গজারের পেটে একটি দুপুর

আগে মেজ নানার মুলতানি গাভির গল্পটা বলে নিই।মায়ের মেজ চাচা, মানে আমার মেজ নানা ছিলেন ব্রিটিশ মালবাহী জাহাজের সারেং। রিটায়ারমেন্টের পর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন। দিনে দিনে অদ্ভুত এক নেশা তৈরি হলো তাঁর। সেই নেশার নাম ‘গরু’। বাড়ির কয়েক মাইল দূরে গরুর হাট। প্রতি সপ্তাহে সেই হাটে গিয়ে নানা জাতের গরু দেখেন। পাইকার ব্যাপারীদের সঙ্গে গরুর জাতপদ ও চরিত্র নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। স্বপ্ন হচ্ছে একটি মুলতানি গাভি ক্রয়। মুলতানি গাভি সম্পর্কে তিনি বহু তথ্য জানেন। ওই গাভির কোনো তুলনা নাকি ত্রিভুবনে নেই। কিন্তু পাইকার ব্যাপারীরা মুলতানি গাভি জোগাড় করে দিতে পারছিল না। বহুকাল আগের কথা। সেকালেও টাউট-বাটপাড়ের কমতি ছিল না। গরুর দালালি করা এক বাটপাড় ভিড়ে গেল নানার সঙ্গে। হাড়-জিরজিরে কেংলামতন একটা গরুর শিংয়ে আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে মুলতানি গাভি পরিচয়ে নানাকে গছিয়ে দিল। নানা যারপরনাই মুগ্ধ। এই তো আসল মুলতানি গাভি পাওয়া গেছে। কুচকুচে কালো শিং মুলতানি গাভি ছাড়া অন্য কোনো গাভির নাকি হয় না। তো সেই গাভি বাড়িতে পৌঁছাল সন্ধ্যার পর। দুখানা হ্যাজাকবাতি উঠানে টানিয়ে দিল নানার পুরনো কাজের লোক। হ্যাজাকবাতির ফকফকে আলোয় উদ্ভাসিত তথাকথিত মুলতানি ঘাস-বিচালি চিবাতে লাগল। গ্রামের লোকজন ভেঙে পড়েছে ওই জিনিস দেখতে। ফজলু নামে ট্যাটন টাইপের এক লোক ছিল। ফাজিলের হাড্ডি। লোকে তাকে আদর করে ডাকত ‘ফক্কর’। বেশ একটা ভাব নিয়ে নানা বসে আছেন হাতলঅলা চেয়ারে, হাতে খানদানি হুঁকার নল। থেকে থেকে গুরুক গুরুক করছে হুঁকা। ফাঁকে ফাঁকে নানা মুলতানি গাভির গুণাগুণ বর্ণনা করছেন। একপর্যায়ে বললেন, বুঝলি ফজলু, এই মুলতানি গাভিটা খুবই শিক্ষিত। ফজলু সঙ্গে সঙ্গে ফক্কর হয়ে গেল। অতিশয় সিরিয়াস মুখ করে বলল, কী পাস, সারেং সাব? বিএ, না এমএ?মেজ নানার মুলতানি গাভির সঙ্গে ঘুরপথে নয়নের গজার মাছের একটা সাযুজ্য আছে। নয়নের পুরো নাম সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন। কালের কণ্ঠের ইভেন্ট এডিটর। সঙ্গে শুভসংঘ’র পরিচালক। একের ভেতর দুই। এদিক দিয়ে তার ওস্তাদ চৌধুরী আফতাবুল ইসলামের সঙ্গে বেশ মিল। আফতাব কালের কণ্ঠের জয়েন্ট এডিটর কাম হেড অব নিউজ। ওস্তাদ-সাগরেদ দুজনেই দুটো করে পদে নিয়োজিত, পদভারে অবনত। আফতাবের সঙ্গে নয়নের ব্যবধান হচ্ছে আফতাব খুবই ঘরমুখো, স্ত্রী আর পুত্রদ্বয়ে আবিষ্ট। নয়ন ঠিক তার উল্টো। বাড়িঘর ছেড়ে থাকতেই ভালোবাসে। আর ভালোবাসে হাত-পা ভাঙতে, কলারবোন ভাঙতে। আমার মগবাজারের ফ্ল্যাটে দেখা করতে এসে বছর সাতেক আগে বাঁ হাতের বাহু তিন ভাঙা দিল। হাতে রড-সিমেন্ট লাগিয়ে ঘুরে বেড়াল বেশ কিছুদিন। এবার ভাঙল কলারবোন। ভাঙার পর আমাকে ফোন করে এত স্বাভাবিক গলায় কথা বলল, শুনে মনে হলো কলারবোন ভাঙেনি, উষ্টা খেয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলে সামান্য ব্যথা পেয়েছে। ওই বস্তু ভাঙার আগে এক শুক্রবার চাঁদপুর জেলার মতলবে গিয়েছিল মাছ ধরতে। এই নিয়ে শুরু হলো তার গজার পর্ব।তার আগে আমাদের উপদেষ্টা সম্পাদক অমিত হাবিব, সংবাদপত্রজগতের অমিতদা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ বয়ান করতে হয়। কালের কণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক হয়ে এলো সে। এসেই ধীরে ধীরে অফিসের পরিবেশ অধিকতর প্রাণবন্ত করার নিমিত্তে তৎপর হলো। আমার রুমের ঠিক উল্টো দিকে তার রুম। সেই রুমের এক কোণে গোলটেবিল ফিট করল। সঙ্গে পাঁচখানা চেয়ার। এই হচ্ছে আমাদের ডাইনিং টেবিল। অমিত ছাড়াও আমরা চারজন খাদক জুটে গেলাম। নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল, আফতাব, আমি আর আমাদের নয়ন। আমরা সবাই বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসি। দুপুর ২টার দিকে অমিত আর আমার মিলিয়ে তিনজন অফিস সহকারী- সোহাগ, খায়ের, সাইদুল টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়। টিফিনবাটি আর প্লেটে সয়লাব হয়ে যায় টেবিল। একেক বাড়ি থেকে তিন-চার পদের তরকারি আসে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারো পদ দিয়ে অন্নগ্রহণ চলে। শুধু নয়ন ফাউ। খেতে
বসে বিভিন্ন ব্যঞ্জনের স্বাদে বিমুগ্ধ নয়ন আহা-উঁহু করে।আমাদের বাড়িতে শোল-গজার মাছের একটা ভুনা হয়। লুডুর ছক্কার মতো, প্রায় ওই সাইজ করেই কাটা হয় মাছ। তেল-মসলার সঙ্গে টমেটোর কয়েকটা টুকরো ফেলে বেশ স্বাদু ভুনা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যের মতো। খেতে খুবই আরাম। সেদিন ওই ভুনা ছিল। খেয়ে নয়ন মহামুগ্ধ। বলল, কী মাছ?আমাদের মধ্যে অমিত হচ্ছে মাছবিশারদ। মুখে দিয়েই বলে দিতে পারে কোনটা কী মাছ। কামাল-আফতাব ওরাও পারে। মাছ বিষয়ে সবাই বেশ জ্ঞানী। মূর্খ বলতে আমি। ছেলেবেলায় মাছের এলাকা বিক্রমপুরে থেকে, ম্যালা মাছ হাতড়ে, ওই নিয়ে সাহিত্য রচনা করেও মাছটা ঠিকমতো চেনা হয়নি। খলিশাকে কৈ মাছের বাচ্চা ভেবে খাই।তো নয়নের প্রশ্ন শুনে অমিত বলল, গজার।আমাদের ভোজনপর্ব চলছে, গজার নামটা শুনে ওই অবস্থায়ই নয়ন প্রায় লম্ফ দিয়ে উঠল। গজার? গজার আপনারা খান নাকি? গত শুক্রবার আট কেজির একটা গজার ধরলাম। কেউ খায় না ভেবে বন্ধুকে দিয়ে এলাম।আমরা উৎকর্ণ হলাম। অমিত চশমার ওপর দিয়ে নয়নের দিকে তাকাল। মাগুর মাছের মুণ্ডু চিবাতে চিবাতে বলল, বলেন কী! আট কেজির গজার! সে তো বিশাল। কোথায় ধরলেন?মতলব থানার সাদুল্লাপুর গ্রাম। মেঘনাতীরে বেড়িবাঁধ দেওয়া হয়েছে। বেড়িবাঁধের জন্য মাটি কেটে তোলার ফলে লেক হয়েছে। লেকটা ঢুকে গেছে একটা পুকুরে। ওই পুকুরে বড়শি নিয়ে গিয়েছিলাম। ছবি আছে, ছবি দেখাচ্ছি।এই নয়ন ধরাটা খেল।ভোজন শেষ হওয়ার পর ফোন অন করে ছবি দেখাতে লাগল। একটা ছবি হচ্ছে বড়শিতে ধরা গজার তোলার আগে পানির তোলপাড়। নয়ন ছিপ ধরে আছে। দেখে মনে হচ্ছে এনিম্যাল প্লানেটে দেখা আমাজন নদীর কোনো মৎস্যশিকারি। পরের ছবিতে মাছ ডাঙায় তোলা হচ্ছে। শুধু মাথা দেখা যাচ্ছে গজারের। বড়ই মনে হচ্ছে। পরের ছবি, নয়ন গজারটাকে খাড়াখাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বায় মাছ প্রায় ওর কোমর অবধি। কিন্তু গজারের স্বাস্থ্য তেমন সুবিধার না। মেজ নানার মুলতানি গাভির মতো কেংলাপনা। হুমায়ূন ভাই (হুমায়ূন আহমেদ) বাংলা-উর্দু মিলিয়ে বলতেন, ‘লেড়কার চে’ লেড়কাকা গু ভারি’। শহীদ কাদরী এক কবির বাড়ি দেখে বলেছিলেন ‘এতনা ছোটা কবিকা এতনা বড়া মাকান’! এসবের আদি ভার্সন হচ্ছে ‘বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি’!নয়নের গজারের ওপর তখন হুমড়ি খেয়ে আছি আমরা। অমিত সিগ্রেট ধরিয়ে ফেলেছে। আফতাবের সিগ্রেটের প্যাকেট থাকে তার লুজ ধরনের জিন্সের ডান দিককার পকেটে। পকেটে হাত দিয়ে কেমন করে যেন ঠিক একটাই সিগ্রেট বের করে সে। এখনো তা-ই করল। মুখটা গম্ভীর। ততক্ষণে কালের কণ্ঠ অনলাইনপ্রধান মাহবুব মোর্শেদ হাজির। হাতে পৃথিবী নিয়ে ঘোরে মোর্শেদ। দুহাতে সদ্যোজাত শিশুকে কোলে নেওয়ার ভঙ্গিতে ধরা ট্যাব। খায়ের আর সাইদুল টক দই দিয়েছে। নয়নের ওই গজারের কারণে টক দই চামচে তুলতে আমরা ভুলে গেছি।এখানে আমাদের শরীর এবং খাদ্য বিষয়ে বর্ণনা করা সংগত। শুধু ডাইনিং টেবিল ফিট করেই ক্ষান্তি দেয়নি অমিত। হণ্টনটা অত্যাবশ্যকীয় করেছে। সঙ্গে সুষম খাদ্যাভ্যাস। লাঞ্চের পর টক দই। এটা খুবই স্বাস্থ্যকর। বিকেলের মিটিং শেষ করে আমরা হাঁটতে বেরোই। প্রথম প্রথম দলে মাত্র তিনজন। অমিত, কামাল আর আমি। দিনে দিনে দল ভারি হলো। মিডিয়া অ্যাডভাইজার তৈয়ব ভাই হাঁটতেন আমাদের অফিস গ্রাউন্ডে। অমিত তাঁকে দলে নিয়ে এলো। সাড়ে ৫টা-পৌনে ৬টার দিকে তৈয়ব ভাই টকটকে হলুদ ফুলস্লিভ টি-শার্ট কালো প্যান্টের ভেতর ইন করে, মাথায় ক্যাপ, পায়ে কেডস্, প্যান্টের নিচের দিকে দুটো ফোল্ড দেওয়া, হাসিমুখে হাজির। বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজামকে প্রথম প্রথম পটানোর চেষ্টা করেছি। চলো নঈম, হাঁটি। নঈম রাজি হয়নি। ইদানীং তার কাজ বেড়েছে অনেক। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিকের সম্পাদক, তার ওপর টিভি টক শো করছে প্রায় প্রতি রাতে। হাঁটার মতো বোরিং কাজে সময় ব্যয় করার সময় কোথায় তার! ঠিক এ সময়েই শরীর একটু তেড়িবেড়ি করল নঈমের। গেল ডাক্তা