অরণ্যের দিনরাত্রির খোঁজে

আমি যখন বয়স ও পরিবারের নিয়ম-কানুনে পরাধীন ছিলাম তখন আমার দেশে অরণ্য ছিল। আমি যখন তার থেকে স্বাধীন ও স্বাধীনতা ভোগ করার উপযুক্ত হয়ে উঠলাম তখন দেশ থেকে অরণ্য উধাও হয়ে গেল। সতেরো-আঠারো বছর বয়স বিপজ্জনক হলেও সেই সময়ের পরিবার ও দেশের নিয়ম-কানুনের প্রচলিত নিগড়ে অনেক কিছু মান্যিগণ্যি করতে হতো। তখন রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র।
আমার দেখা অরণ্য বলতে তখন রাঙামাটি রিজার্ভ বাজারের সঙ্গে লাগোয়া রিজার্ভ ফরেস্ট। স্কুলের দুপুর ছুটিতে দৌড়ে সেখানে চলে যেতাম আমরা কয়েকজন সহপাঠী। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, অমিয়াংশু চাকমা, অমলেশ চাকমা, দিবাকর খিসা, রফিকুল ইসলাম, আবদুর রহমান, সুনীল দাসরা আমার সহপাঠী। কেন ছুটে যেতাম রিজার্ভ ফরেস্টে? কাছেই। পাঁচ-সাত মিনিট যেত, পাঁচ-দশ মিনিট ওখানে কাটিয়ে আবার সময়মতো ক্লাসে ফিরে আসতাম। বিশাল বিশাল চিভিট, গর্জন, চাপালিশ, জারুল, প্রভৃতি গাছ। সবার নামও জানি না। একেকটি শতাব্দীর গাছ। এর আড়ালে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে থাকা যায়। আমরা সেখানে লুকিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ বা লুকোচুরি খেলতাম। গাছের পাশে গাছ। লতাও সে রকম বড় বড়। মরা ডাল পড়ে চলাচলও বন্ধ করে দিত। তাতে আমাদের লুকোলুকিও জমে উঠত জম্পেশ। ওপরে আকাশ বলে কিছু ছিল না, ছিল গাছের ডালপালার আচ্ছাদন। ডাকত কালো কাঠবেড়ালি, বানর, ভীমরাজ, পাহাড়ি দাঁড়কাক, ময়না। আর যত সব নাম না-জানা পোকা। সুতো কাটা পোকা, ক্রেং পোকা, সিকেড বা আর কী কী নামও জানতাম না। সে জন্য মাথাও ঘামাতাম না। ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে ছুটছি স্কুলে। ঘণ্টা পড়ার আগে ফিরতে হবে। স্কুলের নিয়ম-কানুন বেশ কড়া।
সেই আমার প্রথম অরণ্যের টুকরো দেখা। চেঙ্গি নদী রাঙামাটির কাছে কর্ণফুলীতে এসে মিশেছে। ওখানে একটা টিলা আছে কর্ণফুলীর ধারে একপাশে একাকী। ওর নাম দিয়েছি একটা। সেই নামে পরে উপন্যাস লিখেছি ‘দৈত্যপাহাড়ের ক্ষুদে মানুষ’। ওটা ‘আমি উপন্যাস’ অর্থাৎ এর নায়ক ‘আমি’। অরণ্যের ঘেরাটোপে রহস্যময় ক্ষুদে আদিবাসীর কাহিনী। অরণ্য ও বনজঙ্গলের প্রাচীন ক্ষুদে জাতির বিচিত্র কাহিনী।
সেই রাঙামাটির অরণ্য আমি হারিয়েও ফেলেছি। এখন সেই অরণ্য কোথাও নেই। আমার সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরে এখনও পাইনি। আমার বাড়ি বাঙ্গুনিয়া থানার ইছামতী গ্রামে। কর্ণফুলীর পাড়ে। ছয় মাইল দূরে নদীপথে চন্দ্রঘোনা। সেখান থেকে ছয় মাইল দূরে সীতা পাহাড় ফেলে চিৎমরমে একটি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার আছে। বড় নৌকায় করে দাঁড় টেনে লগি মেরে নৌকা চলত উজানের চিৎমরমে। সন্ধের আগে আগে সেখানে পেঁৗছতাম। রাতে যাত্রা করলে ভোরের আগে। চন্দ্রঘোনার থেকে পাহাড় শুরু, অরণ্যর আভিজাত্য দেখতাম নৌকা থেকে। ডান পাশে ওয়াগ্গা চা বাগান। সেখানে রাতে ও দিনে ছড়ায় হাতি-বাঘ নামত। তারপর বিজইন্যার বাঁক। ওখানে সীতা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে কর্ণফুলী নেমে এসেছে। প্রবল গরমের দিনেও ওখানে ঠাণ্ডা হাওয়া বইত বলে তার নাম ‘বিজইন্যার বাঁক’। ব্যাজন বা তালের পাখার হাওয়া থেকে আঞ্চলিক এই শব্দের উৎপত্তি। কী সুন্দর অনাবিল শীতল হাওয়া। চা বাগানের পরই গাছে গাছে ঢাকা সীতা পাহাড়। গাছ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। আমাদের বাঁ তীরে কাপ্তাই যাওয়ার পায়ে চলার কাঁচা রাস্তা। রাস্তার বাঁ পাশেও সীতা পাহাড়। সেগুন গাছের ঘন বন। মাথার ওপর সন্ধের তারাভরা আকাশ ও ছায়াপথ। তখন সাত ভাই, শুকতারা ও সম্ভবত ধ্রুবতারা ছাড়া কিছুই চিনতাম না। মাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ে উঠেছি। কিন্তু আম, জাম, কাঁঠাল প্রভৃতি বাড়ির চৌহদ্দির গাছপালা চিনতাম। সেগুন চিনলাম সেই প্রথম, প্রথম অরণ্য বৃক্ষ।
চিৎমরম কর্ণফুলীর কূলে, অরণ্যের প্রাণে, সেগুন কাঠের বিশাল বিশাল খুঁটির ওপর কাঠের বাড়ি। চূড়াসহ তিন-চার তলা সমান উঁচু। ওখানে যাত্রীদের থাকার কাঠের মাচাঘর। সকালে ঘুম থেকে উঠে উঠোনে বেরিয়ে দেখি একপাশে গাছের মতো মোটামোটা বাঁশ। বেড় হবে অন্তত ছত্রিশ ইঞ্চি। কিছুদূর পরপর টিলার ওপর মারমা বসতি। আর অদূরে চোখ জুড়ানো অরণ্য। কিন্তু ওখানে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একটি পাহাড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলাম। উঠতে উঠতে হাঁফিয়ে পড়ি। ওখানে আছে একটি ‘ভাবনা কেন্দ্র’ আর আশপাশে গাছপালায় ঠাসা। ভাবনা কেন্দ্রের এক কোণে বড় একটি চিনিচাঁপার পাকা ছড়া। লোকজন কেউ নেই। আমরা যে ও-ঘরে যাই একটি করে খেয়ে আসি।
২০০৩ সালের বর্ষায় দ্বিতীয়বার শুভলং যাই রাঙামাটি থেকে। সঙ্গে সহপাঠী অমিয়াংশু চাকমা ও সদ্য পরিচিত মং প্রু চাই ওরফে মানু। শুভলংগঞ্জের ওপারের গ্রাম মিতিঙ্গাছড়ি। ঘাট থেকে প্রায় খাড়া পথ। বৃষ্টি হয়েছে একটু আগেও। পিচ্ছিল দুর্যোগপূর্ণ পথ। প্রায় উবু হয়ে উঠছি পায়ের ওপর সব ভরসা ঢেলে দিয়ে। অনেক কষ্টে এক শিক্ষকের বাড়িতে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে পিনন-খাদি পরিহিত গৃহকর্ত্রী এনে দিলেন কত্তি [মাটির সোরাই] ভরা ঝরনার সুপেয় পানি। শুভলং হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঝরনার আড্ডা। আমি লঞ্চে করে আসার পথে বারো-তেরোটা গুনেছি। দু’পাড় থেকে সঙ্গীতের লহর তুলে রাঙামাটি হ্রদে পড়ছে। এর তলায় কর্ণফুলী ডুবে আছে। সেই বর্ণনা এখানে দু’দশ বাক্যেও বলা সম্ভব নয়।
পাহাড়িদের বাড়িতে গেলেই প্রথমে এগিয়ে দেবে কত্তি। তারপর বাঁশের হুঁকো। একে বলে ধুন্দাখানা। দেয়ালে ঝুলছে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও কার্ল মার্কসের ছবি। পাহাড়িরা মানবেন্দ্রকে জাতির পিতার মযার্দায় শ্রদ্ধা করে।
এখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের ঢালুতে বনজঙ্গলে শুনি ঝিরিঝিরি মধুর শব্দ_ প্রায় বৃষ্টির মতো। মানুর দিকে তাকালাম। মানু বুঝতে পেরে বলল, দেখবেন?
দেখব। কিন্তু কী?
মানু কিছু না বলে সেদিকে চলল। গাছপালা ঘেরা বনখণ্ডের দিকে। ছবি গেল না। সে চলল অদূরে স্কুলের দিকে। ঠাসা গাছপালার মাঝখান দিয়ে সরু পথ। আসাম গাছ, উদাল, বড় বড় পাতার লতা, উঁচু কিছু অচেনা গাছ। ‘বাঁশ বনে ডোম কানা’ অবস্থা আমার। আকাশ নেই মাথার ওপর। জগতের অপার সৌন্দর্য রাশি আমার চোখ দখল করে নিল। দেখি পাহাড়ি এক তরুণী ঝোপঝাড়ের ঘেরাটোপে স্নান করছে। ঊর্ধ্ব অঙ্গে খাদি নেই, নিম্নাঙ্গে শুধু পিনন। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল আকিরা কুরোসাওয়ার বিখ্যাত ছায়াছবি ‘দারসুজালা’র সেই বিখ্যাত স্নানদৃশ্য_ এ রকম এক সৌন্দর্যের ঝরনাধারায়। আমি আর এগিয়ে যেতে পারি না। থমকে গেলাম। ক্যামেরার কথা ভুলে গেলাম। ও যে বনসুন্দরী। মর্ত্যের মানবী নয়। কুরোসাওয়ার নায়িকা। চলুন, মানু তাগাদা দিল অনড় গায়ে হাত দিয়ে।
না, মেয়েটি স্নান করছে। বললাম আমি।
মেয়েটি তখনও আমাদের দেখেনি। ঝরনার শব্দসঙ্গীত বাজছে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খানের নেপথ্য সঙ্গীতের আবহে।
সে কি! ঝরনাটা দেখবেন! চলুন! ও কিছু মনে করবে না। আমি বলব।
আমি গেলাম। পাহাড়ের কোলজুড়ে ঝরনা নেমে এসেছে। কী স্বচ্ছতোয়া সলিল! পাহাড়িরা খাবার পানি নেয়। মেয়ে-পুরুষরা দিনের শেষে কাজ সেরে স্নান করে। সন্ধের সাঁঝবাতি দেওয়ার আগে আগে রাতের খাবার সেরে নেয়।
মিতিঙ্গাছড়ির ঝরনার জল আঁজলা ভরে পান করলাম। তরুণী একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মানু চাকমা ভাষায় কথা বলল তরুণীর সঙ্গে। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। জগতের পার্বত্য দুর্লভ সৌন্দর্যের লহমা কুড়িয়ে নিলাম কোঁচড় ভরে। অরণ্যের স্বপ্ন কুড়িয়ে নিয়ে এলাম চলচ্চিত্রের মতো। ওকে নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলাম ‘বনদেবী ও জলদেবী’ নামে।
১৩ ডিসেম্বর, ২০০৭ সাল একেবারে ভিন্ন। ছোট হরিণাবাজার থেকে যাব থেগা [ঠেগা]। কর্ণফুলীর উজানে, যেখানে কর্ণফুলী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকেছে। আমরা ছোট হরিণায় পেঁৗছার আগে দুপুর ১২টায় ইঞ্জিনের নৌকা চলে গেছে। আবার এক সপ্তাহ পর যাবে। আমার পথপ্রদর্শক কেভি দেবাশীষ চাকমা। তরুণ ভিক্ষু। বাজারে তিনি পেয়ে গেলেন কুকিছড়ার সুনীতি চাকমাকে। পরিচিত। এমন সময় মাথায় হ্যাট ও প্যান্ট-শার্ট পরা বেঁটে-খাটো জিরা পাংখোকে পেলাম। ১৬৩ কলাবুনিয়া মৌজা, বড় হরিণার হেডম্যান। ইচ্ছা করলে ওর বাড়িতে দু’দিন কাটিয়ে আসতে পারি। ওর লাইসেন্স করা বন্দুক আছে। তুখোড় হরিণ-শুয়োর শিকারি। বনমোরগও মেলে। আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা দেওয়ার বাসনাসিক্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু এক ঘণ্টা ইঞ্জিনের নৌকায় চলে মাইল চারেক হাঁটতে হবে পাহাড়-অরণ্যের অন্ধকার পথে। অমনি থমকে গেলাম। ওদের চার-পাঁচ মাইল আমাদের ১০ মাইলের কম নয়। আঁধার রাত, পাহাড়-অরণ্যের পথ, মাঝে মাঝে ছড়া পড়বে, টর্চ দরকার। ওসব কিছুই আমার নেই। তবু উঠে বসলাম নৌকোয়। বর্ডার গার্ডের কাছ থেকে ছাড়পত্র পেতে প্রায় বেলা শেষ।
ছোট হরিণা নদী ঢাকার তুরাগের চেয়ে ছোট। দু’পাশে অরণ্য। কর্ণফুলী থেকে ঢুকলাম। ডিসেম্বর হলেও কাপ্তাই বাঁধের কারণে পানি আছে, নাব্য। দু’চোখ ভরে দু’পাশের পাহাড়ও অরণ্যপ্রায়। বড় গাছ খুব একটা নেই। মাঝে মধ্যে চাষযোগ্য সমতল। কাশ ও হাতি-ঘাস, নলখাগড়া ও বুনো লতা গাছপালা। দ্রুত নেমে আসছে আঁধার। সাদা বক নিজেদের আস্তানায় ফিরছে প্রায় পানি ছুঁয়ে উজানের দিকে। আমাদেরও গন্তব্য উজানে। মাঝে মধ্যে দু’চারটি ফুলভরা গাছ। নাম জানি না। দেবাশীষও ঠিকমতো বলতে পারে না। এক পাশের খাড়া পাহাড়ের ছায়ায় ঢেকে ফেলেছে ছোট হরিণকে। নদীর ধারে বড় গাছের বড় ডালে আটকে আছে অর্থাৎ বর্ষার সময় ওগুলো সেখানে আটকে গেছে। এখন তার দশ-পনেরো হাত নিচে নদীর পানি। মাঝে মধ্যে জেলে নৌকো ফিরছে আস্তানায়। বনের রাতের মায়াজাল খুলছে।
হরিণ-শুয়োরের ডাক শোনা অবহেলা করে জিরা পাংখোর সঙ্গে যাব না ঠিক করলাম। আঁধার খা-খা করছে আকাশে ঝাঁ ঝাঁ করছে তারার পাশে তারা, গায়ে গায়ে তারা। পুব থেকে পশ্চিমে মিথুন, বৃষ, মেষ, মীন, কুম্ভ রাশি। মিথুন রাশির বিখ্যাত সোমতারা পুব দিগন্তে ঝলমলে। বৃষ রাশির রোহিণী বুঝি আরও উজ্জ্বল। পুব আকাশে সূর্যপথে কালপুরুষ বা ওরাইয়ন। মাঝ আকাশে তিমিমণ্ডল। রাতের আকাশ দেখতে হলে শহর থেকে অরণ্য শ্রেয়। তবে ফাঁকা জায়গা চাই। কত কত তারা! নিচে বন ও পাহাড় উপরে তারাভরা আকাশ। আবদুল জব্বারের ‘তারা-পরিচিতি’ বইয়ের ডিসেম্বরের চিত্রটি যদি ফটোকপি করে আনতাম! পারসিয়াস, ক্যাসিওপিয়া, এনড্রোমিডা, পক্ষিরাজ তো চিনি। পাহাড়ের জন্য বকমণ্ডল দেখতেই পাচ্ছি না। নৌকোর ইঞ্জিনের ভটভট বিতিকিচ্ছিরি শব্দ উৎপাত এতক্ষণ ভুলে ছিলাম। তারা চিনতে না পারাতে ওই শব্দ উৎপাত হয়ে চেপে বসল। অরণ্যশোভা তো অন্ধকারে কামশীতল হয়ে আছে।
নৌকোর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেতেই অন্ধকারের গাছপালা হয়ে উঠল যৌন উদ্দীপকের মতো মত্ত সুশ্রী। ঘ্যাস করে ভিড়ল তরী। অন্ধকারেও তারার আলোয় দেখি ১০ মাথা সমান উঁচু খাড়া পাড়। গোল্লায় যাক! পাহাড়-অরণ্যের শোভা তখনও মনে আসেনি। বরং নতুন জায়গা, রাতের অচেনা সৌন্দর্য, অদেখা ভূমির কল্পসৌন্দর্যে আমি বিভোর। কালপুরুষের পায়ের তারা বনরাজা থেকে যামীমণ্ডলের নদীমুখ একেবারে দক্ষিণ আকাশের দিগন্ত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। তবুও ভড়কে গেলাম। সমতল ভূমির মানুষ আমি, যুবক নই, প্রৌঢ়ত্বও ঘুচে গেছে বলা চলে। কিন্তু মনে মনে বিপজ্জনক যুবক। পায়ে ভ্রমণ উপযোগী জুতো, নিঃশ্বাসের কষ্ট হলে সেরোফ্লো-১২৫ ইনহেলার আছে। পাহাড়ি ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক অ্যাভলোকুইনের কোর্স চলছে।
সুনীতির কুকিছড়া যাওয়াই সিদ্ধান্ত নিলাম। জিরা পাংখোকে এখান থেকে বিদায় জানাব। তারেইঙ্গা ঘাটের খাড়া পাড় নিঃশ্বাস হজম করে, মনের জোরে অন্যদের টর্চের আলো-আঁধারী ও বিপৎপাত পুলসেরাতের ভয় জয় করে পার হলাম। অন্ধকার পাহাড়ি পথ আনাড়ির পক্ষে কতখানি ভয়াবহ!তা আবার তরুণ-যুবকদের জন্য অ্যাডভেঞ্চার। বুড়োর হাড় ভাঙলে সহজে জোড়াও নিতে চায় না। তবুও রোমাঞ্চ ও ভয়-বাধা পার হয়ে আধা ঘণ্টা ধরে হাঁটতে-শেখা শিশুর মতো কোনো মতে যখন মনিময় চাকমার বাড়ির উঠোনে পেঁৗছলাম তখন মাথার উপর খোলা ঝকঝকে তারাভরা পিচ্ছিল আকাশ। ইঁদুর বন্যায় পীড়িত সুনীতি চাকমা চাষি হলেও চাল কিনতে গেছিল হরিণাবাজারে। এখানে না এলে পাহাড়-অরণ্যে ইঁদুর বন্যা কী তা কোনোদিন জানতে পারতাম না। ঘরে এনে রেখেছে ধান। তাতেও নিরাপদ নয়। বেড়ার ঘর, কত দিকে ফাঁকফোকর। এমনকি আলু, মিষ্টি কুমড়ো, বীজ কিছুই রাখা যায় না। আখক্ষেত শেষ। জমিতে ধান পাকতে বসেছে। তার চারদিকে টিনের ঘেরা। তাতেও সুরাহা নেই। হ্যামিলনের বাঁশি এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি এই বন-অরণ্যে এসে বিশ্বাস করলাম। আখক্ষেতে পড়ে আছে শুধু পাতা। বনের অন্যসব গাছপালা নিরাপদ।
সকালে উঠে এক পেট ভাত খেয়ে যাত্রা শুরু। তারেইঙ্গা ঘাট থেকে কুকিছড়া যাচ্ছি। ছড়ার পাশ দিয়ে কূলে কূলে এঁকেবেঁকে যাওয়া। আমাদের ইচ্ছামতো নয়, ছড়ার ইচ্ছামতো। বনের টিলা, পাহাড়, গাছপালার পাশ দিয়ে ছড়া এঁকেবেঁকে চলেছে। পায়ে চলা পথ। কুয়াশা ও শিশিরে ঢাকা পথ। গাছের গায়ে গাছের ডাল আকাশ বন্ধ করে রেখেছে। রোদ কোথা দিয়ে আসবে? খুব ঘন-নিবিড় অরণ্য নয়। তবুও বলতে হয় এমন নিবিড় বন কোথাও আর নেই। মারিশ্যা, কাসলং, মাচলং, সাজেক ঘুরেছি। এ রকম বনও পাইনি। দেবাশীষ বহু বছর আগে এই পথে এসেছিলেন। ছেলেবেলায়। সেই স্মৃতি ধরে হেঁটে চলেছি। মাঝে মধ্যে অনেক প্রজাপতি, কিন্তু রঙে খুব বৈচিত্র্য নেই। ভীমরাজ ডেকে ওঠে। ঠাকুর পেইখ বা হলুদ পাখি ডাকে। সুদাত্তবি বা টুনটুনিও আছে। দূরে ডেকে গেল ছোট একঝাঁক টিয়ে। দেখাদেখি নেই, শব্দ শব্দ ও সঙ্গীত শুনে বোঝা। পথে মাইলখানেকের মধ্যে কাউকে দেখিনি। অর্থাৎ মানুষ। গাছের শেকড় এমনভাবে উঠে আছে, তার তলার মাটি সরে গেছে যে, ওকে সমীহভরে ঘুরে যেতে হয়। লতাপাতার ডাল এড়িয়ে যাচ্ছি শিশিরে ভিজে যাব বলে। জুতো ভিজে গেছে। লাথি মেরে, শেকড়ে ঘষে জুতোর তলার আবর্জনা কমাতে হচ্ছে। নয়তো ভারী হয়ে উঠছে। হঠাৎ করে একটা মরা ডাল টুপ করে পড়ল সামনে অথবা অদূরে। যেন শত্রুর হামলার পূর্বপ্রস্তুতি। দেবাশীষ থেকে কত জিজ্ঞেস করব। এটা কোন গাছ, ওটা কোন ফুল, কোন পাখি ডাকল? চালতা তো চিনি। পড়ে আছে পথের ওপর। আহা কী চমৎকার আচার বা চাটনি হতো। প্রায় পেকে গেছে। কে যেন দায়ের এক কোপে দু’টুকরো করে দিয়ে গেছে। বাঁশঝাড়ের গোড়ায় বড় বড় গর্ত। ওগুলো বাঁশ ইঁদুরের। বাঁশের শেকড়সুদ্ধ খেয়ে নেবে, তারপর বাঁশে ফল হয়েছে, বীজ খেয়ে ইঁদুরের প্রজনন শক্তি যাবে বেড়ে। ইঁদুরের বংশ বেড়ে যাবে হু হু শব্দে। একটা উঁচু টিলায় এসে গেছি। ছড়া পার হওয়া মুশকিল। তাই প্রায় আধা মাইল ঘুরে পার হতে পারলাম। কুয়াশার বাড়ি উধাও। শিশির তখনও জমজমাট। হাঁটছি তো হাঁটছিই। গাছপালা চিনি না বলে সব একরকম। এত বৈচিত্র্যময় তবুও একঘেয়ে তাই। কুয়াশা গিয়েও সূর্য তেমনি অধরা। কোনোমতে কোথাও সুযোগ পেলে মাটিতে ছবি আঁকছে কাটাকুটির মতো। ছড়ার কূলে বাঁশ কেটে এনে রেখেছে। অল্প পানিতে ফেলে পাটা বাঁধছে। কূলের ওপর চারটা বাঁশ পুঁতে ছাউনির মতো করেছে কলাপাতা দিয়ে। রাতে কি ওখানে বাঁশ কাটুনিয়ারা থাকে? বিশ্রামের জন্য, নাকি খাওয়া-দাওয়ার জন্য?
মাইলখানেক দূরে ছড়ায় বাঁধ দিয়ে বাঁশের চালি নিয়ে যাবে। তারও মাইলখানেক দূরে আরেকটি বাঁধ দেবে। উপরের বাঁধটি কেটে দিয়ে বাঁশের চালি নামিয়ে নেবে। এভাবে ছোট হরিণা নদীতে নিয়ে যাবে বাঁশ। বর্ষাকালে এর দরকার পড়ে না।
দেবাশীষ সব অন্ধিসন্ধি বুঝিয়ে দিচ্ছে। বনের কত ঘোপঘাপ! কত তার রহস্য, কত রভস! ঠিক তখুনি দেখি এক চাকমা তরুণী মাথায় থুরুং [কল্লোং বা খাঁচা], যাচ্ছে তারেইঙ্গা ঘাটের দিকে। মুখোমুখি হলাম। দেবাশীষ চাকমা ভাষায় বললেন, কোথায় যাচ্ছ বোন? গতকাল ছোট হরিণা বাজার থেকে আনা জিনিসগুলো এখন সে ঘরে নিয়ে আসবে। একা একা অভয় মনে তার চিরচেনা পথ ধরে যাচ্ছে। ওখানে বাঙালি নেই। তাই ওর ভয়ডর নেই। গতকাল ছোটহরিণা থেকে নৌকোয় ওঠার পর আমি ছাড়া কাউকে কালো দেখিনি। কোনো বাঙালির দেখা পাইনি। কী মধুর করে তাকাল! আমাকে দেখল। ও যেন আমাকে বলল, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’
অমনি বনের গাছপালা ঝমঝম করে ওকে সমর্থন করল। উঁচু-নিচু পথে আমি সেই অভিযোগ শুনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার দিশা। হঠাৎ হাওয়া খেলে গেল বলে ওই ঝমঝম শব্দ। নাকি মেয়েটিকে সমর্থন করল! পাশের বাঁশঝাড়ের গোড়ায় বড় একটা ইঁদুর। মারাঙা [মাছরাঙা] ডেকে উঠল কি লিলিলি, বিষণ্ন সেই সুর। শঙ্খচিলের মতো। গাছ ও পাতায় পাতায় প্রতিধ্বনি তুলে চলল। বনের ওপর দিয়ে হাওয়া ও বৃষ্টি ছুটে যাওয়ার শব্দসঙ্গীত কখনও শুনেছেন? কখনও শুনলে আমাকে বলবেন।
এরই মধ্যে তিন ঘণ্টা কেটে গেল ছড়ার ঘোরপ্যাঁচে ঘুরতে ঘুরতে। ডিসেম্বরের শীতেও ঘেমে গেলাম। একটা দোকান বা ঘরবাড়ি পড়ল না পথের পাশে। এক জায়গায় অদূরে একটি পাড়া বা কয়েকটি ঘর দেখেছি অদূর থেকে। গাবগাছ দাঁড়িয়ে আছে ঝাঁকড়া মাথায় বাউলের মতো। চুন্দুল ও শীলভাদি গাছ চিনিয়ে দিলেন দেবাশীষ। কুকি ছড়া আর কতদূরে কে জানে! ক্লান্তি নেই এমন অচেনা বনে, সবকিছু আমার কাছে নতুন। কেরেং পোকার কী তীক্ষষ্ট সুরেলা ডাক! সুতোকাটা পোকা সুতো কেটেই যাচ্ছে শুদ্ধ-সঙ্গীত শুনিয়ে শুনিয়ে। আরও কত পোকা! ভ্রমরও দেখেছি, চেনা বলে অবজ্ঞা করিনি। আ-হা-হা-হা! কী সৌভাগ্য, একটা বড় ধনেশ নিচু ডালে বসে কটকট করছে ঠোঁট খুলে। ওপাশে বড় একটা শোন্যাক বা খনাগাছ। এক হাত লম্বা তার চ্যাপ্টা ফল ঝুলছে। বুড়ো থুত্থুড়ে হয়ে গেছে, খাওয়ার অযোগ্য এখন। সামনে পড়ল গাছে গাছে ঠাসা পথ। তার ভেতর দিয়ে একটি মাত্র পায়ে চলা পথ। ম্যাক্সিম গোর্কির একটি অসাধারণ গল্পে বড় একটি দলের তাড়া খেয়ে ছোট একটি দল অরণ্যে ঢুকে পড়েছিল। ছোট দলটির বাঁচার একমাত্র পথ নিশ্ছিদ্র অরণ্য পেরিয়ে যেতে পারলে। অন্ধকার রাত। গাছে গাছে ঠাসা সামনে, পথ নেই। তখন ছোট দলের মৃত্যু অবধারিত। পেছনে মশাল নিয়ে এগিয়ে আসছে বড় দল। তাদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ছোট দলের সবাই তখন তাদের তরুণ অধিনায়ককে বলল, এখন উপায়? একমাত্র তুমিই আমাদের বাঁচাতে পারো। তুমি আমাদের দলনেতা।
সেই তরুণ তখন অন্য কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে বুক চিরে নিজের হৃৎপিণ্ডটি বের করে নিল। সেই হৃৎপিণ্ডের আলোয় পথ দেখে তারা ঘন অরণ্য পেরিয়ে গিয়ে বেঁচে যায়।
গোর্কির সেই অরণ্য আমাদের দেশে ছিল ১৯৭০ সালেও। এখন বিখ্যাত কাচলং রিজার্ভ ফরেস্ট নেই। খাগড়াছড়ি, মায়ানী, কাচলং, মাচলং ও সাজেক আমি ঘুরেছি। কোথাও অরণ্য তো নয়ই, বনও নেই। ছোট হরিণা থেকে কর্ণফুলীর উজানে বড় হরিণা হয়ে থেগা পর্যন্ত গেছি। মধুপুর গড়ে নেই। শুনেছি সিলেটেও গভীর অরণ্য নেই। চেঙ্গী উজানে নেই। মারিশ্যা, শুভলং, বরকল কোথাও নেই। এই নেই ও আছে নিয়ে আমার গল্প ও উপন্যাস আছে চলি্লশের অধিক। আছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কিছু অংশ। সেখানে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়নি। সুন্দরবনে দু’বার মাত্র গেছি। সে তো সুন্দরবন। তাও ধ্বংস হয়ে যাবে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে। একসময় সীতাকুণ্ড থেকে বারতাকিয়া পর্যন্ত অরণ্য ও হাতির অরণ্য ছিল। এখন নেই। অরণ্য মানুষের সৃষ্টি নয়। আমাজানের অরণ্যও প্রাকৃতিক। সুন্দরবনও প্রাকৃতিক। মানুষ পারে অরণ্য ধ্বংস করতে, সৃষ্টি করতে পারে না। পারে বনখণ্ড ও সামাজিক বনায়ন। অরণ্যের শোভা পাবলাখানির রিজার্ভ ফরেস্টে ছিটেফোঁটা দেখেছিলাম বছরখানেক আগে। সেই অরণ্য দিনের আলোয় ফুটফুটে। অরণ্য দিনের আলোতেও সন্ধে হয়ে অলস দিনযাপন করে। তেমন অরণ্য ১৯৯১ সাল থেকে খুঁজে খুঁজে এখনও পাইনি। হয়তো আছে, সেখানে পেঁৗছতে পারিনি। আর আছে, আমার মনোভূমে, দশ লাখ বছর ধরে মানবসভ্যতার বহমান রক্তধারায় আমার মধ্যেও।