পটভূমিকা প্রসঙ্গে
পুরাণ-মিশ্রিত এই কাহিনীর পটভূমি খ্রিস্টের জন্মের সহস্রাধিক বৎসর আগের প্রাচীন পৃথিবী–পৃথিবীর এক নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। এই ভূখণ্ডের আকৃতি বাঁকা চাঁদের মত। উত্তরে তার কৃষ্ণসাগর, দক্ষিণে আরব মরুভূমি। পূর্বে পারস্য, পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর–পারস্য উপসাগর থেকে অর্ধবৃত্তাকার এই ভূমি মিশরের লোহিত সাগরের কিনারা ছাড়িয়ে গেছে।
আরব মরুভূমির বুকে তিনটি প্রধান ধর্মের জন্ম–যিশুর ধর্ম, মুসার ধর্ম এবং হজরত মুহম্মদের ধর্ম। বর্ণিত মরুভূমি থেকে ধর্মগোষ্ঠীগুলি অর্ধবৃত্তাকার জমির কোলে আশ্রয় পেয়েছিল এবং সেখান থেকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভূভাগে ছিল কৃষি জীবন নির্ভর বহু দেবদেবীর নানান বিচিত্র ধর্ম। প্রাচীন বাইবেলে পশুপালক মরুযাযাবর গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কৃষিজীবী মানুষদের ধর্ম ও জীবনগত এক নিরন্তর দ্বন্দ্বের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। বর্তমান কাহিনীতে এই দ্বন্দ্বকে মূর্তিমান ঈশ্বর এবং মূর্তিহীন ঈশ্বরের দ্বন্দ্ব রূপে কল্পনা করা হয়েছে। কল্পনাকে মরুভূমির প্রধান তিনটি ধর্মই সমর্থন করে।
পুরনো বাইবেলেই রয়েছে ভাষাগত বিভেদের কথা। কাহিনীতে বিশেষ উপাদান রূপে ভাষার সমস্যাটিকে লোটা নামের একটি কাল্পনিক চরিত্রের সাহায্যে উপস্থিত করা হয়েছে। ধর্ম এবং ভাষার সমস্যা উপন্যাসের সৃষ্টি নয়, ধর্মশাস্ত্রীরাই এই দ্বন্দ্বের রূপকার। জীবন আশ্রয় না পেলে ধর্ম বাঁচে না–মরুভূমিতে এই সত্য আবিষ্কৃত হয়। নিরন্তর এক অর্থহীন যুদ্ধের হাত থেকে জীবন পরিত্রাণ খুঁজেছে মাটির কাছে। লোটা আশ্রয় চেয়েছিল, উপন্যাসের এটিই প্রধান আকাঙ্ক্ষা। ধর্ম এবং ভাষা সভ্যতার বাহন হলেও, এই দুইটি জৈবনিক উপাদান শুধু আজকার ভারতবর্ষেই নয় প্রাচীন দুনিয়াতেও মানুষকে বিচ্ছিন্ন, দগ্ধ এবং যুদ্ধলিপ্ত করেছে। লোটা তারই নিদর্শন। এ কাহিনী। তাই মরুভূমির পটকে নির্বাচন করে শস্যশ্যামল ভূমিক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হয়েছে।
লোটার উটপূজা কোন কল্পনা নয়। হজরত মুহম্মদ নারীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, তোমরা খোদাকে সিজদা (প্রণাম) করবে। যদি খোদা ব্যতীত কারুকে সিজদা করতে চাও, স্বামীদের কর-কুত্রাপি উটকে সিজদা কর না–বোঝা যায় উটপৃজা ঐতিহাসিক সত্য। বিভিন্ন পুঁথিতে এবং লোককথায় উটপূজা আর উটের দেবতা বা নবীর কথা বর্ণিত। এভাবে বিচিত্র উৎস থেকে, এই কাহিনীর গড়ন গড়বার জন্য অজস্র (যেমন উটের পিঠে যৌনাচার ইত্যাদি) উপকথা, কিংবদন্তী বা লোককল্পনার বিবিধ উপাদান জড়ো করা হয়েছে, যা কল্পনামাত্র নয়, তা ইতিহাসও বটে–উটের পিঠে যৌনবিহারের কথা মুসলমানদের হাদিসে অবধি উল্লিখিত রয়েছে। অতএব লোটাই শুধু নয়–সাদইদ, নোয়া প্রমুখ চরিত্রগুলি কিংবদন্তী আশ্রিত হলেও সমস্তটাই সেই প্রাচীন নগর-সভ্যতার বিলুপ্ত ইতিহাসের সাক্ষ্য। সাদইদ স্বর্গ গড়তে চেয়েছিল সেদিনের নির্মিত নগরগুলির নির্মাণ আর ভাস্কর্যের বাস্তব সৌন্দর্য দেখে–নগরগুলিই তার স্বর্গ কল্পনার ভিত্তি। বাইবেল এবং কোরানে সাদইদকে নিন্দা করা হয়েছে, এবং সাদইদের জন্য অশ্রুপাতও শাস্ত্রসম্মত। এছাড়া কৃষির দেবদেবীদের কথা, সূর্যদেবতার বিবরণ একই প্রকারে প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি, যা গুহাচিত্র, প্রাচীরচিত্র ইত্যাদি থেকে উৎকীর্ণ হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে—এ-কাহিনী সেইসব গ্রন্থের প্রণেতা এবং পুরাতত্ত্ববিদদের কাছে ঋণী। ঋণী সেইসব গ্রন্থের অঙ্কিত চিত্রগুলির শিল্পীদের কাছে, সংগ্রাহক বিজ্ঞানীদের নিকট। তাছাড়া সাধারণ প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থও এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে–সব গ্রন্থের নামোল্লেখ সম্ভব নয়। প্রধান যে গ্রন্থটিকে অবলম্বন করা হয়েছে, তার প্রণেতা লরেন্স টুম্স্।
শ্রদ্ধেয়কলা-সমালোচকসন্দীপ সরকার অজস্র চিত্র এবং ভাষ্যের সাহায্যে এই কাহিনী নির্মাণে আমাকে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছেন। তাঁর সহযোগিতা ছাড়া এই উপন্যাস অসম্ভব ছিল।
–লেখক
.
চরিত্র ও স্থান পরিচিতি
ইহুদ–মুসাপন্থী এক অখ্যাত নবী।
সাদইদ–সেনাধিপতি।
লোটা–সাদইদের প্রধান সেনা।
হেরা–নিনিভে নগরীর নির্মাতা ভাস্কর।
আক্কাদ–দামাস্কাস ও মেসোপটেমিয়ার বণিক।
নমরু-মিশরের ভূপতি; মিশর-নগরী আমারনার পুরোহিত।
আবীরুদ–নমরুর পুত্র; রিবিকার প্রেমিক।
হিতেন–হিটাইট বা হিত্তীয় জাতির রাজা।
আব্রাহাম–প্রাচীন নবী।
নোহ–নৌ-নির্মাতা নবী । অপর উচ্চারণ নোয়া।
লোট–আব্রাহামের বন্ধু।
মিশাল–নৌকারিগর।
দিনার–রহস্যময় মরু-কিশোর ।
ফেরাউন–মিশরের রাজা।
মোসি–মুসা বা মজেস।
আমন–সূর্যদেবতা।
যবহ–ঈশ্বর। অন্য উচ্চারণ ইয়াহো।
ইস্তার–কৃষির দেবী।
মসীহ–ত্রাতা।
সারগন–রাজচক্রবর্তী, যিনি সাধারণ অবস্থা থেকে রাজা হয়েছিলেন।
জিব্রিল–দেবদূত।
আজরাইল–যম। জিগুরাত-স্বর্গ ।
নিনিভে–আসিরিয়ার নগরী।
কনান–প্যালেস্টাইন।
রিবিকা–নায়িকা।
রুহা–হাতকাটা দেবদাসী।
নিশিমা–দেবদাসী।
নিনিভা–হেরার দ্বিতীয় পত্নী।
.
০১.
সমস্ত রাত্রি মরুভূমির আকাশে নিশান-মাসের চতুর্দশীর চাঁদটির দিকে চেয়ে ছিল সুন্দরী রিবিকা। নিশান-মাসটি যে মুক্তির মাস সেকথা স্বপ্নদশী ইহুদ বারবার বলেছিলেন। এই মাসে নিস্তার-পর্ব পালন করছিল তারা। অথচ তাদের একমাত্র আশ্রয় এলিফেনটাইন দুর্গটি জ্বালিয়ে দিলে মিশরীয়রা। হাতির দাঁতের কারুকাজ করা মন্দিরটি ধ্বংস করল। হায় দেবী ইস্তার তোমাতে আমাতে আর কোনই বিশেষ পার্থক্য নেই।
চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পায়ের তলার ভেজা বালি পাথর আর জল মুঠো করে চেপে ধরল রূপবতী রিবিকা। রিবিকার গায়ে কাপড় নেই। পরনের কাপড়খানিও মরুদসুর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে। আকাশের নীল নদীর জলের মত উজ্জ্বল চাঁদ নগ্ন রূপসীকে দেখছে, কিন্তু নির্বাক। আকাশের ওই ক্রীতদাসী চন্দ্রমা কী বলবে তাকে? রূপ আছে কিন্তু নরদেবতা ফেরাউনের পিরামিডের আকাশ ছেড়ে কোথাও চলে যাওয়ার সাধ্য নেই। যেন সে পিরামিডের চুড়োর সঙ্গে গাঁথা। নরদেবতা সপ্তম ফেরাউন তাকে আটকে রেখেছে। তার বন্দিত্ব আর রিবিকার বন্দিত্ব নীল নদীর আকাশের মত সীমাহীন অথচ তা যেন-বা একটি পিরামিডের চূড়ার চারপাশে বন্দী।
একটি হায়েনা এসে মরুকূপটির উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে রিবিকার হৃদয় কেঁপে উঠল। মানুষ নাকি হৃদয় দিয়ে চিন্তা করে–একথাই বলেন নরোত্তম ইহুদ। সেকথা যদি সত্য হয়, তাহলে এখন সেই হৃদয় স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। পায়ের তলায় জল পাথর আর বালি ফের মুঠো ভরে আঁকড়ে ধরে বিনিদ্র রিবিকা। তারপর সে কূপটির তলা থেকে সেই ভেজা ভারী পাথর মিশ্রিত বালি উপরের দিকে ছুঁড়ে মারে। এই মরুকূপের ভিতর সে মরুদস্যুর হাত থেকে কোন প্রকারে প্রাণে বেঁচে আত্মগোপন করতে পেরেছে। উপরে দীর্ঘক্ষণ তাদের দলটির সঙ্গে দস্যুদলের লড়াই হয়েছিল সন্ধ্যার মুখে।
কেউ রক্ষা পায়নি। সকলকে হত্যা করেছে ডাকাতরা। কেবল সে লড়াই বাধার পর উটের পিঠ থেকে নেমে পালাতে শুরু করে। ঊর্ধ্বশ্বাসে মরুভূমির ভিতর দিকহারার মত ছুটতে শুরু করে। একজন ডাকাত তার পিছু পিছু তেড়ে এসে তার গায়ের পোশাক টেনে ছিঁড়ে দেয়। পরনের পোশাক ধরে টানাটানি করার সময় রিবিকা হতভাগ্য দেবী ইস্তারের নাম ধরে কঁকিয়ে কেঁদে ফেলেছিল। দস্যুটি তাকে কিছুতেই ছাড়ত না-সহসা কোথা থেকে একটি বর্শা এসে কামোন্মত্ত ডাকাতটিকে পিছন থেকে বিদ্ধ করে। লোকটি রিবিকার পরনের পোশাক ছেড়ে মরুভূমির বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে যায়।
আবার পালাতে থাকে দেবী ইস্তারের মত নগ্ন এবং রূপসী রিবিকা। কতদূর সে ছুটে এসেছে বুঝতে পারে না। যেন নীল নদীর পশ্চিম তীরে সূর্যদেবতা সামাশ ডুবে যাচ্ছেন, মরুপথ অতিক্রম করতে করতে বুঝতে পারে মাত্র–অথচ কোথায় সেই নীল নদী পড়ে রইল পিছনে। তার শস্য রাঙানো দেহতীরের বসতি ভেঙে দিল মানবদেবতা ফেরাউন–যে কিনা দুই-তৃতীয়াংশ দেবতা এবং মাত্র একাংশ মানুষ। ফেরাউনদের শবাধারলিপি সে পড়েছে। তাতে স্পষ্ট করে লেখা ছিল, চিরকাল তারা লিখে আসছে :
‘আমি কাউকে কখনও কাঁদাইনি,
আমি কাউকে কখনও কষ্ট দিইনি,
আমি পশুদের কখনও আঘাত দিইনি।
আমি কাউকে কখনও মৃত্যুদণ্ড দিইনি ।।‘
মরুপথে দিগ্বিদিক ছুটতে ছুটতে রিবিকা কতবার সেই শবাধারলিপি মনে মনে পাঠ করেছে আর দেবী ইস্তারের নাম ধরে কেঁদেছে।
বালির আঘাতে রিবিকার পা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, ফোস্কা পড়েছে। সে ছুটতে ছুটতে বালির ঢিবির পাশে পড়ে গিয়েছিল, শ্ৰমশ্রান্ত সে–তার হৃদয় আর চলছিল না। হৃদয় চিন্তা করতে পারছিল না। আস্কিলনের রাজকুমার ওয়িডিয়া হৃদয় দিয়ে চিন্তা করতেন। নরদেবতা ফেরাউন সেই হৃদয় দিয়েই চিন্তা করেছে। এমনকি পুণ্যশ্লোক ইহুদ অবধি হৃদয়ের সংকেতে কথা বলেন। কারণ এই সকল দিব্যজ্ঞানী মহাত্মাদের হৃদয় সত্যের পালক দিয়ে ওজন করেছেন ঈশ্বর–তাঁরা প্রত্যেকেই সত্যের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। অথচ রিবিকা জানে না, পালকের মত হালকা আর কোমল তার হৃদয় ভেঙে পড়বে কিনা! তার হৃদয় আজ কোন্ সংকেত বহন করছে। সূর্যদেব সামাশ মরুভূমির বুকে অস্ত গিয়েছেন, চাঁদের বেগুনি আলো পড়েছে বালিতে, যা ক্রমে রূপার গলিত বিভায় উজ্জ্বল হবে, হৃদয় মাত্র এইটুকু চিন্তা করতে পারে।
কেমন এক আচ্ছন্নতার ভিতর, ক্লান্ত অবসাদের ভিতর রিবিকার সময় কেটেছে । চারিদিকে চাঁদের আলোর ঘোর। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হলে চোখ মেলে রিবিকা। চাঁদ কোন দেবী কিনা জানে না সে, তবে ক্রীতদাসী যে সন্দেহ নেই। ইহুদের হৃদয় কি তবে সত্য বলেনি? কোথায় মুক্তি! মরুভূমির বালিতেই রিবিকা মুখ গুঁজড়ে পড়ে আছে।
ক্রীতদাসী চাঁদ জানে মাত্র তিনটি ভেড়ার লোমের বিনিময়ে রিবিকা দামাস্কাসের এক মরুবণিকের কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। অথচ সুন্দরী কনান তার মাতৃভূমি। পবিত্র দেশ কনান। আব্রাহামের মধুদুগ্ধপ্রবাহিণী স্বপ্নের দেশ, মহাপিত নোহের পিতৃভূমি। একজন বণিক, যার ছিল মদ আর লোমের ব্যবসা–রিবিকাকে তিনটি মেষের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়ে ফোরাত নদীর তীরভূমির দিকে চলে গিয়েছিল। সেই পূর্বদেশের দেবী ছিলেন ইস্তার। আকাশের দেবতা সূর্য,নাম তার সামাশ। অথচ সেই মেষপালক বণিকটি ক্ষুদে ব্যবসায়ী এবং চতুর–তাকে কন্যারূপে গ্রহণ করে, দাসীরূপে ব্যবহার করেছিল।
লোকটির নাম ছিল আক্কাদ। তার নবী ছিলেন সালেহ। সালেহ উটের নবী। পুণ্যশ্লোক ইহুদের মতই কি তিনিও মরু আরাবার নবী? নিশ্চয়ই তাই। ফোরাতের তীরে আক্কাদের ছিল ছোট একটি গোষ্ঠী।
সবচেয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আক্কাদীয় গোষ্ঠী। মাত্র গুটিকতক তাঁবুর তলে তারা বাস করত।
কিন্তু এসব ভেবে তো কোন লাভ নেই। আক্কাদ অবশ্য ইট দিয়ে গেঁথে জমরুদ পাথর গেড়ে একটি সুন্দর ইমারত গড়েছিল–তার ছিল সাদা সাদা উট আর উষ্ট্রী। আর ছিল নানা রঙের মেষ। মদের দোকান ছিল।
চাঁদের আলোয় হঠাৎ খেয়াল হল, ঠিক পায়ের কাছেই একটি অর্ধমৃত কূপ। নিচে নেমে বালি সরাতে পারলে জল পাওয়া যাবে। তৃষ্ণার পীড়নে বুক ফেটে যাচ্ছে। আর দেরি না করে রিবিকা গড়াতে গড়াতে কৃপের তলায় নেমে আসে। ক্লান্ত হাতে বালি সরাতে সরাতে মরু-দস্যুটির কামানো থুতনি আর ঝোলা গোঁফ মনে পড়ছিল। তাকে দেখাচ্ছিল আক্কাদের সাদা আর গায়ে হলুদ মুতমাথা গাধাটার মত বোকা। নিশ্চয়ই পাহাড়ী ডাকাত। একটা হিত্তীয় বাঁদর। একেবারে গোঁয়ার হাটুস। হিটাইট বা হিত্তীয় জাতিকে মনে মনে হাটুস বলে গালি পাড়তে পাড়তে বালি খুঁড়ে চলল রিবিকা। আঙুলে জলের ছোঁয়া লাগা-মাত্র সে শিউরে উঠল। যেন-বা ফেরাউনের দৈবী হৃদয় পালক আর ঐশ্বর্যময় জীবনের মত তাকে ছুঁয়েছে। উপরে চাঁদের আলোর হালকা হাওয়া বইছে। দূরের অরণ্যে কোথাও পাতাগুলি নড়ে উঠল। এই সময় মরুভূমির পশুরা বালির উপর খেলা করে। উপর থেকে হাওয়ার একটা গোলা বয়ে এসে কূপের ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই বাতাসে পশুর গায়ের রমণ করা গন্ধ।
নিঃশ্বাস টেনে কেমন বিপন্ন হয় রিবিকা। জলপান করতে করতে ভাবে, ঈশ্বরের রমণকৃত সুঘ্রাত শ্বাস দিয়ে মানুষের জন্ম। এই জল, এই জ্যোৎস্না, এই বায়ু, উপরের বন্যঘ্রাণ, মাতাল মরুভূমি, রক্তঝরা মৃত্যুশীতল বালকা–অবধিহারা তার বিস্তার–অথচ সে এক ভাগ্যতাড়িত ক্রীতদাসী কিনা মুক্তির কথা ভাবছে–যে কিনা দেবী ইস্তারের মত নগ্নিকা। কী তুচ্ছ এই জীবন!
উপরে কৃপের কিনারে ভয়ংকর সেই লম্বাটে মৃত্যুবৎ জঘন্য-দর্শন মুখটা ঝুঁকে আসে। হিংস্র আর ধূর্ত মরু-হায়েনাটা কিছুতেই যাবার নয়। রিবিকা জলের ভিতর হাত নেড়ে খলবল শব্দ করে, খুব দ্রুত এবং সবেগে হাত নাড়ে। ক্রমাগত হাতের আন্দোলনে জলের চাপা অদ্ভুত শব্দে হায়েনাটা দূরে কান পাতে এবং মরুভূমির আকাশে তাকায়। জলের শব্দ থেমে যেতেই আবার ঝুঁকে আসে। রিবিকা অতর্কিতে পাথর মেশানো বালি ছুঁড়ে মারে। ভেজা দলা পাকানো বালি গিয়ে লাগে হায়েনার জ্বলন্ত চোখে। পশুটা অন্ধের মত চিৎকার করে ওঠে। হিংসার বিদ্যুৎ গলা থেকে খেঁকিয়ে বার হয়। গায়ে মোচড় মেরে পালিয়ে যায় পশুটা।
অতঃপর কুপের তলার জলে রিবিকার হাতে আন্দোলিত জল মাত্রই যে-শব্দ ওঠে, তাতেই ভয় পায় হায়েনাটা। সমস্ত রাত্রি এভাবে কূপটা জেগে থাকে। জল, মানুষ, চাঁদ আর হায়েনা ছাড়াও নাঙা দেবী ইস্তার জাগেন।
কাল ভোরে কী হবে, কোথায় যাবে রিবিকা কিছুই জানে না। সেকথা ভাববার মত মনের অবস্থাও তার নয়। সে কেবল এই রাতটুকু কোনভাবে পার করতে চায়।
নীল নদীর দক্ষিণ প্রান্তে এলিফেনটাইন (ঐরাবত দুর্গ)। দুর্গটি ধ্বংস হয়ে গেল। ইহুদের জনগোষ্ঠী নিরাশ্রয় হল। তার আগে পর পর সাত বছর নীল নদীতে জলোচ্ছ্বাস হল না। দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। স্বাভাবিকের চেয়ে মাত্র পাঁচ ফুট নিচে দিয়ে জল বইলেই নীল নদীর অববাহিকা অঞ্চলে ফসল জন্মানো যায় না। মাটি শুকিয়ে ওঠে। পর পর সাত বছরের খাদ্যাভাবে প্রচুর মানুষ মারা গেছে। ইহুদের যাযাবর গোষ্ঠীর পশুরা মরেছে। মিশরে ইহুদের লোকবল অতি সামান্য। অথচ সামান্য এই জনগোষ্ঠীর জন্যই ইহুদের স্নেহ অসামান্য। তিনি চান পারস্য উপসাগরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণ থেকে লোহিত সাগরের কিনারা পর্যন্ত বিস্তৃত হাজার মাইলের চন্দ্রকলাকৃতি অর্ধবৃত্তাকার ভূভাগের আধিপত্য। তাঁর ধর্মের বিস্তার। এবং তিনি আব্রাহামের বায়োগোষ্ঠীর একতা যাতে হয়, সেই ইতিহাস সৃষ্টি করতে চান। তাঁর বারোটি গোষ্ঠী চন্দ্রকলাকৃতি ভূভাগে ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের তিনি খুঁজছেন।
ইহুদ কবেই (ঐরাবত) এলিফেনটাইন ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। দুর্গের চারপাশ ঘিরে গড়ে ওঠা রিবিকাদের বস্তীগুলিকে তিনি এক পরম মমতাবশত ত্যাগ করে যাননি। তাঁর সংকল্প ছিল মোসির উল্লিখিত নিশান-মাস অর্থাৎ মুক্তির মাসেই যাত্রা করবেন কানের দিকে। ঠিক এই মাসেই মাত্র ৮০ জন উৎকৃষ্ট উম্মত পরিবার সঙ্গে করে মোসি এই মিশর ছেড়ে গিয়েছিলেন একদা অতীতে। কিন্তু একদিন (১২০০-৫২৫ খ্রিঃ-পূর্বাব্দের কোন এক সময়) ইতিহাসের চাকা অতীতবৃত্তে ঘুরে যেতে লাগল পিছনে, ঘুরেই গিয়েছে বলা যায়। মিশরীয়রা মোসির আগের যুগের মত বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদের ধর্মের লোকজনকে কিনে। এনে, জোর করে ধরে এনে ক্রীতদাস ব্যবস্থার নতুন করে পত্তন করেছে এই মিশরের বুকে। দক্ষিণ-পূর্বের অসুর জাতি মিশর আক্রমণ করেছে অতীতের মত।
অবশ্য মোসি তো মাত্র ৮০ জন উম্মত পরিবারকে কনানের দিকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। পরে সেই টানে আরো কতজন বিভিন্ন স্থানে মুক্তি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু দাসত্বের শৃঙ্খল বারবার পায়ে পরেছে তারা। কেবল একটুখানি মুক্তির স্বাদ তাদের রক্তে মিশেছিল সেই কবে। সেই স্বাদ আবার তারা ভুলে যেতে বসেছে। যাযাবর জাতি স্বাধীন চৈতন্যে ঘোর, ফের মাটির টানে তার রক্ত উষ্ণ হয়, ক্রীতদাসত্বে মজে। হানাদার হিসেবে তার বদনাম যত, মুক্তি-পিপাসু এবং ভূমিবশ্য হিসেবেও তার রক্তের গড়নের দাম আছে। ইহুদ এসব বলেন।
এলিফেনটাইন (ঐরাবত) কতবার ধ্বংস হয়েছে। দুর্গের মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেছে ক্রীতদাসেরা। বিশেষত মেসোপটেমিয়ার আব্রাহামী দাসেরা চেয়েছে মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করে সাজাতে এবং দুর্গের প্রাচীর খাড়া করতে। অতঃপর দেবী ইস্তারকে মন্দিরের সর্বোচ্চ ধাপে প্রতিষ্ঠা দেবার চেষ্টা করেছে। তারা। এমনকি তারা মন্দিরের গায়ে খোদিত করেছে মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন অনুশাসনলিপি। মানবাধিকারের জ্বলন্ত উক্তি।
‘অত্যাচারী তার পাপের ভারা টানতে পারে না। তার স্পর্ধাচিহ্ন পিরামিডের চুড়ার মত আকাশম্পৰ্শী হলেও সে ডোবে।‘
এই লিপি হুবহু সুমেরীয় লিপির অনুকৃতি নয়। তার সঙ্গে আধুনিক মেজাজ এবং মিশরীয় উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। সেদিকে আঙুল তুলে ইহুদ বলেছেন–এই লিপি ইতিহাসজড়িত। কিন্তু মিশরের রাজা এতে ক্ষুব্ধ হতে পারেন। প্রাচীন অনুশাসন অবিকৃত রাখাই বিধেয়। তোমরা এভাবে প্রকাশ্য উক্তির নকশা না আঁকলেই পারে। তাছাড়া দেবী ইস্তারকে এভাবে গহনা পরিয়ে জীবিত করার মানে নেই। এ দেবী নগ্ন ছিলেন। এসব কুসংস্কার।
ইহুদেরও দেবীর উপর রাগ। কিন্তু তিনি খুব বুদ্ধিমান। সব কথাই খুব নরম সুরে বলেন। তিনি জানেন পর পর সাত বছর দুর্ভিক্ষ হলে মানুষ কৃষির দেবী, উর্বরতার বিগ্রহ ইস্তারকেই ডাকবে। নগ্ন হলেও ডাকবে । ইহুদের বোঝা উচিত, কেন, কীভাবে দেবী নগ্ন হয়েছিলেন!
রিবিকার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। সে তখন জলের তলায় হাত চালিয়ে দিয়ে শব্দ করল। জলের শব্দে হায়েনাটা আবার সরে গেল। যেন মৃত্যুর ছায়া সরে গেল চকিতে।
তার মনের ভিতর জেগে উঠল তিনটি লোম-ছাঁটা ভেড়ার করুণ নেড়া ছবি। একজন কনানীয় চাষী রিবিকাকে বিক্রি করছে। মেষের লোম স্থূপীকৃত করেছে একজন যাযাবর মেষপালক বণিক। মদের কারবারী। লোকটির হাতে ধরা লোমকাটার যন্ত্র। খুরপি চকচক করছে। আক্কাদের গাধাগুলির পিঠে ছিল চামড়ার থলে ভর্তি মদ আর শুঁটকি মাছ। সেবছর মরুভূমির হাহাকার করা শীত ছিল কনানের গ্রামগুলিতে–সে যে কী ভয়ংকর দুর্দশা!
মরুভূমিতে শীত সব বছর সমান পড়ে না। এই শীতকে চাষীরা যমের চেয়ে ভয় পায়। মেষপালক যাযাবর আব্রাহামীদের সেকারণে রেয়াত করতে বাধ্য হয় তারা। যাযাবরী তাঁবুগুলির সঙ্গে সেই সময় সদ্ভাব হয়। ভেড়ার নোম আর যাযাবরীদের হাতে বোনা লোমের পোশাক চাষী তার শস্যের বিনিময়ে কেনে। ঘটনা এমনও রয়েছে যে,একটি গরিব চাষী পরিবার শুধুমাত্র নোম পাওয়ার জন্য যাযাবরীদের চাষের জমিতে বসবাসের সুযোগ দিয়েছে। চাষবাস এবং অন্যান্য কাজের সুযোগ দিয়েছে। দ্রাক্ষাচাষ এবং মদ তৈরি শিখিয়েছে।
নগরের লোকেরা আব্রাহামীদের কেন যে বেদে বলে উপহাস করে? অমার্জিত অসভ্য বলে কটুক্তি করে? খুরপি-অলা আক্কাদের চোখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বালিকা রিবিকার দুই চোখ ম্লান হয়ে আসছিল। দুই চোখ তার বারবার ভিজে উঠছিল। ঠাকমার মুখে রাজা সারগনের গল্প শুনেছে । তিনি ছিলেন রাজচক্রবর্তী। এই আক্কাদের পূর্বপুরুষ তিনি। ফোরাত আর হিদ্দেকল নদীর তীরে ছিল তাঁর রাজপ্রাসাদ ‘জিগুরাত’ সে এক স্বপ্নবেষ্টিত পৃথিবী। আজ আর নেই। কেন নেই, সে এক অভিশাপের কথা। সে কাহিনী শুনলে মন খারাপ করে।
মানুষ রাজত্ব গড়ে, ফের রাজত্ব হারায়। আব্রাহামীদের বদনাম ঘোচে না–এরা মরু আরাবার হানাদার গোষ্ঠী। এরা বেদে। এরা নিরন্ন। দিদিমা সুর করে বলতেন :
‘আব্রাহামী হানাদার মাথা নিচু করে না,
সারগন মরে তবু সারগন মরে না ॥
নলখাগড়ার ঝুড়িতে সারগন ভাসে রে;
পীচ-আঁটা ঢাকনার ঝুড়িতে–
জর্দন নদীতে, ফোরাতের কূলেতে,
ভিস্তির কোলেতে সারগন হাসে রে ॥
তার জাত আরাবার, কাঁচাখেকো হানাদার–
বেঁচে থাকে তাঁবুতে, ঘরবাড়ি জোটে না,
যখন সে মরে যায়, কাঁচা খায় হায়েনা ॥
কবর তো জোটে না, তিন হাত জমিটুকু
তাও সে পায় না, এমনই হাহাকার–
হানাদার হানাদার, জর্দন নদীতে ফোরাতের কূলেতে ॥’
কোথায় ফোরাত আর কোথায় জর্দন! সারগন কতদূর পূর্বে পশ্চিমে উত্তরে দক্ষিণে সাম্রাজ্য গড়েছিল–সবই নিশ্চিহ্ন হয়েছে। পরে তারই জাত মিশরের ফেরাউনের হাতে বন্দী হল। সবই কপাল! এই আহাদী আক্কাদ তাকে আজ পশুলোমের বিনিময়ে মদ আর শুঁটকি মাছের বিনিময়ে খরিদ করছে বালিকা সে, তার বাধা দেবার কোনই ক্ষমতা নেই। তাকে বেচে নানী এই চাষী পরিবার। মরুভূমির শীতের হাত থেকে বাঁচবে। একটি পারিবারিক উষ্ণতার বিনিময়ে রিবিকা মধুদুগ্ধপ্রবাহিণী পবিত্র জন্মভূমি ছেড়ে কোথায় ভেসে যাবে।
আক্কাদ লোম কাটতে কাটতে হাতের খুরপি থামিয়ে ঘাড় তুলে বলল–ফোরাতের পানি তো খাওনি বাছা! দেখবে কী মিঠে! ফোরাতের হাওয়া খুব ভাল। আমার বাড়ির নাম হাওয়ামহল। খালি বসন্তের হাওয়া বয়। মরুভূমির ঠাণ্ডা পোঁছয় না। খুব তাড়াতাড়ি তুমি যুবতী হতে পারবে।
–আমি যাব না ঠাকমা! আমি কি আক্কাদের ভেড়ার চেয়ে দেখতে খারাপ!
–না বাছা! কিছুতেই না! তুমি যে খুবই সুন্দরী মাগো!
–তবে এভাবে বেচে দিচ্ছ কেন?
–তোমার ভাগ্য মা! আক্কাদের তোমাকেই চোখে ধরল কিনা! এই দ্যাখো, উনি আমাকে একখানা কুর্তা দিয়েছেন। তোমার কাকাদের লোমের জোব্বা দিয়েছেন। তোমার কাকীদের গরম বসন দিয়েছেন। সবই তোমার জন্য মা! জমিতে ভাল ফসল হলে তাই বেচে একটা উট কিনে তোমায় আনতে যাবে তোমার ছোটকাকা। ততদিনে তুমি আর কতটুকু বড় হতে পারবে–যদি বৃষ্টির দেবতা চোখ তুলে চান–সামনের সন তুমি ফিরে আসবে।
–তুমি যে বল, পূর্বদেশে যারা গেছে, তারা আর ফেরেনি!
–তারা তো যুদ্ধে মরেছে। তাছাড়া মিশরের রাজা ধরে নিয়ে গেছে। বিহিস্তুনের ডাকাতেও মেরেছে ওদের। তা ফের কারুকে ভান হ্রদে পুঁতে দিয়েছে। তুমি যাবে নিনিভে নগরী পার হয়ে, ফোরাত কি হিদ্দেকলের ধারে–সেখানে উটকণ্ঠী নৌকা ভাসছে মা। ভয় পেও না। মহপিতা পুণ্যশ্লোক নোহ তোমার সঙ্গে রইলেন!
সমস্ত ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে পড়ছিল রিবিকার। আক্কাদ সেদিন তিনটি ভেড়ার লোম কেটে তূপীকৃত করেছিল, এবং রিবিকাকে পেয়ে লোমসুদ্ধ তিনটি ভেড়াই দিয়ে দিয়েছিল কনানীয় দরিদ্র পরিবারটিকে।
লোমছাড়ানো হতকরুণ একটি মেষ যেমন, রিবিকা নিজেও তাই–ভাগ্যের কথা মনে হলে, বারবার তার তিনটি ভেড়ার ছবি মনে পড়ে। আক্কাদ তাকে যত সস্তায় কিনেছিল তত কম দামে বেচেনি, চড়া দাম নিয়েছিল মিশরীয় এক বণিকের কাছে। আসলে আক্কাদ তাকে চড়া দরে বেচে দেবার জন্যই যে। কিনেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু কেনার সময় দেবী ইস্তারের নামে, কৃষিদেবতা। বালদেবের নামে দিব্যি গেলেছিল, সে রিবিকাকে কন্যার মত দেখবে এবং বেচে দেবে না। বলেছিল-উটের গা ছুঁয়ে কসম খাই মা!
মিশরীয় সেই বণিক পুরনো নগরী আমারনার লোক ছিল। লোকটি সূর্যদেবতা আটনের জন্য রচিত সূর্যস্তোত্র আওড়াত। এর নাম ছিল নমরু। মিশরের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু সম্প্রদায়ের লোক। সংখ্যালঘু আক্কাদ করত উটের পূজা। নমরু করত সূর্যস্তব। ভাবতে অবাক লাগে, এরা দুজনই এমন ধর্ম পালন করত, যার কোন মিলই নেই। সেদিক দিয়ে দেখলে আক্কাদ ছিল বিদ্রোহী আর কোণঠাসা, একটেরে লোক। ইহুদের আবার এই দুই ধর্মসম্প্রদায়ের উপর সহানুভূতি লক্ষ্য করা গেছে। রিবিকা যখন যেখানে থেকেছে সেই ধর্মই পালন করেছে। তবে দেবী ইস্তারের মত এত স্পষ্ট কেউই নয়, অন্তত রিবিকার তাই মনে হয়েছে। এই দেবী যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা (সেকালে সেখানে অন্ন বলতে যব গম ইত্যাদি বোঝাত), কোমল, ভীরু আর নগ্ন। নবান্নের দেবী। অন্নপূর্ণাই বল আর লক্ষ্মীই বল, এত অসহায় কেউ নয়, এত পূর্ণশ্রীও কেউ না।
টুকরো টুকরো ভাবে কত ছবিই না মনে পড়ে! পূর্বদেশের নবান্নের রাত, যে-রাতে আক্কাদ তাকে প্রথম সম্ভোগ করেছিল উটের পিঠে শুইয়ে । কন্যা হয়েছিল উপপত্নী। তখন রিবিকার বুকে কেবলই কুঁড়ি ফুটেছে। স্তনবৃন্তে মর্দন করা লোকটার মেটে সাপের মত আঙুল সিরসির করছিল; ঘৃণায় আর ভয় মেশানো কামার্ধ দেহে রিবিকা কেঁদেছিল–তার যোনি-প্রদেশ রক্তাক্ত করেছিল গর্দভ-লিঙ্গ পশুটা। সে বারংবার রিবিকাকে বুঝিয়েছিল, উটের পিটে যৌন আস্বাদন করলে পুণ্য হয়, এ জিনিস সুন্নৎ। নবী সালেহ তাতে খুশী হন।
উটের কুঁজটা নবী সালেহর কবর। এখানে তিনি শুয়ে আছেন। এই অনুমান পূর্বদেশগুলির সকলেই বিশ্বাস করত। কেন করবে না? সালেহ ছিলেন মরু আরাবার আমোরাইট বা আমেলেক জাতির লোক, আব্রাহামের বংশের মানু নোহের পুত্র সামেরের গোত্রভুক্ত, তথাপি উট-উপাসক। নিশ্চয়ই বারো গোষ্ঠীর এক গোষ্ঠী এরা। নবান্নের রাতে আক্কাদের লোকজন উটকে মাল্যে পুষ্পে সুর্মা তিলকে সাজাত, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে দিত। এই রাতে তারাও দেবী ইস্তারের সামনে যৌনাচার করত। এই রাতে সমূহ গ্রাম নগরী সেজে উঠত। গ্রামে এবং নগরে সর্বত্র উৎসব চলত। চাষী জীবনে উটের প্রভাব তেমন ছিল না, কিন্তু যৌনাচারের রাতে কোন কোন চাষীপুত্র উটকে ব্যবহার করত তার আন্দোলিত পৃষ্ঠভূমিতে যৌনবিহারের জন্য।
দুটি ধর্ম–নির্দিষ্ট এই রাত্রিতে মিলিত হত। নবান্নের রাতেই আক্কাদ রিবিকাকে উটের পিঠে জোর করে তুলে নিয়েছিল। সেই সময় আক্কাদের চোখদুটি দপ দপ করে জ্বলছিল। আক্কাদের চোখে হীরা পর্বতের নীল সুমা। মোসি যে পর্বতে ঈশ্বর যবহের প্রত্যাদেশ পেয়েছিলেন, সীনয় উপদ্বীপের হীরা পর্বতটি, অতএব সীনয় পর্বতেরই সংলগ্ন অথবা সীনয়েরই অন্য নাম হেরোর বা হীরা। অথবা হীরা কোন গুহা মাত্র। যাইহোক, হীরার পবিত্র সুর্মা চাষীদের চোখেও সেই রাতে জ্বল জ্বল করছিল পশুচর্বির মশালের আলোয়। আলোর ফোয়ারা উঠছিল আকাশের দিকে। মিলনের এমন রাত পৃথিবীতে কমই আসে।
নবান্ন আর দোলের রাত একই রাত। আকাশে পূর্ণিমা। উদ্ভাসিত আলোয় প্লাবন বইছে চরাচরে। দেবী ইস্তার অলংকৃতা। ঢোল বাজছে বাতাসে। উট সুসজ্জিত। সবার পরনে বেগুনি রঙের পোশাক। মরুসরষের পাঁপড়ি আর বোঁটায় রাঙানো–বোঁটা বেগুনি, পাপড়ি হলুদ। রঙে ছোপানো হয় সেদ্ধ করার পর। রিবিকার গায়ে কাঁচুলি–দুই-তিনটি স্তরে পাতলা কাপড়ে ঢাকা বক্ষবন্ধনী)–আর কোন পোশাক নেই। মধ্যরাত্রিতে গায়ে সামান্য সুতো রাখাও নিষেধ। ধর্মের নিষেধ। দেবী ইস্তার ক্ষুণ্ণ হবেন। আক্কাদীয়রাও সেকথা বিশ্বাস করে। কাঁচুলি পরা বিদেশী নাগরিক প্রভাব । চাষীরা অনেকে কাঁচুলি পরলে ঠাট্টা এবং ঈষৎ কটুক্তি করত।
আক্কাদের মা তাড়া দিচ্ছিল–যাও বাছা! আক্কাদ উটের পিঠে অপেক্ষা করছে। বুকে ওইরকম লাগাম পরেছ, লজ্জা হয় না? এত শউরেপনা ভাল না!
কথাটার ইঙ্গিত বালিকা রিবিকা বুঝতে পারছিল না। ঢেলে সেই কখন কাঠি পড়ে গিয়েছে। দেবী ইস্তার শেষ রাতে পাতালে নামবেন। যমালয়ে প্রবেশ করবেন তিনি। যমের বাড়ি পাতালে,এই হল লোকবিশ্বাস। মাটি ও বৃষ্টির দেবতা তামুজদেব মাঠ থেকে হলুদ শস্য কেটে নেবার পর পাতালে চলে যান। যমালয়ে যাত্রা করেন। মাঠ শূন্য। একটি দানাও সেখানে পড়ে নেই। আকাশ মেঘহীন। মরুভূমির শীত সামান্য হালকা হয়েছে। দোল রাত্রি এসেছে। নবান্ন হয়েছে প্রথমে একবার। যখন ফসল উঠেছিল। এবার হচ্ছে দ্বিতীয়বার। এটাই বড় উৎসব। এই উৎসবটি হয় বীজ গমের পায়েস দিয়ে, দেবীকে খাইয়ে, তেভাগ দিয়ে, পাঠানো হয় তামুজদেবকে উদ্ধার করতে। তামুজদেব পাতাল থেকে ফিরে না এলে আকাশে মেঘ জমবে না। আঁর প্রিয়তমা দেবী ইস্তার ছাড়া তাঁকে বাঁচিয়ে তুলে যমালয় থেকে ফিরিয়ে আনার কেউ নেই। দেবীকে সাত সাতটি তোরণ অতিক্রম করে যমালয়ে পাতালে শেষ স্তরে পৌঁছতে হবে।
প্রত্যেকটি তোরণ অতিক্রম করার সময় দেবীর হাত থেকে তাঁর দৈবশক্তির প্রতীকগুলি একটি একটি করে কেড়ে নেওয়া হয়। প্রত্যেক তোরণে একটি করে প্রতীক তিনি হারিয়ে ফেলেন। সাতটি স্তরে পেঁচানো পোশাক, প্রত্যেকটি খণ্ড খুলে পড়ে প্রতিটি তোরণের কাছে। যম তাঁর বস্ত্রহরণ করেন। দেবীমূর্তির দিকে চেয়ে ছিল রিবিকা। বুকে তার কেবলই কুঁড়ি ধরেছে। বারবার সে আনমনা হয়ে যাচ্ছিল।
পুরোহিত এবার চতুর্থ খণ্ড পোশাকটি খুলে ফেলছেন দেবীর গা থেকে। চতুর্থ প্রতীক একটি নৌকা, সেটি হাত থেকে নামিয়ে রাখলেন। এই সময় বিষয় শিঙা বেজে উঠল। মৃত্যুর স্বর যেন ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। রাঙা রাত্রি যে বিষাদে ভরে যায়, অন্তত রিবিকা বালিকা হলেও বুঝতে পারে। এই যে নৌকার, প্রতীক–এটা নোহের চিহ্ন। নৌকার পুচ্ছটাতে ফের উটের মুখ আর গলা। তা ছাড়া উটের বিগ্রহও আছে।
এই সময় খানিকটা গোলমাল বাধে। প্রতীক নামাতে গিয়ে পুরুত নাকি ভুল করেছেন। চতুর্থবার নামবে উটের চিহ্ন। ষষ্ঠবারে নামবে নৌকা এবং অবশেষে বৃষমূর্তি। বৃমূর্তি হল চাষীর চিহ্ন। দেবী ষষ্ঠ তোরণ পর্যন্ত মহাপিতা নোহের নৌকায় করে যেতে পারেন। সপ্তম তোরণে গিয়ে বৃষের পিঠ থেকে পড়ে যান। অতঃপর নগ্ন দেবী ভাসতে ভাসতে গিয়ে রানী এরেসকীগালের কাছে উপস্থিত হন। এই কাহিনী ইস্তার পুরাণে লিখিত আছে। পুরোহিত সেই পুরাণ পাঠ করে চলেছেন মন্ত্রস্বরে। বস্ত্রহরণ করছেন যম। এই অনুষ্ঠানে পুরাণ-পাঠ আবশ্যিক।
মণ্ডপের সামনে থেকে নড়তে এতটুকু ইচ্ছে নেই রিবিকার। অথচ আক্কাদের মা বারবার ডেকে পাঠাচ্ছে। কেন যে এভাবে ডাকছে এবং বারংবার আক্কাদ উঠের পিঠে ওঠাতে চাইছে বোঝা যায় না। উঠের পিঠে ওঠা মানে যে একজন কুমারীর পক্ষে খুব মারাত্মক, রিবিকা শুনেছে–কিন্তু দোলের এই রাত্রি তার কাছে কোনই আনন্দ বহন করে না। প্রথমে বুঝতে না পারলেও ক্রমশ রিবিকার মনে হচ্ছিল, তার বিপদ হবে।
দেবী ইস্তারও কুমারী। তামুজদেব তাঁর প্রেমের উপাস্য পুরুষ। তাঁর সঙ্গে অবৈধ মিলনে আকাশে মেঘ জমে, মাটি উর্বর হয়। মাটির সঙ্গে চাষীর হলের সম্পর্ক, বলপ্রয়োগের সম্পর্ক। যে দেবী তামুজকে উদ্ধার করেন, তাঁরই যৌন-প্রহারে দেবী দুঃখ এবং আনন্দ পান। পুরাণের মস্বরে সেকথা আছে। দুঃখ আর আনন্দ মেশানো দোলরাত্রি বিষাদে আচ্ছন্ন হয় এই মুহূর্তে।
দেবীর তরফে আর্তস্বর পুরুতের গলায় ধ্বনিত হয় :
‘আমাকে ছেড়ে দাও, যাতে আমি যে-দেশে গিয়ে কেউ ফেরে না, সেখানে যেতে পারার সান্ত্বনা পাই, জানি সে দেশ বিষণ্ণতার, সে দেশ অন্ধকারের। (ইয়োব ১০ : ২০-২১)।
এই পূর্ণিমা রাতে বস্ত্রহৃতা দেবীর বিসর্জন। আর্তস্বরে সমস্ত গ্রাম আর আলোকোজ্জ্বল নগরীগুলি মথিত হচ্ছে। একই সঙ্গে চুড়ান্ত দুঃখ আর আনন্দ পাওয়ার অনুভূতি রিবিকার হয়নি। তার জীবনে অবৈধ কোন প্রেমও নেই। সে জানে আক্কাদের উটের কুঁজটা নবী সালেহের কবরভূমি। যে নবী মাটিতে ঠাঁই পাননি মৃত্যুর পর। সমগ্রজীবন মরু আরাবার পথে পথে, ফোরাতের তীরে তীরে। তাড়িত হয়ে ফিরেছেন। শুধু তৃষ্ণার জল দিয়েছে মরুবাহক উট। উটই ছিল তাঁর দেবতা। সালেহের জীবনও ইস্তারের মত। দুঃখের রূপ তো একই। অসহায় যে তার একই কষ্ট। দেবী প্রতীক হারিয়ে অন্ধকার পাতালে প্রবেশ করেন, সালেহ ঘুরে মরেন মরুভূমির উষর পথে পথে।
প্রতি বছরই দোলরাত্রির দেবী-অর্চনায় উটের প্রতীক নামানোর সময় পুরুতে পুরুতে গোলযোগ বাধে। পুরোহিতরা অবস্থাপন্ন এবং প্রচুর জমির দখলদার। তারা সালেহের উপাস্যদের পছন্দ করে না। এরা যেহেতু মরু আরাবার যাযাবর জাতি, হানাদার–তাই ঘৃণ্য। এদের বাস্তু নেই, নির্দিষ্ট কোন বাসভূমি নেই, এরা তাঁবুতে থাকে। জোর করে পূর্বদেশীয়দের শস্যভূমিতে ছাগল মেষ উট নিয়ে ঢুকে পড়ে–জবরদখল করে জমি। এই অতীতে বহুবার ঘটেছে। পরে এরা বাস্তু পেয়েছে কিন্তু কখনই নিজস্ব ভূখণ্ড পায়নি, জবরদখল করাই এদের নিয়তি। এদের ইতিহাস দীর্ঘ। এরা যখনই নিজস্ব বাসভূমির জন্য কোন এক স্থানে তাঁবু স্থাপন করেছে, গ্রাম ও নগরের মানুষরা ক্ষুব্ধ হয়েছে।
অথচ দিনে দিনে এরা চাষীজীবনের সঙ্গে খুব একটা দূরত্বও রাখতে চায়নি। বরং মিশে যেতে চেয়েছে। তাদের যাযাবরী অনেক প্রথাকানুন ত্যাগ করে, কোথাও বালদেব, কোথাও দেবী ইস্তারের উপাসনা শুরু করেছে। চাষবাস শিখে স্থিতু হয়েছে। শুধুমাত্র মাংসভুক এই শ্রেণীর মানুষ তাদের কাঁচাখেকো বদনাম ঘোচানোর জন্য চাষীদের ঘরে বৈবাহিক সম্বন্ধ গজার চেষ্টা করেছে। কিন্তু চাষীরা আপন ঘরের গৌরীদান করতে হামেশা কুণ্ঠা প্রকাশ করে। বরং যাযাবর মেয়েদের ঘরে বউ করার পর চোর বলে খোটা দেয়। আসল বউ নয়, উপপত্নী।
রিবিকার মা ছিল কনানীয় পরিবারে দ্বিতীয় শ্রেণীর বউ। অর্থাৎ রক্ষিতার চেয়ে সামান্য উন্নত। উপপত্নী মাত্র। রিবিকার বাবা রূপে মুগ্ধ হয়ে পরিবারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁর থেকে মেয়েটিকে ঘরে তুলেছিল। পরে কালাজ্বরে বউটি মারা যায়। উপপত্নীর মেয়ে বলে বাতৃ আর জমিতে রিবিকার কোন আইনগত অধিকার ছিল না।
আক্কাদ ওকে পশুলোমর বিনিময়ে খরিদ করল। একজন যাযাবর বণিক চাইছে–পরিবার তেমন কোন আপত্তিই করল না। কেনই বা করবে!
রিবিকার মায়ের মুখের ভাষা ছিল অন্যধারা। পরিবারের পাঁচজন নাকি বুঝতেই পারত না। কে জানে কী ছিল–মাকে তো রিবিকার তেমন মনেই নেই। ভাষাভেদ মানুষকে বিভিন্ন করে, খাদ্যাভ্যাস আলাদা করে দেয়–সর্বোপরি ধর্ম কখনই এক হতে দেয় না। অথচ রিবিকার বাবা ছিল মহাপিতা নোহের বংশধর। নোহ কি যাযাবর ছিলেন না? নোহকে কেন যে সবাই চাষী মনে করে? চাষী বটে, জেলেও বটে, মিস্ত্রীও বটে। তিনি নৌকার কারিগর, চাষের উদগাতা, বীজ ও জীবের পালক। অথচ তিনিও মহাপুরুষ পুণ্যশ্লোক আব্রাহামেরই পূর্বপুরুষ।
তা সত্ত্বেও বিভেদ কম নয়। আব্রাহামীরা একদা যখন বাবিলনের পতনের পর ঈশ্বর যবহের অভিশাপে ভাষাভেদ হল বারোটি গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে গেল মরুনগরী আর গ্রামগুলি এবং মরুছাউনিগুলিতে, নোহ তাঁর নৌকায় সকল গোষ্ঠীর বীজ ও জীবকে স্থান দিয়েছিলেন-তিনি ভাষাভেদ গণ্য করেননি–যাযাবর কি চাষী, ভেদাভেদ করেননি।
রিবিকার বাবা যদি মাকে পত্নীরূপে বিবাহ করতেন, তাহলে বোধহয় রিবিকা এভাবে বিচ্ছিন্ন হত না। আক্কাদ মরুবণিক যাযাবর সালেহর কউম। ঠাকুমা একবার ভেবেও দেখলেন না কার হাতে পড়ছে মেয়েটি! যেখানে যাচ্ছে। সেখানকার অবস্থা কীরকম। তিনটি মেষ আর মেয়ে কি সমান? কনানীয়দের গণিতের ভাষা কি এই ধারা? মন্দিরের দেবীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রিবিকা আপন মনে ফুঁপিয়ে উঠল। চতুর্থ প্রস্থ কাপড় খণ্ড খুলে ফেলেছে। পুরোহিত।
উটের চিহ্ন নিয়ে বিবাদ। আসলে আক্কাদীয়দের কেউ চায় না। মন্দিরে উটের ঠাই দিতে গভীর কুঠা-পুরোহিতরা চরম অসন্তোষে প্রতি বছর দোলের রাতে বিবাদ বাধায়। তারা চায় আক্কাদীয়দের উচ্ছেদ করতে। কিন্তু আক্কাদ অনেক চাষী পরিবারের লোম, মদ আর শুঁটকি মাছ দাদন দিয়ে মাথা খরিদ করে রেখেছে। আক্কাদের এই উন্নতি পুরোহিতরা সহ্য করতে পারে না।
সালেহ মরুপথে ঘুরে মরেছেন। উটের মাংস আর তৃষ্ণার জল দিয়ে তাঁর বাহক মানুষের জীবন রক্ষা করেছে–তাঁর দলকে নিয়ে ঘুরেছেন তিনি উষর মরু, নীল বনানী, সবুজ উপত্যকার চন্দ্রকলাকৃতি পথে। তাঁর পূর্বপুরুষ আব্রাহামের মত তাঁরও চোখে ছিল একটি পবিত্র দেশের স্বপ্ন, মধুদুগ্ধপ্রবাহিনী দেশের মেঘমেদুর ছায়ায় তিনি আশ্রয় এবং সমাধির স্বপ্ন দেখেছিলেন।
সালেহ পাননি। উটের কুঁজই তাঁর সমাধিক্ষেত্র। মন্দিরের সামনে থেকে রিবিকাকে আক্কাদের ভগিনী এসে জোর করে হাত ধরে টানল। আক্কাদের উটের কাছে এনে রেখে গেল। ইস্তার পুরাণে উট-উপাস্যদের বিধর্মী এবং বিদেশী বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে দেবী তাঁদেরও বাঁ হাতে গমশীর্ষ উপচার নেন। দেবী হতভাগ্যদের অমোচন করেন। অসভ্য জাতিরা সংযত থাকলে দেবী প্রসন্ন থাকেন। দেবী গমশীর্ষ চান–উট-উপাসক যেন নিজের জমি থেকে সেই ফসল উৎপাদন করে।
কিন্তু সালেহর যেখানে মরবার মত সাড়ে তিনহাত জমিই ছিল না–সেক্ষেত্রে তাঁর সংখ্যালঘু গোত্রটি জমি কোথায় পাবে–গমই বা ফলাবে কোথায়?
রিবিকাকে মন্দিরের চৌহদ্দির অনেক দূরে দাঁড়িয়ে দেবী ইস্তারের অর্চনা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছিল, এমন সময় আক্কাদ-ভগিনী সেবা তাকে টেনে নিয়ে এল।
বলল–ওভাবে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? পোশাক-খোয়ানো নাঙা দেবী নিজেই তো বাঁচে না, তোমায় কি রাখবে গা? নবী সালেহর আশ্রয়ই আসল। পাতালে গিয়ে ভাসেন যে-দেবী, ইজ্জৎ যার নিজেরই নেই, তা ফের গমের শীষ! কথায় বলে কিসে আর কিসে–তামা আর সীসে! কোথায় সালেহ আর কোথায় ইস্তার। এসো তেতা, দাদা সেই কখন থেকে সেজে বসে আছেন ভোলায়।
উটের পিঠে দোলা চাপানো হয়েছে। সেবা বলে ভোলা। ঠেলা দিয়ে সেবা রিবিকাকে উটের পিঠে তুলে দিতেই উটটা চলতে শুরু করল।
মৃত্যবৎ জঘন্য-দর্শন কুৎসিত লম্বা মুখাকৃতি হায়েনাটা ফের ফিরে এসেছে। কূপের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রিবিকাকে দেখছে। সঙ্গে সঙ্গে রিবিকা সতর্ক হয়। জলের তলায় সজোরে হাত এবং আঙুল নেড়ে জলকে সরব আর হিংস্র করে তোলে। জলের যেমন সুন্দর ধ্বনি আছে, ফোরাত আর হিদ্দেকলের নদীতে সুর আছে, আছে জর্দনে আর নীল নদীতে সংগীতের ধ্বনিমালা, পার্বত্য নদীগুলির গান আছে ঝিরিঝিরি, তেমনি সেই জলেই রয়েছে হিংসা। ভয়াবহ প্লাবনে সেই হিংসারই ছবি ভেসে ওঠে।
কূপের জল মায়াবী। রিবিকার প্রাণরক্ষা করেছে। ফের সেই জলকে হিংস্র করে তুলে তাই হয়েছে তার অস্ত্র। হিংসা দিয়ে হিংসা দমন করা একটা শিক্ষা বটে। কিন্তু একে দমন না বলে, বলা উচিত–হিংসা ঢাল এবং হিংসাই তরবারি। শুধু আত্মরক্ষার জন্য ইহুদের ঈশ্বর এই হিংসার পক্ষপাতী। কোমল আর মৃদু এই হিংসা আজকার এই জলের মত সত্য। একজন ক্রীতদাসের হিংসা এরকমই নরম আর মায়াবী হতে বাধ্য।
যবহের হিংসা কোমল আর মায়াবী। সীনয় পাহাড়ে তাঁর আত্মা রয়েছে। তিনি জ্বলে ওঠেন কিন্তু কখনও দাবানল ঘটান না। চোখে এই দৃশ্য দেখা যায়। হঠাৎ আকাশের তলা আর পাহাড়ের চূড়া রক্তিম হয়ে ওঠে। আগুন লাগে আকাশের গায়ে। অথচ আকাশ থেকে গন্ধক বৃষ্টি হয় না, মানুষ পুড়ে মরে না। যবহের পবিত্র চোখ থেকে আগুনের সংকেত বার হয়। যবহ পবিত্র নাম। মনে মনে তাঁকে ডাকতে হয়। তিনি বাবিলের স্বর্গ (জিগুরাত)-এর পতন হলে পিতা আব্রাহামকে ডেকে নিয়েছিলেন। মহাত্মা মোসিকে তিনি মিশর থেকে উদ্ধার করেন। যবহ এক রহস্যময় ঈশ্বর। তাঁর সংকেত আছে। জ্বলে ওঠা আছে, হিংসা আছে কোমল আর মৃদু। যবহ, কে? যবহ কেমন?
ইহুদ বলেন, তাঁকে দেখা যায় না। তিনি অদৃশ্য। তিনি সংকেতকারী। তাঁর উদ্দেশে নিশানমাসে ঢেরা-চিহ্ন আঁকতে হয় ঘরের দেওয়ালে। এই চিহকরণের ক্রিয়াপথ হল নিস্তার বা স্বস্তিকা। যারা চিহ্ন আঁকে তারা যবহের লোক। বান্দা। যবহের দাস কখনও ফেরাউনের দাস হতে পারে না। যবহ বলেন–আমি কে। এই প্রশ্ন করো না। আমি যা আমি তাই। আমার চিহ্ন যারা আঁকে তাদের আমি রক্ষা করি। বন্যা এবং খরার হাত থেকে নিস্তারীদের বাঁচাই। শিলা ও গন্ধক বৃষ্টি তাদের মাথার উপর হতে দিই না । উত্তরের পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে ফেলে তাদের হত্যা করি না। মরুভূমির তপ্ত হাওয়া ছড়িয়ে বালিঝড় দিয়ে ফসল এবং প্রাণ নষ্ট করি না। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত করি না আমার উপাস্যদের। মরুদস্যুর আক্রমণ থেকে তাদের রক্ষা করি। আমি তোমাদের মুক্ত করি।
কিন্তু মহাপ্লাবনের কথা মনে আছে? আমি শুধুমাত্র নোহ এবং তার নিজের লোকেদের ত্রাণ করেছিলাম। কিস্তি (নৌকা) বানানোর বুদ্ধি আমি নোহকে দিয়েছিলাম। আমি বুদ্ধি এবং জ্ঞান দান করি। তোমার শত্রুদের জন্য বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, মরুলু, গন্ধক বৃষ্টি ঘটাই। ফেরাউনের ধ্বংসের জন্য এইসব দুর্যোগ সৃষ্টি করি। ভয় পেও না–কারণ নোহ ভয় পায়নি। নিস্তার-পর্বে ঢেরা-চিহ্ন আঁকো–আমাকে স্মরণ করো। তোমাদের গুণ-চিহ্নিত গৃহ আমি রক্ষা করব। আমি গন্ধক বৃষ্টির হাত থেকে আব্রাহামকে বাঁচিয়েছিলাম। বন্যার হাত থেকে নোহকে রক্ষা করেছি। আমি মোসিকে চূণ অবস্থায় তার মায়ের পেটে লালন করেছি। এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যে, ফেরাউন বুঝতে পারেনি মোসির মা গর্ভবতী। গর্ভাবস্থার সমস্ত লক্ষণ আমি গোপন রেখেছিলাম। সেই স্ত্রীলোকের তলপেট এমনভাবে নির্মিত ছিল যে, মোসি যে রয়েছে তা বোঝার উপায় ছিল না। পেট ফোলেনি, স্বাভাবিক ছিল। নিয়মের এই বৈকল্য আমার ইচ্ছাধীন। নইলে সেই সময় ফেরাউনের নির্দেশ ছিল মোসির উম্মতদের যত স্ত্রীলোক গর্ভবতী হয়েছে, তাদের হত্যা করা হোক। আমি গোপন করতে পারি এবং প্রকাশ করতেও পারি। আমি ওই শিশুকে আগুনের ভিতর বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।
যখন ফেরাউনের সেপাই শিশুহত্যার জন্য প্রবেশ করল, আমি উনুনের ভিতর মোসিকে ঠেলে দিলাম। আগুন তখন নিবে গিয়েছিল। আমারই নির্দেশে আগুন নেবে এবং প্রজ্বলিত হয়। পাহাড়ে যে আগুন জ্বলে ওঠে–এ-সবই সেই সংকেত মাত্র। সেপাই সর্বত্র শিশু মোসিকে খুঁজেছে তন্নতন্ন করে, পায়নি। আমি তাকে উনুনের ভিতর রেখেছিলাম। উনুনে যে শিশু থাকতে পারে একথা শিশুর মা অবধি বিশ্বাস করেনি। কারণ আমিই তাকে গড়িয়ে দিই।
রিবিকা, তোমার মত সুন্দরী তন্বীকে আমিই কুপের ভিতর গড়িয়ে ফেলেছি, তোমাকে আমি কূপের অন্তরালে গোপন করেছি। জলকে হিংস্র করে তোলার বুদ্ধি আমিই তোমাকে দিয়েছি।
মোসি যখন তার দলবল নিয়ে লাল দরিয়া (লোহিত সাগর) পার হচ্ছেন তিনি তাঁর হাতের লাঠিকে ইশারা করেন, উত্তাল জলের উপর আঘাত করতেই জল দু’ভাগ হয়ে পথ সৃষ্টি হয়। সেই পথের উপর একখানা পাথর পড়ে ছিল, যবহ মোসিকে নির্দেশ করেন, আঘাত করো। মোসি তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে পাথরের উপর আঘাত করেন, পাথর দু’ভাগ হয়। যবহ মোসিকে এই লাঠি দান করেছেন। এই লাঠি দিয়ে তিনি মেষ চরান। মেষ যেমন লাঠির নির্দেশে একমুখে প্রবাহিত হয়, যবহ তাঁর উপাস্যদের সেইভাবে একত্রিত করেন, একাভিমুখী করেন।
ইহুদের হাতেও অনুরূপ একখানি লাঠি আছে। তিনি সেটি মাথার উপর ঘুরিয়ে বলেছিলেন–পাথর দু’ভাগ হলে দেখা গেল একটি ঘাস ফড়িং একটি ঘাস মুখে করে সমুদ্রের তলায় পাথরের ভিতর বেঁচে আছে। যবহ তাঁকে ঘাস যোগাচ্ছেন। এইভাবে তিনি গোপন করতে পারেন। রক্ষা করতে পারেন।
অথচ এলিফেনটাইনের ঢেরা-চিহ্নিত সমস্ত গৃহ এবং দুর্গটি মিশরীয়রা বেছে বেছে জ্বালিয়ে দিয়েছে। যবহ প্রেরিত মৃত্যুদূত ইহুদীদের রক্ষা করেনি। স্বপ্নদর্শী ইহুদ বলেছিলেন–সাত বছর দুর্ভিক্ষ হয়েছে, সাত বছর নীল নদীতে জলোচ্ছ্বাস। হল না–এ-সবই যবহের নির্দেশ–মিশরীয়রা দুর্বল হয়েছে এবার আমরা। কনানের দিকে চলে যেতে পারব। তাই সবাই চিহ্ন এঁকেছিল। নিস্তার পর্ব পালন করছিল। এই সময় অগ্নিসংযোগ করল মিশরীয়রা বাইরের শত্রু আক্রমণ করল ফের মিশরকে। লুঠ, হত্যা, ধর্ষণ চলতে লাগল। সবই কি যবহের নির্দেশ? আগুনের হাত থেকে মোসি বেঁচেছিলেন কিন্তু রিবিকাদের। কত প্রাণ চলে গেল! যবহ তাঁর বান্দাদের এমন শাস্তি দিলেন কেন?
রিবিকা কূপের তলায় আর্তনাদ করে উঠল–ঘাসফড়িঙের মুখে ঘাস জোগাও জানি, কিন্তু আমার বস্ত্র কেড়ে নাও। দেবী ইস্তার তো নাঙা থাকে। মহাত্মা ইহুদ!
যদি আমরা ঢেরা না আঁকতাম, আমাদের অনেকগুলি গৃহ বেঁচে যেত। চলার পথে মোসিকে যবহ যে লীলা প্রত্যক্ষ করালেন ওই পাথর দু’ভাগ করে, তার মহিমা যাই হোক, দেবী যে নগ্ন থাকে, এ তো মিথ্যা নয়। নগ্নতাই এখন বাস্তব, ধর্ষণের ফলে ছিন্ন রক্তাক্ত যৌনাঙ্গ বাস্তব, দু’পা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়া বাস্তব, পথের উপর বিচ্ছিন্ন মস্তক, ওপড়ানো চোখ বাস্তব, উটের পিঠে চড়িয়ে বালিকাকে যৌনপ্রহারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলানো বাস্তব–মনে পড়ে। সবই মনে পড়ে। এবং উপরে প্রহরারত মৃত্যু অবাস্তব নয়।
আক্কাদ বলল–রিবিকা! আজ দোলের রাত! আমি যৌন-বিহারের জন্য পাঁচটি উট চাষার ছেলেদের ভাড়া দিয়েছি। উটের দোলনে রতিমোচন আনন্দদায়ক। একজন বুড়োলোকও এই রাতে বালিকাদের দিয়ে গা লেহন করায়। ওই দ্যাখো…
একটি চালার নিচে দৃশ্যটি দেখা গেল। এক বৃদ্ধকে দুটি নগ্ন নারী চাঁদের ছায়ায় লেহন করে চলেছে। সমস্ত বুক এবং যাবৎ অঙ্গ লালায় মথিত হচ্ছে। বুকের পাঁজর দ্রুত প্রকম্পিত হচ্ছে কামনাতাড়িত বাতাসে। শিঙা বেজে উঠল মন্দির চাতালে। বৃদ্ধের মুখ দিয়ে রক্ত উথলে এসে গলা ভিজে যাচ্ছে। বুড়োটি রোগগ্রস্ত। এই রোগ ছোঁয়াচে–অথচ দুটি তরুণী বধূ তাকে লেহন করছে। মৃত্যু এবং যৌনতা এত ঘনিষ্ঠ যে সহ্য হয় না। কাম এবং পুনর্জীবন তো ইস্তারের উপাসনা মাত্র। ফসলের জন্ম আর মৃত্যু আর জন্মই জীবন।
আঙুল তুলে দেখিয়ে আক্কাদ রিবিকাকে বলল–এসো! রিবিকা বলল–তুমি আমার পিতা। ক্ষমা করো!
আক্কাদ বলল–তুমি আমার কেনা। ক্রীত যা তাই হল দাসী। তোমাতে আমার অধিকার। পালক পিতা পালিতাকে এমনি কেনে না। কুঁজের এদিকে মাথা রাখো।
কবরের দিকে মাথা রেখে রিবিক মৃত্যু আর যৌনতার মাঝখানে ছটফট করে ক্রমাগত একটি অন্ধকার স্রোতে তলিয়ে যেতে লাগল। যেন ইস্তার চলেছেন পাতালে।
.
০২.
মরু-হায়েনাটার গায়ে ভোরবেলার সূর্যের আলো এসে যখন লাগল, সে তখন অরণ্যের দিকে চলে গেল। কূপ থেকে উঠে এল রিবিকা। সূর্যদেব আটনের দিকে জলভরা দুই চোখ মেলে চাইলে সে। আমারনার বণিক নমরুর স্তোত্রোচ্চারণ মনে পড়ছিল তার।
‘দুনিয়ার সকল কিছুর একমাত্র স্রষ্টা তুমি,
যা কিছুর অস্তিত্ব চোখে পড়ে এবং পড়ে না,
সমস্তই একা তুমি সৃষ্টি করেছ;
তোমার চোখের ভিতর থেকে যাবৎ মানুষ
বেরিয়ে এসেছে। তোমার মুখ থেকে
দেবতাগণ অস্তিত্ব লাভ করেছেন;
দেবতাদের মধ্যে তুমিই রাজা ॥”
[মিশরীয় প্রাচীন কবিতা]
মহাপৃথিবীর আকাশে তুমি কোথাও সামাশ, কোথাও-বা তুমি আটন অথবা আমন। তুমিই আমেন। ঈশ্বর। অথচ তোমার এই আকাশ অবধিহারা–সবখানে তুমি রয়েছ। রিবিকা বিড়বিড় করে বলল–নারীর কতটুকু লজ্জা পাওয়া উচিত হে দেবতা! মরুপথ দিয়ে রথ এবং অশ্ব পূর্বে পশ্চিমে ছোটাছুটি করছে–কখনও-বা নেমে আসছে উত্তরের পর্বতগাত্র বেয়ে। কারা এরা? কাউকে আমি চিনি না। কে শত্র কে মিত্র আমি জানি না। শুধু জানি আমার লজ্জায় পৃথিবী লজ্জা পায় না–পৃথিবী মানে ওই আকাশ, ওই পাহাড়, সমুদ্র, লাল দরিয়া, নীল নদী, আকাশচুম্বী পিরামিড, অথবা আলোকোজ্জ্বল নিনিভে নগরী, বাবিলের স্বর্গের সিঁড়ি, কেউ লজ্জিত হয় না–ম্লান হয় না দেবতা সামাশ। হা আমীন, হা আমীন, যুদ্ধশেষে যে জেতে, যুদ্ধের পাওনা এই নারী তার হয়। আমি কারো নই, আমার মূল্য মাত্র তিনটি পশুলোমের সমান।
আমারনার সূর্যমন্দিরে আমি ছিলাম সকাউৎসর্গীকৃত নারী। হা দেবতা, তুমিই আমার বর। তামুজদেব নয়, তুমি। দেবদাসী রিবিকাকে কে তোমার দাসী করেছিল মনে আছে? একজন সম্পত্তিশালী পুরুত! নমরু নামেমাত্র বণিক–আসলে সে ভূপতি। ঘরে অনেকগুলি বউ। আমি ছিলাম তোমার ভোগ্যা–হে দেবতা! অথচ তোমার নামমাত্র। মন্দিরে রেখে নমরুই আমাকে ভোগ করত। মানুষ দেবতার নামে যা দেয়, তা আসলে নিজেরই জন্য দখলে রাখে। দেবতার ছুতা না দিলে ক্রীতদাসী হালাল হয় না–অধিকারেও থাকে না। নারী ‘তাহলীল’ হয় আমনদেবের মন্দিরে, শুদ্ধ হয়। আক্কাদের এটো মাল দেবতাকে দিয়ে শুদ্ধ করিয়ে নিয়েছিল নমরু।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম আলো-ঝরানো সূর্যের দিকে ফের চোখ তুলল রিবিকা। মরুপথ অশ্বের ক্ষুরের উৎক্ষিপ্ত ধূলায় একটা সমাচ্ছন্ন মেঘের মত পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। তারই আড়াল ধরে অরণ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে রিবিকা। তার আর চলবার শক্তি নাই। অথচ তার থেমে পড়ার মত কোন ছায়া সে দেখতে পাচ্ছে না। এইভাবে একলা পথ হেঁটেছিলেন মহাপিতা আব্রাহাম।
চন্দ্রকলাকৃতি ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব দিকের অসুর জাতি অতীতে পুনঃ পুনঃ যে বীভৎস আক্রমণ করে মিশর থেকে ইহুদের পূর্বযুগের মোসির উম্মতদের টেনে এনে তাদের নগরগুলিতে বন্দী করেছিল–সে এক ভয়াবহ আতঙ্কের ইতিহাস; আজও সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। অসুররা কতবার যে মিশর আক্রমণ করেছে তার সঠিক হিসেব করা হয়নি। এরা পার্বত্য হিত্তীয়দের মতই। দুর্ধর্ষ। মিশরও কম যায়নি। প্রতি-আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু মোসির মত ইহুদও শান্তি চান। তাঁর অভিযাত্রা অবশিষ্টদের নিয়ে, যারা অসুরদের হাতে এখনও বন্দী এবং যারা আজও মিশরের ক্রীতদাস মাত্র। মোসির অসম্পূর্ণ কাজ তিনি সম্পন্ন করতে চান। তিনিও আব্রাহামের মত দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত থেকে অর্ধগোলাকৃতি পথে দক্ষিণ-পশ্চিম কিনারা পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেন।
এই পথে কাঠের তৈরি তেতলা সাঁজোয়া গাড়ি গেছে। বন্দীদের বহন করে নিয়ে গেছে অসুররা। নিনিভে নগরীর দিকে চলে গেছে সৈন্যবাহিনী, রথ আর পদাতিক। অশ্ববাহিনীর পদচিহ্ন পড়েছে পথে। এই দৃশ্য কত পুরনো, যুগযুগান্তর একই দৃশ্যের অবতারণা করছে নগরনির্মাতা মানুষ–কেন করছে। কিছুই বোঝা যায় না।
রিবিকা পথের দিকে চেয়ে আঁতকে উঠল। তার হৃদয় স্তব্ধ হয়ে গেল।
সারি সারি খুঁটা পোঁতা–মানুষের মুণ্ডুহীন ধড় এবং কোথাও শুধুমাত্র গুচ্ছবাঁধা ছিন্ন মুণ্ড ঝুলছে। রক্ত টুপিয়ে পড়ছে বালির উপর লাশ পচে গলে পড়ছে, মরুশকুন আর শৃগাল খুঁটিগুলিকে ঘিরে গোল বৃত্ত রচনা করেছে, রিবিকা শৃগালগুলিকে হায়েনা ভেবে শিউরে ওঠে। পশুদের জিহ্বা লাল আর রক্তমাখা। শকুনের চঞ্চতে মানুষের হাড় আর পচা মাংস ধরা। সবই যেন মরুপথের চিরন্তন। দৃশ্য। এ-দৃশ্য কিন্তু রিবিকা এই প্রথম দেখল। অসুররা চিরদিন এভাবেই পথ অলংকৃত করে মৃতদেহ সাজিয়ে। অধিকাংশই পুরুষদেহ। আক্রান্ত জাতির পুরুষ। ধ্বংস করা একটা যুদ্ধনীতি। পুরুষকে শেকল পরিয়ে সাঁজোয়ায় তোলা বীরত্বের নমুনা। বন্দী করে কৃষিজমিতে চাষে জোড়া, পাথর কাটার কাজে নিয়োগ করা সবই যুদ্ধের উদ্দেশ্য। সুন্দরী মেয়েদের পুরুষহীন করা এবং ধর্ষণ করা এক ধরনের বিক্রম। মেয়েরাও শ্রমিক হয় দ্রাক্ষাক্ষেত্রগুলিতে।
কচি খেজুর রসের মত, নবীন সান্ধ্য রসের মত কৃষককন্যার গায়ের গন্ধ অসুরদের মুগ্ধ করে। যৌনতার এই মৌতাত তাদের সংগীতকে মাদকতায় পূর্ণ করেছে। মিশরীয়দের মত এরা ফুলের ঘ্রাণের উপমা প্রয়োগ করে না। ফোরাতের তীরেও একই ধরনের গান গাইত কিছু শ্রেণীর লোক। একটি খুঁটায় ঝোলানো নারীদেহ দেখে রিবিকার সেই গানের সুর মনে পড়ে। ভয়ে আর ত্রাসে সেই সুর পাখির ডানার মত মনের ভিতর ঝাঁপটায়-হৃদয়কে আঘাত করে।
রিবিকার দিকে পশুরা হিংস্র হলুদ চোখ মেলে তাকায়। রিবিকা ভয়ে অরণ্যের দিকে ছুটতে শুরু করে। ইহুদ কোথায় সে জানে না। খুটা পোঁতা পথ কতদূর গেছে সে জানে না। ইহুদকে সাঁজোয়ায় করে অসুররা তুলে নিয়ে গেছে কিনা তাও সে জানে না। ইহুদ চলেছিলেন পায়ে হেঁটে। তাঁর দল সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। রিবিকা হাঁটতে পারছিল না বলে দয়ালু ইহুদ তাকে উটের পিঠে চড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর উটের পিঠে ছিল আরো কিছু রমণী–তারাও আর নেই। উটের সঙ্গে পায়ে হাঁটা লোকেরাও নিশ্চিহ্ন, নিশ্চয়ই। তারা খুঁটায় ঝুলছে অথবা বালির উপরে শুয়ে আছে, বেঁচে নেই। হতে পারে অসুররা নয়, হিত্তীয়রা মেরে ফেলেছে।
এমন অরণ্যও এই প্রথম দেখছে রিবিকা। সমুদ্রের ভেসে আসা স্বল্প মেঘ এই অরণ্য রচনা করেছে। ক্ষুদ্র অরণ্য। দূর থেকে সমুদ্রের তান ভেসে আসছে। বৃক্ষপত্রের মর্মরধ্বনিও বেজে চলেছে। দেবদারুগাছ, ঝাউ আর শালসেগুনের গাছ, তাল খেজুর বীথি আছে, পাশেই রয়েছে দ্রাক্ষাকুঞ্জ। ফলবতী দ্রাক্ষা মৌমাছির পুঞ্জে গুঞ্জিত। একটি কৃষ্ণবর্ণ গাছের ছায়ায় আশ্রয় পায় রিবিকা। চারিদিক সৌরভে মুগ্ধ, আবিষ্ট। রক্তাক্ত নৃশংস মৃত মুণ্ডমালিকা-সজ্জিত পথ ছেড়ে এসেছে সে। রথ, অশ্ব, বর্শা, সাঁজোয়া, মরুকূপ, হায়েনা, শৃগাল শকুন–সেই ত্রাস এখানে নেই। দূরে রয়েছে মৌন সুদৃশ্য পাহাড়। অদ্ভুত স্তব্ধতা জমাট বেঁধে সৌরভ আর গুঞ্জনে ফুরিত করছে এক অপার সংগীত।
হঠাৎ রিবিকার চোখে পড়ল একটি বাচ্চা মেষ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কালো কুঞ্চিত কেশ সারা গায়ে, কিন্তু ছোট ঘোট। মেষটির বয়স খুবই কম। মরুযাত্রীরা ফেলে চলে গেছে। মরুদস্যুরা ওকে নেয়নি। রিবিকার অত্যন্ত মায়া হল। সে ওকে ধরবার জন্য হাত বাড়াল–আ মসীহ! বলে দু’হাত সামনে প্রসারিত করল রিবিকা।
হাতের নাগাল থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাণীটি। মনে হল একে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে সে। এই প্রাণীই তার নগ্নতাকে আড়াল করতে পারে।
এক দেবদাসীকে ভালবেসেছিল এক মিশরীয় যুবক। নমরুর জোয়ান পুত্র আবীরুদ। আবীরুদ রোজ মন্দিরের চারপাশে ঘোরাঘুরি করত। সূর্যমন্দিরের সামনের একটি গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়ে থাকত সারা দুপুর। রাত্রে আসত চুপিচুপি। বলত–আমি তোমাকে দু হাত রাঙানোর প্রচুর মেহেদি পাতা দিতে পারি, ঠোঁট রাঙানোর জন্য দিতে পারি সুগন্ধি পাতা আর পা রাঙাবার প্রসাধন–সব দিতে পারি এবং দামাস্কাসের পাথরের মালা এবং আমাদের প্রসিদ্ধ আতর। আমার জন্য তুমি কি দুয়ার খুলবে না? আমি তোমার জন্য অশ্ব আর। সুর্মা প্রস্তুত রেখেছি। নীল নদীর উপর চাঁদ ঝুলে আছে–এসো আমরা সম্বন্ধ পাতাই। তুমি আমার বোন। এসো বিয়ে করি।
মুখে ছেলেটির এ ছাড়া কোন কথাই ছিল না। যেন মরু-দোয়েল। ক্রমাগত শিস দিয়েই চলেছে। মরু-চাতকের মতই ছিল আবীরুদের পিপাসা। পাখির সেই ডাকে মন খারাপ করত। পিরামিডের নিঃসঙ্গ চূড়াকে আর্তস্বরে প্রদক্ষিণ করত পাখিটি।
এই পাখিটিই যেন আবীরুদ। অথচ আবীরুদের সঙ্গে আপন বোন দীনার বিবাহ স্থির ছিল। ভূসম্পত্তি রক্ষা করতে হলে আপন বোনকে বিয়ে করাই বুদ্ধির কাজ। নমরু যখন জানতে পারল তার ছেলে তারই রক্ষিতা দেবদাসী রিবিকার। প্রেমে আসক্ত হতে চলেছে, তার হৃদয়ে পিরামিড ভেঙে পড়ল।
মিশরীয়রা উট পছন্দ করে না। কিন্তু অশ্বে তাদের অশেষ ভক্তি। কারণ যুদ্ধপ্রিয় হিত্তীয়রা অশ্বশিক্ষা জানে–অশ্ব সবচেয়ে দ্রুতগামী এবং শক্তিশালী পশু। উট শ্লথগতি এবং বিকটদর্শন। একজন মিশরীয় যুবক যখন তার। প্রেয়সীকে অশ্বের কথা বলে, তখন সে তার আভিজাত্য আর আধুনিক মনের পরিচয় দেয়। রিবিকা ছিল উট-পূজকের রক্ষিতা এবং দেবী ইস্তারের মত দুর্ভাগা। ফলে তার সূর্যমন্দিরে আশ্রয় হয়েছিল। তার প্রতি একজন ভূপতি। সূর্যপুরোহিত আসক্ত হতে পারে, কিন্তু সে তার ছেলের সঙ্গে সেই ‘সদকা’ নারীর বিবাহ কস্মিনকালেও দিতে পারে না।
তথাপি একদিন রাত্রে আমারনার মন্দির থেকে রিবিকা আবীরুদের সঙ্গে ঐরাবত মন্দির (এলিফেনটাইন) দুর্গের এলাকায় অশ্বধাবিত হল। রাত্রির উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত নদী নীল। তারই কিনারা ধরে ছুটে চলল অশ্ব। বসন্তের দীপ্র হাওয়ায় রিবিকার মাথার চুল উল্লসিত আবেগে কম্পিত হল ছন্দে ছন্দে। সে আবীরুদকে পিছন থেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে অশ্বের তীব্র বেগ সামাল দিচ্ছিল–এই তার অনিঃশেষ স্মৃতি, উষ্ণ আর উতল।
যখন মিশর আক্রান্ত হল, ইহুদের উম্মতরা নিস্তার-পর্ব পালন করল, নিশান-মাস এল–আগুন লাগল সিবিকাদের ঘরে ঘরে–আবীরুদ নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। একটি বর্শা এসে তাকে বিদ্ধ করে মাটিতে ফেলে দিল। সেই বর্শা ছুঁড়েছিল মিশরীয় বণিক পুরোহিত নমরু। অসুররা আবীরুদকে মারেনি। পিতার হাতে পুত্রের জীবননাশা হয়েছিল। নমরু থুৎকার দিয়ে বলেছিল–এ মাগী বেশ্যা। দেবতা আমন তোকে ঘৃণা করে। ইহুদ ছাড়া তোকে নেবার কেউ নেই।
আবীরুদের সঙ্গে খুব স্বল্প সময় রিবিকা একটি তাঁবুতে বাস করেছিল। এই জীবন যাপনের কোন মানে হয় না। আবীরুদ তাকে কোনদিনই ঘরে তুলতে পারত না। নমরু এই সম্পর্ক স্বীকার করবে কেন? মরু-যাযাবরের মত আবীরুদ তাঁবুতে দিন কাটাত-সঙ্গে সুন্দরী রিবিকা। এলিফেনটাইনের (ঐরাবত মন্দিরের) অধিবাসীরা তাদের সন্দেহের চোখে দেখত। এই জীবন কোনদিই মিশরের মাটিতে প্রতিষ্ঠা পাবে এমন সম্ভাবনা ছিল না। তবু সেই তাঁবুর জীবনে আকাশে মরু-চাতকের করুণ স্বর কখনও থামেনি।
লোকে আবীরুদকে ঠাট্টা করে বলত–অমন সুন্দর প্রাসাদ ছেড়ে ছেলেটা ওই পূর্বদেশী একটা ইস্তারীকে নিয়ে পড়ে আছে! দেবদাসীকে ঘরে তোলার সাধ্য তো নেই। আমনের বউকে গৃহ দিতে নেই, সে মন্দিরের সরকারী মাল । ছোঁড়াটা দু’দিন মধু লুটছে। আসলে ঘেন্নাপিত্ত থাকলে আমারনা থেকে পালিয়ে আসে-সঙ্গে একটা উটমুখী মেয়ে। হায়, একেই বলে ভ্যাগাবন্ডী! জীবনে হুতোশ লাগলে কে ঠেকায়!
ফেরাউনদের শবাধারলিপিতে খোদিত ছিল :
‘আমি কাউকে কখনও কাঁদাইনি,
কাউকে কষ্ট দিইনি। কখনও কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিইনি।’
মিশর রিবিকাকে কেবলই কাঁদিয়েছে। আবীরুদকে মেরেছে। চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে অশ্বারোহণের উদ্দাম চঞ্চল বেগবতী স্মৃতিই রিবিকার দহ্মানো জীবনকে আরো দন্ধেছে। জীবনের কোথাও সে আশ্বাস পায়নি জন্মাবধি। তার দেহে। খেজুর রসের নবীন স্বাদু ঘ্রাণ মিশরীয় আতরে মজ্জিত হয়েছে মাত্র–সেই সজ্জা, সেই রাতের গভীর উত্তেজক যাত্রা তাকে কাঁদায়।
ইহুদ তার পিঠে হাত রেখে মন্দ্রস্বরে বলেছিলেন–একটি মেষশাবক তোমায় পথ দেখাবে রিবিকা। সেই তোমার নিয়তি। কারণ মাসি সেই বাচ্চা মেযেদের ভালবাসতেন।
রিবিকা আবার ভেড়ার বাচ্চাটির দিকে হাত বাড়াল। তার হাসি পাচ্ছিল স্বপ্নদর্শী ইহুদ অদ্ভুত কথা বলেন। তাঁর পয়গম্বরী রহস্যময়। তিনি স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা একটি পবিত্র দেশের কথা বলেন। মর্তের এক অমরাবতী সেই কনান। মধু আর দুধ বইছে তার মাটিতে, উপত্যকায় স্বর্ণশস্যে ম ম করছে হাওয়া।
এই সংগীতময় অরণ্যের মর্মর ব্যঞ্জিত সুঘ্রাত হাওয়া এসে রিবিকার নগ্ন ত্বকে স্পর্শ দিচ্ছিল। সমস্ত রাত্রির জাগরণের ক্লান্তি দু চোখে ঘুমের আবেশ এনে দিয়েছিল, সে আর চোখ তুলে চাইতে পারছিল না। তথাপি সে জোর করে দু চোখ প্রসারিত করল। ভেড়ার বাচ্চাটিকে ধরবার জন্য ছুটে গেল। বাচ্চাটি অরণ্যের ভিতর ছুটে যেতে লাগল।
রিবিকা অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করেছিল। সে আর ভেড়াটিকে দেখতে পেল না। স্বপ্নদশী ইহুদের কথা কি সত্য? তাই যদি হবে তাহলে এই অরণ্যে পথ কোথায়? সে তো পথ হারিয়ে ফেলেছে। এ অরণ্য আর যাই। হোক নিরাপদ নয়। মনে হচ্ছিল হিংস্র জন্তু রয়েছে, ডাকাতদল থাকতে পারে। যে-নারীর জীবনের দাম মাত্র তিনটি ভেড়ার লোমের ওজনের সমান–তাকে একটি মেষশাবক পথ দেখাবে কী করে? ইহুদ তাঁর ধর্মের প্রতীক মেষের কথা বলেছেন। মেষশিশু মানে সেই মসীহ, সীনয় পাহাড়ে যাঁর ঈশ্বরের সঙ্গে কথা হয়েছিল। মুসা, মোসি, মসীহ।
হঠাৎ শিঙার আওয়াজ কানে এল রিবিকার। সে উৎকর্ণ হয়ে উঠল । আবোরা প্রবেশ করল ভিতরে। চোখে পড়ল তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি ভূমিক্ষেত্রে লোজন রয়েছে, তারা সৈনিকের পোশাক পরা এবং বিচিত্র রঙের বলিষ্ঠ অশ্ব চিৎকার করছে। রিবিকা ভয় পেয়ে পিছনে ফিরল এবং দ্রুত দৌড়তে লাগল। মেষশাবককে নিকটে আকর্ষণ করে। বস্ত্রখণ্ড তুলে নেয়। তার বুকে প্রজাপতির ডানা মৃদু স্পন্দনে যেরকম তার শ্বাসপ্রশ্বাস যেন সেই ছন্দে স্পন্দিত। কিন্তু তবু সে এই জীবনকে বিশ্বাস করতে পারে না।
প্রজাপতি দুটি তার বুক থেকে উড়ে পালাবার ক্ষমতা রাখে না। ক্রমে মৃত্যুই স্বাভাবিক। মধুর লোভে যে এই দুটি প্রাণ এসেছিল তা সে বুঝতে পারে উপরে চোখ তুলে। বিরাট কালো মধুচক্র। যেন মেঘ। ক্ষুদ্র পিরামিড উল্টো করে। ঝোলানো, যেন ঝুলন্ত শিলা। টুপিয়ে পড়া মধু মৃত্যুসোমরস। কী বোকা রে তোরা! নারীর বুকের এই পুষ্পফুল্লতা মায়াবী, এ যে পুষ্পভ্রম মাত্র! যদি আক্কাদ। কখনও নারীর বুকে চন্দ্রোদয় দেখত অথবা পুষ্পকলিকার বিকাশ লক্ষ্য করবার প্রতিভা পেত! একজন মরুবণিক তা পারে না। তার তো মদ আর শুঁটকির কারবার। মরুর রঙ ধূসর। দামাস্কাস থেকে ফোরাতের তীরে বাসা বেঁধেছিল ঐশ্বর্যের লোভে কারবার ফলাবার জন্য। বোকা চাষীদের ঠকিয়ে মুনাফা করার জন্য। তার চোখে মেয়েমানুষ খরিদা সম্পত্তি, যুদ্ধে পরিত্যক্ত মাল। সে কখনও মিশরের শৃঙ্গার রসের কবিতা পড়েনি।
‘নারী তুমি মেষপশমের মত হালকা
তোমার দাম নেই, ওজন নেই–
তবু তোমাকে ফুলের বিনিময়ে খরিদ করা যায় না।
মরুশীতে উষ্ণপশম দিতে পারিনি প্রিয়া–
আতর আর সুর্মা তাই বৃথা গেছে। আমার তো
ফুলের বাজার–খদ্দের আসে না ।।’
ভূপতির ছেলে আবীরুদের মেজাজ আতর আর সুর্মার মেজাজ। কিন্তু প্রিয়ার জন্য শীতের পশম কেনার সামর্থ্যও তার ছিল না। তাঁবুর জীবনে পশুর লোম যোগাড় করা সমস্যা, কিন্তু সেই দুঃখকে সে সস্তা আতরে আর সুর্মায় এবং ফুলে ভরিয়ে তুলেছিল। অন্তত তার মুখের কবিতায় তার দারিদ্র্য আর বাদশাহীপনা। একাকার হয়ে যেত। বস্ত্রখণ্ড গায়ে জড়াতে জড়াতে সেই কবিতার সুর কানে ভেসে আসছিল স্মৃতির ধুনে। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল রিবিকা।
হঠাৎ তার চোখ চলে যায় সামনের দেবদারু গাছটির দিকে। আড়া থেকে একখানি পা বেরিয়ে এসেছে। সৈনিকের জুতা পরিহিত এই পা সে ‘মশরের মাটিতে দেখেছে। শরীরের তুলনায় এই পা সরু হয়, পাতা একটু বেশি লম্বা এবং ভারী, কিন্তু পাতার তুলনায় পায়ের উপর অংশ মিহি, অসুন্দর পা। এই পা মরুভূমিতে দ্রুত ছুটতে পারে। কিন্তু চোখ দুটি হয় ভেতরে ঈষৎ ঢোকানো, দয়ার্দ্র। সেই চোখ সুদূরাভিসারী। মুখ খুব সুন্দর এবং মায়াময়। ঠিক ঠাকুমার বিবরণ অনুযায়ী সারগনের পা। রাজচক্রবর্তী সারগন। বাদশা সারগন। মনে পড়ল, সারগন মরে, তবু সারগন মরে না।
লোকটি সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে ওর ক্ষুদ্র বর্শা। পিছনে একটা দীর্ঘদেহী। তুষারধবল অশ্ব। মনে হচ্ছে সাদা আগুন দাউদাউ করছে। লাগাম ধরা রয়েছে বাঁ হাতের আঙুলে। পিঠের দু’পাশে ঝুলন্ত রেকাব, পিঠে গদি আঁটা। অশ্বের মুখ ঈষৎ ফেনশুভ্র। লোকটি শৌখিন।
এ অশ্ব হিত্তীয় অশ্ব। লোকটির পা দুখানি দেখে বোঝা যায় মানুষটি অসুর নয়। কিন্তু মুহূর্তে আসুরিক ঘটনা ঘটে যায়। ক্ষুদ্র বর্শাটা নিক্ষিপ্ত হয় নিরীহ ভেড়াটির গায়ে এবং মায়াভরা শিশুমেষ মাটিতে গেঁথে গিয়ে পিছনের দু পা শূন্যে উঠে যায়, ছটফট করে, এত চকিতে ঘটে যে,ভেড়ার বাচ্চাটি মরবার আগে কাঁদবার সময় পায় না। তার হৃদক্রিয়া রুদ্ধ হয় নিমেষে। সে তাকে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করে গেল, কিন্তু প্রাণ দিতে বাধ্য হল।
লোকটি বলল–আমি বিনিময়ে বিশ্বাসী। কাপড় দিয়েছি, ভেড়ার মাংস আমার। আশা করি দুঃখ পাওনি। অবশ্য এতটুকু মাংস কাকে দেব? আমার শিবিরে এখন আটাশজন সৈন্য কসরত করছে।
একটু থেমে লোকটি বলল–তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।
বলেই লোকটি বর্শায় গাঁথা মেষটিকে কাঁধে তুলল। তারপর রিবিকার খুব কাছে এসে দাঁড়াল-তোমাকে তাই বলে হত্যা করব ভেবো না। যারা তোমাকে এবং তোমার ভেড়াটিকে ছেড়ে গেছে, হয়. মরেছে, নতুবা পালিয়েছে, তাদের সরদার হয় সৎ পুরুত,নয় কপট মসীহ (নবী)। কারণ সৎ পুরুত ভীতু হয়, কপট মসীহ হয় কাপুরুষ। মসীহর হাতে লাঠি থাকে বটে, কিন্তু পথের বাঘ বা হায়েনা থোড়াও ডরায় না। যুদ্ধই জীবন-যুদ্ধ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। শিরোপা, পদাধিকার, সৌধ, একটি ছোট পাহাড়। সোনাদানা তো বটেই, খাদ্য পানীয় সুরা। এমনকী তোমার মত সুন্দরীদের। শৌর্য থাকলে পথের উপরই সব পড়ে থাকে। দেবতাদের ধন্যবাদ, এই জীবন যেন কখনও শেষ না হয়। ভাগ্যিস অসুররা মিশর আক্রমণ করেছিল! এসো!
বলে লোকটি ক্লিবিকার বুকের দিকে হাত বাড়াল। ঈষৎ ক্রুদ্ধ স্বরে বলল–তুমি আমার ভাষা বুঝতে পারছ না?
রিবিকা বলল–সব কথা পারিনি। তবে আমি অনেক ভাষা জানি। ভাষা বুঝে আমার লাভ নেই। আমাকে ছেড়ে দাও। আমার বাঁচার ইচ্ছে নেই। আমাকে ছোঁবে না। হাত সরাও।
সাদইদ বলল–খাওয়া-দাওয়ার পর তোমার ফের বাঁচতে ইচ্ছে করবে। একদণ্ড দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখেই তার বিশ্বাস স্থির হল যে ওরা দস্যুও হতে পারে, ফের দুর্ধর্ষ সৈনিকও বটে। এটা তাদের গোপন শিবির। অশ্ব এবং অস্ত্রচালনা, শিক্ষা করছে। এদের হাতে পড়লে তার আর নিস্তার নেই।
রিবিকা দিগভ্রান্তের মত ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। তারপর এমন এক স্থানে এসে পড়ল যে,মনে হল এদিকে ওরা আর আসবে না। ওদের অশ্বধ্বনি আর শোনা যাচ্ছে না। ওদের দৃপ্ত গলার স্বরও অরণ্যের আড়ালে ঢাকা পড়েছে।
এবার রিবিকা আছাড় খেয়ে দেবদারুর তলায় পড়ে গেল দু চোখ শীতল ক্লাসের ছোঁয়ায় ক্লান্তিতে ক্ষুধায় বুজে এল। গাছে সুরেলা পাখি ডাকছিল। বাতাসে বিচিত্র বর্ণের প্রজাপতি উড়ছিল। কিছুই আর চেয়ে দেখতে পারছিল না রিবিকা। গাছের ডালে প্রকাণ্ড মধুচক্র ছিল–চক্রটি এত বড় যে, রিবিকা যদি দেখত হলে পুলকিত এবং ভীতও বোধকরি হতৃত্ব। তার নগ্ন বুকের উপত্যকায় মধুচক্র থেকে মধু টুপিয়ে পড়ল। স্তন ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজে যেতে লাগল। সেই মধুর পতনে তার শরীর মৃদু মৃদু কেঁপে উঠছিল।
ঠিক এই সময় দুটি উজ্জ্বল রঙের, সেই রঙও অসাধারণ, প্রজাপতির জগতে এমন রঙদার ছবি খুব বিরল, সেরকম দুটি প্রজাপতি এল। এতবড় প্রজাপতিও সাধারণ নয়। মসীহ যদি এ প্রজাপতি পাঠিয়ে থাকেন, তবে এই নির্জন অরণ্যই সেকথা টের পেল। বুকের উপর, যেন দুটি রাঙা কুসুমের উপর বসছে এভাবে, সন্তর্পণে মধুলোভী প্রজাপতি, দুই সম তরঙ্গের প্রাণ চুপচাপ বসে পড়ল। প্রাচীন এ অরণ্য, বৃক্ষও নবীন নয়, বাতাস যে কবেকার সমুদ্রবিধৌত হয়ে আসছে কে জানে–এ নারী দেবী ইস্তারের মত দুঃখী আর বিষাদমথিত–এর মাথায় নীল ফিতে বাঁধা, যা নীল নদীর স্মৃতিবাসিত চিহ্নস্বরূপ, চোখ দুটি গভীর কালো পিরামিডের ছায়া ফেলেছে, যে সমস্ত রাত্রি মৃত্যুর সঙ্গে জলের হিংসা জাগিয়ে যুঝেছে, যে একদা উটের পিঠে কবরে মাথা রেখে পুরুষের দ্বারা যৌন-প্রহৃত হয়েছিল, যার আসক্তি নীল নদীর কিনারা ধরে ছুটে গিয়েছিল একদা নির্জন জ্যোৎস্নাস্নাত রাত্রিতে, যার বিবাহ হয়েছিল সূর্যদেব আমনের সঙ্গে, যার ঘর জ্বলে গিয়েছে ভস্মরূপে, মিশরীয়দের পুঞ্জীভূত ঘৃণা, পূর্বদেশের অবহেলা, কনানের ভাগ্যহত স্মৃতিই যার সম্বল, তাকে ফুলের মত সুন্দর দেখে দুটি কোমল বহুলরঙরঞ্জিত প্রজাপতি অধিকার করল–চন্দ্রকলাকৃতি ভূখণ্ডের ইতিহাসে এই তুচ্ছ দৃশ্যটি অবলোকন করেছিল যে, তার নাম সাদইদ। সে দেখেছিল নারীর নগ্নতাকে অলংকৃত করেছে দুটি ডানা-ছড়ানো রঙিন প্রজাপতি।
ভেড়ার বাচ্চাটি ঘুমন্ত রিবিকার কাছে এসে দাঁড়ায়। তার হাঁটুর উপর মুখ বাড়িয়ে শোঁকে। ভেড়ার গরম নিঃশ্বাসে ঘুমন্ত রিবিকা চোখ মেলে। প্রথমে সে ভয় পায়, আর্তনাদ করতে গিয়ে ভেড়াটিকে দেখে থেমে যায়, পুলকিত হয়।
বলে—’আ মসীহ, তুমি এসেছো!’ মুখ দিয়ে কথা বার হতে না হতে সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে। ভেড়াটির পিঠে যত্ন করে ভাঁজ করা খুব মসৃণ কাপড়–সৈনিকের শরীরের বস্ত্রখণ্ড। শরীরে পেচিয়ে মসীহদের মত করে পরা যায়। ডান হাত উন্মুক্ত থাকবে, বাঁ কাঁধের উপর ফেলে দিলে পিঠে কোমর ছাড়িয়ে জানু অবধি ঝুলবে। সৈনিকরা কেউ কেউ বিশ্রামের সময় এই পোশাক পরে।
প্রথমে আহ্লাদিত হয়ে উঠলেও, রিবিকা ক্রমশ ভীত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তার মুখ শুকিয়ে ওঠে। সে ভেড়াটির দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে সাহস পায় না। তার মনে হয় সে ফাঁদে পড়ে গিয়েছে। মেয়েরা আদিকাল থেকেই ভয় বা সংকোচ পাওয়ামাত্র চকিতে আপন বুকের দিকে তাকায়। যেদিন সে শরীরের উর্বভাগে কাপড় পরত না, সেদিনও সে চোখ আপন বুকের দিকে মেলেছে। মেয়েরা কখনওবা নরম পতঙ্গকেও ভয় পায়। হোক সে প্রজাপতি। যেন তার বুকে প্রাচীন আকাশের ইন্দ্রধুন ডানা মেলেছে। সূর্যদেবতা সামাশ আকাশে এই রঙ ছড়িয়ে দিতে পারেন। বৃষ্টির পর আকাশে তিনি ধনুকের সংকেত মেলে মানুষের জীবন-সংগ্রামের ছবি আঁকেন।
রিবিকা আপন স্তনযুগলের বর্ণপ্রলেপে ভয় পায়। আর্তস্বরে বলে ওঠে-মা গো!
মা আর দেবী ইস্তার এক্ষেত্রে একাকার। কোমল প্রজাপতি কিন্তু উড়ে পালাতে পারে না। মধুতে পাখা প্রলিপ্ত হয়েছে। দূর থেকে দেখলে সুশোভিত কাঁচুলির মত দৃশ্য হয়। এই প্রকৃতি শীতল, সালংকারা, বর্ণবিভাসিত। এই কি তবে মধুদুগ্ধের দেশসীমা! দৈবনির্দেশিত এই দৃশ্যে ভয় এবং আহাদ মিশে রিবিকাকে ক্রমে আশ্বস্ত করে! আবীরুদের হাতের আঙুলের চেয়ে কোমল এই ডানা আবীরুদের অঙ্গুরীয় বিভার মত রঞ্জিত। কী বিস্ময়! কী বিস্ময়!
রিবিকার কণ্ঠে আদরের ভেজা নরম স্বর নিরর্থক বেজে ওঠে। সে জানে না। এই দৃশ্যের কোন দর্শক আছে কিনা।
রিবিকার চোখে কৃতজ্ঞতার অরুণালোক খেলা করতে থাকে। তার গ্রীবায় প্রজাপতির রঙ লেগেছে; অস্তগামী সূর্যালোক যেমন নীল নদীতে ছায়া ফেলে মন্দিরগাত্রে ভেসে ওঠে, তেমনি এক ছবি। রিবিকা মনে করে জীবন অলীক নয়, রহস্যময় ঈশ্বরের দান–দেবী ইস্তার কাপড় না পেলেও মানুষ পায়। মসীহর সংকেতে ঘাসফড়িঙের বাঁচা, প্রজাপতির উড়ে আসা।
–এমন কেন হল? নিজের কাছেই এই প্রশ্নের বিস্ময় শেষ হয় না। সে বেশ! ছোঁব না। তুমি নিজে থেকেই ঘোড়ায় উঠে বসো। তুমি সুন্দরী না হলে, আমি সৈন্যশিবিরে ছেড়ে দিতাম। তাছাড়া সামান্য প্রজাপতি তোমার ইজ্জৎ রেখেছে, ক্ষুদ্র জীবেরা আমার শিক্ষক। আমি নরম প্রাণীদের ভালবাসি। আমার কথা তুমি বুঝবে না! আমি মসীহ (নবী) হলে এই কথাই তোমার আশ্চর্য লাগত। তোমার সরদারের নাম কী?
ঈষৎ বিস্ময়াপন্ন গলায় রিবিকা প্রায় অস্ফুটে বলল–ইহুদ। মহাত্মা ইহুদ।
সাদইদ ঘোড়র কাছে ফিরে এসে গদিতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল–ও! সেটা একটা লাঠিধারী বটে! যাক গে! এখন যা বলছি শোন, আমার নষ্ট করার। মত সময় নেই। অসুররা যে-কোন সময় হামলা করতে পারে।
সহসা সাদইদের কাঁধে ধরা বর্শার বাঁটের দিকে চোখ পড়ে রিবিকার। বাঁটের কারুকৃতি অদ্ভুত। ডানামেলা প্রজাপতি কাঠে কোঁদা হয়েছে। শত দুঃখের মধ্যেও রিবিকার চোখে বিস্ময় ঝলসে ওঠে। লোকটি শৌখিন মাত্র নয়, কেমন যেন অন্যরকম। চোখ দুটি দয়াপূর্ণ এবং উদাসীন। গভীরও বটে। রিবিকা তথাপি রাগতস্বরে বলল–একজন সামান্য সৈনিকের কাছে দয়াই যথেষ্ট। মসীহর নামে ঠাট্টা করার স্পর্ধা তোমার মত নিষ্ঠুরের শোভা পায় বইকি। তুমি নিশ্চয়ই জানো লাঠি ঘোরালেই কেউ মোড়ল হয় না। তবে বর্শা ছুঁড়তে পারলেই ডাকাত হওয়া যায়।
তাই নাকি! সাদইদ তরুণীর মুখের দিকে সকৌতুকে চাইল। ক্ষণকাল চুপ। করে থেকে বলল–তুমি যে আমারনার দেবদাসীদের মত কথা বলছ দেখছি। তোমার পরিচয় জানতে পারি?
–তুমি দেবদাসীর ঘরে গেছ কখনও? পাল্টা প্রশ্ন করে রিবিকা।
–সে অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। দেবদাসীর চেয়ে সুন্দর মেয়ের আমার অভাব নেই।
–তবে আমায় ছেড়ে দাও। তোমার তো অনেক আছে।
–অনেক আছে বলেই তোমাকে আমার দরকার। যার আছে সেই তো রাখতে পারে!
–কিছুই থাকে না সেপাই। নানভী (নিনিভে) নগরীও ধ্বংস হবে! আর তোমার নরম ক্ষুদ্র প্রাণী শখের প্রজাপতিও বেঁচে নেই। আমার মত মেয়ের স্তনে মধু পড়লে তা বিষ হয়ে যায়, অত নরম প্রাণ কি বাঁচতে পারে! এই দ্যাখো … কিছুই থাকে না! যা দেখছ সব!
বলে অশ্বের কাছে এগিয়ে এসে রিবিকা গায়ের কাপড় দু হাতে সরিয়ে পিঠে মেলে দু হাত দু পাশে প্রসারিত করে দিলনাও দেখে নাও। আমি আমনের (সূর্যদেব) বউ, আমার তো কোন লজ্জা নেই! হায়েনাও আমাকে খেতে পারে না। সাত বছরের দুর্ভিক্ষেও আমি মরিনি। নাঙা মেয়ের চুলে নীল ফিতে বাঁধা–তাই দেখে কবিতা লিখবে এমন মানুষ নোহের সন্তানরা জন্ম দিতে পারে না। আর তোমার মত সৈনিক জীবনেও কাঁদতে জানে না। নাও, দ্যাখো, দ্যাখো!
সাদইদ যা গাছের আড়াল থেকে চুরি করে দেখছিল কিছুক্ষণ আগে, তা অতি নিকটে উদ্ভাসিত হতে দেখল। এমন রূপ সে কখনই দেখেনি। সে কোন প্রকার জাদু বিশ্বাস করে না। স্বপ্নদর্শীরা জলের উপর তেল ফেলে মানুষের ভাগ্য গণনা করে, পশুর মেটের আকৃতি, তেলের আকার দেখে ভাগ্য বলা তার কাছে হেঁয়ালি এবং অসত্য। কোন প্রকার নবীগিরি বা নবুয়তী সে পছন্দ করে না। কারুকে মাথার উপর লাঠি ঘোরাতে দেখলে পাগলা কুকুর লেলিয়ে দিয়ে আনন্দ পায়। সে যে-কোন প্রকারের গ্রাম্যতাকে ঘৃণা করে। দেবদাসীর প্রতি তার কণামাত্র আগ্রহ নেই। সে যুদ্ধের অর্জনকে সম্মানজনক ভাবে, নিনিভের ঐশ্বর্য আলো উদ্ভাসন তাকে লুব্ধ এবং ঈর্ষাতুর করে। তথাপি তার আজ মনে হল, এই। মেয়েটিকে সে পথে পেয়েছে, যুদ্ধ করতে হয়নি এ তার ভাগ্য।
রিবিকার বুকের দিক থেকে সে চোখ ফেরাতে পারছিল না। তার কুসুকুলিকার মত রাঙা আঙুল স্তনের প্রলিপ্ত প্রজাপতির ডানাকে ছুঁয়ে তুলে ফেলে উড়িয়ে দেবার আকাঙ্ক্ষা করে–এই মুহূর্তে। এই মনোভাব কোন মসীহ বা ঈশ্বর জানতে পারে না। মানুষ সে অর্থে দেবতার চেয়ে দুর্গম।
রিবিকা সাদইদকে ভুল বুঝল। মনে হল, চোখে যতই দয়া থাক, এ নিশ্চয়ই এমন নির্জনতায় সম্ভোগ না করে ছাড়বে না। মসীহ যদি সহায় থাকেন, সম্ভোগের পর ছেড়ে দেবে। তখন সে মরুপথে কেঁদে বেড়াবে, তাই বেশ । তবু নিস্তার পাবে। মহাত্মা ইহুদকে সে কি পাবে না খুঁজে? সাদইদের গালে চড় মেরে বলল–অনেক দেখেছ, দেবদাসী দ্যাখোনি, না? কোন পুরুষের হৃদয়ে যুদ্ধের যুগে সত্য নেই সরদার। পুরুষ যে কখনও সত্য সৃষ্টি করেছে, ঈশ্বরের প্রত্যাদেশে করেছে, তেমন দুএকজন ছাড়া আমার কে আছে? নাও, যা করবার করো। তুমি আমার মেষশিশুকে মেরেছ! প্রাণের উপর খুব মায়া তাই না, প্রজাপতির বন্ধু!
বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দুহাতে মুখ ঢেকে সাদইদের পায়ের কাছে মাটির উপর বসে পড়ল রিবিকা। কান্নার চাপে তার বুক ভেঙে যেতে লাগল। শরীর কাঁপতে লাগল।
সাদইদ কিছুক্ষণ হতভম্বের মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে ধীরে ধীরে কান্না থেমে গেল রিবিকার। কান্নাভেজা দুহাত চোখের উপর থেকে সরিয়ে কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদইদকে দেখল। তারপর গায়ের কাপড় সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
এবার সাদইদ খুশি হয়ে উঠল অকারণ। বলল–ওঠো! আমি লাগাম ধরে হেঁটে যাব।
রিবিকা প্রথমে সাদইদের প্রস্তাব ঠিক শুনছে কিনা বুঝতে পারছিল না। হাসি মুখে খুব নরম করে সাদইদ বলল–উঠবে না? জিজ্ঞাসা করেই সে তার আঙুলে লেগে থাকা প্রজাপতির পাখার আসান লক্ষ্য করছিল। কিছুই থাকে না। একটি নগরী আঙুলের এই রেণুর মত শেষ হয়। তাই কি? কিন্তু আমি কখনই একথা মানতে পারি না। মনে মনে বলল সাদইদ।
রেকাবে পা রেখে বহুকষ্টে রিবিকা ঝুলে ঝুলে বেয়ে বেয়ে ঘোড়ার পিঠে। উঠল। সামনে লাগাম ধরে এগিয়ে চলল সাদইদ। অনেকক্ষণ দু’পক্ষই নীরব।
হঠাৎ সাদইদ মিশরীয় সেই কবিতা আউড়ে উঠল আপন মনে :
‘আমার ফুলের বাজার, তাই খদ্দের আসে না।
আমার নেই পশম, যা দিয়ে তোমায় রক্ষা করি,
ওহে প্রিয়া! মরুশীতে একটি বৃদ্ধ উট
আমার সঙ্গী! আতর আর সুর্মা কী হবে!
শুধু পশমের জন্য, আঙুর বাগিচার জন্য,
সবুজ উপত্যকার জন্য এ জীবন–আব্রাহাম!’
চমকে ওঠে রিবিকা! সে চুপিচুপি বুকের কাপড় সরিয়ে দেখে দুটি প্রজাপতিই স্পন্দনহীন। এ-স্থল ছুঁয়েছে ওই লোকটি!
কবিতার সুর সহসা সাদইদের গলায়।
সাদইদ বলল–তোমার এই ভেড়ার বাচ্চাটা যদি আমাদের শিবিরে না ঢুকে পড়ত, তাহলে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হত না। ভেড়াটাকে দেখেই মনে হল, রাস্তায় নিশ্চয়ই কোন কাফেলা (মরুযাত্রীদল) যাচ্ছে। আমার সৈন্যরা যে যেমন পারল এদিক-ওদিক ছড়িয়ে গেল ঘোড়া নিয়ে, মরুভূমির মধ্যে। আমি একা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আসছিলাম। তোমাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখে কী যে হল বলতে পারব না–কোলের বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিলাম, ওর পিঠে চাপিয়ে দিলাম আমার ঘাড়ের কাপড়। ওকে এভাবে বর্শায় গেঁথে মারার আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিল না।
–তবে মারলে কেন? উদ্বেগের সঙ্গে বলল রিবিকা।
সাদইদ বলল–হিত্তীয় সৈনিকদের সম্বন্ধে তোমার কোন ধারণা নেই। ওরা ক্ষ্যাপা কুত্তার মত মরুভূমি তোলপাড় করে যখন কিছুই পাবে না–জুমা পাহাড়ের ওদিকে ঘোড়া হাঁকিয়ে চলে গিয়ে মদ খেয়ে দেবদাসীদের মন্দিরে পড়ে থাকবে দুদিন। যুদ্ধ যত ঘোরতর হয় দেবদাসীদের উপর ততই নির্যাতন বাড়ে। যুদ্ধের আধেক শক্তিই দেবদাসী। বিশেষ করে আমারনার মেয়েদের উপর বেশি লোভ।
–কেন?
–তারা সুন্দরী আর ওদের হাত-পা মোলায়েম। মিশর সুখী দেশ। চাষী ঘরে যারা মাঠে কাজ করে তারা গেঁয়ো হয় ঠিকই, হাত-পা শক্ত হয়, কিন্তু শহুরে দেবদাসীরা কামকলায় পটু আর লেখাপড়াও কিছুটা জানে, গান জানে। ওখানকার অভিজাতরা দেবদাসীদের যত্নে রাখে। একটা রাষ্ট্র কতটা ভাল তা বোঝার উপায় হচ্ছে দেবদাসী। যেখানে কবিতা-চৰ্চার চেয়ে কামকলার চর্চা বেশি হয়, জানবে সেটা ঐশ্বর্যশালী দেশ। কবিতা হল উটচালকের জিনিস, তারা তো চুটকিলা গায়, ঠুংরি জাতীয় গান করে।
–তুমি কী করো! সকৌতুকে জানতে চায় রিবিকা!
–আমি? বলে স্নান হেসে পিছনে ফিরে চাইল সাদইদ। তারপর সামনে চোখ মেলে চলতে চলতে বলল–আমি কী করি একটু পরেই বুঝতে পারবে। অকৃতজ্ঞতা হল যুদ্ধের শর্ত? তোমার ভেড়ার ওপর আমার কোনই কৃতজ্ঞতা ছিল না। থাকলে হত্যা করতাম না। আমি শিবিরে গিয়ে কোন কথাই বলব না, শুধু ভেড়াটা ছুঁড়ে দেব। একটা ভেড়া আর তোমার মত সুন্দরীকে পেলে ওরা চুড়ান্ত উৎসাহ পাবে। আমি ওদের পরিচালক। ওরা মরুভূমি ছুঁড়ে খালি হাতে ফিরেছে। ব্যর্থতার জ্বালায় জ্বলছে। আমি ওদের প্রশমিত করব। ওদের বোঝাতে হবে, রেগে উঠলেই হয় না, চোখ খুব তীক্ষ্ণ আর মাথাটা ঠাণ্ডাও। দরকার।
–তুমি আমাকেও ভেড়াটার সঙ্গে হত্যা করলে না কেন? অশ্বপৃষ্ঠে হাহাকার করে উঠল রিবিকা।
–মানুষ যে যুদ্ধে জেতে কেন জেতে, তলার ইতিহাস খুব কটু। একজন মহাপরিচালকের পক্ষে খারাপ দেখালেও তাকেও কতকগুলো ছোট কাজ করতে হয়। ভেড়া বওয়াটা নিশ্চয় খুব মর্যাদার কাজ নয়। তবু কেন বইছি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ।
–আমাকে ক্ষমা করুন। বলতে বলতে রিবিকার মাথা ঘুরে উঠল। সে ঘোড়ার গা খামচে ধরল।
সাদই বলে যেতে লাগল–তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমাকে যে মন্দিরটা দেওয়া হবে, তা খুবই পরিচ্ছন্ন আর আধুনিক। সূর্যমন্দিরই পাবে তুমি । সূর্য যতদূর আলো ছড়ায় একজন সৈনিক আকাঙ্ক্ষা করে সে ততদূরই পৌঁছবে। কিন্তু সারগনও তা পারেননি। কিন্তু সূর্যের বর পেয়েছে দেবদাসী–সবখানে তার দেশ। মহাপিতা নোহের কাহিনী সবদেশে আছে, দেবদাসীর কাহিনীও মানুষের যুদ্ধের সঙ্গে জড়ানো–সর্বত্র আছে। মন্দিরে তোমাকে পাহারা দেবে সমর্থ একজন গামছাবালা। তোমার কাছে আসবে রাষ্ট্রনায়ক, মন্ত্রী। সত্যি বলতে কি তোমার জন্য মোতায়েন হবে গামছাবালা-এরা দালাল চরিত্র নয়। প্রহরী বলতে পারো। মিলনের আগে এবং পরে সেই গামছাবালা তোমার ও তেনার নানারকম সেবা করবে। লাঠিধারী যেমন পদবী, গামছাবালাও তাই।
শুনতে শুনতে রিবিকা অশ্বপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে খসে পড়ল। ক্ষুধায় এমনিতেই এত কাহিল ছিল যে, গা কাঁপছিল; তার কম্পিত হৃদয়ও আর চিন্তা করতে পারছিল না। পড়ে যাওয়ার শব্দে পিছনে ফিরে তাকাল সাদইদ। দেখল মেয়েটি মূৰ্ছা গিয়েছে। তার বুকের উপর থেকে কাপড় সম্পূর্ণ সরে গিয়েছে। একটি প্রজাপতিও আর জীবিত নেই। ভোরের এই অরণ্য আড়াল দেওয়া টুকরো টুকরো আকাশে প্রজাপতির রেণু মাখিয়েছে কে!
সে আপন মনে লজ্জা পেল, গামছাবালা যে পদবী সে যে দালাল নয়, একন নির্যাতিতার সামনে এসব এমন করে বিবৃত করা ঠিক হয়নি। মেয়েটিকে নিয়ে এখন সত্যিই সে কী করবে! মেয়েটি তো জানে না এই পুরুষটি আসলে কে–কী তার ভাগ্যের পরিচয়। গামছাবালা কথাটি কি আর সাধে সাধে মুখে আসে!
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল সাদইদ। মহাপরিচালক কথাটাও কি কম পরিহাস্য! মর্যাদা! নিরীহ অসহায় নারীর কাছে মর্যাদার কথা! সামান্য একজন ভাড়াটে সৈনিক! যারা মিশর থেকে, আসিরীয় ভূখণ্ড থেকে, বাবিলন থেকে গুপ্তপথে, চোরাপথে পালিয়ে আসা সৈনিক, তারাই তার সহচর। একত্র দল গড়েছে–সেই দল ভাড়া খাটে, তারই পরিচালক সে। যুদ্ধ শেষ হলে কিংবা আসিরীয় নগরী নিনিভে ধ্বংস হলে তাদের আর কোনই দাম থাকবে না। যুদ্ধ থাক, কিন্তু নগরী যেন ধ্বংস না হয়। একটা বড় নগরী ধ্বংস হওয়ার পর কিছুকাল যুদ্ধ থেমে থাকে। বিজয়ী জাতি ভাড়াটে সেনাদের নিজের রাষ্ট্রে বন্দী করে আবার । স্বপ্নের পাহাড়, ক্ষুদ্র অরণ্য, মরূদ্যান, মন্দির, দেবদাসী–সব কেড়ে নেয়। যুদ্ধ থামলে আবার তাকে পার্বত্য নগরীর মধ্যে হিত্তীয় রাষ্ট্রের সৈন্যশিবিরে,নতুবা কোথাও ঠাঁই নিতে হবে।
অথচ কনান তার দেশ। মহামতি হিত্তীয় রাজা হিতেন তাকে এই যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার সময় খানিকটা স্বাধীনতা দিয়েছেন মাত্র। সে নিজের উদ্যোগে সৈন্যদল গড়েছে। তথাপি হিতেনের যুদ্ধবিদ্যা সাদইদের অধিগত হয়েছে হিতেনের বদান্যতায়–ফলে হিতেনের কাছে তার আনুগত্য প্রবল।
হিতেন সাদইদকে একটি ছোট পাহাড়, কিছু মন্দির এবং শিবির স্থাপনের জন্য এই সামান্য অরণ্য দিয়েছেন। এখানে ছোট একটি দ্রাক্ষাকুঞ্জ আর দুটি কূপ এবং ক্ষুদ্রাকৃতি মরূদ্যানের বিস্তার আছে। দ্রাক্ষাকুঞ্জের কাজ করে আহত সৈনিকরা–বিশ্রামের জন্য তাঁবু খাটায়। পাহাড় এখান থেকে পঞ্চাশযাট মাইল দূরে অবস্থিত। সেখানেই রয়েছে নতুন মন্দিরগুলি। হিটাইটরা (হিত্তীয়) অশ্ব চালনাতেই কেবল পারঙ্গম, তাই নয়, এরা মাটির ইট, বালির তাপে শক্ত করে নিয়ে বাড়ি তৈরি করতেও পারে। সেই গৃহগুলি পাথর এবং ইটের প্রস্তুত। ঠিক সেইভাবেই তারা মন্দির গড়েছে।
এইসব মন্দিরগৃহ উপাসনার জন্য তৈরি নয়। সৈনিকরা এখানে দেবদাসীদের হাতে মদ্যপান এবং রাত্রিবাস করার জন্য আসে; আক্রান্ত জাতির সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে দেবদাসী করা হয়। তারা অধিকাংশই পুরুষহীন। তাদের পুরুষরা হয় যুদ্ধে নিহত, নতুবা জেল খাটছে অথবা পঙ্গু। যুদ্ধে ক্রমাগত পুরুষের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে দেবদাসীদের সংখ্যা দিনে দিনে অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে।
একটি নগরীর শ্রীবৃদ্ধি মানে দেবদাসীর সংখ্যা-বৃদ্ধি। দেবতা সামাশের জয়জয়কার। নারীকে পুরুষহীন না করতে পারলে সৈনিকদের জন্য দেবদাসী সরবরাহ করা যাবে না। দেবদাসী না থাকলে সৈনিকরা যুদ্ধ করবে না। দেবদাসীর সংখ্যা বাড়লে মন্দিরের সংখ্যা বাড়বে, সঙ্গে সঙ্গে গামছবালার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। পরাধীন রাষ্ট্রের পুরুষদের জন্য গামছা কাঁধে করা চাকরি নির্দিষ্ট। হয় সে দ্রাক্ষার মদ বানাবে, নয় গামছা কাঁধে ফেলে টুলের উপর বসে থাকবে দেবদাসীর মন্দিরের দরজার কাছে। আবোবদনে এইধারা বসে থাকাই হল সভ্যতার চিহ্ন। যে দেবদাসীর সৌন্দর্য যত বেশি তার গামছাবালার চাকচিক্যও তত বেশি।
সংজ্ঞাহীন রিবিকার মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে জীবনে এই প্রথম সাদইদের মনে হল, দেবদাসীদের পাড়ায় এই মেয়েটির খুব কদর হবে। কিন্তু এই মেয়েটিকে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে তুলতে সাদইদ বুকের মধ্যে কেমন একধারা কষ্ট অনুভব করছিল।
ঠিক সে জানে না, এই কষ্টটাই বা কিসের! এমন তো কখনও হয়নি। যার পুরুষ নেই, তার তো ঈশ্বর আছেন! গামছাবালা এবং পুরুত আছে। সর্বোপরি সৈনিকদের আদর-সম্ভাষণ তো রয়েছেই। সাদইদ কূপ থেকে মাথার টুপিতে করে জল বহে এনে রিবিকার মুখে প্রক্ষেপ করতে করতে ভাবল–আমি না হয় দেবদাসীর ঈশ্বরকে অথবা যে কোন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি না–তা বলে আমনদেব সূর্য তো মিথ্যে হয় না। সে প্রতিদিন আকাশে আসে। ঈশ্বর যবহ পাহাড়ে বসে চোখ রাঙায়। দেবতার আশীর্বাদে একজন প্রথম শ্রেণীর দেবদাসী কত সমাদৃত হয়। নগর রাষ্ট্র ধ্বংস হয়, তেমন রূপসী দেবদাসী ধ্বংস হয় না। একটি নগর শেষ হলে আর-একটি নগর জেগে ওঠে। বিজয়ী রাষ্ট্র-পুরুষ সবচেয়ে সুন্দরীকে অশ্বে তুলে নিয়ে চলে যায়।
মেয়েটিকে বলতে হবে–সে যেন কোন সৈনিকের প্রেমে না পড়ে। তার নিজের দাম বোঝা উচিত। সৈনিক আজ আছে কাল নেই। আজ রাতে যে সৈনিক এই মেয়েটির পাশে শুয়ে রাত কাটালোকাল ভোরেই তার মৃত্যু হতে পারে। অসুররা যে কখন কার প্রাণ নেবে বলা তো যায় না। ভাড়াটে সৈনিকের দেশ নেই, রাষ্ট্র নেই, জীবনের স্থায়িত্ব নেই। তার চুক্তিরও কোন দাম নেই। আজ সে মিশরের পক্ষে, কালই সে অসুরদের তরফে। একটি ছোট পাহাড় দেখে একটি নগরীর কল্পনা করা কী বোকামি! সাদইদ তার পাহাড়টির দিকে গাছপালার ফাঁক দিয়ে একবার চাইল। তারপর আবার রিবিকার জলসিক্ত মৃদু কম্পিত মুখের রেখার দিকে চাইল। এই মেয়েটি তাকে প্রজাপতির বন্ধু বলে ঠাট্টা করেছে। অত্যন্ত উর্বর-মস্তিষ্ক না হলে, অমন বাক্য মুখে আসত না। যার রূপ প্রখর আর মিন্ধ এবং বুদ্ধি প্রখরতর,তাকে দেবী ভাবলে অন্যায় হয় না । দেবী যে আকাশে থাকে না, সাদইদের এ হল গভীর বিশ্বাস!
একজন দেবী কখনও এত স্পষ্ট নয়, যা প্রত্যক্ষ তাই সত্য। যা বোঝা যায়, তাই সত্য এবং সুন্দর। প্রজাপতি এই সুন্দরীকে অধিকার অকারণ করেনি। সাদইদ দেখল, রিবিকার চোখের পাতা ঘন-ঘন নড়ে উঠছে। সে চেতনা ফিরে পাচ্ছে।