সাড়ে তিন হাত ভুমি


মাগো, আমি যুদ্ধ করব তোমার জন্য।
তোমার বুক থেকে যারা রক্ত ঝরিয়েছে, আমার বুক থেকে যারা কেড়ে নিয়েছে আমার মাকে, আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস না করে দেওয়া পর্যন্ত, তাদের বুক থেকে রক্ত না ঝরানো পর্যন্ত, জন্তুগুলোর প্রতিটিকে শেষ না করা পর্যন্ত আমি যুদ্ধ করব। আমার হাত থেকে ওদের নিস্তার নেই, মুক্তি নেই।
মাগো, আমি যুদ্ধ করব আমার বাবার জন্য।
আমার বাবাকে যারা শেষ করেছে, বাবার বুকের রক্তে যারা ভাসিয়েছে উঠানের মাটি, তাদের রক্ত কাক-কুকুরকে না খাইয়ে আমি থামব না মা। আমি যুদ্ধ করব, আমি ওদেরকে শেষ করে দেব মা, ওদেরকে একদম শেষ করে দেব।
আমি যুদ্ধ করব আমার বোনের জন্য। আমার বকুল ফুলটির জন্য। ‘কই গো কই গো কই, আমার বকুল ফুল কই!’
মাগো, আমি আমার বকুল ফুলকে খুঁজি মা। আমার বোনটিকে খুঁজি। যে বকুল ফুলটি তার মা-বাবার বুক জুড়ে ছিল, ভাইয়ের বুক জুড়ে ছিল, ভাই যুদ্ধে চলে গেল আর বোন রয়ে গেল মা-বাবার বুকে, ফিরে এসে দেখি, মাগো, ফিরে এসে দেখি কোথায় আমার সেই বকুল ফুল! কোথায় আমার বোনটি! তার ঘরে পড়ে আছে এক ছিন্নভিন্ন বকুল। যেন মাত্র ফুটে ওঠা এক বকুল ফুল পায়ে দলে কিংবা দু-আঙুলের ডগায় ধরে অবিরাম পিষেছে কোনো জন্তু। আমার বোনটি আর মানুষের চেহারায় নেই। আমার বকুল আর বকুল নেই।
আমি আমার বকুলের জন্য যুদ্ধ করব, মা।
আমি যুদ্ধ করব আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য। আমার মায়ার জন্য। আমি যুদ্ধ করব আমার অনাগত সন্তানের জন্য। ছেলে ছিল মা, আমার সন্তান ছেলে ছিল। আমি আমার ছেলের জন্য যুদ্ধ করব। পিতা যুদ্ধ করবে পুত্রের জন্য।
আমি যুদ্ধ করব বুয়া পারুল আর কদমের জন্য। আমি যুদ্ধ করব বারেকের জন্য। আমি যুদ্ধ করব দেশের সাত কোটি বাঙালির জন্য।
আমি যুদ্ধ করব আমাদের গোয়ালের গরুগুলোর জন্য, বাড়ির হাঁস-মুরগিগুলোর জন্য, ছাগলছানা দুটো, বল্টু কুকুরটা, মিনি বিড়ালটা আর খোপভর্তি পায়রাগুলোর জন্য। আমি যুদ্ধ করব বাগানের গাছপালার জন্য, বর্ষার পানি আর পানির তলার মাছের জন্য। বাঁশঝাড়গুলোর জন্য আমি যুদ্ধ করব, আমি যুদ্ধ করব বাঁশঝাড়ের তেনার জন্য। তেনায় থাকুন তার মতো, তাকে রক্ষা করার জন্য আমি যুদ্ধ করব, মা।
আমি যুদ্ধ করব বাগানের পাখি, প্রজাপতি আর ফড়িংয়ের জন্য, মাছি আর মশাগুলোর জন্য। ঝিঁঝিপোকা আর ইঁদুর ব্যাঙের জন্য। আমি যুদ্ধ করব মাথার ওপরকার আকাশ, বয়ে যাওয়া হাওয়া আর বৃষ্টির জন্য। আমি যুদ্ধ করব আমার নিজস্ব রৌদ্রটুকুর জন্য। আমার ছয়টি ঋতু, মানুষের ঘরবাড়ি আর ফসলের মাঠ, আমার নদী আর বিল বাঁওড়, আমার নিজস্ব পায়েচলা পথটুকুর জন্য আমি যুদ্ধ করব।
আমি যুদ্ধ করব দেশের প্রতিটি ঘাসের জন্য। সবুজ ঘাসের ডগায় লাল একটুখানি ফুলের জন্য। ফুলের সুবাস আর আকাশের চাঁদের জন্য আমি যুদ্ধ করব। আমার বাউল ফকির আর ভাটিয়ালি গানের জন্য আমি যুদ্ধ করব। আমি যুদ্ধ করব আমার স্বাধীনতার জন্য, আমার দেশের মাটির জন্য। ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা’। আমি যুদ্ধ করব আমার কবরের জমিটুকুর জন্য, আমার সাড়ে তিন হাত ভূমির জন্য।
আমার কী হয়েছে, মা!
কী হয়েছে আমার!
এই যে তোমার শরীরের অনেকখানি আমার কোলের ওপর তোলা, তোমার মাথায় মুখে আমি হাত বুলাচ্ছি, তোমার রক্তে চিটচিট করছে আমার হাত, জমাটবাঁধা রক্তের গন্ধও পাচ্ছি, সকাল থেকে রাত, তোমাদের লাশ পড়ে আছে বাড়িতে, শ্রাবণ মাস, বৃষ্টি নেই, আকাশে চাঁদ, গরম তেমন নেই, আবার আছেও, তার পরও শরীরে এখনো পচন ধরেনি কারো।
নাকি ধরেছে!
নাকি ধরেছে, মা!
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। বোধশূন্য মানুষ কি বুঝতে পারে এসব!
বারেকের কথা মনে পড়ছে মা। বুয়ার কথা মনে পড়ছে।
কিন্তু কেন মনে পড়ছে তাদের কথা! নিজের মায়ের লাশ কোলে নিয়ে বসে আছে যে ছেলে, সেই ছেলের কেন মনে পড়বে আরেক ছেলের কথা! কেন মনে পড়বে আরেক মায়ের কথা!
আমি বুঝতে পারছি না। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, মা। আমার তো মনে পড়ার কথা তোমাকে। তোমার কত দিনকার কত কথা, কত স্মৃতি। আমার জন্য কত চোখের জল তোমার। কত কান্না, কত হাহাকার। এসএসসি পরীক্ষা দিতে মুন্সীগঞ্জে গিয়ে থাকব, মাত্র তো দিন পনেরোর ব্যাপার, তাও তুমি কাঁদছ! ঢাকায় গিয়ে কলেজে পড়ব, খালার কাছে থাকব, তোমার বাড়িতেই থাকব, তাও তুমি কাঁদছ!
বাবার স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে বকুলও চলে গেল ঢাকায়। ইডেন কলেজে পড়বে। মায়াও পড়ত ওই কলেজে। তোমার দুই ছেলেমেয়ে, দুজনই ঢাকায়, চোখের আড়ালে। ছেলেমেয়ের জন্য দিনে এক-দুবার তুমি কাঁদছই! আহা রে, এত নরম মন তোমার! এত মায়াভরা মন!
প্রথমবার কলেজ ছুটির পর বাড়ি এসেছি, ফিরে যাওয়ার আগের সন্ধ্যা থেকে শুরু হলো তোমার কান্না। রাতের বেলা আমরা সবাই খেতে বসেছি। তুমি চোখ মুছছো আর আমার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছ। তোমার দিকে তাকিয়ে এত মন খারাপ হলো আমার, আবার একটা চালাকিও এলো মনে। বললাম, একটা কাজ করো মা…
শুনে তুমি তো চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেই, বাবা আর বকুলও তাকাল।
তুমি চোখ মুছে বললে, কী করতে কছ?
আমার সঙ্গে চলো।
কই যামু তোর লগে?
ঢাকায় চলো।
তারপর?
তারপর আবার কী! আমার সঙ্গে থাকবে। তাহলে আর কান্নাকাটি করতে হবে না তোমাকে। আমি সারাক্ষণ তোমার চোখের সামনেই থাকব।
আর এইদিকে কী হইব? বকুলরে কে দেখব? তোর বাবারে কে দেখব?
এসএসসি পাসের পর বকুলও তো চলে যাবে ঢাকায়। এখন শুধু ছেলের জন্য কাঁদছ, তখন তো ছেলেমেয়ে দুজনের জন্যই কাঁদবে। এত কান্নাকাটি না করে ঢাকায় চলো। বকুল ঢাকায় গিয়ে মনিজা রহমান গার্লস স্কুলে ভর্তি হোক। ওখান থেকে এসএসসি দিক।
তোর বাবা কি একলা থাকবে বাড়িতে?
বাবাকেও নিয়ে চলো।
বাবা হাসলেন। আর আমার স্কুল?
মুখের ভাত গিলে বললাম, তুমি একটা কাজ করতে পার বাবা। অনেক দিন তো স্কুল চালালে, এখন অন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে তুমি রিটায়ার করো। আমরা সবাই মিলে ঢাকায় চলে যাই। ঢাকায় থাকি।
বাবা বললেন, সেটা কখনোই সম্ভব না।
কেন?
আমি এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাব না। আমার স্কুল ফেলে কোথাও যাব না।
তাহলে আমার মা সব সময় আমাদের জন্য কেঁদেই যাবে?
বরং অন্য একটা কাজ করা যায়।
কী কাজ?
তোর মা তোদের সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে থাকল, আমি থাকলাম বাড়িতেই। কদম ওরা আছে, ওরা আমার দেখাশোনা করবে।
আমি তোমার দিকে তাকালাম। কী বলো মা? এটা তো ভালো প্রস্তাব।
তুমি চোখ মুছে বললে, ভাত খা। আর কথার দরকার নাই।
বাবাকে ছেড়ে তুমি যে যাবে না তা তো আমি জানতামই। এসব কথা তুলেছিলাম তোমার কান্নাকাটি থামাবার জন্য। বকুল আমার চালাকিটা ধরে ফেলেছিল। হাসিমুখে বলল, তুমি বুঝতে পারো নাই মা? তোমার কান্নাকাটি থামাবার জন্য দাদা এসব কথা বলল।
বকুলটা খুব বুদ্ধিমতী হয়েছিল মা। খুব বুদ্ধিমতী।
আমাদের বিক্রমপুর অঞ্চলে বড় ভাইকে দাদা বলার নিয়ম। বহু বহুকাল ধরে চলে আসছে এই নিয়ম। হিন্দুপ্রধান অঞ্চল ছিল বলেই কি এই নিয়ম কি না, কে জানে!
বকুল আমাকে দাদা বলে ঠিকই কিন্তু দাদার সঙ্গে ‘তুই’। দাদা তুই।
আহা রে আমার বোনটি! আহা রে আমার বকুল ফুলটি!
চাঁদের আলো আরেকটু প্রখর হয়েছে। তোমার আমার শরীরে বিকেলবেলার কোমল রোদের মতো পড়েছে জ্যোৎস্না। তোমার মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মা। চোখ বুজে আমার কোলে যেন ঘুমিয়ে আছ তুমি। নিথর প্রশান্ত মুখ। বন্ধ চোখের ওপর পড়েছে চাঁদের আলো। শ্রাবণ রাতের একটু একটু হাওয়া আসছে। সকালবেলার গোলাগুলির শব্দে আকাশ পাথালে উড়ে গিয়েছিল যেসব পাখি, থেমে গিয়েছিল বাড়ির পোকামাকড়, ইঁদুর, ব্যাঙের চলাচল আর ডাকাডাকি, তারা বোধ হয় ভুলে গেছে সকালবেলার স্মৃতি। ঝিঁঝি ডাকছে গলা খুলে। সঙ্গে নানা ধরনের রাতপোকা। রাতের প্রাণী বাদুড় ওড়াউড়ি করছে বাগানের দিকে। দু-একটা রাতপাখি ডাকছে।
দূরে ডাকছে, নাকি আমাদের বাড়িতেই!
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, মা। আমার কাছে সব কিছুই বহুদূরের মনে হচ্ছে। কদম পারুল আর বুয়া কোথায় গেল! বারেকের হদিস তো যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই নেই। আমাদের বল্টু, বল্টুকে কি নিয়ে গেছে কোনো রাজাকার?
না, তা হওয়ার কথা না।
বল্টু মহা তেজি। অন্য কেউ তাকে নিতে পারবে না। ঘেউ ঘেউ করে খাবলে ধরবে পা। কামড়ে বারোটা বাজিয়ে দেবে।
তাহলে বল্টুর কী হলো!
বল্টুকে কি গুলি করে মেরেছে ওরা?
নিশ্চয়ই ওদেরকে দেখে তেড়ে গিয়েছিল বল্টু। তখনই গুলি করেছে বল্টুকে। অথবা বল্টু তার স্বভাবমতো উঠানের কোণে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিল। অথবা বাড়ির পেছন দিকে, রান্নাঘরের ওদিকে ছিল। গুলির শব্দে দিশেহারা হয়ে সামনের দিকে ছুটে এসেছিল। অথবা দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল। তখনই গুলি করা হয়েছে তাকে। গুলি খেয়ে সে হয়তো ছিটকে গিয়ে পড়েছে বর্ষার পানিতে। এতক্ষণে হয়তো মরে ফুলে উঠেছে আমাদের বল্টু।
আর মিনি অমন সাদা ধবধবে আদুরে বিড়াল। তাকে নিশ্চয়ই কোলে তুলে আদর করতে করতে নিয়ে গেছে জন্তুগুলোর কেউ।
কিন্তু একবার যে আমার মনে হলো পায়রার একটুখানি যেন আওয়াজ হলো। পায়রার খোঁয়াড়, হাঁস-মুরগির খোঁয়াড় সবই তো ওরা নিয়ে গেছে, এমনকি আমাদের ঢেঁকিটাও নেই। শুধু বাড়ির ইটগুলো খুলে নিতে পারেনি। পারলে সেগুলোও নিয়ে যেত।
গুলির শব্দে পায়রাগুলো উড়ে গিয়েছিল নিশ্চয়। কোথায় কোন দিকে গিয়েছিল কে জানে।
কোনোটা কি ফিরে এলো!
খোঁয়াড়ে নিশ্চয় ছানা ছিল। দুচারটা ছানা তো সব সময়ই থাকছে কোনো না কোনো খোপে। ছানার মায়ায় কি ফিরে এলো কোনো পায়রা!
কিন্তু বিকাল থেকে আমি বাড়িতে। তখন তো কোনো পায়রার ডাক শুনলাম না, দেখলামও না কোথাও। এমনকি কাক শালিকের ডাকও শুনলাম না, চোখেও দেখলাম না। গোলাগুলির শব্দে পাখিরা সব পালিয়েছিল। আর বেশির ভাগ পাখিই তো রাতকানা। রাতের বেলা চোখে দেখতে পায় না। তাহলে রাতের বেলা কেমন করে ফিরবে পায়রা! পূর্ণিমা রাত হোক আর যাই হোক, দিনের পাখি কখনো রাতে বেরোবে না।
আসলে ডাক বোধ হয় আমি শুনিনি মা।
ওসব আমার মনের ভুল।
বিভ্রম।
নাকি উড়তে পারে না এমন কোনো পায়রা…
আচ্ছা মা, আমি এত পায়রা পায়রা করছি কেন? আমরা তো বলি কবুতর! কবুতর না বলে আমি সমানে পায়রা বলে যাচ্ছি!
এলোমেলো, সব এলোমেলো মা।
আমাদের কবুতরগুলোর কোনোটা হয়তো ভালোমতো উড়তে পারে না। হয়তো কোনো ছানা উড়তে শেখার চেষ্টা করছে। ওরা যখন বাড়ির মানুষজন শেষ করে লুটপাট চালাচ্ছে, খোপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে কবুতরগুলোর যেটা যেদিকে পারে উড়াল দিয়েছে, ওরকম সদ্য উড়তে শেখা কোনো কবুতর উড়াল দিয়ে হয়তো বেশিদূর যেতে পারেনি, কোনো গাছের ডালে, পাতার আড়ালে গিয়ে বসেছে, সে হয়তো কোনো শব্দ করে থাকতে পারে!
আমার কপালের দিকটা একটু ভেজা ভেজা লাগছে মা।
কেন বলো তো!
আমি কি ঘেমেছি!
ঘামলে তো ঘাড় গলা এগুলো আগে ঘামবে! কপালের দিকটা কেন!
দেখো তো কী কাণ্ড! আসলে কপালের দিকটাই ঘামবার কথা। শেষ বিকালে বাড়ি ঢুকে তোমাদেরকে দেখে, প্রথমে বাবাকে উঠানে পড়ে থাকতে দেখে, বসাঘরে তোমাকে, বকুল মায়া আর মায়ার গর্ভজুড়ে আমার ছেলে সব দেখে আমি উদ্ভ্রান্তের মতো ঢুকলাম মায়া আর আমার রুমে।
না না, মায়াকে দেখার আগেই ওকে খুঁজতে ঢুকেছিলাম আমার রুমে। সেই রুমে কিছুই নেই। সব লুটপাট হয়ে গেছে। এককোণে পড়ে আছে কতকগুলো ছেঁড়াখোঁড়া জীর্ণ পুরনো খবরের কাগজ। ওই দিকটায় ওদের বোধ হয় চোখ পড়েনি। চোখ পড়লেই বা কী! ওই জিনিস দিয়ে ওরা কী করবে? ওগুলো ওরা ছুঁয়েও দেখেনি।
কিন্তু ওর তলায় ছিল মহা মূল্যবান এক সম্পদ। কাগজগুলোর দিকে তাকিয়েই আমার সে কথা মনে পড়েছিল। বাড়িতে ঘটে গেছে এত বড় সর্বনাশ, সে কথা যেন আমি ভুলে গেলাম। পাগলের মতো হাতড়াতে লাগলাম কাগজগুলো। তলার দিকে পেয়ে গেলাম আমার সম্পদ। আমার স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সবুজ জমিনের ওপর লাল টকটকে সূর্য। সূর্যের বুকে হলুদ রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র।
গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডে, মনিজা রহমান গার্লস স্কুল ছাড়িয়ে ফারুক ভাইদের বাড়ির সামনে কাশেমের মুদি দোকান আর মোসলেমের দর্জি দোকান। অতি যত্নে মোসলেম দর্জি এই পতাকা আমাকে তৈরি করে দিয়েছিল। বাড়ি আসার সময় পতাকাটা আমি নিয়ে এসেছিলাম। মায়ার হাতে দিয়েছিলাম। কী মনে করে পুরনো খবরের কাগজের তলায় পতাকাটা যত্নে রেখে দিয়েছিল মায়া। রুমে ঢুকে, ফাঁকা শূন্য রুম, কোথাও কিছু নেই শুধু এককোণে পড়ে আছে খবরের কাগজগুলো, সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়েছে পতাকার কথা। আমি পাগলের মতো কাগজগুলো এলোমেলো করে বের করলাম পতাকা। সেই পতাকা ভাঁজ করে পেঁচিয়ে বাঁধলাম মাথায়। যেন একজন বীর যোদ্ধা তার প্রাণপ্রিয় পতাকা মাথায় বেঁধে শত্রুর বিরুদ্ধে এখনই শুরু করবে ভয়াবহ যুদ্ধ। শত্রুর শেষ না করে সে থামবে না।
এই এতক্ষণে কপালের দিকটা ভেজা ভেজা লাগতেই বুঝলাম মাথায় পতাকা পেঁচিয়ে বাঁধা। এ জন্যই কপাল মাথা ঘেমেছে। এই পতাকাই তো এখন আমার একমাত্র শক্তি, মা। এই পতাকাই এখন আমার সব কিছু।
আমি আমার পতাকার জন্য যুদ্ধ করব।
আমি আমার জাতীয় সংগীতের জন্য যুদ্ধ করব।
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

(চলবে)