স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ

আমার রবীন্দ্রনাথ সোনার বেদিতে বসানো আরাধনার নন, তিনি আমার মহান অগ্রজ, তাঁর সাফল্য যেমন জানি, তাঁর ব্যর্থতাও আমার চোখে পড়েছে; ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলিনি কিন্তু শিখেছি তা থেকে, সাফল্যে সবার সঙ্গে থেকেছি। হয়তো কোনো একদিন একটি বইই লিখব অগ্রজের ওই সাহিত্যিক ও সামাজিক ব্যর্থতা নিয়ে, যা তাঁর অসামান্য কৃতির আলোয় চোখ ধাঁধানো আমদের চোখেই পড়েনি। তাঁকে নিয়ে মুগ্ধ বা অধ্যাপকসুলভ উদ্দীপনে কিছু লিখে ওঠার তাড়া কখনোই ছিল না। আমার মেধা ও দৃষ্টি নির্মাণে তিনি ছিলেন আমার জন্যে অনেকখানির হাত লাগানো মানুষ।

রবীন্দ্রনাথের একটি দুর্ভাগ্য এই যে, স্বদেশেও স্বভাষী অনেকের কাছে তিনি তখনো এবং কারো কারো কাছে এখনো ‘আধ্যাত্মিক’ দর্শনসম্পন্ন এক কবি ছাড়া আর কিছু নন। এই দৃষ্টিভ্রমের পেছনে তিনটি কারণ সনাক্ত করতে পারি, যেগুলোর একটির জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই দায়ী। প্রথম কারণ, বৃটিশ ও তাদের সূত্রে পাশ্চাত্য বিশ্বের প্রচারণা; রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরস্কার পান তখন লন্ডনের ‘টাইমস’ পত্রিকায় ১৯১৩ সালের ১৯শে নভেম্বর সংখ্যায় সম্পাদকীয় প্রবন্ধে গোড়াতেই বলা হয়, স্মৃতি থেকে উদ্ধার করছি ‘ডক্টর টেগোর প্রাচীন হিন্দু ঋষিদের মতোই তাঁর গান গেয়ে বেড়ান।’ এবং এই কথাটিই সেদিন ইয়োরোপ ও আমেরিকার সমস্ত পত্রিকায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল; সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে তাঁর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ভূমিকার কথা, বাঙালির মনে দেশচেতনা সঞ্চার এবং সমাজ ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধনের কথা। দ্বিতীয় কারণ, ভারতবর্ষের রাজনীতি এবং সে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির উপস্থিতি; ধর্মপরিচয়ের দিক থেকে ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী, মুসলমানরা, বিশেষ করে বৃটিশ বাংলায়, এই রাজনীতি ও ভেদবুদ্ধির কারণে তাঁকে বাঙালি বা ভারতীয় বলে গ্রহণ না করে, ‘হিন্দু’ বলেই মনে করতো, বেদ ও প্রাচীন আর্য ভারতের বোধে প্রাণিত এক ব্যক্তি বলেই ধারণা করতো। হায়, কোন কবি তো কবিই নন যদি তিনি না হন যে-কোন ধর্ম বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে মানুষের কবি এবং রবীন্দ্রনাথ একজন কবি। তৃতীয় কারণ, রবীন্দ্রনাথেরই তৈরি; তাঁর জীবন যাপন, বেশভূষা, কেশবিন্যাস, কোনটিই-তাঁকে মানুষ সংলগ্ন কবি বলে প্রতিভাত হতে সাহায্য করেনি।

রবীন্দ্রনাথ কোন অর্থেই ‘আধ্যাত্মিক’ ছিলেন না; তিনি ছিলেন কাজের মানুষ। কবিতা লেখা, গান সৃষ্টি করা, ছবি আঁকা, এই সবই ছিল তাঁর কাজ—বিশ্বভারতী, শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার মতোই তাঁর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই মানুষটি সব অর্থেই ছিলেন ইহলৌকিক কাজে নিবেদিত, চারদিকের বাস্তব প্রতিদিনের নিঃশ্বাসে গ্রহণ করেই তিনি ছিলেন জীবিত, প্রাণিত, সক্রিয়। তিনি যে কত বড় কাজের মানুষ ছিলেন তা আজ আমরা বুঝি, যখন দেখি, মৃত্যুর এত বছর পরেও তাঁর উপস্থিতি যে কোন জীবিত মানুষের চেয়েও অধিক ও প্রত্যক্ষ। তাঁর সমস্ত কাজ-কবিতা, গান, প্রবন্ধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দেশদিকনির্দেশ-আমাদের জাতীয় জীবনের কত গভীরে গিয়ে ছুঁয়েছে সেটা অনুভব করতে এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট যে, এখনো এই বাংলাদেশে তাঁর বিরোধিতা করাটাও-কবি অর্থে, আধুনিক বাঙালির রূপকার অর্থে-চলতি রাজনৈতিক কূটকৌশলের প্রধান একটি চাল।

হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ যদি আর ক’টি বছর বেঁচে থাকতেন, ভারতবর্ষ থেকে বৃটিশ শাসনের অবসান দেখে যেতে পারতেন! তিনি যে দেখে যেতে পারেন নি, আমার মনে হয়, এটি একই সঙ্গে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য এবং সৌভাগ্য। দুর্ভাগ্য—কারণ, যে স্বদেশের মুক্তি ছিল তাঁর সমস্ত কাজের একমাত্র কারণ, সেই মুক্তি আসতে পারে কেবল রাজনৈতিক কাঠামোয়, সেই রাজনৈতিক মহাকাঠামো, স্বাধীনতা, তিনি প্রত্যক্ষ করতে পারলেন না। সৌভাগ্য—যে প্রাচ্য ছিল তাঁর অস্থিমজ্জায়, সেই প্রাচ্যের যে তিনটি দেশকে তিনি অনুভব করতেন রক্তের ভেতরে—চীন, জাপান ও ভারতবর্ষ এবং যার একটিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই দেশটির দ্বিখণ্ডন তাঁকে চোখে দেখে যেতে হল না; যে বৃহত্তর সমন্বয় সাধনে তিনি ব্রতী হয়েছিলেন নিজের দেশে, আঞ্চলিক বিচারেও সেই সমন্বয়ের স্বপ্ন সব অর্থে যখন ভেঙে পড়ল তখন সে শোক তাঁকে আমাদের প্রজন্মের মানুষের মতো সইতে হল না; মৃত্যু তাঁকে বন্ধুর মত তুলে নিয়ে গেল।