আরজ আলী মাতুব্বর

আরজ আলী মাতুব্বর (১৯০০–১৯৮৫), স্ব-শিক্ষিত, স্বধর্মত্যাগী দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং লেখক। তিনি ১৭ই ডিসেম্বর ১৯০০ (বাংলা সালঃ ১৩০৭) বরিশাল শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে চড়বাড়িয়া ইউনিউয়নের অন্তর্গত লামছড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর প্রকৃত নাম ছিলো “আরজ আলী”। আঞ্চলিক ভূস্বামী হওয়ার সুবাধে তিনি “মাতুব্বর” নাম ধারণ করেন। তিনি গরীব কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি মক্তব গ্রামে কিছুকাল পড়াশোনা করেন। সেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুধুই কোরান ও অন্যান্য ইসলামিক ইতিহাসের উপর সিক্ত হয়েছিলো। তিনি নিজ চেষ্টায় বিজ্ঞান ও দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করেন।তিনি ইসলাম-বিরোধী কর্মী হিসেবে সর্বদা সমালোচনা করেন। জগত ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী জিজ্ঞাসা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে যা থেকে তাঁর প্রজ্ঞা, মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।

 

জীবন দর্শন ও সৃষ্টি

মাতুব্বর ছিলেন সাম্যবাদী ঢঙের, অনেক অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেন।তাঁর লেখার জন্য তাঁকে ধর্মীয় ভাবমূর্তির প্রতিমাধ্বংসকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, তিনি ইসলামের বংশগতির ধারা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেন এবং স্বকীয় মত-বৈশিষ্ট্য একমতে আনতে ব্যর্থ হন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঘাটতি সত্ত্বেও তিনি কতিপয় বই সাহসীকতার সহিত লেখেন। বিশ্ব ও জীবন সম্পর্কে তাঁর দার্শনিক লেখা বিতর্কিত হয়ে পড়ে।

মাতুব্বর বরিশালের অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির, অধ্যাপক মুহাম্মদ সামসুল হক সহ অন্য অনেক সংখ্যক সাম্যবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিলো। তাঁর বইগুলো সর্বদাই সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধের হুমকিতে থাকত, কারণ তাঁর লেখনী রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু লোকদের মতের বিরুদ্ধাচারিত নির্দিষ্ট দাবিকৃত ধর্মীয় মত বা ভাবাদর্শ ধারণ করত। মাতুব্বরকে তাঁর বই – “সত্যের সন্ধানে”র (Sotyer Shondhaney) জন্য বন্দী করা হয় এবং পুলিশ হাজতে নেয়া হয়। লেখনীর কারণে তিনি যতবার দাবিকৃত ধর্মীয় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ততবার তাঁকে হুমকি ও হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়।

প্রথম জীবন

বরিশাল শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে লামছড়ি নামক গ্রামে বাংলা ১৩০৭ সনের ৩রা পৌষ এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে আরজ আলী মাতুব্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম এন্তাজ আলী মাতুব্বর। বার বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। এর পরে দুই একরের (৮১০০ মিটার) বসতবাড়িটি নিলামে উঠে। জমিজমাহীন বালক আরজ আলী স্থানীয় সুদখোরদের কাছে তখন তাঁদের পরিবারটি দেনার দায়ে পূর্বপুরুষের ভিটামাটি হারিয়ে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়ে যায়। অন্যের দয়া দাক্ষিণ্যে বহু কষ্টে খেত খামারে কাজ করার কারণে আর দরিদ্র আরজ আলী আর স্কুলে পড়ার সুযোগ পান নি। আরজ আলী নিজ গ্রামের মুন্সি আবদুল করিমের মসজিদ দ্বারা পরিচালিত মক্তবে সীতানাথ বসাকের কাছে ‘আদর্শলিপি’ পড়তেন। দরিদ্রতার কারণে নিয়মানুবর্তিতার অভাবে তাঁকে মক্তব ছাড়তে হয়। এরপর তিনি কৃষিকাজে নিয়োজিত হন। পরে এক সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তায় তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। সাথে সাথে তিনি নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় লেখাপড়া শিখতে থাকেন। নিজের জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে তিনি বরিশাল লাইব্রেরীর সমস্ত বাংলা বই একজন মনোযোগী ছাত্রের ন্যায় পড়েন। দর্শন ছিলো তাঁর প্রিয় বিষয়। কিন্তু পাঠাগারে পর্যাপ্ত বই ছিলো না। পরে বিএম মহাবিদ্যালয়ের দর্শনের এক শিক্ষক – কাজী গোলাম কাদির তাঁর জ্ঞানগর্ভ বিচার দেখে মোহিত হন এবং তিনি মহাবিদ্যালয়ের পাঠাগার থেকে বই ধার দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এভাবেই তাঁর মানসিক আকৃতি গঠিত হয়।

বসবাস

আর্থিক সঙ্কটের কারণে, মাতুব্বর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কোর্স বা ডিগ্রী লাভ করতে পারেন নি। কৃষিকাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি জমি জরিপ বা আমিনের কাজ শিখে নেন। এরপর জমি জরিপের কাজকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কৃষি ক্ষেতের জন্য এভাবে কিছু পুঁজি জমা করেন।

 মৃত্যু

১৫ই মার্চ ১৯৮৫ সাল বাংলা সনের ১লা চৈত্র ১৩৯২তারিখে তিনি ৮৬ বছর বয়সে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পরলোকগমন করেন।তিনি মরণোত্তর চক্ষুদান করেন।মেডিকেলের ছাত্রদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ-এর এনাটমি বিভাগে মরণোত্তর দেহদান করেন। মৃত্যু পরবর্তী আরজ আলী মাতুব্বর বাংলাদেশের গ্রাম্যসমাজে এই পর্যন্ত পরিখার আদলে গড়ে উঠা বিশ্বাস ও কুসংস্কারে অকুতোভয় ছিলেন।

লেখালেখি ও রচনা বলী

মাতুব্বরকে তাঁর বইগুলো প্রকাশে অনেক বাধা পেরোতে হয়েছিলো। এমনকি তিনি তাঁর প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদও আঁকেন, যেটি ১৯৫২ সালে লেখেন এবং ১৯৭৩ সালে “সত্যের সন্ধানে” তা ছাপানো হয়। এই বইটি তাঁকে তাঁর এলাকায় “শিক্ষিত ব্যক্তি” হিসেবে সুনাম এনে দিয়েছিলো। মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেনঃ “আমি অনেক কিছুই ভাবছি, আমার মন প্রশ্নে ভরপুর কিন্তু এলোমেলোভাবে। আমি তখন প্রশ্নের সংক্ষেপণ লিখতে থাকি, বই লেখার জন্য নয় শুধুমাত্র পরবর্তীতে মনে করার জন্য। অসীম সমুদ্রের মতন সেই প্রশ্নগুলো আমার মনে গেঁথে আছে এবং আমি ধীরে ধীরে ধর্মীয় গন্ডি হতে বের হতে থাকি।” তিনি এই বইটিতে দার্শনিক প্রশ্নগুলোর সাতটি বিবৃতি তুলে ধরেন। সেগুলো হলোঃ
বিবৃতি একঃ আত্মার সাথে সমঝোতা, বেশি হলে ৮টি প্রশ্নে গঠিত।
বিবৃতি দুইঃ ঈশ্বরের সাথে সমঝোতা, বেশি হলে ১১টি প্রশ্ন।
বিবৃতি তিনঃ পরলোক, বেশি হলে ৭টি প্রশ্ন।
বিবৃতি চারঃ ধর্মীয় উপাদান, বেশি হলে ২২টি প্রশ্ন।
বিবৃতি পাঁচঃ প্রকৃতি, বেশি হলে ১০টি প্রশ্ন।
বিবৃতি ছয়ঃ জড়বস্তু, বেশি হলে ৯টি প্রশ্ন।

প্রথম আটটি প্রশ্নে তিনি নিজের ভাবভঙ্গি ব্যক্ত করেন। যেমন – ১। আমি কে? (নিজ) ২। জীবন কি শরীরী বা অপার্থিব? ৩। মন এবং আত্মা কি একই জিনিস? ৪। জীবনের সাথে শরীর বা মনের সম্পর্ক কি? ৫। আমরা কি জীবনকে চিহ্নিত করতে পারি? ৬। আমি কি মুক্ত? ৭। মরণোত্তর আত্মা শরীর বিহীন জ্ঞান ধারণ করে? এবং সর্বশেষ, ৮। কিভাবে শরীররে আত্মা প্রবেশ করে ও বের হয়?

প্রকাশিত গ্রন্থ

তিনি একজন অন্য প্রকৃতির লেখক ছিলেন। তাঁর কারণ তাঁর গ্রামীণ পটভূমি। তাঁর পক্ষে সমাজে বিরাজ করা অন্ধকার মেটানো সম্ভব ছিলো না, কিন্তু তিনি যতদূর পেরেছেন তাঁর ক্ষীণ ও নিষ্প্রভ আলো ভয়হীন বা সন্দেহ ছাড়াই ধারণ করেছেন। বাংলাদেশে, তাঁর লেখা যে সব বইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ (সেন্সর) করা হয় সেগুলো হলঃ

সত্যের সন্ধানে, (The Quest for Truth) (1973)
সৃষ্টির রহস্য, (The Mystery of Creation) (1977)
অনুমান, (Estimation) (1983)
মুক্তমন (Free Mind) (1988)

মরণোত্তর কতিপয় কিছু অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি আরজ আলী মাতুব্বরের রচনাবলী শিরোনামে প্রকাশিত হয়। তাঁর কিছু লেখা ইংরেজীতে ভাষান্তর করা হয় এবং পাঠক সমাবেশ কর্তৃক সেগুলো খন্ডাকারে আবদ্ধ করা হয়। এছাড়া তার আরো কতিপয় প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে –
ম্যাকগ্লেসান চুলা (১৯৫০)
স্মরণিকা (১৯৮২)

সম্মাননা
বাংলা একাডেমী কর্তৃক আজীবন সদস্য পদ প্রদান এবং বাংলা ১৩৯২ সালের ১লা বৈশাখ নববর্ষ সংবর্ধনা জ্ঞাপন।
হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৩৮৫ ব.)
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী কর্তৃক বরণীয় মনীষী হিসেবে সম্মাননা (১৩৯২ ব.)
বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ প্রতি বছর তার স্মরনে আরজ আলী মাতুব্বর স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে থাকে।

তথ্যসূত্র

1.১.০ ১.১ ১.২ ১.৩ Matubbar, Aroj Ali
2.২.০ ২.১ The Quest for Truth
3. http://www.prothom-alo.com/print/news/148821
4.http://www.prothom-alo.com/print/news/148821
5.The Quest for Truth
6.The Quest for Truth
7.http://www.mukto-mona.com/Special_Event_/5_yrs_anniv/sirajul_islam_chy/aroj1.htm
8.Freedom of speech
9. http://www.prothom-alo.com/print/news/148821