সাড়ে তিন হাত ভুমি


চৈত্র মাসের দুপুরবেলাটা গুমোট হয়ে আছে।
কোথাও হাওয়া নেই, হাওয়ার চলাচল টের পাওয়া যায় না। হঠাৎ মাঠের দিকে তাকালে দেখা যায় আচমকা উঠেছে চৈতালি ঘূর্ণি। একটা জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাওয়া। ঘুরে ঘুরে মাঠের ধুলোবালি আর খড়কুটো নিয়ে কোনো একটা দিকে এগোচ্ছে।
আমাদের এলাকায় এই ঘূর্ণিকে বলে ‘বানাডুলি’।
ছেলেবেলায় তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে মা, স্কুল থেকে ফেরার সময়, বা মাঠের দিকে দুপুরবেলা গেলে, নির্জন মাঠে বানাডুলি দেখলেই যেন বুকে থুতু দিই।
কেন বলেছিলে?
আমার মনে আছে, মা। আমি তোমার কোনো কথাই ভুলিনি। সেই কবে কোন ছেলেবেলায় বানাডুলি দেখলে বুকে থুতু ছিটাতে হবে, সে কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে। আমাদের বাঁশঝাড়ে যে তেনায় থাকতেন, ও রকম তেনারা নাকি কোনো কোনো নির্জন দুপুরে, বিশেষ করে চৈত্র মাসের নির্জন দুপুরে বিল-বাদাড়ে, মাঠঘাটে চরতে বেরোন। চৈত্রের রোদ তাঁদের খুব পছন্দ। রোদ গায়ে মেখে কিছুক্ষণ চলাচল করেন তেনারা। ওই চলাচলের সময় ঘূর্ণি হাওয়ার রূপ ধারণ করেন। ঘুরতে ঘুরতে একসময় তারপর কোথায় যে মিলিয়ে যান, কেউ তা জানে না।
কিন্তু ওই সময় তেনাদের সামনে পড়লে বিপদ। ওই হাওয়ার মধ্যে পড়লে বিপদ।
তখনই কিছু হবে না। বাড়ি ফিরে আসার পর জ্বর হবে। সেই জ্বর একমুহূর্তের জন্যও কমবে না। জ্বরে জ্বরে মরতে হবে। মরণ অবধারিত।
তবে বুকে থুতু ছিটালে তেনারা সামনে আসেন না। তেনারা সবচাইতে ঘেন্না করেন মানুষের থুতু। থুতুর বদগন্ধে অন্যদিকে চলে যান। মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা পর্যন্ত করেন না।
বারেকের মাও শিখিয়েছিল একই রকম কথা। বারেককে, আমাকে। নির্জন দুপুরে বাঁশঝাড়তলায় গেলে, মাঠঘাটে গেলে, আচমকা বাঁশঝাড় দুলে উঠতে দেখলে, মাঠঘাটে বানাডুলি দেখলে, সঙ্গে সঙ্গে যেন বুকে থুতু ছিটাই আমরা।
কিন্তু বারেক কি সেদিন বুকে থুতু ছিটিয়েছিল, মা!
মায়ের মার খেয়ে বাঁশঝাড়তলার দিকে চলে গেল, তারপর যে তেনায় বারেককে বাগে পেয়ে ওদিককার কাদাভর্তি পুকুরের তলায় এমন করে পুঁতে দিলেন, বারেকের লাশও কোনো দিন ভেসে উঠল না!
আহা রে, বারেকটা যে কেন এমন করল! মায়ের মার খেয়ে কেন যে বুকে থুতু ছিটাতে ভুলে গেল! তাহলে তো ওভাবে মরতে হয় না তাকে।
সম্পূর্ণ ছেলেবেলাটা, বারেকের কথা মনে হলেই এ কথাটা ভাবতাম আমি। রাতদুপুরে বারেকের মায়ের গুমরে গুমরে কান্না আর বিলাপ শুনে যে রাতে আমার ঘুম ভাঙত, বুকে থুতু ছিটানোর কথাটা আমার মনে হতো।
আর মনে হতো তোমার কথা। মা, মাগো, তোমার কথা মনে হতো। ওই তো পাশের ঘরেই বকুলকে বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে আছ তুমি। তবু মনে হতো। মনে হতো, বারেকের জায়গায় যদি হতাম আমি আর বারেকের মায়ের জায়গায় হতে তুমি, তাহলে তুমিও তো রাতে ঘুমাতে পারতে না। গভীর রাতে উঠানে বারান্দায়, রান্নাঘর গোয়ালঘরের সামনে বসে আমার জন্য গুমরে গুমরে কাঁদতে। বারেকের মায়ের মতো বিলাপ করতে। রবি রে, আমার রবি। আমারে ছাইড়া তুই কই চইলা গেলি, বাজান? আমার কথা তোর মনে হয় না? আমার লেইগা তোর মায়া লাগে না? মনডা কান্দে না মার লেইগা? মারে ছাইড়া তুই থাকস কেমনে? কে তোরে ডাইকা আইনা ভাত খাওয়ায়! কে তোরে নাওন-ধোওনের কথা কয়! কে তোরে ঘুমানোর সময় মাথায় হাত বুলাইয়া দেয়! ও রবি, রবি!
এসব ভেবে আমার চোখে পানি আসত, মা। বারান্দা কিংবা উঠানে বসে, রান্নাঘরের সামনে কিংবা গোয়ালঘরের ওদিকটায় বসে যে রাতদুপুরে বারেকের মা ওভাবে কাঁদত আর বিলাপ করত, এদিকে আমার ঘরে শুয়ে ঘুমভাঙা আমি কোনো কোনো রাতে চোখের জলে ভাসতাম। বারেকের মায়ের জায়গায় তোমাকে ভাবতাম, মা। বারেকের জায়গায় ভাবতাম আমাকে।
দিনে দিনে দিন কেটে গেল। বারেকের কথা ভুলে গেলাম আমরা। দশ বছরের একজন বারেক আমাদের সংসারে ছিল, সে এখন আর নেই।
আমরা তো ভুললামই, বারেকের মাও বোধ হয় ভুলল।
মায়ের মন পুরোপুরি হয়তো ভোলে না। মনের অনেক ভিতরে চাপা পড়ে গেল বারেক। দু-চার মাসে হয়তো একদিন হারিয়ে যাওয়া ছেলেটির কথা সে ভাবত, হয়তো একটু চোখের পানি ফেলত, কিন্তু রাত জেগে সেই গুমরে গুমরে কাঁদা আর বিলাপ করাটা তার বন্ধ হয়েছিল।
এ সময় চৈত্র মাসের এক দুপুরে এলো সেই মুসাফির। ধূলিধূসর পা, মাথায় গোল সাদা টুপি, মুখে চাপদাড়ি, মোচ নেই। নাকের তলাটা কামানো। পরনে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা পাঞ্জাবি, তার তলায় লুঙ্গির একটুখানি দেখা যাচ্ছে। কাঁধে রেক্সিনের খয়েরি রঙের চটে যাওয়া ব্যাগ। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঢুকে গেছে আমাদের ভিতরবাড়িতে, রান্নাঘরের ওদিকটায়।
কদিন হলো বাড়িতে এসেছি আমি। কলেজ বন্ধ। বাবা স্কুলে। বকুল সেদিন স্কুলে যায়নি। চৈত্র-বৈশাখ মাসের দিকে প্রতিবছরই তখন দু-চার দিন জ্বরে ভুগত বকুল। এই জ্বরটা ওর বাঁধা ছিল।
সেদিনও জ্বর বকুলের।
খানিক আগে বারেকের মা আর পারুল তার মাথায় পানি দিয়েছে। পানি দেওয়া শেষ করে মাথা মুছিয়ে দুধ-বার্লি খেতে দিয়েছে। নাকি দুধের সঙ্গে সাগুদানা ভিজিয়ে দিয়েছিল, মনে করতে পারছি না, মা।
জ্বরের সময় একদমই খেতে চাইত না বকুল। তুমি সামনে বসে চামচে করে খাওয়াতে। বকুল শিশুর মতো মাথা দোলাত, কাঁদো কাঁদো মুখে বলত, আর খাব না, মা। আর খাব না। আমার বমি আসছে।
তুমি বুঝিয়ে-শুনিয়ে খাওয়াতে। আরেকটু খা মা, আরেকটু। না খাইলে শরীল দুর্বল হইব। দুধ-বার্লি খাইলে, দুধ-সাগু খাইলে জ্বর তাড়াতাড়ি কমে। তোর ডাক্তার কাকা বইলা গেছেন।
ডাক্তার কাকা মানে গগন ডাক্তার।
কাঞ্চনপুর বাজারে গগন ডাক্তারের ডিসপেনসারি। তাঁর কম্পাউন্ডার হরিপদ। ডাক্তার কাকা দেশগ্রামের খুবই নামকরা ডাক্তার। রোগী দেখতে ভিজিট নিতেন দুই টাকা। কিন্তু আমাদের বাড়ির কাউকে দেখে ভিজিট নিতেন না। বাবার বন্ধু মানুষ। আমাদেরকে নিজের ছেলেমেয়ের মতো দেখতেন। পার্টিশনের পর দেশগ্রামের বেশির ভাগ সচ্ছল হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছে। ডাক্তার কাকা যাননি। মাঝারি ধরনের অবস্থাপন্ন মানুষ। ইচ্ছে করলেই কলকাতার ওদিকে গিয়ে বাড়িঘর করে ভালোই থাকতে পারতেন। আরামে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি দেশ ছাড়েননি। বাবাকে বলতেন, যেই মাটিতে জন্মাইছি, এই মাটিতেই মরুম। নিজের মাটি ছাইড়া যামু না রে, মতি।
নিজে তো যানইনি, ছেলেমেয়েদেরও যেতে দেননি। দুই ছেলেই দেশে। একমাত্র মেয়ে প্রতিমার বিয়ে দিয়েছেন শ্রীমঙ্গলে। মেয়ের জামাই সেখানকার এক চা বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।
ডাক্তার কাকা আমাদের বাড়িতে রোগী দেখতে এলেই প্রথমে তোমাকে ডাকতেন, মা।
আচ্ছা, ডাকতেন বলছি কেন? ডাক্তার কাকা তো এখনো বেঁচে আছেন। তাঁর দুই ছেলে ঢাকায় থাকে। বড় ছেলে নবীন ইনস্যুরেন্স কম্পানিতে চাকরি করে। ছোট ছেলে কিশোর ভাইয়ের কাছে থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বকুলের বয়সী হবে।
ডাক্তার কাকা কি গ্রামে আছেন, মা?
তাঁর ছেলেরা নিশ্চয়ই ঢাকায় নেই। নবীন আমার বয়সী। তবে বিয়ে করেনি। নবীন আর কিশোর- দুজনই কি মুক্তিযুদ্ধে গেছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, গেছে তো!
দুজনই মুক্তিযুদ্ধে গেছে। এ কথা আমি আগেই শুনেছি। ভুলে গিয়েছিলাম কেন!
আমার এখনকার অবস্থাটা কী রকম জানো, মা! এই এক কথা মনে পড়ছে, এই আরেক কথা মনে পড়ছে। বহু আগের কথা চলে আসছে পরে, অনেক পরের কথা চলে আসছে আগে। চিন্তাচেতনা একদম এলোমেলো। পরিষ্কার করে ভাবতে পারছি অনেক কিছুই, আবার অনেক কিছুই পারছি না, মা। ভাবতে পারছি। মাথার ভিতরে একবার ঢুকছে চাঁদের আলো, চিন্তার জায়গাটা আলোকিত হচ্ছে, আবার ঢুকে যাচ্ছে অন্ধকার। সব ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে। আকাশের চাঁদ যেমন হঠাৎ হঠাৎ ঢেকে দেয় গভীর কালো মেঘ, তারপর সরে যায়, সরে যাওয়ার পর যেমন আগের মতো আলোকিত হয় চারদিক, আমার মাথার ভিতরটা সেভাবে একবার আলোকিত হচ্ছে, আবার সেই আলো ঢেকে যাচ্ছে মেঘে।
আমার কি এমন হওয়ার কথা, মা!
একজন যোদ্ধার কি এমন হওয়ার কথা! যোদ্ধা যেকোনো ধরনের পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকে। নিজের জীবনের মায়া যোদ্ধাকে মানায় না। যোদ্ধা জীবন দেবে হাসিমুখে। যোদ্ধা কোনো মৃত্যু দেখে কষ্ট পাবে না, চিন্তাচেতনা এলোমেলো হবে না তার। যুদ্ধক্ষেত্রে লাশের পর লাশ সে দেখবে নির্বিকার চোখে, নির্বিকার দৃষ্টিতে।
আমি পারছি না কেন, মা!
অথবা পারছি। চোখে পানি আসছে না আমার। যোদ্ধার চোখে পানি মানায় না।
কিন্তু চিন্তাচেতনা এলোমেলো হচ্ছে কেন?
বাড়িতে এসে এ রকম দৃশ্য দেখব ভাবা তো দূরের কথা, কল্পনাও করিনি বলে কি এমন হচ্ছে! আচমকা এক কিশোর আমি কি পড়েছি চৈতালি কোনো ঘূর্ণির মধ্যে!
বড় হয়ে জেনেছি, চৈতালি ঘূর্ণির সঙ্গে তেনাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ওটা প্রকৃতির খেলা। ও রকম প্রকৃতির খেলা কি ঢুকে গেছে আমার বুকে আর মাথায়! আমার চিন্তাচেতনা কি ঘুরপাক খাচ্ছে বানাডুলির মতো! ফেলে আসা জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা কি মাঠের ধুলোবালি আর টুকরোটাকরা খড়কুটোর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়! মাথা স্থির করতে পারছি না আমি।
মুসাফির লোকটার কথা বলি মা, মুসাফির লোকটার কথা বলি।
সরাসরি এসে ঢুকেছে আমাদের ভিতরবাড়িতে। বুয়া আর পারুল বকুলের মাথায় পানি দিয়ে যে যার কাজে গেছে। তুমি বকুলকে জ্বরের পথ্য খাইয়ে দিয়েছ। আমি বড় পুকুরে অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে গোসল করে এসেছি। কদম স্কুলে গেছে বাবার দুপুরের খাবার নিয়ে।
পুরনো আমলের পিতলের একটা টিফিন ক্যারিয়ারে স্কুল খোলা থাকার দিনগুলোয় দুপুরের মুখে মুখে বাবার খাবার নিয়ে যেত কদম। বাবার খাওয়া হলে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ফিরে আসত।
কদম তখনো ফেরেনি।
মুসাফির লোকটাকে প্রথমে দেখল পারুল। বুয়ার সঙ্গে রান্নাঘরে ছিল। কী কাজে ওদিককার উঠান পেরিয়ে দালানঘরের বারান্দার দিকে আসছে, দেখে গোয়ালঘর ছাড়িয়ে ঢেঁকিঘরের ওদিকটায় এসে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা এক মুসাফির।
সঙ্গে সঙ্গে মাথায় ঘোমটা দিয়েছে পারুল। লোকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, কেডা, আপনে কেডা?
মুসাফির কথা বলে না। অপলক চোখে পারুলের দিকে তাকিয়ে আছে।
পারুল বিরক্ত। কথা কন না ক্যাঁ? কে আপনে? চিনা নাই জানা নাই বাড়ির ভিতরে আইসা ঢুকছেন?
মুসাফির তবু কথা বলে না। আগের মতোই তাকিয়ে আছে পারুলের দিকে।
পারুল এবার রাগল। আরে, কোন পদের মানুষ আপনে? কথা কইতে পারেন না? নাকি বোবা! কই থিকা আইছেন? চান কারে?
পারুলের চড়া গলা শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছে বুয়া। কী হইছে রে, পারুল? কার লগে চিল্লাস? কে আইছে বাড়িতে?
বুয়াকে দেখে মুসাফির লোকটা পারুলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়েছে তার দিকে। ফিরিয়ে পারুলের দিকে যে রকম অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল, সেভাবেই তাকাল বুয়ার দিকে। তাকিয়েই রইল। চোখ দুটো ছলছল করছে।
এই দৃশ্য আমি দেখতে পেয়েছিলাম আমার রুম থেকে।
গোসল সেরে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরেছি। দেয়ালে ঝোলানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁকই দিয়ে মাথা আঁচড়িয়েছি। খানিক পর খেতে বসব। বাইরে অচেনা এক মুসাফির, তার অদূরে পারুল আর বুয়া। পারুলের কথার কোনো জবাবই দিচ্ছে না মুসাফির। তাকিয়ে ছিল পারুলের দিকে। বুয়াকে দেখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। এখন চোখ ছলছল করছে।
ঘটনা কী?
লোকটা কে?
আমি বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। কিছু একটা বলতে যাব, তার আগেই দেখি মুসাফির লোকটা যেভাবে তাকিয়ে আছে বুয়ার দিকে, বুয়াও সে রকম অপলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। মুখটা একটু যেন হাঁ হয়ে আছে।
পারুল একবার মুসাফিরের দিকে তাকায়, একবার বুয়ার দিকে তাকায়।
বারান্দায় বেরিয়ে দুজন মানুষের এই অবস্থা দেখে আমিও তাকিয়ে তাকিয়ে দুজনকে দেখছি। কথা বলতে পারছি না।
মুসাফির লোকটা কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামাল উঠানে। ছলছল চোখে এগিয়ে গেল বুয়ার কাছে।
বুয়া তখনো কথা বলছে না। আগের মতোই তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। কাছাকাছি আসতেই বিড়বিড় করে বলল, কে? কে রে? বারেক, আমার বারেক!
সঙ্গে সঙ্গে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল লোকটা। হ গো মা, আমি বারেক। আমি তোমার পোলা বারেক।
দুহাতে পাগলের মতো মাকে জড়িয়ে ধরল বারেক। হাউমাউ করে কাঁদতেই লাগল। আমি বারেক, মা। আমি বারেক। তোমার পোলা।
আশ্চর্য ব্যাপার, ছেলে উধাও হয়ে যাওয়ার পর যে মা রাতের পর রাত উঠান বারান্দায় বসে, রান্নাঘর ঢেঁকিঘরের ওদিকটায় বসে, কোনো কোনো দুপুর কিংবা রাতে গোয়ালঘরের ওদিকে গিয়ে গুমরে গুমরে ছেলের জন্য কাঁদত, বিলাপ করত, সেই মা আজ আশ্চর্য রকমের নির্বিকার। ছেলে জড়িয়ে ধরেছে মাকে, কাঁদছে বুকফাটা কান্না, কিন্তু মা কাঁদছে না। তার চোখে পানি নেই, তার কোনো আবেগ নেই। ছেলেকে সে জড়িয়ে ধরেনি। যেন গাছ কিংবা পাথর হয়ে আছে। বারেক যেন একটা গাছ জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। বারেক যেন মানুষের মতো দেখতে একটা পাথর জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
বাড়িতে ততক্ষণে সাড়া পড়ে গেছে।
মুসাফির লোকটা বারেক জানার পরই দৌড়ে বকুলের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে পারুল। তোমাকে খবর দিয়েছে, মা। ভীষণ উত্তেজিত সে। হাঁপাতে হাঁপাতে তোমাকে বলল, বিরাট কারবার হইয়া গেছে গো, আম্মা। বিরাট কারবার। বুড়ির পোলায় ফিরত আইছে। বারেক, বারেক ফিরত আইছে।
শুনে তুমি হতভম্ব হয়ে গেছ। বারেক ফিরত আইছে!
হ গো আম্মা, হ। রান্ধনঘরের সামনে বুড়িরে প্যাঁচাইয়া ধইরা কানতাছে। আপনে তাড়াতাড়ি আসেন। আইসা দেখেন।
তুমি তো সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেই, জ্বর শরীরে বকুলও এলো তোমার পিছন পিছন। আমরা তিনজন মানুষ বারান্দায়। পারুল গিয়ে দাঁড়িয়েছে উঠানে। রান্নাঘরের সামনে বুয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে বারেক। বুয়া আগের মতোই নির্বিকার।
যে শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিল তার ছেলে জীবিত নেই, বাঁশঝাড়ের তেনায়ই শেষ করেছেন ছেলেকে, সেই মৃত ছেলে এগারো বছর পর ফিরে এসেছে, কিন্তু মা নির্বিকার। এ তো আশ্চর্য ঘটনা!
বারেককে দেখে যতটা না অবাক আমরা, তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক বুয়ার কাণ্ড দেখে।
কেন এমন গাছ হয়ে আছে সে!
কেন এমন পাথর হয়ে আছে!
(চলবে)