বিকেলের বেহাগ

নয়
তুলিকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে, কিছুটা বিমর্ষও। কাছে থেকে দেখলে বোঝা যায় তার অবস্থা প্রায় কাঁদো কাঁদো। এনায়েতুল্লা দূর থেকে তাকে কয়েকবার দেখলেন। ভাবলেন, তার আব্বা-আম্মা হয়তো কিছু নিয়ে বকেছে তাকে। তার ট্যাবলেট কেনা নিয়ে?হতেও পারে। ঠিকই আঁচ করেছে তারা যে এর পেছনে তুলির হাত আছে। তিনি তো তাদের বলেছেনই যে তুলি তাকে ফেসবুক ব্যবহার করতে সাহায্য করছে। তুলির দিকে তাকিয়ে আর এ কথা ভেবে তার খারাপ লাগল। খবরের কাগজ পড়া শেষ না করেই তিনি তুলির ঘরে গেলেন। আজ শুক্রবার ছুটির দিন, তুলি বাড়িতেই আছে। ঘরে ঢুকে দেখলেন সে তার বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে,মাথাটা এক পাশে রেখে, দুই হাত দিয়ে দুই পাশে বালিশ দুটো চেপে ধরে। তার পায়ের শব্দ শুনে সে এদিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। তিনি দেখলেন তার দুই চোখ ভেজা; শব্দ না করে কেঁদেছে এতক্ষণ, হয়তো এখনো কাঁদছে। তিনি তার বিছানায় এক পাশে বসে ডান হাত বাড়িয়ে মাথায় রেখে বললেন,
কী হয়েছে তুলি? কাঁদছিস কেন? আব্বা-আম্মা বকেছে?
তুলি মাথা নাড়ল। না, বকেনি এটা জানাল।
এনায়েতুল্লা বললেন, তাহলে? মন খারাপ কেন?কাঁদছিস। বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছিস।
তুলি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, অ্যামি ওয়াইনহাউস মারা গেছে।
কে মারা গেছে? বুঝতে না পেরে তাকালেন তিনি।
অ্যামি ওয়াইনহাউস। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে কানড়বাভেজা চোখ হাত দিয়ে মুছল সে। তার কণ্ঠস্বর বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গেছে। কান্না আসতে চাইছে ভেতর থেকে নতুন করে। তার কথা শুনে তুলি যেন আর নিজেকে সামলাতে পারছে না।
অ্যামি ওয়াইনহাউস কে?তুলি তার দিকে ভেজা চোখ তুলে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার ফেভারিট সিঙ্গার। সেদিন বললাম না তোমাকে তাদের নাম? বেওন্সে, টেইলর সুইফট, লেডি গাগা, অ্যামি ওয়াইনহাউস। তারপর দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, অ্যামি ওয়াইনহাউস মারা গেছে। ক্যামডেনে তার লন্ডন ফ্ল্যাটে তাকে মৃত পাওয়া গেছে।
তিনি বললেন, বয়স হয়েছিল নিশ্চয়ই। বয়স হলে সবাই এভাবে চলে যায়। কেউ আগে, কেউ পরে।
তুলি মাথা তুলে বলল, সি ওয়াজ ওনলি টুয়েন্টি সেভেন। তার জীবনের সবটাই সামনে পড়েছিল।মাত্র দুটো অ্যালবাম বার হয়েছে। শেষেরটা ব্যাক টু ব্ল্যাক চার্টের উপরে উঠেছে। সোল আর পপ
মিউজিকের জন্য পাঁচটা গ্র্যামি পেয়েছিল সে দুই বছর আগে। আরো পেত বেঁচে থাকলে। কী করে মারা গেল?
তুলি চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, সে অ্যালকহলিক ছিল। হয় বেশি পানের জন্য অথবা ড্রাগ সেবনের কারণে। ইনকোয়েস্ট হচ্ছে, কারণ জানা যাবে।
শুনে তিনি বললেন, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, সীমানা অতিμম করলে এমন দুর্ঘটনা ঘটবেই। সে কি জানত না যে এমন হতে পারে?তার ফ্যানদেরও এটা জানার কথা। যা অনিবার্য ছিল তার জন্য খুব বেশি শোক হওয়ার কথা নয়। তিনি সান্ত¡না দেয়ার ভঙ্গিতে কথাগুলো বলেন।
তুলি বলল, মুশকিল হলো কী জান?এন্টারটেইনারদের নেশা না করলে চলে না। দে আর কমপেলড টু বি অ্যাডিক্ট। না হলে পারফর্ম করতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টেজে নেচে নেচে জোর
গলায় গান গাওয়া সোজা ব্যাপার না। এর জন্য অনেক এনার্জি দরকার হয়। ফলে বাধ্য হয়েই তারা ড্রাগ নেয়, অ্যালকোহল পান করে। শুধু গায়ক কেন,খেলোয়াড় আর অ্যাথলেটরাও এটা করে থাকে।
ভেরি স্যাড। কিন্তু কেঁদে কী হবে এখন? মরেই যখন গেছে মেয়েটা কাঁদলে সে তো ফিরে আসবে না।
তারপর তুলির দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলেন, হ্যাঁ মন খারাপ হবে। কানড়বাও পাবে। এটাই স্বাভাবিক।তুমি তার ফ্যান ছিলে। সে তোমার প্রিয় গায়িকাদের একজন। তার অকাল মৃত্যুতে মন খারাপ হওয়ারই কথা। কিন্তু কাঁদতে হবে কেন? সে তো ব্যক্তিগতভাবে তোমার পরিচিত ছিল না।কাঁদছি এই জন্য যে তার মৃত্যুর কারণ আমি, আমার মতো সব ফ্যান। আমাদের জন্যই তাকে মরতে হলো অকালে।
কী বলছিস তুই? বুঝতে পারছি না আমি। তোরা তার মৃত্যুর জন্য দায়ী হবি কেন? তুই আর অন্য সব ফ্যানের এতে কোনো হাত ছিল না। এনায়েতুল্লা অবাক হয়ে তাকান তুলির দিকে।
আমরা এ জন্য দায়ী যে আমাদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে, আমাদের খুশি করতে গিয়ে তাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে। দিনের পর দিন। স্টেজে উঠে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেচে, লাফিয়ে গান গাইতে হয়েছে। শরীর যেন এসব করতে অস্বীকার না করে,দর্শন-শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য তাকে ড্রাগ ব্যবহার করতে হয়েছে। অ্যালকোহলিক হতে হয়েছে। তাহলে কি আমরাই দায়ী হয়ে যাচ্ছি না তার মৃত্যুর জন্য?
তুলি তাকায় তার দাদুর দিকে। তার চোখ তখনো ভেজা।
এনায়েতুল্লা তুলির সরল মুখের দিকে তাকান। তারপর তার মাথায় হাতের আঙুল দিয়ে আদরের সঙ্গে বুলোতে বুলোতে বলেন, খুব স্পর্শকাতর তুই। তোর মনটা খুব নরম। তাই এমন ভাবছিস, এমন করছিস। আসলে মানুষ সবাই তার নিজের জন্য দায়ী। নিজের জীবনে যা হয়, ঘটে তার অনেক কিছুতেই ব্যক্তির ভূমিকা প্রধান। অন্যরাও জড়িত থাকে, তবে একই মাত্রায় না। তোরা, অ্যামি ওয়াইনহাউসের ফ্যানরা তাকে মাদকাসক্ত হতে বলিসনি। তার সুনাম হোক, জনপ্রিয়তা বাড়ুক এটা তোরা চেয়েছিস। তোদের আনন্দ দিয়ে যাক এই কামনাও করেছিস। কিন্তু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু করতে বলিসনি।
তুলি যেন অনেক দুঃখেও হেসে বলল, দাদু তুমি কথা ঘুরাচ্ছ। ব্যাপারটা কি একই দাঁড়াল না? আমাদের ওই চাওয়াতেই তো সাড়া দিতে গিয়ে তাকে অস্বাভাবিক আচরণ করতে হলো। অ্যাডিকটেড হতে হলো।
তুমি দুটোর মধ্যে কানেকশনটা দেখতে পাচ্ছ না কেন?
এনায়েতুল্লা বললেন, পাচ্ছি। কিন্তু এর জন্য তোর মতো ফ্যানদের, ভক্তদেরই সব দোষ দেব না। দিতে পারছি না। নিজের ভালো-মন্দের ভার অন্যের ওপর ছেড়ে দেয়া যায় না। নিজেরও দায়িত্ব আছে। আমরা যা চাই, যেমন হতে চাই তাই হয়ে যাই শেষ পর্যন্ত। এটাই বাস্তবতা।
তুলি অনেকক্ষণ তার দাদুর দিকে তাকিয়ে থাকল।
তারপর আস্তে আস্তে বলল, তুমি খুব ভালো উকিল হতে পারতে। কনভিন্স করার কায়দা জান।
শুনে এনায়েতুল্লা হাসেন। কোনো কথা না বলে তুলির মাথায় আঙুল বুলোতে থাকেন। তার টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখেন একটা মেয়ের ছবি। মনে হয় আজই সেখানে রাখা। মেয়েটার মুখটা উঁচু, যেন দাঁত বেরিয়ে এসেছে কিছুটা সামনে। চোখে-মুখে উগ্রতা আর অস্থিরতা। বেশ অ্যাগ্রেসিভলি তাকিয়ে আছে,বেপরোয়া ভাব। ছবিটা তিনি আগে দেখেননি;
নিশ্চয়ই অ্যামি ওয়াইনহাউস। তারুণ্যের ঔদ্ধত্ব আর বেপরোয়া ভাবের মূর্ত প্রতীক। এমন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যে ভাবা যায় না সে মৃত। তিনি দুঃখবোধ করেন, কিছুটা বিষন্ন হন। অকাল মৃত্যু,বিশেষ করে যারা প্রতিভাবান, তাদের স্বল্পায়ু তাকে সবসময় ব্যথিত করে। কারণ যাই হোক, এর মধ্যে তিনি বিধাতার বিচার খুঁজে পান না। তিনি যাদের ভালোবাসেন তাদের কম বয়সেই ডেকে নেন, এই যুক্তিও তার কাছে জোরালো মনে হয় না।