সাড়ে তিন হাত ভুমি

সাড়ে তিন হাত ভুমি
বকুল আমার কথাই শোনে না, মা।
আমার চেয়ে আট বছরের ছোট। আমার কথা শুনবে না কেন? আমি কোনো কিছু চাইলেই বলে, আমাকে এত অর্ডার দেবে না। আমি কি তোমার চাকর? পারুলকে বলো, বারেকের মাকে বলো।
বারেকের মাকে আমরা ডাকি বুয়া।
আমার সঙ্গে কথা বলার সময়, বারেকের মা যে বকুলকে এত আদর করে, কুট্টি কুট্টি বলে জান দিয়ে দেয়, সেই বারেকের মাকে সে বুয়াটা পর্যন্ত বলে না। সোজা বলে বারেকের মা।
এসব অবশ্য অনেক আগের কথা, মা।
আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। বকুল টুতে উঠেছে। চড়ুই পাখির মতো চঞ্চল, ছটফটে। একটা মুহূর্ত স্থির নেই। ছোটাছুটি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখছে। সামনে আমার পরীক্ষা। সকালবেলা পড়তে বসেছি। নাশতার পর সেই বয়সেই এক কাপ চা খাওয়া অভ্যাস হয়েছে। পড়ার টেবিলে দুলতে দুলতে পড়ছি। দেখি, বারান্দার দিকে বকুল একটা ফড়িং ধরার চেষ্টা করছে।
তুমি তো জানই মা, আমাদের বাড়িতে ফড়িং, প্রজাপতি, মৌমাছি, ভ্রমর_এসবের অন্ত নেই। মেঠো ইঁদুর আছে, ব্যাঙ আছে দুই-তিন রকমের। কোলা ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ। সোনা ব্যাঙ আছে পুকুরের ওদিকটায়। বর্ষার মুখে মুখে, বৃষ্টি-বাদলা শুরু হলেই ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাকতে শুরু করে ব্যাঙগুলো। আমাদের এখনকার যে মিনি বিড়ালটা, ওটার মা-বাবা দুটোই তখন বাড়িতে। অর্থাৎ, আমাদের তখন দুটো বিড়াল। হুলোটা কোনো কোনো দিন চলে যেত ঝোপ-জঙ্গলে; মেঠো ইঁদুর, ব্যাঙ_এসব ধরে নিয়ে আসত। ইঁদুর-বিড়ালের খেলাটা আমরা খুবই মজা করে দেখতাম।
হুলোটা করত কী, ইঁদুর ধরে সেটাকে আধমরা করে উঠানের দিকে নিয়ে আসত। সামনে ফেলে রেখে নিজে আয়েশ করে বসত। একটা পা দিয়ে আলতো করে একটু নাড়া দিত মরার মতো পড়ে থাকা ইঁদুরটাকে।
ইঁদুরও অতি চতুর জীব। সে ইচ্ছা করেই মরার ভান করে পড়ে থাকত। হুলোর নাড়া খেয়ে ভাবত, এখন আর কোনো বিপদ নেই, এখন আচমকা একটা দৌড় দিলেই জানে বাঁচি।
ইঁদুর সেই চেষ্টাই করত।
বিড়ালের নাড়া খেয়ে যেই না পালাতে গেছে, আমাদের হুলো অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। ঘাপ করে কামড়ে ধরল ঘাড়ের কাছটা।
এই খেলাটা আমরা সবাই মজা করে দেখতাম। অনেকক্ষণ ধরে খেলাটা খেলত হুলো। তারপর একসময় তুমি কিংবা বুয়া, কদম বাড়িতে থাকলে কদম আর নয়তো পারুল তাড়া দিয়ে বিদায় করত হুলোটাকে। হুলো ইঁদুর মুখে নিয়ে বাড়ির কোন দিকে যে চলে যেত!
কী কারণে যেন ইঁদুর-বিড়ালের কথা বলছিলাম, মা!
আমার সব কিছু এলোমেলো, কেন কী বলছি, বুঝতে পারছি না। মাথায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্নভাবে আসছে নানা রকম স্মৃতি। চোখে ভেসে উঠছে নিকট আর দূর অতীতের কত কত দৃশ্য। কোন স্মৃতি কেন আসছে মাথায়, চোখে কেন ভেসে উঠছে একের পর এক বিচ্ছিন্ন দৃশ্য, বুঝতে পারছি না, মা।
ও মনে পড়েছে, বকুলের কথা বলছিলাম। আমার পড়ার ঘরের বারান্দায় ফড়িং ধরায় ব্যস্ত ছিল বকুল। সকালবেলার আলোয় ঝকঝক করছে চারদিক। সামনে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা। জুন-জুলাই মাস। গ্রীষ্মকালও শেষ হয়ে আসছে। তবে রোদ ওঠে বাঘের মতো। গাছপালা ঘেরা বাড়ি বলে আমাদের বাড়িতে গরমটা লাগে কম। হাওয়া একটু না একটু আছেই। অথবা গাছপালার নিজস্ব শীতলতাও কাজ করে।
আমি পরীক্ষার পড়া পড়ছি। বকুলেরও পরীক্ষা। কিন্তু সে পড়ালেখা নিয়ে ভাবছেই না। তুমি বা বাবা কেউ ওকে তেমন কিছু বলো না। বাবা বলেন, ওইটুকু মেয়ে, ও ওর মতোই পড়ুক। যখন ইচ্ছা পড়তে বসবে, যতক্ষণ ইচ্ছা পড়বে, না হলে পড়বে না। ওকে চাপাচাপি করবার দরকার নেই।
তবে সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম মতোই পড়াশোনাটা করত বকুল। সেদিন বোধ হয় পড়া শেষ করেই ফড়িং ধরায় ব্যস্ত হয়েছে।
আমি পড়তে পড়তে ডাকলাম, বকুল।
বকুল সাড়া দিল না, তাকিয়েও দেখল না।
আমি আবার ডাকলাম, এই বকুল।
এবার সে আমার দিকে মুখ ফেরাল। কী?
এদিকে আয়।
পারব না।
কেন?
দেখছো না আমি ব্যস্ত!
আমি বিরক্ত হলাম। না, দেখছি না। কী করছিস তুই?
ফড়িং ধরছি।
এখন ফড়িং ধরতে হবে না।
না, আমি ধরব। এই নীল রঙের ফড়িংটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এটাকে ধরে সুতা দিয়ে বেঁধে রাখব।
না, এসব করতে হয় না।
করলে কী হয়?
আল্লাহ গুনাহ দেয়।
কিন্তু আমি তো ওটাকে মারব না। আল্লাহ গুনাহ দেবে কেন?
ঠিক আছে, একটু পরে ধর। আগে আমার একটা কাজ করে দে।
কী কাজ?
বুয়াকে বল, আমাকে এক কাপ চা দিতে।
বারেকের মা চা বানাত অসাধারণ। আমাদের বাড়ির গরুর ঘন দুধের চা। চিনি দিয়ে এত চমৎকার করে বানাত! কাপের পর কাপ খেতে ইচ্ছা করত আমার।
আমার কথা শুনে বকুলকে দেখলাম ভেতরের দিকে চলে যেতে।
আমি পড়ছি আর চায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। সময় যাচ্ছে, চায়ের খবরই নেই। কী ব্যাপার? বকুল বলে আসার পরও বুয়া চা দেবে না, এমন তো হওয়ার কথা না।
পড়া রেখে আমি উঠলাম।
প্রথমে বকুলকে খুঁজলাম। কোনদিকে গেছে সে, খুঁজে পেলাম না। গেলাম রান্নাঘরে। গিয়ে দেখি, পারুল পাটাপুতায় ঘসর ঘসর করে হলুদ বাটছে। সামনে শুকনামরিচ, জিরা, ধনিয়া। হলুদগুলো মাটির একটা মালসায় ভেজানো। ভেজালে নরম হয় হলুদ। বাটতে সুবিধা। সে মন দিয়ে তার কাজ করছে। আর বারেকের মা মাটির একটা হাঁড়িতে জিইয়ে রাখা কৈ মাছ বের করার জন্য মাত্র হাত দেবে।
বুয়া।
বুয়া চমকে তাকাল, জ্বে দাদা।
আমি না চা চাইলাম!
বুয়া আকাশ থেকে পড়ল। কার কাছে চাইছেন?
তোমার কাছে।
আমার কাছে?
হ্যাঁ। বকুল তোমাকে বলেনি?
না তো। কুট্টির লগে তো আমার দেখাই হয় নাই।
আমার খুবই মেজাজ খারাপ হলো। গম্ভীর গলায় বললাম, আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসো।
ফেরার সময় দেখি, পেছন দিককার বারান্দায় একটা নীল লম্বা লেজের ফড়িংয়ের ডানা সুতা দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করছে বকুল।
আমি গিয়ে সামনে দাঁড়ালাম। বকুল।
বকুল আমার দিকে তাকাল না। কী?
তোকে আমি কী বলেছিলাম?
কী বলেছিলে?
ভুলে গেছিস?
বলো না, কী বলেছিলে?
বলেছিলাম না, বুয়াকে গিয়ে বল আমাকে এক কাপ চা দিতে।
বকুল তবু আমার দিকে তাকাল না। ফড়িং ধরছিলাম তো, মনে ছিল না।
সঙ্গে সঙ্গে ঠাস করে বকুলের গালে আমি একটা চড় মারলাম। তখনো ফড়িংটাকে সে বাঁধতে পারেনি। আমার চর খেয়ে তার হাত থেকে ফড়িং ছুটে গেল। ডানায় বোধ হয় ভালো রকম ব্যথা ততক্ষণে পেয়ে গেছে সে। তবু ভাঙা ডানা নিয়ে উড়ে চলে গেল।
আমি তাকে চড় মারব_এটা বকুল ভাবেইনি। প্রথমে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে তোমার ঘরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর তুমি এসে ঢুকলে আমার ঘরে।
বকুলকে চড় মেরেছিস কেন?
ও তোমাকে বলেনি, কেন মেরেছি!
বলেছে।
তাহলে আবার জানতে চাইছো কেন?
সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমার ডান কান মুচড়ে ধরলে। বোনের গায়ে হাত তোলে কোনো ভাই! তাও এত ছোট বোন!
আমি গোঁয়ার গলায় বললাম, কিন্তু ও আমার কথা শোনেনি কেন?
ছোট মানুষ, ভুলে গিয়েছিল।
আমার কথা ও ভুলবে কেন? তোমরা ওকে বেশি আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছো। বড় ভাই কথা বলে, তাও শোনে না। তোমাদের জন্য সে এমন বেয়াদব হয়ে উঠছে। আরেকদিন আমার কথা না শুনলে, আজ তো আমি শুধু চড় মেরেছি, এরপর লাঠি দিয়ে পেটাব।
সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমার চুলের মুঠি ধরে দুই গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারলে। এমন রাগলে, তোমার ফর্সা সুন্দর মুখ লাল হয়ে গেল। বেয়াদব বকুল, না তুই! আমার মুখের ওপর এভাবে কথা বলছিস। আমি তোকেই লাঠি দিয়ে পেটাব। পিটিয়ে হাড্ডিগুড্ডি ভেঙে দেব, ফাজিল কোথাকার।
বুয়া আমার চা নিয়ে মাত্র দরজা দিয়ে ঢুকবে, দেখে এই দৃশ্য। দেখে দরজার সামনেই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ, আমাদের দুই ভাইবোনের কারো গায়ে তুমি কিংবা বাবা হাত তুলেছো_এই দৃশ্য ওরা তেমন দেখেইনি।
আমি তখন রাগে-অভিমানে পড়ার টেবিলে বসেই মাথা নিচু করে ঝরঝর করে কাঁদছি। তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকালে না। বুয়াকে বললে, চা নিয়ে যাও, চা ওকে দেবে না।
খুবই রাগী ভঙ্গিতে তুমি তারপর বেরিয়ে গিয়েছিলে, মা।
মনে আছে, এসব কথা তোমার মনে আছে, মা!
আমি যে তারপর অদ্ভুত একটা কাজ করলাম, তা কি তোমার মনে আছে? বলো না মা, আমার সঙ্গে একটু কথা তুমি বলো না। মনে আছে!
আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি।
আমার পরনে পায়জামা ছিল আর স্যান্ডো গেঞ্জি। তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর চোখ মুছতে মুছতে আমি একটা হাফহাতা শার্ট গায়ে দিলাম। খালি পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম।
কোথায় গেলাম?
গেলাম বাচ্চুদের বাড়ি।
বাচ্চু আমাকে দেখে অবাক। কী রে, তুই এই সময় আমাদের বাড়িতে?
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, এলাম।
স্কুলে যাবি না?
না। আমি তো যাবই না, তুইও যেতে পারবি না।
কেন?
বাচ্চু আমাকে ওর পড়ার চেয়ারটায় বসাল। ঝগড়া করেছিস?
এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। আজ সারাদিন আমি তোদের বাড়িতে থাকব।
বাচ্চু আমাকে ম্যানেজ করার জন্য বলল, আচ্ছা। আচ্ছা ঠিক আছে।
দিনটা আমি বাচ্চুদের বাড়িতে কাটালাম। বাচ্চুও আমার জন্য স্কুলে গেল না। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর কথায় কথায় বাচ্চু আমার কাছ থেকে সব জেনে নিল। তারপর আমাকে বোঝাতে লাগল। এ রকম তো হতেই পারে। তুই বকুলকে মেরেছিস, এটা ভালো হয়নি। খালাম্মা এ জন্যই তোকে শাসন করছেন। এ নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। চল, তোকে বাড়িতে দিয়ে আসি।
বাচ্চুটা ওই বয়স থেকেই এত ভালো ছেলে, মা। এত সুন্দর করে সব ম্যানেজ করত। সত্যি সত্যিই বুঝিয়েশুনিয়ে বিকেলবেলা ও আমাকে বাড়িতে নিয়ে এলো। স্কুল শেষ করে বাবা ফিরেছেন। তিনি তো সকালবেলায়ই জেনেছেন পুরো ঘটনা। হয়তো এসব নিয়ে তোমার সঙ্গে কথাও হয়েছে তাঁর।
বিকেলবেলা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন বাবা। অকারণে স্কুল কামাই করা খুবই অপছন্দ করেন তিনি। আমি আর বাচ্চু দুজনেই স্কুল কামাই করেছি। বাবা আমাদের কিছুই বললেন না। একবার শুধু চোখ তুলে তাকালেন।
সন্ধ্যার পর সেদিন আমি পড়তে বসলাম না। বুয়া হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে ঘরে। চিত হয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। তুমি এসে ঢুকলে। পাশে বসে আমার মাথায় হাত রাখলে। মা একটু শাসন করেছে, তাতেই এত রাগ!
আমি কথা বলি না। গম্ভীর।
তুমি আমার মাথাটা কোলে টেনে নিলে। এই যে আমি যেভাবে তোমার মাথা এখন কোলে নিয়েছি, ঠিক এইভাবে বললে, তুই তোর বাবাকে খুব ভালোবাসিস, আমি জানি। বাবা তোর জান, তুইও বাবার জান। কিন্তু তুই জানিস না, আমি তোকে কত ভালোবাসি। বাবার জন্য তোর টান দেখে আমি আমার ভালোবাসার কথাটা কখনো তোকে বলি না। আজ বললাম।
শুনে আমার মন নরম হতে লাগল। টের পাই, ধীরে ধীরে অভিমান কমছে। তবু তোমাকে কিছু বুঝতে দেই না। তুমি আমার মাথা কোলে নিয়ে আদর করছো, আমি সাড়াই দিচ্ছি না। চুপচাপ তোমার কোলে মাথা দিয়ে আছি।
তখন তুমি সেই গল্পটা বললে_মায়ের হৃদযন্ত্রের গল্প।
নিজের জীবনের চেয়েও ছেলেকে বেশি ভালোবাসেন মা। স্বামী নেই, একমাত্র ছেলেই তাঁর সবকিছু। কী যে মমতায়, কী যে যত্নে ছেলেকে বড় করেছেন! মাটিতে রাখেননি, পিঁপড়ায় কামড় দেবে। মাথায় রাখেননি, উকুনে কামড় দেবে। ছেলেকে রেখেছেন তিনি বুকে, হৃদয়ের কাছে।
এই ছেলে বড় হলো। একটি মেয়ের সঙ্গে ভাব হলো তার।
আমি বুঝলাম, প্রেম-ভালোবাসা শব্দটা এড়িয়ে গেলে তুমি। নাইনে পড়া ছেলের সামনে শব্দ দুটো উচ্চারণ করতে চাইলে না। প্রেম-ভালোবাসার জায়গায় বললে ‘ভাব’।
আমি নিঃশব্দে তোমার গল্প শুনছি। অদূরে পড়ার টেবিলে জ্বলছে হারিকেন। চিমনিটা নতুন। তাও আবার জ্বালানোর আগে যত্ন করে মুছেছে পারুল। আলোটা পরিষ্কার। খোলা জানালা দিয়ে আসছে সন্ধ্যারাতের হাওয়া। হাওয়ায় ফুল-লতাপাতার স্নিগ্ধ গন্ধ।
তুমি বললে, আসলে ভাব বলাটা ঠিক হলো না। ছেলেটি মেয়েটিকে খুবই পছন্দ করছে। তাকে বিয়ে করতে চায়। সরাসরি প্রস্তাব দিল মেয়েটিকে। মেয়ে তার প্রস্তাবে সাড়া দেয় না। ছেলে নাছোড়বান্দা। সে লেগেই আছে মেয়েটির পেছনে।
মেয়েটি একসময় বিরক্ত হয়ে গেল। ছেলেটিকে তার জীবন থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কঠিন একটা শর্ত দিল।
এই প্রথম কথা বললাম আমি। কী শর্ত, মা?
তোমার গল্প বলার ধরনে আর আমার মাথায়-বুকে আদরের হাত বুলাচ্ছো, কোন ফাঁকে আমার মন থেকে মুছে গেছে সকালবেলার ঘটনা, রাগ করে বাচ্চুদের বাড়িতে চলে যাওয়া, মান-অভিমান_সব আমি যেন নিজের অজান্তেই ভুলে গেছি।
তুমি বললে, মেয়েটি বলল, শর্তটা হলো_আমাকে একটা জিনিস উপহার দিতে হবে।
ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলল, অবশ্যই দেব। বলো, তুমি কী চাও?
আমি চাই তোমার মায়ের হৃদযন্ত্র।
ছেলে থতমত খেল। কী, কী চাও তুমি?
তোমার মায়ের হৃদযন্ত্র। তাঁর হৃদযন্ত্র এনে আমাকে উপহার দিতে হবে। তাহলেই আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি হব, তোমাকে বিয়ে করব।
আমার তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, মা। তোমার কোল থেকে মুখ না তুলে তোমার মুখের দিকে তাকালাম, চোখের দিকে তাকালাম। দূর থেকে আসা হারিকেনের আলোয় কী যে সুন্দর লাগছিল তোমার মুখ! যেন তুমি এই পৃথিবীর কোনো মানুষ নও, যেন তুমি স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক দেবীমা।
তোমার সৌন্দর্য দেখেই দাদু তোমাকে তাঁর ছেলের বউ করে এনেছিল। তখন তোমার খুবই কম বয়স। একেবারেই কিশোরী। বাবার চেয়ে তোমার বয়স অনেক কম। দশ-বারো বছর হতে পারে। বা তারও বেশি। তার পরও দাদু তোমার মা-বাবাকে রাজি করিয়ে বাড়ির বউ করে এনেছিলেন তোমাকে।
ওইটুকু মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছিলেন না তোমার মা-বাবা, যদিও তোমাদের ওই কালে বাল্যবিবাহই হতো। বরের বয়স একুশ, কনে নয়-দশ, বড়জোর এগারো। এই বাড়ির বউ হয়ে আসার সময় তোমার বয়স এগারো-বারোর বেশি না।
তোমার মুখেই তো শুনেছি, ঘটকের কাছে খবর পেয়ে দাদু একদিন কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ করেই তোমাদের বাড়ি গেছেন; মতলব হলো_একেবারেই ঘরোয়া বাড়ির পরিবেশে তোমাকে দেখবেন। প্রাথমিক দেখা শেষ হলে, পাত্রী পছন্দ হলে, তারপর ঘটা করে বিকেল শেষের কনে দেখা আলোয় তোমাকে দেখবেন, বিয়ের কথাবার্তা, দিন-তারিখ পাকা করবেন। সেদিন অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছিল।
দাদা ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতি করা মানুষ তো! খুবই বুদ্ধিমান ছিলেন। গেছেন একা। দুপুরের দিকে। তোমাদের বাড়ির সঙ্গে পদ্মা নদী। গ্রীষ্মকাল। বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুমি নদীতে নেমে শিশু-কিশোররা যেভাবে সাঁতরাসাঁতরি করে, ডুবোডুবি আর হৈচৈ করে, তা-ই করছিলে।
দাদু যখন তোমাদের বাড়িতে ঢুকবেন, ঠিক তখনই নদী থেকে উঠেছো তুমি। রোগা-পটকা টিংটিংয়ে এক কিশোরী। কিন্তু অবাক করা সৌন্দর্য তোমার। গায়ের রং পাকা সবরি কলার মতো। নাকি দুধে-আলতা রং বলব, মা!
দাদু তোমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তুমি ভেবেছো, গ্রামের কোনো মুরুবি্বজন হবে। একবারও তাঁর দিকে না তাকিয়ে বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দৌড়ে ভিতরবাড়িতে চলে যাচ্ছিলে। দাদু তোমাকে ডাকলেন_শোনো মা।
তুমি দাঁড়ালে। জি্ব, বলেন।
তোমার নাম কী?
আলো।
বাবার নাম?
জয়নাল আবেদীন খান।
কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস ফোরে।
আচ্ছা ঠিক আছে মা, ঠিক আছে।
কিন্তু তুমি বললে, আপনি কে?
দাদু হাসিমুখে বললেন, আমাকে তুমি চিনবে না মা।
বাবার কাছে আসছেন?
হ্যাঁ।
বাবা তো বাড়িতে নেই।
কোথায় গেছে?
মুন্সীগঞ্জ।
কেন গেছে, বলতে পার?
জি্ব পারি। মামলার কাজে। আমাদের একটা জমি নিয়ে মামলা চলছে।
আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি তাহলে যাই।
বাবা বাড়িতে এলে কিছু বলতে হবে?
না না, ঠিক আছে। আমি আরেকদিন আসব।
তবু আপনার নামটা বলে যান। কোন গ্রাম থেকে আসছেন, বলে যান।
গ্রামের নাম কাঞ্চনপুর। বলবে, কাঞ্চনপুরের চৌধুরী সাহেব এসেছিলেন।
জি্ব আচ্ছা।
বাড়ি ফিরেই ঘটককে ডাকালেন দাদু। মেয়ে দেখা তাঁর হয়ে গেছে। এখন কনেপক্ষের সঙ্গে কথা পাকাপাকি করে বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে ফেল। মেয়ে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। জাত-বংশও ভালো। পদবি হচ্ছে খান।
মাস দুয়েকের মধ্যে এই বাড়ির বউ হয়ে এলে তুমি। তখন শীতকালের শেষ দিক।
ওই দেখ, কোন কথা বলতে কোন কথায় চলে গেছি। বললাম না, মা, তোমাকে বললাম না, আমার সবকিছু এলোমেলো। অতীত-বর্তমান সব একাকার হয়ে গেছে। স্মৃতির পাতাগুলো চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে উল্টোপাল্টা ভাবে। পাঁচ নম্বর পাতা থেকে ফিরে যাচ্ছি দুই নম্বর পাতায়, পনের নম্বর পাতা রেখে চলে যাচ্ছি পঁচিশে।
এখন আবার মনে হচ্ছে, দৃশ্যটা এমন না। তোমার নিথর মাথা কোলে নিয়ে বসে নেই আমি, তুমি আমার মাথা কোলে নিয়ে বসে আছো। এখনকার মতোই সন্ধ্যারাত। হারিকেনের আলোয় তোমার অপূর্ব মুখ দেখতে পাচ্ছি আমি। মায়ের হৃদযন্ত্রের গল্প বলতে বলতে একটু যেন উদাস হয়েছো। উদাস হলে তোমার চোখ কেমন যেন মায়াবী হয়ে ওঠে, গলার স্বর বদলে যায়।
আমি বললাম, তারপর কী হলো, বলো না মা!
ছেলে যাকে বিয়ে করতে চায়, সেই মেয়ে চেয়েছে তার মায়ের হৃদযন্ত্র! ছেলে খুবই চিন্তিত হলো। এই শর্তটা কি তুমি বদলাতে পারো?
মানে?
আমার মায়ের হৃদযন্ত্র ছাড়া অন্য যা তুমি চাও, তা-ই তোমাকে আমি দেব। আমাদের যা কিছু আছে, সব দিয়ে দেব। জায়গা-জমি, বাড়িঘর, সোনাদানা, স্থাবর-অস্থাবর_সব তোমাকে দিয়ে দেব।
না, আমি তোমার মায়ের হৃদযন্ত্রই চাই।
ছেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠিক আছে, আমি আমার মায়ের কাছে যাচ্ছি। মা আমাকে খুবই ভালোবাসেন। গিয়ে বলি তাঁকে।
ভালোবাসলে নিশ্চয়ই তিনি তোমার কথা শুনবেন। তোমার জন্য সব করবেন।
হয়তো করবেন।
তাহলে আর দেরি করছো কেন? যাও, তোমার মায়ের হৃদযন্ত্র নিয়ে এসো। এনে আমাকে দাও। তারপর তোমার প্রস্তাবমতো আমি কাজ করব।
ছেলে মায়ের কাছে গেল। ঘটনা খুলে বলল মাকে।
আমি উৎকণ্ঠিত গলায় বললাম, মা কী বললেন?
বললেন, বাবা, তোমার জীবনের কোনো সাধ আমি অপূর্ণ রাখিনি। তুমি যখন যা চেয়েছো, আমি সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে তা দিয়েছি। যা বলেছো, আমি তা-ই করেছি। তুমি আমার আত্মা, আমার জান। তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কিছু নেই। তুমি আমার হৃদয়। আমার হৃদয় আমারই হৃদয় চেয়েছে, আমি কি তাকে তা না দিয়ে পারি!
তারপর?
তুমি এখনই আমাকে হত্যা করো। নিয়ে যাও আমার হৃদযন্ত্র। তুমি যাকে চাও, তাকে উপহার দাও। শর্ত পূরণ করো তার, খুশি করো তাকে। আমি চাই, আমার হৃদযন্ত্রের বিনিময়ে আমার ছেলে পূরণ করুক তার মনোবাঞ্ছা। খুশি হোক সে, সুখী হোক।
আমার দম ততক্ষণে প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। কোনো রকমে বললাম, তারপর? তারপর কী হলো, মা?
মাকে হত্যা করল ছেলে।
সত্যি সত্যিই হত্যা করল?
হ্যাঁ। হত্যা করে তাঁর হৃদযন্ত্র নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল সেই মেয়ের বাড়ির দিকে। এমন উন্মাদের মতো ছুটছিল, পথে পাথর-কঙ্কর কত কি ছড়িয়ে আছে, কোনো কিছুই খেয়াল করছিল না। হঠাৎ এক পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ল সে। বুকের কাছে দুই হাতে ধরা মায়ের রক্তাক্ত হৃদযন্ত্র। ছেলে হোঁচট খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদযন্ত্র কথা বলে উঠল, ব্যথা পেয়েছো, বাবা?
উদাস মুখখানি নামিয়ে তুমি আমার দিকে তাকালে। এই হচ্ছে মা, বুঝেছিস! মায়ের চেয়ে আপন কেউ নেই পৃথিবীতে, মায়ের চেয়ে বড় কেউ নেই।
তোমার গল্প শুনে আমার তখন বুক ফেটে যাচ্ছে, চোখ ফেটে যাচ্ছে। কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। উপুড় হয়ে মুখ গুঁজে দিলাম তোমার কোলে। দুই হাতে তোমার কোমর জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কাঁদতে লাগলাম। মা, মাগো, আমার মা!
আমাদের বাড়িতেই আরেক মাকে রাতের পর রাত বিলাপ করে কাঁদতে দেখেছি আমরা। কখনো কখনো দিনের কাজ করতে করতেও হঠাৎ করে কোথাও বসে সে কাঁদত। আমাদের বারেকের মা বুয়া। তার সেই কান্না ছিল বারেকের জন্য। সেই যে মায়ের মার খেয়ে বাঁশঝাড়ের ওদিকে চলে গিয়েছিল বারেক, তারপর তার আর কোনো খবর নেই। যেন ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল দশ বছরের ছেলেটি!
কোথায় গেল?
[চলবে]