালের স্বামী সামান্য মানুষ মৃণালের তুলনায়, তা যত বড়ই কর্তা হোক সে অফিসে কিংবা সংসারে।

গোরা (১৯১০) অবশ্য আলাদা মাপের পুরুষ। সে তো সাহেবের আপিসের বেতনভুক কর্মচারী নয়। পরাধীনই নয় সে। অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, ভয়ংকরভাবে জাতীয়তাবাদী। ইংরেজ ও ইংরেজদের কর্মচারী উভয়ের সঙ্গে তার বিরোধ বাধে এবং সে জেলও খাটে। গোরার মতো প্রবল পুরুষ রবীন্দ্রসাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। ওদিকে আবার পরাধীন পুরুষ মানুষের নিদর্শন খুঁজতে হলে তাও গোরাদের বাড়িতেই পাওয়া যাবে। গোরার ‘বাবা’ কৃষ্ণদয়াল একদা ছিল ইংরেজদের সেবক, এখন অবসর নিয়ে ভক্ত সেজেছে ধর্মের, সেবার পাত্রটি বদলেছে সেবাটি বদলায়নি। গোরার ‘ভ্রাতা’ মহিম একজন হীনপ্রাণ অফিসনির্ভর বাঙালি বাবু। এদের উভয়ের তুলনায় অনেক উঁচুস্তরের মানুষ ওই গোরা; ছাদে গিয়ে তার মাথা ঠেকে, ছাদ ভেঙে বের হয়ে পড়বে মনে হয়। সেই গোরা নিতান্তই শিশু একটি, মাতা আনন্দময়ীর কাছে। আনন্দময়ী তার মা নয়, প্রতিপালক মাত্র; কিন্তু আনন্দময়ীর কাছে গোরা অবুঝ অস্থির পলায়নপর সন্তান ছাড়া আর কিছুই নয়।

গোরাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি নিষ্ঠুর পরিহাসের অবতারণা করেছেন, এমন বলা যাবে। একেবারে শেষে এসে ধরিয়ে দিয়েছেন যে হিন্দু-অহমিকায় উদ্দীপ্ত জাতীয়তাবাদী গোরা হিন্দু তো নয়ই, এমনকি ভারতবর্ষীয়ও নয়। না হোক, কিন্তু সে যে কলোনিতে বসবাসকারী যুবক, তাতে সন্দেহ কী। তার সামন্তবাদমুখিতা, জাতীয়তাবাদের নামে ধর্মে প্রত্যাবর্তনে তার তীব্র আগ্রহ সবই বলে দিচ্ছে নীরবে যে সে নিজে একজন বন্দি, যে জন্য অত তার ছটফট করা, জাতীয় গৌরব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। কিন্তু আত্মপরিচয়ের রূঢ় বাস্তবতাটা যখন বের হয়ে পড়ে ভূমিকম্প ঘটিয়ে, ব্রাত্য গোরা তখন যাবে কোথায়, কার কাছে? যায়, যেতে হয় ওই মায়ের কাছেই। যেতে হয় সুচরিতার কাছেও, যে প্রেয়সী হলেও উর্বশী নয়, মাতার মতোই আশ্রয়দাত্রী।

আনন্দময়ী যে অনেক বড় সে খবর আমরা আনন্দময়ীর নিজের আচরণেই পাই। পাই বিনয়ের স্বীকারোক্তিতেও। বিনয় বলছে তাঁকে, ‘মা তোমাকে যতই দেখছি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। তোমার মন এমন সাফ হলো কি করে। তোমাকে কি পায়ে চলতে হয় না- ঈশ্বর তোমাকে কি পাখা দিয়েছেন। তোমার কোনো জায়গায় কি ঠেকে না।’ এবং পরে নিজের কথা বলছে সে, ‘কিন্তু মা, আমি মুখে যাই বলি মনটাতে ঠেকে যে। এত যে বুঝিসুঝি, পড়িশুনি, তর্ক করি, হঠাৎ দেখতে পাই মনটা নিতান্তই মূর্খ রয়ে গেছে।’

মূর্খ থাকার কথা ছিল বরং আনন্দময়ীরই। কৃষ্ণদয়ালের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী তিনি, নিঃসন্তান, উচ্চশিক্ষা পাননি। কিন্তু তিনি ছাড়িয়ে যান সাহেবদের সঙ্গে মেলামেশা করে ধনী হওয়া স্বামী কৃষ্ণদলায়কে, সাহেব বাব-মার সন্তান গোরাকে, উচ্চশিক্ষিত বিনয়কে। আন্দময়ীর মধ্যে পবলতা নেই, নেই তা সুচরিতার ভেতরও; কিন্তু জয়ী হয় তারা উভয়েই।

‘যোগাযোগের’ (১৯২৯) রাজা মধুসূদনের সংস্কৃতি, সভ্যতা বলে কোনো কিছু নেই। উপনিবেশের সফল ব্যবসায়ী সে; স্থূল, কর্কশ, মাংসলোলুপ। একেবারেই মিল নেই গোরার সঙ্গে। জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, এসব ব্যাপারে বক্তৃতা করবে, এমনটা আশা করার কোনো হেতু নেই তার কাছ থেকে। কিন্তু তার পবলতাকে যে অস্বীকার করব, তারও তো জো নেই। কুমুকে ছিনিয়ে এনেছে ক্ষুদ্রাকৃতির এই বনমানুষটি, এনে বন্দি করে রেখেছে রাজপ্রাসাদের অপ্রশস্ত গণ্ডিতে। তবে কুমুকে যতই পীড়িত করেছে ততই কিন্তু হেরে গেছে সে- ওই কুমুর কাছেই। কুমুর জন্য বন্ধন এই ব্যবসায়ী; কিন্তু কুমুর চেয়ে খাটো সে প্রায় সব দিক দিয়ে। তার জোর একটাই, টাকার। অন্ধকার যেমন আলোকে উজ্জ্বল করে, তেমনি তার আঁধার দীপ্যমান করে তোলে কুমুকে। কিন্তু কুমুকে মুক্তি দিতে পারেনি তার শ্রদ্ধাভাজন ভ্রাতা বিপ্রদাসও। বিপ্রদাসের অক্ষমতাই কুমুর বন্দিত্বের প্রকৃত কারণ। বিপ্রদাস তা-ই মধুসূদন যা নয়, কিন্তু তারা উভয়েই পরাভূত কুমুর কাছে। কুমু মৃণাল নয়, বিদ্রোহ করে না, সে মালতী নয়, দরখাস্ত লেখে না, নিজের অবস্থানে দাঁড়িয়ে সহ্যক্ষমতার আলো জ্বেলে সে ধরিয়ে দেয় তার স্বামী কেমন সামান্য, ভ্রাতা কেমন অসমর্থ। স্বামী মধুসূদন রজনীগন্ধার ঝাড়টাকে এনেছে ছিন্ন করে, ভাই বিপ্রদাস সেটিকে পারেনি রক্ষা করতে। বিপ্রদাসরা জমিদার বংশ, তারা পুরনো রাজা, এখন পড়তির দলে, সেই জন্য তারা দুর্বল, ব্যবসায়ী বংশ এখন নতুন রাজা, তারা উঠেছে। সে জন্য তারা প্রবল; কিন্তু দুইয়ের কেউই যোগ্য নয় শান্ত কুমুর অভিভাবক হওয়ার। উপনিবেশের জমিদার ও ব্যবসায়ী উভয়ই উপনিবেশের জাতীয়তাবাদীর মতোই হাতে-পায়ে বাঁধা।

দামিনী কুমুর তুলনায় অশান্ত। দামিনী বিধবা, স্বামী ছিল ভক্তির রাজ্যের বিনীত প্রজা, দামিনী তা নয়। সে বিদ্রোহিনী, তার নিজের মতো করে। তার আচরণ মোটেই হিন্দু বিধবার মতো নয়; স্বামীর সহযোগীরা এখন তার অভিভাবক। তাদের সে বলে, আমরা শুনি, ‘তোমাদের ভক্তরা যে এই ভক্তিহীনাকে ভক্তির গারদে পায়ে বেড়ি দিয়া রাখিয়াছে। তোমরা কি আমার আর কোনো রাস্তা রাখিয়াছ।’ দামিনী নিজে জ্বলছে, সে অন্যদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। সচীশকে নয়, সচীশের প্রতি তার বিশেষ দৃষ্টি। সচীশই সবচেয়ে বড় মাপের মানুষ, দামিনীর অভিভাবকদের মধ্যে। সে একটি জ্যোতিষ্ক, তার আছে আভা। শেষ পর্যন্ত দামিনীর বিয়ে হলো সচীশ নয়, রায়চাঁদ-প্রেমচাঁদের মার্কাওয়ালা শ্রীবিলাসের সঙ্গে। কিন্তু শ্রীবিলাস তো তার যোগ্য নয়, শ্রীবিলাসকে তো সে চায়নি। দামিনী শোধ নিল সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে। ‘সাধারণ মেয়ে’র মালতী বলেছিল, হায় রে, সাধারণ মেয়ে, বিধাতার শক্তির অপচয়, সেই অপচয়ই শেষ পর্যন্ত ঘটল দামিনীর ক্ষেত্রে, যদিও সে সামান্য নয়।

‘চতুরঙ্গে’ (১৯১৪) এই যে জগৎটি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ, সেটি একটি বন্দিশালার। সেখানে ভক্তরা নেচে নেচে কীর্তন গায়, এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় ছোটাছুটি করে; কিন্তু পুরোই বন্দিদের ছটফটানো, তার বাইরে নয়। জ্যাঠামশাই জগমোহন কেবল নাস্তিক নন, দৃঢ়তায় ও কর্মব্যস্ততায় তিনি অসাধারণ। কিন্তু ওই যে একেবারেই সামান্য মেয়ে ননীবালা, তাকে তো তিনি বাঁচাতে পারলেন না। আয়োজনের ত্রুটি করেননি, আশ্রয় দিয়েছেন নিজের ঘরে, বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন সচীশের সঙ্গে; কিন্তু সে মেয়ে তো পালিয়ে গেল- আত্মহত্যা করে।

চার

অমিস্ট্রায়কে চেনা যায় তার বাক্যবিন্যাসে। সব সময়ই সে বিদ্যুতের মতো দীপ্ত এবং সর্বদাই প্রস্তুত। ভাবতে অবাক লাগে যে ‘দেশের কবিতা’ ও ‘যোগাযোগ’ একই বছরে লেখা (১৯২৯); কেননা তারা তো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, একে অপর থেকে। অমিত মধুসূদন নয়, যেমন লাবণ্য নয় কুমু। অমিত ব্যবসায়ী নয়, ব্যারিস্টার। তার আছে কল্পনা, আছে তার বিদেশি সাহিত্যে অগাধ উৎসাহ ও পাঠ। সে জানে কবিতা লিখতে, চালায় যে মোটরগাড়ি, অনায়াসে জয় করে নেয় যেকোনো মানুষের হৃদয়। কলকাতার ছেলে, কিন্তু অধিকতর স্বাভাবিক সে অঙ্ফোর্ডে ও শিলঙে।

অমিত সাহেবের সন্তান গোরা থেকেও স্বতন্ত্র। একেবারেই সে জাতীয়তাবাদী নয়, বরং আন্তর্জাতিক। কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও, না মেনে উপায় কি যে সেও কলোনিরই বাসিন্দা। তার স্ফূর্তি বাক্যে, তার জগৎ কর্মের দিক থেকে সংকীর্ণ। গায়ে গন্ধ নেই সংস্কারের ও ধর্মবাদিতার; কিন্তু সুগন্ধি রয়েছে ইংরেজিপ্রীতির। কাজ নেই, প্রেম করে বেড়ায়। দায় নেই অর্থোপার্জনের, চলে পূর্বপুরুষের অনার্জিত আয়ে। কেটি-লিজিদের সমাজেরই মানুষ সে। অমিত পরিণত বয়সের বালক একজন।

তার কাছে হেরে যাবে লাবণ্য। যেতেই হবে। কী আছে ওই মেয়ের? আশ্রয়টুকু পর্যন্ত নেই। শিলঙে এসেছে বেড়াতে নয়, চাকরি নিয়ে, থাকে অন্যের বাড়িতে, তাকে গভর্নেস বললে রূঢ় শোনাবে; কিন্তু মিথ্যা বলা হবে না। তার নেই উত্তরাধিকারের বৈষয়িক আনুকূল্য, বাবার সম্পত্তি নেয়নি সে। লাবণ্য কী করে পাবে অবাধ চলাফেরার সুযোগ ও অধিকার? ওই অমিত, ব্যারিস্টার ও অভিজাত অমিস্ট্রায়, লাবণ্যকে বিয়ে করবে কেন? এ বিয়ে অসম হতো। বিয়েটা তাই হয়নি।

লাবণ্য কিন্তু অমিতকে দেখিয়ে দিয়েছে অমিতের সীমা। যেন দর্পণ একটি, এই দেখো অমিত, তুমি যতই যা বলো, প্রেমের কথা, সংস্কৃতির কথা, তুমি আসলে তোমার শ্রেণি ও সমাজেরই একজন। তুমি বিয়ে করবে কেটিকেই, অঙ্ফোর্ড থাকার সময় যার আঙুলে তুমি আংটি দিয়েছিলে পরিয়ে। লাবণ্য অবশ্যই প্রেয়সী, কিন্তু মোটেই লেলিহান নয়, সে শান্ত, তার আছে মায়ের গুণ। অমিত যতই যা ভাবুক, অমিত উপযুক্ত নয় লাবণ্যের জন্য।

লাবণ্যের কাছে হেরে যায় লাবণ্যের পিতাও। পিতা অবনীশ দত্ত একজন মহৎ পুরুষ। বড়মাপের গবেষক তিনি, ছিলেন পশ্চিমী কলেজের অধ্যক্ষ। মাতৃহীনা লাবণ্যের প্রতি তাঁর মমতার কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু অতর্কিতে তিনি বিয়ে করে ফেললেন, লাবণ্যকে অবিবাহিত রেখেই। লাবণ্য বুঝেছে পিতার আগ্রহ, সে নিজেই ব্যবস্থা করে দিয়েছে পিতৃপরিণয়ের সব কিছুর। এবং সম্পত্তির ভাগ নেয়নি।

সহপাঠী শোভনলালের যদি সাহস থাকত ডাক দেওয়ার, তাহলে অবশ্যই সাড়া দিত লাবণ্যলতা। কিন্তু শোভনলাল সে সাহস কোথায় পাবে? তার বাবা থাকে গ্রামে, তার শিক্ষালাভ ঘটেছে ছাত্রবৃত্তির টাকায়। গবেষক হিসেবে বড় হতে পারে; কিন্তু পরনিবর্ভরশীলতাটা ঘোচে না। ফরাসি দেশের পণ্ডিতদের সঙ্গে যে যোগাযোগ করবে, তার জন্য সাহায্য চাইতে হয় তাকে অমিতের কাছে। লাবণ্যের জন্য উপযুক্ত তাকে বলি কী করে?

শোভনলালকে তো অবশ্যই, লাবণ্য যে হারিয়ে দেয় অমিতকেও সেটাই লক্ষ করার বিষয়।

পাঁচ

মধুসূদনের মতো বণিক রাজার নয়, খাঁটি রাজার রাজবাড়িতে কী ঘটেছে দেখা যাক। ‘ঘরে বাইরে’র (১৯১৬) বিমলার দুই পাশে দুইজন- কেউই তারা সামান্য নয়। স্বামী নিখিলেশের জমিদারি এতটা বড় যে সেটা একটা রাজত্বের মতো। নিখিলেশ চেয়েছে বিমলাকে চরিতার্থতা দেবে। কিন্তু উপনিবেশের জমিদার সে, তার চতুর্দিকের বেষ্টনীটা বেজায় শক্ত। স্ত্রীকে মেম সাহেব শিক্ষয়িত্রী রেখে ইংরেজি শেখাতে পারে; কিন্তু কর্মের স্বাধীনতা যে দেবে তা পারে না। বিমলার অন্য দুই জা বিধবা; সধবা হয়েও বিমলা বিধবার মতোই। ৯ বছরের সংসার, কিন্তু নিঃসন্তান সে, স্বামীর সঙ্গে গড়ে উঠেছে তার একটা দূরত্ব, যা লঙ্ঘন করা না তার পক্ষে সম্ভব, না সম্ভব তার স্বামীর পক্ষে। স্বামীর নিজের যে কর্মজগৎ সেটাও সামান্য; অবৈতনিক স্কুল, দেশি শিল্পোদ্যম, তাঁতের স্কুল, কোনো কাজই বেশি দূর এগোয় না। কেননা রাষ্ট্র আছে কাঁধের ওপর চেপে। নিখিলেশের নিজের জীবনে চরিতার্থতা নেই, সে যে বিভক্ত ঘরে ও বাইরে, কলকাতায় ও গ্রামে, তার পক্ষে অন্যকে চরিতার্থতা দেওয়া কী করে সম্ভব হবে? হয় না।

নিখিলেশের বন্ধু সন্দ্বীপ অনেক দিক দিয়েই তা-ই, নিখিলেশ যা নয়। সে অত্যন্ত প্রবল, যেন এখুনি ঘটাবে একটি অগ্নিকাণ্ড। কিন্তু সন্দ্বীপের উত্তেজনা কিছুটা যাত্রাদলের প্রধান অভিনেতার, কিছুটা ডাকাতদলের লোলুপ সর্দারের। সে পরজীবী; তার যত বীরত্ব দলের ছেলেদের ও রাজরানি বিমলার সামনে। সন্দ্বীপও ওই উপনিবেশেরই সন্তান, যে উপনিবেশকে সে ভাঙতে চায়। উপনিবেশ নিজে অবৈধ, বিরোধীদেরও সে চালনা করে অবৈধতার দিকে। সন্দ্বীপ বৈধ নয়, সে সন্ত্রাসী, অবৈধতার প্রতিমূর্তি। হিন্দুত্বে বিশ্বাসী গোরা এবং প্রেমিক অমিতের মতো সন্দ্বীপও বাক্যে নিপুণ, যে নিপুণতা ঔপনিবেশিক অভিশাপের বার্তাবহ।

নিখিলেশ শান্ত কিন্তু কাপুরুষ নয়, সন্দ্বীপ অশান্ত কিন্তু আসলে সে কাপুরুষ। নিখিলেশের পুঁজি খাজনার টাকা, সেটা থাকে সিন্দুকে, কখনো কখনো চুরি হয়, কিন্তু সাধারণত গিয়ে জমা হয় সদরে। এই পুঁজি যে শিল্পপুঁজিতে রূপান্তরিত হবে, পরাধীন দেশে সেই সম্ভাবনাটা নেই। নিখিলেশকে জমিদারই থাকতে হবে, যেমন সন্দ্বীপকে থাকতে হয় উত্তেজিত জাতীয়তাবাদী, সারা জীবন না হলেও অনেক দিন। বিপ্রদাস যেমন কুমুকে রক্ষা করতে পারেনি মধুসূদনের গ্রাস থেকে, নিখিলেশ তেমনি বিপদে পড়েছে বিমলার নিরাপত্তা নিয়ে। বিপ্রদাস আটক ছিল জমিদারির পড়তি দশার হাতে, নিখিলেশ আটক তার উপনিবেশ-শাসিত উদারনীতির জালে। সে বন্দি, সন্দ্বীপ বন্দি, বন্দি বিমলা। কিন্তু বিমলা শান্ত নয়, তার বিধবা বড়জা যেমন। সংসারমনস্ক ও বাৎসল্যপুষ্টও নয়, মেজোজার মতো। সে কাজ চায়, কিন্তু কাজ পায় না, ভূমিকা দাবি করে, যে ভূমিকা তাকে না দিতে পারে তার দায়িত্বসচেতন স্বামী, না পারে অগ্নিকাণ্ডে বিশ্বাসী সন্দ্বীপ। বিমলারা বড়ই অসহায়।

এ তো গেল রাজবাড়ির খবর। একেবারে গরিবের চেয়েও গরিব যে ঘর দুই ভাই দুখিরাম রুই ও ছিদাম রুই- এর সেখানেও তো ঘটনা একই। ‘শাস্তি’ (১৮৯৩) গল্পের ওই দুই পুরুষ অত্যন্ত কাতর থাকে; তাদের নিজের জমি নেই, উভয়ে মজুর খাটে অন্যের জমিতে; মাসে মাসে বেগার দিতে হয় জমিদারের কাছারিতে। ঘরে তাদের বউরা সারা দিন কলহ করে পাড়া মাতিয়ে রাখে। ঘটনার দিন দুই ভাইকে জবরদস্তি শ্রম দিতে হয়েছে জমিদারবাড়িতে, খাবার জোটেনি, ফিরেছে দুই ভাই সন্ধ্যাবেলার বর্ষার গুমোট গরমে, অভুক্ত অবস্থায়। এসে দেখে ঘরে ভাত নেই। বড় ভাইয়ের স্ত্রী ব্যঙ্গ করে বলেছে; চাল পাব কোথায়, যে রান্না করব। খুন চেপে গেছে দুখিরামের মাথায়, দায়ের কোপে খুন করেছে সে স্ত্রীকে। ছোট ভাই ছিদাম বড় ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে রটিয়ে দিয়েছে যে তার স্ত্রী চন্দরাই খুন করেছে বড়জাকে, রাগের মাথায়। তারপর ইংরেজ রাষ্ট্রে যা হয় তা সব কিছু হলো। থানা-পুলিশ, আদালত, বিচার। ১৭-১৮ বছরের মেয়ে চন্দরা, সে স্তম্ভিত হয়ে গেছে খুনের অভিযোগ শুনে। তার অপরাধ লাঘব হতে পারত, যদি স্বামীর পরামর্শ শুনত, যদি বলত সে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে যে বড় বউ তাকে বঁটি নিয়ে কাটতে এসেছিল বলেই সে আত্মরক্ষার তাৎক্ষণিক তাগিদে বড় বউকে আঘাত করেছে। কিন্তু না, তা সে বলবে না। কিছুই বলবে না- নিজেকে বাঁচানোর জন্য। বোঝাই যায়, তার প্রচণ্ড অভিমান হয়েছে পুরো সংসারের ওপর, বিশেষ করে নিজের স্বামীর ওপর। ফাঁসির আগে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, স্বামীকে দেখতে চায় কি না। চন্দনা বলেছে ‘মরণ’। ধিক্কারের অন্তিম ও চরম ধ্বনি। রাষ্ট্র আছে, তার অধীনে সমাজ, সেখানে জমিদারের প্রতাপ, ভূমিহীনের অমানবিক দারিদ্র্য- সব কিছু মিলে যে মস্ত বোঝা তা অতি নির্মমভাবে পীড়ন করছে নারীকে। চন্দরাকে কে পারে বাঁচাতে? কিন্তু চন্দরার ওই যে ধিক্কার তা বিদ্ধ করে পুরো ব্যবস্থাটাকেই। রাজবাড়িতে যা পর্ণকুটিরেও তা-ই, পুরুষ ব্যর্থ নারীকে চরিতার্থতা দানে। সে ব্যর্থতা কোথাও অত্যন্ত চরম উন্মোচিতরূপে, কোথাও তা আচ্ছাদিত ভদ্রতার আবরণে।

শ্রেণির মাপে ‘নষ্টনীড়ে’ (১৯০১) নীড়টির অবস্থান রাজবাড়ি ও পর্ণকুটিরের মাঝখানে। ভূপতি উপনিবেশের বুদ্ধিজীবী; তার কর্মক্ষেত্র ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদনা। কাজটা সে মনেপ্রাণে করে। কিন্তু কাগজটা দাঁড়ায় না, শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। উপনিবেশে শিল্পোদ্যমের জন্য এই ঘটনা অস্বাভাবিক নয়; দাঁড় করানো খুবই কঠিন।

ভূপতি আপন কাজের উন্মাদনায় গৃহের খবর রাখেনি। তার নিঃসঙ্গ নিঃসন্তান স্ত্রী চারুলতার কেমন করে দিন কাটে সে তথ্য খবরের কাগজের সম্পাদকের জানা ছিল না। চারুর সঙ্গী বলতে এক অমল, দুজনের মধ্যে খুব গভীর বন্ধুত্ব। দুজনে মিলে সাহিত্যচর্চা করে। অল্প দিনে লেখক হিসেবে অমলের নাম হয়ে যায়। চারুর লেখা অমলের মতো নয়, সে তো ধরে নিয়েছে অমলই লেখক, তার নিজের লেখা আবার কী। কিন্তু যে কেউ দেখলে বুঝবে, চারুর লেখায় যে মৌলিকত্ব রয়েছে, অমলের লেখায় তা নেই। অমল লেখে প্রবন্ধ, চারু লেখে গল্প; চারুর গল্প সরাসরি উঠে এসেছে জীবন থেকে, লেখক হিসেবে তার ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা অমলকে।

ইতিমধ্যে ভূপতি মার খেয়েছে বাইরে। তার কাগজ গেছে উঠে। সে বেচারা চারুর কাছে এসে দেখে, গৃহে প্রবেশ যত সহজ, অন্তরে প্রবেশ তত সহজ নয়। পরাজিত ভূপতি জয়ের আয়োজন করে, গোপনে চেষ্টা করে লেখক হওয়ার; কিন্তু বাংলা লেখায় তো তার অভ্যাস নেই, তার দক্ষতা ইংরেজিতে। অবোধ নয় ভূপতি যে বুঝবে না, যে তার লেখা আসলেই কিছু হচ্ছে না। বন্ধুর লেখা বলে যে খাতাটি চারুর কাছে দিয়েছিল মতামতের জন্য, সেটি ফেরত নিয়ে সে পুড়িয়ে ফেলে। এবার সে চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছে মৈশুরে, সেখানে ইংরেজি পত্রিকা সম্পাদনা করবে। পরাজিত নায়ক সে।

ওদিকে অমলও পরাজিত। সে বিয়ে করে টাকার জন্য। শ্বশুরের টাকায় বিলেত চলে যায় পড়তে এবং খোঁজ করে না চারুর। চারু গোপনে কাঁদে অমলের জন্য।

ভূপতি ও অমলের মধ্যে বয়সে ও অবস্থানে ব্যবধানটা সামান্য নয়; কিন্তু চারুর প্রয়োজনের কাছে তারা উভয়েই ব্যর্থ। স্বামী ভূপতি নিজের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে চারুর অধিকার নেই প্রবেশের, বন্ধু অমল নিজের জগৎ যতক্ষণ খুঁজে পায়নি ততক্ষণই সঙ্গী ছিল চারুর, নিজের জন্য স্বতন্ত্র জগৎ পাওয়া মাত্র বের হয়ে গেছে। বলা যাবে, পুরুষদের কারোরই কি দায়িত্ব ছিল চারুলতাকে মুক্ত করার? হ্যাঁ, ছিল। স্বামীর ছিল, স্বামী তো আর কারাপ্রহরী নয়, সে কর্তৃত্ব করে এবং দায়িত্ব নেয় স্ত্রীকে বন্দি নয়, বিকশিত হতে দেবে। আর বন্ধু তো বন্ধুই নয়, যদি না সাহায্য করে বন্ধুকে। ভূপতি ও অমল উভয়েই ইংরেজভক্ত, ভূপতি ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদনা করে এবং অমল যদিও বাংলায় প্রবন্ধ লেখে, তবু সুযোগ পাওয়া মাত্র সে বিলেত চলে যায় ভাগ্য গড়ার অভিপ্রায়ে।

ছয়

মেয়েরা দুই রকমের, এই প্রতিবাদ্য যেখানে উপস্থিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ সেই ‘দুই বোন’-এ একজন প্রতারক রয়েছে। নাম তার নীরদ। তার ভাণটা ছিল চৌকসের, অভিপ্রায়টা ছিল কর্তৃত্বের। বিস্তর শাসন করত সে ঊর্মিমালাকে। সেও বিলেত গেছে, ঊর্মিমালাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে নানা প্রয়োজনের কথা বলে এবং অবশেষে প্রত্যাখ্যান করেছে ঊর্মিমালাকে। তাতে ঊর্মির কোনো ক্ষতি হয়নি, সে বরং বেঁচেই গেছে।

কিন্তু ঊর্মি নিজেই বিপদ বাধিয়েছিল তার আপন বোনের জন্য। বোন শর্মিলার স্বভাবটা সম্পূর্ণ বিপরীত। ঊর্মি হচ্ছে প্রেয়সী, সে বসন্তের মতো চঞ্চল, শর্মিলা হচ্ছে মাতা, বর্ষার মতো শান্ত। দুজনের দৃষ্টি একজনের প্রতি; সেই ব্যক্তি শশাঙ্ক। শশাঙ্ক শিবপুরের পাস করা ইঞ্জিনিয়ার। ভারি দক্ষ কাজকর্মে। কিন্তু শর্মিলার কাছে সে নিতান্ত শিশু। শর্মিলাদের সন্তান নেই, শর্মিলার কাছে স্বামী শশাঙ্কই সন্তান। যত্নের এবং সেবার কোনো অভাব নেই। কিন্তু বিধাতা কার ভাগ্যে কী লিখে রেখেছেন কে জানে। শর্মিলা অসুস্থ হয়ে পড়ল। দেখাশোনা করার জন্য এলো ঊর্মিমালা। তার সাহচর্যে শশাঙ্ক নতুন জীবন পেয়েছে। সব কিছুতেই এখন তার উৎসাহ। ঊর্মি তার অনিবার্য সঙ্গী।

শশাঙ্ক একজন দক্ষ ব্যক্তি। কর্মক্ষেত্রে সে প্রায় অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু হেরে যায়। চাকরিতে তার প্রমোশন হয় না। পদ কেড়ে নেয় তার চেয়ে বয়সে ছোট এক ইংরেজ, বিশেষ যোগ্যতা লেখা আছে যার গায়ের গৌর বর্ণে। চাকরি ছেড়ে দিল শশাঙ্ক, স্ত্রীর পরিচালনায়। আমরা জানি শশাঙ্কের ইঞ্জিনিয়ারিং পাস সম্ভব হয়েছিল ধনী শ্বশুরের আর্থিক সমর্থনে। চাকরি ছেড়ে এবার যখন ব্যবসা শুরু করল, তখনো টাকা দিচ্ছে শর্মিলাই, বাপের রেখে যাওয়া টাকা থেকে। ব্যবসায়ে শশাঙ্কর লাভ হয়েছে প্রথম দিকে, পরে বিস্তর ক্ষতি। সে জন্য গুটিয়ে ফেলতে হলো ব্যবসাটিকে এবং চাকরি নিয়ে চলে যাবে ঠিক করেছে নেপালে।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য ঘোষণা দিল শশাঙ্ক, যাবে না সে নেপালে, থাকবে কলকাতাতেই, ঊর্মিও থাকবে তাদের সঙ্গেই, প্রকাশ্যে। একেবারে বীরের মতো কাজ। শর্মিলাও মেনে নিয়েছে এই ব্যবস্থা, তার স্বভাবে আত্মত্যাগ অধিক, বোনের সতিন হয়ে থাকা যে অসম্ভব নয় এমন নজির তার জানা আছে।

জয় হওয়ার কথা শশাঙ্কের। কিন্তু সেটা হলো না। ঊর্মিমালাই হতে দিল না। কাউকে না জানিয়ে রওনা দিয়েছে সে বিলেতে। বাবার ইচ্ছা পূরণ করবে, ডাক্তার হয়ে ফিরবে, ফিরে এসে হাসপাতাল খুলবে সুচিকিৎসার। নীরদ প্রত্যাখ্যান করেছে ঊর্মিকে- সে তো সামান্য ব্যাপার, শশাঙ্ককে ঊর্মির এই প্রত্যাখ্যান সে তুলনায় অনেক বড়। কেননা শশাঙ্ক ধরেই নিয়েছিল ঊর্মি তার এবং উর্মির নিজের স্বভাবের মধ্যে ছিল চঞ্চল বিদ্যুল্লতা।

‘রবিবার’ (১৯৩৯) ছোটগল্পের অভীক শশাঙ্কের তুলনায় অধিক প্রাণবন্ত। একাধারে শিল্পী ও মেকানিক সে। অভীকের পেছনে মেয়েরা ঘোরে, অভীক ঘোরে বিভার পেছনে। নাস্তিক অভীক ঘর ছেড়েছে, নিজে সে দেবতাকে বিশ্বাস করে না; কিন্তু বিভার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ায় ঘোষণা দেয় বিশ্বাসের। বিভা যে অভীককে পছন্দ করে না তা নয়, আসলে সে তাকে ভালোবাসে। কিন্তু অভীককে সে বিয়ে করতে পারবে না একটি কারণে। অভীক তার যোগ্য নয়। যোগ্যতার এই মাপটা বিভা নিজে তৈরি করেনি, তার বাবা তৈরি করে রেখে গেছেন। তিনি অনেক টাকা এবং একটি শর্ত রেখে দিয়ে চলে গেছেন, শর্তটি রূপকথার মতো নয়, বাস্তবিক অযোগ্য পাত্রকে বিয়ে করা চলবে না। বাবার মানদণ্ডে অযোগ্য কারা, বিভা তা বিলক্ষণ জানে। অভীক সেই অযোগ্য দলে পড়ে যায় তার নাস্তিকতার কারণে।

কাহিনীর শেষটা এই রকমের; অভীক যাচ্ছে বিলেতে, জাহাজে খালাসির কাজ নিয়ে। জাহাজ থেকে চিঠি লিখছে সে বিভাকে, তাতে আছে, ‘আবার আমি ফিরব- তখন আমার মত, আমার বিশ্বাস, সমস্ত চোখ বুজে সমর্পণ করে দেব তোমার হাতে; তুমি তাকে পৌঁছিয়ে দিয়ো তোমার তীর্থস্থানের শেষ ঠিকানায়, যাতে বুদ্ধির বাধা নিয়ে তোমার সঙ্গে এক মুহূর্তের বিচ্ছেদ আর কখনো না ঘটে।’ চিঠির নিচে সই করেছে তোমার নাস্তিক ভক্ত অভীক বলে। হেরে যায়, অভীককে হেরে যেতে হয় বিভার কাছে।

যেমন যক্ষপুরীর রাজা হেরে যায় নন্দিনীর কাছে, আরো বড় আয়োজনে, ‘রক্তকরবী’তে (১৯২৬)। রাজা কোনো বিশেষ স্থানের নয়, রাজা হচ্ছে পুঁজিবাদের কারিগর। মাটি খুঁড়ে লুকানো ধন টেনে বের করে আনে। তার জোর ওই ধনসম্পত্তির জোর। রাজা সবাইকে অধীন করে রেখেছে; অধ্যাপক তার অনুগত, গোঁসাই তার স্তাবক, সর্দার তার সেনাপতি। শ্রমিকরা ইতিমধ্যেই দাসে পরিণত, তাদের ব্যক্তিগত পরিচিতিটুকু পর্যন্ত নেই; তারা একেবারে নিশ্চিহ্ন।

এই রাজ্যে বিদ্রোহিনী একজনই। নন্দিনী। ঘটা করে বিদ্রোহ করে না, তার বিদ্রোহ বেরিয়ে আসে স্বতঃস্ফূর্তরূপে। কেননা সে নারী। নন্দিনী হচ্ছে সৃষ্টির, ফসলের স্বাভাবিকতার। তার আছে প্রাণ। কখনো সে বিদ্যুৎ শিখা যে ভেঙে ফেলে, কখনো সে গানের ছন্দ যে সহজে বহন করে বিপুল বোঝাকে; এবং সর্বক্ষণই সে বিদ্রোহী। শেষ পর্যন্ত তারই জয় হয়। ধ্বনি ওঠে তারই নামে।

রাজা নিজেও ছিল বন্দি, নিজ ব্যবস্থার হাতে। তার শক্তি ছিল না বের হয়ে আসে। ভাঙতে গিয়ে মারা পড়ল।

সাত

ঘটনাটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে কী?

নারী যে পুরুষ থেকে স্বতন্ত্র, রবীন্দ্রনাথ সেটা খুবই মানেন। তারা যে পরস্পরের পরিপূরক, এটাও অস্বীকার করেন না। কিন্তু যা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো, নারী-পুরুষের মধ্যে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তিনি সর্বদাই লক্ষ করেছেন, তা সে নারী মাতাই হোক কি প্রেমিকাই হোক কিংবা হোক দুয়ের সংমিশ্রণ। এই দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে দেখা গেছে পুরুষই আধিপত্য করে- স্বামী, প্রেমিক, পিতা, ভ্রাতা, বন্ধু- নানা ভূমিকায়; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষ জেতে না, শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় নারীই। আর ওই দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে পুরুষ নিজেও যে বন্দি নানা ব্যবস্থার হাতে, সে সত্যটা উন্মোচিত হয়ে যায়। মেয়েরা জয়ী হয়, কেননা তারা প্রতিনিধিত্ব করে সৃষ্টির, প্রকৃতির ও স্বাভাবিকতার। বিশাল রবীন্দ্র সাহিত্যের নীরব পক্ষপাতিত্ব নারীর পক্ষেই।