কেরানি ও দৌড়ে ছিল

image_1285_320201
১৮
ভোরবেলা। জিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাসির। আমাদের কেরানি রওনা হবে ঢাকার দিকে। উঠানে নেমে তরতর করে জিপের দিকে এগিয়ে যায় কেরানি। হঠাৎ তার মনে হয়, আর কবে হস্তিবাড়ি ফিরে আসা হয় কে জানে। মাকে একবার সালাম করে যাওয়া ভালো। কতকাল মাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে নাই সন্তান। ভোরের পাখিটাও যেন এই সৎ খেয়ালে সায় দিয়ে কুউও ডেকে ওঠে।
কী নাম এই পাখির? শীতকালে কোকিল! হবেও বা। কেরানি ফিরে মায়ের ঘরে যায়। ঘরে ঢুকেই আলনার দাঁড়ে বাবার লম্বা পাঞ্জাবিটা চোখে পড়ে প্রথমে। চোখ আটকে যায়। চোখ ছাপিয়ে পানি আসে কেরানির।
চৌকির ওপর মা বসে আছে জ্বলজ্বল একজোড়া চোখ নিয়ে। বাকশক্তি নাই, কানেও কিছু শোনে না। কেরানি কাছে যেতেই খপ করে তার জামার হাতা ধরে মা টান দেয়। তার সেই জামা ধরে বিষম টান, আর খামচে ধরা, আর একেবারেই ধরে রাখা, ছাড়া নয়, রেহাই নয়_ কেরানির মনে হয় মা যেন কী এক তিরস্কারে রুদ্র রূপ ধরে আছে নিঃশব্দে।
কেরানি ডাক দেয় মা! কিছু কবার চাও?
কেরানির গা পুড়ে যায় মায়ের দৃষ্টির আগুনে। মা কি তার জননী-শক্তি দিয়ে টের পেয়ে গেছে যে, এক সন্ত্রাসীর পোষ্য সে এখন?
বড়বুবু পেছন পেছন এসেছিলো, বলে, আও করিবার শক্তি নাই। কী আর কইবে? ভাল্ থাকিস তুই। সৎ পথে থাকিস।
বোনটিরও তবে সেই একই বার্তা। সৎ পথ! কেরানি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর মায়ের পায়ে দ্রুত হাত রেখে বাইরে বেরিয়ে আসে।
বাইরে জিপ। জিপের সমুখে মূর্তিমান ও কে দাঁড়িয়ে? কেরানি থমকে যায়। নিজের ছোট ভাইটিকেই চিনে উঠতে সময় লাগে তার। শীর্ণ চেহারা। চোখ কোটরে বসে গেছে। গাঁজার গন্ধে কাছে ভেড়া যায় না। বাপজানকে কবর দেবার সময় একবার দেখা গিয়েছিলো, তারপর থেকে উধাও। হঠাৎ এখন।
কোথায় ছিলি তুই? এতবড় অমানুষ তুই? কুলখানিতেও দেখলাম না।
রক্তচক্ষু মেলে ভাইটি প্রায় আদেশের সুরে বলে, বাদ দেও ও সকল কথা! জিপগাড়ি যাবার দেমো না। হামাকে নিয়া চল।
কোথায়?
ঢাকায়।
ঢাকায় যায়া কী করবি তুই?
তোর মতো বড় মানুষ হমো।
কেরানি হেসে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলে, বড় মানুষ হবার চাস? নেশাভাঙ করিয়া বড় মানুষ হওয়া যায় না। আগে বদাভ্যাস ছাড়, তারপরে দেখা যাইবে ঢাকা কি হেথা।
তবে পাইসা দিয়া যা। ধমকের সুর ভাইটির গলায়।
কেরানি তার ভাইয়ের দিকে স্নেহের সুধাময় অস্টম্ফুট হাসি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর ৫০০ টাকা তার হাতে দিয়ে দ্রুত জিপে উঠে পড়ে। নাসিরকে বলে, স্টার্ট করো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
গেঁজেল ভাইটি টাকার কড়কড়ে পাঁচখানা নোট দলামোচড়া করে হাতের মুঠোয়। বলে, আরো কিছু দিবার পারো না?
না! আর নয়! তোর বেশ্যাবাড়ির খরচ মুই দিবার নও!
কথাটা মনের মধ্যে গুমরে মরছিলো কেরানির। হস্তিবাড়ি এসেই সে শুনতে পেয়েছিলো ভাইটি তার এক বেশ্যাকে নিয়ে মত্ত হয়ে আছে। এখন শেষকালে সেই কথাটা দুম করে বলে ফেলতে পারে তার ভেতরটা আরাম পায়। আরাম! না, তাও বোধহয় সত্য নয়। তার ভেতরটা কেঁদে ওঠে অসীম শূন্যতা অনুভব করে। কেরানি সেটাকে ধামাচাপা দিতে গাড়ির সিট থেকে ঝুঁকে পড়ে বড়বুবুর হাত একটুখানি ধরে। ধরে এবং ক্রমে কঠিন হয়ে পড়ে তার মুঠো। বলে, আসি বুবু।
বুবুর চোখে পানি। তখন মনে পড়ে যায় কেরানির, বুবু একটা প্রশ্ন করেছিলো জ্যোৎস্নায় যখন কাল রাতটান ভেসে যাচ্ছিলো।
হাতটা ধরে রেখেই কেরানি বলে, চিন্তা না করো, বুবু! আমি সৎ পথেই আছি। না, এখন পর্যন্ত অসৎ কিছু করি নাই। তোমার ভাইকে দিয়া অসৎও কিছু হবার নয়, এই কথা জানিও। আসি তবে।
জিপের এঞ্জিন গুঞ্জন করে ওঠে। বিষম এক ধাক্কায় এঞ্জিন গাড়ি কাঁপিয়ে তোলে, যেন অস্থির হয়ে লাফ দিতে চায়, হস্তিবাড়ি থেকে পালাতে চায়। কেরানি সিটের ওপর টাল সামলায়।
নাসির বলে, সরি!
কেরানির মনে হয় জিপটাও তাকে বড়বুবুর মতো তিরস্কার করতে চাইছে। আসন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চাইছে। বলতে চাইছে, সত্যের মোকাবেলা যদি করতে না পারো তবে নেমে যাও। খানাখন্দে গিয়ে পড়ো।
কেরানি তাকিয়ে দ্যাখে, সংসার যন্ত্রণায় বোনের চোখ দুটি কী করুণ আর মাছের চোখের মতো নিষ্পলক নীল ঠাণ্ডা। কেরানি দেখতে পায় সেই চোখ দুটিতে ক্রমে ফুটে উঠছে গভীর কী এক বিশ্বাস। না, তার ভাই বিপথে যাবার নয়! যেতে সে পারেই না! যাবে না!
কেরানির যাত্রার দিকে বড়বুবু তাকিয়ে থাকে চোখ মেলে। জিপ মিলিয়ে যায় পথের বাঁকে। তবুও সে তাকিয়েই থাকে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস পড়ে অনেকক্ষণ পরে। তারপর ফিরে যায় বাড়ির ভেতরে। গেঁজেল ভাইটি তখনো ১০০ টাকার পাঁচখানা নোট হাতের মুঠোয় মোচড়াতেই থাকে।
একটা কি দুর্বোধ্য বেদনা ছিলো বিদায়ের এই দৃশ্যটিতে? সত্যকে মিথ্যার মোড়কে সাজিয়ে তোলার বিশ্বময় বেদনা? নেশাসক্ত এক সহোদরের ক্রমেই গহ্বরে পতিত হবার বেদনা? নাকি সে আমাদের কেরানি বাবাকে কবর দেবার পর রাজধানীতে ফিরে যাচ্ছে বলে বিদায়েরই বেদনা কেবল? নাকি, এই যে সে চলে যাচ্ছে, এই যে বড়বুবু দাঁড়িয়ে আছে পথের ওপর সিমের মাচার একটা বাখারি ধরে, আর কখনো তাদের দেখা হবে না, তারই একটা আগামবার্তা এই বেদনায়? আমরা এখনি কিছু বলবো না। আমরা ঘটনাক্রমের দিকে চোখ রাখবো।
সারাটা পথ কেরানির মন বেদনায় ভার হয়ে থাকে। বাবার মৃত্যুশোক নয়, ভাইটির গাঁজা দোষ নয়, বড়বুবুর নিঃসঙ্গতা নয়, এমনকি মদিনার কথাও নয়, বেদনা এক অপার বেদনা আমাদের কেরানিকে নীরব করে রাখে সারাটা পথ।
খাম্বা সামাদের সঙ্গে দেখা হতেই সে বলে, আপনারে য্যান মনমরা দেখি। তা হইবোই তো! বাপের শোক! চলেন, মনটা ভালো করবেন। লেট আস সিট সামহয়আর।
গুলশানের এক প্রাইভেট ক্লাবে কেরানিকে নিয়ে যায় সামাদ। এর আগে কখনো এখানে তাকে আনেনি সে। এই প্রথম। চারদিকে নারী-পুরুষ। সুখী সমৃদ্ধ। পোশাক-আশাকে ঝলমলে। সুগন্ধ বাতাসে। কিন্তু আলো আলো এত কম, ভালো করে কারো মুখ দেখা যাচ্ছে না। দূরে দূরে টেবিলে টেবিলে ছায়ার মতো তারা। তবু আমাদের কেরানি টের পায় তাকে ওরা লক্ষ করছে। বিশেষ করে মেয়েরা। আমরা তো এ কাহিনী কথনে কতবারই বলেছি, আমাদের কেরানির চেহারাটি অনিন্দ্য সুন্দর। এমন দীর্ঘ দেহ, এমন মাজা স্বাস্থ্য, এমন নায়ক-সুলভ চোখ-মুখ, দৃষ্টি না কেড়ে পারে?
খাম্বা সামাদের চোখে চঞ্চলতা। কাকে যেন সে খোঁজে। এ টেবিল ও টেবিল ঘুরে আসে। কাকে যেন সে জিগ্যেসও করে, আসে নাই?
উত্তরটা শোনা যায়, আসবে! আসবার তো কথা!
কে, খাম্ভাই?
তার উত্তর না দিয়ে খাম্বা সামাদ একটা টেবিলে বসতে বসতে কেরানিকে বলে, আপনে কী খাইবেন? ইউ ক্যান গেট দ্য ফাইনেস্ট হিয়ার।
যা হয়! আপনি বলুন। আমি তো ভালো বুঝি না।
আরে, এতদিন হয়া গেলো এখনো কন বুঝি না! না বুঝলে চলবো কেমতে?
দুটো হুইস্কি শেষ হতে না হতেই কেরানির ঘোর লেগে যায়। দূরে দূরে টেবিলে টেবিলে মেয়েরা যে ঘুরে ঘুরেই তাকে দেখছে, সে বড় গৌরব বোধ করে। শক্তি অনুভব করে। খাম্বা সামাদকে বলে, এখানে কারা আসে, খাম্ভাই? এরা কারা?
এরা? এরাই তো!
মদের ঘোরে এই অস্পষ্ট উত্তরটাই যথেষ্ট মনে হয় কেরানির। সমঝদারের মতো বলে, তাই! কিন্তু কার আসার কথা যেন জিগ্যেস করছিলেন?
কইলাম তো কেউ না। সময় হইলেই জানবেন। দেখবেনও!
পুরো ব্যাপারটাই রহস্যময় মনে হয় কেরানির। কিন্তু ততক্ষণে মদের নেশা চড়তে শুরু করেছে তার। আর তাছাড়া আমরা তো কতবার এটাও বলেছি যে, আমাদের কেরানির মনে কোনো ব্যাপারেই দুশ্চিন্তাও নাই, কৌতূহলও নাই। সবটাই সে ঘটনার ওপরে ছেড়ে দিতে অভ্যস্ত। এটাই তার চরিত্র।
হঠাৎ খাস্বা সামাদ বলে, আপনারে একটা কথা কওয়া হয় নাই।
কী কথা?
ধিমিধিমি হাসতে থাকে খাম্বা সামাদ। বলে, অনুমান করেন।
বলে ফেলেন!
অনুমান করেন!
পারবো না।
রুহিতন বইলা কাউরে চেনেন?
রুহিতন! কেরানি মর্মমূল পর্যন্ত চমকে ওঠে।
শি কেম টু মি!
আসছিলো? আপনার কাছে?
আই ওয়াজ অ্যাট এ মিটিং। হঠাৎ বাপ্পি আইসা আমারে কয়, এক মাগী আপনের লগে দেখা করতে চায়।
কেরানির ভেতরটা ঝাঁকিয়ে ওঠে। রুহিতনের ব্যাপারে মাগী শব্দটা! ঠোঁট কামড়ে সে নিশ্চুপ হয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
খাম্বা সামাদ বলে, সে আমারে সকল কথা বলছে। আপনার বিয়া, তারে তালাক। তালাকটা তার বাপে আর চাচায় মিলা জবরদস্তি লওয়াইছে, এই কথাও সে কইলো। আমি তারে কইলাম, কিয়ের বিয়া? কিয়ের শাদি? হইয়া থাকলেও অখন তো তালাক! তবে আর কথা কী! সে আমারে কয়, আমি শুনছি সে আপনের লগে আছে, আপনে তার বড়ভাই, আপনের কথায় উঠে বসে, তারে আপনে ফিরায়া দ্যান। আরে! তালাক হয়া গেছে! আমি ফিরানের কে?
শুকনো গলায় কেরানি জানতে চায়, তারপর?
তারপর আর কী! তারে বিদায় কইরা দেই। বিদায় কি হইতে চায়।
কেরানি গুম হয়ে বসে থাকে। অনেকক্ষণ পরে প্রশ্ন করে, কবে এসেছিলো?
এই আপনে যখন দ্যাশের বাড়িতে বাপেরে দাফন করতে গেছেন তখন আইছিলো।
তারপর?
তারপর আর কী?
আর কিছু নাই? আর কোনো কথা?
আর কী, ওই এক প্যাঁচাল, ওই এক গাওনা_ তারে আমি ভুলতে পারি না। ফিরায়া দ্যান। আইনা দ্যান। আপনে মনে হয় জবর শান্তি সুখ দিছেন তারে। নো সারপ্রাইজ! ইউ আর সাচ এ হ্যান্ডসাম ইয়াং ম্যান। আপনেরে যে মাগী একবার পাইছে ভোলা তার পক্ষে কঠিন!
আবার সেই শব্দ_ মাগী! কেরানির অন্তরাত্মা হাহাকার করে ওঠে। হতে পারতো ক্রোধ, হওয়াটাই উচিত ছিলো, স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু না, হাহাকার! শুধু হাহাকার!
ছলছল করে ওঠে নদী। কেরানির চোখ ভিজে উঠতে পারতো, না, চোখে পানি আসে না। নদী! নদীর বুকে লঞ্চ। লঞ্চে ঢাকা থেকে বরিশাল, বরিশাল থেকে ঢাকা। কতদিন আমাদের কেরানির মনে হয়েছে জীবন যে নদীর মতো বহে চলে, নদীর ধারা তো অবিরাম ধায়, ফেরে না, যে ঘাট ফেলে আসে সেই ঘাটে আর সেই এক পানি তো ফেরে না। চোখের পলকে নতুন পানি। নতুন ধারা।
খাম্বা সামাদ তাড়া দেয়, ধম ধইরা গেলেন যে! আমি সম্বাদ লইছি। আই মেড অ্যান এনকোয়ারি। ইয়েস, ইউ ওয়ার ম্যারেড টু হার! হাঁ, এই রকম হইতেই পারে। আর সে মাগীরেও যে আপনে ঠাণ্ডা রাখতে পারছেন, দ্যাখলাম তো, বড় খর যৌবন তার, সারা বডিতে খাবো-খাবো চিক্কার পাড়তাছে, তারে যে ভাই আপনে ঠাণ্ডা তুষ্ট রাখতে পারছেন, এইটা দেইখা বড় নিশ্চিন্ত হইছি যে মানুষ চিনতে আমি ভুল করি নাই।
কেরানি আতান্তরে পড়ে যায়। শরীর! খাবো-খাবো! ঠাণ্ডা তুষ্ট! আর, তা দেখে খাম্বা সামাদ নিশ্চিন্ত! মানুষ চিনতে ভুল করে নাই! কিছুতেই কিছু ঠাহর করে উঠতে পারে না আমাদের কেরানি।
হঠাৎ ঘরের ভেতরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় সবার। যে যেখানে যেন স্থানু হয়ে যায়। ব্যাপার কী? কেরানি ত্রস্ত চোখে চারদিকে দৃষ্টি করে। টেবিলে টেবিলে মানুষগুলো হাতের গেলাশ হাতেই, বাকশূন্য হয়ে আছে, কেবল চোখ তাদের কাকে যেন খুঁজছে।
কেরানির চোখে পড়ে এক বেয়ারা। সে চোখে চোখে কী যেন নীরবে জানান দিলো, আর তক্ষুনি উঠে গেলো খাম্বা সামাদ।
না, কিছুই বলে গেলো না সে। দ্রুত উঠে গেলো। কেরানি অনুভব করে, যার আসবার কথা খাম্বা সামাদ জিগ্যেস করছিলো, সেই মানুষটাই হয়তো এসে গেছে। কিন্তু কোথায়? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না!
কেরানি অধিক ভাবে না। বরং সে ভাবে রুহিতনকে নিয়ে। খাম্বা সামাদের কাছে এসেছিলো রুহিতন। বলেছে, তাকে সে ভুলতে পারছে না? বলেছে, তাকে ফিরিয়ে দিতে? রুহিতন সত্যি তাকে চাইছে? কতটা চাইলে তবে সে খাম্বা সামাদকে খুঁজে বের করেছে, ভেবে মনটা গলে যায় কেরানির। চোখের সমুখে ভেসে ওঠে রাতের বিছানা! নগ্ন রুহিতন!
কিন্তু বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না সে এই দৃশ্য। তালাক ইজ তালাক। শি ইজ নো মোর মাই ওয়াইফ! তাকে নগ্ন কল্পনা করাও পাপ! রুহিতন ইউ বি হ্যাপি। রুহিতন তুমি সুখী হও। আমি দোয়া করছি। আমি তো তোমার কাছে সেই ঘোর অন্যায় করেছি, আমার প্রথম বিয়ে, মদিনার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা গোপন রেখেছি তোমার কাছে। আমাকে মাফ করে দিও। আমি পাপী!
আমরা ঈষৎ অবাক তো হতেই পারি এখন। কারণ, আমরা জানি কেরানির মতো তাপ অনুতাপ চিন্তা-দুশ্চিন্তা বলে কিছু নাই। তবে এখন কেন?
নদীর কথা মনে হয়। নদীতেই তো তার কত দিন কেটেছে। নদীকে সে ভুলতে পারে না, পারে নাই। কেরানি শুনেছে, নদীর ধারা যে কখনোই ফেরে না, কিন্তু ফেরে! কোথায় ফেরে? কখন ফেরে? নদী যখন বইতে বইতে সাগর পায়, তখন। সারেং তাকে একদিন এক নিশুতি রাতে এই কথা বলেছে। লঞ্চ যখন সুমসুম করে নিশুতি রাত আর কালো পানি ভেঙে গন্তব্যের দিকে চলছে, দূরে দূরে বিকন বাতির লাল চোখ যখন সতর্ক করে দিচ্ছে এখানে বিপদ ওখানে নিরাপদ, যখন যাত্রীরা সবাই ঘুমিয়ে, জেগে শুধু পথের কাণ্ডারি লঞ্চের সারেং মাস্টার, আর কেরানি তার জন্যে চায়ের গেলাশ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন দূর কালো জলরাশির দিকে তাকিয়ে সারেং হঠাৎ বলেছিলো_ এই যে নদী, এর ধারা ফিরে ফের ফিরতে চায় যখন সাগরের কাছে এসে যায়। তখন এক ছলকানি ওঠে নদীর বুকে। নদী উলটে পথ চায়। সাগরের পানি নোনা! নোনার ভেতরে তার মিঠা পানি মেশাবে সে? না! না! নদী ফিরে তার উজানে যেতে চায় তখন। কিন্তু নদীও পারে না। সাগরেই সে লয় হয়। মানুষও পারে না। মানুষও পেছনের দিকে আর ফিরতে পারে না।
খাম্বা সামাদ ফিরে আসে। খুব ত্রস্ত হয়ে সে ফেরে। ত্রস্ততা তার এই ক্লাব থেকে ফিরে যাবার। কিন্তু চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। দুটোকে মেলানো যায় না। কেরানি একটু অবাকই হয়। খাম্বা সামাদ চেয়ারে আর না বসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তাড়া দেয়, লন, যাই!
বাইরে বেরিয়ে গাড়ির অপেক্ষা করে তারা। মাইকে ড্রাইভারকে ডাকা হয়েছে। খাম্বা সামাদ বলে, ফরগেট ইট। ভুইলা যান।
কেরানি বলে, রুহিতনের কথা তো?
হ্যাঁ, আর কার কথা? মন থিকা মুইছা ফালান। মনে করেন, সব থুক্কু। ছামনে আপনের নতুন জীবন। আপনে খালি ছামনেই যাইবেন। আমি ক্লিয়ার সিগনাল পায়া গেছি। আপনেরে আর পিছন ফিরা চাইতে হইবো না। নো, নেভার লুক ব্যাক। লাইফ ইজ আ রান। অখন খালি দৌড়াইয়া যাইবেন।
কেরানি বলে, ভুলে যে যাবো, একটা তো ভোলা যায় না।
কী? কী সেইটা?
আহমদউল্লাহ। সাগর নীল লঞ্চ কোম্পানি!
সেই পাগলির কথা তো! তার প্যাট বাজাইছিলেন আপনে ওই শালা আহমদউল্লাহ কইছিলো!
সকলের সামনে হি কিক্ড মি! আপনি বলেছিলেন_
ভুলি নাই। টুমরো ইউ উইল সি! ঠিক ওই এক সময়ে, এক টাইমে, শালারে আমি হাজির করবো, আর আপনে তার হোগায় লাত্থি মারবেন সকলের ছামনে। ইয়োর অপমান ইজ মাই অপমান। চলেন এলা, সোনারগাঁয়ে গিয়া ডিনার করি।
তার চেয়ে বোডিংয়ে যাই।
তবে ফোন কইরা দেই। চিতল মাছের পেটির কথা ম্যানেজার জগদীশ কইছিলো পাক হইছে। আমাগো দুই ভাইয়ের জন্যে য্যান রাখে। আর ভাত বহায়া দেয়। গরম ভাত!
সেই ভাতও ছুঁয়ে দ্যাখে না কেরানি। রুহিতন তার মনটা তছনছ করে দিয়ে গেছে। সোজা নিজের রুমে বসে আবার সে হুইস্কির গেলাশ হাতে নিয়ে বসে। খাম্বা সামাদকে বলে, কিন্তু আমাকে বললেন না ক্লাবে কে এসেছিলো। কার সাথে দেখা করে আপনি এত খুশি। ইয়েস, টেল মি! প্লিজ টেল মি!
সে কথার উত্তর না দিয়ে খাম্বা সামাদ বলে, আপনের ইংরেজিটা খুব খুলছে। বিটিশ কাউন্সিলের কোর্সটা খুব কামে আসছে আপনের।
এটা তো আপনারই কারণে।
খাম্বা সামাদ দু’হাত তুলে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, আর লাগে কী! সিনেমার হিরোর মতো চেহারা, সাহেবদের মতো ইংরাজি, আর রুহিতনের মতো খরশান যুবতীকে খায়েশ মিটায়া দেওনের শক্তি, দুনিয়া আপনের পায়ের নিচে!
ঘুমভাঙা চোখে ময়না এসে বলে, ভাইজান, বাত্ খাইবেন না? আমি কলাম আর রাইত জাগতে পারি না! বলেই সে কেরানির হাত ধরে টান দেয়। উডেন! উডেন তো!
সেই টানে কেরানি উঠে পড়ে। বলে, চেবিলে যাবো না। ভাত এখানেই আন।
ময়না চলে যায় ভাত আনতে।
খাম্বা সামাদ হা হা করে হাসে। নেশাগ্রস্ত গলায় বলে, পরথমে তো মনে করছিলাম এই ছুট্টো মাইয়াটার উপ্রে আপনের নজর পরছে!
ছি! ছি!
না, কই আর কি! এখন দেখি মায়ের প্যাটের বইনের মতো আপনে তারে দ্যাখেন। টান দেওনের লগে লগে উইঠা পড়লেন। ভাত খাইবেন না কইলেন, ভাতও আনতে কইলেন। নাহ্, আপনে সত্যই সাচা মানুষ। পাগলির প্যাট আপনের কারণে হয় নাই, হইতেই পারে না! আহমদউল্লাহর মরণ টানছিলো বইলাই আপনেরে সে আসামি করছে! কাইলেরই দিনই তার বারোটা বাজবে কছম আল্লার!
[চলবে]