পদ্মা সেতুর দুর্নীতি ফাস হলো যে ভাবে

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল : রুমানা হাসানের ঘটনা, টেংরাটিলা গ্যাসের ঘুষের কারণে ক্যালগরির নাইকো কোম্পানিকে ৯৪ লাখ ৯৯ হাজার ডলার জরিমানা, মঞ্জুর মোরশেদ নামে এক প্রতারক ৭টি কন্ডো বিক্রির নামে ২ কোটি ডলার প্রতারণা প্রভৃতি নেতিবাচক ঘটনার পর আবার দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক আলোচিত ও বিতর্কিত হলেন বাংলাদেশী-কানাডিয়ান মোহাম্মদ ইসমাইল।   পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এসএনসি নাভালিনার ভাইস প্রসিডেন্ট রমেশ সাহা ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান আর আন্তর্জাতিক বিষয়ক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল বাংলাদেশী-কানাডিয়ান। ইসমাইলের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া। তিনি বুয়েটের ৮৯ ব্যাচের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। কানাডা এসে অটোয়ার কার্লটন ভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে প্রথমে অটোয়ায় স্ট্যানটেক চাকরি করে পরে এসএনসি নাভালিনার কোম্পানিতে যোগ দেন। তিনি প্রথমে ২০০৪ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত মেটেরিয়াল এক্সপার্ট, ২০০৬ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত প্রজেক্ট ম্যানেজার এবং ২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এসএনসি-নাভালিনার পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। চাকরিচ্যুত হওয়ার পর রমেশ সাহা (৬২) বর্তমানে সাসকাচুয়ানের একটি ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানির কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন। আর মিসিসাগার মোহাম্মাদ ইসমাইল (৪৯) টরন্টোর অকভিলে ২০১১ জুন থেকে এএসসিও নামে নিজ ফার্মের প্রেসিডেন্ট এবং সিও।   রমেশ সাহা ইতোপূর্বে বাংলাদেশে ২-১টি প্রকল্পে এসএনসির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। তার আউট-পুন এবং আচরণ সন্তোষজনক নয় বলে তাকে শুরুতে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করতে চায়নি। সে জন্যই উক্ত কোম্পানি প্রথমে তাকে এ প্রকল্পের প্রস্তাব প্রণয়ন ও দাখিলের সঙ্গে যুক্ত করেনি। ইসমাইলের সঙ্গে তার সদভাব ছিল না। ফলে কারিগরি মূল্যায়নে এসএনসি প্রথম হতে না পারায় রমেশ কৌশলের ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে ইসমাইলকে কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরপরই সাহাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেন এবং তার পরিবর্তে ইসমাইল নিজেই বাংলাদেশে এসএনসির প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হন। উক্ত দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কেভিন ওয়ালেসের সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন এবং দেনদরবার করেন।   ২০১১ সালে মোহাম্মদ ইসমাইল বাংলাদেশে গিয়ে হোটেল শেরাটনে অবস্থান করেন এবং ঢাকা ক্লাবে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে বৈঠক করে তা রমেশ সাহাকে প্রতিনিয়ত রিপোর্ট করতেন, যা রমেশ ডায়েরিতে নোট করতেন বলে জানা গেছে। পরে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে বিষয়টি ফাঁস করে দেন। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি প্রকাশ পায়। অন্য একটি প্রজেক্টের কারণে মোহাম্মদ ইসমাইলকে চাকরিচ্যুত করার ক্ষেত্রে রমেশ সাহা ভূমিকা রাখেন। ঘটনার জের ধরে ইসমাইল পরবর্তীতে রমেশকেও চাকরি থেকে আউট করে দেন।   প্রতিহিংসার কারণেই অফিসিয়াল সিক্রেট বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগরিটি ডিপার্টমেন্টের কানে পৌঁছে। তারপর শুরু হয় হৈচৈ। বিষয়টি কানাডা সরকারকে জানালে অভিযুক্ত কোম্পানি এসএনসি নাভালিনার বিরুদ্ধে রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেন পুলিশ তদন্ত শুরু করে। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর নাভালিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশী টাকায় ৩৪৫ কোটি টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পায়। ফলে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলারের চুক্তি বাতিল করে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদ ইসমাইলকে আরসিএমপি গ্রেপ্তার করে। পরে রমেশ সাহাকেও আটক করা হয়। তারা দুজনেই মুচলেকা দিয়ে বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। আগামী বছর এপ্রিলে তাদের বিরুদ্ধে কানাডার আদালতে বিচার শুরু হবে। বাংলাদেশ ও নেপালে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর এলেন গোল্ডস্টেইন স্বীকার করেছেন যে, বিশ্বব্যাংকের এ রিপোর্টের জন্যই রমেশ আর ইসমাইলকে গ্রেপ্তার হয়েছে। কানাডিয়ান দৈনিক গ্লোব এন্ড মেইলের মাধ্যমে জানা যায়, নাভালিনার আরেক প্রকৌশলীকে সুইজারল্যান্ডে আটক করা হয়েছে। মন্ট্রিয়ল ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নাভালিনা কানাডার একটি নামকরা কোম্পানি হলেও এদের বদনামও রয়েছে। যদিও ক’দিন আগে এসএনসি-নাভালিনা নিজ দেশের ৫০টি সেরা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১তম স্থান অর্জন করে নিন্দিত থেকে নন্দিত হলো। অনেকেই মনে করছেন, নিজেদের বদনাম ঢাকার জন্যই এটা সাজানো ব্যাপার।   রমেশ-ইসমাইল ছাড়াও টরন্টোতে বসবাস করেন এমন চারজনের কাছে নাভালিনা মনোনীত ব্যক্তি অর্থ দিয়েছে, এমন তথ্য প্রমাণ কানাডিয়ান পুলিশের কাছে আছে। তাদের তিনজন সম্প্রতি ঢাকা সফর করেছেন। তাদের প্রত্যেককেই ঢাকায় প্লট বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এভাবে যদি রুমানা হাসান, মঞ্জুর মোরশেদ, নাইকো, নাভালিনা, ইসমাইলরা তাদের অপকর্মকা- ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখেন, তাহলে কানাডায় আমাদের মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না!   সুত্রঃ ভোরের কাগজ ২৯শে জুলাই ২০১২। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল : কবি, সাংবাদিক।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
মিতা- র আরো পোষ্ট দেখুন