প্রিয় সুনীলের কথা

পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকের কথা। সুনীলের বয়স তখন আঠারো-উনিশের বেশি হবে না, আর আমি তখনই সাতঘাটের জল খেয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় এসে ঢুকেছি। কাজ করতুম রবিবাসরীয় বিভাগে। সেখানে গল্প বাছাই করতে-করতে হঠাৎ একটা গল্পে আমার চোখ আটকে যায়। গল্প ছাপোষা এক চাকরিজীবী মধ্যবয়সী ভদ্রলোককে নিয়ে। তাঁর চশমা জোড়া হারিয়েছে, অথচ আপিসে না-গিয়ে তাঁর উপায় নেই। অগত্যা অল্পবয়সী ছেলের (না কি মেয়ের?) চশমা চোখে এঁটেই তাঁকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে হয়। এবং, তারই ফলে ঘটে যায় এক তাজ্জব কাণ্ড। তিনি খুঁত খুঁতে মানুষ। অথচ আজ রাস্তায় বেরিয়ে যা-কিছু দ্যাখেন, যা-কিছু শোনেন, তা-ই তাঁর ভালো লাগতে থাকে। আপিসের পরিবেশ তাঁর একটুও পছন্দ নয়, অথচ আজ তাও তাঁর খারাপ লাগে না। প্রতীকী গল্প। যার মোদ্দা কথাটা এই যে, পৃথিবী মোটেই খারাপ একটা জায়গা নয়, তবে কিনা সেটা বুঝতে হলে নজরটাকে পালটে নেওয়া চাই। সাদা-সাপটা গল্প, কিন্তু সেটা যে এমন একজন লেখকের হাত থেকে বেরিয়েছে, যাঁর বয়স তখন কুড়িরও কম, এইটে দেখেই আমি চমকে গিয়েছিলুম।
সুনীলকে তার আগে পর্যন্ত আমি কবি বলে জানতুম। গল্পকার হিসেবে তাঁর সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। প্রিয় কবিকে গদ্যের আসরে ঢুকতে দেখে প্রথম-প্রথম যে অনেকেই একটু অস্বস্তি বোধ করেননি, তা নয়। তাঁরা ভয় পেয়েছিলেন, এখন থেকে গদ্যেই হয়তো সর্বাংশে তাঁর দখল নিয়ে নেবে, কবিতাকে তিনি আর সময় দিতে পারবেন না। ভয় পেয়েছিলুম আমিও। পরে দেখা গেল, ভয়টা একেবারেই ভিত্তিহীন। কবিতা লিখতে-লিখতেই ছোটগল্পে হাত দিয়েছিলেন সুনীল, কিন্তু কবিতার হাত তাই বলে ছাড়েননি। আবার ছোটগল্প লিখতে-লিখতেই যখন তিনি উপন্যাসের বিশাল ভুখণ্ডে এসে ঢুকলেন, কবিতার উপরে তাঁর শক্ত মুঠিতে তিনি তখনও এতটুকু আলগা দিলেন না। একইসঙ্গে লক্ষণীয়, নিজেকে প্রকাশ করার, অর্থাৎ যা তিনি ভাবছেন তাকে অন্যের কাছে পেঁৗছে দেবার এই যে তিনটি মাধ্যম_ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস_ এগুলির কোনোটিকেই তিনি অন্য-কোনোটির উপরে প্রভাব বিস্তার করতে দেননি, প্রতিটিরই শর্ত ও দাবি তিনি পৃথকভাবে রক্ষা করেছেন। যেমন কবিতা লিখেছেন কবিতার নিজস্ব শর্ত মেনে, তেমনই যখন তিনি গল্পকার বা ঔপন্যাসিক, তখন গল্প ও উপন্যাস রচনার নিজস্ব শর্ত মান্য করেছেন নিষ্ঠাভরে।
সে-দিক থেকে যখন দেখি, তখন কবি-সুনীল, গল্পকার-সুনীল ও ঔপন্যাসিক-সুনীলকে তিন আলাদা লেখক বলে আমাদের মনে হতেই পারে। আবার এই তিন লেখকের তিন গোত্রের রচনার একটু ভিতর-প্রদেশে যখন চোখ চালাই, তখন তাদের একটি সামান্য লক্ষণও আমাদের নজরে এসে যায়। আমরা দেখি যে, একটি কাব্যময় চিন্তার লাবণ্য এই তিন গোত্রের রচনাকেই আদ্যন্ত অতি প্রবলভাবে অধিকার করে রয়েছে; এবং তাঁর গল্প ও উপন্যাসকেও ক্রমাগত জোগান দিয়ে চলেছে সেই প্রাণরস, যার সন্ধান একমাত্র শুদ্ধ একজন কবিই রাখেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অতিতুখোড় গল্প-বলিয়ে। সেই গল্পের শুরু যেখানেই হোক না কেন, তার সুতোটাকে কীভাবে টানতে হয় ও কোথায় নিয়ে শেষ করতে হয়, সেটা যে তাঁর চেয়ে কেউ ভালো জানেন, এমন আমার মনে হয় না। কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর জীবনের যখন সূচনাপর্ব, বাংলা সাহিত্যে তার কিছুকাল আগেই শুরু হয়েছিল গল্পবিহীন গল্প লেখার আন্দোলন। বস্তুত যাকে আন্দোলন না-বলে মরণফাঁদও বলা যায়। সুনীল তাতে পা বাড়াননি। তার কারণ, জীবন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার তখন ক্রমশ ব্যাপ্ত ও বিশাল হয়ে উঠছিল, এবং তাঁর বলবার কথাগুলিও হয়ে উঠছিল অত্যন্ত জরুরি। তার চেয়েও যা জরুরি, সেটা এই যে, সেই কথাগুলিকে তিনি তাঁর পাঠকসমাজের কাছে পেঁৗছে দিতে চাইছিলেন। কীভাবে পেঁৗছে দেবেন? কোন পথে?
পথ তো একটাই। মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ। তা কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে যাঁদের মহাজন বলে গণ্য করা হয়, বক্তব্য তো তাঁদের কারও কিছু কম জরুরি কিংবা কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, কিন্তু পাঠকের কাছে সেই বক্তব্যটাকে পেঁৗছে দেবার জন্যে তাঁরা সবাই দেখছি একই পথে হেঁটেছেন। পথটা, সন্দেহ নেই, ঠাসবুনট কাহিনীর পথ। যে-পথ রুশ মহাজন টলস্টয়ও নিয়েছিলেন, আবার জার্মন মহাজন টমাস মানও নিয়েছিলেন। তাঁদের উপন্যাস না-পড়লে এই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারণা যে অনেকটাই অপূর্ণ ও দৃষ্টি অনেকটাই অনচ্ছ থেকে যেত, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু কথা হচ্ছে, ঠাসবুনট একটি কাহিনীর ভিতর দিয়ে যদি না এই মহাজনের বক্তব্য ক্রমশ উন্মোচিত হতো, তবে তাঁদের কোনো উপন্যাসই আদ্যন্ত অতি আগ্রহভরে সবাই পড়তেন কি না। কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই যে অনেকে রণে ভঙ্গ দিতেন, তা না-বললেও চলে।
মহাজনদের প্রদর্শিত এই রাজপথেই সুনীল হেঁটেছেন, তার কথাসাহিত্যিক জীবনের প্রথমাবধি। আয়তনে ছোট, চরিত্র কম, গল্প তো আমাদের জীবনের মাত্র এক ঝলক দেখিয়ে দেয়। কাহিনীর খেই হারিয়ে যাবার বিপদ সেখানে নেই বললেই হয়! বিপদ ঘটে উপন্যাসের বেলায়। সে তো মস্ত বড় জমির উপরে, অনেকখানি সময় ব্যেপে, অনেক মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে কাহিনী বুনে তোলার ব্যাপার।
কিন্তু শুধু গল্প শোনাবার জন্যই তো সুনীল উপন্যাস লেখেন না। একই সঙ্গে শোনাতে চান জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কিছু জরুরি কথা। তাঁর উপলব্ধির কথা। মজা এই যে, স্রেফ কাহিনীর টানে যিনি তাঁর উপন্যাস পড়েন, উপন্যাস পাঠ শেষ হবার পরে তিনিও হয়তো বুঝতে পারেন যে, জরুরি সেই বক্তব্য আর লেখকের সেই উপলব্ধি তাঁর মনের মধ্যে গেঁথে গেছে, পাঠক হিসেবে তাঁকে পালটে দিয়েছে অনেকখানি।
সুনীলের সামাজিক চরিত্রগুলির সব তাঁর মা, বাবা, ভাই, বোন, কাকা-জ্যাঠা ইত্যাদি আত্মীয়স্বজন বা রাস্তাঘাটে-হাটেবাজারে আপিস-কাচারিতে নিয়ত দেখতে-পাওয়া চেনা মানুষের আদলে আঁকা বলে মনে হয়। আবার ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিকেও সুনীল যেহেতু, কল্পনার আশ্রয় নিয়েও, একটা সম্ভবপরতার সীমার মধ্যেই ধরে রাখেন, তাই তাদেরও তাঁর বিশ্বাসযোগ্য ঠেকতে থাকে।
আর ভাষা? সুনীলের ভাষার মধ্যে কোনো বানিয়ে তোলা ব্যাপার নেই। যে-ভাষায় তিনি তাঁর গল্প-উপন্যাস লেখেন, তার মধ্যে কোথাও কোনো কসরত কিংবা পাঁচজনের থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখাবার চেষ্টা আমাদের চোখে পড়ে না। তাঁর ভাষায় ঘামের এতটুকু চিহ্ন নেই। যে-ভাষায় আমরা কথা বলি, চিঠি লিখি, এও সেই স্বাভাবিক ভাষা। আর এরই ফলে তাঁর গল্প-উপন্যাসে এমন একটা সতেজ সাবলীল প্রাণময়তার সঞ্চার হয়, পাঠককে যা প্রবলভাবে কাছে টানে।