কেরানিও দৌড়ে ছিল

image_1299_323489
২০
কেরানির জ্বর ঘন হয়ে আসে। জ্বর বাড়তেই থাকে। দিনের পর দিন। মাঝে মাঝে কেরানি নিজেই টের পায় সে জ্বরের ঘোরে ভুল বকছে। লঞ্চের পাটাতনে যাত্রীর জামার কলার ধরে চেঁচিয়ে উঠছে, ভাড়া নাই! লঞ্চে উঠছো কেন? তার ধন্দ লাগে সে এখনো নীল সাগর লঞ্চের চাকরিতেই।
শরীরের নিচে নদীর স্রোত টের পায় কেরানি। নদী বয়ে চলেছে নদীর মতো। এই নদী থেকে সেই নদী। পানির কোনো বাধা নাই। জ্বরের ঘোরে পানির ওপরে কেরানি ভেসে চলে। তলতল করে বয়ে চলেছে নদী। অন্ধকার রাত। কুচকুচে নদীর পানি। চোখে না দেখা যায়, শুধু কুলুকুলু ধ্বনিতে টের পাওয়া যায়। কেরানি চিৎকার করে ওঠে। তখন ময়না তাকে জাপটে ধরে।
অন্ধকারে বিকন বাতির লাল আলো নাই। লঞ্চ যদি চরে ঠেকে যায়! দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে কেরানি। ব্রিজ ঘরে যায়। কিন্তু সারেং নাই! কোথায়? কোথায় গেলো সে? লঞ্চ তবে চালাচ্ছে কে? কেরানি মূচ্ছর্িত হয়ে পড়ে। ময়না তাকে ডাক দেয়। মামা! মামা! ময়না আজকাল তাকে মামা বলে ডাকে।
জ্বরের প্রকোপ শুরু থেকেই ময়না দিনরাত কেরানির ঘরে থাকছে। বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার জগদীশ সময় পেলেই কেরানিকে দেখে যায়। ময়নার মা মাঝেমাঝে এসে উঁকি দেয়। তার হয়তো সন্দেহ একটা থেকেই যায় যে উঠতি বয়সের মেয়েটি না কেরানির কুকামে লেগে যায়! জ্বর হইছে তো কী! পুরুষ পোলার ধনের তাপ জ্বর ছাড়াও ওঠে!
বোর্ডিংয়ের পাকঘরে মসলা পিষতে পিষতে ময়নার মা হঠাৎ উঠে একেকবার কেরানির ঘরে আসে। পুরুষ তার অনেক দেখা আছে। জীবনে কম অভিজ্ঞতা হয় নাই তার দুই পায়ের ফাঁকে রসের পিঠা থাকার কারণে! ময়নার মা চোখ সরু করে সব নজর করে, তত্ত্ব তালাশ করে। ময়না ছোট হলে হবে কী, মায়ের ভাবগতিক বোঝে। মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সে বারবার মামা বলে ডেকে ওঠে। ও মামা! কিছু লাগবো? ও মামা! মাথাটা টিপা দিমু?
ময়না ছিলো বলেই কেরানির এখন নিজেকে একা মনে হয় না। ছোট বোনটির কথা মনে পড়ে। বড়বুবুর কথা মনে পড়ে। বাবা যে কবরের তলায়, কথাটা এখনো তার বিশ্বাস হয় না। মায়ের কথা তেমন মনে পড়ে না। বরং ময়নাকেই মাঝেমাঝে মনে হয়, মা ছোট হয়ে তার কাছে এসেছে, তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে, গেলাশ ধরে দুধ খাওয়াচ্ছে, পথ্য মুখে তুলে দিচ্ছে।
রুহিতনের কথা মনে পড়ে। জ্বরের ঘোরে কানে সে অবিরাম শুনতে পায় রুহিতনের আদর মাখানো ডাক। রুহিতন তাকে ডাকছে, জজমিয়া! ও জজমিয়া! কত কালের ওপার থেকে মনে পড়ে আফলাতুন মিয়ার গলা ভেসে আসে_ তার এই চেহারা আর ল্যাখাপড়া নিয়া হে জজম্যাজিস্টর হইতে পারতো! কপাল খারাব, তাই লঞ্চের কেরানি! রুহিতনের খিলখিল হাসি।
কিন্তু কতক্ষণ? অচিরে ডাক ওঠে। ঘোড়াটা মাথার ভেতরে ডেকে ওঠে। আহ, শ্বশুর বুলবুল মিয়ার ঘোড়া তাকে লাথি মেরেছিলো সেই রাতে, যে রাতে সে লঞ্চের চাকরি হারিয়ে, নদীর পাড়ে কাদা আবর্জনা থেকে উঠে চোরের মতো বাসায় ফিরে এসেছিলো। ডান জানুতে চোটটা লেগেছিলো! ব্যথায় সে আর্তনাদ করে ওঠে। ময়না আকুল হয়ে ডাকে, মামা! মামা!
আর সারাক্ষণ চোখের ভেতরে সেই ছবিটা_ সেই ভোরবেলায় সে যখন হস্তিবাড়ি থেকে যাত্রা করছিলো, মদিনা দুয়ার ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। কী করুণ সেই মুখখানা তার। ওই শেষ দেখা মদিনাকে। বড়বুবু চিঠিতে লিখেছিলো, তালাকের খবর পাইয়া মদিনা জ্ঞান হারায়। এ তুমি কী করিলা? কেন করিলা? মদিনার মুখ আছড়ে ভেঙে পড়ে কেরানির মাথার ভেতরে। ভাঙা সেই ছবিটার ওপরেই রুহিতনের ডাক আছাড় খায়, লুটোপুটি করে_ জজমিয়া! জজমিয়া! আর্ত সে ডাক। আদর মাখানো আর নয়!
দিন যায়। রাত যায়। আমরাও অগ্রসর হই কেরানির এ কাহিনী কথন নিয়ে। আর বেশি দূর নাই। আর অধিক তার জ্বর তাপ জ্বালা নাই। সকলই জুড়াবে তার, অচিরে জুড়াবে। সবারই জুড়ায়। আমাদের আর একটু অপেক্ষা করতে হবে। না, জ্বরে তার মৃত্যু যে হবে না, অন্তত এটুকু আমরা এখনই বলে রাখতে পারি।
ডাক্তার নিয়মিত আসে। না, খাম্বা সামাদ কেরানির চিকিৎসার কোনো ত্রুটি রাখে নাই। কিন্তু সে নিজে আসে নাই। তার এখন মাথার ভেতরে অনেক চিন্তা। যে কাজের জন্যে কেরানিকে সে ফিট করেছে, তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ঘনিয়ে এসেছে কি একটা তারিখ পারও হয়ে গেছে। অনেক কায়দা করে আরেকটা তারিখ তাকে নিতে হয়েছে। সে তারিখও এই এসে যায় বলে!
একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে কেরানি নিজেকে চমৎকার দেখতে পায়। জ্বর নাই। তাপ নাই। মাথায় যন্ত্রণা নাই, বরং মাথার ভেতরটা ফুরফুরে হালকা বোধ হয় তার। ম্যাজিক নাকি! ময়না বলে, আইজ নিয়া আঠারো দিন জ্বরে আছিলেন, মামা!
আঠারো দিন! বলিস কী!
কেরানি ফোন করে খাম্বা সামাদকে। ভাই, জ্বর ইজ গন! নাই!
ওপার থেকে খাম্বা সামাদের উৎফুল্ল গলা ভেসে আসে। আলহামদুলিল্লাহ!
ওই শব্দটা কেরানিকে মনে করায় আহমদউল্লাহ্র কথা। প্রায় একই রকম ধ্বনি_ আলহামদুলিল্লাহ আর আহমদউল্লাহ!
কেরানি বলে, খাম্ভাই, আহমদউল্লাহ্র খবর কী!
সে তো শুনছেনই! ন্যাংটা কইরা ছাইড়া দিছি।
কাজটা বোধহয় ঠিক হয় নাই।
আচ্ছা, আমি আসতাছি।
খাম্বা সামাদ এসেই বলে, ঠিক হয় নাই মানে? খুব ঠিক হইছে! এই সবায় শুরু। আমারে কইছিলো, আমারে ন্যাংটা কইরা ছাইড়া দিবে। তার আগেই আমি তারে! এর সাথে আপনের অপমানের কুনো রিশতা নাই। এ আমার নিজের মামলা।
বিষয়টা জটিল মনে হয় কেরানির। সে ভ্রু কুঁচকে নীরব প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে খাম্বা সামাদের দিকে।
খাম্বা সামাদ বলে, অ্যাতো হিস্ট্রি আপনের জাইনা কাম নাই। ফরগেট ইট।
তবু বলেন, ভাই। আমার খারাপ লাগে আপনি আমার জন্যে একটা মানী মানুষের কাপড় খুলে নিলেন। দুনিয়ার সামনে বেইজ্জত করলেন। আমি তো মাফ করে দিয়েছিলাম।
আপনে মাফ করলেই শ্যাষ? আহমদউল্লাহ্ আমারে হুমকি দিছিলো ধরায়া দিবে, আমারে ন্যাংটা কইরা ছাড়বে, জেলের ভাত খাইতে হবে আমারে। আমারে? আরে! সে যে ইনকামট্যাক্স অ্যাতো ফাঁকি দিছে, আমি সেইটা যখন তার কাছে তুইলা ধরি, হ্যাঁ, তারে কইছিলাম দশ লাখ ট্যাকা আমারে এখন দিবেন, তার বাদে অন্য কথা, তার বাদে করাপশন আর কী কী করছেন, সেইটা না হয় এখন ধরলামই না, উলটা তার ধমক! কয় কী না, তার নাকি গরমেন্ট পার্টিতে লোক আছে, মন্ত্রী মিনিস্টার আছে! আমি কই, রাখো! আমারও কী আছে, তা তুমি জানো না! দ্যাখো। খালি দেইখা যাও। না, কেরানিভাই, আপনের অপমানের বদলা ধইরা তারে ন্যাংটা করি নাই। ন্যাংটা তো ন্যাংটা, দ্যাখছেন কী! তার নামে কেস ভি লাগায়া দিছি। লঞ্চ এইবার কালা গাঙে খাইবো। আর জেলের ভাত খাইবো সে নিজে!
কেরানি স্বচ্ছ শাদা চোখে খাম্বা সামাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখের এই দৃষ্টি আমরা জানি। দুশ্চিন্তাহীন দৃষ্টি! আবার সে তার পুরনো ধরনে ফিরে গেছে। পূর্বাপর নিয়ে আর তার ভাবনা নাই। আবার সেই পুরনো শাঁস সে ফিরে পায়_ ঘটনাকে শুধু ঘটে যেতে দেয়া। সে কেবল এক দর্শক। এবং শ্রোতা। ঘটুক যা ঘটবে। জ্বরের ঘোরে যা কিছুই তার ভেতরে এসেছিলো, এখন সবই এক ফুঁয়ে উড়ে গেছে। আমরাও আমাদের পুরনো সেই কেরানিকে ফিরে পেয়েছি।
খাম্বা সামাদ বলে, বেটার ফিল করতাছেন কইলেন! দেখতাছিও বেটার আপনেরে। চিন্তায় ফালায়া দিছিলেন। খুব চিন্তায়!
আমিও। মনে করেছিলাম, আর বোধহয় বাঁচবো না।
কী যে কন! এই তো সবায় শুরু।
কেরানি বলে, ভাই, জ্বর থেকে কেবল উঠলাম, ভালো একটা ডিনার করতে ইচ্ছা করছে।
করবেন।
আর_
কন, কয়া ফালান!
ড্রিংক করলে কী এখন ক্ষতি হবে?
খাম্বা সামাদ কেরানির হাতে সোৎসাহে চাপড় দিয়ে বলে, কীয়ের ক্ষতি! কী যে কয়! আপনে একটা ভালো কইরা গোছল দ্যান তো! সন্ধ্যাবেলা আসুম। দুই ভাই আইজ আবার আগের মতো, নাকি!
সন্ধ্যের জন্যে অপেক্ষা করে না খাম্বা সামাদ। বিকেলেই চলে আসে। তার আগে দশটার দিকে গরম পানিতে বেশ করে গোসল করেছে কেরানি। দুপুরে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছে। জগদীশ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পরিবেশন করেছে_ কৈ মাছ কাঁচকলার পাতলা ঝোল, পাতলা ডাল, আর শেষপাতে টক দই।
খান, স্যার, আপনের লাইগা ইস্পিশাল কাঁচকলা দিয়া রানতে কইছিলাম। ছুটোকালে জ্বর থিকা উঠলে আমার জইন্যে মায়ে রানতো, কইতো বলে এই পথ্যের উপর পথ্য নাই। স্টমাক দুর্বল তো!
কিসের দুর্বল! কেরানি পেট পুরেই খায়। পেটের কোনো গড়বড় নাই। ঘুমটাও বেশ গাঢ় হয়েই নামে। কেরানি শুয়ে পড়ে। ময়নাকে বলে, ক’দিন তোর ওপরে খুব ধকল গেছে রে। খুব কষ্ট দিয়েছি তোকে। যা, মায়ের কাছে যা। আর আসতে হবে না। আমি সন্ধ্যের সময় বাইরে যাবো। ফিরতে রাত হবে।
ময়না মায়ের মতো গলায় বলে, এইডা ঠিক না। রাইত কইরেন না। আবার যুদি জ্বর আহে।
জ্বর এলে তুই তো আছিসই! না, জ্বর আর আসবে না। যা!
ঘুমের ভেতরে খাম্বা সামাদের ডাক। ধড়মড় করে উঠে বসে সে।
আরে, আপনি! এখন! কয়টা বাজে? সাড়ে চারটা?
একটু আগেই আয়া পড়লাম। আপনেরে নিয়া একটু ঘুরবো। তারপর ডিনার।

বেরোয় তারা। লাল জীপ আজ আনেনি, শাদা গাড়িটা এনেছে খাম্বা সামাদ।
গাড়িতে বসে খাম্বা সামাদ ড্রাইভারকে বলে, চলো! উত্তরা টংগী ছাড়ায়া!
কেরানি বলে, তার মানে কোথায়?
গম্ভীর গলায় খাম্বা সামাদ অন্যমনষ্ক উত্তর দেয়, দেখি। যতদূর মন চায়।
তার গলার স্বরটা ঈষৎ চিন্তিত করে কেরানিকে। কিন্তু সে বেশিক্ষণ সেটাকে পাত্তা দেয় না। গাড়ির ভেতরে গা এলিয়ে বসে। গাড়ি চলতে থাকে। গাড়ির ভেতরে খাম্বা সামাদ সিগারেট ধরায়। জ্বর থেকে সদ্য ওঠার কারণে সিগারেটের ধোঁয়াটা কটু লাগে কেরানির। একবার ভাবে, বলবে সে সিগারেটটা নেভাতে, কিন্তু ঠিক সাহস পায় না।
খাম্বা সামাদ বলে, আপনে যে ছিগ্রেট খান না, এইটা ভালো।
হ্যাঁ, স্বাস্থ্যের জন্যে খারাপ। আপনি ছেড়ে দিলেই পারেন।
খাম্বা সামাদ ধোঁয়া সমেত লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, নাহ্, স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করি না। জীবন দুই দিনের। সুখ থিকা নিজেরে বঞ্চিত কইরা লাভ নাই। হোয়াট আই ওয়াজ থিংকিং, দেয়ার আর পিপল হু ডাজ নট লাইক স্মোকিং। এমন মানুষ আছে যারা সিগারেট খায় শুনলেই মানুষটারে রিজেক্ট করে। কয়, দরকার নাই! যে মানুষ ছিগ্রেট ফোঁকে, তারে বিদায় করো।
কথাটা হাসতে হাসতে বলা স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু খাম্বা সামাদের গলায় কেরানি লক্ষ করে গম্ভীরতা। এমনকি তার কণ্ঠের স্বরও অনেক দূর থেকেই ভেসে আসা বলে কেরানির মনে হয়। কেরানি ঈষৎ ভ্রুকুটি করে। সেটা খাম্বা সামাদের নজর এড়ায় না।
খাম্বা সামাদ বলে, আপনে এমন মানুষ দেখেন নাই ছিগ্রেটের ধোঁয়া একদম লাইক করে না?
কেরানির মনে পড়ে না। আসলে এ ব্যাপারে যে একটা কথা উঠতে পারে, তার একটা মতামত থাকতে পারে, কখনোই চিন্তা করে নাই কেরানি। তার বরং একটু অবাকই লাগে, এই ছোট্ট একটা বিষয়ে এমন গুরুত্ব নিয়ে প্রসংগটা রগড়াচ্ছে কেন খাম্বা সামাদ।
অন্তর্যামীর মতো প্রশ্নটা অনুমান করেই যেন খাম্বা সামাদ বলে, ভাই, আপনেরে একটা জায়গায় নিয়া যাবো।
আজ?
না, আইজ না। কয়দিন পর। যার কাছে নিয়া যাবো, তিনি ছিগ্রেট একেবারে পছন্দ করেন না।
কেরানি লক্ষ না করলেও আমরা লক্ষ করি, খাম্বা সামাদ সেই ব্যক্তির উল্লেখে সম্মানসূচক আপনি ব্যবহার করে। আমাদের যদি কৌতূহল হয়, ব্যক্তিটি কে, আমরা এখনই তার উত্তর পাবো না। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
কেরানি জানতে চায়, মানুষটা কে?
খাম্বা সামাদ রহস্যময় গলায় বলে, জানবেন। যখন নিয়া যাবো দেখবেন। তিনি আপনেরে দেখছেন।
আমাকে? কখন? কোথায়?
খাম্বা সামাদ আরেকটা সিগারেট ধরায়। লম্বা টান দেয়। তারপর যখন সে জানালার কাঁচ আরো একটু নামিয়ে দেয়, তার সিগারেটের ছেড়ে দেয়া ধোঁয়াটা পাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। সেদিকে তাকিয়ে থাকে খাম্বা সামাদ কিছুক্ষণ। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলে, কোথায়? ক্যান আপনের মনে নাই, ডু ইউ নট রিমেমবার_ একদিন আই টুক ইউ টু এ ক্লাব ইন গুলশান?
কেরানির মনে পড়ে। তার মনে পড়ে, সেদিন খাম্বা সামাদ বড় অস্থির ছিলো, বারবার তাকাচ্ছিলো চারদিকে, তারপর এক সময় এক বেয়ারার কী এক ইশারা পেয়ে উঠে গিয়েছিলো দ্রুত। কোথায় সে গিয়েছিলো কেরানির চোখে পড়ে নাই। একেবারে ভেতরের দিকে সে গিয়েছিলো। ভেতরে একটা কোনো ঘরে। তারপর ফিরে যখন এসেছিলো তাকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলো। বারবার হাত কচলাচ্ছিলো খাম্বা সামাদ। কেরানির মনে পড়ে।
কেরানির মনে অনুমান জাগে। সে বলে, সেখানে?
ইয়েস, সেখানে। তিনি আপনাকে দেখেন। আপনি দেখেন নাই। তিনি সামনে আসেন নাই।
বড় রহস্যময় ঠেকে কেরানির কাছে। সে দেখে নাই, সেই ব্যক্তিটি তাকে দেখেছে! কেন সেই ব্যক্তিটি সমুখে আসে নাই?
খাম্বা সামাদ জানালা দিয়ে সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলে, আপনি তাকে দেখবেন। সামনের মঙ্গলবার।
ক্লাবে?
না।
তবে?
সে দ্যাখা যাইবো তখন।
কেরানি প্রশ্ন করে, তিনি সিগারেট পছন্দ করেন না। ড্রিংক?
পছন্দ!
তিনি নিজে?
বহুত!! তবে সব সময় না। রঙে থাকলে, তখন। আমরা টংগী পার হইলাম!
কেরানি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে। আরে, ওই তো! ওই সেই বাজার! না, দেখা গেলো না। তার আগেই পার হয়ে গেলো। সেই ভাতের হোটেল! সেই যেখানে আমাদের কেরানি একদিন কাজ করতো। সেই যেখান থেকে একদিন তার চাকরি চলে গিয়েছিলো হোটেল মালিককে এক মাতারির সঙ্গে এক বিছানায় সে দেখে ফেলেছিলো বলে।
তৎক্ষণাৎ পাগলির কথা মনে পড়ে যায় কেরানির। সদরঘাটের সেই পাগলি। ফুটফুটে এক শিশুর জন্ম দিয়েছিলো সে। শিশুটির মুখ গোলাপের কুঁড়ির মতো মনে হয়েছিলো কেরানির। শিশুটি কেরানির চোখ ভরে থাকে এখন।
কেরানি বলে, ভাই, সেই পাগলির কোনো খবর নাই? বাচ্চা হলো। তারপর? তারপর আর খবর নাই?
খবর!! হে হে করে হাসতে থাকে খাম্বা সামাদ। বলে, খবর? ভাই, কে কার খবর রাখে দুনিয়ায়? জিন্দিগিটা এমুন, খবর এই আছে এই নাই! নাহ, সে পাগলির ব্যাপারে চিন্তা কইরেন না। তার ব্যবস্থা হইছে!
কেরানির মনে শংকা লাফিয়ে ওঠে। পাগলি বেঁচে আছে তো? তার বাচ্চাটা ঠিক আছে তো? নাকি দু’জনই শেষ! কেরানি ভীত চোখে খাম্বা সামাদের দিকে তাকায়। নির্ণয় করতে চেষ্টা করে, খাম্বা সামাদ দুটোকেই খতম করে ফেলেনি তো! এতদিনে তার বুঝতে বাকি নাই যে খাম্বা সামাদের পক্ষে অসম্ভব কিছু নাই।
খাম্বা সামাদ প্রায় আপন মনেই বলে ওঠে, কী সোন্দর পোলাটা হইছিলো। আহা রে কার না জানি বাচ্চা! কেরানি ভাই, আল্লার বিষয়টা লক্ষ করেন! কত মানুষ সন্তানের লাইগা পাগল, ব্যাংকক হংকক ইন্ডিয়া যায়, চিকিৎসা করায়, বাচ্চা হয় না। বিষয় সম্পত্তির অভাব নাই, সুখের সীমা নাই, দুঃখ ক্যাবল বাচ্চা নাই, বাচ্চা হয় না। আর দ্যাখেন, পাগলি! রাস্তায় পইড়া থাকে, দিলে খায়, না দিলে উপাস! কেউ তারে নিয়া একদিন ফুর্তি করছে, কি একবার ঠাপাইছে, আর লগে লগে প্যাট বাইজা গেলো! তার প্যাটেই কিনা আল্লায় দিলো সন্তান! বাচ্চাটারে দেইখা আমার বড় দুঃখ হইছিলো, কেরানি ভাই।
আবার একটা সিগারেট ধরায় খাম্বা সামাদ। ড্রাইভারকে বলে, আরো আগায়া যা! টান দিয়া ছিরিপুর তক্ যাইবি।
শ্রীপুর? সে তো অনেক দূর, খাম্ভাই।
আরে, দূর কিয়ের! যাউক না। মেলা টাইম আছে। আটটার মইধ্যে ফিরা আসুম। দুই ভাই সোনারগাঁয়ে বসুম। ডিনার করুম। খাতিরজমা বয়া থাকেন। ছিনারি দ্যাখেন! আইছেন আগে এইদিকে?
না, আসি নাই।
লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে খাম্বা সামাদ বলে, হেই পাগলি! ভালা মনে করাইছেন। আপনেরে বলা হয় নাই। অ্যাতো তালে থাকি, হকল কথা মনেও থাকে না। পাগলিরে আমি পাবনা পাঠায়া দিছি। মেন্টাল হাসপাতালে। কয়া পাঠাইছি, বেবাক খরচ আমার। যা লাগে! যতদিন লাগে!
আর বাচ্চাটা?
তারে খুলনায় পাঠাইছি।
খুলনায়?
হ খুলনায়। খিরিস্টানদের এক প্রতিষ্ঠান আছে সেইখানে। এতিম বাচ্চা রাখে। যাগো বাচ্চা হয় না, তারা সেইখান থিকা বাচ্চা নিয়া পালে। ঢাকা থিকা কত মানুষ তাগো কাছে যায় বাচ্চা আনতে। পষ্ট আমি কয়া দিছি, পাগলির এই পোলাটা দিলে ভালা ঘরে দিবা, শিক্ষিৎ ঘরে দিবা, পয়সাওলা ঘরে দিবা। তারা আমারে কথা দিছে, ফুলের মতো এই বাইচ্চারে আমরা দেইখা শুইনাই পালক দিমু।
কেরানি আরামের নিঃশ্বাস ফেলে। তার মনে চিন্তা যে একটা ছিলো পাগলির ওই বাচ্চার ভালোমন্দ নিয়ে, এটা সে আগে অনুভব করে নাই, এখন টের পায়। তার মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। আর অগাধ কৃতজ্ঞতাও জাগে খাম্বা সামাদের প্রতি। এবং বিস্ময়ও! না, সে ভাবে নাই, খাম্বা সামাদের মতো একটা মানুষের মনেও তবে মায়া আছে।
কিন্তু তার প্রতি মায়া? কেরানির কাছে এটা দুর্বোধ্য, এখন পর্যন্ত। পথের এক ফুটফুটে শিশুর জন্যে মায়া, সেটা বোঝা যায়। কিন্তু কেরানির জন্যে, কেন?
কেরানি ভাবতে থাকে। মাইলের পর মাইল গাড়ি চলতে থাকে। কেরানির মনে ভাবনার ধাত ছিলো না কখনোই, এ আমরা শুরু থেকেই জানি। কিন্তু জ্বরে পড়বার দিন কয়েক আগে থেকে সে নানা বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলো। জ্বর নেমে যাবার পর দিব্যি সেটার ইতিও হয়ে গিয়েছিলো। আবার কি তবে ফিরে এলো? ভাবনা? প্রশ্ন? চিন্তা? হ্যাঁ, ফিরে এসেছে বলেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে একটা পরিবর্তনও আমরা লক্ষ করি এবার। দুশ্চিন্তা আর নয়। যে চিন্তা মানুষকে ভীত করে, তেমনটি আর নয়। কেরানির মনে শুধু বিস্ময় জড়ানো প্রশ্ন, খাম্বা সামাদ তার ভেতরে কী দেখেছে যে এত মায়া করেছে তাকে? তাকে স্বপ্নে অতীত রাজার হালে রেখেছে?
সন্ধ্যার ঘন অন্ধকারে গাড়ি চলছে। খাম্বা সামাদ হঠাৎ বলে ওঠে, এই, রোখো! রোখো! ড্রাইভার ব্রেক করে। সাইড! সাইড করো! কেরানিকে বলে, ওই যে দ্যাখেন, ভাই, দূরে ওই যে গেট! দেখছেন! ওই গেট এক বাগানবাড়ির। ভালা কইরা লক্ষ করেন। গেট! গেটের পরে রাস্তা। সেই রাস্তা যাইবেন আর যাইবেন, তবে বাড়িটা, হেই শ্যাষ মাথায়। ফাইভ স্টার হোটেলের থিকাও হাইক্লাস ব্যবস্থা। ভেতরে রাস্তার দুইধারে ফুল আর ফুলের গাছ। ফলের গাছ। কত রকমের যে সুমার নাই। হরিণ। ময়ূর। পাখপাখালি। পুকুরে হাঁস। এমুন বাগানবাড়ি দ্যাশে কারু নাই। জিন্দিগিতে কেউ দ্যাখে নাই। বাংলাদ্যাশে যে এমুন বাড়ি, চিন্তাও করতে পারবেন না।
কার বাড়ি এটা?
বাড়ি না বাড়ি না, বাগানবাড়ি! যার বাড়ি সে মাঝেমইধ্যে আসে। তারে আপনে দেখবেন! জানবেন! আপনেরে নিয়া যামু।
নামবো?
কেরানি গাড়ির দরোজা খুলতে যাচ্ছিলো, খাম্বা সামাদ হাত থাবা দিয়ে বাধা দেয়। বলে, না, না! আইজ না। মঙ্গলবার। এই গাড়ি ঘুরাও!
[চলবে]