কেরানিও দৌড়ে ছিল

কেরানীও দৌড়ে ছিল
কেরানীও দৌড়ে ছিল
কেরানীও দৌড়ে ছিল

বৃষ্টি! বৃষ্টি! কী বৃষ্টি! সোমবার থেকে নেমেছে তো শুক্রবারেও তার জিরেন নেই। টানা পাঁচদিন। বড় বড় মানকচুর পাতা কেটে মাথায় ধরে পথে এখন লোক। আধকোশা নদী থৈ থৈ। ভাগ্যে এখন বাঁধ দিয়েছে সরকার, নইলে নদীর পাগল ধাক্কায় পাড়ের বাড়িঘর ধসে পড়ত নদীর বুকে। বৃষ্টিমাথায় কেরানি এসে ঘাটে দাঁড়ায়। জলেশ্বরী বাস ইস্টিশান থেকেই বৃষ্টি দেখে কেরানির মন খারাপ হয়ে যায়। তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল, নদীর ঘাটে যাওয়ার জন্য সাইকেল ভ্যানে উঠেছিল কেরানি। রেক্সিনের ব্যাগে বিয়ের সামগ্রী। লাল শাড়ি চুড়ি পাউডার স্নো আঁবসাত, নিজের পাঞ্জাবিটা হয়েছে, কিন্তু টুপির পয়সা হয় নাই। পাছে না ভিজে সব নষ্ট হয়ে যায়, বুকের কাছে ব্যাগ ধরে কেরানি উবু হয়ে ছাট ঠেকায়। কিন্তু ঘাটের কাছে আসতে না আসতেই বৃষ্টি মুষলধারে পড়তে শুরু করে। ভ্যানওয়ালা আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে প্যাডেল ঠেলতে ঠেলতে মুখ খারাপ করে, আল্লা শালার গরিবের দিকে নজর নাই। সে তো আর চাষি নয়, তাকে ভ্যান ঠেলে জীবন নির্বাহ করতে হয়! না, বিয়ের মুখে বৃষ্টি কোনো কাজের কথা নয়।
কেরানির মনে পড়ে যায় তার বাবার কথা। বাবা বলত তারও বিয়ের দিন বৃষ্টি হয়েছিল খুব। জমিয়ে গল্প করত। বিষ্টির পানিতে তোর মায়ের মুখখান মুঁই আইজও চক্ষে দ্যাখোঁ। টলটল করিচ্ছে পুষ্করিণীর পদ্ম ঝ্যান! আর মোর জামাজোব্বা ভিজিয়াও অ্যাকশা! বাসর ঘরের চাল ফুটিয়া টপটপায়া পানি রে পানি! বিছানাপত্র ভাসি যায়। মুঁই গান ধরিয়া তোর মায়েকে কইলোম, জলেভাসা কইন্যা হামার নায়ে উঠিলেন, নায়ের কাঠে পায়ের ভিজা চিহ্ন রাখিলেন! শুনিয়া তোর মায়ে শরম পায়া কয়, আউ আউ! তারবাদে নিশুত রাইতে কয়, তোমরা যে গান বান্ধেন, সেই কথা শুনিছোঁ মুই। সওয়াল করে, ক্যামন করি গান বান্ধা হয় গো? ঝ্যামন করি বুকের পরে তোমাক বান্ধা হয়! এত বলিয়াই ঝেই তাকে! কেরানির মনে পড়ে ঠিক তখনই মায়ের শাসন, ওগুলা কী গপ্প করেন ব্যাটার সাথে! বুড়া হয়া শরম-ভরম সউগে গ্যাছে তোমার! হ্যাঁ, সেবারে হয়েছিল বটে ঝুম বৃষ্টি। নাগাড়ে পাঁচদিন। তবে সে যাত্রা ছিল দীর্ঘদিন খরার পরে বৃষ্টি। আজমতউল্লার বিয়ের খানাদানা সব পানিতে বরবাদ। তবু লোকেরা নিরাশ হয় নাই। হাপুসহুপুস করেই খেয়েছে যে যেমনভাবে পেরেছে ওই বৃষ্টির মধ্যেই। তারা বরং বলাবলি করেছে, আজমতউল্লার বিবাহ ভাগ্যেই বৃষ্টি নামে। আসমান হতে আল্লার রহমত বর্ষিছে হে! রহমত মানে দয়ার করুণার ধারা। এর অর্থ একেকজনের কাছে একেকরকম। মহাজনেরা লাভের স্বপ্ন দ্যাখে। বীজধানের নামে আগাম দিয়ে চাষিদের বেশ বন্ধন করা যাবে! চাষিরা ধানের স্বপ্ন দ্যাখে। আবার ধান হইবে! সইর্ষা হইবে! পাট হইবে! আবার হামরা প্যাট ভরিয়া খামো! এ বিবাহ সুখের হইবে, বাহে! কিন্তু সুখের হলো কই? একে কি সুখের বলা যায়? পরপর দুই বাচ্চা পেট থেকে খসে পড়ল। তারপরে হলো তো হলো মেয়ে একটা! কেরানির দাদি সান্ত্বনা দিয়েছিল, বেটি ছাওয়া তো বেচেয়া খাইবার! তার মানে, সেকালে এ অঞ্চলে দস্তুর ছিল মেয়ের বিয়েতে বরপক্ষ একটা মূল্য ধরে দিত কন্যাপক্ষকে। তাকেই বলে বেচেয়া খাওয়া। এখন সে রীতি অচল হয়ে পড়েছে। আর, মেয়েটিরও পাত্র জোটে নাই। এখন সে গাঁও-গেরামের বিয়ের বয়স পার করে ইশকুলের মাস্টারি মেনে নিয়েছে। বিবাহের আর আশা নাই তার। তারপরে আমাদের কেরানি যদি বা ধরাপৃষ্ঠে এসে অবতীর্ণ হলো তো শরীরে রাজ্যের অসুখ নিয়ে। ১২ বছর বয়স পর্যন্ত মৃত্যুর সঙ্গে টানাটানি চলেছে তাকে নিয়ে। জমি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে হাসপাতাল আর কবিরাজের খরচ জোগাতে। একটু গতি হলো শরীরে তো ছেলে বায়না ধরল হাটে তরকারিওয়ালা সে হবে না, আলু-পটোলের পাহাড় নিয়ে লম্ফ জ্বালিয়ে দোকানদারি সে করবে না পড়াশোনা করবে! নগেন মাস্টারের ইশকুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। তারপরে ছেলের জিদে জলেশ্বরী পাঠাতে হলো উচ্চ ইংরেজি ইশকুলে। সেখানে জায়গির পাওয়া যায় বলে খরচের হাত থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু ছেলে ততদিনে শৌখিন হয়ে পড়েছে। প্যান্ট চাই তার, শার্ট চাই, দাড়ি কামাবার বয়স হলো তো সাহেবদের মতো ক্ষুর চাই তার। ক্ষুর! ওই বয়সে! কেরানিকে আগেই বলেছি আমরা সৃষ্টিকর্তা মেয়ে বানাতে বসেছিলেন, শেষ পর্যন্ত ছেলে করতে হলো তাকে। কিন্তু ১৪ বছরেও মুখে তার দাড়িগোঁফের রেখা নাই! মেয়েলি সেই মুখখানা অল্প বয়সেই ক্ষুর চালিয়ে সে পুরুষালি করতে শুরু করে। কেরানির পরে যে মেয়েটি গর্ভে আসে, পেটপোঁছা শেষের মেয়েটি, সে তো এখন হস্তিবাড়িতে ভারি নাম কুড়িয়েছে রঙ্গিলা বলে! দিনরাত সাজন তার। আর পাড়া বেড়ানো। চাঁদনি রাতে চেয়ারম্যানের যুবক ছেলের সঙ্গে আ ছি, ছি! মরমে মরে যায় বুড়া আজমতউল্লাহ। দারুণ শূলব্যাথায় জীবন তার এখন সোডানির্ভর। শরীরও পড়ে গেছে শয্যায়। উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েকে যে শাসন করবে সে বল নাই। শূলের দরুনও অন্য ভাবনার অবকাশ নাই মনে। আজমতউল্লার মুখে এখন অবিরাম খিস্তি, চোদং মুঁই সংসারকে! না, বিবাহ তার সুখের হয় নাই। কেরানি ঘাটে এসে দ্যাখে পারাপারের খেয়া নাই। খেওয়া কোন্ঠে? আর কোন্ঠে! শালার বিষ্টি দেখিয়া মাংয়ের গত্তে সান্ধাইছে! পা