সাড়ে তিন হাত ভুমি


আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময়টার কথা খুব মনে পড়ছে, মা।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার সিট পড়েছে মুন্সীগঞ্জে। আমাদের কাঞ্চনপুর হাই স্কুল আর লৌহজং থানার কাজীরপাগলা হাই স্কুলের সিট পড়েছিল মুন্সীগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে।
মুন্সীগঞ্জ মহকুমা শহর।
কাঞ্চনপুর থেকে আট-দশ মাইল দূরের পথ। বর্ষাকালে যাতায়াতের ব্যবস্থা নৌকা আর গ্রীষ্মকালে পায়ে হাঁটা। আট-দশ মাইল পথ হেঁটে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আবার এতটা পথ হেঁটে আসা সম্ভব না।
পরীক্ষার সময় বিক্রমপুর অঞ্চলের সব ছাত্রছাত্রী মুন্সীগঞ্জ শহরে এসে কোনো না কোনো বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে। থাকা-খাওয়া বাবদ টাকা-পয়সাও দিতে হয়। তবে শহরে যাদের আত্মীয়স্বজন আছে, তাদের জন্য টাকা-পয়সার কোনো ব্যাপার নেই। যাদের কেউ নেই, তাদের জন্য এক ধরনের মধ্যবিত্ত পরিবার টাকা-পয়সার বিনিময়ে ছাত্রছাত্রীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে।
আমার জন্য তেমন কিছু করতে হয়নি।
বাবার বন্ধু মুন্সীগঞ্জের বিখ্যাত কাদের ডাক্তার।
হরগঙ্গা কলেজের উত্তর দিকটায় ডাক্তার কাকার বাড়ি। আমি সেই বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলাম।
ডাক্তার কাকার পরিবারের সবার কথা আমার এখন মনে পড়ছে না, মা। শুধু দুজন মানুষের কথা মনে পড়ছে। একজন প্রায় আমার বয়সী। ডাক্তার কাকার ছেলে বাবুল আখতার। অসম্ভব সুন্দর গলার স্বর। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করে। রেডিও-টেলিভিশনে খবর পড়ে।
তোমার কানে বাজছে না, মা! রেডিও পাকিস্তান ঢাকা, খবর পড়ছি বাবুল আখতার।
হ্যাঁ, সেই বাবুল আখতার। এখন সে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। সেখান থেকে খবর পড়ে, কথিকা পড়ে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে।
ডাক্তার কাকার আরেকটা ছেলের কথা মনে পড়ছে। সে সবার ছোট কি না মনে পড়ছে না। ছেলেটির তিনটা নাম। এক নাম আজাদ, আরেক নাম জিল্লু। ভালো নাম মুনির কাদের।
কেন যেন ম্যাট্রিক পরীক্ষার কথা তুললাম!
মনে পড়েছে। বাবার সঙ্গে পরীক্ষার তিন দিন আগে রওনা দিয়েছি। পায়ে হেঁটে মুন্সীগঞ্জ যাব। সঙ্গে কদম আছে। আমার বইপত্র কাপড়চোপড়ের স্যুটকেস মাথায় করে নিয়ে যাবে কদম। আমার কাঁধে হালকা একটা ব্যাগ, বাবার কাঁধেও একটা ব্যাগ, কদমের হাতেও একটা ব্যাগ। সেই ব্যাগে নানা রকমের শুকনো খাবার তৈরি করে দিয়েছ তুমি। মুড়ির মোয়া, নারকেলের নাড়ু, তিল-কাউনের নাড়ু। একটা বয়ামে দিয়েছ আমের মোরব্বা। পড়তে পড়তে খিদে পেলেই যেন কিছু না কিছু খেতে পারি আমি।
কিন্তু ওসবের কোনো দরকারই ছিল না, মা। ডাক্তার কাকার বাড়িতে, কাকি আমাকে একদম তোমার মতো করে সামলাতে লাগলেন। এটা খাও বাবা, ওটা খাও। তোমার মা কেন এত সব খাবার দিয়ে দিয়েছেন! আমার বাড়িতে কি খাবারের অভাব! তোমার ডাক্তার কাকা রোজ চিত্তর দোকানের মিষ্টি নিয়া আসেন।
ওই দোকনের ছানার অমিত্তির কোনো তুলনা হয় না, মা।
দোকানের নাম ‘লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। মালিকের নাম চিত্তরঞ্জন। সবাই বলে চিত্ত, চিত্তর মিষ্টির দোকান।
ডাক্তার কাকি আমাকে সকাল-বিকাল মিষ্টি খেতে দিতেন। কী যে স্বাদ সেসব মিষ্টির! মিষ্টি খেতে খেতে তোমার দেওয়া নাড়ু, মোয়া, মোরব্বা আমার খাওয়াই হয় না।
কী কারণে এসব কথা বলছি, মা!
মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। পরীক্ষার জন্য দিন বিশেক মুন্সীগঞ্জে থাকব আমি। যেদিন যাব তার আগের রাত থেকে শুরু হলো তোমার কান্না। যখন-তখন কাঁদছ। আমাকে খেতে দিয়ে, আমি পড়তে বসলে পড়ার টেবিলের সামনে এসে মাথায় হাত রেখে তুমি চোখ মুছছ।
আমি তোমাকে বোঝাই, বাবাও নানা রকমভাবে বোঝান।
আমি বলি, আমি যাচ্ছি পরীক্ষা দিতে আর তুমি কাঁদছ! তোমার এ রকম কান্নাকাটি দেখে গেলে আমার ভালো লাগবে! মন খারাপ হবে না! যখন-তখন তোমার কান্নাভেজা মুখটা আমার চোখে ভাসবে না! আমি ঠিকঠাকমতো পরীক্ষা দিতে পারব? রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাবে না!
তুমি চোখ মুছতে মুছতে বললে, তোরে ছাইরা এত দিন আমি কোনো দিন থাকছি!
আমাদের বাড়িতে সবাই আমরা বইয়ের ভাষায় কথা বলি। একেবারে শুদ্ধ ভাষা। শুধু তুমি শুদ্ধ-অশুদ্ধ মিলিয়ে বলো। শুদ্ধর সঙ্গে বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষার মিশেল দিয়ে কথা বলো।
তোমার সেই ভাষা এ জীবনে আমার আর কখনো শোনা হবে না, মা। পাকিস্তানি বুনো কুকুরগুলো, সঙ্গে তাদের দোসররা ছিল, তারা চিরতরে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল তোমাকে।
আমি কী বলব, মা!
ওদেরকে আমি এখন কী বলব!
পৃথিবীর এমন কোনো কুৎসিত গাল নেই, যা দিলে সত্যিকার গাল দেওয়া হবে ওদেরকে।
আর গাল দিতে তো আমি শিখিনি, মা।
তোমার মতো মা, বাবার মতো বাবা, তোমরা যে কী যত্নে, কী মমতায় এবং রুচিস্নিগ্ধতায় আমাকে আর বকুলকে বড় করেছ, কোন মানুষের এমন ভাগ্য হয় তোমাদের মতো মা-বাবা পাওয়ার!
ম্যাট্রিক পরীক্ষার কথা বলি, বাবার কথা বলি।
মানে বাবা তোমাকে ওসময় কী বুঝ দিয়েছিলেন ওসব কথা আর কি!
তোমার কান্নাকাটি দেখে বাবা আগের দিন সন্ধ্যায় বললেন, ছেলে যাচ্ছে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে আর তুমি কেঁদেকেটে বিনাশ করছ!
বাবার কথা শুনে তুমি রেগে গেলে- বিনাশ করছি অর্থ কী?
মানে তোমার কান্না দেখে ছেলের মন খারাপ হচ্ছে।
আর আমি যে এত দিন আমার ছেলেরে না দেইখা থাকুম আমার মন খারাপ হয় না! আমার চোখে পানি আসে না!
আমিও তো এত দিন আমার ছেলেকে কখনো না দেখে থাকিনি। ঢাকায় গিয়েছে আমাদের সঙ্গে। কখনো কখনো দু-চার দিন বেলার ওখানে থেকেছে, কিন্তু বিশ দিন একসঙ্গে থাকেনি। এবার পরীক্ষার জন্য তাকে থাকতে হচ্ছে। আমি কি আমার ছেলেকে কম ভালোবাসি? কই, আমি তো কাঁদছি না, আমার চোখে তো পানি আসছে না!
বাপ আর মা এক জিনিস না। মার কলিজা ছেলেমেয়ের জইন্য যেইভাবে পোড়ে, বাপের সেইভাবে পোড়ে না।
আমি আমার পড়ার ঘর থেকে বারান্দায় তোমাদের দুজনের এসব কথা শুনি আর মনে মনে হাসি। আট-দশ মাইল দূরের মুন্সীগঞ্জে যাচ্ছি পরীক্ষা দিতে, দিন বিশেক থাকব, ওই নিয়ে তোমরা কত কথা বলছ!
কিন্তু মা, মুন্সীগঞ্জ গিয়ে প্রথম দু-চার দিন তেমন কিছু মনে হলো না। তার পর থেকে তোমাদের জন্য খুবই মন খারাপ হতে লাগল। যখন-তখন তোমাদের কথা মনে হয়, রাতের বেলা ঘুম আসতে চায় না। পরীক্ষার মাঝখানে এক-দুদিনের গ্যাপ থাকে, ইচ্ছে করে এক দৌড়ে বাড়ি চলে যাই, তোমার মুখটা একটু দেখে আসি। বাবার মুখটা, আর আমার বকুলটার মুখটা একটু দেখে আসি।
যদিও ওই বিশ দিনে চারবার বাবা আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন, তবু আমার মনটা খারাপ হয়ে থাকত।
ডাক্তার কাকি আমাকে খুবই আগলে রাখেন। তিনিও তো মা। আমার মনটা তিনি বুঝতে পারেন। পড়তে বসে আমি গেছি উদাস হয়ে, পেছন থেকে এসে তিনি আমার মাথায় হাত দিলেন, কী হইছে বাজান?
না, কিছু না।
মনটা খারাপ দেখতাছি।
কই?
হ বাবা। আমি দূর থিকা তোমারে খেয়াল করছি। তোমার মনটা ভালো নাই। মা-বাবার কথা মনে পড়তাছে?
জি না কাকি। তেমন কিছু না।
আমি বুঝি বাজান। আমিও তো মা। আমার ছেলেরা বাইরে গিয়া থাকলে তাগো যেমন আমার জন্য খারাপ লাগে, আমারও খারাপ লাগে তাগো জন্য। ওই দিকে তোমার মা তোমার জন্য মন খারাপ করতাছেন আর এই দিকে তুমি করতাছ মায়ের জন্য।
বাবার কথাও আমার খুব মনে হয়। বকুলের কথা মনে হয়।
এই তো কয়টা মাত্র দিন। পরীক্ষা শেষ হইলেই তো মা-বাবার কাছে চইলা যাইবা, বইনের কাছে চইলা যাইবা। এখন মন খারাপ কইরো না। তাইলে পরীক্ষা খারাপ হইব।
না, পরীক্ষা আমার খারাপ হয়নি, মা। আর্টস থেকে ফার্স্ট ডিভিশন পেলাম আমি। অঙ্কে লেটার মার্কস।
কিন্তু মুন্সীগঞ্জ থেকে ফেরার সময় অন্য কারণে আবার মন খারাপ। চলে আসার দিন দেখি ডাক্তার কাকি ঘন ঘন আঁচলে চোখ মোছেন। আমি এতগুলো দিন তাঁর কাছে ছিলাম, নিজের ছেলেদের মতো করে আমার দেখভাল করেছেন, আমাকে আগলে রেখেছেন, এখন আমি চলে যাচ্ছি আর তিনি চোখের জলে ভাসছেন।
আহা রে, কী ভালো আমার দেশের মায়েরা!
এমন মমতাময়ী মা পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে!
ম্যাট্রিক পাস করার পর কলেজে পড়তে চলে গেলাম ঢাকায়। তোমাদের দীননাথ সেন রোডের বাড়িতে থাকি, ভর্তি হয়েছি জগন্নাথ কলেজে। কখনো লোহারপুলের ওদিক দিয়ে ফরাশগঞ্জ, শ্যামবাজার, বাংলাবাজার হয়ে কলেজে যাই, কখনো যাই ডিস্টিলারি রোডের ওদিক দিয়ে, কাঠেরপুল পার হয়ে প্যারীদাস রোড হয়ে সোজা বাংলাবাজারের দিকে।
রিকশায় চড়তে আমার ভালো লাগে না। আমার হাঁটতে ভালো লাগে। হেঁটে হেঁটে কলেজে যাই। এই নিয়ে মায়া আমাকে কিপটা কিপটা বলে খেপায়। এত বড়লোকের ছেলে, সে কলেজে যায় হেঁটে!
মায়া তখন মনিজা রহমান গার্লস স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে।
তোমাকে একটা খবর দিই, মা। একটা না, দু-তিনটা খবর দিই। তোমাদের বাড়িটা হচ্ছে সাধনা ঔষধালয়ের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে তার একেবারে শেষ মাথায়। সাধনার প্রতিষ্ঠাতা শ্রীযোগেশচন্দ্র ঘোষকে তো তুমি চেনোই। এপ্রিলের ৪ তারিখে তাঁকে গুলি করে মেরেছে দানবগুলো। তিনি সাধনা ঔষধালয়ের ভেতরেই ছিলেন, তাঁর ঘরে। ওই বয়সী মানুষটাকে ওরা গুলি করল।
মনিজা রহমান গার্লস স্কুলের হেড মিস্ট্রেস বাসন্তী আপাকেও তুমি চিনতে। মানে নামে চিনতে। বাসন্তী গুহঠাকুরতা। তাঁর স্বামী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। পঁচিশে মার্চ রাতেই ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে তাঁকে গুলি করা হয়। তার পরও তিনি চার-পাঁচ দিন ঢাকা মেডিক্যালে বেঁচে ছিলেন। বাসন্তী আপা তাঁর একমাত্র মেয়ে দোলাকে নিয়ে যে কোথায় আছেন এখন?
আর গেণ্ডারিয়া হাই স্কুলের হেডমাস্টার সুধীর স্যার, বেঁচে আছেন না মারা গেছেন জানতেই পারিনি।
আমি কলেজে ভর্তি হব, তোমরা সবাই এ উপলক্ষে ঢাকায় এলে। যেন বিশাল একটা উৎসব শুরু হলো আমাকে নিয়ে। আমি বেলা খালার বাড়িতে থেকে জগন্নাথে পড়ব।
আমরা সব সময় বলতাম বেলা খালার বাড়ি।
বেলা খালা মাঝে মাঝে হাসতেন। বেলা খালার বাড়ি বলছিস কেন? এই বাড়ি তো তোর মায়েরও। তোর মার অর্ধেক, আমার অর্ধেক। দুটো ভাড়াটে আছে, কিছু টাকা ভাড়াও পাওয়া যায়। তোর মা সেই টাকা নেয় না। ছোট বোনকে দিয়ে দেয়। আমাদের দুই বোনের ভালোবাসা যে কী রকম, সেটা তোরা বুঝবি না।
মা, আমি কিন্তু বুঝতাম। বেলা খালা যে তোমার জান, এটা আমি টের পেতাম। খালাকে তুমি পরিষ্কার বলে দিয়েছিলে, ওই বাড়ি তোরই। আমার অনেক আছে। আমার ওই বাড়ি লাগবে না। শুধু আমার ছেলেমেয়ে দুটি যখন ঢাকায় পড়তে যাবে, তখন ওই বাড়িতে থাকবে। অর্থাৎ তোর কাছে থাকবে। কারণ একটাই, মায়ার মতো আমার ছেলেমেয়ে দুটিকেও তুই একই রকম ভালোবাসবি, একই রকম আদর করবি।
খালা তোমাকে ডাকে ‘বুজি’।
বিক্রমপুরের ভাষা। বুজি মানে বুবু, আপা।
তোমার কথা শুনে বেলা খালা বলত, এই সব কথা কেন বলো, বুজি? তোমার ছেলেমেয়ে তো আমারই ছেলেমেয়ে। মায়ার সঙ্গে বকুলের কি কোনো ব্যবধান আছে! আর রবি হচ্ছে তোমার-আমার দুজনেরই একমাত্র ছেলে।
দীননাথ সেন রোডে তোমাদের বাড়িটা গ্রামের বনেদি বাড়ি ধরনের।
বাড়ির সামনে তিন-চারটা লিচুগাছ। তারপর টিনের চৌচালা সুন্দর একটা বসার ঘর। বাড়ির চারদিকে ঢেউটিনের বেড়া। গেটটা কাঠের। তারপর দক্ষিণমুখী দোতলা টিনের বিশাল একটা ঘর। ওপর-নিচ মিলিয়ে সাত-আটটা কামরা। পেছন দিকে আরো দুটো বেশ বড় সাইজের টিনের ঘর। ওই দুই ঘরেও তিন-চারটা করে কামরা। দুই ঘরে দুটো পরিবার ভাড়া থাকে। এক ঘরে শান্তি আপারা, অন্য ঘরে হারুনরা। দুই ঘরের জন্য দুটো রান্নাঘর, আলাদা চাপকল আছে, আলাদা গোসলখানা, পায়খানা। ভাড়া কত হবে? দুই ঘরের ভাড়া বোধ হয় দেড় শ দেড় শ তিন শ টাকা। আগে তো ইলেকট্রিসিটিও ছিল না। দু-তিন বছর হলো ইলেকট্রিসিটি এনেছে খালা।
বেলা খালার পরিবারের জন্য একেবারেই আলাদা ব্যবস্থা।
চাপকল আলাদা। চাপকলের সঙ্গে পানি জমিয়ে রাখার জন্য পাকা একটা হাউস। তার দক্ষিণ পাশে চারদিকে ইটের দেয়ালঘেরা গোসলখানা, পায়খানা। রান্নাঘরটা দোতলা ঘরের পশ্চিমে। তারও পশ্চিমে দু-তিন কাঠা খোলা জায়গা। সেখানে বাগান করেছে খালা। একটা জামরুলগাছ আছে। দুটো আমগাছ, পেয়ারা, বরইগাছ আছে। শীতকালে খালা নিজ হাতে সবজির চাষ করে- লাউ, কুমড়া, শিম, ঢেঁড়স, ডাঁটা, টমেটো, বেগুন। বাগানের দিকটা বেশ সবুজ। তাকালেই ভালো লাগে।
খালার কাজের লোক দুজন, মাজেদা আর মাজেদার স্বামী, কী যেন নাম লোকটার? ওদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। নাকি ছিল, মারাটারা গেছে!
ইস্, কেন যে মনে পড়ছে না!
যা ইচ্ছে হোক গিয়ে। ওরা থাকে দোতলা ঘরের নিচতলা একটা কামরায়। ওপরে খালা আর মায়া। আমারও জায়গা হলো ওপরেই। দোতলার সামনে সুন্দর রেলিং দেওয়া বারান্দা। বারান্দার সঙ্গেই কামরাগুলো। দক্ষিণমুখী বারান্দা। বিকেলের দিকটায় ওই বারান্দায় বসলে কী যে ভালো লাগে! বাইরে ফুরিয়ে যাচ্ছে একেকটা মনোরম বিকেল। বাড়ির দক্ষিণ দিকটায় হালিম ভাইদের বিশাল জলাভূমি। সারা বছর কচুরি ভর্তি। এমন ঘন কচুরি, পানি দেখাই যায় না। আর পুব-দক্ষিণ কোণে গেণ্ডারিয়া রেলস্টেশন। খালার বাড়ির পুব দিকে বাঁধানো ঘাটলার একটা পুকুর আছে। পুকুরের পানিটা জসীম উদ্দীনের কবিতার মতো। কাকচক্ষু জল। অর্থাৎ কাক পাখির চোখের মতো স্বচ্ছ পানি।
খালার বাড়ির উত্তর পাশে, রাস্তার ওপারে, পুরনো আমলের, আমাদের এই বাড়ির মতো একতলা একটা দালানবাড়ি। নিশ্চয় মাঝারি সাইজের কোনো হিন্দু টাকাঅলা লোকের বাড়ি ছিল। পুকুরটা তাদেরই। পার্টিশনের সময় হয়তো কোনো মুসলমান কিনে নিয়েছেন পুকুরসহ।
বাড়ির মালিক ভদ্রলোককে আমি চিনি। নামটা এখন মনে করতে পারছি না। বাড়ির ছেলেমেয়েগুলোকেও চিনি। মেয়েগুলোর নাম ফিরোজা, মমতাজ ও কোহিনূর। ছেলেটার নাম রঞ্জু। শুধু ভদ্রলোকের নাম মনে করতে পারছি না।
পুকুরটার ওপারে বেশ কিছুটা উঁচু জমি। অর্থাৎ পুকুরের পাড়। সেখানটায় কয়েকটা ছাপরাঘর তুলে থাকে কয়েকটি পরিবার। জায়গাটা নিশ্চয়ই রেলের খাসজমি। কারণ ওই ছাপরাঘরগুলোর ঠিক পেছনেই বিশ-ত্রিশ হাত চওড়া নালা, তারপর রেললাইন। ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে রেল যায় নারায়ণগঞ্জে। যাওয়ার পথে গেণ্ডারিয়া স্টেশন আর পাগলা স্টেশনে থামে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেরার সময়ও ওভাবেই দুটো স্টেশন ধরে আসে।
ভোররাতের দিকে ঢাকা থেকে যেত একটা ট্রেন। দূর থেকে সেই ট্রেনের হুইসল ভেসে আসত। ঘুমের ভেতর থেকে সেই শব্দ পাই আমি। মনে হতো স্বপ্নের রেলগাড়ি যায়।
আরেকটা ট্রেন যায় দুপুরের ঠিক পর পর। ওটা আসে নারায়ণগঞ্জ থেকে।
নিজের ঘরে বসে মায়া হয়তো তখন গ্রামোফোন বাজাচ্ছে। গ্রামোফোনে বাজছে হেমন্তের গান।
‘ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো
এখন কত দূরে
আজ আসে না রাজার কুমার পঙ্খীরাজে উড়ে’
কী যে স্নিগ্ন নির্জন একেকটা দুপুর! কী যে মনোরম একেকটা বিকেল! খালার বাড়ির লিচুগাছগুলো তোলপাড় করছে হাওয়ায়। আমি হয়তো গিয়ে বসে আছি ফিরোজাদের পুকুরঘাটে। উদাস চোখে তাকিয়ে আছি রেললাইনের দিকে।
কোনো কোনো দিন মালগাড়ি যায় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে। ইট রঙের বগি। এত বগি একেকটা মালগাড়ির! যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, শেষ হয় না। পুকুরঘাটে বসে কিংবা দোতলার রেলিংয়ে বসে আমি মালগাড়ির বগি গুনি। এক, দুই, তিন…
বগি গোনা আর শেষ হয় না।
কিন্তু সেই চৈত্র মাসের দুপুরবেলা মুসাফির টাইপের লোকটা এসে যে সরাসরি আমাদের ভিতরবাড়িতে, রান্নাঘরের ওদিকটায় চলে এলো, লোকটা কে? এভাবে বাড়ির ভেতর এসে ঢুকল কেন?
(চলবে)