সাড়ে তিন হাত ভূমি

সাড়ে তিন হাত ভুমি
বিলের ওইদিকে আমাদের একটা দীঘি আছে।
তুমি তো জানোই মা, চারদিকে আমাদের ধানি জমি, মাঝখানে বিশাল দীঘি। বর্ষা যে বছর কম হয়, বিলে মাঠে পানি কম, দীঘির চারটা পাড়ই জেগে থাকে। পাড়ে ঝোপজঙ্গল আছে, হিজল বরুণ গাছ আছে। তেঁতুল গাছ, গাব গাছ আছে, কদম গাছ আছে।
মা, কোথা থেকে যেন কদম ফুলের একটা গন্ধ আসছে!
তুমি পাচ্ছ!
গন্ধটা তুমি পাচ্ছ, মা!
আমাদের বাড়িতে কদম গাছ আছে অনেক। দশ-বারোটার কম হবে না। কদম হচ্ছে আষাঢ় মাসের ফুল। শ্রাবণ মাসেও কি কদম থাকে! কদম ফুলের জীবন বেশি দিন স্থায়ী না। শ্রাবণ মাস পর্যন্ত ফোটে কি না মনে করতে পারছি না।
বোধহয় ফোটে।
বোধহয় আমাদের বাড়ির গাছগুলোতে ফুটেছে। নয়তো গন্ধ আসবে কোত্থেকে!
নাকি দীঘির পাড়ের কদম গাছের কথা থেকে কদম ফুলের গন্ধটা আমার নাকে এলো। বাস্তবিকই এলো, নাকি ব্যাপারটা আমার মনের! আমার মনের ভিতর থেকে আসেনি তো গন্ধটা!
মা, আমার মনে হচ্ছে তোমার শরীর থেকে আমি কদম ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া তোমার শরীর, জমাট বাঁধা রক্ত, লণ্ডভণ্ড হাড় মাংস, মা, আমি তোমার শরীর থেকেই কদম ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। তোমার হাত পা মুখ মাথা থেকে, আষাঢ় শ্রাবণ মাসের ঘোরতর বৃষ্টিতে ফুটে থাকা কদম ফুলের গন্ধ যেমন হঠাৎ হঠাৎ একটুখানি ভেসে আসে হাওয়ার টানে, ঠিক তেমন করে তোমার শরীর থেকে কদম ফুলের গন্ধ আসছে।
কী যেন বলছিলাম!
ও, আমাদের ওই দীঘির কথা।
ধানি মাঠের মাঝখানে দীঘি। দীঘিটা বহু বহু কালের পুরনো। দাদার বাবা নাকি কাটিয়েছিলেন জিওল মাছ খাওয়ার আশায়। কচুরিপানা, ঝোপজঙ্গল ভরা দীঘি বর্ষার পানিতে ডুবে গেলে, আশ্বিন কার্তিক মাসে বর্ষার পানি যখন নেমে যায় তখন জংলা পুকুর দীঘিতে কৈ শিং মাগুর শোল চিতল ফলি টাকি খলিসা ভেদা_এসব মাছ কচুরিপানা আর ঝোপজঙ্গলের তলায় আশ্রয় নেয়। টাকি মাছও থাকে। টাকি মাছের ভর্তা, আহা, কী যে মজা করে বানাতে তুমি! সরিষার তেল কাঁচামরিচ পেঁয়াজ ধনিয়া পাতা দিয়ে তোমার হাতে টাকি মাছের ভর্তার কোনো তুলনা নেই মা। আমাদের দীঘি থেকে ধরে আনত কদম আর তুমি ভর্তা বানাতে।
মাগো, কত দিন তোমার হাতের সেই ভর্তা খাইনি!
গ্রামের লোকজন প্রায়ই চুরি করে আমাদের দীঘির মাছ ধরে নিয়ে যেত। এ জন্য পবন জেলেকে বছর চুক্তিতে দিয়ে দেওয়া হতো দীঘি। ধানের জমিগুলো যেভাবে বর্গা দেওয়া, অনেকটা সে রকমই ব্যবস্থা। পবন তার মতো করে পাহারা দিয়ে রাখত দীঘি। বছরে দুবার মাছ ধরবে, অর্ধেক তার, অর্ধেক আমাদের।
ইস, একেকবার মাছ ধরলে, ভাগের অর্ধেক মাছে উঠান প্রায় ভরে যেত আমাদের। এত মাছ দিয়ে কী করব?
বাবা তাঁর স্কুলের শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি মাছ পাঠাতেন। গ্রামের লোকজনকে মাছ বিলাতেন। তার পরও জিওল মাছে মাটির বড় বড় হাঁড়ি ভরা থাকত প্রায় সারা বছর।
এর বাইরেও আরেকটা ব্যবস্থা ছিল। আমাদের বাড়ির জন্য হঠাৎ মাছ ধরার দরকার হলে কদম একটা ঝাঁকি জাল আর একটা খাঁচি নিয়ে যেত। দু-তিন দিন চলার মতো মাছ ধরে আনত। পবন কিছু মনে করত না। দীঘির উত্তরপাড়ে ছাপরাঘর করে সে আর নয়তো তার ভাই, ভাইয়ের ছেলে, নিজের ছেলেরা পালা করে দীঘি পাহারা দিত।
কিন্তু ওই দীঘি নিয়ে এত কথা আমি বলছি কেন!
কোনো কোনো শীতকালে বিকাল হয়ে আসার সময় কদমের সঙ্গে দীঘির ওইদিকটায় বেড়াতে যেতাম আমি। কী সুনসান নির্জন চারদিক! শীতের বেলা দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। ধানি মাঠ ছবির মতো স্থির। ধান কাটা হয়ে গেছে। নতুন করে চাষের আয়োজন করছে কৃষকরা। দীঘির পাড়ে উঠে পানির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কচুরিপানা আর পানিতে ডোবা ঝোপজঙ্গলের ভিতর থেকে খোলা জায়গায় এসে ঘাই দিয়ে যেত মাছ।
আমার খুব কৌতূহল। কদমকে বলতাম, কী মাছ ঘাই দিল, কদম চাচা?
এটা শোল।
বুঝলে কী করে?
আমি মাছের ঘাই দেখে বুঝতে পারি।
তখন হয়তো আরেকটা মাছ ঘাই দিল। এটা কী মাছ?
চিতল।
দীঘির পাড়ের কোনো ঝোপে তখন হয়তো ডাকতে শুরু করেছে ডাহুক পাখি। কোনো কোনো ডাহুক পাখি একটানা সারা রাত ডাকে। ওরকম সারা রাত ডাকার ফলে সকালের দিকে তাদের গলা থেকে বেরোয় এক ফোঁটা রক্ত।
কদমই বলেছিল এ কথা।
কেন ওরকম রক্ত বেরোয় ডাহুক পাখির গলা থেকে!
কী অর্থ এই রহস্যের!
জানা হয়নি। নাকি রহস্যটা কদম বলেছিল, এখন আর আমার মনে পড়ছে না। তবে ডাহুক পাখির ডাকে আমার একটা গানের কথা মনে পড়ত।
‘পদ্ম দীঘির ধারে ধারে
ডাহুক ডাকা মাঠের পারে
কানামাছি খেলার কথা যায় কি ভোলা
মনে আজ সেই ভাবনা দেয় দোলা।’
কার গাওয়া গান জানি না। এই রেকর্ডটা আমাদের বাড়িতে ছিল না। আকাশবাণী কলকাতা থেকে রবিবার দুপুরবেলা অনুরোধের আসর নামে গানের একটা অনুষ্ঠান হতো।
এখনো হয় নাকি, মা?
মনে করতে পারছি না।
হয়, নিশ্চয় হয়! এত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান না হয়ে পারে!
আমরা সবাই রেডিওতে অনুরোধের আসর শুনতাম। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে, নাকি খাওয়াদাওয়ার আগেই, মা! অনুরোধের আসরটা আড়াইটার সময় হতো না! আড়াইটা থেকে তিনটা!
তাহলে খাওয়াদাওয়া সেরেই আমরা শুনতাম। ওই গানটা অনুরোধের আসরেই শুনেছিলাম।
কিন্তু আমাদের দীঘিটা পদ্ম দীঘি না। পদ্ম ফুলের বালাই ছিল না। ছিল কচুরিপানা, ঝোপজঙ্গল। তবু সেই দীঘির পাড়ে দাঁড়ালে, ডাহুক পাখির ডাকা গানের কথাগুলো আমার মনে আসত। কিশোর বয়সের কথা। এখনো ভুলিনি।
মা, আমাদের বাড়ির ঝোপজঙ্গলে, বাড়ির চারপাশে ধানি মাঠে তো অনেক ডাহুক পাখি থাকে। নির্জন দুপুরে ডাকে, রাতে ডাকে। বর্ষাকালে পানিতে ডোবা ঝোপের আড়ালে বাসা বাঁধে। কালো কালো একঝাঁক ছানা নিয়ে মা ডাহুক চড়তে বেরোয়। পানিতে ভাসে, ডাঙায় ওঠে। কিশোর বয়সে কত চেষ্টা করেছি একটা ডাহুকের ছানা ধরতে, কোনো দিন ধরতে পারিনি। এত চালাক ছানাগুলো! এই দেখছি চোখের সামনে চড়ছে, পা টিপে টিপে গেছি ধরতে, কাছাকাছি গেছি, সঙ্গে সঙ্গে উধাও। মুহূর্তে কোথায় যে লুকায়, কোথায় যে উধাও হয়_কে জানে!
ডাঙায় যা পানিতেও তাই। হয়তো একদম পরিষ্কার পানিতে মায়ের সঙ্গে চড়ছে। কদমকে নিয়ে আমি গেছি ধরতে, আমাদের দেখেই ডুব দিল। ডুব দিয়ে কোথায় কোনদিকে যে চলে গেল, হদিস নেই।
মা, আমাদের বাড়িভর্তি পাখি ছিল। কাক শালিক চড়ুই এসব তো সাধারণ পাখি। সব গ্রামে, সব বাড়িতেই থাকে। আমাদের গাছপালাঘেরা বাড়ি বলে বাড়ির নামার দিককার হিজল গাছগুলোতে নানা রকমের বক বাসা বাঁধত বর্ষাকালে। ঘুঘু ডাকত সারা দিন। বুলবুলি ছিল, তালগাছটায় ছিল বাবুই পাখির বাসা। ইষ্টিকুটুম, কাঠঠোকরা, পুকুর ধারে মাছরাঙা, পেঁচা আর আমাদের কবুতরগুলো তো ছিলই। ডাহুকগুলো কোথায় গেল! পাখিগুলো সব কোথায় গেল, মা! কোথাও কোনো প্রাণের সাড়া নেই কেন?
খানিক আগে, বাবার ওখানে বসে একটু যেন কবুতরের শব্দ শুনেছিলাম! তারপর আর কোনো সাড়া নেই।
আসলে কি শুনেছিলাম!
নাকি মনের ভুল!
বিভ্রম!
বল্টু কুকুরটা, মিনি বিড়ালটার মতো বাড়ির পাখিরাও কী সব গুলির অবিরাম শব্দে যে যার মতো উড়ে গেছে দূরের গ্রামে! নিরাপদে নির্জনে থাকতে!
এই গ্রামে এখন আর কোনো পাখিই নেই!
এমন স্তব্ধতা মানুষ সহ্য করে কেমন করে!
না মা, একটা শব্দ আছে মা। তুমি শুনতে পাচ্ছ না! তুমি শুনতে পাচ্ছ না, মা! ঝিঁঝিঁ ডাকছে, শুধুই ঝিঁঝিঁ ডাকছে। আর কোনো শব্দ নেই। এমনকি হাওয়ার চলাচল, গাছের পাতা নড়াচড়ার শব্দও নেই!
দানবগুলোর কর্মকাণ্ড দেখে প্রকৃতিও স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমাদের বাড়ির গাছপালা, মাটি পানি হাওয়া সবই কি কাঁদছে, মা!
এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে কাঁদছে!
কিন্তু আমার কান্না পাচ্ছে না কেন?
আমার চোখে পানি আসছে না কেন?
চোখ, চোখ। চোখের কথায় চোখ এলো মা। ওই যে খানিক আগে বক পাখির কথা বললাম, তখনই বুঝি মনের ভিতর নড়েচড়ে উঠেছিল চোখ।
আমাদের গ্রামের ফইজু, কানা ফইজু আর কি! চিনতে পেরেছ মা?
হ্যাঁ, বক শিকারি, ডাহুক শিকারি। বর্ষা শেষ হয়ে এলে, মাঠে মাঠে কাদাপানিতে ধান কাটা শুরু হবে, এ সময় বক আর ডাহুকগুলো ধান ক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে, বকগুলো পুঁটি টেংরা শিকারের আশায় ঘুরে বেড়ায় আর ডাহুক পাখিগুলো ধান খায়। ফইজু ফাঁদ পাতত বক ডাহুক ধরার জন্য। প্রতিদিনই দু-চারটা ধরত। ধরে কাঞ্চনপুর বাজারে নিয়ে বিক্রি করত।
কাজটা কার কাছ থেকে শিখেছিল কে জানে। কিশোর বয়সে প্রথম ফাঁদ পেতে একটা বক ধরেছে। কার্তিক মাস। প্রথম দিনই শিকার ধরতে পেরে বেজায় আনন্দ তার। বক নিয়ে বাড়ি এসেছে। ফাঁদ থেকে বক বের করে পলো দিয়ে উঠানে আটকে রেখেছে। পলোর মুখ দিয়ে যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে সে জন্য পলোর মুখে মাটির একটা সরা বসিয়ে রেখেছে।
ধরা পড়া বক পলোর ভিতর বসে ঝিমাচ্ছে। ফইজু অতি উৎসাহে বাড়ির লোকজনকে ডেকে এনে দেখাচ্ছে। কিন্তু বকটা তখন বেশ কাহিল। শরীরের ধকলে মড়ার মতো লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে।
ফইজু ভাবল, হায় হায় বক আমার মইরা গেল নি?
সরা সরিয়ে পলোর মুখ দিয়ে উঁকি দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল বক। অল্প পানিতে পা ডুবিয়ে যে রকম তক্কেতক্কে থাকে ছোট মাছ শিকারের আশায়, স্বচ্ছ পানির তলায় কাচের মতো ঝকঝক করে যেসব ছোট মাছ, ফইজুর চোখ দুটোকে বক মনে করল সেই রকম কোনো মাছ।
যার যা স্বভাব!
লম্বা ঠোঁট বাড়িয়ে ফইজুর ডান দিককার চোখ বরাবর ঠিক মাছ ধরার কায়দায় একটা ঠোকর দিল। এক ঠোকরে ফইজুর চোখ তুলে, মাছ গেলার মতো কোৎ করে গিলে ফেলল।
এই হলো ফইজুর ঘটনা।
বালক বয়সেই ফইজু গেল কানা ফইজু হয়ে। তবে শিকারটা সে ছাড়ল না। এক চোখ নিয়েই আশ্বিন কার্তিক মাসে বক ডাহুক শিকার করে। লোকে ডাকে কানা ফইজু।
বাবা একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, একটা চোখ খোয়ালি বকের হাতে, তার পরও শিকারটা ছাড়লি না?
ফইজু হে হে করে হেসে বলল, জিদ কইরা ছাড়ি নাই মাস্টার সাব। জিদ কইরা শিকারটা করি। যেই বকে আমার চোখ নিছে, আমারে কানা করছে, ওই বকের গুষ্টি আমি সাফা কইরা ফালামু।
মা, ফইজুর কথা ভেবে আমার শরীরের ভিতরে কী রকম যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে। রক্ত গরম হয়ে উঠছে। শরীর যাচ্ছে শক্ত হয়ে। বুকের ভিতর কাজ করছে প্রবল এক শক্তি। আমার মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে ফইজুর চোখ নিয়েছিল যে বক সেই বকের গুষ্টি শেষ করার জন্য ফইজু যেমন বক শিকার করে, আমিও, মা, আমিও আমার বুক খালি করেছে যারা তাদের শেষ করে দেব। একটা একটা করে শেষ করে দেব। আমার বাবা মা বোন স্ত্রী আর আমার সন্তান যারা শেষ করেছে তাদের আমি ধ্বংস করে দেব। একটা পাকিস্তানিকেও ছাড়ব না। একটা রাজাকারকেও ছাড়ব না। আলবদর, আলশামস, শান্তিবাহিনী, পাকিস্তানি কুত্তাগুলোর যারা দোসর তাদের একটাকেও ছাড়ব না।
মা, পোষা প্রাণীরা তো বাড়ির লোকের গায়ের গন্ধ টের পায়। গন্ধ চেনে। এই যে এতটাক্ষণ ধরে আমি বাড়িতে, বল্টু কুকুরটা বুঝলাম কোথাও পালিয়ে গেছে, অথবা গুলির শব্দে দৌড়ে পালাচ্ছিল কোনো দিকে, ওকেও গুলি করেছে কুত্তারা। হয়তো বল্টু মরে পড়ে আছে কোনো ঝোপঝাড়ের আড়ালে কিংবা বর্ষার পানিতে।
কিন্তু মিনি! মিনি বিড়ালটা!
বিড়ালটা কোথায় গেল!
ওকি পালাতে পেরেছিল!
নাকি ওকেও গুলি করে মেরেছে!
নাকি খুবই আদুরে বিড়াল দেখে কোনো রাজাকার বাড়ির যাবতীয় মালামাল লুট করার মতো আমাদের মিনিকেও লুট করে নিয়ে গেছে। আমাদের গোয়ালঘর, রান্নাঘর, গোলাঘর, ঢেঁকিঘরের টিন কাঠ দিয়ে যেমন করে উঠবে রাজাকারদের ঘরবাড়ি, সে রকম কোনো বাড়িতেই কি জায়গা হবে মিনির! নাকি জায়গা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে!
মিনি কি আমাদের ছাড়া থাকতে পারবে?
ওকে বাটি ভরা দুধ দেবে কে?
কোলে নিয়ে আদর করবে কে?
কী আশ্চর্য মা! মানুষ রেখে আমি বিড়াল নিয়ে কথা বলছি।
না, আমি একদম আমার মধ্যে নেই। আমার সব কিছু এলোমেলো, লণ্ডভণ্ড। যেমন লণ্ডভণ্ড তোমরা, আমার মা বাবা বোন স্ত্রী আর সন্তান, যেমন লণ্ডভণ্ড আমাদের সংসার, সংসারের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি জিনিস, যেমন লণ্ডভণ্ড আমাদের বাড়ি, ঠিক তেমনই আমার ভিতরটা। মাথা কাজ করছে না, চিন্তাচেতনা খাপছাড়া।
মা, আমার আবার বারেকের কথা মনে পড়ছে, বারেকের মায়ের কথা মনে পড়ছে। সেই যে মায়ের মার খেয়ে বাঁশঝাড়তলার দিকে দৌড়ে গেল বারেক, সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, দুপুর গড়িয়ে বিকাল, বারেকের দেখা নেই।
কোথায় গেল সে?
ফিরছে না কেন?
আমাদের সবার খাওয়াদাওয়া হলে কাজের লোকরা খেতে বসে। আমরা আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ করেছি। কদম পারুল বারেকের মা আর বারেক খেতে বসবে। কিন্তু বারেক নেই। কদম আর পারুলকে ভাত বেড়ে দিয়েছে বারেকের মা। নিজের ভাত, বারেকের ভাতও বেড়েছে। কিন্তু বারেক কোথায়?
বুয়া নিজের থালায় আর হাত দিতে পারে না। ভাত তুলতে পারে না মুখে।
ইস, আমার যে কী এলোমেলো হচ্ছে সব! একবার বলছি বারেকের মা, একবার বলছি বুয়া।
এই অবস্থা আমি কেমন করে কাটাব, মা!
বলো না, কেমন করে কাটাব!
ওই দেখো, চাঁদের আলো আরেকটু প্রখর হয়েছে। কপাট ছাড়া দরজা জানালা দিয়ে দিনের আলোর মতো গলগলিয়ে ঢুকছে আমাদের বসার ঘরে। তোমার আমার শরীর জুড়ে জ্যোৎস্না। আমরা মা-ছেলে চাঁদের আলোয় ভাসছি।
বুয়াও কি কোনো কোনো রাত ছেলেকে নিয়ে চাঁদের আলোয় ভাসেনি!
কদম খেতে খেতে বলল, কি হইল বারেকের মা, ভাত বাইরা বইয়া রইলা, খাইবা না?
পারুলও তো মেয়ে। মায়ের জাত। ঘটনা সে বুঝল। মুখের ভাত গিলে বলল, বুড়ি বইয়া রইছে পোলার লেইগা।
এই প্রথম কথা বলল বুয়া। হ রে, পোলাডারে এমুন মাইর মারলাম, অহন মনডা খারাপ লাগতাছে। বিয়ানের নাশতা খাইছে। এত বেলা হইল, তারপর থিকা আর কিছু তো মুখে দেয় নাই, কই যে গেল, তাও বুঝতাছি না। এতক্ষুণে তো পোলার বিরাট খিদা লাগনের কথা!
কদম বলল, হ, দোফর হইয়া গেছে। খিদা লাগনের কথা।
পারুল বলল, খিদা লাগলে তো ফিরত আহনের কথা।
বুয়া বলল, আইতাছে না জিদ কইরা। বিরাট জিদ্দি পোলা।
কদম হাসল। ডাকাইতের পোলা জিদ্দি হইবই।
বুয়া উঠল। তোমরা খাও।
পারুল বলল, তুমি যাও কই?
পোলাডারে বিচরাইয়া লইয়াহি।
আইচ্ছা যাও।
বুয়া বাড়াভাত রেখে বেরিয়ে গেল। ফিরল আধা ঘণ্টা পর। মুখে হতাশা, অসহায়ত্ব।
কদম পারুল তখন খাওয়া শেষ করে যে যার মতো আয়েশ করছে। গোলাঘরের সামনে বসে কদম তার প্রিয় তামাক টানছে। দুপুর শেষের নির্জনতা কিছুটা ভেঙেছে তার তামাক টানার গুরুক গুরুক শব্দে। পারুল গিয়ে কাত হয়েছে দালানের পিছন দিককার যে ঘরটায় বুয়া বারেক আর সে থাকে। বুয়ার হতাশ মুখটা সে দেখতে পেল না। দেখল কদম। তামাকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা মানুষটা বলল, কী হইল বারেকের মা? পাইলা না বারেকরে?
না গো মিয়াভাই।
কও কী?
হ। পুরা বাড়ি বিচরাইলাম। বারেক কোনোখানে নাই।
জিদ কইরা অন্য কোনো বাড়িতে গিয়া মনে হয় বইসা রইছে।
অন্য কোন বাড়িতে যাইব?
গেরামে বাড়ির আকাল আছে নি? তোমার পোলারে চিনে বেবাকতেই। আছে কোনো বাড়িতে!
বুজলাম কোনো বাড়িতে গেছে, তয় অরে ভাত দিব কে?
কদম কথা বলল না।
আমি শুয়ে আছি আমার ঘরে। পিছন দিককার জানালা দিয়ে রান্নাঘর গোলাঘর ঢেঁকিঘর আর ওইদিককার উঠান পুরোপুরি দেখা যায়।
আমার ঘুম আসছে না। ছুটিছাটার দিনে সেই ছেলেবেলা থেকেই দুপুরবেলা চান্স পেলে ভালো একটা ঘুম দেই।
সেদিন ঘুম আসছিল না। বিছানায় শুয়ে উদাস চোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি। বুয়া কদম পারুলদের খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে, টুকরোটাকরা কথাবার্তা সবই কানে আসছিল। বুয়া বারেককে খুঁজে এলো তাও দেখলাম।
কদমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বুয়া দেখি একসময় কাঁদছে। কদমকে সে ডাকে মিয়াভাই। কাঁদতে কাঁদতে বলল, মিয়াভাই গো, আমার ডর করতাছে।
কিয়ের ডর?
পোলায় তো দৌড়াইয়া গেছিল বাঁশঝাড়তলায়।
হ।
ওইখানে অর কোনো বিপদ হইল না তো?
কিয়ের বিপদ?
ওই যে ওইখানে তেনায় থাকেন। তেনায় আমার পোলার কোনো ক্ষতি করে নাই তো!
বুয়াকে একটা ধমক দিল কদম। আরে ধুৎ! যাও, ভাত খাও গিয়া। খিদা লাগলে তোমার পোলায় নিজে থিকা দৌড়াইয়া আইসা কূল পাইব না নে!
বুয়া তবু ভাত খেলো না। না গো মিয়াভাই, আমার গলা দিয়া ভাত নামব না। পোলারে ছাইড়া একওক্ত (একবেলা) ভাত আমি খাই নাই। আমি যাই, গেরাম ঘুইরা দেখি পোলা গেল কই? আছে কই?
বুয়া বেরিয়ে গেল। শেষ বিকালের দিকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরল। না, বারেককে কোনো বাড়িতে পাওয়া যায়নি। গ্রামের কোথাও পাওয়া যায়নি। বারেকের মা স্কুলবাড়িতে খুঁজেছে, কাঞ্চনপুর বাজারে গিয়েও খুঁজে এসেছে।
বারেক নেই।
বারেক উধাও।
বুয়া বিলাপ করে কাঁদতে লাগল। হায় হায়, কই গেল আমার পোলা! ক্যান আমি ওর গায়ে হাত তুললাম? অহন আমি আমার পোলা পামু কই?
মাঠ থেকে গরু নিয়ে ফিরেছে কদম। গোয়ালঘরে গরু বেঁধে মুখের সামনে রাখা গামলায় জাবনা দিয়েছে। গরুরা নির্বিকার ভঙ্গিতে সেরে নিচ্ছে রাতের খাবার। বুয়ার বিলাপে তাদের কী যায় আসে!
স্কুল ছুটির দিনে বিকালবেলাটা বাবা এদিক-ওদিক একটু হাঁটতে যান। সন্ধ্যার মুখে মুখে ফিরে আসেন। সেদিন বেরোননি। বুয়ার বিলাপ শুনে আমরা সবাই তখন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি।
বাবা চিন্তিত গলায় বললেন, গ্রামের কোনো বাড়িতে নেই, বাজারে নেই, এইটুকু ছেলে তাহলে যাবে কোথায়?
বাবা গম্ভীর গলায় কদমকে ডাকলেন। কদম।
জে কর্তা।
কর্তা ডাকটা সবাই ছাড়তে পেরেছিল, কদম পারেনি। অনেক চেষ্টা করেও বাবা তাকে ছাড়াতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ডাকটা বাবা মেনে নিয়েছেন।
তুই একটা হারিকেন নিয়ে বেরো। গ্রামের লোকজনকে খবর দে। বারেককে খুঁজে বের কর।
জে কর্তা। অহনই যাইতাছি।
পারুল, হারিকেন জ্বেলে দে।
তখনো সন্ধ্যা হয়নি। অনেকগুলো হারিকেন নিয়ে পারুল এ সময় রান্নাঘরের সামনে বসে। হারিকেনের চিমনি অতিযত্নে পরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়ে মোছে, কেরোসিন ভরে। সন্ধ্যা হলেই ম্যাচের কাঠি দিয়ে হারিকেন জ্বালায়।
সেদিনও ওই কাজে বসেছে সে। বাবার কথা শুনে দ্রুত হাতে একটা হারিকেন জ্বেলে দিল। তখনো পুরোপুরি সন্ধ্যা হয়নি। কদম হাতে হারিকেন ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল।
আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।
[চলবে]