শীতের কাব্যবয়ান

পৌষ যায় যায়, এখনো মাঘ আসেনি। শীত এসেছে, এখনো আসেনি শীতের বাঘ। যে বাঘের কামড়ে কাঁপন জাগে সুন্দরবনের ডোরাকাটা বাঘের হাড়েও। কাঁপন জাগতে শুরু করেছে আমারও ষাটোত্তর হাড়ে। এখন সকাল এগারোটা, পৌষের শেষ সপ্তাহ। আমার পুস্তকাকীর্ণ লেখার টেবিলে বসে বন্ধ করে দিয়েছি পাশের কাচের জানালা। খুললেই আসছে শীতের মৃদুমন্দ তীর। ত্বকের উপর কেমন যেন ভালো-লাগা পরশ। তবে কিছুক্ষণ পরে সেই তীর বিদ্ধ করতে চাইছে হাড়ের হৃদয়। বটে, হাড়েরও যে হৃদয় আছে তা বেশ টের পাচ্ছি তার শিহরিত নড়াচড়ায়। আবার চাদরের আবরণী পেরিয়ে সেই শীতের আদর পেঁৗছে যাচ্ছে বুকের পাঁজরেও। মাথায় ক্যাপ পরেছি বটে, কিন্তু চিন চিন করছে কানের উদোম লতি। এমন মুহূর্তে ভাবা যায় কিছু, লেখা যায় কিছু?
তবে অবাক কাণ্ড! সাহস করে ল্যাপটপ খুলে কী-বোর্ডে আঙুল চালাতেই মনের কথাগুলো অক্ষর হয়ে জেগে ওঠে মনিটরে। লিখতে লিখতে কখন যেন আমি আমার টেবিলের চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো বইগুলোর মধ্যে রবীন্দ্র-নজরুল আর তাদের পরবর্তী কবিদের কাব্যগ্রন্থের দিকে হাত বাড়াই। উদ্দেশ্য, শীতের পঙ্ক্তি খুঁজে বেড়ানো। তখনি মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পঙ্ক্তি : ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে। পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তাল্।ে।’ বাহ! বেশ তো মিলে যাচ্ছে শতবর্ষ পরে কবিগুরুর বাণী। শতবর্ষ পরে আমি এক ষাটোর্ধ নতুন কবিযশোপ্রার্থী পড়ছি তার নবায়িত পঙ্ক্তি। আমারও জানালা আছে, তার পাশে গাছের ডাল আছে, তার ডালে ডালে শীতের হাওয়ার নাচন আছে। তবে পার্থক্য যে নেই তেমন নয়। আমার গাছটি আমলকী নয়, আম্র। তার পাতাগুলো নিষ্কম্প, কিন্তু ধূলিধূসরিত; তাতে নাচন নেই, আছে শিহরিত কম্পনের দোলা। রবীন্দ্রনাথ তার এই অজর কবিতাগানে প্রকৃতির যে বহির্চিত্র এঁকেছেন, তারই পাশাপাশি বিম্বায়িত করেছেন প্রকৃতিবাহিত নিয়তির মনোচিত্রও। শীতার্ত গাছের পাতা উড়ে গেল, ফলের কোনো আশা আর রইলো না। আর এই যে শূন্য করার খেলা, এটি যেমন বিরহ-সুখের, তেমনি সেই খেলা যিনি খেলছেন, তার জন্যেও ব্যাকুল অপেক্ষা স্বয়ং কবির। শীতের পরশ বারবার কবিকে ডেকে যায়, আর আউড়ে যেতে চায় আরেকটি বৃষ্টিবিহীন মেঘলা চরণ : ‘সব খোয়াবার সময় আমার হবে কখন কোন সকালে!’ গায়ের চাদরটা গোছাতে গোছাতে ভাবি, শীতের সকাল এলে কি শুধু এই ‘সব- খোয়াবার’ কথাটিই মনে পড়ে? হ্যাঁ, তাতো বটেই; কিন্তু রাতের বেলাটি কেমন? শীতার্ত রাত সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিচিত্র। তবে যেহেতু রবীন্দ্রনাথের শীতের সকালের কথা বলেছি, তার কণ্ঠেই শোনা যাক শীতরাত্রির কথা : ‘আমার শীতের বনে এলে যে সেই শূন্য ক্ষণে।/ … রাতের তারা উঠবে যবে সুরের মালা বদল হবে/তখন তোমার সনে মনে মনে।’ শীত এভাবেই হারিয়ে পাওয়ার বেদনা-সুখের বৈপরীত্যকে পুষ্পিত করে। বলতে ইচ্ছে করে, শীত এলে রিলকের পাতা ঝরে যায়, কিন্তু ফুটে ওঠে রবীন্দ্রনাথের নিশীথকুসুম। সেই কুসুমের বুকে বুক লাগিয়ে বিপরীত তাপে পরস্পর উষ্ণ হয়ে ওঠার অপেক্ষা। আর শুধু স্মৃতি কুড়ানো, সেই স্মৃতির মালা বদল করা হৃদয়বতীর সঙ্গে। ইচ্ছে হয়, বোদলেয়ারের কবিতার চরণে বিম্বিত নির্বেদকে শীতের উষ্ণতায় পরিশুদ্ধ করি নিজের গরজে : ‘হাজার বছর যেন বেঁচে আছি এতো স্মৃতি জমেছে আমার’। তবে কি শীত ও স্মৃতি যুগপৎ শিহরণ তোলে কবির সৃষ্টিসত্তায়?
এবার হাত বাড়াই নজরুলের দিকে। গানের পাখি নজরুলের কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হয় রবীন্দ্রবোধ, তবে নতুন ছন্দে, নতুন আনন্দে। রবীন্দ্রনাথ ঘরে ফেরার জন্যে উতলা হননি, কিন্তু নজরুলে সেই দেখি ব্যাকুলতাকেই। শীতের হাওয়াকে তিনি বলেছেন উদাস হাওয়া। ‘শীতের হাওয়া বয়রে ভাই উদাস হাওয়া বয়/ ঘরের পানে ফিরতে যে ভাই মন যে উতল হয়।/বেলা-শেষে বাঁশির তান/নেয় কেড়ে বিরহী-প্রাণ/থেকো না আর মান করে রাই বাঁশির সুরে কয়/ সেই সুরে মন কেমন করে পরান পাগল হয়।’ এখানেও আছে রাই প্রসঙ্গ, তবে যে দ্ব্যর্থ-চিত্র আছে রবীন্দ্রনাথে, তার বিপরীতে নজরুলে আছে একরৈখিক মিলনাকাঙ্ক্ষা। বুঝতে পারি বৈষ্ণবোত্তর বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র-নজরুল মানসিকতায় শীত এমনি করে প্রকৃতি ও নিয়তির রূপক হয়ে নতুন কাব্যবয়ানের সূচনা করেছে। তবে স্বীকার করতেই হবে, শীত নিয়ে এই যে কাব্যবয়ানের রূপান্তর তার এক শিখাস্পর্শী অবয়ব আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তিরিশের অগ্রণী কবি বুদ্ধদেব বসু। না, বাঙালি কবিতার পাঠক ভুলতে পারে না শীত নিয়ে বুদ্ধদেবের সেই দোলায়িত প্রলম্বিত গদ্যস্পন্দের অভাবনীয় প্রার্থনা, যা বাংলা কবিতায় শীতের বহুমাত্রিক নন্দনভাষ্য হিসেবে এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। পাঁচ/ছয় চরণের একুশটি স্তবকে গ্রথিত শতাধিক পঙ্ক্তির এই প্রায়-মহাকাব্যিক ভাষ্যটি শীত নিয়ে এমন একটি দর্শনমনস্ক কবিতা, যা বারবার পড়েও স্বাদ মেটে না। বরং বলা চলে, এই সেই কবিতা যা পড়তে পড়তে শরীর ও মন থেকে শীতের বাঘ পালিয়ে যায় সুন্দরবনের পত্রালি ছায়ায়। বুদ্ধদেব প্রথমেই পাঠককে নিয়ে যান এক নির্ভাবনার জগতে, যেখানে শুরু হচ্ছে অন্য এক অব্যাখ্যাত প্রস্তুতি : ‘এসো, ভুলে যাও তোমার সব ভাবনা, তোমার টাকার ভাবনা, স্বাস্থ্যের ভাবনা,/এরপর কী হবে, এর পর,/ফেলে দাও ভবিষ্যতের ভয়, আর অতীতের জন্য মনস্তাপ।/আজ পৃথিবী মুছে গেছে, তোমার সব অভ্যস্ত নির্ভর/ভাঙলো একে-একে; _ রইলো হিম নিঃসঙ্গতা, আর অন্ধকার নিস্তাপ/ রাত্রি;_ এসো প্রস্তুত হও।’ বুঝতে কষ্ট হয় না বোদলেয়ার-অনুবাদক বুদ্ধদেব-বর্ণিত এই হিম নিঃসঙ্গতার উৎস বহুলাংশে বোদলেয়রীয় কাব্যজগৎ, কিন্তু যে ভাষায় ও ব্যাখ্যায় তা পুনর্চিত্রিত তা একান্তভাবেই বুদ্ধদেবীয়। আর আগেই বলেছি, এমন বহুরৈখিক দর্শনমনস্ক উচ্চারণ বাংলা কবিতায় অশ্রুতপূর্ব। হিম, বরফ-রাত্রি, ডাইনি-হাওয়ার চাবুক, কুয়াশার মধ্যে চাঁদটাকে কাগজের মতো টুকরো করে ছিটিয়ে দেয়া, আকাশকে উপড়ে আনা, শাদা নরম নাচের মতো অক্ষরে পৃথিবীতে মৃত্যুর ছবি আঁকা, ইত্যাকার চিত্র-বর্ণনা বাংলা কবিতায় আগে দেখিনি; পরেও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শীতকে কবি বানিয়েছেন অতীত ও ভবিষ্যতের চলমান মঞ্চ, যার গতি দিগন্তমুখী : ‘যে-অতীত অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য, তারই নাম ভবিষ্যৎ; /যাবে, হবে, ফিরে পাবে। মুহূর্তের পর মুহূর্তের ছলনা/কেবল চায় বেঁধে রাখতে, লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু তোমার পথ/চলে গেছে অনেক দূরে দিগন্তে। … এসো, আস্তে পা ফ্যালো, সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসো তোমার শূন্য ঘরে _ /তুমি ভরে তুলবে, তাই শূন্যতা। তুমি আনবে উষ্ণতা, তাই শীত।’ আসলে শীত, অন্ধকার, জীবন, আলো, মৃত্যু, বীজ, বীজ থেকে অঙ্কুর, পুনর্জন্ম, ফসল, অপেক্ষা, বিরহ, পাতাল, সময়হীনতা যেন একাকার এই কবিতায়। এই অস্তিত্বকেই তিনি বলেছেন ‘অনাকার অন্ধকার’। আর সেই অন্ধকারই মাতৃগর্ভ, জন্মজন্মান্তরের মঞ্চ। ‘মৃত্যুর নাম অন্ধকার: কিন্তু মাতৃগর্ভ _ তাও অন্ধকার, ভুলো না,/তাই কাল অবগুণ্ঠিত, যা হয়ে উঠেছে তা-ই প্রচ্ছন্ন;/এসো, শান্ত হও; এই হিম রাত্রে, যখন-বাইরে ভিতরে কোথাও আলো নেই,/তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য/প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও।’ শীত যে একটি ঋতুমাত্র নয়, নয় কোনো আঙ্গিক মানসিক অনুভবও, তার শিকড় যে মানব-উপলব্ধির ভেতরমুখী অতল গভীরতায় ও আকাশচারী শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত হতে পারে এই কাব্যবয়ান তারই স্মারক। কেবল এমন একটি মহৎ কবিতার