কবির প্রতীক্ষা শেষ হয় না

অপেক্ষা

অপেক্ষা মানুষ জীবনে যা চায়, যা কিছুর জন্য মানুষ অপেক্ষা এবং প্রতীক্ষায় থাকে_ তার সবটা কি পায়? সব স্বপ্নের রঙ মানুষ দু’হাতে পারে না আঁকড়াতে।
নিজের সম্পর্কে একটা অস্পষ্ট, একটা বিচ্ছিন্ন ধারণা তো বরাবরই ছিল আমার। কবি হবো_ এমন ধারণা কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সেই স্থির করি এবং এমত জীবন যাপন আরম্ভ করি। আর বাবা এই ভাবনা ও জীবন যাপনে তেমন বাধা না দিলেও বড় ভাই চাননি কখনও যে, আমি কবি হই, একটি অনিশ্চিত জীবন বেছে নিই। ভাই হয়তো আমার সুখ-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ জীবনের প্রত্যাশায় বিচ্ছিন্ন এক জীবনের পথে আমাকে যেতে দিতে চাননি। এ জন্য বড় ভাই চেষ্টাও করেছিলেন খুব; কিন্তু আমিই নিজে বেছে নিয়েছি দুঃখময় এক উদ্বিগ্ন জীবন। পা বাড়িয়েছি জীবনকে গভীরতম দুঃখের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দেখবার পথে।

এইখানে কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ
পড়ে থাকে কবিতারা উধাও হয়েছে
কবির জীবন ছিলো নিরুদ্দিষ্ট কবিতার পাতায়-পাতায়;
ছিন্নভিন্ন, ছেঁড়াখোঁড়া, দীর্ঘশ্বাসে-দীর্ঘশ্বাসে খুব
দীর্ণ ও উবুড়!
কবির জীবন মানেই উদ্বিগ্ন জীবন। নানা ধরনের উদ্বিগ্নতা। সেগুলো যেমন জাগতিক; একইভাবে অনেক সময় দার্শনিকও। মানব মনের আত্মিক যে শূন্যতা_ সে শূন্যতা কবিকে আরও এক জীবনের প্রতীক্ষায় উদ্বিগ্ন করে তোলে। আর এই যে জীবন; এই উদ্বিগ্ন জীবনে ভালোবাসাও তো পেয়েছি অনেকের। আমি সন্তানদের ভালোবাসা পেয়েছি; আমি আমার প্রিয় মানুষদের ভালোবাসা পেয়েছি, বেশ কিছু মানুষের প্রবল স্নেহ পেয়েছি। এসব তো কম নয় এক জীবনে সময়ের কাছ থেকে পাওয়া। এ জীবনকে তো আমি ভালোবাসি। এবং আমার ডাক নাম ‘জীবন’। তাই কবিতায় লিখেছিলাম একদিন

বাবা-মা আদর ক’রে
‘জীবন’ ‘জীবন’_ ব’লে ডাকতো যাকে
সে আজ ‘মৃত্যু’র খুব নিকট-আত্মীয়।

হ্যাঁ, মৃত্যু আমার নিকট আত্মীয়ই বটে। যত দিন যাচ্ছে, ততই আমি মৃত্যুর কাছাকাছি পেঁৗছাচ্ছি। জীবনের যাত্রা শেষের এই সংকেতও আমাকে দীর্ঘ এক হাহাকারে নিক্ষেপ করে যে, জীবনটা আসলে কী? যে কোনো কবির জন্যই এই জীবনের মানে খোঁজা যেন এক অনিবার্য নিয়তি। এই অর্থ খুঁজে পাওয়ার জন্য আমার প্রতীক্ষা তো শেষ হবে না। পাই বা না পাই আমার প্রতীক্ষা কখনও ফুরাবে না। কবির প্রতীক্ষা শেষ হয় না।
আমি অপেক্ষা করছি আমার কবিতাগুলোকে আরও একটু নিজের মতো করে তুলতে। কোনো কবিই কি তার লেখা নিয়ে সন্তুষ্ট? আমিও না। কিন্তু এও সত্য যে, আমি আমার সমস্ত জীবনে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনও কলম ধরিনি। শুধু লেখার জন্যই লিখিনি কখনও। মনের জন্যই লিখেছি কবিতা। তাই হতে পারে তারা সংখ্যায় কম তবু প্রত্যেকেই আমার সন্তানের মতো। এবং তারাই আমাকে আগামী দিনে কবি রফিক আজাদ হিসেবে সবার সামনে হয়তো খুব ক্ষুদ্রাকারে হলেও উপস্থিত করবে। একজন কবি হিসেবে এও আমার এক প্রতীক্ষা।
আমার আরও এক প্রতীক্ষা হচ্ছে, আমার দেশের মানুষের সুখ-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ। আমি প্রতীক্ষা করি। কবি তো দেশ বা সমাজ-অসংলগ্ন কোনো ব্যক্তি নন যে তার দেশের শেকড়ের সঙ্গে তার কোনো যোগ থাকবে না। বৈষম্যহীন সুষম সমাজ ব্যবস্থা আমি প্রত্যাশা করি। আপামর মানুষের কল্যাণ আমাকে অপেক্ষায় রাখে। সে জন্য শুভবোধসম্পন্ন মানুষের জাগরণ আমি প্রতীক্ষায় রাখি।
চেয়েছিলাম সাগরের নীলিমামগ্ন চোখে, জীবনের গূঢ় ধারাবাহিকতা ছাড়া অন্য কোনো ছবি আর কখনও দেখব না। দেখতে চাইনি আর ঊষর, ধূসর রঙ_ সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ।

আমার প্রতীক্ষা আমার সন্তানদের মুখগুলো একটু দেখবার জন্য। ওদের কাছ থেকে আমার খুব বেশি কিছু চাইবার নেই। আমি তাদের কাছে জাগতিক কোনো সুখের প্রত্যাশা করি না। আমি অপেক্ষা করি_ তাদের মুখগুলো আমার সামনে আসবে, আমি তাদের জড়িয়ে ধরব আবার।
আর অপেক্ষা করি এমন কিছু মুহূর্তের জন্য যেগুলো কবির মুহূর্ত। কবিই বোঝে সেইসব মুহূর্তের ভাষা। এমন কিছু মুহূর্তের জন্য যখন আমি কবি হিসেবে অপেক্ষা করি_ তাকে বোঝানোর জন্য তখন ‘অপেক্ষা’ শব্দটিকে প্রকৃতই আর যথেষ্ট মনে হয় না।
আমি তখন প্রতীক্ষায় থাকি। আর এই প্রতীক্ষাকে নিয়েইএকদিন আমি লিখি
এমন অনেক দিন গেছে
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,
হেমন্তে পাতা ঝরার শব্দ শুনবো বলে
নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে
কোন বন্ধুর জন্যে কিংবা অন্য অনেকের জন্যে
হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবো…
এমন অনেক দিন তো গেছে
কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব’সে আছি
হয়তো কেউ বলেছিলো, “অপেক্ষা কোরো
একসঙ্গে বেরুবো।”

এক শনিবার রাতে খুব ক্যাজুয়ালি
কোনো বন্ধু ঘোরের মধ্যে গোঙানির মতো
উচ্চারণ করেছিলো, “বাড়ি থেকো
ভোরবেলা তোমাকে তুলে নেবো।”
হয়তোবা ওর মনের মধ্যে ছিলো
চুনিয়া অথবা শ্রীপুর ফরেস্ট বাংলো,
আমি অপেক্ষায় থেকেছি…

যুদ্ধের অনেক আগে
একবার আমার প্রিয় বন্ধু আলোক মিত্র
ঠাট্টা ক’রে বলেছিলো,
“জীবনে তো কিছুই দেখলি না
ন্যুব্জপীঠ পানশালা ছাড়া। চল্ তোকে
দিনাজপুরে নিয়ে যাবো
কান্তজীর মন্দির ও রামসাগর দেখবি,
বিরাট গোলাকার চাঁদ ও মস্ত খোলা আকাশ দেখবি,
পলা ও আধিয়ারদের জীবন দেখবি
গল্প-টল্প লেখার ব্যাপারে কিছু উপাদান
পেয়ে যেতেও পারিস,
তৈরী থাকিস আমি আসবো”…
আমি অপেক্ষায় থেকেছি;

আমি বন্ধু, পরিচিত-জন, এমনকি-শত্রুর জন্যেও
অপেক্ষায় থেকেছি,
বন্ধুর মধুর হাসি আর শত্রুর ছুরির জন্যে
অপেক্ষায় থেকেছি

কিন্তু তোমার জন্যে আমি অপেক্ষায় থাকবো না,
প্রতীক্ষা করবো;
‘প্রতীক্ষা’ শব্দটি আমি শুধু তোমারই জন্যে খুব যত্নে
বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখলাম,
অভিধানে শব্দ-দু’টির তেমন কোনো
আলাদা মানে নেই
কিন্তু আমরা দু’জন জানি
ঐ দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য অনেক।

‘অপেক্ষা’ একটি দরকারি শব্দ
আটপৌরে, দ্যোতনাহীন, ব্যঞ্জনাবিহীন,
অনেকের প্রয়োজন মেটায়।
‘প্রতীক্ষা’ই আমাদের ব্যবহার্য সঠিক শব্দ,
ঊনমান অপর শব্দটি আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য,
আমরা কি একে অপরের জন্য প্রতীক্ষা করবো না?

আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বত্থের মতো
দাঁড়িয়ে থাকবো,
ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ’রে যোগ্য পথিকের
জন্যে প্রতীক্ষমান,
আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো
আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকবো অমল বিশ্বাসে,
দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে আমার পায়ে
শিকড় গজাবে
আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না…

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
রফিক আজাদ- র আরো পোষ্ট দেখুন