ক্লাউনের পোশাক পরে

শেখের সম্বরা, আত্মার সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে শওকত ওসমান ক্লাউনের পোশাক পরে সমাজের সঙ্গে লড়াই করেছেন। এই পোশাকটা তার দরকার, তিনি যেসব প্রশ্ন করতে চান কিংবা সমালোচনা, এ পোশাকটা তাকে কতক সুবিধা দেয়। তিনি ক্লাউন, তিনি বাইরের লোক, তার চোখে সব ধরা দেয়, তিনি অন্যদের চেয়ে বেশি অবেগপ্রবণ এবং স্পর্শকাতর। এই পোশাক পরে শওকত ওসমান সমাজের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করেন; এই সম্পর্কটা সমালোচনা এবং টেক্সটের, বুদ্ধিজীবীর এবং সমাজের। ক্লাউনের মধ্যে একই সঙ্গে ক্রিয়াশীল বৈদগ্ধ এবং সরসতা, এই পরস্পর প্রবিষ্টতা সমালোচক শওকত ওসমানের নিজস্ব সম্পদ। তার বায়বীয়, কথ্য শায়েরী, রসিকতার মধ্যে রসিকতা, উক্তির মধ্য দিয়ে তিনি নিজের বোতামগুলো ফুর্তির সঙ্গে খুলতে থাকেন, ফুর্তির মধ্যে থাকে গেরিলা পদ্ধতি, তিনি আক্রমণের পর আক্রমণ করতে থাকেন এই বদ্ধ, পচা, ধর্মান্ধ, পশ্চাৎপদ কূপমণ্ডূক সমাজটাকে। তিনি জামা খুলে নিজেকে দেখান অলজ্জ ভঙ্গিতে, তার ঠোঁটে থাকে সরস বাকভঙ্গি, তিনি ঝগড়া কিংবা লড়াই, ঠাট্টা করতে থাকেন বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে, অন্ধতার বিরুদ্ধে, শওকত ওসমান এই স্টাইলটি সযতেœ নির্মাণ করেছেন, এই স্টাইলে বিচ্ছুরিত উজ্জ্বলতা এবং নির্মমতা, বিচ্ছুরিত উদ্দাম হাসি এবং বেপরোয়া ঠাট্টা, যেন ঠাট্টা করে হেসে তিনি উড়িয়ে দেবেন সব ভান এবং মিথ্যা, তার শব্দ হচ্ছে নির্মম খঞ্জর। তিনি উদাম করে দিচ্ছেন মোল্লাদের, বুর্জোয়াদের, তিনি বেঁচে আছেন একটি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সংকটের জাতীয় জাগরণের মধ্যে। এসব লেখা পড়লে মনে হয় শওকত ওসমান একটি বিশেষ লক্ষ্য অবলম্বন করেছেন, সাময়িকভাবে ‘সাহিত্য’ স্থগিত রেখেছেন। অন্যপক্ষে এসব লেখা বুদ্ধিদীপ্ত, বিশদ ও বিস্তারিত, তির্যক ও তীক্ষè, লড়াই কিংবা অভিজ্ঞতার দিকে এক ধরনের মনোভঙ্গি ঝাণ্ডার মতো উঁচু করে ধরা। এ যেন সংকট মুহূর্তে অত্যন্ত সচেতন একজন ব্যক্তির এক ধরনের কমিটমেন্ট, এই কমিটমেন্টে ক্রিয়াশীল এক ধরনের বাচালতা, এক ধরনের স্টাইল এবং অন্য এক ধরনের চেতনাবোধ।
এ কি স্ববিরোধিতা? সৃষ্টিশীল কাজে যেখানে শওকত ওসমান স্থিতধী সেখানে শওকত ওসমান এসব কাজে ক্লাউনের পোশাক কেন পরেন? তিনি এসব কাজে ‘জোকার’ সচেতনভাবে প্লিবিয়ান জোকার, তিনি ছিঁড়ে খুঁড়ে দেন মেকীপনা, মাটি কিংবা বাস্তবে পা রেখে কথা বলতে থাকেন অনর্গল, কথা বলার মধ্য দিয়ে তিনি তৈরি করেন মানষী স্বাভাবে আস্থা, সে আস্থার ভিত্তি মানুষের বাঁচনোর তাগিদ, মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, এ সবের মধ্য দিয়ে তিনি অনুগত্য জানান সত্য, সুন্দর, সদগুণ এবং সাহসের কাছে। তার উপন্যাসের ক্ষেত্রে যেসব বক্তব্য কিংবা রাজনৈতিকভাবে কাঠামোগত কারণে তীব্র তীক্ষè করতে পারেন না। সেসব এ ধরনের লেখার মধ্যে একপক্ষে তিনি রাজনৈতিকভাবে তীক্ষè করতে সক্ষম হয়েছেন এবং অন্য পক্ষে এ ধরনের লেখার মধ্যে তার মেজাজ ফুর্তি পায়। তিনি আরও বেশি সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক অর্থে, তার মেজাজ ঝরনার মতো স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে। যে-অন্ধ আনুগত্যকে তিনি ক্রিতদাসের হাসি কিংবা রাজা উপাখ্যানে ইতিহাসের পরিসরে পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করেছেন, সেই অন্ধতাকেই তিনি নিজেস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত কিংবা শেখের সম্ভরা নামক শায়েরী কিংবা আত্মার সঙ্গে সংলাপ নামক তীর্যক শিক্ষকতার মধ্যে ঠাট্টায়-ঠাট্টায়, রসিকতায়-রসিকতায়, চাবকে-চাবকে ফালা-ফালা করে দিয়েছেন। তিনি এসবে জটিলকে সরল করেছেন, ‘পবত্র’ সব প্রতীক কিংবা ঘটনাকে নেংটো করেছেন নিজেকে নেংটো করার মধ্য দিয়ে। নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত আত্মজৈবনিক বিবরণের অন্য অর্থ হচ্ছে তার সমকালীন আত্মজৈবনিকতা মেলে ধরা, এও এক ধরনের বি-নির্মাণ পদ্ধতি নিজের ঘটনার উল্লেখের মধ্য দিয়ে স্বকালের জটিল তাৎপর্য ব্যাখ্যা করার চেষ্টা।
শওকত ওসমান উপন্যাস/গল্প লেখা থেকে যখন কমিক্যাল লেখার দিকে ঝোঁকেন তখন তিনি ‘মহান’ বিষয় থেকে সাধারণ বিষয়, ‘সূক্ষ্ম’ ইঙ্গিতময়তা থেকে ‘স্থূল’ নির্দেশের মধ্যে নিজেকে এবং অন্যকে নিয়ে কোলাহল করতে থাকেন। নাগরিক শওকত ওসমানের এ যেন দেহাতী দেহান্ত কিংবা দেহাতী পরিসরকে তার কখনও উপেক্ষা না করা।
এসব লেখায় শওকত ওসমান তার উপন্যাস/গল্পের চেয়ে বেশি ‘উইট’ বেশি ‘ইডিওসিনক্রেটিক’, সে জন্য তিনি ঝকঝকে তরুণ শেষ পর্যন্ত এসব লেখায় থেকেই যান। ব্যক্তি শওকত ওসমানের ‘উইটে’র পেছনে কাজ করে সামাজিক যুক্তি। তার এসব ব্যঙ্গ কৌতুক রসিকতা শায়েরীর মধ্যে প্রোথিত সামাজিক যৌক্তিকতা, এই যৌক্তিকতা, নিরক্ত ভদ্রতা এবং আমলাতান্ত্রিক শালীনতা ছত্রখান করে এবং পেরিয়ে যায়, সে জন্য এসব শায়েরীর মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়ে দেন ভাষার সামাজিক দিক, শব্দের মধ্যকার কৌতুক এবং সন্ত্রাস, ভাষার সামাজিকতা, শব্দে অন্তঃশীল কৌতুক এবং সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে তিনি পৌঁছে যান কমনসেন্সে। তার বক্তব্য হচ্ছে : কমনসেন্সের বড় অভাব সমাজ এবং স্বদেশে, সে জন্য তার মধ্যে তৈরি হয় থেকে-থেকে অধৈর্য এবং ক্রোধ, তিনি বেঈমান সময়টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান শায়েরীর ঐতিহ্য নিয়ে।
এ কথাও বলা দরকার : এ ধরনের লেখা তার সাহিত্যকর্মের একটা বড় অংশ এবং এসব লেখা সাহিত্যই। এ তার ‘সাহিত্যিক’ লেখার মধ্যে অন্তরিক ব্যবহারিক বোধি, বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ততা আর উচ্চমানের রেটরিক্স যা-কিনা তার উপন্যাস/গল্পকে জমকালো করেছে। তার অনুপস্থতি এসব ক্ষেত্রে লোকবাদী, ক্লাউনের মুখোশ পরে সমাজকে নাচিয়ে যাচ্ছেন। তিনি চূড়ান্তে নিয়ে চলেছেন শরীরকে এবং আত্মাকে, সূক্ষ্মতাকে এবং স্থূলতাকে, সেজন্য তিনি খুব সহজেই উচ্চারণ করে চলেছেন ‘ব্লেসফেমাস’ কথাবার্তা। এভাবে এসব সংস্কৃতির ঐতিহ্য অন্তর্গত হয়ে যাচ্ছে, আবার সংস্কৃতি থেকে সাহিত্যকর্মে অন্তরিত হচ্ছে।
শওকত ওসমান তার গল্প/উপন্যাসে আলোকপ্রাপ্ত যৌক্তিকতার মধ্যে কাজ করেছেন। আলোকপ্রাপ্ত যৌক্তিকতার মানবিকতা পশ্চিম দেশীয় মানবিকতা, এ মানবিকতার যৌক্তিকতার মধ্যে ঔপনিবেশিক অবস্থান অস্বীকৃত এবং ঔপনিবেশিক অধস্তনদের সংস্কৃতি এবং সাহিত্য ‘স্থূল’ হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু এই ‘স্থূলতা’ অধস্তনতার লোকজ বধি, বিপরীত মেজাজ এবং বাক্যবিন্যাস। শওকত ওসমান আলোকপ্রাপ্ত যৌক্তিকতা এবং মানবিকতা বিপরীতে এসব সরস শায়রীতে লোকজ মূলে ফিরে গিয়েছেন, সংস্কৃতির বিপরীত পাঠ তৈরি করেছেন, ‘স্থূলতা’কে সাহিত্যিক বাকভঙ্গির শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ হচ্ছে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ভদ্র ‘সূক্ষ্মতা’ এবং ‘শালীনতা’র বিরুদ্ধে। ভদ্র সূক্ষ্মতা এবং শালীনতা হচ্ছে শিক্ষিত জন এবং শিক্ষিত স্তরের কর্তৃত্ব এবং এই কর্তৃত্বে যৌক্তিকতা তিনি এক ফুঁয়ে অস্বীকার করে চলেছেন এসব কাজের মধ্য দিয়ে।শ্রুতিলিখন : কামাল হোসেন

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর- এর আরো পোষ্ট দেখুন →
রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...