সাড়ে তিন হাত ভুমি


মা, তুমি তো অনেকবার ঢাকায় গিয়েছ।
পদ্মায় তোমাদের বাড়ি ভেঙে যাওয়ার পর নানা গ্রামে আর বাড়িই করেননি। ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় গিয়ে, দীননাথ সেন রোডের একেবারে শেষ মাথায় বিঘাখানেক জমির ওপর একটা বাড়ি করলেন। তোমরা দুভাই, দুবোন। আমাদের মতো না হলেও নানারও ভূসম্পত্তি কম ছিল না। ওসব বিক্রি করে তিনি দুই ছেলেকে দশ কাঠা দশ কাঠা করে জমি কিনে আলাদা আলাদা বাড়ি করে দিলেন ঢাকায়। জলু মামাকে দিলেন মগবাজারে, মাবু মামাকে আজিমপুরে। দীননাথ সেন রোডের বাড়িটা তোমাদের দুবোনের।
নানা-নানি যত দিন বেঁচেছিলেন তাঁরা ছিলেন গেণ্ডারিয়ার বাড়িতে। বেলা খালাও থাকতেন নানার সঙ্গে। মায়াকে নিয়ে অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। কিন্তু অভাব-অনটন তাঁর ছিল না।
ছিল না বলছি কেন! এখনো নেই। জহুরুল খালু মানিকগঞ্জের লোক। তিনিও পৈতৃকসূত্রে জায়গা-সম্পত্তি পেয়েছিলেন অনেক। যদিও তাঁর ক্যান্সার চিকিৎসায় খরচা হয়েছে অনেক, তার পরও বেলা খালা নগদ টাকা পেয়েছেন ভালোই, মানিকগঞ্জের গড়পাড়ায় জায়গা-সম্পত্তি এখনো কিছু আছে তাঁর। কিছু মানে কী, ভালোই আছে।
আর যেটা খালার সবচাইতে বড় ভাগ্য, তাঁর শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদরা তাঁকে খুবই ভালো জানেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে শাশুড়ি মারা গেলেন। শ্বশুর এখনো বেঁচে আছেন। আশির ওপর বয়স হবে। ঢাকা মানিকগঞ্জ মিলিয়েই বেলা খালা থাকতেন। কিছুদিন মানিকগঞ্জে, কিছুদিন ঢাকায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই খালাকে তাঁর শ্বশুর মানিকগঞ্জে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠালেন। বাড়িতে কিছু ভাড়াটেও আছে। তাদের হাতে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে খালা চলে গেলেন শ্বশুরের কাছে। নিজের মেয়েদের চেয়েও ছেলের বউকে বেশি স্নেহ করেন শ্বশুর। আর খালাও সারাক্ষণ শিশুর মতো আগলে রাখছেন আশি বছর বয়সী শ্বশুরকে।
খালা যখন মানিকগঞ্জে থাকেন, নিজের পড়াশোনার জন্য মায়া থাকত ঢাকায়। তার দেখভাল করার জন্য দুজন কাজের লোক। রফিক আর রফিকের বউ মাজেদা। রফিক বাজারঘাট আর বাইরের কাজ করে, অর্থাৎ পুরুষ মানুষের যা কাজ তাই করে। মাজেদা সংসার সামলায়। মায়া তার মতো পড়াশোনা নিয়ে থাকে। কোথাও কোনো অসুবিধা নেই।
বেলা খালা আমার শাশুড়ি। কিন্তু তাঁকে কখনো মা বলা হলো না, আম্মা বলা হলো না। শাশুড়িকে তো মানুষ মা অথবা আম্মাই বলে। আমি খালাই বলি। এই ডাকটা আর বদলাতে পারিনি।
জলু মামার পুরো নাম জালাল আবেদিন খান। সংক্ষেপে জলু। তুমি ডাকো জলুদা। মাবু মামা হচ্ছেন মাহবুব আবেদিন খান। তাঁরা কে কোথায় আছেন জানি না। উড়ো উড়ো খবর পেয়েছি, জলু মামা আছেন তাঁর শ্বশুরবাড়ি লালমনিরহাটে। মাবু মামা আছেন বিক্রমপুরেই। তাঁর শ্বশুরবাড়ি কবুতরখোলা গ্রামে। আমাদের এলাকা থেকে বহুদূর। শ্রীনগরের ওদিকে।
জলু মামার অবস্থা আমাদের মতো। মানে মামার এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে বড়। নাদিরা আপা। বিএ পাস করার পর বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লা শহরে। এখন হয়তো সেখানে নেই। কুমিল্লার কোনো গ্রামের দিকে চলে গেছেন। গ্রামেও নিশ্চয় বাড়ি আছে। জলু মামার ছেলে বাদল মানসিক প্রতিবন্ধী। এই ছেলে নিয়েই মামা-মামির যত কষ্ট। কষ্ট যেমন ভালোবাসাও তেমন। দুজনের জান হচ্ছে বাদল।
জলু মামা তোমার বড়।
তোমাদের ভাইবোনের সিরিয়ালটা হচ্ছে এই রকম- প্রথমে জলু মামা, তারপর তুমি, তারপর মাবু মামা, তারপর বেলা খালা।
মাবু মামার ছেলে নেই। তিন মেয়ে। বিনু মিনু দিনু। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দিনুর এখনো হয়নি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স পড়ে। বিনু মিনু নিশ্চয় শ্বশুরবাড়িতে। দিনু আছে মামার সঙ্গে।
কী অবস্থা বলো তো, কারো কোনো খোঁজখবরই নিতে পারছি না আমরা। পাকিস্তানি কুত্তারা আমাদেরকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। নাদিরা আপা তাঁর যমজ ছেলে দুটোকে নিয়ে কেমন আছেন, জানতে ইচ্ছে করে।
তোমার ঢাকায় যাওয়ার কথা বলছিলাম না, মা!
কেন বলছিলাম জানো!
গুলিস্তান সিনেমা হলের জন্য।
বাবাকে নিয়ে তুমি গুলিস্তান হলে গিয়ে উত্তম-সুচিত্রার অনেক সিনেমা দেখেছ। আমি সে কথা জানি। আমাকে আর বকুলকে, মায়া এ বাড়ির বউ হয়ে আসার পর মায়াকে ওইসব সিনেমার গল্প তুমি বলেছ। সুচিত্রা-উত্তমের ছবিতে হেমন্ত আর সন্ধ্যার গান থাকত বেশি। ‘হারানো সুর’ ছবির সেই বিখ্যাত গানটির রেকর্ড ছিল আমাদের বাড়িতে। হেমন্তের গাওয়া গান-
আজ দুজনার দুটি পথ ওগো
দুটি দিকে গেছে বেঁকে।
সুচিত্রার গলায় যে গানটা ছিল সেটা হচ্ছে-
তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার
কানে কানে শুধু একবার বলো।
এই গানটা কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাননি। এটা গেয়েছেন গীতা দত্ত। কী মিষ্টি গান! শুনলে শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে।
পঁয়ষট্টি সালে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের একটি হাস্যকর যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধের পর থেকে ইন্ডিয়ান সিনেমা পূর্ব পাকিস্তানে আর আসে না। এ জন্য কত ভালো ভালো ছবি আমাদের দেখা হয়নি। ঢাকায় যখন জগন্নাথ কলেজে পড়ছি, তেষট্টি-চৌষট্টি সালের কথা, তখন সপ্তাহে সপ্তাহে ইন্ডিয়ান সিনেমা দেখতে যেতাম। বাংলা-হিন্দি সব ছবিই দেখতাম। সদরঘাটের রূপমহল, ইসলামপুরের লায়ন, কোর্টের সামনে মুকুল। কত সিনেমা হল চারপাশে। তারপর তো সব বন্ধই হয়ে গেল। যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি, ইন্ডিয়ান সিনেমা আসা বন্ধ হয়ে গেছে। আসত পশ্চিম পাকিস্তানের নিলু-মোহাম্মদ আলী, জেবা-ওয়াহিদ মুরাদ, দিবা-সুধীর এসব অভিনেতা-অভিনেত্রীর সিনেমা। পশ্চিম পাকিস্তানের সিনেমা আমার ভালো লাগত না। আমার ভালো লাগত পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সিনেমাগুলো। জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত- এঁরা কী সুন্দর স্নিগ্ধ ছবি বানাতেন। রাজ্জাক-কবরী, আজিম-সুজাতা, সুচন্দা, সুলতানা জামান- এঁদের ছবি আমার খুব ভালো লাগত। নতুন ছবি এলেই বন্ধুরা দল বেঁধে দেখতে যেতাম।
মা, তুমি কি খেয়াল করেছ, বাড়ির সব কিছুতেই ‘ছিল’ বলতে হচ্ছে আমাকে। অর্থাৎ এখন আর নেই। সব লুটপাট করে নিয়ে গেছে ওরা। সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।
যে জন্য ঢাকার কথা বলছিলাম, গুলিস্তান সিনেমা হলের কথা বলছিলাম সেই কথাটা শোনো, মা। গুলিস্তানের সঙ্গেই, একই বিল্ডিংয়ে ‘নাজ’ নামে ছোট্ট আরেকটা সিনেমা হল আছে। ওই হলটায় শুধু ইংরেজি ছবি চলে। পৃথিবীর বিখ্যাত সব ইংরেজি ছবি। অন্য ভাষার ছবি চলে ইংরেজি সাব টাইটেলে। ইউনিভার্সিটি থেকে ঢাকার বাংলা ছবি দেখতে যাওয়ার মতো আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে ওই হলে সিনেমা দেখতে যেতাম। কী অসাধারণ সব সিনেমা যে চলত হলটায়!
এখন, এই অবস্থায়ও হয়তো পাকিস্তানিরা হলটা খোলা রেখেছে। সিনেমা হয়তো চলে। কারা দেখতে যায় না যায় কে জানে। পাকিস্তানিরা তো ঢাকাকে এমনভাবে রেখেছে যেন বাইরের পৃথিবীর কেউ বুঝতেই পারে না এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, পাকিস্তানিরা চালাচ্ছে পাশবিক নির্যাতন। ওরা ঢাকা শহর ঠিক রেখে ধ্বংস করছে অন্য শহরগুলো, গ্রামের পর গ্রাম, গঞ্জের পর গঞ্জ। ঢাকায় পাকিস্তানিরা এখন যা করছে তা করছে একটু অন্য রকমভাবে। অত্যাচার নির্যাতন হত্যাকাণ্ড সবই চালাচ্ছে কিন্তু বিদেশিদের কিছুই বুঝতে দিচ্ছে না।
একটা সিনেমার কথা মনে পড়ছে, মা। নাজেই দেখেছিলাম। রাশিয়ান ছবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি।
নামটা যেন কী!
নামটা যেন কী!
মনে পড়েছে। ‘ব্যালেড অব এ সোলজার’। পুরো গল্পটা মনে পড়ছে না, মা। একটা দৃশ্যের কথা শুধু মনে পড়ছে। এক কিশোর ছেলে যুদ্ধে চলে গেছে। তখনো তার দাড়ি-গোঁফ ওঠেনি। ট্রেনে করে এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরেক যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছে সে। সৈনিকের পোশাক পরা, কাঁধে রাইফেল। নিজেদের এলাকার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। স্টেশনে ঘণ্টাতিনেক অপেক্ষা করবে। ছেলেটি এই সুযোগটা নিল। কমান্ডারকে অনুরোধ করল, আমি আমার মায়ের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। তুমি কি আমাকে ঘণ্টাদুয়েক সময় দেবে? মা ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই। আমি শুধু মাকে একটু দেখেই চলে আসব।
কমান্ডার তাকে সময় দিলেন। ছেলে এলো মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। এই যে আমি যেমন তোমাদের সঙ্গে একরাতের জন্য দেখা করতে এসেছি, অনেকটা এই রকম।
যুদ্ধের ডামাডোলে তছনছ হয়ে যাওয়া চারদিক। মা ব্যস্ত ছিলেন কোনো কাজে। ছেলে এসেছে শুনে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এলেন। এসে, ছেলেকে দেখে কী রেখে কী করবেন বুঝতে পারলেন না। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই তিনি ছেলের গালে হাত দিলেন। তুই শেভ করেছিস!
অর্থাৎ যুদ্ধে যুদ্ধে কিশোর ছেলেটি তাঁর কোন ফাঁকে যে বড় হয়ে গেছে!
জানি না মা, কেন যে এই দৃশ্যটি দেখে আমার চোখে পানি এসেছিল!
আজ আমি যখন বাড়ি ফিরছি, মাগো, আমার মনে হয়েছিল, এত দিন পর বাড়ি ফিরছি আমি, আমার আসার খবর পেয়ে সেই রাশিয়ান মায়ের মতোই ছুটে আসবে তুমি। আমার মাথাটা দুহাতে জড়িয়ে ধরবে তোমার বুকে। আমার গালে মাথায় বুকে পিঠে হাত বুলাবে আর চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলবে, আহা রে, আমার ছেলেটা কত রোগা হয়ে গেছে। ও বাবা রবি, তোরা ঠিকঠাকমতো খাওয়াদাওয়া করস না? ঘুমাস না ঠিক মতন। চোখ এত লাল কেন বাবা?
মাগো, কী ভেবে এলাম, কোন স্বপ্ন নিয়ে এলাম। আর এসে এ কী দেখছি! তোমরা কেউ নেই, মা। তোমরা কেউ নেই।
আশ্চর্য ব্যাপার মা, তার পরও আমার কান্না পাচ্ছে না। চোখে পানি আসছে না।
কেন বলো তো!
আমি কি সত্যি সত্যি পাথর হয়ে গেলাম! সিনেমার দৃশ্য দেখে যে ছেলে কাঁদে, তাও কোনো মৃত্যুর দৃশ্য নয়, অতি সামান্য এক আবেগের দৃশ্য, সেই ছেলেই তাঁর বাবা মা বোন স্ত্রী এবং স্ত্রীর গর্ভে থাকা সন্তানের এ রকম ভয়াবহ মৃত্যু দেখে কাঁদতে পারছে না কেন!
কোন কথা থেকে যে কোন কথা এসে যাচ্ছে, মা।
কথায় কথায় বারেকের মায়ের কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সেই যে হারিকেন হাতে বাবার কথামতো সন্ধ্যার আগে আগেই বারেককে খুঁজতে বেরিয়ে গেল কদম, বাড়িতে আমরা অপেক্ষা করছি, অপেক্ষা করছি, অনেকটা রাত হয়ে গেল কদমের খবর নেই, বারেকের খবর তো নেই-ই।
বারেকের মা পাগলের মতো ছটফট করতে লাগল।
আমাদের ঘরে ঘরে হারিকেন জ্বলছে। এই এদিক যাচ্ছে বারেকের মা, এই ওদিক যাচ্ছে। একবার সামনের উঠানে যায়, একবার পেছনের উঠানে আসে। অকারণেই রান্নাঘরে ঢোকে, গোলাঘর ঢেঁকিঘরে ঢোকে। বিড়বিড় করে, শব্দ করে কথা বলে। কদম মিয়াভাই অহনতরি আহে না ক্যান! আমার বারেকরে নিয়া আহে না ক্যান মিয়াভাইয়ে!
আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে বারেকের মায়ের অস্থিরতা দেখি।
বকুল তোমার কোলে, মা। আধো আধো কথা বলতে শিখেছে। বুয়াকে বলত ‘বুলা’। তোমার কোল থেকে বলছিল, বুলা কী, মা! বুলা কী!
অর্থাৎ বুয়ার কী হয়েছে?
তুমি নানারকম কথায় তাকে ভুলাচ্ছিলে। আর বারেকের মাকে ভুলাচ্ছিল পারুল। তুমি অস্থির হয়ো না বুড়ি। এত অস্থির হইয়ো না। কদম মামায় ঠিকই বারেকরে খুঁইজা আনব। এইটুকু পোলা আর কই যাইব! এই দেখবা বাড়িতে আইসা পড়ল।
বুয়া বুক চাপড়ায়। কাঁদে না কিন্তু বিলাপ করে। আল্লায় য্যান তাই করে। মিয়াভাইয়ে য্যান আমার পোলারে লইয়াই ফিরত আহে। দোয়া কর, তুই আমার পোলার লেইগা দোয়া কর।
তারপর তোমার দিকে তাকাল সে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আম্মা, আম্মাগো, আপনে তো রোজ বিয়ানে কোরআন শরিফ পড়েন। আমার বারেকের লেইগা দোয়া করেন। মিয়াভাইয়ে য্যান বারেকরে লইয়াই বাড়িতে আহে। আপনের দোয়া কামে লাগব। আল্লায় আপনের কথা শুনব।
তুমি তাকে সান্ত্বনা দিলে। আমি দোয়া করতেছি। আল্লায় তোমার পোলা ফিরত আনব। তুমি সুস্থির হও।
বাবা গম্ভীর হয়ে পায়চারি করছিলেন সামনের দিককার উঠানে।
কদম ফিরল রাত প্রায় দশটার দিকে। ততক্ষণে আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে। রোজ এই কাজটা বুয়া আর পারুল মিলে করে। সেদিন তো আর এদিকে মন থাকবার কথা না বুয়ার। আমাদের খাওয়াদাওয়ার কাজটা পারুল একাই সামলালো।
খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার অনেক পরে ফিরল কদম।
কিন্তু একা।
বারেক নেই।
বারেককে পাওয়া যায়নি।
সারা গ্রাম তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। সঙ্গে গ্রামের লোকজনও ছিল। সবার এক কথা, বারেককে আজ সকাল থেকে তারা কোথাও দেখেইনি।
আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
বারেকের মায়ের মাথায় যেন আমাদের পুরো দালান বাড়িটা ভেঙে পড়ল।
প্রথমে মুহূর্তের জন্য সে একটু স্থির হলো, তারপর দুহাতে বুক চাপড়ে চিৎকার করে বিলাপ আর কান্না। হায় হায় এইডা কী হইল! আমি ক্যান মারলাম আমার পোলারে! ক্যান অর গায়ে হাত তুললাম! কই চইলা গেল আমার পোলা! হায় হায় এইডা কোন সব্বনাশ হইল আমার! আল্লাহ, আল্লাহগো, এইডা তুমি কী করলা! কই লইয়া গেলা আমার পোলারে? হায় হায়, আমি অহন কি লইয়া বাচুম, আমি অহন কারে লইয়া বাচুম। আমার বুকের সামনে রাইত্রে কে ঘুমাইয়া থাকব! কে আমারে মা ডাকব! কে আমারে প্যাঁচাইয়া ধরব! আল্লাহ আল্লাহ এইডা কি হইল! যার লেইগা আমি সংসার ছাড়লাম সেও চইলা গেল আমারে ছাইড়া!
বারেকের মায়ের আহাজারি দেখে পারুলও চোখ মুছতে লাগল। কদম গোলাঘরের সামনে হারিকেনটা নামিয়ে রেখে পাথর হয়ে বসে রইল। এই যে আমি যেমন তোমার মাথা কোলে নিয়ে পাথর হয়ে বসে আছি, কদমের অবস্থা অনেকটা এমন।
কিন্তু বারেকের মাকে কে কী সান্ত্বনা দেবে?
তুমি বললে, এমন কইরা কাইন্দো না বারেকের মা। তোমার ছেলে বাইচা আছে। রাগ কইরা লুকাইয়া আছে কোনোখানে। ফিরত আসব।
বারেকের মা আগের মতোই বুক চাপড়ায়। নাগো আম্মাগো, আমার পোলা ফিরত আইব না। অর কী হইছে আমি বুইঝা গেছি। আমার পোলা বাইচা নাই।
বাবা বললেন, কী আবোল-তাবোল কথা বলছ। বেঁচে থাকবে না কেন? আছে, বেঁচে আছে। কোথায় আছে এখন সেটাই দেখতে হবে। আজ রাতে না হয় পাওয়া যায়নি, কাল থেকে সব দিকে আমি লোক পাঠাব, ঠিকই বারেককে খুঁজে পাওয়া যাবে।
বারেকের মায়ের ওই এক কথা। নাগো খালুগো, অরে আপনেরা পাইবেন না। ও নাই। অরে কে খাইছে আমি বুইঝা গেছি। ওই যে বাঁশঝাড়তলায় গেল, ওই বাঁশঝাড়ের তেনায় অরে খাইছেন। আমার পোলারে মাইরা পুষ্কুনির তলায় কেদার (কাদা) মইধ্যে গুইজা রাখছে। অরে আমি আর কোনো দিন পামু না। হায় হায় রে, হায়রে, এইডা আমি কী করলাম! ক্যান গায়ে হাত তুললাম পোলার! ক্যান নিজের এই সব্বনাশ করলাম!
সারা রাত থেকে থেকে এ রকম আহাজারি করল বারেকের মা। একটু থামে আবার শুরু করে। আমরা সেই রাতে ঠিকঠাকমতো কেউ ঘুমাতেই পারলাম না।
আমিও তো বারেকের কাছাকাছি বয়সের। বারেকের মায়ের ওই বাঁশঝাড়তলার তেনার কথা শুনে খুবই ভয় করছিল। তার মানে জিনিসটা সত্যি সত্যি দিনেরবেলায়ও বেরোয়। বারেক হয়তো তেনার সামনে পড়েছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে ওইটুকু ছেলেটাকে ধরে সে আমাদের ওইদিককার কাদাভর্তি পুকুরে, কাদার তলায় গুঁজে দিয়েছে। কোনো দিন বারেকের লাশও ভেসে উঠবে না।
পরদিন আবার খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। চারপাশের গ্রামে লোকজন পাঠালেন বাবা। বারেকের মা নিজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মাঠে ঘাটে যাকে পায় তাকেই জিজ্ঞেস করে, বারেকরে দেখছেন? আমার বারেকরে? দশ বছইরা পোলা। দেখতে কালাকোলা। তয় চেহারায় মায়া আছে। আমার পোলার হাসি খুব সোন্দর। চক্ষু দুইখান খুব সোন্দর। দেখছেন? ওই রকম একটা পোলারে দেখছেন আপনেরা?
না বারেককে কাল থেকে কেউ দেখেনি।
কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারল না। চারদিকে পাঠানো লোকজন ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। বারেকের মায়ের আহাজারি আরো বাড়ল, বাঁশঝাড়ের তেনায়ই যে বারেককে গুম করেছে এই ধারণাটা তার বদ্ধমূল হয়ে গেল।
আহা, তারপর থেকে আমাদের বুয়া রাতের পর রাত ঘুমাত না। ঘরে বসে কাঁদলে পারুলের ঘুমের অসুবিধা হবে দেখে নিঃশব্দে দরজা খুলে উঠানে বেরিয়ে আসত। ঢেঁকিঘরের ওদিকটায় গিয়ে যতটা নিচু গলায় সম্ভব কাঁদত আর বারেককে ডাকত। বারেকরে, ও বারেক, ও আমার বাজান। আমি নাইলে তরে একটু মারছিলাম, এর লেইগা মার লগে রাগ করতে হয় বাজান! মারে ছাইড়া চইলা যাইতে হয়! ও বাজান, বাজান আমার কথা তর মনে হয় না! আমার লেইগা তর মায়া লাগে না, কান্দন আহে না! আমারে ছাইড়া তুই ঘুমাস কেমনে? খাস কেমনে? খাইতে বইলে আমার কথা তর মনে হয় না! ও বাজান, বাজান!
নিশিরাতে বারেকের মায়ের সেই কান্না শোনে অন্ধকার কিংবা জ্যোৎস্না রাত। গাছের পাতারা আর হাওয়া, ঝিঁঝিঁপোকা আর রাতপাখিরা। আমাদের বাড়ির মাটি আর মাটির মতো নিরীহ গরুগুলো। খোঁয়াড় থেকে শোনে ঘুমভাঙা কবুতররা। কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙে শুনি আমি। আমারও তখন বারেকের জন্য খুব কান্না পেত।
আরেকটা কাণ্ড করত বুয়া। নির্জন দুপুরে আর কোনো কোনো গভীর রাতে একা একা চলে যেত বাঁশঝাড়তলায়। সেখানকার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তেনার অশরীরী হাতে পায়ে ধরত। বাবা, আপনে আমার বাবা। আমার পোলাডারে আপনে ফিরত দেন। পোলার জানের বদলে আমার জান আপনে নেন। এই তো আমি আপনের সামনে। আমারে আপনে মাইরা ফালান। তাও আমার পোলাডারে ফিরত দেন।
সেটা হয়তো ফাগুন মাসের কোনো দুপুর কিংবা রাত। বারেকের মায়ের কাকুতি-মিনতি শুনত আমাদের বাঁশবনের বাঁশঝাড়গুলো। বাঁশের পাতায় পাতায় তখন শনশন করত মধ্যরাতের হাওয়া। হাওয়ার টানে কোথায় কোন সুদূরে ভেসে যেত বারেকের মায়ের আকুতি।
বাঁশঝাড়তলা থেকে তাকে ফিরিয়ে আনত কদম আর নয়তো পারুল। বারেকের জন্য আমাদের বাড়িতে একটা শূন্যতা তৈরি হয়ে গেল।
তবু দিন বসে থাকে না, দিন চলে যায়। বুয়া ছেলের জন্য নিশিরাতে, দিনদুপুরে কেঁদেই চলে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় কান্নাও কমে আসে তার। ওই যে তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত লিখেছেন না, ‘পৃথিবীতে শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর’।
বছরখানেক ধরে বারেকের জন্য অনেক চেষ্টা-তদবির চলল। মালখানগরের মোসলেম ফকির, ইছাপুরার পবন ঠাকুর, আর আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব তো ছিলেনই। মোসলেম ফকির নানা রকম তাবিজ আর পানিপড়া দিয়েছিল বুয়াকে। পবন ঠাকুর ছিল গণক। গণনা করে বলেছিল, না, তোমার পোলা নাই। পোলার আশা ছাইড়া দেও। আর আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব, হাফেজ শেখ মোহাম্মদ নুরুদ্দিন, বারেকের মা তাঁর কাছে গেলেই দোয়া দরুদ পড়তেন বারেকের উদ্দেশে।
বড় ভালো মানুষ ছিলেন ইমাম সাহেব। কত সান্ত্বনা যে বারেকের মাকে দিতেন। কত রকমভাবে যে বোঝাতেন, বাঁশঝাড়ের ওই সব ভূতপ্রেত কিছু না। ভূত বলতে আসলে কিছু নেই। তোমার ছেলের জীবনে অন্য ঘটনা ঘটেছে।
বুয়া আকুল হয়ে বলত, কী ঘটনা হুজুর?
সেটা আল্লাহপাক ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।
এ ঘটনার এগারো বছর পর একদিন দুপুরবেলা একজন লোক এলো আমাদের বাড়িতে। পরনে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা সাদা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির তলায় হালকা আকাশি রঙের লুঙ্গি। মাথায় সাদা টুপি। খালি পা ধুলায় ধূসর। মুখে ঘন কালো চাপদাড়ি। চৈত্র মাসের দুপুরবেলা। রোদে ঘামে, বহুদূর পথ হেঁটে আসার ফলে ক্লান্ত বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। লম্বা পাঞ্জাবিটা পুরনো, বোধহয় ধোয়াও হয়নি বেশ কিছুদিন। বারবাড়ির ওদিক থেকে সোজা হেঁটে এসে ঢুকল আমাদের পিছনদিককার উঠানে। একেবারেই মুসাফির টাইপের লোক। কাঁধে র‌্যাকসিনের সস্তা খয়েরি রঙের একটা ব্যাগ।
কে, লোকটা কে?
[চলবে]