বিকেলের বেহাগ

bikeler behag-1আট
ফেসবুকের অ্যাকাউন্ট খোলার পর তুলি তার দাদুর বন্ধুদের নামের তালিকা নিয়ে এক একজন করে সার্চ করতে থাকে। একটা নামের কমান্ড দিতেই অনেক মানুষের নাম এসে যায়। সবারই এক নাম। তখন ঠিকানা, তাদের শিক্ষা, চাকরি, বিয়ে, ছেলেমেয়ে,শখ এসব তথ্য ব্যবহার করে বাদ দিয়ে দিয়ে দেখতে হয় যাকে খোঁজা হচ্ছে ফেসবুকে তার নাম আছে কি না। এখানে বেশি সাহায্য করে ফটোগ্রাফ;ফেসবুকে প্রত্যেকের নামের সঙ্গেই থাকে ফটোগ্রাফ। যাকে খোঁজা হচ্ছে তার হালনাগাদ ছবি থাকে, যদি খুব পরিবর্তন না হয়ে থাকে চেহারায় তাহলে পরিচিতজনের পক্ষে চিনতে অসুবিধা হয় না। ড্যান বারকে পাওয়া যায় প্রমে, তার পুরাতন শহর সিয়াটলেই। তার ছবি দেখে সোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠেন এনায়েতুল্লা। মনিটরের সামনে মুখ নিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলেন, ড্যান বার, ড্যান বার। আমার পুরনো ক্লাসফ্রেন্ড। বুড়িয়ে গেছে বেশ, মাথায় চুল নেই, টাক চকচক করছে। গলার নিচে চামড়াও ঝুলে পড়েছে; টার্কি পাখির মতো দেখাচ্ছে।
তুলি বলল, এখনই তার সঙ্গে কন্টাক্ট করতে পারবেন। কথা বলার মতো হবে। তুমি যেমন তার সব তথ্য পেলে সেও তোমার তথ্য পেয়ে যাবে।ফেসবুকে আলাপ করা ছাড়াও তোমরা ফোনেও কথা বলতে পারবে। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মতো।
ফেসবুক আর গুগলস মিলে এই অ্যাপ্লিকেশন যোগ করেছি ইদানীং। এখন ফেসবুকে শুধু লিখে না,মুখের কথাও শোনা যাবে, কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে চেহারা দেখা যাবে, ঠোঁট নড়বে। মনে হবে সামনাসামনি কথা বলছ।
এনায়েতুল্লা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, দারুণ। তুই দারুণ দেখালি তুলি। একটা নতুন জগতের দরজা খুলে দিলি। থ্যাঙ্ক ইউ। মনে হচ্ছে এখন পুরনো অনেক বন্ধুর খোঁজ পেয়ে যাব।
তুলি বলল, থ্যাঙ্ক জুকারবার্গ। সে না হলে ফেসবুক হতো না। তারপর বলল, হতো। কেউ না কেউ বার করত। তবে হয়তো সময় নিত।
এনায়েতুল্লা বললেন, কত কিছু সম্ভব হচ্ছে এখন টেকনোলজির বদৌলতে। ভাবা যায় না। সময় কাটানোর কত উপায় বের হয়েছে। হারানো মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
তুলি বলল, সত্যিকার অর্থে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক।শুধু একজন না পরিচিত সবার মধ্যে যোগাযোগ হচ্ছে, নিয়মিত আলাপ করা যাচ্ছে। ব্যস্ত মানুষ আবার সামাজিক হয়ে উঠতে পারছে।
খাবার টেবিলে বসে এনায়েতুল্লা ফেসবুক নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে কথা বললেন। জয়নাব আর দাউদ খাচ্ছিল কিন্তু তুলি তখনো ঘর থেকে আসেনি।
জয়নাব চিন্তিত মুখে বলল, এর খারাপ দিকটার কথা কেউ বলে না।
খারাপ দিক? বুঝতে না পেরে তাকালেন এনায়েতুল্লা।
জয়নাব বলল, সময় নষ্ট করছে ফেসবুকে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা। এতদিন মোবাইলে এসএমএস করত,কথা বলত। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ফেসবুক। পড়াশোনার বেশ ক্ষতি হচ্ছে।
আহা। তুমি শুধু পড়াশোনার কথাই ভাব। জীবনে অন্য আরো কত কিছু আছে। থাকা প্রয়োজন।পরিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য এসব সাহায্য করে।
জয়নাব তুলির দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,ফেসবুকের জন্য অনেকের দাম্পত্য জীবনও ভেঙে যাচ্ছে। খুব সামাজিক হওয়ার বিপদও রয়েছে বাবা।
শুনে এনায়েতুল্লা চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, এর জন্য অল্প বয়সীদের তো দোষ দেয়া যাবে না। যারা এডাল্ট তাদের দায়িত্বশীল হতে হবে,নিজের বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহার করতে হবে। কেউ যদি ছেলেমানুষি করতে চায় তাহলে টেকনোলজি ছাড়াও তা হতে পারে। বলে তিনি দাউদের দিকে তাকান। দাউদ তাকে সমর্থন করে মাথা নাড়ে।
জয়নাব এত সহজে হার মানতে চায় না। সে বলে,এতদিন গেমিং আর চ্যাটিং করা থেকে মেয়েকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। পুরোপুরি পারিনি। এখন এসে হাজির হয়েছে ফেসবুক। নেশার মতো হয়ে যাচ্ছে ছেলে-মেয়েদের। টেকনোলজি অ্যাডিকশন।
দাউদ বলল, তুমি নতুন টেকনোলজির ভালো দিকের কথা ভুলে যাচ্ছ। টুইটার, ইউটিউব এসবের সাহায্যেই তো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় গণবিপ্লব ঘটতে পেরেছে। গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। নতুন
টেকনোলজি না থাকলে স্বৈরাচারী শাসকরা ক্ষমতা ছেড়ে যেত না।
জয়নাব বলল, আমাদের দেশে সেই পরিস্থিতি দেখা দেয়নি। যখন দেখা দেয় তখন প্রশংসা করা যাবে।এখন টেকনোলজি যে সমস্যা সৃষ্টি করেছে বাবা-মার জন্য, তারপর দাউদের দিকে তাকিয়ে বলল, স্ত্রীদের জন্য, সেই সমস্যা নিয়ে ভাবতে হবে।
দাউদ বলল, আব্বা তো বলেই দিয়েছেন এডাল্টদের দায়িত্বশীল হয়ে চলতে হবে। কিছু মানুষের অপকর্মের জন্য একটা ভালো জিনিসের বদনাম করা যায় না।
এনায়েতুল্লা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। তা তো ঠিকই। সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে।
তারপর বলেন, একটা ব্যালান্স এসে যাবে মানুষের ব্যবহারে। কেউ কেউ হয়তো পারবে না কিন্তু অধিকাংশই পারবে। যেমন, সবাই কি চোর-ডাকাত হয়? হয় না। জয়নাব তুমি যাকে টেকনোলজি অ্যাডিকশন বললে, তার অপব্যবহারের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সে ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার হবে।অধিকাংশই এড়াতে পারবে বিপদ, ঝুঁকি। আগেও এমন হয়েছে। যেমন ধূমপান। মদ্যপান। মাদক সেবন। নেশার জিনিস সবসময়ই মানুষের সামনে ছিল। মানুষই সেসব তৈরি করেছে, কিংবা আবিষ্কার করেছে। তার জন্য সবাই নেশাগ্রস্ত হয়ে যায়নি।
জয়নাব বলল, যা-ই বলেন বাবা অভিভাবকদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। এমনিতেই পড়াশোনার কত চাপ এখন ছেলে-মেয়েদের ওপর। তারা ঠিকমতো পড়াশোনা করছে কি না তা দেখতেই অস্থির হয়ে যেতে হয়। তার ওপর এসব…। সে কথা শেষ করে না।
এনায়েতুল্লা তার দিকে তাকালেন। জয়নাবকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। আজকাল সব বাবা-মাকেই বুঝি এমন দেখায়।
তিনি হেসে বললেন, হ্যাঁ। তা বেড়ে গেছে। আমাদের বাবা-মাকে আমাদের পেছনে এত সময় দিতে হয়নি। তখনকার সময় ছিল আলাদা।এখন আধুনিক যুগ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের কত উন্নতি ।
মানুষের জীবন একটু জটিল তো হবেই। আর সেই জটিলতার মোকাবেলা করতে সময় দিতে হবে, ধৈর্য রাখতে হবে। তবে একটা বিষয় আমি নিশ্চিন্ত।
তুলি বিপথগামিনী হবে না। আমি বেশ বুঝতে পারি তা। বয়স হওয়ার এই একটা সুবিধা। বলে তিনি হাসেন।
দশ দিন ছুটি কাটিয়ে মইনুল অস্ট্রেলিয়া চলে গেল।
যাওয়ার দিনও এনায়েতুল্লা দাউদের সঙ্গে এয়ারপোর্টে গেলেন তাকে বিদায় জানাতে। যাওয়ার সময় গাড়িতে বসে তিনি বড় ছেলেকে বললেন সে যেন তার জন্য দুশ্চিন্তা না করে।
মইনুল বলল, আপনি শরীরের দিকে নজর দেবেন।কেয়ার ফ্রি হওয়া ভালো, কিন্তু কেয়ারলেস হওয়া ঠিক নয়।
শুনে বেশ জোরে হাসলেন এনায়েতুল্লা খান।
দাউদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর ভাই খুব ভালো টেলিভিশন অ্যাঙ্করম্যান হতে পারত। শব্দ নিয়ে বেশ খেলা করে, হিউমার আছে কথায়।
তারপর নিজে নিজে উচ্চারণ করলেন, কেয়ার ফ্রি ভালো, কেয়ারলেস কখনোই না। হা হা। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, দুটোর মধ্যে তফাতটা কিন্তু খুব সূক্ষ্ম। কেয়ার ফ্রি, কেয়ারলেস, দেয়ারবাই হ্যাংস এ টেল। শেকসপিয়র মনে আছে?
মইনুল গম্ভীর হয়ে বলল, আব্বা আপনি ব্যাপারটা এত হালকা করে দেখবেন না।
এনায়েতুল্লা হেসে বললেন, এতদিন কী দেখলি এসে,কী শুনলি বাড়িতে? আমি তো হালকা করে নেয়ার প্রতিজ্ঞাই করেছি। জীবনে অনেক সিরিয়াস হওয়া গেছে। আর কত!
রাতে ঘুমোবার আগে এনায়েতুল্লা সিএনএন,আলজাজিরা আর বিবিসির খবর শোনেন। এখন তিনটে খবর এসব চ্যানেলে গুরুত্ব পাচ্ছে।
আমেরিকার সরকার গভীর আর্থিক সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। ১৪.৪ ট্রিলিয়ান ডলার পর্যন্ত ঋণ গ্রহণের যে ক্ষমতা সরকারের রয়েছে সেই সীমানা স্পর্শ করেছে ওবামা সরকার। যদি ২ আগস্টের মধ্যে এই সর্বোচ্চ সীমা বাড়ানো না হয় তাহলে সরকারের সব কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হবে। এমন আর্থিক সঙ্কটে আমেরিকা কখনো পড়েনি। সঙ্কটটা তৈরি হয়েছে রিপাবলিকান দলের একগুঁয়েমির জন্য। তারা চাইছে ওবামা প্রশাসন সোশ্যাল সিকিউরিটি এবং অন্যান্য খাতে খরচ আর করের বোঝা কমাক।ডেমোক্রটরা বলছে তারা কমাতে রাজি আছে কিন্তু ধনীদের ওপর কর বাড়াতে হবে। এ নিয়ে দুই পক্ষে দ্বন্দ্ব; কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। এ সঙ্কট নিয়ে তিনটা চ্যানেলেই দীর্ঘ আলোচনা হচ্ছে। দ্বিতীয় যে বিষয় আলোচনায় আসছে এখন তা হলো অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডকের নিউজ ইন্টারন্যাশনাল সংস্থার মালিকানায় নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকার কর্তৃপক্ষের গোপনে বিভিন্ন ব্যক্তির ফোনে আড়িপাতার কৌশল ব্যবহার। আড়িপাতার শিকার রাজকীয় পরিবার থেকে আফগানিস্তানে যুদ্ধরত সৈন্যদের পরিবার; এমনকি একজন অপহৃত কিশোরীর টেলিফোনও। কিশোরীকে হত্যা করার পরও যে তার ভয়েস মেইল হ্যাকিং করা হয়েছে এই তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর ব্রিটেনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। পার্লামেন্টে উভয় পক্ষ একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে, মার্ডক আর তার ছেলের শুনানি হয়েছে। উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত হবে বলে জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যে দেড় শ বছরের পুরনো পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে; এনায়েতুল্লা যখন বিলেতে লেখাপড়া করতেন সেই সময় এ পত্রিকাটি মাঝেমধ্যে পড়তেন। খুব উঁচুমানের পত্রিকা নয়,কিন্তু খুব জনপ্রিয় ছিল। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার মনে হলো যেন ব্যক্তিগত একটা ক্ষতি।
তৃতীয় যে খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার হচ্ছে তিনটি চ্যানেলে তা হলো নরওয়ের অসলো শহরে এবং তার নিকটবর্তী এক দ্বীপে এক উগ্রপন্থীর বোমা হামলা এবং গুলিবর্ষণে প্রায় ৭০ জনের মৃত্যুর খবর।খবরটা যখন প্রম জানা যায় তখন তার মনে হয়েছিল যে আততায়ী হয়তো ইসলামী জিহাদি কেউ হবে আর তা ভেবে তিনি বেশ দুশ্চিন্তিত হয়েছিলেন। তিনি নিজে খুব ধার্মিক নন কিন্তু তার ধর্ম ইসলামের ওপর পশ্চিমা জগতের মানুষ যেভাবে বিষোদগার করছে তার জন্য তিনি শুধু বিরক্ত নন,বেশ ক্ষুব্ধও। এর মধ্যে তিনি পশ্চিমাদের পক্ষপাত এবং ঘৃণার প্রকাশ দেখতে পান। নরওয়ের হামলাকারীর প্রকৃত পরিচয় জানার পর তিনি কিছুটা শান্ত হলেন কিন্তু পশ্চিম ইউরোপে এবং আমেরিকায় যে উগ্র ডানপন্থী ধর্মবাদীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে সে ঘটনা তাকে বিচলিত করে তোলে। পুরো ইউরোপেই বিদেশি বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে এবং তাদের আক্রমণও করা হচ্ছে মাঝেমধ্যে। এর মধ্যে তিনি নব্য নাৎসি আন্দোলনের আভাস দেখতে পান।
একদিকে টেকনোলজির অগ্রগতি আর অন্যদিকে মানুষের মন-মানসিকতায় মধ্যযুগীয় তামসিকতা,এই বৈপরীত্ব তিনি বুঝে উঠতে পারেন না।
তিনটি খবর আন্তর্জাতিক কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তাদের তাৎপর্য আছে, কোনোটি প্রভাবও ফেলতে পারে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কোনো পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলে এ তিনটি বিষয়কে খুব গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। এক ইংরেজি পত্রিকায় প্রথম দিন খবরটি ছাপা হয়েছে খুব ছোট আকারে, তাও ভেতরের পাতায়। বাংলাদেশের কম-বেশি সব পত্রিকাই মনে হয় প্রভিন্সিয়াল, অথচ এটা এখন বিশ্বায়নের যুগ। আমাদের মিডিয়ার তন্দ্রাভঙ্গ কবে হবে? ভাবেন তিনি।
তিনি টেলিভিশন দেখছেন আর এসব ভাবছেন এই সময় দরজায় কেউ নক করল বলে মনে হলো তার।
কান খাড়া করে শুনলেন। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। কেউ নক করছে। তার দরজা খোলাই থাকে, ভেজানো।
দাউদ আর জয়নাব বলেছে ওইভাবে খুলে রাখতে। কারণটা তিনি বোঝেন। শুনে হেসেছেন সেই জন্য।দাউদ আর তার স্ত্রীর সতর্কতায় তিনি মজা পেয়েছেন, ভালোও লেগেছে। তারা তার জন্য ফিল করে। তিনি টেলিভিশনের ভল্যুম কমিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, খোলা আছে। ভেতরে এসো।
তুলি ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তার হাঁটায় সতর্কতা কিন্তু চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। সে কাছে এসে বলল, আস্তে কথা বলবেন। আব্বা-আম্মা শুনতে পাবেন। তাহলে এসে ধমক দেবেন আমাকে এত রাতে জেগে থাকার জন্য। তারপর তার দিকে তাকিয়ে সে বলল, দাদু আপনিও দেখি অনেক রাত পর্যন্ত জাগেন। এখন রাত সোয়া ১২টা। বেশ রাত।
এনায়েতুল্লা বললেন, ঘুমোনোর আগে ইন্টারন্যাশনাল নিউজগুলো শুনি। আমার পুরনো অভ্যাস। তা ছাড়া দেরিতে ঘুমোলে অসুবিধা নেই আমার। আমাকে ক্লাসে যেতে হয় না তোর মতো। অফিস নেই।দেরিতে ঘুম থেকে উঠি, যখন খুশি। এটাই বুড়ো বয়সের বিলাসিতা। এখন বল দেখি এই গভীর রাতে তুই পা টিপে টিপে কেন ঘরে এলি? ব্যাপার কী?
তুলি দুই কান পর্যন্ত হাসি বিস্তৃত করে বলল, গচ্চা। গচ্চা?হ্যাঁ। আমেরিকানরা যেমন বলে থাকে। গট ইউ।ইউ মানে এখানে তুমি না তোমার পুরনো বন্ধুদের মধ্যে আরো দুজনকে পাওয়া গেছে। জাপানের হিরোশি আর নায়ারে, তানজানিয়ার। তোমার নাম,ঠিকানা আর ছবি পাঠানোর পর তারা উত্তর দিয়েছে। তারা খুব খুশি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। এসো আমার ঘরে, দেখবে নিজের চোখে। তারপর ঘরটার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল,এখানে কম্পিউটার নেই। তুমি যদি পুরনো বন্ধদের সঙ্গে ফেসবুকে নিয়মিত যোগাযোগ করতে চাও তাহলে একটা আইপ্যাড কিনতে হবে। অথবা স্যামসুং ট্যাবলেট। একই ফাংশন আর অ্যাপ্লিকেশন। দুটোই একা শ্লেটের মতো দেখতে,বেশ পাতলা আর হালকা। টাচ স্ক্রীনে আঙুল দিয়েই ব্যবহার করতে পারবে। আমি দেখিয়ে দেব। খুব সোজা।
এনায়েতুল্লা ঘর থেকে বের হতে হতে উত্তেজিত স্বরে বললেন, এভাবে সব পুরনো বন্ধুকে খোঁজপাওয়া যাবে? যোগাযোগ করতে পারব আমি?
তুলি ঠোঁটে আঙুল রেখে সতর্ক করার ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলল, সবার খোঁজ পাওয়া যাবে কি না জানি না। কিন্তু অনেককেই পাওয়া যাবে। বলেছি না বিদেশে সব বয়সের মানুষ এখন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে অংশ নিচ্ছে। সবাই কানেকটেড থাকতে চায়। আগে ব্লগ খুলে এই চেষ্টা করেছিল। এর আওতা ফেসবুকের মতো বড় নয়। ফেসবুক ইজ ফ্যান্টাসটিক। এসো তোমার পুরনো বন্ধুদের ছবি দেখ, তাদের সঙ্গে আলাপ কর ফেসবুকে। তোমার সব খবর দাও তাদের। তারাও খবর পাঠাবে। চিঠির চেয়েও দ্রুত হবে এই আদান-প্রদান। ই-মেইলে হতো দুজনের মধ্যে আলাপ, চিঠির বিনিময়।
ফেসবুকে হবে সবার সঙ্গে একত্রে যোগাযোগ। তুমি এক বন্ধুকে কী জানালে অন্যরা তা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারবে। অবশ্য ইচ্ছে করলে কোনো খবর ব্লকও করতে পার।
ব্লক করব কেন? এনায়েতুল্লা তুলির ঘরে ঢুকে বলেন।
তুলি তার টেবিলে কম্পিউটারের দিকে যেতে যেতে বলে, প্রাইভেসির জন্য।
তিনি একটা চেয়ারে বসে বলেন, এই বয়সে আমার কোনো প্রাইভেসির দরকার পড়বে না। বলার পরই তার মনে পড়ে যায় ঘরে বিছানার পাশে মার্কেজের বইটার কথা। না, তারও প্রাইভেসি রক্ষার প্রয়োজন পড়ে কখনো কখনো। নিজের বাড়িতেই পড়তে পারে।
¯স্ক্রীনে হিরোশির ছবি দেখেই চিনলেন তিনি। সেই ভোঁতা নাক, সরু চোখ, চ্যাপ্টা চিবুক। ঠোঁট একটু বাঁকা হয়ে নিচে নেমে এসেছে, অনেকটা স্মাইলির হাসির মতো। মাথার চুল কপাল থেকে সরে গেছে পেছনে কিছুটা, কিন্তু চুলের রঙ এখনো কালো। প্রায় জাপানিদেরই চুল কালো থাকে, কেননা তারা সামুদ্রিক লতাপাতা খায় খুব বেশি। এই ব্যাখ্যাটা তিনি হিরোশির কাছেই শুনেছিলেন। ছবিসহ হিরোশির তথ্য দেখতে দেখতে তিনি বললেন, এর সঙ্গে আমার দুবার দেখা হয়েছে। একবার হিরোশিমায়, দ্বিতীয়বার টোকিওতে। অল্প সময়ের জন্য দেখাশোনা হলেও আমরা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। দুজনে একসঙ্গে মাউন্ট ফুজির ওপর উঠেছিলাম। জাপানের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়।
তুলি সপ্রশংস দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদু তুমি খুব অ্যাডভেঞ্চারাস ছিলে। এখনো আছ। এই তো সেদিন সুন্দরবন ঘুরে এলে। কাউকে বললে বিশ্বাস করবে না। তারপর সে আবদারের সঙ্গে বলল, আমি যখন যাব আমাদের সঙ্গেও তোমাকে যেতে হবে।
এনায়েতুল্লা হেসে বললেন, অবশ্যই যাব। সুন্দরবন একবার দেখলে হয় না। আর তোর সঙ্গে যাওয়ার মজাই হবে আলাদা।
তুলি ফেসবুকে তার দাদুর আরেক বন্ধুর ছবিসহ তথ্য নিয়ে এলো। এটা তানজানিয়ার নায়ারের অ্যাকাউন্ট।
এনায়েতুল্লা দেখে বললেন, ব্যাটার বয়স একটুও বাড়েনি মনে হচ্ছে। আগের মতোই দেখাচ্ছে। মাথার চুল অবশ্য আগেও ছোট ছিল,কোঁকড়া। এখনো তাই। মুখের পেশি ছিল টান টান,
মেদহীন। ৭০ বছর পার হওয়ার পরও একই রকম দেখাচ্ছে। কারণ কী জানিস? বলে তিনি তুলির দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, আফ্রিকানরা খুব হাঁটে।
যখন গ্রামের স্কুলে পড়ে সেই সময় তাদের অনেককেই প্রতিদিন দৌড়ে পাঁচ-ছয় মাইল যেতে হয়। সেই জন্যই ওরা লং ডিসট্যান্স রানে এত ভালো করে। এখন দেখা যাক নায়ারের জীবনে কী কী অ্যাচিভমেন্ট। হুঁ- বলে তিনি পড়তে থাকেন।
দেখেন যে প্রম স্ত্রী মারা গেছেন। দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। সব মিলিয়ে আট ছেলেমেয়ে। তারপর হেসে বলেন, আফ্রিকানগুলো এখনো ট্রাইবাল ট্রাডিশন অনুসরণ করছে। বিগ ফ্যামিলি। মেনি
ওয়াইভস। নায়ারে দেখা যাচ্ছে আমার মতোই প্রমে সরকারি চাকরিতে তারপর একটা আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেছে। শখের মধ্যে বোঙ্গো ড্রাম বাজানো। হ্যাঁ, তা-ই তো বাজাবে। আফ্রিকানগুলো সব ধরনের ড্রাম বাজাতে ওস্তাদ। আমাকেও সে বোঙ্গো ড্রাম বাজিয়ে শুনিয়েছিল। তিনি কথা বলা শেষ করে তুলির দিকে তাকিয়ে বলেন, এরা আমার সব তথ্য পেয়ে যাবে আজই?
তুলি বলল, হ্যাঁ। পেয়ে যাবে কেন, পেয়ে গেছে ইতিমধ্যে। দেখবে এখনই তাদের মেসেজ আসা শুরু করেছে। তোমার কথার উত্তর দেবে। নিজেরাও তোমাকে প্রশ্ন করবে। এভাবে এখন তোমাদের মধ্যে আলাপ চলতে থাকবে।
এনায়েতুল্লা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, চমৎকার। সুন্দর সময় কাটবে আমার। পুরনো দিনের কথা, বন্ধুদের এখন কে কী করছে সব জানা যাবে। মনে হবে পুরনো দিনেই ফিরে গেছি। থ্যাঙ্ক ইউ তুলি। তুই না হলে এই সুযোগ পেতাম না। ফেসবুকের নাম শুনেছি, পড়েছিও কাগজে। কিন্তু আমি নিজে ব্যবহার করতে পারব, আমার কোনো কাজে লাগবে তা ভাবতে পারিনি। মনে করেছি ওটা তোদের বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য।
তুলি বলল, মোটেও নয়। সব বয়সের মানুষ এটা ব্যবহার করতে পারে। করবে, কেননা সবাই সামাজিক হতে চায়। বেশি বয়স হলে এই ইচ্ছাটা আরো বাড়ে, কেননা তখন তো ঘোরাঘুরি করার দরকার পড়ে না। আর ঘোরাঘুরি করাও যায় না।
তারপর তিনি দুঃখের সঙ্গে বললেন, আমার জাপানি বন্ধু কাইদার কথা চিন্তা কর। বেচারা এখন ওল্ড হোমে থাকছে। বুড়ো হয়ে গেলে বিদেশে অনেকেই তেমন করে, তাদের ছেলে-মেয়েরাই পাঠিয়ে দেয়। জাপানে এটা আরো বেশি, কেননা সেখানে লোকের আয়ু বাড়ছে। দুঃখের বিষয় হলো ওল্ড হোমে যাওয়ার পর ছেলে-মেয়েরা তেমন খোঁজ নেয় না,বড়জোর ক্রিসমাসে দেখতে যায় উপহার নিয়ে। এ অবস্থায় ফেসবুকের সামাজিকতা কায়দার মতো লোকের খুব কাজে লাগবে।
তুলি তার দিকে তাকিয়ে বলল, ইউ আর লাকি। নিজের বাড়িতে থাকছ। ছেলে, ছেলের বউ দেখাশোনা করছে। তারপর হেসে বলল, নাতনি তোমাকে পুরনো বন্ধু খুঁজতে সাহায্য করছে।
এনায়েতুল্লা কম্পিউটার ¯স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিকই বলেছিস। আই অ্যাম লাকি।তারপর তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, কেনচজানিস?
কেন?
আমার এই বাড়ির জন্য। ইট ইজ এ গোল্ড মাইন।ছেলেরা তা জানে।
তুলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমার এমন ভাবা উচিত না দাদু। তারা যদি সত্যি সত্যি তাই মনে করে তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে তাহলেও এমন ভাববে না তুমি। ভাবা উচিত নয়।মনে করবে তাদের ফিলিংস জেনুইন। তারা কোনো মোটিভ নিয়ে কাজ করছে না। তেমন ভাবলে নিজেই ছোট হয়ে যাবে নিজের কাছে। তোমার পাওয়াগুলো তুচ্ছ মনে হবে। মেকি, অলীক।
এনায়েতুল্লা অবাক হয়ে তুলির দিকে তাকালেন। পনের-ষোল বছরের একজন তাকে হারিয়ে দিল বুদ্ধিতে আর বিবেচনায়। বয়সের তুলনায় কত ম্যাচিউর তুলি, কত বিবেচক, কত বুদ্ধিমান। তিনি লজ্জিত হয়ে বললেন, আই অ্যাম সরি তুলি। আমার এ কথা বলা উচিত হয়নি। মনে মনে ভাবলেও বলা উচিত হয়নি।
তুলি বলল, মন থেকে ঝেড়ে ফেল চিন্তাটা। থিঙ্ক পজিটিভ।
এনায়েতুল্লা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, ঠিক বলেছিস। পজিটিভলি চিন্তা করতে হবে। লোকের সম্পর্কে ভালো ভাবতে হবে। তাদের মনের ভেতর কী আছে তা অনুমান করে মন খারাপ করার মানে হয় না। সিনিসিজম ইজ ব্যাড। তারপর ¯স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, তিনজন পুরনো বন্ধুর খোঁজ পাওয়া গেল এ পর্যন্ত। অন্যদের?
তুলি বলল, হবে। অল ইন গুড টাইম। বলেছি না সময় নেবে। একেকটা নামের মানুষ কয়েক শ। কয়েক হাজারও হতে পারে। তার মধ্য থেকে খুঁজে বের করতে সময় নেয়।
তিনি বললেন, হ্যাঁ। তা তো নেবেই। তারপর শান্ত স্বরে বললেন, তাড়াহুড়া নেই। বার কর তুই তোর অবসর সময়ে। পড়াশোনার ক্ষতি না করে। তারপর ইতস্তত করে বলেন, কুমু? কুমুর পেইজটা পেলি না
ফেসবুকে?
না। মনে হচ্ছে কুমু নামে কোনো এন্ট্রি নেই। এটা তো ডাক নাম। তার ভালো নাম মনে আছে তোমার?
ভালো নাম? ভালো নাম … বলে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন এনায়েতুল্লা। তারপর মাথা নেড়ে বললেন,না। তার ভালো নাম মনে পড়ছে না। আমরা সবাই তাকে কুমু বলেই ডেকেছি। তবে তার একটা ভালো নাম ছিল। চিন্তা করে দেখি মনে পড়ে কি না। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, অনেক রাত হয়ে গেছে ১টা বাজে। কথায় কথায় টের পাইনি। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়। তোর তো আবার কাল ভোরে উঠে স্কুল।
তুলি তাকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বলল, আমার অভ্যাস আছে। অনেক রাত পর্যন্ত পড়ে পর দিন ভোরে উঠে স্কুলে যেতে পারি। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখি। কোনো অসুবিধা হয় না।
এনায়েতুল্লা কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, তোকে কষ্ট দেয়া হচ্ছে। তোর সময় নষ্ট করছি। থ্যাঙ্ক ইউ বললে যথেষ্ট হয় না।
তুলি হেসে বলল, বলো না। ইউ আর ওয়েলকাম।
পর দিন সকালে নাস্তার পর এনায়েতুল্লা দাউদকে বললেন, আইডিবি ভবনে গিয়ে একটা ট্যাবলেট কিনতে হবে। তুই কখন ফ্রি?
দাউদ অবাক হয়ে বলল, ট্যাবলেট কিনতে আগারগাঁও আইডিবি ভবনে যেতে হবে কেন? যে কোনো ওষুধের দোকানে গেলেই হয়।
না, না। খাওয়ার ট্যাবলেট না। স্যামসুংয়ের ট্যাবলেট। অ্যান্ড্রোয়েডের অ্যাপ্লিকেশন দেয়া।ফেসবুক ব্যবহার করব ওই ট্যাবলেটে।
দাউদ কিছুক্ষণ কথা বলে না। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ফেসবুক? আপনি ব্যবহার করতে জানেন?
এনায়েতুল্লা বললেন, হ্যাঁ। শিখে ফেলেছি। তারপর ইতস্তত হয়ে বললেন, তুলি শিখিয়েছে।
শুনে দাউদ জয়নাবের দিকে তাকাল। দুজনকেই অসন্তুষ্ট মনে হলো।
দাউদ বলল, সে নিজেও ওইসব করে সময় নষ্ট করে। এখন আপনাকে দলে ভিড়িয়েছে। আব্বা আপনি ওর কথায় নাচবেন না। ও যা বলে তাই করবেন না। আপনার বয়সের কথা
ভাবুন। এসব তুলির বয়সের ছেলে-মেয়েরা করে। আপনে বই পড়ছেন, গান শুনছেন, টেলিভিশন দেখছেন। এসবই যথেষ্ট।
এনায়েতুল্লা বললেন, হ্যাঁ। ওইসবই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পেতে হলে তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ফেসবুক ছাড়া উপায় নেই। এটা খুব জরুরি। তোরাও ব্যবহার করতে পারিস।
জয়নাব গম্ভীর হয়ে বলল, ফেসবুকে কথা বলার সময় নেই আমাদের বাবা। সংসার আর মেয়েকে দেখাশোনার পর অন্য কিছু করার কথা মনে পড়ে না।
শুনে এনায়েতুল্লা গম্ভীর হয়ে যান। তারপর বলেন,আমাকে সতর্ক করার কিছু নেই। আমার সময় অঢেল। শিখে ফেলার পর তুলিকেও আর সাহায্য করতে বলব না। স্বনির্ভর হয়ে যাব। এখন যে তিনজন পুরনো বন্ধুর খোঁজ পেয়েছি তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কায়দা শেখার পর অন্য বন্ধুদের সঙ্গে নিজেই আলাপ করতে পারব। তুলির দরকার পড়বে না। কিন্তু আমার নিজের একটা কম্পিউটার দরকার।
তুলি বলল ট্যাবলেট অনেক সিম্পল।
তারপর দাউদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যখন ফ্রি থাক আমাকে বলো। আইডিবি ভবনে গিয়ে দেখে আসব। কিনেও আনা যাবে একটা। কত দাম হতে পারে? ৪০ থেকে ৫০ হাজার। সে রকমই শুনেছি। দাউদ গম্ভীর হয়ে বলল।
এনায়েতুল্লা হেসে বললেন, অনেক টাকা। কিন্তু কী করা যাবে, বুড়ো বয়সে শখের জন্য না হয় টাকাটা খরচ করলাম। একটা এফডিআর ভাঙাব।
দাউদ আর জয়নাব কিছু বলল না। তারা দুজনই টেবিলের দিকে মুখ নিচু করে বসে আছে। বোঝা গেল এনায়েতুল্লার এই শখের ব্যাপারে তারা খুব উৎসাহী নয়।
এনায়েতুল্লা নিজের ঘরে গেলেন, ভাবলেন কী করা যায়। মার্কেজের বইটা পড়া হয়ে গেছে। তিনি কোয়েলহোর অ্যালকেমিস্ট বইটা হাতে তুলে নিলেন। এটা এখন পড়তে হবে, তুলি যে কোনো দিন জিজ্ঞেস করবে বইটা পড়া হলো কি না। তিনি মার্কেজের বইটা পড়ে তেমন আনন্দ পাননি, কেমন যেন খেলো আর ভাসা ভাসা মনে হয়েছে। তার তুলনায় কাওয়াবাতার ‘স্লিপিং বিউটি’ অনেক ভালো। অনেক বেশি সুরুচিপূর্ণ। বেশ তাৎপর্যময়। একটা দার্শনিকতা আছে সেখানে। তুলনায় মার্কেজের বইতে স্থূল অনুভূতি প্রাধান্য পেয়েছে।
এনায়েতুল্লা নিজের ঘরে যাওয়ার পর দাউদ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, অনর্থক ৪০-৫০ হাজার টাকা খরচ করবেন। কোনো মানে হয় না। কতক্ষণই বা ব্যবহার করবেন। তা ছাড়া কয়েক দিন পর ফেসবুকের ব্যাপারে তার আগ্রহ কমেও যেতে পারে। নতুন খেলনা পাওয়ার পর ছোট ছেলেমেয়েরা যেমন করে থাকে।
জয়নাব বলল, এসব তোমার মেয়ের পরামর্শে হচ্ছে।সে-ই আব্বাকে কিনতে বলেছে। আমাদের সঙ্গে আলাপ না করে তার এ কথা বলা ঠিক হয়নি।
দাউদ চিন্তিত স্বরে বলল, আব্বা তুলিকে বেশ প্রশ্রয় দেন। তার কথা শোনেন। হ্যাঁ, সে-ই বলেছে তাকে ট্যাবলেট কিনতে। তোমার অনুমানই ঠিক। তবে সে কবেই আমাদের অনুমোদন নিয়ে তার মতামত জানানো বন্ধ করে দিয়েছে। এখন এ কথা বললে সে শুনবে না। বরং আব্বাকে বলে দেবে এবং তিনি তখন আমাদের ভুল বুঝবেন।
জয়নাব মাথা নেড়ে বলল, মেয়েটাকে এত লাই দেয়া ঠিক হচ্ছে না। একটা থেকে আরেকটা হবে; শেষে ওকে নিয়ন্ত্রণ করাই অসম্ভব হয়ে যাবে।
দাউদ উঠতে উঠতে বলল, নিয়ন্ত্রণের কথা ভুলে যাও। আজকাল কোনো বাবা-মাই তা পারে না।আমরা উপদেশ দিয়ে যাব আর আশা করব যে সে বখে যাবে না। বিপথগামী হবে না।
জয়নাব ঠোঁট উল্টে ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, দেখ।