সাড়ে তিন হাত ভুমি


হযরত আবু হুরায়রা হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহেওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ্! আমি সবার আগে কার সঙ্গে সদাচরণ করব? রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহেওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মায়ের সঙ্গে।
লোকটি প্রশ্ন করল, তারপর?
উত্তর আসলো, তোমার মা।
লোকটি আবার জানতে চাইল, তারপর কে?
রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহেওয়াসাল্লাম এইবারও একই জবাব দিলেন, তোমার মা।
ওই লোক চারবারের বার একই প্রশ্ন করল। নবীজি জবাব দিলেন, তোমার পিতা।
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, মায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। মায়ের সঙ্গে কাহারও তুলনা হয় না।
তোমার মনে আছে মা, সেইসব দিনের কথা মনে আছে!
সন্ধ্যার পরপর আমরা সবাই পেছন দিককার বারান্দায় বসে আছি। বারান্দায় তুমি, আমি ও বকুল বসে আছি চেয়ারে। কদম, পারুল আর বুয়া বসে আছে পুব দিককার দেয়ালে হেলান দিয়ে। বারেক বসে আছে বুয়ার পায়ের কাছে। খানিক আগে মাগরিবের নামাজ পড়েছে বারেক। নামাজ পড়ার পর গোয়ালঘরের ওদিকটায় তসবি হাতে পায়চারি করেছে, দোয়া-দরুদ পড়েছে। তারপর এসে বারান্দায় বসেছে। বসে কোরআন-হাদিসের কথা বলতে শুরু করেছে।
বারেক ফিরেছিল একেবারে অন্য মানুষ হয়ে। মুসল্লি হয়ে। অতি বিনয়ী ভঙ্গি। নম্র, গভীরভাবে ধার্মিক এক যুবক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে। অতি সহিহ্ ভঙ্গিতে অজু করে নিজেই আজান দেয়, তারপর ঘরে ঢুকে জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়ে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর তসবি হাতে পায়চারি করে আর দোয়া-দরুদ পড়ে। শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়তে চলে যায় দূরের মসজিদে।
বারেক আসার পর বাড়ির পরিবেশটাই অন্য রকম হয়ে গেল।
সে থাকে কদমের ঘরে। ওই ঘরে দুটো চৌকি পাতা। একটায় কদম ঘুমায়, আরেকটা খালি পড়ে থাকে। পুরনো কাঁথা-বালিশ ডাঁই করে রাখা। সেই চৌকি এত সুন্দর করে পরিষ্কার করল বারেক! পুরনো ছেঁড়া কাঁথা বিছানো অতি দীন ধরনের বিছানা। বালিশ তেল চিটচিটে, বিক্রমপুরের ভাষায় ‘ল্যাড়ল্যাড়া’। ওই কাঁথা-বালিশেই বারেকের বিছানাটা আশ্চর্য এক পবিত্রতায় ভরা।
মা, তুমি অবশ্য বারেককে পুরনো ধোয়া একটা চাদর দিয়েছিলে। চাদরটা বেশ বড়। চৌকির চারদিক দিয়ে কিছুটা ঝুলে পড়ত। সেই চাদরে এমনভাবে নিজের কাঁথা-বালিশ বারেক ঢেকে রাখত, ছিমছাম পবিত্র একটা ভাব ফুটে থাকত বারেকের বিছানায়।
এক দুপুরে আমি বারেকের ঘরে উঁকি দিয়েছিলাম।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে কদম তার বিছানায় নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার পাশেই নিজের বিছানায় আসনপিঁড়ি করে বসে বারেক খবরের কাগজ দিয়ে অতিযত্নে মলাট দেওয়া নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা শখানেক পৃষ্ঠার কী একটা বই পড়ছে। এত মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, পাশের বিছানায় শুয়ে, ভালো রকম শব্দ করে একজন মানুষ নাক ডাকাচ্ছে, আর একজন মানুষ, আমি খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়েছি, বারেক কিছু টেরই পাচ্ছে না।
আশ্চর্য ব্যাপার!
পড়ার জন্য মায়ের মার খেয়ে যে ছেলে মাত্র দশ বছর বয়সে উধাও হয়ে গিয়েছিল, এগারো বছর পর সেই ছেলেই পড়ার প্রতি এমন মনোযোগী হয়ে কোত্থেকে ফিরল?
কে তাকে এমন করে বদলে দিল?
কারা তাকে এমন করে বদলে দিল?
এই এতগুলো দিন কোথায় ছিল বারেক?
খানিক বারেককে দেখে মৃদু শব্দে গলা খাঁকারি দিলাম আমি। আচমকা শব্দে মানুষ সাধারণত একটু হলেও চমকায়। বারেক চমকালো না। নির্বিকার ভঙ্গিতে চোখ তুলে তাকাল। হাসিমুখে সালাম দিল। আসসালামোয়ালাইকুম।
এই আরেক স্বভাব নিয়ে ফিরেছে বারেক। দিনে যতবার যার সঙ্গে দেখা হয় তাকে ততবারই সালাম দেয়। বাবাকে, তোমাকে, আমাকে আর বকুলকে তো দিচ্ছেই; কদম, পারুল, বুয়াকেও দিচ্ছে।
বারেকের সালামের চোটে আমরা একটু অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। পারুল একদিন ধমকই দিল বারেককে। এই ছেমড়া, এতবার সেলামালাইকুম দেওনের কাম কী? একবার দিলেই তো হয়?
বারেক হাসিমুখে নম্র গলায় বলল, পারুল খালা, আসসালামোয়ালাইকুম অর্থ হইতেছে আপনার ওপর বা তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। দিনে যতবার সালাম দেওয়া যায়, ততবারই আল্লাহপাক তোমার ওপর শান্তি বর্ষণ করবেন। তুমি যতবার সালামের জবাব দিবা ততবারই যেই মানুষটা তোমারে সালাম দিচ্ছে তার ওপর আল্লাহপাক শান্তি বর্ষণ করবেন।
সেই দুপুরে বারেকের সালামের জবাব দিয়ে আমি ঘরে ঢুকলাম। কী পড়ছিল বারেক?
কিতাব। বুখারি শরিফের ছোট একটা অংশ।
বারেকের পরনে সাদা লম্বা পাঞ্জাবি আর নীল লুঙ্গি। মাথায় সাদা টুপি। নিয়মিতই আতর ব্যবহার করে সে। শরীর থেকে আসছিল আতরের পবিত্র গন্ধ।
বলল, বসেন মামা, বসেন। বুখারি শরিফে এই মাত্র যা পড়লাম, বলি আপনারে।
আমি বারেকের বিছানায় বসলাম। বারেক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, একবার এক ব্যক্তি রাসুলে করিমের কাছে আসলো। আইসা বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি জিহাদে যাওয়ার জন্য আপনার অনুমতি প্রার্থনা করতেছি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহেওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি মা-বাবা জীবিত আছেন?
লোকটি জবাব দিল, জি হুজুর, জীবিত আছেন।
রাসুলুল্লাহ বললেন, তুমি তোমার মা-বাবার সেবাযত্নে নিজেকে নিয়োজিত করো।
তার পরই দেখি বারেকের দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে। গাল ভিজে যাচ্ছে বারেকের। হঠাৎ সে কাঁদছে কেন?
আমি কথা বলার আগেই বারেক কান্নাকাতর, ধরা গলায় বলল, আমার বাবায় ডাকাইত আছিল। জানি না সে জীবিত আছে, না আল্লাহপাক তারে তুইলা নিছে। ডাকাইত স্বামীর সংসার করে নাই আমার মায়। আমারে বুকে লইয়া সংসার ছাইড়া আইছিল। আমারে ডাকাইত বানাইতে চায় নাই, লেখাপড়া শিখাইয়া মানুষের মতন মানুষ বানাইতে চাইছিল। কিন্তু আমার রক্ত হইল ডাকাইতের রক্ত মামা। আমার লেখাপড়া ভাল্লাগে না। দশ বচ্ছর বয়সেই আমার মনডা উড়ু উড়ু। ঘরবাড়িতে আমার থাকতে ইচ্ছা করে না। বই লইয়া বইতে ইচ্ছা করে না। ইসকুল আমার কাছে জেলখানা মনে হয়। এই জইন্য মায়ের হাতে মাইর খাইয়া আমি চইলা গেছিলাম। এই বাড়ি ছাইড়া, আপনেগো ছাইড়া আর আমার মারে ছাইড়া চইলা গেছিলাম। অবশ্য চইলা গিয়া আমার ভালো হইছে। আল্লাহপাক আমারে পথ দেখাইছেন। মা কী, আমি বুঝতে শিখছি মামা!
কিন্তু তুই গিয়েছিলি কোথায়? এত দিন কোথায় ছিলি? লেখাপড়া শিখলি কোথায়? এ রকমভাবে নিজেকে বদলে ফেললি কেমন করে?
বারেক দুহাতে চোখ মুছল। বলব মামা, বলব। সব আপনাদের বলব। তয় মামা, আমার মারে এগারোটা বচ্ছর আমি যেই দুঃখ দিছি, জানি না আল্লাহপাক আমারে দয়া করবেন কি না। আমার এই গুনাহ তিনি মাফ করবেন কি না? তবে মামা, আমার মায় যুদি আমারে মাফ করে তয় আল্লাহপাকও আমারে মাফ করবেন। এই জইন্য আমি ফিরত আইছি। মার পাও ধইরা পইড়া থাকি, মা, মাগো, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও মা। আমারে তুমি মাফ কইরা দেও। তুমি মাফ না করলে আল্লায়ও আমারে মাফ করব না। তোমার লগে আমি যা করছি এই গুনাহর জইন্য দোজকের আগুনে পুইড়া মরতে হইব আমার। কিন্তু মামা, মায় আমারে মাফ করে না। মার পাও ধইরা এত কান্দি আমি, মায় আমারে মাফ করে না!
বারেক আবার কাঁদতে লাগল।
আমাদের কথাবার্তায় কোন ফাঁকে যে কদমের ঘুম ভেঙে গেছে, বারেক, আমি কেউ তা খেয়াল করিনি। আনমনা চোখে কদমের বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখি কদম তার বিছানায় উঠে বসেছে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বারেকের দিকে।
কিন্তু বুয়া এত কঠিন হয়ে গিয়েছিল কেমন করে, মা?
আমরা সবাই দেখছি, বাড়ির সবাই দেখছে, সুযোগ পেলেই বারেক তার মায়ের পা জড়িয়ে ধরছে, অনুনয়, বিনয় করছে, কাঁদছে, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও মা, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও। কিন্তু বুয়া তার কথা পাত্তাই দেয় না। তার যেন কোনো অনুভূতিই নেই। সে যেন পাথর, সে যেন মানুষের মতো দেখতে একটি গাছ!
সেই সন্ধ্যায় বারান্দায় কোনো হারিকেন ছিল না, মা।
আমাদের প্রতিটি ঘরের দরজা খোলা। প্রতিটি ঘরেই জ্বলছে হারিকেন। কদম-বারেকের ঘরেও জ্বলছে। বাইরে, বাগানের দিকে, বাঁশঝাড়ের ওদিকটায়, সর্বত্র ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে, দু-একটা বাদুড় উড়ে যাচ্ছে, উড়ে আসছে। গোয়ালঘরের ওদিকটায় লেজ ঝাপটে মশা তাড়াচ্ছে গরুগুলো। আমরা বারান্দায় বসে বারেকের কথা শুনছি।
বারেক বসে আছে বুয়ার পায়ের কাছে। এক হাতে মায়ের পায়ে কখনো হাত বুলাচ্ছে, কখনো পা টিপে দিচ্ছে।
কিন্তু বুয়া নির্বিকার।
সে বারেকের দিকে তাকায়ই না। আমি দুই-একবার বুয়ার মুখের দিকে তাকালাম। বিভিন্ন ঘর থেকে বারান্দায় এসে পড়েছে হারিকেনের আলো। আমাদের পায়ের কাছে, হাতের কাছে, শরীরের কোথাও কোথাও পড়েছে সেই আলো। যারা নিচে বসে আছে তাদের মুখে, চোখে পড়েছে; মাথায় পড়েছে।
বুয়ার মুখে পড়েছিল হারিকেনের আলো। তবু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না তার চোখ। তবে সে যে বারেকের দিকে তাকিয়ে নেই- এটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। বারেক ফিরে আসার দিন থেকেই তো প্রথমবার বারেকের মুখের দিকে সে তাকিয়েছিল, ছেলেকে চিনেছিল, বিড়বিড় করে তার নাম উচ্চারণ করেছিল, তারপর…
কিন্তু বারেক যে মায়ের পা ধরছে, পা টিপে দিচ্ছে, বুয়া পা সরিয়েও নিচ্ছে না। যেন ছেলের স্পর্শ সে টেরই পাচ্ছে না। আর ছেলের সঙ্গে তো কথা সে বলেই না। ছেলে এত যে মা, মা করছে, নানা রকমভাবে মাফ চাইছে, বুয়া নির্বিকার। যেন আপন ছেলেকে সে চেনেই না।
বারেক একবার বুয়ার দিকে তাকাল। বারেকের গলা পর্যন্ত হারিকেনের আলো, তার ওপর থেকে আবছা অন্ধকার। আমাদের বারান্দায় বেশ একটা আলো-আঁধারির খেলা।
বারেক বলল, সাহাবি আলকামা মারা যাইতেছেন। এই সময় তাঁর জবান থেকে কালেমা বাইর হইতেছে না। খবর পাইয়া নবীজি আসলেন। আলকামার অবস্থা দেইখা তাঁর মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি আলকামার ওপর নারাজ?
আলকামার মা উত্তর করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার ছেলে আমার চেয়ে তার স্ত্রীকে বেশি গুরুত্ব দিত। এই কারণে আমি তার প্রতি নারাজ!
তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহেওয়াসাল্লাম অন্যকে হুকুম দিলেন, আলকামাকে আগুনে জ্বালাইয়া পোড়াইয়া ছারখার কইরা দাও।
আলকামার মা এই কথা শুইনা গগনবিদারী চিৎকার দিয়া বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার চোখের সামনে আমার সন্তানরে আগুনে জ্বালাইয়া পোড়াইয়া ছারখার করলে, আমি মা হইয়া কেমন কইরা তা সহ্য করব?
নবী করিম তখন আলকামার মাকে অনুরোধ করলেন, তাহলে আপনার সন্তানরে মাফ কইরা দেন। তা না হইলে অনন্তকাল ধইরা আপনার আলকামা জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। তা আপনি কেমন কইরা সহ্য করবেন?
এই কথা শুইনা মায়ের মন বিগলিত হইল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরে ক্ষমা কইরা দিলেন।
বারেক একটু থামল।
আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছি বারেকের কথায়। এত সুন্দর করে গুছিয়ে সে মোছলা মাছায়েল বলে, শুনতে শুনতে ঘোর লেগে যায়। ভাবতে অবাক লাগে, এই সেই বারেক! সেই দুরন্ত, দুষ্টের শিরোমণি বারেক! যে তার মায়ের মুখের ওপর দশ বছর বয়সেই বলত, আমি লেখাপড়া করুম না। আমি ডাকাইত হমু।
এই সেই বারেক!
বারেক থামার সঙ্গে সঙ্গে পারুল বলল, তারপর?
বারেক বলল, তারপর আলকামার জবান থেকে কালেমা তাইয়্যেবা জারি হইয়া গেল। কালেমা পড়তে পড়তে ইমানের সঙ্গে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন!
বারেক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
পারুল বলল, নবীজির কথা আরো ক বারেক। শুনি।
আচ্ছা মা, বাবা সেই সন্ধ্যায় কোথায় ছিলেন?
আমি মনে করতে পারছি না, আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না!
বাবা কি বাড়িতে ছিলেন?
নাকি স্কুলের কাজে ঢাকায় গিয়েছিলেন?
নাকি গ্রামের কোনো বিচার-সালিসে গিয়েছিলেন?
বিচার-সালিসে গেলে কদম যায় বাবার সঙ্গে। রাত-বিরাতে কদমকে ছাড়া চলাফেরা করেন না মা-বাবা। অন্ধকার রাতে হারিকেন হাতে কদম হাঁটে আগে আগে, বাবা হাঁটেন পেছন পেছন।
কদম সেই সন্ধ্যায় বাড়িতে! এটা আমার পরিষ্কার মনে পড়ছে। সেও বারান্দায় বসে বারেকের কথা শুনছে।
তাহলে বাবা কোথায়?
মা, বাবা কোথায়?
স্কুলের কাজে ঢাকায়?
আমি বড় হয়ে গেছি, ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, সেই ছেলেবেলার মতো বাবার জন্য কান্নাকাটি করি না। বাবা বাড়িতে না থাকলে ছটফট করি না। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতিগুলো বদলাতে শুরু করেছিল।
এটাই মানুষের নিয়ম।
প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি অদ্ভুতভাবে মানুষকে বদলে দেয়। বদলটা হয় এত ধীরে, মানুষ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
বকুলের কিশোরী বয়সে বাবা একদিন তোমাকে বলছিলেন, মেয়ের বাবা হওয়ার দুঃখ কী জানো?
কোনো কোনো রাতে বাবার মাথায় তিব্বতের কদুর তেল দিয়ে দিতে তুমি। সারা দিন স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকতেন বলে বাবার মাথাটা বেশ গরম হয়ে যেত। রাতে ভালো ঘুম হতো না। কদুর তেল বাবা ঢাকা থেকে নিয়ে আসতেন। রাতের বেলা ওই তেল মাথায় দিলে মাথা ঠাণ্ডা হয়, ঘুম ভালো হয়।
বাবা তাঁর ঘরে চেয়ারে বসে আছেন, পেছন থেকে তুমি তাঁর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছ। মাথার চুল এলোমেলো করে অতি যত্নে মাথা টিপে দিচ্ছ।
এই অবস্থায় কথাটা বললেন বাবা।
শুনে তুমি বললে, কী?
মেয়ে বড় হয়ে উঠলে তাকে আর কোলে নেওয়া যায় না।
তুমি হাসলে। এইটা খালি মেয়ের বেলায়ই না, ছেলের বেলায়ও। আমি কি রবিরে এখন কোলে নিতে পারি?
তা ঠিক। ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে গেলে নিজেদের অজান্তেই মা-বাবার সঙ্গে তাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়। সম্পর্কের মাঝখানে আবছা একটা আড়াল তৈরি হয়।
আমি বারান্দার দিকে যাচ্ছিলাম। তোমরা ছেলে-মেয়ে নিয়ে কথা বলছিলে শুনে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে শুনলাম ওই কথা। শুনে মনটা খুব খারাপ হয়েছিল মা। খুব খারাপ হয়েছিল।
সত্যি তো, যত বড় হচ্ছি ততই দূরে সরে যাচ্ছি তোমাদের কাছ থেকে। যে ছেলেটি বাবার জন্য ছটফট করত সারাক্ষণ, বাবা ঢাকায় গেলে বারবার তোমাকে বলত, বাবা কবে আসবে? বাবা কখন আসবে? যে দিন বাবার আসার কথা সে দিন সকাল থেকে বাবার জন্য অপেক্ষা। বাবা আসবেন বিকালে, সেই বিকাল যেন হতেই চায় না। সে দিন যেন দিনটা হয়ে যায় অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। সকাল যেন দুপুরই হয় না, দুপুর যেন বিকালই হয় না!
সেই ছটফটে ছেলেটি এখন বাবাকে ছেড়ে ঢাকায় থাকে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মা-বাবাকে চিঠি লেখে তাও মাসে একটা, দুটো। অতি ধীরে কেমন এক দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
এগারো বছর পর বারেক ফিরে আসাতে কি তেমন এক দূরত্ব বারেকের সঙ্গে তৈরি হয়েছিল বুয়ার?
না, বারেকের ব্যাপারটাই অন্য রকম!
দিনে দিনে বুয়া জেনেছিল তার ছেলে বেঁচে নেই। সে মারা গেছে। বাঁশঝাড়ের তেনায়ই বারেককে মেরেছেন। সে আর কোনো দিন ফিরবে না। এই কারণে সে ফিরে আসার পর বুয়া প্রথমে হতভম্ব, হকবাক। তারপর তার ভেতর জন্ম নিল অভিমান। গভীর অভিমান। বেঁচে থাকার পরও মায়ের কাছে বারেক ফেরেনি কেন? এগারোটি বছর কেটে গেছে। এই এতগুলো দিন, এতগুলো বছর সে কোথায় ছিল?
কার কাছে ছিল?
[চলবে]