বুবনা(শেষাংষ)

আলো জ্বালে। বাথরুমের আলোর সুইচ অন করে। নেই।
দরজা খুলতে চেষ্টা করে, পারে না। বাইরে থেকে বন্ধ। তৌকির দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে কোথায় গেল?
ঘুমটা একেবারে ছুটে যায়। টেলিভিশন চালাতে চেষ্টা করে, কিন্তু রিমোট কন্ট্রোল পাচ্ছে না। এ কোথায় এসেছে।
লুবনা যখন স্কুলজীবনের বান্ধবী সাব্রিনার সঙ্গে এই আমেরিকান পাত্রের প্রশংসা করছিল- দারুণ হ্যান্ডসাম, অমিতাভ বচ্চনের চেয়েও সুদর্শন, সাব্রিনা বলল, লুবু তোর কপালটা ভালো। আমার কপালের সঙ্গে একটুখানি ঠুকে দে। আমার জন্য যেসব প্রস্তাব আসে তাতে পাত্র থাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কিংবা পিরোজপুর। ঢাকার সবচেয়ে কাছাকাছি পাত্রটি রাজবাড়ী কলেজের লেকচারার।
সাব্রিনা তার মামাতো বোন রাইসা হকের গল্পটাও শোনাল। রাইসার বাবা শামসুল হক ইংরেজি কাগজের সম্পাদক। রয়টার, এএফপি আর ভয়েস অব আমেরিকায় কাজ করা পরিচিতজনদের গোয়েন্দাগিরির পর ভালো পাত্র হিসেবে বাংলাদেশের একজন ডাকসাইটে সচিবের ভাগ্নেকে পাত্র সাব্যস্ত করা হল। চেহারাও মাশআল্লাহ- যাকে বলে মহেন্দ্রনিন্দিত কান্তি উন্নত দর্শন। রাইসার বিয়েতে কী যে মজা হল! সেই রাইসা গেল তোদের ওই আমেরিকাতে। জায়গাটার নাম বার্কলে। তোর বরের বাড়ি থেকে জায়গাটা কতদূর খোঁজ নিস তো। বিয়ের দু’মাস পর ইসাবেলা নামের কুস্তিগীর টাইপের গর্ভবতী এক কালো মহিলা এসে তার গলা টিপে ধরে জিজ্ঞেস করে : এই বেশ্যা, তুই আমার হাজব্যান্ড লাভলুকে কবে কব্জা করলি? বাসা খালি পেয়ে ঢুকে পড়েছিস? ব্লাডি হোর। আমার পেটে লাভলুর বেবি।
বার্কলে থেকে ঢাকায় ফেরার টিকেট লাভলু দেয়নি। রাইসার বাবাকেই বাংলাদেশ থেকে পাঠাতে হয়েছে।
লুবনার মনে হল সকাল না হতেই প্রসব আসন্ন, ফোলা পেট একজন কালো মহিলা ঘরে ঢুকে তার ওপর চড়াও হবে। আঁচড়ে কামড়ে তার শরীর রক্তাক্ত করে ফেলবে।
ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। একসময় ঘুমিয়েও যায়। হাতপা গুটিসুটি মারা আতংক ঘুম। কখন যে তৌকির ঘরে ঢুকে তার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে লুবনা টেরও পায়নি।
লুবনা কিচ্ছু বলেনি। চেহারাতে কোনো ভিন্ন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলেনি।
তৌকির প্রায় দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়েছে।
আবদুল্লাহ মুত্তাকিন বেডরুমের দরজায় নক করে বলেছে, ব্রেকফাস্ট ইজ সার্ভড। আমি কাজে চলে যাচ্ছি।
লুবনা সাড়া দেয়নি।
অনেকক্ষণ পর দরজা খুলে বাইরে আসে। টেবিলে দুই প্লেটে জেলি কিংবা জ্যাম লাগানো দুটো দুটো চার টুকরো পাউরুটি। দুধভর্তি দুটো বোতল। একজোড়া খালি কাপ-পিরিচ।
মাখন-পাউরুটি কিংবা জেলি-পাউরুটি, নেহায়েৎ বাধ্য না হলে এ খাবার বাংলাদেশেও খায়নি। এসব খাবার জন্য আমেরিকায় এসেছে?
তৌকির সারা দিন বের হয়নি। বলেছে, জেটল্যাগ।
সন্ধ্যার দিকে লুবনাকে নিয়ে বের হয়। আধঘণ্টা হাঁটার পর ম্যাকডোনাল্ডস-এর একটি খাবার দোকানে ঢুকে দুটো বড় বার্গার, চিপস ও দুটো ফিশ ও ফিলে এবং দু’গ্লাস লার্জ কোক নেয়।
তেমন কথা হয় না। তৌকিরই বলে, কাল জিনস কিনে দেব। জিন্স পরবে।
ফেরার সময়, একজনের খাবার নিয়ে নেয়। আবদুল্লাহ মাঝরাতে ক্যাবিং করে ফিরবে। এসে খাবে। সে খুব পরিশ্রম করে। হি ইজ অ্যা গ্রেট সৌল।
হেঁটে ফেরার পথে আচমকা ডান পা-টা মচকে গেল। তারপরও পা টেনে টেনে ঘরে ফিরল। লুবনা বলল, টিভির রিমোর্ট কন্ট্রোলটা কোথায়?
তৌকির বলল, সরি, এটার পিকচার টিউব নষ্ট হয়ে গেছে। রেন্টাল শপ থেকে কালই তিন মাসের জন্য একটা টিভি ভাড়া নিয়ে আসব। তিন মাস না ফুরোতে হাতে কিছু টাকা এসে যাবে, তখন নতুন একটা কিনব।
টেলিভিশন ভাড়ায় পাওয়া যায়- লুবনা এমন আজব কথা এই প্রথম শুনল। তৌকির বলল, এ দেশে সবই ভাড়ায় পাওয়া যায়।
সে রাতেও তৌকির সুলতান লুবনাকে ঘুমন্ত রেখে বেরিয়ে গেল। ঘুম ভাঙা লুবনা দেখল, তার হাজব্যান্ড পাশে নেই।
তৃতীয় রাতে শুনল, ফেরার সময় আবদুল্লাহ মোত্তাকিন পিৎজা আর কোক নিয়ে আসবে। তখন ডিনার করবে।
লুবনা বলল, ইম্পসিবল, আমি না খেয়ে মাঝরাত পর্যন্ত থাকতে পারব না। আই অ্যাম হাংরি। একটা কিছু এখনই নিয়ে এসো। কাল থেকে রান্না শুরু করব।
রান্না শুরু করতে পারেনি। গ্যাস বিল খেলাপি হওয়ার কারণে লাইন কেটে দিয়েছে। তৌকির বলল, আবদুল্লাহ মোত্তাকিন না আসা পর্যন্ত তাকে না খেয়েই থাকতে হবে। সে গত এগার মাস ধরে বাড়ি ভাড়া দিয়ে যাচ্ছে। তার মতো গ্রেট সৌল স্টেটস-এর কোথাও নেই।
লুবনা গোটা ফ্ল্যাটে পড়ার মতো কিছুই পেল না, এমনকি পুরনো কোনো খবরের কাগজও না।
পঞ্চম রাতে উঠে যাওয়ার সময় লুবনা তৌকিরকে ধরে ফেলল। তৌকির অনুনয়ের সঙ্গে বলল, প্লিজ লেট মি গো। অর হি উইল হ্যাক মি টু ডেথ। আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলবে।
মানে?
উই আর কমিটেড টু ইচ আদার। হি ইজ মাই হাজব্যান্ড।

লুবনা হতভম্ব হয়ে তৌকির সুলতানের দিকে তাকিয়ে থাকে। এসব কী বলছে? হাজব্যান্ড মানে কী?
লুবনার শরীর হঠাৎ নিরক্ত হয়ে ওঠে। তৌকির চলে যায় পাশের রুমে আবদুল্লাহ মুত্তাকিনের কাছে। কথাটা যখন লুবনাকে বলেই ফেলেছে, বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করার তাগিদ বোধ করল না।
দরজা খোলাই রইল। লুবনার ঘুম কিছুক্ষণ পর পর ভাঙছে। আবার ঘুমিয়ে পড়ছে। ঘুম ভাঙলে মনে হচ্ছে তার শরীরের চারপাশে শুধু চা পাতা। চা পাতা শরীরের দ্রুত পচন ঠেকায়।
আব্বু আমেরিকার এগারটি ফোন নম্বর গুরুত্বের ক্রম অনুসারে লিখে দিয়েছিল। লুবনা দু’জনকে ফোন করেছে।
এক আত্মীয় বাংলাদেশে ফেরার টিকেট করে দিয়েছেন।
তৌকির বারবার বলেছে, আমাকে বুঝতে চেষ্টা কর, আমি তোমাকে আমেরিকায় সেটল্ড করিয়ে দেব। লুক আই অ্যাম অলসো অ্যা গুড সৌল।
ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার ঠিক তেইশ দিন পর লুবনা আবার ঢাকায় ফেরার ফ্লাইট ধরল।
যে বাবা তাকে সি-অফ করতে এয়ারপোর্টে আসেননি, সেই বাবাই মেয়েকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করলেন। ট্র্যানজিট এয়ারপোর্টে অন্য একটি উড়োজাহাজের ফুয়েল ট্যাংকারে আগুন ধরে যাওয়ায় জাহাজ উঠানামা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতে একঘণ্টার বেশি লাগেনি, কিন্তু বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা পরীক্ষায় কেটে যায় আরও তিন ঘণ্টা।
বোয়িং ৭৭৭ টেইল উইন্ড পাওয়ায় পনের মিনিট আগেই রানওয়েতে টাচ ডাউন করে।
যখন লুবনা অ্যারাইভাল লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসে, কর্নেল নুরুস সাফা বললেন, ডন্ট ওয়রি। দ্যাটস জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট।
এয়ারপোর্ট রোড ধরে মহাখালীর কাছাকাছি এসে লুবনা বলল, আব্বু, আমি আর পড়াশোনা করব না। আমার ইউনিভার্সিটিতে যেতে ভালো লাগে না। এখন আরও বেশি খারাপ লাগবে।
দ্যাটস ওকে।
আব্বু আমি বাসায় থাকব, রান্না করব।
আচ্ছা, বলে তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যেই কর্নেল সাফা নাক ডাকতে শুরু করলেন।
ঘুম ভাঙতেও তার সময় লাগে না। ফার্মগেট সিগন্যালে গাড়ি থামতেই তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, হোয়ার ইজ মাই রিভলবার?
তারপর লুবনার দিকে তাকিয়ে বললেন, আই উইল শুট দ্যা বাস্টার্ড তৌকিরের বাচ্চা।
লুবনা বলল, আব্বু কাম ডাউন। মাথা ঠাণ্ডা কর।
তিনি বললেন, আই স্পয়েলড ইয়োর লাইফ।
লুবনা বলল, তুমি তো আমার ভালোই চেয়েছিলে। ইউ ট্রাইড টু গেট মি দ্য বেস্ট ওয়ান। এটা আমার নিয়তি- মাই ডেসটিনি।
তৌকির লুবনাকে সি অফ করতে এয়ারপোর্টে আসতে পারেনি। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির জন্য লুবনার বার্কলে জীবনের উনিশতম দিনে তৌকির সুলতান তার অফিস থেকে গ্রেফতার হয়। ঢাকায় ফিরে আসার পরিকল্পনাটি তৌকিরকে জানায়নি।
সেই সন্ধ্যায় বাড়িতে পুলিশ আসে, সঙ্গে কুকুর। কুকুর সারা ঘর শুঁকে। আবদুল্লাহ মুত্তাকিনের রুম তালাবদ্ধ ছিল। বাড়িওয়ালা তার মাস্টার কি দিয়ে দরজা খুলে দেয়। সেখান থেকে প্রায় একশ’ পর্নো সিডি, একটি নোটবই… জব্দ করে সিজার লিস্টে লুবনার সই নেয়।
রাতে আবদুল্লাহ মুত্তাকিন লেবানিজ শর্মা নিয়ে আসে। লুবনা খায় এবং তাকে ধন্যবাদ জানায়।
আবদুল্লাহ তৌকিরকে গালিগালাজ করে এবং বলে, আমি একজন ভিক্ষুকের জন্য বাড়িভাড়া শোধ করতে রাজি আছি। কিন্তু একজন জালিয়াতের জন্য কেন দেব? ক্রেডিট কার্ড ফ্রড ইজ অ্যা সিরিয়াস ক্রাইম। আমি এখনই বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়ে দিচ্ছি। মাসের বাকি ক’টা দিন তুমি আরামে থাকতে পার। এরপর তোমার গাঁটের পয়সায়, অবশ্য যদি থাকে। যদি না থাকে আমাকে বলতে পার। আমি তোমাকে ডেসটিউট সেন্টারে দিয়ে আসতে পারি। তুমি কাজ না পাওয়া পর্যন্ত ওরা তোমার টেক কেয়ার করবে। তোমার হাত খরচের জন্য আমি কিছু টাকাও দিতে পারব।
লুবনা বারবার বলছে, সো কাইন্ড অব ইউ।
আবদুল্লাহ বলল, নতুন মাসের প্রথম দিন আমি একটা সস্তা ডর্মিটরিতে উঠব, কিন্তু তার আগে তোমার একটা বন্দোবস্ত হয়েছে তা নিশ্চিত হতে চাই।
আবদুল্লাহ মুত্তাকিন আরও একটু এগিয়ে অর্থকষ্ট থেকে বেঁচে স্বাধীন জীবনযাপনের জন্য আরও একটি প্রস্তাব দেয়। নেভার মাইন্ড। …
লুবনা মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলল, আমি তোমাকে জানাব।
১০
বেস্ট চয়েস গ্রুপ বছর ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই বুবনাকে আরও দু’বছরের জন্য তাদের ব্র্যান্ড আম্বাসেডর নিয়োগ করল। খবরটি বেশ ফলাও করে কোনো কোনো পত্রিকার অর্থ ও বাণিজ্য, কোনটার কর্পোরেট, কোনটার বিনোদন পাতায় ছাপা হল।
কোম্পানি বুবনাকে একটি গাড়িও দিয়েছে। মার্কেটিং বিভাগে বুবনার জন্য বরাদ্দ রুমটি হেড অব সেলসকে দিয়ে বুবনাকে উঠিয়ে আনা হয় চারতলায় ভিআইপি জোনে। এখানেই চেয়ারম্যান, এমডি, সিইও কোম্পানি সেক্রেটারির অফিস, বোর্ড রুম, মিনি কনফারেন্স এবং স্পেশাল ডাইনিং। নতুন যোগ হল ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের অফিস।
ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের কাজ কি আমার জানা নেই। তার অফিসেরই বা কী দরকার কে জানে।
আমার কানে বন্ধুদের মন্তব্য আসে। বুবনাকে বিয়ে করে আমাদের আবদুল স্মার্ট হয়ে উঠছে। সম্ভবত মিথ্যে বলছে না। বুবনা টাই বাঁধা শিখিয়ে দিয়েছে। আমার ছাতা হাতে ঘুরে বেড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। বুবনা যা বলছে সব মেনে নিয়েছি। বুবনা আমার কল্যাণ ও সমৃদ্ধি চায়- এ নিয়ে আমার এতটুকুও সন্দেহ নেই।
আমার কাজে ব্যস্ততা বাড়ছে। আমি রাতের বেলা এমবিএ পড়তে শুরু করেছি। ভালো ক্যারিয়ারের জন্য এমবিএ অনিবার্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বিজনেজ অ্যাডমিস্ট্রেশনের সুনাম আছে।
বুবনার গাড়িতে অফিসে ড্রপ নিই। প্রায় রাতেই সাড়ে ন’টা-দশটার দিকে আমাকে আইবিএ বিল্ডিং থেকে তুলে নেয়। আমার ক্লাসমেটদের কেউ কেউ বুবনাকে দেখে ফেলেছে এবং নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাকে জিজ্ঞেস করেছে। বলেছি, জি বুবনা সাফা, এখন বুবনা করিম। আপনাদের রেজাই করিমের স্ত্রী।
বুবনা গাড়ি হাতে পেয়ে ড্রাইভিং শিখতে দেরি করেনি। শেখার সময় যে লার্নার্স লাইসেন্স নিয়েছিল তা জমা দিয়ে আসল লাইসেন্স নেয়ার কথা। কিন্তু বিআরটিএ-তে যাওয়ার সময় হয়ে উঠছে না।
বুবনা বিত্তবান প্রযোজকদের শুভ দৃষ্টিতে আছে। সিমেনার শুটিং-এ নেপাল ও ভুটানে প্রায় একমাস কাটিয়ে এলো। কোম্পানি পারফর্মেন্স বোনাস দিয়েছে। টার্গেট অ্যাচিভমেন্ট সেমিনারের নামে টপ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে তিনদিন কাটিয়ে আমার জন্য ড্রাগন আঁকা একজোড়া কটিকের হাফ শার্ট নিয়ে দেশে ফিরেছে।
শিরোনামের সঙ্গে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে বহুল প্রচারিত একটি দৈনিকের সিনেমা পাতা কোনো একটি ক্লিপিং থেকে কেটে নেয়া বুবনার বিষণœ একটি ছবি ছেপে এর নিচে লিখেছে : বুবনার সংসারে ভাঙনের শব্দ শুনি? দৈনিকের বিনোদন প্রতিবেদক বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছেন বেস্ট চয়েজের সিইও এবং বুবনার বিয়ে কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। টি হায়দারের স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনসহ অসামাজিক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে বুবনা ও টি হায়দার বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থান করছেন বলে তার স্ত্রী জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে বুবনার স্বামী ব্যাংক কর্মকর্তা রেজাই করিম প্রথমে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পুনরায় মন্তব্যের অনুরোধ জানালে তিনি বলেন, বুবনা যা-ই করুক তাতে আমার যদি সমস্যা না হয়, আপনাদের সমস্যাটা কোথায়?
আমি অবাক হই। সরাসরি কিংবা ফোনে আমাকে কোনো সাংবাদিক কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেনি, কিংবা আমি তাদের কাউকে ডেকেও কিছু বলিনি। জিজ্ঞেস করলে হয়তো এরকম কিছু একটা কথাই বলতাম। সংবাদে সত্যতার লেবাস দেয়ার জন্য এরকম দু’চারটা কথা ম্যানুফেকচার করতে হয়।
ব্যাপারটা যদি সত্যিও হয়ে থাকে তাহলে এ মুহূর্তে আমার কী করণীয়? সাবিহা হায়দারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে টি হায়দার ও বুবনার বিরুদ্ধে মামলা করা?
পেশাগত ঈর্ষা থেকে টাকা-পয়সা খরচ করে এ ধরনের সংবাদ যে ছাপানো হয়ে থাকে এটাও তো মিথ্যে নয়।
আমি ভেবেছিলাম খবরটি একটি পত্রিকাই ছেপেছে, কিন্তু না। অন্য একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর পড়ে আমাদের চট্টগ্রাম কর্পোরেট ব্রাঞ্চের একজন সহকর্মী ফোনে জিজ্ঞেস করল, রেজাই করিম, খবরটা কি আমাদের ভাবিকে নিয়ে? বলেই আমার জবাবের অপেক্ষা না করে পুরো খবরটি পড়ে শোনাল। আবার জিজ্ঞেস করল, এটা ভাবি তো?
এসব প্রশ্নে সিরিয়াস হলে চলে না। হেসে হেসে বললাম, এ রকম বড় পদে আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। তোমাদের ভাবির কল্যাণে যদি এমন একজন পেয়েই যাই চাকরি-বাকরির জন্য কোথাও ঠেকব না। বেস্ট চয়েস খুব সলভেন্ট গ্র“প। তোমার কী মনে হয়?
তার সঙ্গে কথা আর এগোয় না। আর একটি ফোন আসে বুবনা ফ্যান ক্লাবের সেকেন্ড ভাইস প্রেসিডেন্ট-এর কাছ থেকে। জিজ্ঞেস করে, ভাইয়া এটা কি সত্যি?
আমি বললাম, বুবনা তো এখনও বিদেশে। ফিরলে জিজ্ঞেস করব।
সত্যি হলে কী করবেন?
অভিনন্দন জানাব। আমার চেয়ে অনেক যোগ্য একজনকে পেয়েছে।
মিথ্যে হলে কী করবেন?
অভিনন্দন জানাব। আমার চেয়ে যোগ্য একজন পেয়েও আমার কাছে ফিরে এসেছে তাই।
থ্যাংক ইউ ভাইয়া। ইউ আর গ্রেট। আই অ্যাপ্রিশিয়েট ইয়োর অ্যাপ্রোচ। ভাইয়া আমি কি আপনার একটা অটোগ্রাফ নেবার জন্য বাসায় আসতে পারি।
আমি তো সেলিব্রেটি নই।
তাতে কী? সেলিব্রেটির হাজব্যান্ড হওয়াও কম কিছু নয়।
১১
আরও একটি ফোন আসে, মিসেস সাবিহা হায়দার। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, অনেকটা সাক্ষাৎকারের স্টাইলে, আচ্ছা আপনি প্রথম কবে টি হায়দারের সঙ্গে আপনার স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপারটি টের পেয়েছেন?
আমি এখনও টের পাইনি। আজই পত্রিকায় এসেছে।
তা আসুক, আমি তো টের পেয়েছি সাত মাস আগে যেদিন থেকে আমার স্বামী গাঢ় নীল রঙের শার্ট পরতে শুরু করেছে।
গাঢ় নীল রঙের শার্টের সঙ্গে বুবনার কী সম্পর্ক?
আরে ধ্যাৎ, আপনি দেখছি একটা ম্যান্দামারা পুরুষ মানুষ। দুনিয়ার কোনো খবর রাখেন না। আমার হাজব্যান্ড তো ছদ্মনামে বুবনা ফ্যান ক্লাবের মেম্বার। ওখানেই কোথাও লিখা আছে বুবনার প্রিয় রং গাঢ় নীল।
আমি জিজ্ঞেস করি, তাই নাকি? আমি তো জানতাম হালকা হলুদ। রংটা বুবনা গায়ের সঙ্গে মিশে যায়। কিছুদিন আগেও তো হলুদ জামা কিনেছে।
কী মুশকিল, হলুদ তার নিজের জন্য প্রিয়। কিন্তু অন্যের পরনে গাঢ় নীল শার্ট তাকে বেশি আকর্ষণ করে। কী আশ্চর্য একসঙ্গে ঘর করেন আর এই সামান্য ব্যাপারটা জানেন না। শুনুন, আপনার স্ত্রী ফেরার পর শেকল দিয়ে বেঁধে রাখবেন। প্রয়োজনে দু’চারটা চড়-থাপ্পড়ও দিতে পারেন। আর একটা কথা- আপনার স্ত্রীর ওপর একটু নজরদারি করবেন। এটা দোষের কিছু নয়। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা- আগামী শুক্রবার বিকাল পাঁচটায় আমরা একটা জয়েন্ট প্রেস কনফারেন্স করব। বিষয়টা দেশবাসীর জানা দরকার।
জেনে দেশবাসীর কী লাভ?
তাই বলে আপনার স্ত্রী অন্যের স্বামীকে এভাবে ফুসলিয়ে নিয়ে নেবে, তার ইচ্ছেমতো গাঢ় নীল শার্ট পরাবে? আপনার প্রশ্রয় না পেলে বুবনা বিবি কী এসব নষ্টামি করে বেড়াতে পারে? বাপ-মা একটা নামও রেখেছে- বুবনা! ছি।
আপনি নিশ্চিত বলে আমাকে প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করছেন, কিন্তু আমি নিশ্চিত নই বলে একই অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারছি না।
তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, তার মানে আপনি বলতে চান আমি প্রশ্রয় দিয়েছি? টি হায়দার সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে? আমাদের বিয়ের দ্বিতীয় রাতেই সে আমার ফুপাতো বোনটাকে …।
তিনি তো তাহলে অত্যন্ত টার্গেট-ওরিয়েন্টেড মানুষ। আমি অফিসের কাজে ব্যস্ত। আপনার সঙ্গে পরে কথা বলব।
লাইন কাটতে কাটতে শুনলাম, জয়েন্ট প্রেস কনফারেন্সের বিষয়টা মনে রাখবেন ভাই। আপনি আমার ভাই, বোনের কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করবেন।
সেদিনের শেষ ফোনটি সত্যিই অপ্রত্যাশিত। অনেকদিন পর লুবনা ফোন করেছে। কোনো ভূমিকা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, নিউজটা কি সত্যি? মানে আজকের নিউজটা? সরি, বিব্রত করার জন্য দুঃখিত।
আজকের বিশ্ব সংবাদ একটিই। তবুও বলি, কিসের নিউজ?
দেখেননি? বুবনা বেস্ট চয়েসের সিইও-কে বিয়ে করছে।
তাই নাকি? খুব ইন্টারেস্টিং তো।
আপনি বলছেন, ইন্টারেস্টিং! আপনি কি পুরুষ না হিজড়া? নাকি তৌকির সুলতানের মতো গে?
আমি ধাক্কা খাই, তবু বলি, কী বললে?
না শুনে থাকলে কানের চিকিৎসা করান। আর কান ভালো থাকলে, আপনি ইম্পোটেন্ট, তারও চিকিৎসা করান।
আমি আবার বলি, লুবনা, তুমি কী বললে?
লুবনা বলল, বলেছি, আমার ফার্স্ট ক্লাসটা ফসকে গেছে। বুবনা ফিরে এলে বলবেন, আব্বু আমাদের বাড়িটা সাড়ে চার কোটি টাকায় বেঁচে দিচ্ছে। পঞ্চাশ লাখ টাকা বায়না হিসেবে নিয়ে নিয়েছে। আর আড়াই মাস পর থেকে আমরা ভাড়াবাসায় থাকব। কোন এলাকায় থাকব এখনও ঠিক হয়নি। আব্বু দিনরাত বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপন পড়ছে।
আমি বললাম, সরি লুবনা।
বুবনা প্রসঙ্গ চাপা পড়ে যায়। লুবনা বলে, ইটস অলরাইট।
এখন রাখছি বলে লুবনা নিজেই ফোনটা কেটে দেয়।
আরও একটি কথা বলতে চেয়েছিলাম- কানের হোক কি ইম্পোটেন্সি চিকিৎসা হোক, তুমি আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে?
বলা হয়নি।
সংবাদটি বুবনার নজরেও আসে।
তার আগে আমাকে যেসব কথা শুনতে হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে :
সংবাদটি বুবনা নিজেই করিয়েছে।
সংবাদটি টি হায়দার করিয়েছে।
সংবাদটি বুবনা ও টি হায়দার করিয়েছে।
সংবাদটি সাবিহা হায়দার করিয়েছে।
সংবাদটি বেস্ট চয়েসের এমডি করিয়েছে।
সংবাদটি স্বর্ণমুকুট বিজয়ী পিউ করিয়েছে।
সংবাদটি বুবনার হাজব্যান্ড রেজাই করিমই করিয়েছে।
এই সাতটি প্রতিপাদ্যের প্রত্যেকটির পেছনেই জোরালো যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে। শো বিজনেসে যারা আছে সবসময় লাইম লাইটে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। আলোর খানিকটা ঘাটতি পড়লে তারা মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মূল কাজটা হচ্ছে এমন কিছু করতে হবে যেন পেছনে সাংবাদিক ছুটে। সুতরাং এটা বুবনার একটা মিডিয়া ট্রিক্স। আর ব্যাপারটা সত্য হলে এক ঢিলে দুই পাখি মরল। লাইম লাইটে এলো এবং ছোট ব্যাংকার ছেড়ে বড় কর্পোরেটের সিইও-ও স্ত্রী হিসেবে নিজের স্ট্যাটাসও বাড়িয়ে নিল।
আসলে কাজটা করিয়েছে টি হায়দার। খবরটা বাজারে ছেড়ে প্রতিক্রিয়া দেখার বন্দোবস্ত করেছেন। বুবনার মতো সুন্দরী মডেল তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে এতে তার গ্ল্যামারও বাড়ছে। তার স্ত্রী-সাবিহাকে এতদিন যে কথাটি নিজে থেকে বলতে পারছিল না খবরের কাগজ তার হয়ে এ কঠিন কাজটা করে দিয়েছে। আর যদি বুবনার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা থেকে থাকে তাহলে পুরো দায়টা খবরের ওপর চাপিয়ে দেয়া যাবে। তখন বুবনাকে বলবেন, এখন তো সাবিহা আমাকে এমন চোখে চোখে রাখছে তোমার সঙ্গে যে কথা বলব সে সুযোগও নেই। কে যে তোমার-আমার এমন ক্ষতিটা করল।
আসলে কাটা একটা জেভি- মানে জয়েন্ট ভেনচার। দু’জন মিলেই অনেক ভেবেচিন্তে কাজ করেছে। কিছুদিন লোকজন এ খবরটা নিয়ে মেতে থাককু, ততদিনে নিজেরা একটু রোমাঞ্চ করে নেবে, আগামীর সংসার একটু গোছগাছ করে নেয়ার সুযোগ পাবে এবং বেস্ট চয়েসও আশ্বস্ত থাকবে যে নিজেদের সিইও-র স্ত্রী হওয়াতে অন্য কোনো কোম্পানি আরও বেশি টাকা দিয়ে তাকে মডেল করতে চাইলেও তার যাওয়া হবে না। তাছাড়া একজনের স্বামী ও অন্যজনের স্ত্রী আগের থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখার সুযোগ পাবে।
সংবাদটি সাবিহা হায়দারের করানো। বউ বাচ্চা রেখে এ ধরনের অবৈধ কাজে লিপ্ত হওয়া টি হায়দারের ওপর সামাজিক চাপ সৃষ্টি হবে। কোম্পানির সিইও-র অনৈতিক কাজে বেস্ট চয়েসের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ায় চেয়ারম্যান তাকে চাকরিচ্যুত করবে। চাকরিচ্যুত মানুষ নিতান্তই অর্ডিনারি মানুষ। বুবনার মতো উচ্চাভিলাষী সুন্দরী কোনো অর্ডিনারি মানুষকে বিয়ে করবে না। তখন টি হায়দারকে স্ত্রীর কাছেই ফিরতে হবে।
বেস্ট চয়েসের এমডি যখন দেখলেন তোফায়েল বুবনার স্বামী হবে, এটা শোনার পরই লাইম লাইট সিইও-র কাছে চলে গেছে তাকে একটা চরম শিক্ষা দেয়ার জন্য সংবাদটি তিনিই করিয়েছেন। উদ্দেশ্য টি হায়দারকে চাকরিচ্যুত করে বাড়ি পাঠানো, কারণ তিনি কোম্পানির নৈতিক মান নামিয়ে ফেলেছেন। তাতে বুবনারও শিক্ষা হবে, অন্যদিকে আর কোনো কোম্পানি তার প্রতি আগ্রহ হারাবে; বুবনার গাড়ি প্রত্যাহার করার হুমকি দিলে আরও কম টাকায় বেস্ট চয়েস প্রোডাক্ট প্রমোশনে চুক্তিবদ্ধ করা যাবে।
বেস্ট চয়েসের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হওয়ার কথা ছিল স্বর্ণমুকুট বিজয়ী পিউ-র। কিন্তু বুবনা তার গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। খবরটি কোম্পানির জন্য বিব্রতকর হবে এবং বুবনার ‘চরিত্রহীনতা-র প্রভাব কোম্পানির প্রোডাক্টের ওপর পড়বে, এমনকি ভালো মেয়েরা বেস্ট চয়েস সেনেটারি ন্যাপকিন ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। নেক্সট অপশন হিসেবে তারই ডাক পড়বে।
সবশেষে গাঁটের পয়সা দিয়ে খবরটি ছাপিয়েছে বুবনার স্বামী রেজাই করিম ওরফে আবদুল। বুবনা তার সংসার করুক কিংবা টি হায়দারের সংসার করুক- তার উদ্দেশ্য মেয়েটাকে খসানো। তাকে শান্ত রেখে সবকিছু সমানে চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার জন্য সে কুড়ি-পঁচিশ লাখ টাকা চাইতেই পারে। এটাই তার টার্গেট। টাকাটা হাতিয়ে নেয়ার পর তাকে আর পায় কে?
আরও একজন সন্দেহভাজনের নাম এসে যায় পুনশ্চ হিসেবে। আমিনা হক। টি হায়দারের সদ্য বিধবা সেক্রেটারি। আমিনার স্বামীর মৃত্যু বার্ধক্যজনিত নয় কিংবা অসুখবিসুখ থেকেও নয়। কে বা কারা তাকে তুলে নিয়ে যায়। সতের দিন পর তার লাশ মেলে। বসের সঙ্গে আমিনার দীর্ঘদিনের একটা সম্পর্কের কথা সবাই জানত। কিন্তু টি হায়দারের জীবনে বুবনা এসে যাওয়ায় আমিনা গুরুত্ব হারাতে থাকে। বুবনাকে সরাতেই আমিনা এ কাজটি করেছে।
১২
বুবনা এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ থেকে বের হয়েই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়। সবাই প্রকাশিত খবরের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বুবনা বলে, সংবাদ আপনারাই তৈরি করেছেন, সত্য-মিথ্যা আপনারাই ভালো জানেন, আমার কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তাও আপনাদের জানা। লিখে ফেলুন অসুবিধে নেই। আমি তো আর আপনাদের কারও বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছি না।
এ কথার পর সাংবাদিকরা আরও একবার তাকে ছেকে ধরে- তার মানে আপনি রিপোর্টটি সত্য বলে মেনে নিয়েছেন?
বুবনা এবার বলল, যা ইচ্ছে লিখুন।
আমাদের সম্পর্কে চিড় ধরেনি। বরং বাচ্চার কথা বলার পর বুবনার জন্য আমার ভালোবাসা আরও বেড়ে যায়। আমি বারবার বলতে থাকি, বুবনা প্লিজ রেস্ট নাও। নতুবা আমার বাচ্চাটার ক্ষতি হবে।
বুবনা বলে, বাচ্চাটা তোমার একার?
সরি, আমাদের।
সে রাতে আমি বুবনার পেটে অ্যান্টি-স্ট্রায়া ক্রিম মালিশ করি। পেটের সন্তান যখন বড় হতে শুরু করবে বুবনার কোমল মসৃণ পেটের ত্বকে ফাটল ধরাবে, এ গর্ভধারণ পেটে স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন রেখে যেতে চাইবে। সেই চিহ্ন যাতে মিলিয়ে যায় সে জন্যই এ ক্রিম।
দেশে ফেরার ঠিক একুশ দিন পর বুবনা রাতে ফেরেনি। রাতে না ফেরার ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু ফোনে জানিয়েছে : আজ শুটিং স্পটেই থেকে যেতে হচ্ছে। রাতে ফিরছি না। ঠিকঠাকভাবে খেয়ে নিয়ো। আমার জন্য চিন্তা করো না, রেস্টহাউসের রুমটা ভালো, যথেষ্ট সিকিউরড।
রাতে আবারও ফোন করেছে : কী খেয়েছ শুনি। আমার মনে হয় তুমি এক গ্লাস দুধ খাবার কথা ভুলে গেছে, ঠিক বলিনি?
আরও দু-একদিন না ফিরলেও আমি যে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতাম এমন নয়। আমি জানি বুবনা ফিরবেই। পাখি যেমন নীড়ে ফিরে আসে তেমনই।
এবার বুবনার কোনো ফোন আসেনি। কিংবা তার হয়ে কেউ কোনো খবরও দেয়নি।
মধ্যরাতে তার স্বরে ফোন বাজতে থাকে। আমি ভাবি বুবনার ফোন। বলবে সরি, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এত রাত যে হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। তুমি খেয়েছ কি না আগে বল?
কিন্তু ফোন করেছেন সাবিহা হায়দার। খুব চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রেজাউল করিম সাহেব, আপনার বিবি বাসায় ফিরেছেন?
কেন বলুন তো।
আমাকে বলতে হবে কেন? কাল কাগজেই বের হবে। রিপোর্টাররা কেউ আপনার সঙ্গে কথা বলেনি? একজন তো খুব চাপাচাপি করে আমার কাছ থেকে আপনার নম্বর নিল। বলল, আপনার কমেন্ট নেবে।
কিসের কমেন্ট?
ওই যে আমার হাজব্যান্ড রাতে বাসায় ফেরেনি, আপনার ওয়াইফও ফেরেনি। সন্ধ্যায় একটি কাগজের বিনোদন রিপোর্টার রাজেন্দ্রপুরের একটি শুটিং স্পটে দু’জনকেই পেয়েছে। বুবনা বিবির ইন্টারভিউও নাকি নিয়েছে। আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? আমার মনে হয় দুই সাসপেক্ট রাজেন্দ্রপুরে কোনো না কোনো রেস্ট হাউসে রাত কাটাচ্ছে। যাবেন নাকি, চলুন আজ হাতেনাতে ধরি। আমি ফোন লাগিয়ে দিয়েছি, খবর পেয়ে যাব। আপনার ঠিকানা বলুন, যত রাতই হোক আমি আপনাকে তুলে নেব।
আমি বললাম, সারা দিন অফিসের কাজ করে আমি খুব ক্লান্ত। না ঘুমোলে কালকের দিনটা মাটি হয়ে যাবে। অনুগ্রহ আপনিই যান।
নিজের স্ত্রীর মান-সম্মানের চেয়ে আপনার ঘুম বড় হয়ে গেল? আপনি কি পুরুষ মানুষ নাকি অন্য কিছু? নিজের স্ত্রীকে বড় মানুষদের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে তাদের টাকায় মোজ করছেন। একচুয়ালি আপনিই হচ্ছেন আসল ক্রিমিনাল। আমি কালই আপনার বিরুদ্ধে কেইস ফাইল করব, আপনি নিজের ঘরের বেশ্যাটাকে লেলিয়ে দিয়ে অন্যের সংসার ভাঙছেন।
জি আমি ফোন রাখছি। গুড নাইট।
ফোন রাখতে পারেন, কিন্তু মনে রাখবেন, কাল খুব ভোরে পুলিশ এসে আপনাকে বলবে, গুড মর্নিং।
পরদিন আমাকে গুড মর্নিং বলতে কোনো পুলিশ চোখে পড়েনি। বুবনাকে নিয়ে গরম রিপোর্ট ছাপা হয়েছে প্রায় সবগুলো বড় পত্রিকায়।
খোলামেলা সাক্ষাৎকারে বুবনা বলেছে : অশ্লীল ছায়াছবির কাছে ভালো ছায়াছবি মার খাচ্ছে তিনি তা বিশ্বাস করেন না। ভালো ছবির প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে সামনে আসার শক্তি থাকতে হবে। নতুবা তা ভালো ছবি নয়।
অশ্লীলতার সমস্যাকে তিনি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, কাজটা আপনি করতে পারলে দারুণ চমৎকার, অন্য কেউ করলেই তা অশ্লীল। শিল্পসম্মতভাবে বিষয়টির প্রকাশ ঘটল কিনা তাই দেখা জরুরি।
পরদিনই ফোন পাই চট্টগ্রামের এক ব্র্যাঞ্চের বন্ধুটির। বলে, তুমি তো ভাই চাইলেই রক্তমাংসের মানুষটিকে যেভাবে ইচ্ছা দেখতে পার, আমাদের ভাগ্য ভার্চুয়াল বুবনা। এখন বল, কোন ছবিতে তিনি…।
বুবনার সাক্ষাৎকারের বাক্য টেনে জবাব দিই, যে ছবিতে চরিত্র তাকে ওভাবে চাইবে।
বন্ধুটি বলল, তুমি দোস্ত ভাগ্যবান।
১৩
বিনোদন পাতা লাল হরফে ছেপেছে : বুবনার নগ্ন হতে আপত্তি নেই। তার এই সাহসী বক্তব্য নিয়ে মন্তব্য করতে বলা হলে ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের একজন সদস্য বলেন, বুবনা কাপড় যতটুকু ইচ্ছে খুলতে পারেন, কিন্তু সেন্সরের কাঁচি আমাদের হাতে। বুবনার ভক্তদের তার দেহের কতটুকু দেখতে দেয়া হবে আমরাই তা ঠিক করব।
সে রাতেও বুবনা ফেরেনি, কোনো ফোনও পাইনি। পরদিন এগারটার দিকে বেস্ট চয়েসের হেড অব ইভেন্টস ফোন করে বললেন, বিকাল চারটায় শেরাটনের বলরুমে বেস্ট চয়েসের পাঁচটি প্রোডাক্ট আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। প্রোডাক্টগুলো হচ্ছে বেস্ট চয়েস বুবনা টামি ট্রিমিং বেল্ট, বেস্ট চয়েস অলিভ পিকল, বেস্ট চয়েস কমফোর্ট ব্রা, বেস্ট চয়েস বেবি কিটস এবং বেস্ট জয়েস হট ওয়াটার ব্যাগ। এই প্রথম মডেলের নাম কোম্পানি প্রোডাক্টের গায়ে এসেছে। খুব বড় প্রোগ্রাম হবে। বুবনা আমাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর- এটা তারই অনুষ্ঠান, তার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে পারছি না। ফোন ধরছেন না। আপনি ছাড়া আর কোনো কন্টাক্টও আমাদের জানা নেই। বুবনা না থাকলে কোম্পানির ক্ষতি হবে। অনুগ্রহ করে এখনই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলুন। চাইলে বিকালের অনুষ্ঠানে আপনিও আসতে পারেন।
আমি বললাম, যোগাযোগ হলে অবশ্যই বলব। কিন্তু বুবনা যে গত পরশু রাতে বাড়ি ফেরেনি, গত রাতেও না।
তিনি বললেন, কী আশ্চর্য, তাহলে তিনি এখন কোথায়?
আমি বললাম, আমারও একই প্রশ্ন। আমার আগে খোঁজ পেলে অনুগ্রহ করে জানাবেন, আফটার অল আমার স্ত্রী তো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আর একটা ফোন। ইচ্ছে করলে নাও ধরতে পারি। কিন্তু ফোনটা যদি বুবনার হয়!
ফোন করলেন ফিল্ম ডিরেক্টর সাজ্জাদ খান। ধমকের স্বরে বললেন, সেট রেডি। সবাই এসে গেছে। কিন্তু বুবনা কোথায়?
তা তো জানি না।
আপনি বুবনার হাজব্যান্ড। বুবনা কোথায় আপনি জানেন না তো কে জানে?
দু’দিন ধরে নেই।
পুলিশকে জানিয়েছেন?
জি না। তিনি বললেন, আরে ভাই তাড়াতাড়ি জানান। সুন্দরী মহিলার হাজব্যান্ড হওয়া শুরুতে যত মজারই হোক আখেরে বড্ড ঝামেলার। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে আমাদের নায়িকা তাপসী ইঁদুর মারার ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করল। ছেলের সঙ্গে জোট বেঁধে মা-মেয়েকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে- এই হচ্ছে মূল বিষয়। মামলায় ফেঁসে গেল তাপসীর স্বামী ফয়সাল। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল হল ফয়সালের ফাঁসি চাই। ফয়সাল নাকি তাপসীকে মেরে মুখে ইঁদুরের বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। পুরো এক বছর জেলে থেকে বেচারা সুন্দরী নায়িকার স্বামী আমাদের ইন্ডাস্ট্রির একটি মেধাবী ছেলে ফয়সালের কেরিয়ারটা শেষ হল। এখন অল্পবয়সে মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ায়। সুন্দরী মহিলাদের কিছু হলে স্বামীই ফার্স্ট ভিকটিম। তাড়াতড়ি থানায় যান পুলিশের খাতায় অন্তত একটা জিডি করিয়ে রাখেন।
তিনি ফোন রেখে দিলেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমিও ফেঁসে গেছি। মনে হচ্ছে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে যথেষ্ট নির্যাতন করার পরও সন্তুষ্ট হচ্ছে না। আরও নির্যাতনের জন্য পুনরায় সাত দিনে রিমান্ড চেয়েছে। পুলিশ বারবার একটাই প্রশ্ন করছে : ডেডবডি কোথায় লুকিয়েছিস, বল হারামজাদা। নতুবা পাছার ছাল তুলে বাটা মরিচ লেপ্টে দেব।
দৃশ্যগুলো একের পর এক আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখছে।
১৪
বুবনাবিহীন তৃতীয় রাত পার হল। পরদিন সকালের একটি বাংলা কাগজ প্রথম পাতায় তিন কলাম বক্স নিউজ করেছে : বুবনার অন্তর্ধান রহস্য : পুলিশ নির্বিকার। সংবাদের ভেতরে অদ্ভুত সব কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে এক মাফিয়াডনের সঙ্গে বুবনার যোগাযোগের এটি সূত্র পাওয়া গেছে। বুবনা ও টি হায়দার একসঙ্গে অন্তর্হিত হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে এ ঘটনার পেছনে বুবনার স্বামী রেজাই করিমের হাত রয়েছে বলে টি হায়দারের স্ত্রী সাবিনা হায়দার পুলিশকে জানিয়েছেন। রেজাই করিমকে রিমান্ডে নিয়ে ভালো করে চাপ দিলে সব কথা বেরিয়ে আসবে বলে তিনি আশা করেন।
পঞ্চম দিন : বেস্ট চয়েস গ্রুপের পক্ষ থেকে সিইও টি হায়দার ও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বুবনা করিমের নিরুদ্দিষ্ট হওয়া নিয়ে থানায় জিডি করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে পুলিশ সক্রিয় হচ্ছে।
ষষ্ঠ দিন : স্ত্রীর সন্ধান পেতে রেজাই করিমের একান্ত আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বেস্ট চয়েস কিউ টিভি সুন্দরী প্রতিযোগিতার স্বর্ণমুকুট বিজয়ী পিউ রেজাই করিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ব্যক্তিগত সমবেদনা জানিয়েছে।
সপ্তম দিন : বাংলাদেশ অভিনেত্রী সংসদ সংবাদ সম্মেলন করে বুবনা উদ্ধারে কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। দলমত নির্বিশেষে দেশের সব সেরা নায়িকা ও মডেল এতে যোগ দিয়েছেন।
মডেল পিউর ব্যক্তিগতভাবে সহানুভূতি জ্ঞাপনকে মিডিয়া স্বাগত জানিয়েছে এবং এখান থেকে রাজনীতিবিদদের শিক্ষা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে।
অষ্টম দিন : বুবনার স্বামী রেজাই করিমকে পুলিশের তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ, কোনো ক্লু পেয়েছে বলে জানা যায়নি।
বেস্ট চয়েস গ্রুপ তাদের সিইও টি হায়দার এবং ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বুবনা করিমকে বরখাস্ত করেছে। তাদের সঙ্গে কেউ কোনো লেনদেন করলে অবশ্যই ব্যক্তিগত দায়িত্বে করবেন। বেস্ট চয়েস গ্রুপ কোনো দায়ভার গ্রহণ করবে না।
দশম দিন : বেস্ট চয়েস গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, চিত্রনায়িকা ঝুমকা শেহেরজাদ এবং বুবনার স্বামী রেজাই করিম গ্রেফতার। খবরে বলা হয় বুবনা শুরুতে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দিকে ঝুঁকলেও পরে টি হায়দারের দিকে মনোনিবেশ করে। ব্যক্তিগত ঈর্ষা থেকে তানভির মওলা এ কাজ করতে পারেন বলে একজন অপরাধ বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন।
তারিক আলীর পরবর্তী ছবি পাতালপুরীতে প্রেমের জন্য ঝুমকা শেহেরজাদই নয়িকা নির্বাচতি হয়েছিলেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে তারিক আলী ঝুমকার জায়গায় বুবনাকে নেয়ার কথা জানালে ঝুমকা বুবনার ওপর শারীরিকভাবে চড়াও হয়। তার পক্ষে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব। সন্ধ্যা নাগাদ তানভির মওলা ও ঝুমকা শেহেরজাদকে থানা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়।
ফ্রায়েড রাইস, ফ্রায়েড চিকেন এবং ৫০০ এমএল পেপসির বোতল নিয়ে থানা হাজতে এল লুবনা। বুবনা ফিরে এসেছে মনে করে সাংবাদিকরাও পিছু নিল। ওসি সাহেব বাসায় চলে গিয়েছিলেন। বুবনা তার স্বামীকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছে শুনে বুবনাকে উদ্ধারের কৃতিত্ব দাবি করার পরিকল্পনা নিয়ে থানায় ফিরে আসেন।
লুবনা আমাকে বলেছে, চিন্তা করার দরকার নেই।
সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। পৌনে বারটার দিকে পুলিশের জিপ আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বলে, তদন্তে সহযোগিতা না করলে নেক্সট টাইম যেই তদবির করুক আমরা কিন্তু হেল্পলেস হয়ে পড়ব। আপনি যে অনেক বিষয় লুকোচ্ছেন এটা আমরা নিশ্চিত।
একাদশ দিন : সীমান্ত চৌকি ও কুর্মিটোলা এয়ারপোর্টকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে বুবনা ও টি হায়দার যেন দেশ ছাড়তে না পারেন।
সাহিবা হায়দার সম্ভাব্য সব স্থানে স্বামীকে খুঁজতে খুঁজতে জানতে পারেন শীতলক্ষ্যায়… লাশ ভাসছে। তার রক্তচাপ বেড়ে যায়। এক সময় তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তাকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
১৫
ফ্যান ক্লাব বুবনাকে ফিরে পাওয়ার জন্য প্রেস ক্লাবে চারজন করে আমরণ অনশন শুরু করেছে। নিজেদের সুবিধার জন্য সদস্যরা চারজন করে পালাক্রমে অনশন করে যাচ্ছে।
বুবনা ফ্যান ক্লাবের একজন নারী সদস্য অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নিতে হয়। জ্ঞান ফিরলেই সাঁঝ নামের এই ফ্যান চেঁচিয়ে বলে, কুদরত মল্লিক বেস্ট চয়েস গ্র“প ও এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের ওপর অপমাণের প্রতিশোধ নিতে টি হায়দার ও বুবনাকে অপহরণ করেছে। এতদিন তারা জীবিত আছে কি না এ নিয়ে তার সন্দেহ রয়েছে। পুলিশ তখনই তাকে হাসপাতালে তুলে নিয়ে একেবারে নিশ্চুপ থাকার নির্দেশ দিয়ে বাসায় রেখে আসে।
রাতের বেলা পরিচালক সাজ্জাদ খান বাসায় এসে পাঁচ লাখ টাকা চাইলেন। বুবনাকে বায়না হিসেবে দেয়া হয়েছিল। বুবনা এক পয়সার কাজও করেনি বরং তার অনুপস্থিতিতে এর মধ্যে দশ লাখ টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে।
বললেন, আমি ক্ষতিপূরণ চাচ্ছি না। নগদ যে টাকাটা দিয়েছিলাম তাই ফেরত দিন। আমি কোনো ঝামেলায় যেতে চাচ্ছি না।
বললাম, বুবনাকে দিয়েছেন তার কাছ থেকে আদায় করুন। আমাকে কেন বিব্রত করছেন?
তিনি বললেন, এতগুলো যোগ্য পাত্রকে ধোঁকা দিয়ে বুবনাকে বাগিয়ে নিলেন, তার কোনো দায় নেবেন না? তাহলে হাজব্যান্ড হতে গেলেন কেন?
সাজ্জাদ খানের হাত থেকে বাঁচার জন্য বলি, আমারও পাঁচ লাখ নিয়েছে। আপনিই বলুন কেমন করে আদায় করব?
মনে মনে বলি বুবনা আমার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে। বুবনার পেটে আমার বাচ্চা। বাচ্চার দাম কোটি টাকা।
সাজ্জাদ খান হুমকি দিলেন, সাত দিনের মধ্যে টাকা না দিলে আমাকে ঘাড় ধরে এ ফ্ল্যাট থেকে বের করে ফ্ল্যাট দখল করবেন।
চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে দু-একজন মাস্তান হতেই পারেন। তাকে দিয়ে তো আর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিজের অন্যদের মাপলে চলবে না। সাবধানের মার নেই। তাড়াতাড়ি করে ধানমণ্ডি থানায় তার নামে একটা জিডি করতে গেলাম। কাজ তো হলই না, উল্টো আমাকে পেয়ে একজন ইন্সপেক্টর যুগল অপহরণ বা যুগল হত্যাকাণ্ডের আসামি বানিয়ে জেরা করতে শুরু করলেন।
১৬
আমি সম্ভবত লুবনার ফোনই প্রত্যাশা করছিলাম। পেলামও।
লুবনা বলল, বুবনার সঙ্গে ফোনে তার অনেকক্ষণ কথা হয়েছে।
সে আলাপের সারাংশ : বেস্ট চয়েসের মার্কেটিং বিভাগর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার এফ ইমাম হায়ার স্টাডিজে আমেরিকার সাউথ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটিতে আসা পাকাপাকি হয়েছিল। আর বুবনার পাসপোর্টে এক বছরের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা লাগানোই ছিল। ফখরুল যখন গর্ভবতী বুবনার সন্তানের পিতৃত্বের দায় নিতে স্বীকার করল, বুবনা আর বাসায় ফেরেনি। প্রথম যে রাতে বাড়ি ফেরেনি, সে রাতের শেষ প্রহরে বুবনা ইমিগ্রেশন পেরিয়ে গেল। আকাশপথে।
বুবনা যে আবদুলকে বলে যেতে পারেনি এ জন্য লুবনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে। আরও বলেছে, আমি আবদুলকে ফোন করার সাহস পাচ্ছি না।
আমি লুবনাকে বলি, আমাকে জানিয়ে খুব ভালো করেছ। আমি বুবনার জন্য ভেতরে ভেতরে খুব টেনশন করছিলাম। বুবনা যে বেঁচে আছে, সুস্থ আছে আমি তাতেই অনেক খুশি।
লুবনা ধিক্কারের ভাষায় আমাকে বলল, আপনার খুশির বাহার দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়। অবশ্য বুবনা বলেছে দেশে থাকলে যে কোনো দিন খুন হয়ে যেত কিংবা খুনের মামলায় ফেঁসে ক্যারিয়ারটা শেষ হয়ে যেত।
কোন খুন?
তাতো বলেনি।
আমি বললাম, জীবন বাঁচাতে গিয়ে বুবনা ঠিক কাজটিই করেছে। লুবনা জিজ্ঞেস করল, তাহলে এফ ইমামের সঙ্গে কেন?
আমি বললাম, বিপদে পড়া মানুষ খড়কুটো যা পায় তাই আঁকড়ে ধরে, ভাগ্যিস সময়মতো এফ ইমামকে পেয়েছিল।
এসব ব্যাখ্যা আমাকে আর শোনাতে হবে না।
আমি জিজ্ঞেস করি, বাবা কি খুব আপসেট?
লুবনা বলল, তাতে আপনার কী দরকার? আব্বু পাগল হয়ে গেছে। এক মাস ধরে ডাক্তার হেদায়েতউল্লার ডাবল-লকড ক্লিনিকে আছে। বুবনা আছে না নেই এসব বোঝার মতো মানসিক অবস্থা তার নেই। আব্বু কিছুক্ষণ পরপর নিজের আঙুল বন্দুকের নল বানিয়ে বলতে থাকে ফায়ার ফায়ার কিল দেম অল, ট্যাট ট্যাট ট্যাট, কখনও কখনও ভারি গলায় ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে ওঠে, হল্ট।
লুবনা একটু দম নিয়ে বলে, বুবনা কেটে পড়ে ভালোই করেছে, এখন এ পাগল সামলাতে হবে আমাকে। প্রতিদিন কেবিনের ভাড়াই সাড়ে তিন হাজার টাকা আর সব খরচ তো রয়েছেই। বাবা বাড়ি বেচতে পেরেছে কিনা জানি না, ব্যাংক থেকে নোটিশ এসেছে, এ বাড়ি আগে থেকেই বন্ধক দেয়া। এর মধ্যে নতুন এক আপদ এসে হাজির হয়েছে। ইমরুল কায়েস নামের একটি পাগলাটে কিশোরকে নিয়ে মায়মুনা নামের এক মহিলা এসেছে, বাড়ি ছাড়ছে না। জোর গলায় দাবি করছে ইমরুল কায়েস কর্নেল সাহেবেরই ছেলে। কেমন করে কীভাবে কর্নেল সাহেবের ছেলে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার সাহসও পাচ্ছি না। ছেলেটার মুখের গড়ন অনেকটা আব্বুর মতোই। আর তো কেউ নেই, আমি কেমন করে সামলাব বলুন।
আমি বলি, আই অ্যাম সো সরি।
লুবনা বলল, আমি যদি সরি বলে দায়িত্বটা এড়াতে পারতাম।
১৭
ভোর পাঁচটার দিকে দরজায় সজোর আঘাত আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। খুলতে বাধ্য হই এবং আমাকে বলা হয় টি হায়দার খুনের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা ছিল। সুতরাং আমাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
এবার আমি লুবনাকে জানানোরও সুযোগ পেলাম না।
স্বীকারোক্তি আদায় যান্ত্রিকভাবে করায় সবার একই উত্তর বেরিয়ে এসেছে। অষ্টম দিন যখন আমার জামিনের শুনানি চলছিল লুবনার নিয়োগ করা আমার পক্ষের ব্যারিস্টার সাহেব হুবহু একই ধরনের স্বীকারোক্তির অযৌক্তিকতা আদালতকে দেখিয়ে আমার জন্য জামিন করিয়ে নিতে সমর্থ হন।
টি হায়দার হত্যাকাণ্ড ক্রমেই গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। নতুন নতুন হত্যাযজ্ঞ ও গুম এসে আগেরগুলোকে ম্লান করে দেয়। পুলিশ যখন জেনে যায় বুবনা আমাকে ছেড়ে এফ ইমামের সঙ্গে সাউথ ক্যারোলিনায় বসবাস করছে, বুবনার স্বামী হিসেবে আমার যে গুরুত্ব ছিল, তা মাটিতে মিশে যায়।
কর্নেল নুরুস সাফা ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফিরেছেন। তাকে চব্বিশ ঘণ্টা দেখভাল করার জন্য দু’জন কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে। দু’লাখ টাকা মায়মুনার হাতে তুলে দিয়ে লুবনা এ যাত্রা ঝামেলা থেকে ছাড়া পায়।
লুবনার সঙ্গে কথা বলেই একদিন কর্নেল সাফাকে দেখতে যাই।
তিনি বিছানায় শুয়েছিলেন।
বুবনা ও লুবনার মতো আমিও ডাক দিই, আব্বু।
তিনি বিছানায় উঠে বসেন,
আব্বু উত্তেজিত হয়ে পড়ছে, একটু পরই ফায়ারিং শুরু করবে। ডাক্তার বলেছেন, বেশি উত্তেজিত হলে কলাপস করতে পারে।
আমি লুবনাকে বলি, যে ফ্লাটে আমি থাকছি, এটা তো আসলে বুবনার। বাড়ি ভাড়া না খুঁজে আব্বুকে নিয়ে ওখানে ওঠো। আমি অফিসের কাছাকাছি কোথাও এক রুম নিয়ে থাকব। পেয়িং গেস্ট থাকার একটা সুযোগও আছে। আমার সমস্যা হবে না।
লুবনা বলল, মাহাত্ম্য দেখাচ্ছেন? ওই ফ্লাটে আমাদের কোনো রাইট নেই।
আমি বুবনার ফ্ল্যাট লুবনাদের ফিরিয়ে দেব, লুবনা করুণার দান নেবে না- এ ধরনের দরকষাকষির মধ্যে একদিন লুবনা ফোনে জানাল, আব্বুর গ্যাস্পিং শুরু হয়েছে। এক্ষণি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসুন।
কর্নেল সাফার অসুস্থতা লুবনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। লুবনা কিছু কিছু ভার আমাকেও বহন করার সুযোগ দিচ্ছে, আমি যে নির্ভরযোগ্য লুবনার সে আস্থাও কিছুটা অর্জন করতে পেরেছি।
অ্যাম্বুলেন্সের দু’জন অ্যাটেনডেন্ট তাকে টেনে তুলল। সাইরেন বাজিয়ে উল্টোপথে গাড়ি চালিয়ে চলে এলো হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। ডিউটি ডাক্তার স্টেথো লাগিয়ে হার্টবিট শুনতে চেষ্টা করলেন। নাড়ি টিপলেন, চোখের ওপর টর্চের ছুঁচালো আলো ফেললেন। লুবনা ও আমি পরস্পরের দিকে কিচুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কি ঘটেছে সম্ভবত আমরা বুঝে গেছি।
ডাক্তার তখনও বলেননি, নেই।
লুবনা হঠাৎ আব্বু বলে চিৎকার করে উঠল, সম্ভবত একটি অবলম্বনের প্রত্যাশায় আমাকে জড়িয়ে ধরল।
কর্নেলকে তারই মেয়ের কেনা ফ্লাটে তোলার মতো মাহাত্ম্য দেখানোর সুযোগ শেষ পর্যন্ত তিনি আমাকে দেননি।
দাফন সেরে যখন ফিরে আসি লুবনা ঘুমিয়ে। কর্নেল সাফাকে দেখাশোনা করার জন্য যে দু’জনকে নিয়োগ করা হয়েছিল তারা অপেক্ষা করছে, পুরো মাসের টাকা দিয়ে দিন, চলে যাই।
আমি অপেক্ষা করতে থাকি, লুবনা জেগে উঠুক। খবরটা বুবনাকে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু নম্বর জানা নেই। লুবনাকে বললাম, বুবনা না তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিল?
বলেছিল সম্ভবত টেলিফোন পাবলিক বুথ থেকে।
কর্নেল সাফা শেষ বয়সে একেবারে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যু সংবাদ দু’চারজনকে জানানো হয়েছে, দু-একজন লাশ দেখতে এসেছেন।
ঘুমভাঙা লুবনা বিছানার ওপর উঠে বসে। আমাকে ডেকে পাশে বসায়। জিজ্ঞেস করে, এখন কী হবে?
আমি বললাম, ভেবো না।
লুবনা বলল, আমার আর কেউ রইল না। আপনিও আমাকে একা ফেলে চলে যাবেন।
আমি বললাম, তোমাকে একা ফেলে যাব না। সঙ্গে নিয়ে যাব। ঘর তালা মেরে দাও। এই বাড়ির ব্যাপারটা আস্তে আস্তে সামলানো যাবে।
আমি ভেবেছিলাম লুবনা বলবে, আপনার সঙ্গে যাব না।
কিন্তু তা করেনি, বলেছে আজকের রাতটা এ বাড়িতে থাকুন। কাল আপনার সঙ্গে চলে যাব।
আমি কিছু খাবার কিনে আনি। ফিরে দেখি লুবনা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি টিভি চ্যানেল সার্ফ করতে থাকি। লুবনা হঠাৎ আব্বু বলে একটি তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠে। তারপর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করে।
১৮
বুবনা চলে যাওয়ার পর এ ফ্লাটে আর সুন্দরের ছোঁয়া লাগেনি। লুবনাকে কোনোভাবে ফ্লাটে ঢুকিয়ে দিয়ে আমি অফিসে ছুটি। গ্রেফতার হওয়ার পর আমাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল। আমি কোর্টের আশ্রয় নিলে পুলিশই প্রতিবেদন দিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রেজাই করিমের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো সংস্রবের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ব্যাংক আমাকে আবার নিয়ে নেয়। ততদিন বুবনার দেশ ছাড়ার কাহিনী আমার সহকর্মীরা জেনে গেছে। আমাকে নিয়ে অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছে, আহ বেচারা রেজাই করিম!
সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসি আমার ঘর তখন নতুন সাজে সেজেছে।
লুবনা বলল, আমাকে বিয়ে করুন।
আমি বললাম, আচ্ছা। আমিও একই কথা বলতে চেয়েছিলাম।
তাহলে বলেননি কেন?
সাহস পাইনি।
আমার আর লুবনার দাম্পত্য সম্পর্কের একুশ বছর পূর্ণ হয়েছে। লুবনার সচেতন সিদ্ধান্ত- চাকরি-বাকরি কিছুই করবে না, বাসা থেকে তেমন বেরও হবে না, হাউস ওয়াইফ হিসেবে জীবন কাটিয়ে দেবে, সন্তান লালন-পালন করবে।
আমি ব্যাংকিং ডিপ্লোমায় ফার্স্ট হয়েছি, এমবিএতে ভালো রেজাল্ট হয়েছে। ব্যাংকার হিসেবেও বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছি।
দু-একবার চাকরি বদলের পর আমি এখন ফিনিক্স ব্যাংকের ডিএমডি- ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আমাদের একজোড়া জমজ কন্যাসন্তান। আইডেন্টিক্যাল টুইন।
লীলাবতী ও কঙ্কাবতী, উনিশ বছর ছ’মাস তাদের বয়স। দু’জনই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সে ভর্তি হয়েছে।
লুবনা বলল, কেন যে মেয়েদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করালে। তুমি রাজি থাকলে তো বুবনার কাছেই পাঠিয়ে দিতে পারতাম।
লীলাবতী চঞ্চল নামের একটি ছেলের প্রেমে পড়েছে। লুবনার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে চঞ্চলের বাবা কে তা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। মা বেস্ট চয়েস কিউ ফিল্মস জাতীয় সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সোনার মুকুট বিজয়ী পিউ মল্লিক। কুদরত মল্লিক মোটেও তার স্বামী নয়, কুদরতের ছেলে রাহাত মল্লিক যখন পিউকে বিয়ে করে তার গর্ভাবস্থার পাঁচ মাস চলছে। চঞ্চল দেখতে ভালো এবং মেধাবী এ বিবেচনায় তার জন্মবৃত্তান্ত গবেষণা আর এগোয় না। লীলাবতী গান গায়, নাটক করে। কঙ্কাবতী শুধু পড়াশোনা। লীলাবতীর এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ তাকে লাইমলাইটে রাখে। কেউ কেউ কঙ্কাবতীকে বলে বা বেশ ভালোই তো গাইলে। কিন্তু কঙ্কা তো গান গায় না।
এক সময় কঙ্কাবতী ক্ষেপে যায়। লীলাবতীর প্রাপ্য প্রশংসার ভার তাকে কেন বহন করতে হবে? লীলা একই রকম পোশাক পরা ছেড়ে দেয়। কালো ও মোটা ফ্রেমের চশমা নেয়, ওড়নায় মাথা ঢাকে।
আমি কিছু বলিনি। তবুও কঙ্কা আমাকে বলে, বাবা আমি কঙ্কাবতী হয়ে বাঁচতে চাই।
লুবনা ফিসফিস করে বলে, মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?
লীলাবতী এসে বলল, কঙ্কা তাকে হিজাব পরার জন্য চাপ দিচ্ছে, নতুবা তার সঙ্গে ক্লাসে যাবে না।
লুবনা প্রথম দিনের বিবাদ মিটিয়ে দু’জনকে নিয়ে গেল। কঙ্কাবতী বোরকা ঢাকা, চিবুকের ওপর থেকে কপালের নিচ পর্যন্ত গাঢ় দুধেল রঙের মানুষটিকে দেখা যায়। কঙ্কার হাসি হৃদয় গলিয়ে দেয়।
সেকেন্ড ইয়ারে উঠতেই কঙ্কা বলে বসল, হলে থাকবে। প্রভোস্ট ম্যাডাম কথা দিয়েছেন, আপাতত ডাবলিং করতে হলেও মাস দুয়েকের মধ্যেই বেড পেয়ে যাবে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাসায় খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হচ্ছে?
কঙ্কা বলল, না বাবা,
লীলাবতী মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। সফল হয়নি। ওয়াশ করিয়ে আনা হয়েছে। চঞ্চল নামের ছেলেটি তাকে বিট্রে করে এখন কঙ্কাবতীর পেছন পেছন ঘুরছে বলে লীলার অভিযোগ।
লীলাবতী হলে থাকে। বৃহস্পতি ও শুক্রবার দু’রাত বাসায় থাকে। যেটুকু না করলেই নয় এর বেশি খরচ করে না।
১৯
অফিসে লেডি গেস্ট আশা নিষেধ নয়। মহিলারাও আমাদের ভ্যালুড ক্লায়েন্ট। আমাদের ব্যাংকে সঞ্চয়ী আমানতের তেতাল্লিশ ভাগই মহিলাদের অ্যাকাউন্টে জমা। সাক্ষাৎ প্রার্থী ভদ্র মহিলা অ্যাপয়েনমেন্ট স্লিপে নিজের নাম লিখেছেন বুবনা ইমাম। সাক্ষাতের উদ্দেশ্য : ব্যক্তিগত।
আমি কিছুক্ষণ থ হয়ে বসে থাকি।
যুগল অপহরণ কিংবা যুগল নিরুদ্দেশ কিংবা যুগল হত্যাকাণ্ড থেকে বুবনার নাম এক সময় খসে পড়ে। রয়ে যায় কেবল টি হায়দার।
মাঝে মাঝে বিনোদন পাড়ায় খবর বের হতো : ম্যাডিসন স্কোয়ারে বুবনাকে দেখা গেছে। ডিপার্টমেন্ট স্টোরে বিতর্কিত মডেল বুবনা। খুনের মামলার সন্দেহভাজন আসামি বুবনা মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়েছেন।
এ রকম অন্তত এক কুড়ি শিরোনাম বিভিন্ন সময় আমার নজরে এসেছে। লুবনাও নিশ্চয়ই দেখেছে। তবে এ নিয়ে আমরা কোনো কথা বলিনি।
এফ. ইমামের স্ত্রী বুবনা ইমাম। বুবনা নামের আর কেউ পৃথিবীতে আছে কি না আমার জানা নেই।
যখন বুবনাকে ভেতরে নিয়ে আসার কথা বললাম, খুব গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি মনে হল তা হচ্ছে- বুবনা নিশ্চয়ই আজই তার অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়ার নোটিশ দেবে।
কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলি, বসো, কবে এলে?
আজই, খুবই ভোরে। এফ. ইমামের ডেডবডি আসছে। পরশু বেলা এগারটায় ঢাকায় নামবে। এখন খুব রাশ যাচ্ছে। একসঙ্গে কার্গোতে কফিনের স্পেস আর প্লেনে আমাদের দুটো সিট মেলাতে পারছিলাম না। তোমার মেয়ে চন্দ্রাবতী বলল, মা তুমি আগে গিয়ে সব ব্যবস্থা কর, আমি কফিনের সঙ্গে আসছি। আমি তাই চলে এলাম।
আমার মেয়ে! আমি বিড়বিড় করি। কী নাম বললে? চন্দ্রাবতী!
আমার চোখে মুখে বিস্ময়।
চন্দ্রাবতী মানে আমার মেয়ে এখন কী করে?
চন্দ্রাবতী তোমার মতো ব্যাংকার। দেখতেও তোমার মতো?
তার মানে কালো? সুন্দর নয়।
অবশ্যই সুন্দর।
এফ. ইমামের কী হয়েছিল।
তেমন কিছু হয়নি।
কোথায় উঠেছ?
শ্বশুরবাড়িতে।
সরাসরি তোমার অ্যাপার্টমেন্টে উঠলেই পারতে। ঠিক আগের জায়গাতেই আছে।
এফ. ইমামের বুড়ো বাবা অতি ভোরে আমাকে আনতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গেই এসেছি। এফ. ইমামের বুড়ো বাপ ছাড়া আর কেউ নেই। ছেলের লাশ আনতে গিয়ে বুড়ো বাপ যদি জ্ঞান হারায় আমি সামাল দিতে পারব না। পরশু দিন কফিন রিসিভ করা থেকে শুরু করে কবর দেয়া পর্যন্ত এটুকু সময় যদি আমার পাশে থাকতে সাহস পেতাম।
কিন্তু পরশু মানে বৃহস্পতিবার তো ওয়ার্কিং ডে।
লাশটা যদি এফ. ইমামের না হয়ে তোমার আপন কারও হতো, তখনও একই কথা বলতে?
ঠিক আছে, দেখা যাক, ব্যবস্থা করব।
পিয়নটা ব্ল্যাক কফি দিয়ে যায়।
তাকে জিজ্ঞেস করি তুমি কিছু খাবে? পাশেই স্যান্ডউইচ, বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এসব পাওয়া যায়।
বুবনা বলল, নো থ্যাংক ইউ, আমি খেয়েই বের হয়েছি। তোমাদের ওয়েবসাইট থেকে তোমার নাম পদবি আর অফিসের ঠিকানা পেয়ে গেলাম। ব্যাংকের নামটা মনে ছিল।
আমি বললাম, এসে ভালো করেছ। তোমার অ্যাপার্টমেন্ট তোমাকে বুঝিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হই। এত দামি অ্যাপার্টমেন্ট- যাওয়ার আগে বেচে দিতে পারতে কিংবা ভাড়া দিয়ে যেতে পারতে।
বুবনা বলল, কত দামি? আমি তোমার যে বাচ্চা নিয়ে পালিয়েছি তার চেয়েও বেশি দাম ওটার। আবদুল, তোমার চন্দ্রাবতীর দাম বিলিয়ন ডলার। তুমি তো চন্দ্রকে দেখোনি? এত বছরে একবারও কি আমেরিকা যাওনি?
তিনবার গিয়েছি। প্রথমবার সেমিনারে, দ্বিতীয়বার ওয়াশিংটনে আর গতবার বোস্টনে।
একবার নিউইয়র্কের একটি পত্রিকায় তোমার ছবি দেখেছিলাম।
তুমি নিশ্চয়ই বিখ্যাত মানুষ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, চন্দ্রাবতী কি আমার কথা জানে?
কখনও বলিনি, ভয়ে।
কীসের ভয়?
যদি তোমার খোঁজে চলে আসে, আর কখনও আমার কাছে না ফেরে। ঠিকই করেছ, বলার দরকার নেই। চন্দ্রাবতী তোমার কাছেই থাকুক। চন্দ্রর বেড়ে ওঠায় আমার কোনো ভূমিকা নেই। চন্দ্র তোমার কাছেই থাকুক।
জিএম (অ্যাডমিন) জরুরি কথা বলার জন্য বাইরে বসে আছে। সাতটায় বোর্ড মিটিং। আমার ঘড়ি দেখা বুবনাকে মনে করিয়ে দেয়, এখন উঠতে হবে, এটা অফিস।
বুবনা বলল, তোমার সঙ্গে আমার এয়ারপোর্টে দেখা হচ্ছে। পরশু ঠিক এগারটায়। কার্গোতে চলে এসো। কফিন ওইদিক দিয়ে বের হবে। তুমি নিশ্চয়ই একটা পিক-আপ ভ্যান দিতে পারবে। কফিনের জন্য পিকআপ ভালো। তোমাদের না থাকলে হায়ার করে নেব।
আমি বললাম, আমাদের আছে চিন্তা কর না, দেব। তোমার অ্যাড্রেস বল, আমি তোমাকেও উঠিয়ে নিয়ে যাব। তোমার হাই উঠছে। ঘুম দাও। জেটল্যাগ না কাটলে অস্বস্তি বোধ করবে।
বুবনা বলল, ঢাকার যে জ্যাম তোমাকে এতটা দূরে যাওয়ার দরকার নেই। আমি দশটা থেকেই এয়ারপোর্টে থাকব। প্রসেস করাতে সময় লাগবে। তুমি কফিনটা সরাসরি গাড়িতে তুলে নিয়ো।
বুবনা উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, আমার গাড়ি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।
বুবনা বলল, দরকার হবে না। আমি তিন দিনের জন্য ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করেছি। তোমাদের পার্কিংয়ে অপেক্ষা করছে। ঢাকা শহরে ভাড়ায় এত চমৎকার গাড়ি পাওয়া যায় চিন্তাই করতে পারিনি। একুশ বছর তো কম সময় নয়, শহর অনেক বদলে গেছে। আই অ্যাম সরি, টি. হায়দার মার্ডার কেসে তোমাকে অনেক ভুগতে হয়েছে। ডেড বডি নিয়ে এসেছি, দু’তিন দিনের ব্যাপার।
ততক্ষণে জিএম (অ্যাডমিন) ভেতরে ঢুকে পড়েছে। বুবনা তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা লম্বা প্যাকেট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, চন্দ্রাবতীর অনেকগুলো ছবি আছে। দেখো। দেখতে একেবারে তোমার মার মতো।
বুবনা বেরিয়ে যায়। জিএম (অ্যাডমিন) হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা চায় না অধিক সুন্দরী কেউ তার বসের রুমে ঢুকুক। জিএম কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার ফাইল সই করে দিলাম। বোর্ড মিটিংয়ে খাবার মেনুর চূড়ান্ত অনুমোদন নিল।
মিটিং শেষে রাত ১০টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে বুবনার দেয়া প্যাকেটটি খুলি। একটি পাতলা লম্বা অ্যালবাম। অনেক ছবি- চন্দ্রাবতীর যখন সাত দিন, যখন প্রথম জন্মদিন, যখন প্রথম হাঁটতে শিখেছে, যখন প্রথম পটিতে বসেছে, যখন দ্বিতীয় জন্মদিন, কিন্ডারগোর্টেনে প্রথম দিন… চেজ ম্যানহাটান ব্যাংকে নিজের কিউবিকলে কাজ করছে চন্দ্রাবতী। ছবির সংখ্যা একশতর কম নয়। আমি কেবল পাতা উল্টে গেছি। সময় করে আবার দেখতে হবে। একটা কথা বুবনা ঠিকই বলেছে, চন্দ্রা দেখতে আমার মার মতো। কিন্তু অনেক স্মার্ট। প্যাকেটে আরও কয়েকটা কাগজ। নিউ জার্সির সলিসিটরের কাছে বুবনার এফিডেভিট। হলফনামা। বুবনা বলছে, ধানমণ্ডিতে তার নামে কেনা ফ্ল্যাটটির মূল্যের একাংশ পরিশোধ করেছে রেজাই করিম। অধিকন্তু রেজাই করিম তাকে দেখাশোনা করেছে, ভরণপোষণের ভার নিয়েছে, পেশাগত জীবনে তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অর্থব্যয়সহ বিভিন্ন ধরনের আত্মত্যাগ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে মানসিক ও শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ব্যক্তিগত ঋণ শোধের একটি অংশ হিসেবে ফ্ল্যাটটির মালিকানা রেজাই করিমের কাছে হস্তান্তর করল।
এই এফিডেভিটের নিচে বাংলাদেশের দূতাবাসের নিউইয়র্ক কনস্যুলার অফিস সই ও সিলমোহর দিয়ে সত্যায়ন করেছে।
বাড়ির মালিক যে রেজাই করিম, এটাই তার লিগ্যাল ডকুমেন্ট।
খুব ইচ্ছে হল বুবনাকে ফোন করে বলি, এ কী করলে?
কিন্তু ফোন নম্বর রাখা হয়নি। বুবনাও সেধে দেয়নি।
সে রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নি। অস্থিরতা কাজ করেছে আমার ভেতর। ঋণ দেয়ার নামে আমাদের ব্যাংক থেকে বড় অংকের টাকা আত্মসাতে একটি সংবাদ আজই পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।
লুবনা বলল, তোমার মাথায় টাইগার বাম মালিশ করে দিই।
আমি বলি, আচ্ছা।
টাইগার বামের প্রলেপে দ্রুত আমার ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু ঘুম এলো না।
রাতের বেলা লুবনা বলল, খুব যন্ত্রণা হয়েছে।
আমি বললাম, কালই সন্ধ্যায় তোমাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছি, আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে রাখব।
আমি লুবনাকে জোড়া ডায়াজিপাম খাইয়ে দিই। টানা ঘুম হবে। ঘুমই সব যন্ত্রণার শ্রেষ্ঠ ওষুধ। লুবনার কপালে চুমো খেয়ে অফিসের পথে বেরিয়ে যাই। ঠিক করি, দেখা হওয়া মাত্রই বুবনাকে বলব, তোমার এত দয়ালু হওয়ার দরকার নেই। আমি উত্তরাতে প্লট পেয়েছি। ডেভেলপারের সঙ্গে কথাও চলছে। তোমার ফ্ল্যাট তোমার কাছেই থাকুক, নতুবা দেশে এলে উঠবে কোথায়?
দশটার দিকে খুব জ্যাম থাকার কথা হলেও অজ্ঞাত কারণে রাস্তাটা খালি পেয়ে যাই। পৌঁছি সাড়ে দশটায়। বিমানের কার্গোর জিএম ইঞ্জিনিয়ার মোসাদ্দেক আমার ক্লাসমেট। আমাকে আশ্বস্ত করেছে সে থাকবে, কফিন পৌঁছার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব ফর্মালিটিস সেরে গাড়িতে তুলে দেবে।
মোসাদ্দেক বলল, প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামীর জন্য তোর যথেষ্ট দরদ দেখছি। সব স্বামীকে যে ধরে রাখতে পারে সেই আইডিয়াল ওয়াইফ।
পৌঁছেই শুনি উড়োজাহাজ টেইল উইন্ড সুবিধা পাওয়ায় ১৫ মিনিট আগেই ল্যান্ড করেছে। এজিএম মাহবুব এসে বলল, এমডি সাহেব জরুরি মিটিংয়ে জিএম সাহেবকে ডেকে নিয়েছেন। কোনো সমস্যা নেই, আমি সব করে দেব।
আমি বুবনার দেখা পেলাম না। জ্যামে আটকা পড়ল না তো?
ততক্ষণে সিলগালা করা কালো কফিন হাজির হল। মাহবুব ছুটে এসে বলল, চালান আপনার নামেই, রেজাই করিম, ধানমণ্ডি এ। সই করুন।
আমি সই করলাম। মাহবুবের লোকজন খুব সাহায্য করল, ১০ মিনিটের মধ্যেই গড়িতে উঠে গেল আটলান্টিকের ওপার থেকে আসা কফিন। আমি অস্থির হয়ে বুবনাকে খুঁজছি।
বুবনার কোনো খবরই নেই।
আমি এ কফিন নিয়ে যাব কোথায়?
এফ. ইমামের বাবার বাড়ির ঠিকানাও আমার জানা নেই।
আমি যখন বুবনার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছি, ট্রলি ব্যাগ টানতে টানতে লম্বামতো একটি মেয়ে এসে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, আর ইউ রেজাই করিম?
আমি ‘হ্যাঁ’ বলতেই মেয়েটি বলল, আপনার কাছেই আমার কফিন হস্তান্তর করার কথা। দিজ ইজ হোয়াট শি ডিজায়ার্ড।
আমি অবাক হই। শি? হু ইজ শি?
মেয়েটি বলল, মাই মাম বুবনা ইমাম। আমি কফিনে তার ডেডবডি নিয়ে এসেছি। মা মারা গেছে ১১ দিন। মরচুয়ারি কেবিনেটে ডেডবডি ছিল। সুইটেবল ফ্লাইট পেতে দেরি হয়ে গেল।
আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, তোমার নাম চন্দ্রাবতী?
ইয়েস, অ্যাবসলিউটলি কারেক্ট।
আমি আবার জিজ্ঞেস করি, এটা এফ. ইমামের কফিন নয়?
মেয়েটি বলল, আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? একটা জীবন্ত মানুষকে কফিনে ঢুকাই কেমন করে? ঋ ইমাম বহু আগে আমার মাকে ডেজার্ট করে চলে গেছে। বাবা তার ক্যারিবিয়ান বউ আর বাচ্চাদের নিয়ে দশ বছর ধরে ক্যালিফোর্নিয়াতে বসবাস করছে। আমি তাকে মার মৃত্যুর কথা বলেছি। বাবা বলেছে, এটা দুঃখজনক। তার নাম করে কফিনে এক গোছা ফুল দিতে আমাকে অনুরোধ করেছে।
তাহলে আমার সঙ্গে কে দেখা করে গেল?
আমার সেক্রেটারি জিজ্ঞেস করল, পিকআপ স্টার্ট দিয়েছে তো, কফিন কোথায় যাবে?
আমি মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে বলি, ধানমণ্ডিতে, আমার বাসায়।
সেক্রেটারি আমার বাসা চেনে।
আমি মেয়েটিকে ডাকি, চন্দ্র, আমার গাড়িতে ওঠ।
ড্রাইভার চন্দ্রাবতীর ট্রলি ব্যাগ গাড়ির সামনের সিটে রাখে। চন্দ্রাবতী আমার পাশে বসে। পিকআপ বেশ এগিয়ে গেছে, পেছনে আমাদের গাড়ি।
আমি জিজ্ঞেস করি, চন্দ্র তুমি চেজ ম্যানহাটান ব্যাংকে ঢুকেছ?
এখনও চাকরি শুরু করিনি, জাস্ট ইন্টার্নশিপ চলছে। তবে ওরা আমাকে নিয়ে নেবে এমন ইঙ্গিত দিয়েছে। চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করার মতো আর কোনো প্রশ্ন আমার নেই।
আমি গাড়ির সিট পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছবির অ্যালবামটা বের করি। পাতা উল্টাই আর চন্দ্রাবতীর দিকে তাকাই।
চন্দ্রা চেঁচচিয়ে ওঠে, ওহ মাই গড, আপনি আমার অ্যালবাম পেলেন কোথায়?
আমি বললাম, বুবনা পাঠিয়েছে।
চন্দ্র বলল, ইমপসিবল। মা মারা গেছে এগার দিন আগে আর এই অ্যালবাম মিসিং মাত্র চার দিন।
আমি পেয়েছি পরশু দিন।
চন্দ্র আমার হাত থেকে অ্যালবাম নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকে। বলে, এটাই, এটাই তো আমার মিসিং অ্যালবাম।
পিকআপের ঠিক পেছনে আমাদের কার থামে। কফিন নামাতে বলে আমি চন্দ্রাকে নিয়ে লিফটে উঠি। পাঁচ তলায় আমার কিংবা বুবনার ফ্লাটের কলিংবেল টিপি। জলতরঙ্গের শব্দ করে বেল যে বাজছে বাইরে থেকে স্পষ্ট শুনতে পাই।
চন্দ্র বলল, মিস্টার রেজাই করিম, ডেডবডি ডিসপোজাল পর্যন্ত আমি আপনার সঙ্গে আছি। তারপর আমাকে ডব্লিউ. হোটেলে নামিয়ে দেবেন। আমার রুম বুক করা আছে। পরশু দিন ভোরের ফ্লাইটে আমি চলে যাব।
কলিং বেল বেজে চলে কিন্তু কেউ দরজা খুলে না। নিশ্চয়ই কেউই বাসায় নেই- লীলাবতী, কঙ্কাবতী কিংবা লুবনা- কেউ না। কঙ্কাবতী এমনিতে মাঝে মধ্যে থাকে।
এবার আমার পকেটের চাবি বের করি। চাবি ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকি, রুমে রুমে খোঁজ করি। রান্নাঘর, বাথরুম, স্টোর চেক করি, ডাইনিং স্পেসের দিকে তাকাই কেউ কোথাও নেই।
আমি ডাইনিং স্পেসের দিকে এগিয়ে আসি। টেবিলে খাবার লাগানো, পাশাপাশি দুটো প্লেট সাজানো। কে খাবে? লীলাবতী আর কঙ্কাবতী না কঙ্কাবতী আর চঞ্চল, না লীলাবতী আর লুবনা? এ সময় তো আমার ফেরার কথা নয়।
আমি বলি, চন্দ্র, হাতমুখ ধুয়ে নাও। একটু খাবার মুখে দিয়ে বের হই। চন্দ্রাবতী ওয়াশরুমে ঢুকল। আমি একে একে লুবনা, লীলাবতী ও কঙ্কাবতীকে ফোন করলাম। একই জবাব- এই নম্বরটি বর্তমানে বন্ধ আছে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চন্দ্র বলল, ডেডবডি ওয়াশ করা, কাফন পরানো জানাজা সব রিচুয়াল শেষ করেই ডেডবডি কফিনে ঢুকানো হয়েছে। এখন সোজা গোরস্থানে নিয়ে গেলেই চলবে। বাট ইফ ইউ লাইক টু হ্যাড অ্যা লাস্ট গ্ল্যান্স- যদি শেষবারের মতো আমার মাকে দেখতে চান তাহলে দেখে নিতে পারেন।
চন্দ্র কিছু খেল না। আমি পরপর দু’গ্লাস পানি খেয়ে দরজায় চাবি ঘুরিয়ে নেমে আসি।
আমার সেক্রেটারিকে বললাম, আজিমপুর নতুন গোরস্থান।
তার আগে একবার মুখটা দেখে নিতে চাই।
কফিনের ডালা তুলে মুখের কাপড় সরিয়ে আমি আঁতকে উঠি। আমি কাকে দাফন করতে যাচ্ছি? এ তো লুবনা।
আমি চন্দ্রকে ডাকি, হ্যাভ এ লাস্ট লুক।
চন্দ্র এগিয়ে এসে চিৎকার করে ওঠে, শি ইজ নট মাই মাম। এটা আমার মা নয়।
পিকআপ ছেড়ে দিয়েছে।
চন্দ্রাবতীর চোখে মুখে আতঙ্ক।
চন্দ্র আমাকে আরও এক দফা বিস্মিত করে বলল, আমি জানি তুমি কে। আমি হোটেলে থাকব না। আমি তোমার সঙ্গে থাকব বাবা।