ফুলগুলি ফুটেছে বাগানে!

মধ্যরাতের পরপর ঘুম ভেঙে যায়। তাড়া থাকলে আমার তেমনই হয়। খুব সকালে বাস ধরতে হবে, ঢাকার বাইরে যাব। জানালার পর্দা সরাতেই হালকা কুয়াশায় লেপ্টে থাকা কাচে আটকে গেল চোখ। রাস্তার লাইটপোস্টের ঘোলা আলোয় বাইরের অন্ধকার কিছুটা ফিকে লাগলেও মনে পড়ে গেল জীবনানন্দের কবিতা_ ‘এখনো হেমন্ত ক্ষেতে ও মাঠে; পাতা ভৈরবী ডালপালা/দীর্ঘ কবিতার বই খুলে পড়ছে সবুজ চিনুখালা…। / রেনুদিদি, ফুলগুলি ফুটেছে বাগানে!/ সাতটি তারার তিমির যেনো আছে ওই খানে।/ বিদ্যুৎ সেতারে মর্মরিত ঠুমরী-খেয়াল, /এখনো আঁধার শ্মশানে আড্ডা মারে সেইসব শেয়াল।’ আমার বইপড়া বা শ্মশানে গিয়ে শেয়ালদের আড্ডা মারা দেখার সময় কই? আমাকে এখন ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে তৈরি হতে হবে। মনে পড়ছে, গত রাতে আকাশে পূর্ণিমার গোল চাঁদ দেখেছিলাম, নীল আকাশে চিত্রিত শাদা মেঘের শিল্পিত কারুকর্মের ভেতর চাঁদটা চোখে পড়েছিল বটে, কিন্তু তখন আমি শাহবাগের মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। শত শত ঘরফেরা মানুষের ভিড়ে আমিও হারিয়ে গিয়েছিলাম, চারদিকে বাস-ট্যাক্সি আর রিকশার হলাহলের ভেতর উজ্জ্বল চাঁদটার দিকে চোখ পড়লেও বুকের ভেতর কোনো দোলা অনুভব করিনি। এখন এই পর্দা সরানো জানালার কাচের দিকে তাকিয়ে হিসাব কষতে চেষ্টা করলাম প্রকৃতির এই পরিবর্তন, ঘোলা অন্ধকার আমাকে টেনে নিয়ে গেল হেমন্তের পালাবদলে।
বাংলাদেশে ছয়টি ঋতু হিসাব করলেও প্রধানত গ্রীষ্ম, বর্ষা এবং শীত আমাদের প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। শরত, হেমন্ত এবং বসন্ত ঠিক বুঝে ওঠার আগেই পেরিয়ে যায় অগোচরে। অথচ হেমন্ত আর বসন্তের রূপ-রস-গন্ধ আমাদের জীবনচেতনায় ফেলে যায় প্রবল ছায়া। বসন্ত যদি হয় রূপ ও সৌন্দর্যের ঋতু, হেমন্ত তবে সচ্ছলতার ঋতু। হেমন্তেই কৃষকের গোলা ভরে যায় ধানে, বর্ষার উত্তাল নদী আর প্লাবনের ভাঙনের পর কৃষকের ক্লান্ত-দীর্ণ মুখে ফুটে ওঠে হাসির ঝিলিক। চতুর্দিকে ধান কাটা আর ধান মাড়াই নিয়ে মেতে ওঠেন গ্রামবাংলার কৃষক। তার ঘরে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা, ‘নবান্ন’ হবে। হেমন্তের ধান কাটার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত অঘ্রান মাসে অনুষ্ঠেয় অন্ন খাওয়ার উৎসবই হলো নবান্ন, যা বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে কালক্রমে। কিন্তু সেও তো আজ গত।
ঢাকা মহানগরীর একটি ভবনের ছয়তলার অ্যাপার্টমেন্টে আমি থাকি। খোলা আকাশ যদিও বা দেখা যায় জানালা দিয়ে, কিন্তু গাড়ি চলাচলের টানা রাজপথ চোখে পড়ে না, পাশের ভবনে গিয়ে চোখ আটকে যায়। বিদ্যুৎ আর ডিশ লাইনের তারে ঝুলে থাকে জীবন-জীবিকার ভাবনাচিন্তা। অলিগলি-সরুপথের ওপর টেনিস বলের মতো ড্রপ খায় দৃষ্টিসীমা। আমি কী করে দেখতে পাব তিরতির করে বয়ে চলা নদীর দু’পাড়ে গজিয়ে ওঠা শাদা কাশবন, কাশবনের ওপর ঢেউ খেলে যাওয়া উত্তুরে বাতাস অথবা দিগন্তবিস্তৃত ফসলহীন মাঠ? যে কৃষক ফসল কেটে ঘরে তুলে নিয়ে গেছে, তার গোলায় ধান উঠেছে, ঘরে আনন্দের বন্যা বইছে, চুলোয় রান্না হচ্ছে নতুন চালের ভাত, তা আমার হৃদয় ভরে উচ্ছ্বাস তুললেও নাগরিক যানের ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে তা হারিয়ে যায় মুক্ত পাখির মতো। আমি তাকে ছুঁতে চাই, অনুভব করতে চাই। কিন্তু গুঁড়ো শিশিরের ভেতর ঠাণ্ডা বাতাস মিলেমিশে তৈরি করেছে এক বিধ্বস্ত নাগরিক জীবন। নীল আকাশে শাদা মেঘের অজস্র শিল্পিত কারুকাজ আমাকে এক ঘোরের মধ্যে টেনে নিয়ে গেলেও আমি বুঝতে পারি না, আমি কি হেমন্তের দুয়ারে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি?
আমি চোখ বন্ধ করি। আমি শুনতে পাই ঢেঁকিতে ধান ভানা আর চিড়ে কোটার শব্দ। কোন্ শৈশবে হয়তো শুনেছিলাম, সেই সব শব্দ অতীতের জঠর ভেঙে উত্থিত হয় চারদিকে। আমি ঢুকে যাই স্বপ্ন এবং ঘোরের ভেতর। সূর্যের রক্তিম আভা কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে নেমে আসে দীঘি, পুকুর আর নদীর তিরতির জলে, ঘাসের কচি ডগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুর ওপর জ্বলে ওঠে লক্ষ লক্ষ হীরকখণ্ড। ঝরাপাতার কাল শুরু হলো বুঝি? নইলে কেন বাতাস ভাঙার শব্দ শুনতে পাই, যে বাতাস বয়ে নিয়ে আসে নানা জাতের পিঠা-পায়েসের সুঘ্রাণ? কেন আমার কানে এসে বর্ষা, শরৎ আর শীতের পুঁথিগান হেমন্তের কীর্তনের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়? চোখ বন্ধ করেও আমি শুনতে পাই শীতের আগমনী শব্দ, তার পায়ের আওয়াজ। মানুষের গায়ে উঠেছে চাদর, মধ্যবিত্তের আলমারিতে তুলে রাখা পরম যত্নের শাল। নারীর শরীর ঢাকা পড়েছে গুঁজে রাখা শাড়ির বাড়তি আঁচলে। তার শরীরের গন্ধও মাখামাখি হয়ে আছে ধানের গন্ধে।
কিন্তু চোখ খুলতেই ঢাকা মহানগরীর শেষ রাতের অদ্ভুত প্রকৃতি আমাকে টেনে নামায় একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল প্রান্তসীমায়। আমার ঘরে নতুন ধানের উৎসব নেই, পিঠে বানানোর প্রস্তুতি নেই, ইট-কাঠের দেয়ালে আমি কী করে শুনব পাতা ঝরার শব্দ? আমার ফ্রিজে জমে আছে গতরাতের অবশিষ্ট খাবার, প্যাকেটের আটায় তৈরি হবে রুটি, ফরমালিন মেশানো কাঁচা সবজি আর রঙ মাখানো টমেটো আমাদের সব অনুভূতি কেড়ে নিয়েছে। আমাদের ইটের দালানে কোথায় পাব শাদা উঠোন, যে উঠোনে ঝরে পড়বে হিজলের পাতা?
এই নাগরিক জীবনে এ যেন বার্গার আর পিৎজার মহোৎসব। টেলিভিশনের পর্দায় রান্নার অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি খাবারের রন্ধন প্রণালি নিয়ে ব্যস্ত আমাদের স্ত্রী-কন্যারা। ওরা কী করে জানবে চিতই পিঠা আর পাটিসাপটার নিখুঁত নির্মাণ কৌশল? কুয়াশায় হেঁটে বেড়ানোর সেই আনন্দ কোথায় পাবে আমাদের সন্তানেরা? মাথায় ক্যাপ আর গলায় মাফলার জড়িয়ে ওরা বিদায় করে দেয় হেমন্তের শীতল অনুভূতি, ওরা কী করে বুঝবে প্রকৃতির এই বিষণ্ন রূপের মধ্যেই লুকিয়ে আছে হাজার বছরের বাঙালিয়ানা?
আমি ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য রাস্তায় নেমে আসি। হালকা শীতল বাতাস আর ধোঁয়াটে কুয়াশা ভেঙে হাঁটতে থাকি। আমার দু’পাশে কি দোল খেয়ে নুয়ে পড়ছে কাশবন, সোঁদামাটির গন্ধ উঠে আসছে, কানের কাছে একটানা বাজছে ঢেঁকির আওয়াজ? রিকশাওয়ালার ডাকে ঘোর ভাঙে_ যাইবেন স্যার? আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখি ঢাকা মহানগরী আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে জাগছে। পিচঢালা রাজপথে শুকোতে থাকে রাতের শিশিরবিন্দু।