সাড়ে তিন হাত ভূমি

মা, চলো তোমাকে বাবার কাছে রেখে আসি।
বাবা এক জায়গায় আর তুমি আরেক জায়গায়, এমন ঘটনা আমরা কখনো দেখিনি।
মা, আগে বাবা যখন স্কুলের কাজে ঢাকায় গিয়ে থাকতেন সেটা অন্য ব্যাপার। পুরুষ মানুষ প্রয়োজনে, কাজেটাজে দু-চার দিন বাইরে তো থাকতেই পারে!
কিন্তু তুমি বাবাকে ছেড়ে কখনো থাকতে চাওনি। একটি দিনের জন্যও থাকতে চাওনি। দু-চার দিন ঢাকায় গিয়ে থাকলেই তুমি অস্থির হয়ে যেতে বাবার জন্য। আমাকে আর বকুলকে বলতে, তোরা থাক। আমার ভালো লাগছে না। তোর বাবা কী খায় না খায়, তার শরীর ঠিক আছে কি না কে জানে। আমি কালই চলে যাব।
খালা তোমাকে নানা রকমভাবে বুঝিয়েও রাখতে পারতেন না।
আমি, বকুল আর মায়া আড়ালে হাসাহাসি করতাম। মায়া বলত, খালুর জন্য খালার টান আশ্চর্য রকমের।
তারপর আমার দিকে তাকাত। তখন আমাদের সম্পর্ক একটু একটু তৈরি হচ্ছে। মায়া আমার দিকে তাকিয়ে বলত, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এমনই হওয়া উচিত।
আমি বুঝতাম, মায়া কী ইঙ্গিত করছে!
চলো মা, চলো তোমাকে বাবার কাছে রেখে আসি। বাবা পড়ে আছেন উঠোনে আর তুমি এখানে, তোমাদের দুজনকে পাশাপাশি রেখে আসি। সারা জীবন যেভাবে থেকেছো, আজও সেভাবে পাশাপাশিই থাকো। একজন আরেকজনের ছায়া হয়ে থাকো। মরণও যেন বিচ্ছিন্ন করতে না পারে তোমাদের!
তার আগে, মাগো, তার আগে বারেককে নিয়ে আর কয়েকটা কথা বলি। বুয়াকে নিয়ে আর কয়েকটা কথা বলি।
বারেককে ও রকম একটা চড় মেরে বুয়া যখন তার মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর ওসব কথা বলছে, তখন আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল মা। অদ্ভুত অনুভূতি। মনে হয়েছিল, আচ্ছা, বারেকের জায়গায় যদি হতাম আমি আর বুয়ার জায়গায় হতে তুমি, তাহলে তুমিও কি আমার সঙ্গে এমন আচরণই করতে?
অমন জোরে ঠাস করে চড় মারতে আমার গালে!
আমার মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে বুয়ার মতো করে কাঁদতে!
আমিও কি তোমার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম আর মাফ চাইতাম!
অথবা বারেক ফিরে আসার পর বুয়া তার সঙ্গে যে রকম আচরণ করেছিল, তুমিও কি আমার সঙ্গে তাই করতে!
না, তুমি আমার সঙ্গে তা করতে না, মা।
আমি ও রকম উধাও হয়ে গেলে এগারো বছর তুমি বেঁচেই থাকতে না।
আমার শোকে পাগল হয়ে যেতে। মারা যেতে।
আর আমিও তোমাকে ছেড়ে অমন করে উধাও হয়ে থাকতে পারতাম না, মা। আমি তোমার জন্য পাগল হয়ে যেতাম, কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে যেতাম।
কিন্তু এখন আমার কান্না আসছে না কেন মা?
এখন আমার কান্না আসছে না কেন!
জানি, কারণটা আমি জানি মা। আমি এখন আর নিজের মধ্যে নেই। আমি এখন এক দিশাহারা এলোমেলো মানুষ! যে মানুষের মা-বাবা, বোন, স্ত্রী আর স্ত্রীর গর্ভের সন্তান এ রকম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় সেই মানুষ কি আর মানুষ থাকে!
মানুষের মতো মন অনুভব আর অনুভূতি থাক!
মে মাস থেকে অগাস্ট মাস, তিন-চারটা মাত্র মাস তোমাদের ছেড়ে ছিলাম। ট্রেনিং ক্যাম্পে কোনো কোনো রাতে তোমাদের কাউকে কাউকে স্বপ্নে দেখতাম। বাবাকে, বকুলকে, মায়াকে আর তোমাকে। খুবই স্বাভাবিক সব স্বপ্ন। ওইসব স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙত, কয়েক মিনিট স্বপ্নটা নিয়ে ভাবতাম তারপর আবার ঘুমিয়ে যেতাম।
এক রাতে তোমাকে স্বপ্নে দেখলাম।
কী স্বপ্ন?
দেখি আমাদের বারবাড়ির সামনের আমগাছটার তলায় বসে তুমি কাঁদছো আর আমার নাম ধরে ডাকছো। রবি রে, আমার রবি। কত দিন হইয়া গেল তোরে আমি দেখি না বাজান। তুই কই আছস, কেমন আছস কিচ্ছু জানি না। তুই কী খাছ, কই ঘুমাছ, কিচ্ছু জানি না। আমার কলিজাটা তোর জইন্য পুইড়া যায় বাজান। আমার জইন্য তোর কলিজা পোড়ে না? মার কথা মনে হয় না?
এই স্বপ্ন দেখে আমি বিছানায় উঠে বসলাম।
আমার দুই পাশে সার ধরে ঘুমাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা। ভোর ৪টায় উঠে ট্রেনিং শুরু করব। এমন পরিশ্রমের কাজ সেটা, সারা দিন ট্রেনিং নেওয়ার পর রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় যাওয়া মাত্রই ঘুমে ঢলে পড়ি আমরা। কারো কোনো খবর থাকে না। কারো কারো নাক ডাকে, কেউ ঘুমায় নিঃশব্দে।
আমার নিঃশব্দে ঘুমানোর অভ্যাস।
স্বপ্ন দেখে উঠে বসেছি। বসার পর কোত্থেকে যে বুক ঠেলে উঠল এক কান্না। স্বপ্নে তোমার কান্নার দৃশ্য আর কথাগুলো ভুলতেই পারি না।
আমি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম, মা।
শিশুর মতো কাঁদতে লাগলাম।
পাশে শুয়ে সবাই ঘুমায়। কেউ টের পায় না আমার কান্না।
মাগো, সে দিনই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ট্রেনিং শেষ করে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব, যাওয়ার আগে যেমন করে পারি কমান্ডারকে ম্যানেজ করে একটি রাতের জন্য বাড়ি আসব। তোমাদের সবাইকে দেখে যাব। তোমাকে জড়িয়ে ধরে বলব, আমার জন্য যে তুমি কাঁদো আমি তা টের পাই মা। বহু দূরে থেকেও টের পাই। স্বপ্নে তোমাকে কাঁদতে দেখে নিজেও কাঁদি।
নিশ্চয়ই তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে তুমি কাঁদতে মা।
তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম আমি।
এই জীবনে সেই কাঁদা আমার জন্য তোমার আর কাঁদা হলো না মা।
তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদা হলো না আমার।
ওদের আমি কী বলে গাল দেব, মা!
পৃথিবীর নিকৃষ্টতম গালটিও ওদের জন্য বেমানান। শুয়োরের দল বলে গাল দিলেও প্রকৃত গাল ওদের দেওয়া হবে না।
আর কী গাল দেওয়া যায় ওদের!
কী গাল!
ওই যে বারেকের কথা বলছিলাম মা, সেইসব কথা তো বলাই হচ্ছে না!
বুয়ার চড় খেয়ে শেষ পর্যন্ত বারেক তার পা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও মা, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও।
মাফ তো বুয়া তাকে তখনই করেছে যখন চড় মেরেছে!
সেই মুহূর্ত থেকে বারেক ফিরে গেল তার ছেলেবেলায়, শিশু বয়সে। তবে অন্য ছেলেবেলায়, অন্য শিশু বয়সে। মা ন্যাওটা শিশুর মতো সারাক্ষণ বুয়ার সঙ্গে সঙ্গে। বুয়াকে কোনো কাজই করতে দেয় না, বুয়ার সব কাজ সে করে। পারলে রান্নাবান্নাটাও করে দেয়, মাছ কুটে দেয়, বাটনা বেটে দেয়। পারলে বুয়াকে গোসল করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
এমন মাতৃভক্তি!
বাড়ির সবাই আমরা বিস্মিত হয়ে গেলাম!
বারেক পাঁচ ওয়াক্ত আজান দিয়ে নামাজ পড়ে আর মায়ের সেবা করে।
একদিন আমাকে বলল, এগারোটা বছর যেই দুঃখ আমি আমার মারে দিছি, আমার মায় যত দিন বাইচা আছে, তত দিন তার সেবা এইভাবেই আমি করতে চাই।
আর ওই যে মোসলেম মিয়ার ওখানে তুই ছিলি, তাঁর প্রতিও তোর দায়িত্ব আছে। সেই ভদ্রলোক তোকে মানুষ করেছেন?
হ মামা, সেইটা ঠিক। তবে তাঁর কাছেও আমি যাব। যাব মার অনুমতি নিয়া। মায় অনুমতি দিলে তাঁর কাছে যামু। তাঁর সেবাযত্নও করুম।
বারেককে অনুমতি দিয়েছিল বুয়া।
তার পর থেকে এক-দুই মাস আমাদের বাড়িতে থাকে বারেক, এক-দুই মাস গিয়ে নারায়ণপুরে থাকে। নিজের মায়ের পাশে থাকে, মোসলেম মিয়ার পরিবারের পাশে থাকে। এত নম্র ও বিনয়ী ভঙ্গিতে জীবন কাটায়, ভাবাই যায় না, এই সেই বারেক, যে ডাকাত হতে চেয়েছিল।
মোসলেম মিয়ার মতো এক পরশপাথরের ছোঁয়ায় সে মানুষ হয়ে গেল।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধও এক পরশপাথর মা!
দেশপ্রেম এক পরশপাথর।
আর সবচেয়ে বড় পরশপাথর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের সাত কোটি মানুষকে তিনি মানুষ হওয়ার মন্ত্র শিখিয়েছেন। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্র শিখিয়েছেন। দেশপ্রেমের মন্ত্র শিখিয়েছেন।
যে মানুষ নিজের দেশকে ভালোবাসে না, সে কি মানুষ!
যে মানুষের দেশপ্রেম নেই, সে কি মানুষ!
যে কুলাঙ্গাররা পাকিস্তানি শূকরছানাদের দোসর হয়েছে সেগুলো তো মানুষ না, মা!
যারা এইভাবে মানুষ হত্যা করে তারা কেমন করে মানুষ হয়!
আমরা ওদের একটিকেও ছাড়ব না মা। একটিকেও না। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রে আমরা উজ্জীবিত। আমাদের কেউ ‘দাবায়া রাখতে পারবে না’। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। আমার মাথায় বাঁধা পতাকা দেশের হাওয়ায় পত পত করে উড়বেই।
এসো মা, এসো, তোমাকে কোলে নিই। বাবার পাশে তোমাকে রেখে আসি। পাঁজাকোলে করে সেই যে একবার জ্বরের সময় আমাকে তুমি কোলে নিয়েছিলে, দেখো মা, দেখো, ঠিক তেমন করে তোমাকে আমি কোলে নিয়েছি। চাঁদের আলোয় তোমাকে কোলে নিয়ে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি।
তোমার মনে আছে মা, আমার সেই জ্বরের সময়কার কথাটা তোমার মনে আছে?
আমার পরিষ্কার মনে আছে।
কতবারই তো জ্বরজ্বারি হয়েছে ছেলেবেলায়। কতবারই তো তুমি আমাকে কোলে নিয়েছো। কিন্তু আমার মনে পড়ে শুধু সেবারের কথা।
কত বয়স হবে আমার তখন?
আট-নয় বছর!
নাকি দশ!
মা, নাকি দশ বছর বয়স আমার!
তা-ই হবে। আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। হঠাৎ এমন জ্বর হলো! সেই জ্বর আর কমেই না। ডাক্তার কাকা দুই বেলা এসে দেখে যান। শিশিতে করে মিক্সচার দিয়েছেন। কমলা রঙের মিক্সচার। কাগজ কেটে সেঁটে দেওয়া হয়েছে শিশির গায়ে। কাগজটা বাঁক করে কাটত ডাক্তার কাকার কম্পাউন্ডার। কড়ে আঙুলের অর্ধেক মাপের হবে এমন জায়গায় একটি করে বাঁক। ওই বাঁককে বলা হতো ‘দাগ’। দিনে তিন বেলা এক দাগ করে সেই তেতো মিক্সচার গিলতে হতো।
কী যে বিচ্ছিরি স্বাদ সেই মিক্সচারের!
দাগ বলতে বোঝানো হতো ওষুধের মাপ।
কিন্তু ডাক্তার কাকার ওই মিক্সচারে আমার জ্বর কমছিল না। এক দুপুরে এমন জ্বর উঠল! জ্বরের ঘোরে আমি প্রলাপ বকতে লাগলাম। তুমি পাগলের মতো ছুটে এসে, এই যে এখন যেভাবে পাঁজাকোলে আমি তোমাকে নিয়েছি ঠিক সেইভাবে আমাকে কোলে নিলে। চিৎকার করে বুয়াকে ডাকলে। দৌড়ে বালতি ভরে পানি নিয়ে এলো বুয়া। আমাকে কোলে নিয়ে বসে রইলে তুমি আর বুয়া বদনার নল দিয়ে আমার মাথায় পানি দিতে লাগল।
আমি চোখ বুজে তোমার কোলে নেতিয়ে আছি।
ততক্ষণে বাড়ির সবাই তোমার ঘরে। তুমি বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে আমার কপালে ও মুখে ফুঁ দিচ্ছো। বুয়া পানি দিয়েই যাচ্ছে।
কতক্ষণ!
এভাবে কতক্ষণ কে জানে!
একসময় চোখ মেলে তাকালাম আমি। অন্য কোনো দিকে না, অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম তোমার মুখের দিকে।
তুমিও তাকিয়ে আছো আমার মুখের দিকে। চোখ দুটো ছলছল করছে তোমার। বিড়বিড় করে তখনো দোয়া পড়ছো।
আমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একসময় বললে, আল্লাহ রহম করো, রহম করো আল্লাহ। আমার বাজানরে রহম করো।
বুয়া আমার মাথায় পানি দিচ্ছিল। সেই পানিতে তোমার শাড়ি ভিজেছে।
মা, মাগো, আজ তোমার রক্তে ভিজেছে আমার শার্ট-লুঙ্গি। ওই সেদিনের মতো আমার মাথার পানিতে ভিজেছিল তোমার শাড়ি, আজ তোমার রক্তে ভিজেছে আমার শার্ট-লুঙ্গি। আমি তাকিয়ে আছি তোমার মুখের দিকে। চাঁদের আলোয় অনেকটাই পরিষ্কার তোমার মুখ। চোখ দুটো বন্ধ। সেখানে আবছামতো অন্ধকার।
আহা, তুমি যদি একবার তাকাতে আমার দিকে!
জ্বরের ঘোর কাটিয়ে আমি যেমন সেদিন তাকিয়েছিলাম তোমার মুখের দিকে, মৃত্যু কাটিয়ে তুমি যদি তাকাতে আমার দিকে! আল্লাহপাককে যদি আমি বলতে পারতাম, রহম করো আল্লাহ, আমার মাকে তুমি রহম করো।
কিন্তু তোমার ওজন এত কমে গেছে কেন, মা?
তুমি খাওয়াদাওয়া করতে না ঠিকঠাকমতো!
নাকি আমার কথা ভেবে খাওয়া বন্ধ করেছিলে।
মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে ছেলে! আগরতলায় ট্রেনিং নিচ্ছে- এ কথা তুমি জানতে। বাড়ির সবাই জানত। নিশ্চয়ই তোমার মনে হতো, সেখানে ঠিকঠাকমতো খাওয়াদাওয়া হচ্ছে কি না আমার! পেটভরে তিন বেলা খেতে পাচ্ছি কি না আমি। হয়তো খেতে বসলেই আমার কথা তোমার মনে হতো আর ওসব ভেবে তুমি খেতে পারতে না।
আমি বুঝেছি মা, আমি বুঝেছি।
আমার জন্যই তোমার ওজন কমে গেছে!
আমার কথা ভেবেই তুমি ঠিকঠাকমতো খাওয়াদাওয়া করোনি।
কিন্তু আমি ভালো ছিলাম, মা। আমি ভালো ছিলাম। খাওয়াদাওয়া খারাপ হতো না আমাদের। তবে বাড়ির মতো কী আর হয়!
দেশের এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে চলে গেছে ভারতে। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে কী অবর্ণনীয় কষ্টে আছে তারা। অপুষ্টিতে ভুগে শিশুরা মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। মানুষের কঙ্কালসার চেহারা। সেই তুলনায় আমি ভালোই ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধারা ভালোই ছিল।
আমার কথা ভেবে কেন তুমি নিজেকে কষ্ট দিয়েছো, মা! বরং তোমার তো ভালো থাকার কথা ছিল। তোমার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা। দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করছে। ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে যুদ্ধ শুরু করবে পাকিস্তানি শূকরদের বিরুদ্ধে। দেশ স্বাধীন করবে! এই নিয়ে তোমার তো অহংকার করার কথা।
অহংকার তুমি করেছো নিশ্চয়ই; কিন্তু নিজের খাওয়াদাওয়ার কথা ভাবনি।
এটা তোমার দোষ না মা। তুমি হচ্ছো বাঙালি মায়ের প্রতীক। বাংলার প্রত্যেক মা-ই তোমার মতো। সন্তানের কথা ভেবে এমনই করেন তাঁরা।
এই দেখো মা, তোমাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি আমি। বাবার পাশে চলে এসেছি। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে বাড়ির সামনের আঙিনা। সেখানে পড়ে আছেন বাবা। একটু একটু হাওয়া আসছে। ঝিঁঝি ডাকছে তাদের নিজস্ব নিয়মে। মাথার ওপর দিয়ে বাঁশঝাড়ের ওদিকে উড়ে গেল একটা বাদুড়। কোথায় যেন ডাকছে একটা ডাহুক পাখি।
আমাদের দিঘির ওদিকে?
হতে পারে।
আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। শুধু অচেনা একটা ফুলের গন্ধ আসে হাওয়ায়। কোথায় কোন ঝোপে ফুটেছে বুনোফুল, কে জানে!
মাগো, তুমি থাকো বাবার পাশে! এই যে আমি তোমাকে শুইয়ে দিলাম। তোমার একটা হাত আর বাবার একটা হাত ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে রইল। তোমরা থাকো পাশাপাশি। আমি যাই আমার বোনটির কাছে। আমার বকুল ফুলের কাছে।
[চলবে]