পতিদাহ

২৩ নভেম্বর ১৯০২।
একটু আগে শ্রীমতী মৃণালিনী দেবীর আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বেরোনোর আগে তার অবিনশ্বর আত্মাকে নশ্বর দেহের নির্দিষ্ট কোটরে আটকে রাখার জন্য হোমিওপ্যাথ ও অ্যালোপ্যাথ প্রচেষ্টার কোনো ত্রুটি করা হয়নি। ২৬ দিন আগে ২৯ অক্টোবর যখন তার জন্য বেডপ্যান কেনা হয়, তখনই আশঙ্কা জেগেছিল ভব বোধ হয় আর টিকবে না। তার স্বামী রবি কোনো দিনও স্ত্রীকে ভব বলে ডাকেনি, বরং তার শ্বশুর বেণীমাধবের দেওয়া নাম ‘ভবতারিণী’ পাল্টে নিজের পছন্দের নাম ‘মৃণালিনী’ চাপিয়ে দিয়েছে পাতলা টিংটিংয়ে মেয়েটির ওপর। বিয়ের সময় রবির বয়স ২২ বছর ৭ মাস আর মেয়ের ৯ বছর ৯ মাস। মেয়েটি দেখতেও তেমন সুশ্রী নয়। ফরসা ও সুদর্শন মেয়ের জন্য যথেষ্ট খোঁজাখুঁজি করা হলেও যশোরের পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে সে সময় বিয়ের যোগ্য আর কোনো সুন্দরী মেয়ে পাওয়া যায়নি। ভালোতে-মন্দেতে মিলিয়ে রবির সঙ্গে উনিশ বছর ঘর করে চিতায় উঠল মৃণালিনী। মনে কিঞ্চিৎ পাপ ছিল বলেই তা মোচন করতে শেষ সময়ে রবি মন দিয়েছিল স্ত্রীর সেবায়। শেষ দিন মৃণালিনী নির্বাক থাকলেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল রবির দিকে। দুর্বোধ্য সেই চোখের ভাষা। সাদামাটা শেষকৃত্যে রবির বুড়ো বাবা দেবেন ঠাকুর খরচ করেছিলেন ২৮ টাকা ২ পয়সা।
টাকাপয়সার যোগ-বিয়োগ যাঁরা করেছেন, তাঁরা এটা বলতে ছাড়েননি, মেয়েমানুষের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সাঙ্গ করতে এত্তগুলো টাকা বেরিয়ে গেল!
রবি সটকে পড়ার তালে ছিল। সেটাই হওয়ার কথা। হ্যাঁ, ঠাকুরবাড়ির এতগুলো কর্মচারীর নাকের ডগার ওপর দিয়ে পালিয়েই গেল রবি। দেশের যে কানুন সবার জন্য প্রযোজ্য, রবির ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে কেন?
দেবেন ঠাকুর যে টাকা বউমার জন্য খরচ করলেন, এর সঙ্গে আর গোটা দশেক যোগ করলে রবির অন্ত্যেষ্টিকর্মও সারা যেত। কিছু বাড়তি বাঁশ, খড়ি আর ঘি। তা ছাড়া রবির শরীরেও যথেষ্ট চেকনাই। একবার আগুন ধরে গেলে শরীরের স্নেহ-মাখন-ঘি আপনি উতলে উঠে অগ্নিশিখাকে লেলিহান করে তুলত। দেশলাইয়ের কাঠি খরচ হতো একটাই। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের বুদ্ধিশুদ্ধির ঘাটতি আছে। নইলে পালিয়ে যাওয়া রবিকে ধরে চিতায় তুলতে এত পেরেশান হতে হয়! চিতা সাজানোর খরচ তো আছেই। পতিদাহ তো আর ধর্মের বাইরে কিছু নয়। বাংলায় আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। রবির জন্য বছরটা এমনিতে ভালো যায়নি।
গত বছর পৌষ মাসের ৭ তারিখ, ডিসেম্বরের ২২, রবি শান্তিনিকেতনে যে স্কুলটা বসিয়েছে, তার খরচ জোগাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। শুরুতেই তো আর ট্যুশন ফি আর বোর্ডিং চার্জ চাওয়া যায় না। আগে স্কুলটা জমে উঠুক, তখন দেখা যাবে। কুষ্টিয়ায় যে ব্যবসা খুলেছিল, তাতে ভীষণ মার খেল। পুরীর বাড়িটা বেচতে হলো। এই হতভাগী বউটাও নিজের কিছু অলংকার ছেড়ে দিয়েছিল স্কুলের জন্য। স্কুলে প্রথম ব্যাচে যোগ দেওয়া শিক্ষকদের মধ্যে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়সহ তিনজন গ্রীষ্মের ছুটির পর শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেননি। এর মধ্যেই আবার স্ত্রী বিয়োগ!
অলংকরণ: তুলিলোকজন রাস্তায় নামল। স্ত্রীর চিতার আগুন পুরোপুরি নেভার আগেই পতিকে শুইয়ে ফেলতে হবে। পালিয়ে যাবে কত দূর? জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে চৌকি বসিয়ে ওর অবস্থান শনাক্ত করা হবে। তারপর পাঠানো হবে নিকটবর্তী স্ন্যাচার ব্রিগেড, তারাই প্রতিরোধ ও প্রতিকূলতার মধ্যে রবিকে ছিনিয়ে এনে প্রয়োজনে হাত-পা বেঁধে চিতায় শুইয়ে দেবে।
এ কেমন কথা! চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাবে। অথচ এই মানুষই না নিজের দেহত্যাগ করে আত্মাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল হাজার মাইল দূরে ঘুমন্ত স্ত্রীর কাছে। ১৮৯০-এর ২৪ আগস্ট রোববার। বোম্বে থেকে জাহাজে চড়ে বিলেতে যাচ্ছে রবি। এডেন থেকে নিজ হাতে সে স্ত্রীকে লিখেছে, রোববার দিন রাতে তার আত্মা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে জোড়াসাঁকোয় চলে যায়। মৃণালিনী তখন একটা বড় খাটে শুয়ে। এত দূর এসে বউটাকে না ছুঁয়ে যায় কেমন করে—‘আমি তোমাকে একটু একটু আদর করলুম আর বললুম ছোট বউ মনে রেখো আজ রবিবার রাত্তিরে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে গেলুম—বিলেত থেকে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব তুমি আমাকে দেখতে পেরেছিলে কি না।’
রাজ্যের মানুষকে ডজন ডজন চিঠি পাঠিয়েছে রবি কিন্তু উনিশ বছরের বউকে চিঠি লিখেছে মাত্র তিন ডজন। স্বীকার করুক কি না-ই করুক, পূর্ববঙ্গের যশোরের এই মেয়েটিকে সে কিছুটা উপেক্ষাই করেছে। উপেক্ষার বড় প্রমাণ যখন মৃণালিনীর চিতা বহ্নিমান, কোথায় একজন একনিষ্ঠ স্বামীর মতো স্ত্রীর চিতায় ঝাঁপিয়ে পড়বে, চারদিকে প্রবল বাদ্য বেজে চলবে, জীবনের অগ্নিশুদ্ধ আত্মা হাত ধরাধরি করে মিলিয়ে যাবে অসীম শূন্যে, কিন্তু তা না করে সে পালিয়ে গেল লোকচক্ষুর অন্তরালে।

২.
পতিই হোক কি পত্নী—যে আগে যাবে, যাওয়ার সময় সঙ্গীকে নিয়ে যাবে সঙ্গে। কিন্তু তখন তো বাংলা এমন নারীবান্ধব ছিল না। পতিরাই যাওয়ার সময় পত্নীকে সঙ্গী করত। দু-একজন দুর্বিনীত স্ত্রী চিতা থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়তে চেষ্টা করত, তাতে কাজ হতো না। চিতার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে নিয়োজিত বাঁশের লাঠি বাহিনী রে রে করে তেড়ে আসত—পালাবি কোথায় হতভাগী? বাঁশ-পেটা করে তাকে ছুড়ে ফেলা হতো চিতার সবচেয়ে গনগনে অগ্নিকুণ্ডে। ঘাটের মড়াই হোক কি তারুণ্য টগবগে খোকাই হোক, ভস্মীভূত হতে হতে স্মিতহাস্যে বলে উঠত, পালাবি কোথায় হতভাগী? আমার সঙ্গে ওপারে চল।
বাকিংহ্যামশায়ারের ছেলে, প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম বেন্টিংক আর ডেভোনশায়ারের ডিউক উইলিয়াম ক্যাভেন্ডিশের একমাত্র কন্যা ডরোথির পুত্র লর্ড উইলিয়াম হেনরি ক্যাভেন্ডিশ বেন্টিংক যখন ভারতবর্ষ শাসন করছেন, সতীদাহে খুব মনঃক্ষুণ্ন হলেন। তাঁকে আরও প্ররোচনা দিলেন রাজা রামমোহন রায়।
রামমোহনেরও একজন প্রিয় বউদি ছিলেন। দাদার মৃত্যুর পর যখন সেই বউদিটিকে চিতায় ওঠানো হচ্ছে, রামমোহন বাধা দিয়েছিলেন, বউদিকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ ও প্ররোচনা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই নাফরমানি ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হতে দেননি সমাজপতি মুরব্বিরা। অনেক দিন পর ইংরেজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রামমোহন সেই শোধটাই নিলেন।
বেন্টিংকের সই ও সিলমোহর নিয়ে ৪ ডিসেম্বর ১৮২৯ সালে জারি হলো সে বছরের ১৭ নম্বর আইন: বেঙ্গল সতী রেগুলেশন। সতীর সহমরণ চর্চা নিষিদ্ধ তো করা হলোই, সেই সঙ্গে সহমরণে সহায়তাকারী কিংবা বাধ্যকারীদের জন্য বরাদ্দ হলো ফৌজদারি দণ্ড। যে নারী সানন্দে স্বামীর চিতায় আরোহণ করে সহাস্যে ভস্মীভূত হওয়ার চ্যালেঞ্জ নেয়, সেই না অরুন্ধতীর মতো স্বর্গগামী হয়। স্বামীকে অনুসরণ করে যে নারী পরপারের যাত্রী হয়, লাভ করে তিন কোটি পঞ্চাশ লাখ বছর আনন্দময় সহবাসের গ্যারান্টি। পিতৃকুল, মাতৃকুল এবং কুমারী অবস্থায় যে কুলে আগমন করেছে, তিন কুলের সমুদয় পাপ স্খলন করে তাদেরও স্বর্গারোহণের নিশ্চয়তা দিতে পারে সেই নারী, এমনকি ব্রাহ্মণ হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ থেকেও স্বামীকে মুক্ত করে নিয়ে স্বর্গে চলে আসতে পারে অগ্নিশুচিস্নাত মর্ত্যের এই দেবী।
রবি লিখে লিখে যথেষ্ট হাত পাকিয়েছে। কী কথা লিখেছে?
খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর
বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।
দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও,
এসো দুই বাহু বাড়ায়ে।
ঠিকই লিখেছে। মৃণালিনী দুই বাহু বাড়ায়েই আসছে। দুই বাহুতে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। মরণলোকের দুয়ার খুলে ছুটে আসা এই নারীর বাহুলগ্ন হতে হবে এই আতঙ্কে রবি ছুটছে তো ছুটছেই।
অথচ এই রবিই লিখেছে:
তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে আলোয় আকাশ ভরা।
তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে
ফুল্ল শ্যামল ধরা।কেমন করে সে মিলন হবে? পতিদাহের আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসেছে। শেষ পর্যন্ত রবি ধরা পড়ল শাহজাদপুর কুঠিবাড়িতে। নিলাম ডাকে ১৩ টাকায় কেনা এই কুঠিবাড়ির একটি গোপন কুঠুরিতে লুকিয়েছিল আর নারী নাম জপছিল—ও মৃণালিনী, ও মৃণালিনী। বিড়বিড় করে সে বলল, হে নারীদরদি লর্ড বেন্টিংক, আপনি আইন করে সতীদাহ নিবারণ করলেন কিন্তু পতিদাহ নিয়ে তো একটি কথাও বললেন না। হে রাজা রামমোহন রায়, বউদিকে আপনি ভালোবাসতেন বলেই তো তাকে চিতায় তুলতে চাননি, বউদিকে ভালো তো আমিও বাসতাম। আপনার তিন স্ত্রীর দুজন তো আপনার জীবদ্দশায়ই লোকান্তরিত হলেন, কই চিতায় ওঠার জন্য আপনাকে তো কেউ জোর-জবরদস্তি করেননি। নাকি এপারে স্ত্রীসঙ্গ যতটুকু পেয়েছেন, তাতেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে মনে করে ওপারে কেবল পুরুষবেষ্টিত থাকার মানসে সতীবর্জিত বিলেতে চলে গেলেন। আমি এলাম শাহজাদপুর, তা-ও ধরা পড়ে গেলাম। ঘাতকেরা বাইরে দাঁড়িয়ে। চিতা সাজিয়ে রেখেছে। আমাকে মৃণালিনীর কাছে পাঠিয়ে দেবে। আপনি সময়মতো কেটে পড়লেন, আমার জন্মেরও ২৮ বছর আগে ১৮৩৩-এ ম্যানিনজাইটিসে ভুগে দেহ রাখলেন ব্রিস্টল শহরে। বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন। পতিদাহকারীদের পাল্লায় আপনাকে পড়তে হয়নি।
দরজায় প্রবল ঘা পড়ছে। কপাট খোল দেবেন ঠাকুরের ছাওয়াল, তোর খবর আছে। চিতা গরম থাকতে থাকতে তোকে ধরে নিয়ে শুইয়ে দিতে হবে। রবির চোখে অশ্রু নেমে আসে। এ জীবনে দিদিমার দেখা সে পায়নি। সুন্দরী সেই নারী নির্বসনা হোন কি পোশাকাবৃত্ত থাকুন, তাঁর নাম দিগম্বরী। তিনিও যশোরের মেয়ে, রামতনু বাবু আর আনন্দময়ী দেবীর কন্যা, জগদ্ধাত্রী প্রতিমার মতো মুখের বর্ণ ও গড়ন, সে তুলনায় মৃণালিনী তো কিছুই নয়। দিগম্বরীও পারেননি তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ ঠাকুরকে সহমরণে বাধ্য করতে। দ্বারকানাথ রামমোহনের প্ররোচনায় মুসলমান বাবুর্চির হাতের রান্না খেতেন, ম্লেচ্ছ খ্রিষ্টানদের সঙ্গে বসে শেরি-শ্যাম্পেন পান করতেন, ইউরোপীয় বাদ্য শুনতেন, যৌন উত্তেজক নৃত্যও উপভোগ করতেন। দিদিমা এসব ভ্রষ্টাচার সহ্য করতে না পেরে তাঁর সঙ্গে নিশিযাপন ও সঙ্গম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন—‘যতবার তিনি দ্বারকানাথের সহিত কথা কহিতে বাধ্য হইতেন, ততবারই সাতঘড়া গঙ্গাজলে স্নান করিয়া নিজেকে পরিশুদ্ধ করিতেন।’
রবির সেই দিদিমা ২১ জানুয়ারি ১৮৩৯ দেহত্যাগ করেন। নির্বিকার দ্বারকানাথ তাঁকে চিতায় উঠিয়ে দেন, একবারও তাঁর মনে হয়নি স্ত্রীর সঙ্গী হয়ে ওপারে চলে যাবেন, ঝাঁপিয়ে পড়বেন স্ত্রীর চিতায়। ১৮৪৫-এর মার্চে দ্বারকানাথ বিলেত চলে গেলেন। ১৮৪৬-এর আগস্টের প্রথম দিন তিনি অবস্থান করছিলেন সেইন্ট জর্জ হোটেলে, সেদিন ছিল প্রচণ্ড ঝড়বাদল। এরই মধ্যে দ্বারকানাথের পৌরুষ আত্মা দেহমুক্ত হয়ে গেল। তাঁর সঙ্গে সহমরণে যাওয়ার মতো কোনো নারীর সন্ধান মেলেনি। পাঁচ দিন পর কোনো ধর্মীয় আচার ছাড়াই তাঁর আত্মাহীন দেহ সমাহিত করা হলো কেনসাল গ্রিন সিমেট্রিতে আর ব্রাহ্ম আচারমতে, শেষকৃত্যের জন্য তাঁর হৃৎপিণ্ড পাঠিয়ে দেওয়া হলো কলকাতায়। কই, তাঁকেও তো পতিদাহের শিকার হতে হয়নি।
রবির এবার মায়ের কথা মনে পড়ল। যে ব্রাহ্মমুহূর্তে যশোরের দক্ষিণডিহি গ্রামের সারদাসুন্দরী দেবী লোকান্তরিত হলেন, পতিদাহের ভয়েই হোক কি অন্য কোনো কারণেই হোক, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।
রবির বয়স তখন কত? তখনো ১৪ হয়নি। সারদা দেবী যে রোগে ভুগছিলেন কী নাম তার? কর্কট!
তঁার হাতে অস্ত্রোপচার করাতে হয়। হোমিওপ্যাথির আর্নিকা দিয়ে চিকিৎসা শুরু হলেও প্রফেসর প্যাট্রিজ এফআরসিএসও তাঁর চিকিৎসা করেন। রবির বাবাকে একটার পর একটা টেলিগ্রাম পাঠানো হয়, সারদার জীবনের শেষ বছরটিতে একটিবারের জন্যও তাঁকে দেখতে আসেননি তিনি। চিতার ছাইয়ের শেষ কণাটুকু বাতাসে উড়ে যাওয়ার অনেক পরে দেবেন ঠাকুর কলকাতায় ফিরে আসেন।
পিতামহ ও পিতার পাপ এবং নিজের উপেক্ষার প্রায়শ্চিত্তই রবিকে করতে হবে।
স্ন্যাচার স্কয়াডের চৌকস যুবকেরা ঘরের দরজা ভেঙে ফেলল। আতঙ্কিত রবি অশ্রুসিক্ত ঝাপসা চোখে তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। গনগনে আগুনের লেলিহান শিখায় মৃত্যু আসন্ন জেনে চিৎকার করে বলতে চাইছে, ও কথা আমি বলিনি, আমার কথা নয়।
কোন কথা?
মরণ রে,
তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।
মেঘবরন তুঝ, মেঘজটাজূট
রক্তকমলকর, রক্ত অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু-অমৃত করে দান।
চ্যাংদোলা করে হাত-পা বাঁধা রবিকে চার বেহারার পালকিতে তুলে দেওয়ার আগে ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বলল, পতিদাহই যদি করবে আমাকে তোমরা, তখন কেন করলে না?
তখন মানে?

আরও ১৮ বছর আগে, ১৮৮৪-র ২১ এপ্রিল, সেদিন কেন আমাকে ধরলে না। আমাকেও কাদম্বরীর সঙ্গে…।
রবি কথা শেষ করতে পারে না। ভেতর থেকে উত্থিত কান্না তার দেহ ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে। তাহলে তোকে কেন, জ্যোতিকে পতিদাহের চিতায় তুলতে হতো। সে-ই তো কাদম্বরীর স্বামী।
চোখ মুছতে মুছতে রবি বলল, সে তো কাগজে-কলমে। জ্যোতিদা বড্ড ঠকিয়েছে এই মেয়েটিকে। আমি একা আর কতটুকু ক্ষতিপূরণ করতে পেরেছি। এর মধ্যে আবার মৃণালিনী ঢুকে পড়ে বেচারির জীবনটাকে আরও কষ্টকর করে তুলল। আত্মহত্যার প্রথমবারের চেষ্টাটা বিফলে গেল, কিন্তু সাড়ে তিন বছর পর কাদম্বরী যখন আত্মঘাতী আফিম সেবন করল, তখন তাকে আর কে বাঁচায়। দুই দিন পর কাদম্বরীকে শ্মশানে নেওয়ার সময় আমিও তো উপস্থিত ছিলাম। আমাকে সেখানে চেপে ধরলেও তো পারতে।
রবিকে আর কথা বলতে দেওয়া হয়নি। তাকে পালকিতে উঠিয়ে বেহারারা ছুটল। ওদিকে চিতায় বর্ষণ করা হলো আরও গব্যঘৃত। আগুন জ্বলতে থাকুক, যেখানেই থাকুক রবিকে দিয়েই শুরু করতে হবে বিশ শতকের প্রথম পতিদাহ।
কাদম্বরীর কী দোষ? জ্যোতির সঙ্গে নটীবিনোদিনীরা, রবির ঘরে নতুন বউ। মরতেই তো হবে। দেরি করে কী লাভ।
কাদম্বরীর অস্বাভাবিক মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে চালাতে, পত্রিকার মুখ বন্ধ করতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের খরচ হয়েছে সাকল্যে ৫২ টাকা।
মৃত্যু-আতঙ্ক ও কাদম্বরীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দৃশ্যপটে পালকিবন্দী রবি ধীরে ধীরে আবৃত্তি করছে:
হয়ত জান না দেবী অদৃশ্য বাঁধন দিয়া
নিয়মিত পথে এক ফিরাইছ
মোর হিয়া।
গেছি দূরে, গেছি দূরে, সেই
আকর্ষণ আছে,
পথভ্রষ্ট হই নাই আহারি অটল বলে।
নহিলে হৃদয়ে মম ছিন্ন ধূমকেতু সম
দিশাহারা হইত সে
অনন্ত আকাশতলে।
রবির মৃত্যুভয় কাটতে থাকে। কাদম্বরীও ওপারে। তার কাছেই যেতে হবে মৃণালিনীর চিতায় সওয়ার হয়ে। রবির ভস্ম আউলা বাতাসে অখণ্ড বঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল। সেই ভস্মে সুফলা হয়ে উঠল রবিকরোজ্জ্বল বাংলাদেশ।