কাঠ-ফাটা রোদ্দুর

রোদ্দুর, সূর্যের যে আলো এসে পৃথিবীকে স্পর্শ করে, তার বহুরূপ। শীতে সে কোমল, পেলব, হেমন্তে আর্দ্রতায় স্নেহময়, বসন্তে সি্নগ্ধ এবং মধুর। গ্রীষ্ম এলেই তার চেহারা আর চরিত্র বদলে যায়। চৈত্র মাস দিয়ে সেই বদলে যাবার শুরু। খুব ধীরে ধীরে নয়, একবারেই রেগে প্রচণ্ডরূপে রুদ্ররোষ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আকাশ থেকে নিচে। সকালের তপ্ত জ্বলন্ত সূর্য যখন দুপুরে মাঝআকাশে ওঠে, সে সময় রোদ যেন আগুনের ফুলকি হয়ে ঝরে। সেই ঝরা জ্বালাময়ী রোদে ঘাস পুড়তে থাকে, মাঠ ফেটে চৌচির হয়, জলাশয় শুকিয়ে আসে। বাতাস হয়ে যায় ড্রাগনের নিঃশ্বাস। চৈত্রের সেই রাগী নির্দয় রোদে কাঠ ফাটে, যার থেকে নাম হয়ে গেছে কাঠ-ফাটা রোদ্দুর। গ্রীষ্মের সূর্যের এমন নিষ্করুণ নির্দয় পরিচয় আর কোনো ভাষায় এমন সশব্দে প্রকাশ পায়নি। ইংরেজি ‘স্কার্ডিং সান’ একটা ছবি তুলে ধরে; কিন্তু সেখানে নীরবতা বিরাজ করে। বাংলায় কাঠ-ফাটা রোদ্দুর বলতেই অডিও-ভিস্যুয়াল অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়। নির্বাক রোদ্দুর যেন হয়ে যায় সবাক চলচ্চিত্র। ‘কাঠ-ফাটা রোদ্দুর’ যত অসহ্যই হোক, তার একটা শিল্পরূপ প্রতিষ্ঠিত হয়_ অসুন্দরেরও যেমন রূপ আছে বলে নন্দনতত্ত্বে বলা হয়ে থাকে, ভয়ঙ্কর জ্বালাময়ী রূপেও সৌন্দর্য আছে। এই মোহনী নিকষিত হেমের।
দুপুরের কাঠ-ফাটা রোদ্দুরে রাস্তার পাশে যে কয়টি গাছ অনাথের মতো দাঁড়িয়ে, তাদের লতা ঝুলে পড়েছে নিচে, যেন সব রস শুকিয়ে যাবার পর এখন ঝরে পড়ার উপক্রম। ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া গাছগুলো বজ্রাহতের মতো। তাদের শাখা-প্রশাখার যেন ফেটে পড়তে না হয়, তার জন্য যুঝে যাচ্ছে ভেতরকার সঞ্চিত রস নিয়ে। শুকনো ডালপালা যেসব নিচে পড়েছে, শীতের মৌসুমে সেসব ফাটার অপেক্ষায়।
যে গাছপালা প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে, সেগুলোর নিচেই দেখা যায় আশ্রয় নিয়েছে শ্রান্ত-ক্লান্ত খেটে খাওয়া মানুষ, পাশে জিভ ঝোলানো কাতর সারমেয়। গাছের ছায়ায় মানুষ এবং প্রাণী রক্ষা পেতে চাইছে নির্মম রোদের হাত থেকে। রোদ তাদের চোখে মোটেও সুন্দর মনে হচ্ছে না। দুপুরের রোদ তাদের জন্য একটা নির্দয় প্রাণঘাতী হুমকি। মলিন গামছা কিংবা ছেঁড়া শার্টের কোনা দিয়ে মুখ, ঘাড়, বুক থেকে মুছে নিচ্ছে ঘাম শরণার্থী মানুষ। কুকুর ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে, লাল জিভ উঠছে-নামছে দ্রুত।
দুটো কাক ফুটপাতের পাশে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নর্দমার কাদা মেশানো পানিতে মাথা ডুবিয়ে ভিজিয়ে নিচ্ছে শরীর। সামান্য পানি পিঠে ছড়িয়ে পাখা ঝাপটাচ্ছে, যেন বাতাস দিচ্ছে নিজেকে। অনেকক্ষণ চলে তাদের জলকেলি, যদিও পানির চেয়ে কাদাই উঠে আসছে বেশি। ওইটুকু ঠাণ্ডার স্পর্শ পেয়ে কাক দুটো চৈত্রের দাবদাহের আতঙ্ক দূর করছে। তারা অনেকক্ষণ ওড়াওড়ি করবে না, ছুটবে না খাদ্যের খোঁজে।
সে শ্রমিক দু’জন ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের উপায় নেই থেমে বিশ্রাম নেবার। তাদের সামনে-পেছনে দুই পাশে নানা ধরনের যানবাহনের স্রোত। ট্রাফিকের চলমান গতি তাদের থেমে মাথার ঘাম মুছে ফেলার সময়টুকু পর্যন্ত দিচ্ছে না। তাদের ছেঁড়া শার্ট শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে, গায়ের রঙ হয়েছে পোড়া কয়লার মতো, মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে জিভ। তারা হাঁফাচ্ছে, বড় বড় শ্বাস ফেলছে, পা দুটো জড়িয়ে ধরছে রাস্তার পিচ। কিন্তু তাদের থামার উপায় নেই, কাঠ-ফাটা রোদ্দুরেও তাদের টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে ঠেলাগাড়ি, ভারবাহী পশুর মতো অসহায়ভাবে। চৈত্রের দুপুরের কাছে তাদের কোনো ক্ষমা নেই।
মহানগরীর রাস্তায় ট্রাফিক মাঝে মাঝেই অচল হয়ে যায়, থেমে থাকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য। যানবাহনগুলো গায়ে গা লাগিয়ে দুপুরের উত্তাপ বাড়ায়, তাদের গা থেকে রৌদ্রের হুঙ্কার ঠিকরে পড়ে, তারা পুড়তে থাকে আকাশ থেকে ঝরেপড়া রোদের আগুনে। রাস্তার পাশে গাছ নেই, বিজ্ঞাপনগুলো জ্বলজ্বল করে, ঝলসে ওঠে তাদের রঙ। বহুতল ভবনগুলো কাঠ-ফাটা রোদ্দুরে ঝিম মেরে থাকে। তাদের গায়ে লাগানো কাচ থেকে উত্তাপ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। লুর মতো বাতাস এলেও আটকে যায় গায়ে গা লাগানো দালানের ভিড়ে। বিশাল উনুনের মতো আকাশ থেকে সূর্য হা-হা করে হাসে নিচের শহরকে দেখে। যেন ফাঁদে ফেলেছে তাকে। শহরে গ্রীষ্ম নির্দয়, কঠিন, দয়া-মায়াহীন।
গ্রামেও গ্রীষ্মে কাঠ-ফাটা রোদ্দুর আসে, আকাশ থেকে ঝরে আগুন। কিন্তু সেখানে গাছপালা, শ্যামলিমায় সেই রোদ্দুর যেন অনেকটা সহনীয়। শহরের গ্রীষ্মের দুপুর যদি হয় কঠিন গদ্যের মতো, গ্রামের কাঠ-ফাটা রোদ্দুরকে বলা যায় নরম সুরে গেয়ে যাওয়া গাথা। এখানে শুধু ছবি নেই, রঙ দেখা যায় না, কাহিনীও পাঠ করা যায়। শস্যহীন মাঠে রোদ পড়ে, মাটি তা শুষে নেয়, তাপের ঝাঁঝ তাতে কমে। মাটি ফেটে চৌচির হয় কখনও কখনও, সেও রোদের উষ্ণতা থেকে প্রকৃতিকে কিছুটা মুক্তি দেবার জন্য। সর্বংসহা হয়ে রুক্ষ মাটি মানুষকে পরিত্রাণ দেয়, অপেক্ষা করে বৃষ্টির।
কাঠ-ফাটা রোদ্দুরে গ্রামের মানুষ অলস হয়ে বসে থাকার বিলাসিতা ভোগ করে না। তারা মাঠে কাজ করে, জমি চষে, হাড্ডিসার গরু দুটোর পেছনে মাথাল মাথায় ঘর্মাক্ত হয়ে হেঁটে যায়। কখনও উষ্ণ বাতাসের ঝাপটা এসে লাগে মুখে-বুকে। শীতল না হলেও বাতাস বলেই কিছুটা আভা থাকে তার মধ্যে। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লে কাজে বিরতি দিয়ে কৃষক গিয়ে বসে কোনো গাছের নিচে। সামান্য যেটুকু ছায়া, সেখানে মায়া জড়ানো থাকে। সেই মায়ায় শ্রান্তি দূর করা যায় কিছুক্ষণের জন্য। গ্রামে সূর্যের দহন অব্যাহত নয়। তার বিরতি আছে, তা থেকে রেহাই পাবার উপায় আছে।
যেখানে জলাশয় তার ভেতর গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে থাকে গরু-মহিষ, কেবল মাথাটুকু দেখা যায় ওপরে। তালগাছঘেরা দীঘিগুলোকে দেখায় শান্ত, কোমল এবং সি্নগ্ধ। উষ্ণ বাতাস সেগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে এলে তার স্পর্শে থাকে শীতলতা। বাতাসে তালগাছের পাতায় লাগানো বাবুইয়ের বাসা দোলে, সেই দৃশ্যে কাঠ-ফাটা রোদ্দুরের কাঠিন্য নেই। গ্রামের সীমানায় গাছপালার বেষ্টনী সূর্যের কাঠিন্যকে করে মসৃণ, সহনীয়। গ্রীষ্মের আকাশের নিচে গ্রামগুলো অসহায় হয়ে জ্বলতে থাকে না। যেমন জ্বলে শহর। কাঠ-ফাটা রোদ্দুর আর গ্রামের মধ্যে বৈরিতা নেই। আছে ঋতু পরিবর্তনের বোঝাপড়া। জনপদ হিসেবে শহর কৃত্রিম, কাঠ-ফাটা রোদ্দুর তাই সেখানে বড় বেশি নির্মম।
কাঠ-ফাটা রোদ্দুরের জন্যই চৈত্র মাস কবিদের খুব প্রিয় নয়। একজন তো অসহায়ভাবে লিখেছেনই :’তখন চৈত্র মাস/তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্ব্বনাশ।’ ‘সর্ব্বনাশ’, সে যে কোনো মাসেই আসতে পারে; কিন্তু কবি চৈত্র মাসেরই উল্লেখ করলেন। কাঠ-ফাটা রোদ্দুর প্রেমকেও দূরে ঠেলে দেয়।
কবিগুরু গ্রীষ্মকে দেখেছেন ‘দীপ্ত চক্ষু শীর্ণ সন্ন্যাসী’রূপে। যিনি শুষ্কপর্ণ নদী তীরে, শস্যশূন্য তৃষা-দীর্ণ মাঠে উদাসী প্রবাসীর মতো এসে পদ্মাসনে বসেন। তার কাছে কবির প্রার্থনা :
‘হে বৈরাগী করো শান্তি পাঠ
উদার উদাস কণ্ঠ যাক ছুটে দক্ষিণে ও বামে_
মাঝনদী পার হয়ে, যাক চলি গ্রাম হতে গ্রামে
পূর্ণ করি মাঠ।
হে বৈরাগী করো শান্তি পাঠ।’
কাঠ-ফাটা রোদ্দুরে কবি শুনেছেন অদৃশ্য বৈরাগীর শান্তি পাঠ। গ্রীষ্ম ধ্বংসের নয়, সৃষ্টির সূচনাবহ। চারদিক ক্ষণিকের জন্য শুষ্ক করে শুদ্ধতা আনার ব্রত তার। কাঠ-ফাটা রোদ্দুর আপাতদৃশ্যেই নির্মম, কঠিন। তার বাণী পবিত্রতার, শান্তির।