কেরানিও দৌড়ে ছিল


আবার সেই ফিরতি যাত্রা, হস্তিবাড়ি থেকে ঢাকা, হস্তিবাড়ির বিল পাড় থেকে বুড়িগঙ্গার সদরঘাট। ঢাকা থেকে হস্তিবাড়ি যাত্রাকালে মনের অবস্থা ছিলো এক রকম_ তখন তো সে বিয়ে করতে যাচ্ছিলো, এখন ফিরতি পথে আরেক রকম_ ঘোর একটা অতৃপ্তি নিয়ে সে ফিরছে। ভেবেছিলো, ঢাকা ফিরে সে জানাবে তাকে বিয়ে করতে হয়েছে। বলবে, বাবার অসুখটা এত বৃদ্ধি পায় যে তিনি মৃত্যুর আগে পুত্রবধূর মুখ দেখতে চান, তখন তড়িঘড়ি তাকে বিয়ে করতে হয় গাঁয়েরই এক মেয়েকে। কিন্তু বিয়ে নামে মাত্রই, বিয়ের সকল আচার পুরো হয় নাই, মদিনার সঙ্গে তার মিলন হয় নাই। যদিবা মদিনা নামের পবিত্রতা সে কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলো বাসরের পরের রাতেই, কিন্তু ওই মনির মৃধার স্মৃতি মনির ভুলতে পারে নাই। যতবারই সে মদিনার গায়ে হাত দিতে চেয়েছে বৌ তার আতঙ্কিত হয়ে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। মনির মৃধা তার বিবাহ-সুখের সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে।
বাবার খবর কী? বাড়িতে এই প্রশ্ন। বাবার খবর কী? লঞ্চের ম্যানেজারের প্রশ্ন। ঢাকায় এসেই কেরানি প্রথমে সদরঘাটে গিয়েছিলো খবর দিতে যে সে এসে গেছে। জানতে গিয়েছিলো আজ থেকেই তার ডিউটি কি-না। রহম আল্লার, ডিউটি আগামীকাল। সুখানি জানতে চায়, কি মিয়া, আব্বায় নি ভালা? কেরানি প্রতি প্রশ্নেই থম ধরে থাকে। কিছুক্ষণ পরে অস্টম্ফুটস্বরে শুধু উম্-না-হ্যাঁ-আছে-এক রকম-আছে বলে। তার কাতর বিষণ্ন চেহারা দেখে কেউ আর বিশদ জানতে চায় না।
সেই যে ভেবেছিলো বিয়ের কথা সে জানাবে, কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না। বরং বিয়েটাই তার কাছে অবাস্তব বলে প্রতীয়মান হতে থাকে। যেন তার নয়, অন্য কারো বিয়ে হয়। সিনেমার ছবির মতো বিয়ের দৃশ্য তার চোখে ভাসে। সিনেমা হলের পর্দার মতোই তা শূন্যপটে চিত্রের প্রক্ষেপণ হয়ে থাকে। কেরানির চোখের ভেতরে মদিনার সেই প্রত্যাখ্যান ঘুরপাক খেতে থাকে। অন্ধকার ঘর। বিছানার একপাশে গুটি মেরে পড়ে থাকা মদিনা। একটা হাত। কেরানির হাত। ধীরে সে হাতখানি যদিবা পাঠায় মদিনার দিকে, মেয়েটি সরে সরে যায়। সরে সরে যায়। সরে সরে যায়। কেবলি সরে সরে যায়। সরতে সরতে দুড়ূম করে পড়ে যায় মদিনা। চৌকি থেকে ওপাশে মাটিতে পড়ে যায়। এক রাত। দুই রাত। তিন রাত।
আসবার আগের রাত। তখন অনেক রাত। ঘরে ঢুকে কেরানি দেখে মদিনা চৌকিতে নাই। জানালার কাছে মাথা নিচু করে বুকের কাছে হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে।
বিছানায় আসো।
মদিনার সাড়া নাই।
আসো।
সাড়া নাই।
রাত অনেক হয়েছে।
তবু সাড়া নাই।
শেষ রাতে আমাকে রওনা হতে হবে।
হ্যাঁ, শেষ রাতে উঠে নদী পাড়ি দিয়ে জলেশ্বরী গিয়ে ভোর সাতটার বাস তাকে ধরতে হবে। বড়বুবুর অনুরোধে তাকে একটা দিন বেশি থাকতে হয়েছে। আজ ভোরের বাস ধরতে পারলে তবে যদি তিনটার মধ্যে ঢাকা পেঁৗছুনো যায়, তারপর সোজা সদরঘাট, হয়তো আজই তাকে লঞ্চের ডিউটিতে ম্যানেজার লাগিয়ে দেবে।
এই একটা রাত। কবে আর আসি ঠিক নাই। ছুটি পাই কি না পাই! বিছানায় আসো।
মন্ত্রের মতো কাজ হয় যেন, এক মুহূর্ত দেরি না করে মদিনা এসে চৌকিতে শুয়ে পড়ে। একেবারে কিনার ঘেঁষে মেয়েটা পড়ে থাকে। দরোজা লাগিয়ে কেরানি তার পাশে আসে, ইতস্তত করে কিনারে বসে। তারপর ফিসফিস করে বলে, কি, তুমি এমন করো কেন?
মদিনার উত্তর নাই।
আজ তিন তিনটা রাত। কী! কথা কও না যে! তোমার কি কোনো সমস্যা? একটা কথা শুনছিলাম! খুব চিন্তার কথা।
মদিনা তৎক্ষণাৎ পা গুটিয়ে শক্ত হয়ে দলা পাকিয়ে যায়।
কেরানি বলে, আশা করি সেই শালা মনির তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারে নাই। নান্নার কাছে আমি সব শুনেছি।
এতক্ষণে মদিনার সাড়া পাওয়া যায়। সাড়া মানে খিনখিন করে তার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। অনেকক্ষণ তাকে কাঁদতে দেয় কেরানি। তারপর একটা হাত সে বাড়ায়। হাত বাড়িয়ে মদিনার শরীরে রাখে। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা উঠে বসে। যেন সাপ! সাপ তার অঙ্গে উঠেছে! মদিনা আলুথালু হয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে।
আমাকে তোমার পছন্দ হয় নাই? বলো, পছন্দ হয় নাই?
মদিনা মাথা নাড়ে।
পছন্দ হলে এমন করছো কেন? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বোঝো না, বোঝার বয়স তো তোমার!
মদিনার মুখে ভাষা ফোটে। _আমাকে ছাড়ি দেও!
কী বেদনা মেয়েটার স্বরে। কেরানির মন গলে পানি হয়ে যায়। বলে, তোমার অনিচ্ছায় কিছু করবো না। আবার যখন আসবো, তখন হবে। নিদ যাও।
মদিনা এ কথা শুনে স্বামীর দিকে তাকায়। গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর শান্ত মেয়েটির মতো পাশ ফিরে চোখ বোজে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে কেরানি তার পাশে অনেকটা জায়গা ছেড়ে শুয়ে পড়ে। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই তাকে উঠে হস্তিবাড়ি ছাড়তে হবে। একটু না ঘুমোতে পারলে চলবে কেন?
কিন্তু ঘুম আসে না তার। মদিনার পাশে সে রাত জেগে পড়ে থাকে।
তারপর শেষরাতে উঠে গোসল করে সে। আকাশে নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। গাছের পাতায় শিশিরের টুপটাপ। চারদিক নির্জন নিস্তব্ধ। কুয়োর পাড়ে গোসলের শব্দ পেয়ে বড়বুবু বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। বড় মায়া চোখে তাকিয়ে থাকে ভাইটির দিকে।
গামছা দিয়ে গা যখন মুছছে বড়বুবু কাছে এসে জানতে চায়, বৌ ওঠে নাই?
না।
ভাব হইছে বৌয়ের সাথে?
হয়, হয়।
ওকি কথা!
আর কেমন করি এ সকল কথা কওয়া যায়, বুবু! তোমার বৌ সুস্থ নয়। তাকে ধরি বিয়া দিলে! আগেপরে ভাবিয়া দেখিলে না! কী করিলে! নিরর্থক বিয়া!
ভাইয়ের হাতখানা ধরতে এগিয়ে আসে বোন, ভাই ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নেয়। বুবু ডাক দেয়, ও বৌ! বৌ! উঠি দ্যাখো, বিদায় দেও!
আর না বোলান তাকে।
কেরানি দ্রুতহাতে জামা-প্যান্ট পরে বাবার ঘরে যায়। _যাই তবে! ছুটি পাইলে ফির আসিমো।
জলদি আসিস। নয়া বৌ!
বৌ নিয়া তোমরা ঘর করেন! আম্মা গো, তবে যাই।
বুবু বলে, যাই কোন্ কথা! কও, আসি।
ওই একে কথা! _বলেই হনহন করে বাড়ি থেকে সড়কে নামে কেরানি। মাথার ওপরে নক্ষত্রের রাশি আগুনের ফুলকি হয়ে জ্বলছে। মাথার ভেতরে আগুন তার। গাছগুলো ভূতের মতো ঝাঁকড়া চুল নিয়ে সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারাও এখন হঠাৎ বাতাস পেয়ে সাঁ সাঁ করে ওঠে।
এত রাতে ভ্যান পাওয়া যাবে না। হেঁটেই তাকে আধকোশা অবধি যেতে হবে। ধাঁ ধাঁ করে হাঁটলে ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই ঘাটে পেঁৗছে যেতে পারবে। কিছুদূর যেতেই পেছন থেকে ডাক আসে_ যেন ভূতের গলায় ডাক_ আরে, দাঁড়াও রে!
নান্না! নান্না ছুটে আসছে। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলে, আরে, তোর বাড়ি যায়া দ্যাখো তুই রওনা হয়া গেইছিস!
এত রাইতে ক্যান বা আসিলি!
আসিলোম একটা খবর দিতে।
খবর?
হয়, হয়, খবর। হাকিমদ্দি মনিরকে নিয়া বডারে গেইছে।
তো শুনিয়া হামার লাভ?
আইজে এক কাণ্ড করি ইন্ডিয়ার গার্ডের হাতে তুলি দিবে তাকে।
দিক! হামার শুনিয়া কাম নাই।
কেরানি আর দাঁড়ায় না। নান্নাকে পেছনে ফেলে সে নদীর দিকে ছুটতে থাকে।
নান্না তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে না দৌড়ে ওখানেই থেমে চেঁচিয়ে বলে যায়, বুবুজান কইলে বৌ ফেলি তুই যাচ্চিস! বৌ তোর দোষী দাগি নয়!
কেরানির জানার কথা নয়, বড়বুবু তখনো বাড়ির সড়কে দাঁড়িয়ে ছিলো, আর নান্না তার কাছে ফিরে গিয়েছিলো।
বুবুজান, এ সকল কথা তোমারও তো জানা। আমার কাছেও জবরদস্তি জেরা করি সমুদয় তোমার ভাই শুনিছে। মনে হয় না আর ফিরি আসিবে।
না! ও কথা না কও, নান্না!
কান্দিও না।
নারীর দুঃখ! নারীর জীবন! _বড়বুবু হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে তখন।
কিন্তু কেরানি ততক্ষণে নদীর ঘাটে পেঁৗছে গেছে। এ কান্না তার কানে পশে নাই।
সদরঘাটে এসে আজ তার ডিউটি নাই শুনে কেরানি বুলবুল মিয়ার বাড়িতে নিজের ঘরে এসে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। আমরা আগেই শুনেছি ও জেনেছি, কেরানির পূর্বাপর চিন্তা করার ধাত নয়। তার ধারাটাই এমন যে, প্রতি মুহূর্তে তার অতীত পেছনে পড়ে যায় এবং সে নির্ভাবনায় পরবর্তী অধ্যায়ে পা রাখে।
অতএব কেরানি এখন মদিনার কথা ভাবে না। মদিনা নামে কোনো নারী তার জীবনে আসে নাই। হস্তিবাড়িতে মাত্রই পাঁচ দিন আগে সে কাউকে বিয়ে করে নাই। খাতার শাদা পৃষ্ঠার মতো তার সময় এখন। সময় এবং জীবন। জীবনে অতঃপর যা কিছু। না, সে বুবুর হাতে বাবার জবানিতে লেখা চিঠি পেয়ে দেশের বাড়িতে যায় নাই। সে ঢাকাতেই আছে এবং ছিলো।
মগরেবের আজান পড়ে। তিন দিক থেকে তিনটি মাইকে নামাজের জন্যে আহ্বান ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। ঘরের ভেতরে অন্ধকারে পড়ে থাকে কেরানি। একবার মনে হয়, সন্ধ্যাকালের আজান শুনে তার উঠে বসা কর্তব্য। কিন্তু শরীর সাড়া দেয় না। তবু জোর করে সে উঠে বসে। বসে থাকে খানিক। তারপর যখন শেষ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ থেমে যায়, ধপ করে আবার সে বিছানায় ভেঙে পড়ে।
ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে রুহিতনের মা ভেতরে উঁকি দেয়।
কি জজ মিয়া, বাড়ি থন? হুড়মুড় কইরা আইলেন দেখলাম। আইয়াই হুইয়া পড়লেন! তাই আর লাড়া দিলাম না। খবর কী? আব্বায় কেমুন আছে?
কেরানি একটু তরাসে ছিলো, হয়তো রুহিতন এসে হাঁক দেবে। রুহিতনের বদলে তার মায়ের গলা শুনে স্বস্তি পেলো। রুহিতনকেও তার এখন ভয় করছে। মেয়েটা যা খর! হয়তো তার গায়ের বিয়ের গন্ধটা ঠিকই টের পেতো সে। ভয়ে ভয়ে ছিলো কেরানি।
মায়ের গলা শুনে কেরানি ধড়মড় করে উঠে বসে বলে, এখন ভালো।
মনডা খারাপ? আইয়াই হুইয়া পড়লেন যে!
লম্বা জার্নি তো।
মহিলা তখন ঘরের ভেতরে আসে। হাতে তার এনামেলের খাঞ্চা।
মন খারাপ কইরেন না। উইঠা বহেন। আপনের লাইগা ঝাল পিঠা বানাইছি। দেইখাই খোলা চড়ায়া দিছিলাম। লন, চা দিতাছি। খায়া গুছোল দ্যান। আইজ ডিউটি আছে নি?
না, কাল থেকে ডিউটি।
কেরানি একটু অবাক হয়। এতটা খাতির সে আশা করে নাই। এর আগে কখনো তাকে পিঠা-চা দিয়ে আপ্যায়িত করার ঘটনা ঘটে নাই। সে মনে করে, বাবার অসুখ শুনে হয়তো এদের খারাপ লেগেছে, তাই এত যত্ন।
পথযাত্রার ক্লান্তির মুখে ঝাল পিঠা তার ভালোই লাগে।
রুহিতন কইতে আছিলো_
বাক্যটা শেষ করে না মহিলা। কেরানি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ পরে মহিলা বলে, রুইতনে কইলো ঝাল পিঠা বানাও। দূরের রাস্তা ভাইঙা আসতে আছে। কাহিল মুখে সোয়াদ পাইবো। কইয়াই তো খালাস! কই যে গ্যালো। কইলাম, ওরে মানুষটা যে আইলো, বাড়িতে থাকিস! তা কি থাকবো? মগরেবের আজান পইড়া গেলো, তার যদি বাড়ির দিকে পাও ওঠে!
কেরানি ভদ্রতা করে বলে, আপনারা সবাই ভালো তো?
আর ভালা! হের রোজগারপাতি নাই। মুনিসিপালিটি থিকা নতুন অডার জারি হইছে, বড় সড়ক দিয়া ঘুড়াগাড়ি চালান যাইবো না। কন তো বাবা, চালান যাইবো না তো সংসার চলবো কেমতে? তার উপ্রে জুয়ান মাইয়া অবিয়াত ঘরে!
কথাটা শুনে শোভনভাবে নীরব থাকে কেরানি।
সেই নীরবতায় উৎসাহ পেয়ে মহিলা কলকল করে বলে চলেন, হারাদিন পাড়াবেড়ানি। মাইনষে ভি খচ্চর হয়া পড়ছে। কয় বোলে, তুমার মাইয়ার বিয়া দেওন মুশকিল আছে। আমি কই বিয়া যহন হইবো চক্ষেই দেখতে পাইবা। দাওয়াতের বেলা তহন আইয়ো ব্রিয়ানি খাইতে! ঝাঁটা মারুম নে!
কেরানি হাসে। কিন্তু হাসিটা ঠিক জমে না। নিজের কানেই কেমন শুকনো ঠেকে। বুকের মধ্যে কী একটা ঠাস হয়ে বসে থাকে। কানে রুহিতনের সেদিনের সেই ফোনের কথাটা বেজে ওঠে, আমি পলাইতেও রাজী!
মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে কেরানির। না, আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, মদিনার স্মৃতি তখনো তার মনে ফেরে নাই। মদিনা কে? এই যা এখানে, এটাই বাস্তব_ বাস্তব বলে কেরানির কাছে বোধ হতে থাকে। রুহিতন তাকে ভর করে থাকে।
ঠিক এই সময়ে রুহিতনের গলা পাওয়া যায়।
আম্মা!
ওই আইছে!
কার লগে কথা কও!
আয়া দেইখা যা!
কেরানি থম্ ধরে বসে থাকে। অপেক্ষা করে। কখন রুহিতন আসে। রুহিতনকে দেখতে তার ইচ্ছে করে। মনে হয়, এক যুগ তাকে সে দেখে নাই। কিন্তু রুহিতন আসে না। তখন তার মা বলে, নাহ্, যাই। দেইখা আসি শাজাদীরে! আপনে কলাম পিঠা কয়টা সব খাইবেন। ফালায়া রাখবেন না।
কী জানি কেন, রুহিতনের মায়ের যত্নটা বড় মিষ্টি লাগে কেরানির। তার মনে হতে থাকে, এই সে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে, তার নিজের মা-ই যেন আবদার করে পিঠা কয়টা শেষ করবার আদরের অনুরোধ করছে তাকে।
রাতে বুলবুল মিয়া ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে ফেরত আসে। এসেই ঘোড়াকে কোনোরকমে একটু দানাপানি দিয়েই কেরানিকে হাঁক দেয়, জজ মিয়া, খবর কী? আব্বায় কেমুন?
এখন ভালো।
হাঁক শুনে বাইরে আসবে ভেবেছিলো, তার আগেই বুলবুল মিয়া ঘরে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই বলে, ইস্সিরে, ঘর আন্ধার কইরা হুইয়া আছেন?
পেছন থেকে তার স্ত্রী বলে, আইছে থনে হুইয়া আছে, বাত্তি ভি জালায় নাই।
ক্যা? কিল্লা?
বুলবুল মিয়া নিজেই বাতি জ্বেলে দেয়। ততক্ষণে শোয়া থেকে উঠে বসেছে কেরানি। এও তার জন্যে নতুন, তার ঘরে বুলবুল মিয়ার আসাটা।
কেরানি বলে, আব্বা ভালো আছে এখন। তবে খুব কাহিল। বিছানা থেকে ওঠার শক্তি নাই।
আপনেরও দেখি সেই হাল। আপনে ভি বিছনা লইছেন!
না, আমি ঠিক আছি।
বুলবুল মিয়া দুয়ারের কাছে দাঁড়ানো স্ত্রীর দিকে ফিরে বলে, জজ মিয়ারে চা পানি দিছো?
দিছিলাম তো।
কি দিছো?
ঝাল পিঠা।
ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে বুলবুল মিয়া।
আক্কেলখান কী! মিঠা-উঠা দিবা, না দিছো ঝাল!
স্ত্রীও কম যায় না। পালটা গলা চড়িয়ে বলে, ক্যান, কাহিলের মুখে ঝাল দিছি, খরাবটা কী করছি? মিঠা খাওনের মেলা টাইম আছে। আপনে আর কতা বাড়াইয়েন না।
কেরানির মনে একটা কথা খেলা করে। রুহিতন! রুহিতনকে এখনও দেখা যাচ্ছে না যে! বাড়িতে এসে একবারও রুহিতন উঁকি দিলো না, ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত মনে হতে থাকে তার। তার ভেতরটা যেন রুহিতনকে দেখার জন্যে ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে।
আমরাও একটা অদ্ভুত ব্যাপার এখানে এসে লক্ষ করবো_ কেরানির মনে মদিনার কোনো স্মৃতি নাই! যেন মদিনা নামে কেউ তার জীবনে নাই। সর্বাংশে মদিনাকে সে ভুলে বসে আছে।
বুলবুল মিয়া স্ত্রীর উদ্দেশে বলে, খানাউনা কী পাকাইছো?
কী আর! কতডি ট্যাংরা মাছ পাইছিলাম, গলি দিয়া মাছুয়া ব্যাডা হাঁকতে হাঁকতে যাইবার লইছিলো, রাখছি। বাগুন দিয়া ছালোন করছি।
তো কাম করছো! জানি্ন কইরা আইছে, ভালামন্দ পাকাইবা, না ট্যাংড়ার কতা হুনাইলা! মোরগ জবো করতে পারলা না? তুমারে না কইলাম আফলাতুনে আইবো, রাইতে আমগো লগে খানা খাইবো?
হে তো কুনকালে কয়া রাখছেন!
নাহ্, তুমারে লয়া ঘর করোন! যাই দেহি।
বুলবুল মিয়া তড়িঘড়ি উঠে যায়।
অচিরে মোরগ জবাই করবার করকরানি শব্দ পাওয়া যায়। অবিশ্বাস্য! তার জন্যে মোরগ জবাই হচ্ছে! না, না, তার জন্যে কেন, আফলাতুন মিয়া আসবে, তারই কারণে মোরগের সালোন আজ হবে। কিন্তু আজকেই বা কেন আফলাতুন মিয়াকে এত খাতির? কেরানি এ বাড়ি জায়গীর এসেছে থেকে তো আফলাতুনকে কখনো খানা কবুল করতে দেখে নাই!
(চলবে)