হাশেম খানকে কেন প্রয়োজন

হাশেম খান বাংলাদেশের এক ধরনের ইতিহাস সংরক্ষণ করে চলেছেন এবং অন্য পক্ষে সময়ের অভিজ্ঞতা নিজের ভেতর ধারণ করেছেন। এই দুই বোধ শৈল্পিক যা কিছু যা কিছু প্রচার করে তার বিরোধী। হাশেম খান তার জীবন বোধ থেকে বুঝেছেন, প্রলেটারিয়াল বিপ্লব থেকে বুঝেছেন ধনতন্ত্রই ইতিহাসকে ধ্বংস করে, সেজন্য অতীতের দিকে ফিরে ফিরে তাকাতে হয়। হাশেম খান অতীতের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন করতে চান না, তিনি তার কাজের প্রয়াস এবং কল্পনার দীপ্তি তার জীবনযাপনের দিকে ছড়িয়ে রাখতে চান। তিনি তার বেঁচে থাকার চারপাশে কল্পনা ও স্বপ্ন, ছড়িয়ে ছড়িয়ে রেখে দিতে চান। এই চাওয়াটাই হাশেম খান।
কৃষকরা হাশেম খানের বিষয়। যে অর্থে জয়নুল আবেদিন কিংবা কামরুলের বিষয় কৃষক, সে অর্থে নয়। তিনি আবেদিন কিংবা কামরুলের ব্যাখ্যা দিয়ে কৃষকদের কাছে পৌঁছাননি। কৃষককে শোষণ কাকে বলে জানেন, কিন্তু সে রাস্তায় তিনি কৃষকদের কাছে পৌঁছেননি। কৃষকদের জীবনাচরণ একটা বিশেষ শ্রম তৈরি করে, যে শ্রমের সঙ্গে মৃত্যুর একটা ঘনিষ্ঠতা আছে। নিজেদের হাত দিয়ে তারা একটা দুনিয়া তৈরি করে, সেই দুনিয়ার মধ্যে তারা নিজেদের ইতিহাস বুনে দেয়। এই বুনন হচ্ছে স্মৃতির আইনকানুন, যে আইনকানুন তৈরি করছে স্মৃতি থেকে বাঁচার জীবন যাপন থেকে। সেই কল্পনাটিকে তিনি চুপি চুপি ধরতে চান। এখান থেকে তিনি একটা ভিন্ন বাস্তব ধরতে চান। এই বাস্তবের ভিন্ন একটা ভিত্তি আছে। সেজন্য তার কৃষক জয়নুলের কৃষক নয় কিংবা নয় কামরুলের কৃষক। তার মধ্যে যে গল্পকথক আছে, সেই কথকটির অভিজ্ঞতার কাছে আমাদের নিয়ে যেতে চান। তার কৃষকরা, এক অর্থে বাংলাদেশের মাইগ্রেন ওয়ার্কার। এই বোধটা আমি আমার চোখ থেকে দূর করতে পারি না। তার নৌকোর বাসিন্দারা, এক হিসেবে, নৌকোর সব রকম ব্যবহার করে থাকে। তারা মাঝি, জেলে, নদী পারাপারকারী, তারা নৌকো থেকে, বিশেষ করে মহিলারা, চোখ মেলে চারপাশের সবকিছু দেখে, একটা বিস্ময় তাদের চোখে, এই পৃথিবীটা কেবলমাত্র তার চেনা চাঁদপুর নয়। পৃথিবীটা অনেক বড়, তাদের চোখে পুরুষ কিংবা নারী কিংবা শিশু অথবা কিশোর, চোখ দিয়ে মানুষের আশা-ভরসা লগ্নি করে রাখে। সেজন্য হাশেম খানের কাছে চোখ হচ্ছে পৃথিবীটা জয় করার প্রধান অস্ত্র।
হাশেম খানের জীবনটা হচ্ছে বাস্তবতা ধরার স্কেচহীন ইচ্ছা। রং, রঙের ভুুবন, বাতাস, গাছ এবং রোদ হচ্ছে তার দিক থেকে বাস্তবতা আয়ত্ত করার কৌশল। এই আকুতি বিরতিহীন হয়ে ওঠে, যখন তিনি নদীর কাছে যান কিংবা নিজের ধরনে নৌকো আবিষ্কার করেন তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্পষ্ট হয়ে ওঠে সূর্য কেন শেষ হয় না, বাতাস কেন আমাদের নাড়া দেয় কিংবা সবকিছু একত্র হয়ে বাস্তবতা হয়ে ওঠে। বাস্তবতা যা দেখি তা শুধু নয়, বাস্তবতা হচ্ছে যা কিছু দেখি সব মিলিয়ে। সেজন্য বাস্তবতা শেষ হয় না কিংবা বাস্তবতা সব সময় আমরা দেখি। এই দেখার শেষ নেই। তার কাজ বাস্তবতার জন্য আকুতি কিংবা অনিঃশেষ এক যাত্রা। এই যাত্রায় আমরা তার সঙ্গী। এক হিসেবে যারা ছবি আঁকেন, তারা অন্যদের গল্প কিংবা অভিজ্ঞতা আমাদের উপঢৌকন দেন। এই উপঢৌকন হচ্ছে তার জীবনচরিত এবং শিল্পী হিসেবে তার পরিবৃদ্ধি। এক্ষেত্রেই তার অভিজ্ঞতা এবং জীবনচরিত বিচার করা জরুরী। এভাবেই হাশেম খানকে বোঝা যায় কিংবা আরো বেশিভাবে বোঝা যায়। জানা যায় তার কাজের সারাৎসার। বোঝা যায় তার স্বপ্ন দেখা এবং কল্পনা করা, তার প্রকৃতিকে ভালোবাসা এবং নিসর্গের প্রতি তার প্যাশন। বোঝা যায় তার কাজ ও কাজের ভাষা। তার ভাষা সরল এবং তার কাজ স্পষ্ট। এই পদ্ধতিতে তিনি ফিজিক্যাল লেবার এবং নিসর্গকে পুনরুৎপাদিত করেন। এভাবে তিনি পৌঁছেন দূরে এবং কাছে, নিসর্গের কাছে এবং নিসর্গের অভ্যন্তরে। তার লেখা থেকে আমরা জানি (হাশেম খান প্রথম শ্রেণীর কিশোর লেখক, কখনও কখনও আমার মনে হয়েছে তার মতো লিখতে যদি পারতাম), তার কাছে কাজ (পেইন্টিং) এবং লেখা, একই সঙ্গে করেছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বারুদ আর সেজন্যই কাজ, পেইন্টিং হচ্ছে বেঁচে থাকার রসদ। তিনি মনে করেন বাস্তবতার কাছে পৌঁছে বড় সড়ক, কাজ এবং কাজ। তার পেইন্টিং বাস্তবতার অন্য নাম।