মরুস্বর্গ-২

সাদইদের দিকে চোখ মেলে চাইল রিবিকা। তার বুকের কাপড় সরে গেছে। লোকটি তার দিকে গভীর আগ্রহে চেয়ে আছে। হঠাৎ কী খেয়াল হওয়াতে সাদইদ রিবিকার বুকের কাপড় সাবধানে তুলে রিবিকাকে ঢেকে দেয়। রিবিকা পুরুষের এই আচরণ ভাবতে পারে না। নারী যখন সংজ্ঞাহীন, পুরুষ তখনও নারীকে গমন করে। মিশরে সমকামী পুরুষের অভাব ছিল না। পুরুষ এমনকি মৃতাকেও গমন করে। নারীর এসব সুযোগ নেই। দেবতা আমন নারীকে এসব সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছেন। ফলে সে সুন্দর হয়েছে।

সাদইদ বলে উঠল–ভয় পেও না প্রজাপতি!… খুব নরম করে বলল, তা আহ্বানের সুরে। কেন যে এমন করে বলল, হৃদয়ের এই চিন্তার ব্যাখ্যা সাদইদের জানা ছিল না। ঠিক তখনই হৃদয়াবেগের প্রবল চাপে রিবিকা সভ্যতার সেই নারী যে লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে ফেলল।

একটা কথা ভেবে রিবিকার কান্না থেমে যায়। অজ্ঞান অবস্থায়, দেবী ইস্তারের মত যখন সে পাতালে ভাসছিল, খুব একা, খুবই অসহায়, যখন সে তার পুরুষকে পাগলের মত অন্ধকার স্রোতে খুঁজছে, তখন এই সৈনিকটা তাকে গমন করেনি তো!

–কী হল? প্রশ্ন করল সাদইদ।

রিবিকা জবাব না দিয়ে উঠে বসে অন্ধকার স্রোতের কোন ক্ষীণ স্মৃতি শরীরে স্পষ্ট লেগে আছে কিনা মনে মনে বুঝে নিল। শরীর কাহিল, কিন্তু অজ্ঞানতার ক্রমাগত নিমজ্জন তাকে অসহায় করেছে, পীড়ন করেনি-বুঝতে পেরে ফের দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল । রিবিকা আপন বুকের দিকে কাপড়ের আড়ালে চক্ষু সঞ্চালিত করে টের পেল মৃত পতঙ্গ অক্ষত। তার কান্না আরো বেড়ে গেল।

সাদইদ বলল–নিনিভে নগরী তোমার চেয়ে সুন্দরী নিশ্চয়। মনে রেখো সেখানের সিংদুয়ারে বৃষমূর্তি আছে বৃষের মুখ মানুষের মত। স্কন্ধ বৃষ, চোখ মানুষের। সেই চোখে তোমার জন্য কোন কান্নার জল জমে নেই–তা আগুন জ্বালায়। বৃষবক্ষ যাকে বলি, তা নির্মম। ওঠো, আমার সঙ্গে তোমাকে যেতে হবে।

কথার শেষ অংশে গলা কঠোর করে তুলল সাদইদ।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে জুমা পাহাড়ের দিকে আবার চাইল সাদইদ।

বলল–তোমাকে মধু আর রুটি দিতে পারি। দেখে মনে হচ্ছে তুমি অনেক দিন কিছু খাওনি। চলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তোমাকে শিবিরে নিয়ে যাই।

রিবিকা ঘোড়ার পিঠে ফের উঠে বসেছিল। অত্যন্ত ম্লান গলায় বলল–খিদেয় ধোঁকাচ্ছি, দেহে বল নাই। এই অবস্থায় যা খুশি করতে পারো। তবে দোহাই, আমাকে শিবিরে দিও না। তোমার সৈনিকরা আমাকে ছিঁড়ে খাবে। হায়েনার হাত থেকে মসীহ আমায় রক্ষা করেছেন, একটা মেষশিশুর কাছ থেকে তুমি একজন প্রজাপতির বন্ধু, কিছুই কি শিখবে না?

–অ। তুমি দেখছি ভারী চালাক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীদের কাছে থেকে কতকিছুই শেখার আছে। হ্যাঁ, আমি একথা বিশ্বাস করি। আমার কাছে ব্যাপারগুলি খুবই স্পষ্ট। অবশ্য ক্ষুদ্র কেন, বৃহৎ প্রাণী যারা, তারাও আমাদের শেখায়। উট, অশ্ব, কুকুর। এরা কেউ ভগবান নয়। এরা লাঠিধারীদের মত ইশারাবাদীও নয়, ভণ্ডও নয়। কিছু মনে করো না। পিতা নোহ ছাড়া আমার কোন মসীহর উপর আস্থা নেই।

বলতে বলতে একটি দেবদারু গাছের ছায়ায় ফের দাঁড়িয়ে পড়ল সাদইদ।

বলল–এখানে একলা তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তুমি নিচে নেমে এসো। আমার ভয় হচ্ছে, তোমাকে সৈনিকরা দেখলে কিছুতেই ছাড়তে চাইবে না।

–দোহাই!

আর্তনাদ করে উঠল রিবিকা। বলল–আমি তোমার কবিতার তারিফ করি সারগন। পিতা নোহের সন্তান তুমি–আমায় বাঁচাও।

–আমি সারগন নই প্রজাপতি। আমাকে এত সম্মান দেখানোর কিছু নেই। আমি শুধু প্রজাপতি দু’টির’আচরণে মুগ্ধ আর অবাক হয়েছি। জানি মধুর। লোভেই তারা তোমার কাছে এসেছিল। কিন্তু তারপর ঘটনাটা অন্যরকম। হয়েছে। ওরা বিভ্রান্ত হয়েছে। কিন্তু সেটা খুব দুর্লভ ব্যাপার। ঠিক তোমাকে বোঝাতে পারব না। হৃদয় উর্বর হলে, আমি এ নিয়ে দু ছত্র লিখতাম। পাথরের গায়ে কুঁদে রাখলে সেটা বাবিলের অনুশাসনলিপির চেয়ে মূল্যবান হত। ধন্যবাদ! তুমি আমার কবিতার তারিফ করেছ!

ধন্যবাদ জানিয়ে সাদইদ বলল–এবার তাহলে তোমাকে নামতে হয়।

রিবিকা বলল–আমার নামবার ক্ষমতা নেই সারগন। আমি আর পারছি না।…বলতে বলতে রিবিকার চোখ দুটি খিদেয় আর ক্লান্তিতে মুদে এল।

দুটি হাত অখের দিকে প্রসারিত করে সাদইদ বলল-তোমার সঙ্গে অদ্ভুত দু’টি প্রজাপতির সংযোগ ঘটেছে। যাই হোক, এই দৃশ্যের খাতিরে আমি তোমাকে খাদ্য আর পানীয় দেব। এবং চাইব না যে তোমাকে ধর্ষণ করে মেরে অসুরদের খুটায় টাঙিয়ে দিক সৈন্যরা। অসুর কে নয় বল? যুদ্ধ যতদিন আছে একটা রঙিন প্রজাপতির পক্ষধ্বনি কারো কানে যাবে না। আমি নিশ্চিত, প্রকৃত নোহের সন্তান ছাড়া এই ধুন শুনতে পায় না। আমি ঠিক যোগ্য নই। চুটকিলা গেয়ে যুদ্ধ থামানো যায় না। দরকারই বা কী! যুদ্ধ থামলে আমার জায়গা কোথায়! এসো! নেমে পড়ো।

গাছের ছায়ায় নামিয়ে রেখে সাদইদ অশ্বারোহণ করল, রিবিকার চোখে অদ্ভুত আকুতি ফুটে উঠল। খিদে আর তেষ্টায় সে বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল। মুহূর্ত কতক চলে যায়। দ্রুতই ফিরে আসে সাদইদ। দ্রাক্ষাকুঞ্জ থেকে মধু আর রুটি সংগ্রহ করে ফিরেছে। হত্যা করা মেষটাকে সৈনিকদের ভিতর ছুঁড়ে দিয়ে এসেছে।

রিবিকা যখন গোগ্রাসে খেতে শুরু করল, সুন্দর মায়া এসে সাদইদের চোখ দু’টিকে ঘিরে ছায়া ফেলে দাঁড়াল।

সাদইদ বলল–তোমার জন্য জল, মধু আর রুটি। শীতে আর গ্রীষ্মে উপযুক্ত পোশাক। যদি পর্যাপ্ত এইসব পাও, কী করবে তুমি? মিশরীয় অভিজাত নারীদের মত তুমিও কামকলার চর্চা করবে। তখন আমার মত যাযাবরের কবিতা ভাল লাগবে না। আমার কতরকম ভাবনা, কোনটারই মাথামুড়ো নেই। কখনও বলি প্রজাপতি, কখনও বলি যুদ্ধ। দিশেহারা একটা ভাব। যার দেশ নেই, গ্রাম কিংবা নিজস্ব নগরী নেই। অশ্ব আর অস্ত্রবিদ্যা কী কাজে লাগল! রাজা হিতেনের অনুগৃহীত। তোমাকে যে খেতে দিলাম–মাগনা নয়। রাজাকে তুষ্ট করলে…যাক গে!

খেতে খেতে রিবিকা থেমে পড়ে দু’চোখ সামান্য কুঞ্চিত করে সাদইদের মুখের ভাষা পড়বার চেষ্টা করে। কেমন সন্দেহ হয়। মনে হয়, এই লোকটাও তাকে বিক্রি করে দেবে। পুরুষ মাত্রই বিক্রেতা এবং ক্রেতা। প্রত্যেকেই বণিক। তবে লোকটির ভাব খুব দুরূহ সন্দেহ নেই। নিজেকে সে দিশেহারা বলছে। নারীর শরীরে কাদা, বালি লাগে, তেমনি ফুলের পাপড়িও লেগে থাকে। সবই সমান। তুচ্ছ প্রজাপতি দেখে মুগ্ধ যে হয়, সে পাগল। লোকটা যখন প্রজাপতিকেও শিক্ষক বলে ঘোষণা করেছে, বোঝা যায়, পাগলামিটাও তবে আস্ত। আবীরুদ এইরকমই ছিল। প্রাসাদ ছেড়ে সে তাঁবুর তলে থাকতে চেয়েছিল।

ভাবতে ভাবতে আবার খেতে শুরু করল রিবিকা। খাওয়া শেষ হলে ঢকঢক করে জলপান করতে করতে থেমে পড়ল সে। বলল–হায় আমন! তোমাকে তো একবারও বললাম না! মাফ করো আমাকে। তোমারও তো খিদে পেয়েছিল!

ক্ষীণ হেসে সাদইদ বললবলেছিলাম না! খেতে পেলে আবার তোমার বাঁচতে ইচ্ছে করবে। ক্ষুধার্ত মেয়েকে বলাৎকার করা কাপুরুষতা। সমকামিতার চেয়ে নোংরা জিনিস। আমি যদি সারগন হতাম, আমার নাগরিক অনুশাসনে একথা লিখতাম। অবশ্য সারগনেরই মত আমার জন্মমুহূর্তেই মা আমাকে ত্যাগ করেছিলেন। হয় আমি জারজ ছিলাম। কোন সৈনিক আমার পিতা ছিলেন, যার কোন উদ্দেশ ছিল নানতুবা মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। আমার মাকে তোমাদের ঈশ্বর হত্যা করেছিলেন। নইলে নবজাতক সাদইদ কেন ঝুড়িতে করে জলে ভেসে যাবে।

একটু থেমে সাদইদ বলল–একজন ভিস্তি–ভিস্তি বোঝো তো! দ্রাক্ষাকুঞ্জের মালি। তিনি কে? তিনি এক ক্রীতদাস। বস্তুত তিনিই আমার পিতা-আসল বাপটি কে জানিনে। এইরকম দিশেহারা নিরাশ্রয় জন্ম আমার। সারগনেরই মত। কিন্তু আমি সারগন নই। বারংবার একটা মিথ্যা কথা বলছ। কেন?

বলতে বলতে সাদইদের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল। আরো খানিক জল আশ্লেষে পান করে রিবিকা বলল–একজন দেবদাসীকে ক্ষমা কর! আমার কথার কি কোন দাম আছে!

সাদইদ রিবিকার স্বীকারোক্তি শুনে অবাক হয়। মুখে আর কোন কথা বলে না। ক্ষমা চেয়ে সুন্দরী রিবিকা ঘাড় নিচু করে অনেকক্ষণ বসে থাকল। তার অধোভঙ্গিমার মুখোনির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কবিপ্রাণ সাদইদের মনে হল, মেয়েটিকে সে কুমারী ভেবেছিল। একটি দেবদাসীকে চিনতে না পারা তার অক্ষমতা। মেয়েটির মাথার নীল ফিতেটিকে দেখে তার আশ্চর্য লাগছিল।

সাদইদ বলল-দেবদাসী না থাকলে আমাদের যুদ্ধ থেমে যেত। তোমরা। আছো বলেই আমরা আছি প্রজাপতি!

–তোমার একথার প্রতিবাদ করার সাহস একজন দেবদাসীর নেই। তুমি সৈনিক। মুখে যা আসে বলতে পারো। তবে একথা একজন বুড়োর মুখে ভাল শোনায়। আমি প্রজাপতি নই। আমার নাম রিবিকা। আমার মত মেয়েকে প্রজাপতি বলে ঠাট্টা না করলেই পারতে সারগন!

রিবিকার ঈষৎ অভিমানভরা কণ্ঠস্বর শুনে সাদইদ হা-হা করে হেসে ফেলে বলল–আবার সারগন!

রিবিকা আবার লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। বলল–অন্য কোন সৈনিক হলে এমন করে সারগন বলে ডাকলে খুশি হত! তুমি তেমন নও। তোমার নাম ধরে তো ডাকতে পারি না।

সাদইদ বলল–শোন আমনের বউ! তোমাদের মুখে তারিফ শুনতে সৈনিকরা ভালবাসে, কারণ তাতেও এক ধরনের নেশা হয়। মদের চেয়ে সে নেশা খর। একজন সৈন্যকে গেজিয়ে দিতে তোমরা ওস্তাদ। বিশেষত একজন ভাড়াটে সেপাই দেবদাসীর মুখে ছাড়া প্রশংসা কোথায় পাবে! আমি অধিনায়ক, কিন্তু কখনও কোন সেপাইয়ের প্রশংসা করিনি। কেন করব?

বলতে বলতে গাছের শেকড়ে বসে থাকা সাদইদ উঠে দাঁড়ায়। তারপর তার ফেনশুভ্র ঘোড়াটির কাছে সরে এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে লাগাম আঁকড়ে ধরে। পরম মমতায় ঘোড়ার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে–তারিফ কখনওই করব না। এরা প্রত্যেকে সারগন হওয়ার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু কখনও ঐক্যবদ্ধ হয় না। লুঠের মাল নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। একজন সুন্দরী দেবদাসীর উপর অধিকার বলবৎ করতে সহযোদ্ধার বুকে চাকু বসায়। মন্দিরে গিয়ে কে আগে কার কাছে কোন্ সুন্দরীর কাছে যাবে তার প্রতিযোগিতা করে। কী বলব, এদের ঐক্য নেই। এরা কখনও কোন একটা সুন্দর নগর নির্মাণের কথা ভাবতে পারে না। ক্রীতদাস ছিল, চোরাপথে পালিয়ে এসেছে, মন খুব ছোট। বিচিত্র মুখের ভাষা। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই।

একটু থেমে সাদইদ বলল–আমি নিজে প্রচুর মেহনত করে ওদের জন্য একটা তাঁবুর মিশ্রভাষা তৈরি করেছি। তাঁবুতে থাকে, কথা চালাচালির একটা মাধ্যম তো লাগে। সেই ভাষা তো কতকগুলো নকশা হলেই চলে না। মুখে একটা নকশার বর্ণনা করতে অনেক সময় লাগে। লিপি তৈরি হয়েছে, ভাষাও সহজ হয়েছে। লিপি দরকার। আমি নকশা নয়, লিপিভিত্তিক একটা বর্ণমালা প্রস্তুত করেছি-বলতে পারো, এটা আমার কোন কৃতিত্বই নয়। ফিনিশীয়রা লিপির ভাষার উদগাতা। উগাতা বোঝো তো! এই ভাষা তৈরি একটা জাতির ক্ষমতা। কল্পনা করার ক্ষমতা। লিপি হল লিখিত রূপ। অঙ্কিত রূপ নয়। সেটি হওয়ার ফলে ভাষাগুলিকে মেশানো সহজ হয়েছে। সে কাজটা কঠিন নয়। তা, সেই কাজ করে আমি প্রমাণ করেছি, বাবিলের গল্পটা ঠিক নয়। মানুষ ভাষার। দূরত্ব ঘোচাতে পারে। তা সত্ত্বেও এরা সত্যকে চিনতে চায় না।

একনাগাড়ে কথা বলার পর দম নেবার জন্য দণ্ডভর থামে সাদইদ। ঘোড়ার কাছ থেকে দ্রুত সরে এসে জলের পাত্রটা রিবিকার হাত থেকে ছোঁ মেরে ঠোঁটে তুলে নিয়ে ঢকঢক করে জল গেলে। তারপর সেটি মাটিতে ফেলে দিয়ে বলে–চলল, ওঠা যাক। তুমি দেবদাসী, তোমার পক্ষে বোঝা কতটা সম্ভব আমি জানি না। ঈশ্বর যবহ বা ধরা যাক আকাশের দেবতারা মানুষের মধ্যে। ভাষাভেদ ঘটিয়েছেন। কারণ মানুষ জিগুরাত তৈরি করে। জিগুরাত বা স্বর্গ যাই বল, মানুষের হাতে গড়া। তাই না? তা আকাশের ঈশ্বর মনে করলেন, স্বর্গের সিঁড়ি বানিয়ে তুলে মানুষ তেনাদের আক্রমণ করতে চাইছে, কী স্পর্ধা! ব্যস হয়ে গেল! অমনি তেনারা জিগুরাত ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হলেন না, মানুষকে আলাদা করে দিলেন। কীভাবে? না, ভাষা আলাদা হল। এক এক গোষ্ঠীর এক এক ভাষা। গল্পটার ছিরি আছে বলতে হবে! সরদার ইহুদ নিশ্চয়ই তোমাকে এই গল্পটা হাজারবার বলেছেন!

–হ্যাঁ! সলজ্জ মুখ তুলে মাথা নাড়ল রিবিকা।

সঙ্গে সঙ্গে সজোরে উচ্চস্বরে হো-হো করে হেসে উঠল সাদইদ। পাগল ছাড়া এভাবে হাসে না। মনে হল, এই হাসি যেন আকাশের দেবতাদেরই বিদ্রূপ করছে।

ইসিতে তার স্বর ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল, হাসি না থামিয়েই সে কথা বলে যেতে লাগল আর কোন সোল্লাসে ঘোড়ার পিঠ চাপড়ে উঠতে থাকল, বলল–তুমি মিশরী মেয়ে, তুমি বুঝবে! রাজা ফেরাউন তো নিজেই তিনভাগ দেবতা, একভাগ, মাত্র মানুষ। দেবতা আর মানুষে এই ভাগাভাগিটা হাস্যকর। হয় তুমি পুরোপুরি দেবতা হও, নতুবা পুরোটাই মানুষ হও। এমনকি তুমি। লাঠিধারীদের মত জাদুকরও হবে না। দেবতাদের স্বভাব সব সময় কুপিত থাকে। তারা যদি সত্যিই কোথাও থাকে, তবে তাদের বোঝা উচিত, মানুষ প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। মৃত্যুর পরও মানুষের একটা ছায়া থেকে যায়। যাক গে! আমার কথা তুমি বুঝবে না।

রিবিকা বলল–মানুষ ভাষা তৈরি করতে পারে একথা বিশ্বাস করা কঠিন সারগন! ভাষা ঈশ্বরের দান। মুখের ভিতর জিভ নেড়ে নেড়ে মানুষ শব্দ করতে পারে মাত্র, ভাষা তো অন্য জিনিস। ঈশ্বর না চাইলে মানুষ নতুন কোন ভাষা সৃষ্টি করতেই পারে না। তুমি ধ্বংস হবে সারগন! ঈশ্বরই ভাষাভেদ ঘটিয়েছেন। তুমি সৈনিকদের জন্য ভাষা তৈরি করলে কেন?

সাদইদ ম্লান হেসে বলল–জুমা পাহাড়ের ওদিকে আমরা এখন চলে যাব রিবিকা। পাহাড়ের নাম জুমা অথবা জুম । আমার ভাষার নাম জুমপাহাড়ী অরমিক ভাষা। এই ভাষা তোমাকেও শিখতে হবে। দেবদাসীরা, ওখানে গিয়ে দেখবে–জুমপাহাড়ীতে কথা বলছে। একটা অত্যন্ত নির্দোষ সহজ মিষ্টি ভাষা। ভয় নেই। আমি কোন দেবতাকে অপমান করার জন্য এই ভাষা তৈরি করিনি। বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলে একটা মিশ্রভাষা গড়ে না নিয়ে উপায় ছিল না। চলো, যাওয়া যাক।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে রিবিকা বলল–কোন অহংকার দেবতারা সহ্য করেন সারগন। নইলে সাত বছর মিশরে বৃষ্টিপাত নেই, জলোচ্ছ্বাস নেই–এমন কেন হবে! যারা ঘরে ঘরে নিস্তার-চিহ্ন, গুণচিহ্ন আঁকল, তারাই পুড়েছে। মহাত্মা ইহুদ, কোথায় রয়েছেন কেউ জানে না। আমি এই অরণ্যে বসে তাঁর জন্য অপেক্ষা করব। তোমার তৈরি ভাষায় কথা বলার আগে আমার যেন মৃত্যু হয়। হায় দেবী! মাগো!

বলতে বলতে দু’হাতে চোখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ল রিবিকা। সাদইদ পরম আশ্চর্য হল। কোন সৈনিক অথবা দেবদাসী কখনও এমন করেনি। সাদইদের কৃত্রিম ভাষায় কথা বলাতে তাদের কোনওই আপত্তি নেই। বিভিন্ন স্থান থেকে তারা এসেছে। তাদের নিজেদের গোষ্ঠীভাষা ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সংযোগের ভাষা জুমপাহাড়ী। তারা বাধ্য এই কৃত্রিম মনুষ্য-উদ্ভাবিত ভাষায় কথা বলতে। কেন না সেখানে এমনও দু একজন রয়েছে, যারা ভাষাগত কারণেই একা হয়ে পড়ে। একটা লোক শুধু তার নিজের ভাষাটিই জানে, সে কী করবে!

ভাষার সমস্যা বিকট। একজন শ্বেতাঙ্গিনী মিশরী দেবদাসীর কাছে কনানী সেনা ভাষার কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়ে গোলমাল বাধায়। আমারনার মেয়ে উর নগরীর প্রায় লুপ্ত ভাষা যখন একজন বলে, বুঝতে পারে না। ঈশ্বরের ভাষা না কি লুপ্ত হয় না। কিন্তু দামাস্কাসের কোন এক মরুজাতির এমন এক ভাষায় লোটা নামে একজন দুর্ধর্ষ সৈনিক আপন মনে কথা বলে যে, সাদইদ স্বয়ং হতবাক হয়ে শোনে বুঝতে পারে না। লোটার ভাষা জুমাপ্রদেশে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ ভাষা। লোটা যদি কালই মরে যায়,জুমার চারপাশে সেই ভাষাটিও আর শোনা যাবে না। মরুভূমির জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রিতে চাঁদের দিকে চেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দুবোধ্য ভাষায় সম্ভবত সে তার ভাগ্যকে অভিসম্পাত দেয়কী করুণ আর আদ্রব্যাকুল তার ভাষা! ভাষা দুর্বোধ্য, দুর্বোধ্যই নয়, অবোধ্য বলাই সঠিক, সে কাঁদে। মনে হয়, মানুষ নয়, অবলুপ্ত হওয়ার ভয়ে ভাষাটাই যেন কাঁদছে!

ভাষা দিয়ে ঈশ্বর মানুষকে বিচ্ছিন্ন করলেন। নোটাকে দেখলে মর্মান্তিক ঘটনাটির সেই যে একমাত্র বিষণ্ণ সাক্ষী, সেকথা গুরুতর আঘাত হয়ে হৃদয়ে বাজতে থাকে। লোটার ভাষাই শুধু আলাদা এবং একলা নয়। তার পূজাবিধিও আলাদা। জুমাতে একমাত্র উট-উপাসক সে। ভাষা এবং পূজা যদি এত স্বতন্ত্র হয়–তার ভাগ্যে অপার ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই বতায় না। অমিতসাহসী, বীর্যশালী এমন সৈনিক হয় না। সে মরে গেলে সাদইদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

সাদইদ সকরুণ চোখে রিবিকার দিকে চাইল। তারপর একটা ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লোটাকে সবাই খাটো চোখে দেখে। কবে সেই বাবিলের জিগুরাত, দর্পিত স্বর্গ মাটিতে ভেঙে পড়ল, কোন সেই অতীতের কথা। কিন্তু ভাষার ভিতর রইল তার শাপলাগা স্মৃতি। ঈশ্বর যেখানে একবার নাক গলাবেন, যুগ যুগ ধরে তারই প্রহার চলতে থাকবে।

দেবদাসী নিশিমা খুব দাম্ভিক মেয়ে। দরজার বাইরে লোটাকে ঠেলে ফেলে দিলে, শালা উটমুখো, বেদে! ভাষার মা বাপ নেই। আমার ইয়ে-ধোয়া জল খাস রে সালেহর বাচ্চা! ওরে গামছাবালা সারগনের ছাঁ–লিয়ে যা, মড়াটাকে পিরামিডের খাঁচায় শুইয়ে দে আয়। ওরে গামছাবালা! ভাতারের শালীর পো, আয় দুদু খা আর গা মোছা আমার! পিদিম জ্বেলে দ্যাখ মড়াটা দুয়োর আগলে ভনভন করে যাচ্ছে রে! কী ভাষার ছিরি! উটের খুরো, উটন্যাজা! শালা আমায় চাট মেরেছে রে! ফেলে দে বালির উপর।

এই তীব্র অপমান কোন সৈনিকই হজম করতে পারে না! তার মজ্জা থেতলে গেছে যেন। শরীরে ভাষার বিষ ঢুকে গেছে। সে পলাতক সেনা। ঘর হারানো, শ্রীপুত্রকন্যাহারা এক দলিত ক্ৰী দাস। আরাবা মরুর কোন্ দিগন্তে তার ভাষাগোষ্ঠী হারিয়ে গেছে। সে এ। এবং এ কারণে এত গোঁড়া যে, সে তার ভাষা এবং উট-উপাসনা কোনটি ছাড়তে রাজি নয়। সে সেই রাতে গামছাবালাদের দ্বারা প্রহৃত হয়ে সাইদের কাছে ছুটে এল। ইচ্ছে করলে সমস্ত মন্দির সে একাই রক্তাক্ত করে পিষে দিতে পারত। কিন্তু তাতে সমস্যা মিটত না। কামনাতাড়িত, নারীসঙ্গহারা, অপমানিত লোটা সাদইদের সামনে গুহার ভিতর নিজেকে একটি পাথরের উপর আছড়ে ফেলল।

নিকষ পাষাণের মত বলিষ্ঠ অন্ধকারসদৃশ ঘর্মাক্ত পিঠে আলো পড়েছে। এই ক্ষুদ্র পাহাড়টির অধীশ্বর সাদইদ। চর্বির মশালের আলো পাহাড়ের অভ্যন্তর উদ্ভাসিত করেছে আলো-ছায়ায়। পাহাড়টির একটি অংশ মন্দিরের মত করে কেটে কেটে বানানো হয়েছে সাদইদের গৃহ। পাহাড়ের চুড়োটা দূর থেকে দেখতে পিরামিডের মত স্পর্ধিত। পাহাড়কে ঘিরে তাঁবুর সংসার এবং কিছু কিছু ইটপাথরে তৈরি দেবদাসী মন্দির আর আছে দ্রাক্ষাকৃঞ্জ। এ অঞ্চল নগরও নয়, গ্রামও নয়।

তাঁবুতে পুরুষরা থাকে। মন্দিরে থাকে দেবদাসী। সৈনিকদের জন্য এ ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা জরুরি নয়। রাজা হিতেন আসলে সৈন্যাবাস এবং দুর্গ। স্থাপনের জন্য সাদইদকে ওই পাহাড় এবং দ্রাক্ষাকুঞ্জ দান করেছেন। যে-কোন সময় কেড়ে নিতে পারেন। পলাতক সৈন্যরা তাঁবুর তলায় থাকে, মন্দিরে রাত্রিবাস করে। বস্তুত এদের কোন সংসার নেই। সাদইদ এদের জন্য কখনও কোন গ্রাম বা নগর নির্মাণ করতে পারবে না। এদের দিতে পারবে না সংসার করার সুখ। যদি কখনও নিনিভে নগরী ধ্বংস হয়, তখনই যুদ্ধ থামবে। সাদইদ মনে মনে অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখে। সে এই সৈনিকদের আর দেবদাসীদের সঙ্গে করে কনান প্রদেশে একদিন ঢুকে যাবে।

তার প্রবর্তিত জুমপাহাড়ী ভাষা যুদ্ধকালীন ভাষা, ভয় হয় যুদ্ধ থামলে এই ভাষাটিরও মৃত্যু হবে। কিন্তু কানে ঢুকে যেতে পারলে ভাষাটি মরবে না। সৈনিদের মুখে এই ভাষা বাঁচবে, সৈনিকরা সংসার পেলে এবং দেবদাসীদের কৃষিক্ষেত্রে নিয়োগ করতে পারলে জুমপাহাড়ী মানুষের ঐক্যের ভাষা হিসেবে টিকে যাবে। দেবদাসীর সন্তানরা সংখ্যায় কম নয়।

আলো এসে পড়ল পিঠের উপর। পাথরের উপর মুখ রেখে কুঁজো হয়ে পড়ে থাকা লোটা ফুঁপিয়ে উঠল। তার শরীর অপমানে থরথর করে কাঁপতে থাকল গমকে গমকে। এই বিচ্ছিন্ন মানুষটিকে যে কোথায় রাখবে সাদইদ,ভেবে পেল না। ধর্মে একা, ভাষায় একক। এই বিচ্ছিন্নতা কেন? লোটার কী ভবিষ্যৎ? মানুষের হৃদয়ে এর কোন আশ্রয় নেই কেন?

নোটার পিঠের ঘর্মাক্ত-পিছল আলো চকচক করছে। লোটা বলছে–আমার। কে আছে? বউ নেই, সন্তান নেই।

অস্পষ্টভাবে লোটার আর্তচাপা গোঙানির ভাষা বোঝার চেষ্টা করে সাদইদ। তার কেবলই মনে হয়, লোটা বলছে, কে আছে তার–তার বউ, তার সন্তান?

যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার কি কোন আক্রোশ পুঞ্জীভূত হয়েছে হৃদয়ে? হঠাৎ সাদইদের মনে হল, লোটা যেন বলছে–যুদ্ধই যখন জীবন, তবে যুদ্ধই আমার। নিয়তি, তিনি আমায় গ্রহণ করুন! কতকাল আমি নারী-সঙ্গ করিনি। মানুষ কি এভাবে বাঁচতে পারে? দেবদাসীর এত দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এই যুদ্ধ? আর আমি, আমার ধর্ম এবং ভাষাকে দেবদাসীর পায়ে উৎসর্গ করব? আমি ভুলে যাব আমার সর্বস্ব? আমি আমার স্ত্রীপুত্রের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেছি, যে ধর্ম পালন করেছি, সব ত্যাগ করব একটি গণিকার কাছে? এমন পতিত অবস্থা কেন হল আমার?

সাদইদের কাছে লোটা এক সুতীব্র সমস্যা। লোটা তার কোন কিছুই ছাড়তে চায় না। জুমপাহাড়ী ভাষা সে মুখে উচ্চারণ করবে না। বোধহয় এই ভাষার অক্ষরগুলি নিয়ে তার আপত্তি আছে। কারণ অক্ষরগুলি ফিনিশীয় বর্ণমালা ছাড়া কিছু নয়, দু’একটি এদিক-ওদিকের মিশেল রয়েছে মাত্র। কিছু ইস্তারী চিহ্ন আর নকশা আছে, আছে মিশরীয় দু’একটি অপভ্রংশ। সব মিলিয়ে এ তার কাছে উৎকট মনে হয়েছে হয়ত। সে মনে করে তার নিজের ভাষা নিদোষ আর পবিত্র। দেবভাষা তার। সে কেন সেই ভাষা ত্যাগ করবে?

অতএব সীমাহারা নিঃসঙ্গতাই তার সঙ্গী! সবচেয়ে বড় সমস্যা তার ধর্ম। সৈন্যশিবিরে দেবতা আমন বা সামাশই যথেষ্ট অথবা দেবী ইস্তার কিংবা বালদেব। কারো মনে উঁকি দেয় ঈশ্বর যবহ। তারা মেষের মূর্তি কাছে রাখে। কিন্তু তাদের কেউ তেমন ঘৃণা করে না। কেবল নোটার বেলা যত বিপত্তি। সে

উটের বিগ্রহ সামনে রেখে বসে থাকে।

লোটার ধর্ম পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাবে, এই ভয়ে লোটা তীব্র এক বিষাদে রক্তাক্ত হয়েছে। তার একাকিত্ব যেন পিরামিডের চূড়ার মত অলৌকিক। লোটার জন্য দেবদাসী রিবিকা কি সুলভ্য হতে পারে না? নাকি এই নারীকে রাজা হিতেনের হারেমে উৎসর্গ করবে সাদই? হিতেনের হারেম সুন্দরীদের এক বিপুল সমাবেশ মাত্র। সেখানকার প্রহরীরা খোঁজা সম্প্রদায়। শোনা যায়, সেই হারেম সমকামী নারীতে পরিপূর্ণ। সমকামী নারীদের রতিমোচনের প্রদর্শনী রাজা হিতেনের প্রসিদ্ধ বিলাস। রাজা হিতেন কাম ও রতির দেবতা হবার বাসনা করেন। তিনি নাকি আপন শরীরে রতি আর কামকে একত্র ধারণ করার কথা ভাবেন।

একদিকে লোটা, অন্যদিকে হিতেনকার জন্য রিবিকাকে সাদইদ নির্বাচন করবে?

বেদনাপূর্ণ দৃষ্টিতে সাদইদ রিবিকাকে দেখতে থাকে। সাদইদের এই দৃষ্টিপাত, চোখের ভাষাবিভঙ্গ, চাহনির কারুণ্য কোন প্রকারেই উপলব্ধি করতে পারে না রিবিকা।

সাদইদ সহসা রিবিকাকে অশ্বপৃষ্ঠে তুলে নিয়ে কেমন এক ক্ষিপ্ত আক্রোশে দুবার বেগে মরুভূমির বুকে অশ্ব ছুটিয়ে দেয়। হতচকিত বিহ্বল হয়ে পড়ে রিবিকা। সাদইদ আপন মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকে–একটি প্রজাপতি জীবনের পক্ষে যথেষ্ট নয়। কিছুতেই নয়। মহাপিতা নোহ, তুমি আমাকে এভাবে বিভ্রান্ত করছ কেন? আমি কোন বীজ অথবা কোন জীবকাররা সুরক্ষা জানি না। আমি ত্রাতা নই। জীবনের অর্থ এই মরুভূমির বুকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। এখানে যুদ্ধ আর নারীর তৃষ্ণা ছাড়া আর কিছু নেই। সুন্দরী নিনিভে, তার আলো, রক্তে তোলপাড় করে। কেন এভাবে ছুটছি আমি? কোথায় চলেছি? আমার ফুলের আর আতরের বাজার। অথচ পশম সংগ্রহের সামর্থ্য নেই। কেন আমি স্বপ্ন দেখি তবে? কেন দেখি? মেয়েটি আমাকে সারগন বলেছে, অথচ আমি তো সামান্য ভাড়াটে সৈনিক। মরুভূমির লুটের রসদ জোগাড় করা আমার কাজ। আমার দৃষ্টি কেন তুচ্ছ রঙিন দু’টি পতঙ্গের উপর নিবদ্ধ হয়? কী আছে হৃদয়ের ভিতর? পিরামিডের চেয়ে, বাবিলের জিগুরাতের চেয়ে হৃদয় কি বিস্ময়কর?

তার দিয়ে ঘেরা এবং ইট দিয়ে কোমর পর্যন্ত খাড়া করা প্রাচীরের আড়ালে শবির। তারগুলি তেমন মিহি নয়, ধাতু ঘষে ঘষে সরু করা। অসুররা অনেক সময় শিবির আক্রমণ করে তাবৎ সৈন্যবাহিনী মুহূর্তে নিঃশেষ করে দেয়। বশেষত ভাড়াটে সৈনিকদের উপর অসুরদের ক্রোধ সীমাহীন। তাই গাছপালা ঘেরা, ইটের প্রাচীর এবং প্রাচীরের উপর ধাতুর মোটা তারের বেড়া, বস্তুত শিক দিয়ে বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে বানানো বেড়া–সহসা আক্রান্ত হলে সৈন্যরা পালিয়ে যাওয়ার কিছুটা সময় পায়। হৃদয়ের কথা ভাবতে ভাবতে শিবিরের দিকে মুহূর্তে চোখ চলে যায় সাইদের। অশ্ব তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছিল, হঠাৎ শিবিরে ঢুকে পড়ল।

গাছপালার ভিতর কতকগুলি তাঁবুর ছাউনি ছাড়া অন্য কোন গৃহ নেই। অশ নিয়ে প্রাচীরের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল সাদইদ। অত্যন্ত ছোট একটি শিঙা, যা তার গলায় ঝোলে, সেটি ফুকে উঠল সে। সেই শব্দে একটি তাঁবু থেকে প্রথমে একজন, পরে অন্যান্য তাঁবু থেকে দু’একজন বেরিয়ে এসে দাঁড়াল। শিঙার সুরের ভিতর কোন ব্যস্ততার সুর ছিল না, খুব শান্ত স্বরে ডাকা–তাই তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসা সৈনিকদের চোখে-মুখে তেমন কোন উদ্বেগের চিহ্নই দেখা যায় না।

সাদইদ রিবিকার সমস্ত মুখমণ্ডল এবং শরীর কাপড়খানির দ্বারা ঘোমটার মত করে তুলে ঢেকে দিয়ে বলল–তুমি চুপ করে থেকো, কথা বলবে না।

রিবিকা বুঝল, সাদইদ তাকে গোপন করতে চাইছে। তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেবার পর কী মনে করে সাদইদ পথ থেকে এদিকেই ফের ছুটে এল । একটি তাঁবুর থেকে একজন মাত্র সৈনিকই তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। জুম পাহাড়ের দিকে অশ্ব ধেয়ে যেতে গিয়ে ফিরে এসেছে সাদইদ। এখানে রয়েছে আটাশজন নব্য সৈনিক–এরা পালিয়ে এসেছে বিভিন্ন নগরী থেকে, দু’একজন জুটেছে মরুপথ থেকে। প্রত্যেকেই ছিল পদাতিক। এদের অশ্ব চালনার কোনওই অভিজ্ঞতা নেই।

সৈনিকটি কাছে এগিয়ে আসতেই সাদইদ বলল–একজনকে পথের উপর পাওয়া গেছে সমের মিঞা, তুমি সকলকে বলে দাও। আমি আহত এই বেচারিকে নিয়ে পাহাড়ে চলে যাচ্ছি। এর চিকিৎসা দরকার। আমার ফিরতে কোন কারণে দেরি হলে লোটাকে পাঠিয়ে দেব। আর শোন, রাজা হিতেনের সঙ্গে দেখা করা জরুরি, আমি চলে যেতে পারি। অযথা কেউ যেন মরুযাত্রীদের আক্রমণ না করে। অসুররা মরুযাত্রীর বেশ ধরে যাচ্ছে, আসলে প্রত্যেকটা কাফেলাই এখন সন্দেহজনক–তারা মরুযাত্রী না-ও হতে পারে। সৈনিক হতে পারে। না বুঝে আক্রমণ করতে গিয়ে, ফল উল্টো হতে পারে। তোমরা নতুন, শিবির ধ্বংস করে চলে যাবে অসুররা। সাবধানে থাকবে।

সৈনিকটা মাথা নেড়ে সাদইদের কথায় সায় দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল, সহসা সাদইদ বলে উঠল–মনে রেখো সমেরু, একজন সৈনিক আমার কাছে আমার এই সাদা ঘোড়াটার মতই দামী। অযথা কোন প্রাণের বাজে খরচ পিতা নোহ পছন্দ করেন না। রাজা হিতেনের কাছে একশ’টি সুন্দরী দেবদাসীর মূল্য যরকম, আমার কাছে ক্ষুদ্র একজন সৈন্য তারও চেয়ে শতগুণ মূল্যবান। আমি তোমাদের শপথ করে বলতে পারি, কখনও যদি একটি গ্রামও আমি অধিকার রুরি, তোমাদের মত সৈনিকদের আমি সেখানে সংসার গড়বার ব্যবস্থা করব।

সাদইদের কথায় পিছনে ফিরে দাঁড়িয়েছিল সমেরু। স্মিত হেসে বলল–প্রাণে বাঁচলে তবে তো সংসার! একখানা তাঁবু, দু’মুঠো খাদ্য আর আমার মা। আমি আর কিছুই চাই না মহামতি। একটা নদীর ধারে ছোট একখানা তাঁবু ফেলবার অধিকার আর মাকে ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখি। আপনি আমার জন্য তাই করুন। আমি কোন দেবদাসীর মন্দিরে যেতে চাই নে। মহাত্মা উঁহুদের ধর্মই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তিনি মানুষের পাপ আর পুণ্যের সীমানা নর্ধারণ করতে পারেন। আমার মনে হচ্ছে, জুম পাহাড়ের ওদিকে তাঁকে কোথাও আমি দেখেছি। আমার বাঁচালতা ক্ষমা করবেন, আমি ছেলেমানুষ, মামার বিয়ে হয়নি, মা-ই আমার চোখে একমাত্র সবচেয়ে সার্থক নারী, আমি সেই মাকে হারিয়েছি, আমার আর চাইবার কিছু নেই।

কথা শেষ করেই সমেরু দ্রুত পায়ে তাঁবুর দিকে ছুটে গেল।

সমেরু নামে এই কিশোরটির মুখমণ্ডল অত্যন্ত নরম। হাত-পা সুন্দরী দেবদাসীদের মত অতিমাত্রায় কোমল। গোঁফের রেখা অবধি ঠিকমতন ওঠেনি। চোখ দুটি এত মায়াবী যে,মরূদ্যানের স্বচ্ছ জল যেন ভরে আছে বলে মনে হয়, শান্ত সেই চোখে স্থির তার হৃদয়, যেন ছায়ায় মোড়ানো একটি হ্রদ। সে তার মা ছাড়া অন্য কোন নারীর কথা চিন্তা করতে চায় না।

যুদ্ধেরও একটি অলিখিত, লিপিহীন পঞ্জিকা প্রণয়ন করতে হয়েছে নাইদকে–কিন্তু সেই পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় আজ একটি অভূতপূর্ব তথ্য সন্নিবেশিত হল। মা-ই একমাত্র নারী। সমেরু জোরের সঙ্গে বলল, মহাত্মা ইহুদের ধর্মই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তিনি পাপ আর পুণ্যের সীমানা নির্ধারণ করেন। কথাটা শুনেই মনে হল, ছেলেটি এই বাক্যটি মুখস্থ করেছে। নারী সম্পর্কে তার বক্তব্যও অজি। মা ছাড়া আর যেন কোন নারীই হয় না। সে তার মাকে নিয়ে নদীর ধারের তাঁবুতে বাস করতে চায়। সে দেবদাসীর মন্দিরকে ভয় পায় বলে মনে চল। ভাবতে ভাবতে সাদইদের এক তীব্র কৌতূহল হতে থাকল।

অশটি মন্থর বেগে অগ্রসর হচ্ছিল। মাথার কাপড় নামিয়ে ফেলে রিবিকা বলল–আমি পারলাম না! হায় দেবী!

–কী পারলে না রিবিকা!

–ওই ছেলেটাকে মুখের পর্দা সরিয়ে কেন দেখলাম না! ও নিশ্চয়ই মহাত্মা ইহুদকে দেখেছে! আমি প্রশ্ন করতে পারতাম! তাছাড়া ওর মুখটা আমার চিনে রাখা উচিত ছিল। যে কিশোর মা ছাড়া কিছু জানে না, তাকে কেন আপনি নষ্ট করছেন সারগন! দোহাই! আপনি ওকে রক্ষা করুন!

রিবিকা আর্তস্বরে ককিয়ে উঠল। সাদইদ লক্ষ্য করছিল, প্রথমাবধি এই মেয়েটি তাকে ‘আপনি-তুমি’ করছে, যখন যা মুখে আসছে। কখনও তাকে ভাবছে সামান্য সৈনিক, কখনও ভাবছে মহামতি সারগন। মাথারও কিছু ‘বেগড়বাঁই’ আছে সন্দেহ নেই। সহসা একটা কিসের ঝোঁকে বেমক্কা সাদইদ ঈষৎ আক্রমণাত্মক ঢঙে পেশ করল–সমেরুকে তোমার পছন্দ হয়? ওকে তুমি চাও বুঝি? চোখে দেখলে তোমার শরীরে তেষ্টা পেত নিশ্চয়ই। ঠিক আছে, একদিন দেখা হবে অবশ্য।

–না! না! ভয়ে কেমন আর্ত চাপাস্বর ফুটে ওঠে রিবিকার গলায়।

–না কেন! ও-ও তো সৈন্যমাত্র। কেবল তুমি তোমার মন্দিরটা পরিচ্ছন্ন রাখবে। দ্যাখো, ও হল জোয়ান ছেলে, দেহে প্রচণ্ড জোর–ওকে সমস্ত বুদ্ধি দিয়ে আমি তৈরি করব । ও যেভাবে মা মা করছে, সেটা পাগলামি! ওকে যদি আমি একটি মাত্র রূপের কথা বলি–যেমন ধরো, নারীর বুকের চন্দ্রোদয় সে দেখেনি, সেটা যদি বলি–কেমন হতে পারে! ভেবে দ্যাখো, দুটি প্রজাপতি তোমাকে অধিকার করেছিল! কেন করেছিল! পতঙ্গ নির্বোধ বটে, কিন্তু ফুল ছাড়া সে বসে না । পতঙ্গ মানে এই দুটি প্রজাপতির কথা আমি বলছি। তারা ফুল ছাড়া বসে না। অথচ তারা তোমায় অধিকার করেছিল। মা সুন্দর। কিন্তু এই দৃশ্যটা নিশ্চয়ই তার জানা নেই। বলা দরকার, জীবনে আরো কিছু আছে, জানতে হলে তোমার মত দেবদাসীর কাছেই যেতে হয়।

অশ্ব কিছুটা গতি বাড়িয়েছে। টিপে টিপে ঠোঁটের তলায় একটি একটি শব্দ উচ্চারণ করে চলেছিল সাদইদ। কথা না কি মন্ত্র বোঝা যায় না। লোকটা কবি সন্দেহ নেই। তবে ভয়ানক যোদ্ধা এবং গভীর চিন্তানায়কও বটে। তার অভিসন্ধিরও সীমা নেই।

সহসা সাদইদ বলে ফেলল–তোমার রূপের আড়ালে খুব উত্তেজক সুরা আছে আমনের বউ। সেটা ছেলেটাকে ধরাতে হবে। নইলে ছেলেটা ফের কোথাও ভেগে যেতে পারে।

শুনতে শুনতে সভয়ে শিউরে উঠল রিবিকা। সমেরু এক অদ্ভুত কিশোর নিশ্চয়। কণ্ঠস্বর পাখির মতন সুরেলা। তাকে সে দেখেনি। সারগন তাকে ঢেকে রেখেছিল। অবশ্যই তাকে নিয়ে এই অশ্বারোহী সৈনিকটির নানান মতলব মাথায় আসছে । পতঙ্গ-অধিকৃত নারী যদি সমেরুকে নষ্ট করবার জন্য ব্যবহৃত হয়–তবে এই সৈনিকটির কবিত্ব সর্বনাশা। এই লোকটি নিশ্চয়ই তার কবিত্বকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করে–একে বিশ্বাস করা পাপ। ভাবতে ভাবতে দম পায় না রিবিকা।

রিবিকা এইরূপ ভাবছিল বটে, কিন্তু যুদ্ধের কতকগুলি নিজস্ব নীতি আছে। মানুষের জমি দখলের দাঙ্গাগুলি একরোখা ঘটনা, সেখানে কোন উচ্চাশা থাকে না। এ অবধি মানুষের মনে পাপ জন্মায় না। বাঁচার জন্য মানুষ হয় হানাদার। কিন্তু যুদ্ধ অন্য জিনিস। মানুষ যখন থেকে নগর গড়তে শিখল, তখন থেকে। হানাহানি মাত্রই যুদ্ধ নয় বোঝা গেল। গ্রাম এবং অন্য নগরীগুলিকে শুষে শুষে এনে একটি উপত্যকাকে সাজিয়ে ভোলা, যেন একটি শোভিত স্বপ্ন, তার খিলান, গম্বুজ, সিঁড়ি ও প্রাচীর-দম্ভ আর ঔদ্ধত্যের ভাস্কর্য, তিনতলা সাঁজোয়া গাড়িটি মানুষের শস্ত্র আর ক্রীতদাসে পূর্ণ হয়ে মরুপথ যখন অতিক্রম করে তখনই বোঝা যায় যুদ্ধ হল মানুষের সর্বাত্মক বিভীষিকা।

সামান্য একজন দেবদাসী নীল নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে কতদিন একথা ভেবেছে। আজ সে জীবনের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার ভিতর প্রবেশ করছিল। জীবনে সে কখনও বা চকিতে অনুভব করার চেষ্টা করেছে যে নারীর বক্ষাকাশে এক নিবিড় চন্দ্রোদয় হয়, আবীরুদ তার কবিতায় একদা একথা বলেছিল, সে কথায় রোমাঞ্চ ছিল–কিন্তু প্রজাপতি যখন তাকে অধিকার করল, পৃথিবীর সকল মসীহ এবং আকাশের দেবতাদের সমূহ প্রার্থনা যেন তখন তারই জন্য। কেন্দ্রীভূত হয়েছে, এ বিস্ময় শেষ হতে না হতেই সাদইদ তাকে বলেছে, তার রূপের আড়ালে রয়েছে মদ। এ সৌন্দর্য যুদ্ধেরই উদ্দীপনা মাত্র। বহুদর্শী এ জীবন তার। অভিজ্ঞতাও নানা-বিভঙ্গিত। আক্কাদের হাতের আঙুল ছিল মোটা, মেটে সাপের মত। সাদইদের আঙুল পুষ্পকলিকার ন্যায়, কিন্তু সে আঙুল নখরে। শাণিত একথা বিস্মৃত হলে চলে না।

সাদইদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–একজন এহেন কিশোরকে সৈন্যরা উত্ত্যক্ত করে। কী বলব তোমায় রিবিকা। মেয়েছেলে সস্তা হলেও, যুদ্ধের নিয়ম হল, সৈনিকের কাছে তাদের একটু আক্ৰা করে রাখতে হয়। যত দেবদাসী দরকার আমার মন্দিরে,ততটা সরবরাহ নেই। হিতেন বলেন, একটু কম করেই রাখো। ফলে হয়েছে কি, একটা মন্দিরেই দশজন সৈনিকের লাইন পড়ে যায়। ফের প্রধান সৈন্যদের আলাদা ব্যবস্থা-জনপ্রতি একজন দেবদাসী দিতে হয়। ভেবে দ্যাখো, কী অবস্থা! একখানা মন্দির, একজন দেবদাসী আর একজনই সেনাপতি। সমস্ত ব্যাপারেই অভাব তৈরি হয়। মেয়েছেলে সস্তা কিন্তু দেবদাসী আক্রা–এই কৃত্রিম অভাব বজায় না থাকলে যুদ্ধ থেমে যাবে। এর একটা কুফল হচ্ছে, সমেরুর মত কিশোরদের সৈন্যরা খোবলাবে। পুরুষ যখন পুরুষকে প্রেম নিবেদন করছে, জানবে সেটা সমকামী শিবির।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অশ্বের গতিবেগ আরো কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে দিয়ে সাদইদ বলল–আমি সৈন্যদের শেখাই। না–কোন ধর্মপুরাণ পাঠ করতে শেখাই না। শেখাই শস্ত্র ক্ষেপণ করা। অশ্ব চালনা। অর্থের পিঠে চড়ে ছুটতে ছুটতে বশ ছুঁড়ে লক্ষ্য ভেদ করা। লক্ষ্য করেছি, সমেক দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকলে কোন কোন সেনা লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হয়। আমি আজ তিনদিন এই সবই করেছি। তোমাকে এসব কথা শোনাতে আমার ভালই লাগছে–কেননা তুমি মিশরী দেবদাসী।

.

আবার থামল সাদইদ। তারপর বলল–সমেরু সামনে থাকলে নষ্টমজ্জার সেপাই দৃষ্টি-বিভ্রান্ত হয়ে কাত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। তখন অন্যরা হো হো করে হাসে। এটাও এক ধরনের উদ্দীপনা এবং শিক্ষাও বটে। সমেরু সামনে থাকলেও লক্ষ্যভেদ করতে হবে–যাতে চাঁদমারী বিদ্ধ হয়। ভয় হচ্ছে সমেরুকে না সৈন্যরা নিজেদের ভিতর লুফালুফি করে মেরে ফেলে!

ফের অশ্বের গতি সামান্য পড়ে এল। এমনকি হঠাৎ থেমেই পড়ল সাদইদ। সমেরুর দুর্ভাগ্যের কথা রিবিকা বিমূঢ় হয়ে শুনছিল। এই বিবরণ বিশ্বাস করতে তার বুক কেঁপে যাচ্ছিল। সমেরু তবে শিবির ছেড়ে পালাতে চাইবে না কেন? যুদ্ধের এই নির্লজ্জতা ক্ষমাহীন। একজন রূপবান নিদোষ কিশোর-রিবিকা তাকে কল্পনার চোখে দেখতে থাকে। সৈন্যরা তাকে কামনা করে পরস্পরের মধ্যে কামড়াকামড়ি বাধিয়েছে–এ দৃশ্য রিবিকার কল্পনায় আসতে চায় না। সমেরু সামনে আছে বলে সৈন্যের বর্শা লক্ষ্যবিন্দু বিদ্ধ করতে পারছে না। ছেলেটা তবে কী করে বাঁচবে! মনে হল, সমেরু তার চেয়েও হতভাগ্য, যে তার মা ছাড়া অন্য কারুকে জানে না। কোন কিশোরের মনের এমন সরল স্বপ্নকে নষ্ট করছে মানুষ, এই অশ্বচালক কবি হয়েও কী করে সইছে এইসব! এ বান্দার পতন অনিবার্য! মনে পড়ল ইহুদ কতদিন সদোম আর ঘোমরা শহর দুটির ধ্বংসের কথা বলেছেন! লোট, লোটের বউ, জিব্রিল আর আব্রাহামের কাহিনী।

উক্ত নগর দু’টি সমকামিতায় ভরে গিয়েছিল। যবহ জিব্রিলকে নগর দু’টিকে ধ্বংস করার জন্য পাঠালেন। পিতা আব্রাহামের সঙ্গে সীনয় পাহাড়ে তাঁর বন্ধু ঈশ্বর যবহের কথা হত। যবহ বললেন,–ওহে আব্রাহাম, শোন আমার বাতাবাহক (পয়গম্বর)! আমার গায়েবী আওয়াজ শোন! অদৃশ্য বার্তা শোন! আমি নগর দুটি ধ্বংস করব! ওখানে আর কোন ভাল মানুষ অবশিষ্ট নেই।

আব্রাহম বললেন–না বন্ধু যবহ! আমার ঈশ্বর! আপনি একবার অন্তত পরীক্ষা করে দেখুন, সেখানে অন্তত ৫০ জন ভাল মানুষ পাওয়া যাবে। লোট আমার বন্ধু–সে অত্যন্ত ভাল লোক। আরো ভাল লোক আছে। আমি বিশ্বাস করি না সমস্ত মানুষ খারাপ হয়ে গিয়েছে।

জিব্রিল একদিন অতঃপর আব্রাহামকে সঙ্গে করে লোটের বাড়ি আতিথ্য গ্রহণ করলেন। তখন নগরীর লোকেরা লোটের বাড়ি আক্রমণ করে। তারা জিব্রিল এবং আব্রাহামকে সমকামী সন্দেহ করে–ভাবে এরা দুজন অপূর্ব মানুষ! লোট নগরবাসীদের বোঝাতে পারে না এই দুজন সমকামী নয়–এরা আলাদা। জিব্রিল খেপে গিয়ে নগরের লোকেদের অন্ধ করে দেন। লোট পরিবারকে খিড়কি পথে নিষ্ক্রান্ত করেন জিব্রিল। আব্রাহাম অতঃপর লোট এবং লোটের বউকে সঙ্গে করে পাহাড়ের দিকে ছুটতে শুরু করেন।

জিব্রিল বলেন, তোমরা কেউ পিছনে ফিরে চাইবে না। শাপ লাগবে। পালাও। পালাও।

হঠাৎ তীব্র এক আওয়াজ হয় পিছনের দিকে। লোটের স্ত্রী ভুল করে পিছনে চেয়ে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নুনের অনড় মূর্তিতে পরিণত হন। সীনয় পাহাড়ের আগুন থেকে গন্ধক বৃষ্টি শুরু হয়। ঈশ্বর লোটের বউকে অবধি গ্রাস করেন। বউ পিছনে চেয়ে দেখে ভুল করেন–এত পাপগ্রস্ত নগরীর দিকে দৃকপাত করাও ভয়াবহ। ইহুদ বলেছেন, সমকামিতা কোন বিদ্যা নয়। কলাও নয়। পাপ। নগর নির্মাণ করা স্পর্ধা মাত্র।

রিবিকা ভাবল, ইহুদের প্রতিটি কথা সত্য। তিনি স্বয়ং সত্য। সমেরু তাকে দেখেছে।

–সমেরুর সঙ্গে আমার দেখা হবে বললে! ও নিশ্চয়ই মহাত্মার ঠিকানা জানে! জিজ্ঞাসা করে রিবিকা।

ঘোড়া থেমে পড়েছে। সামনের দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে সাদইদ। সদ্য হত্যাকাণ্ড হয়ে গেছে পথের উপর। একটি সুদীর্ঘ উদ্বাস্তু প্রবাহ উল্টো দিকে চলেছিল বলে মনে হচ্ছে। আসিরিয়ার দিক থেকে যাচ্ছিল সিদন টায়ার মাগিদ্য উপদ্বীপগুলির দিকে–সবই রাস্তায় খতম হয়ে গিয়েছে। এ প্রবাহ নতুনই শুরু হয়েছে। ক্রমশ নিনিভের পতন আসন্ন হয়ে উঠছে । নিনিভের উপর চারিদিকের আক্রমণ শুরু হয়েছে।

ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে সাদইদ। ঘোড়াটি রিবিকাকে পিঠে করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এমন দৃশ্য অশ্বটির কত চেনা। দেবদাসীকে যেভাবে মানুষ চারিদিক থেকে খোবলায়, রূপসী নগরীকেও সেই ধারা ঠুকরে চলে। যারা খতম হল, তারা সবাই ভাস্কর আর মিস্ত্রী। দুঃখ হয় এরাই নিনিভের নির্মাতা। যারা গড়ে তুলেছিল, তাদেরই আজ কোন আশ্রয় নেই। ওদের অস্ত্র হল নানা ধরনের চিকণ কাজের হাতিয়ার। থলেয় মুখ আঁটা অবস্থায় তাদেরই মৃতদেহের পাশে পড়ে রয়েছে।

সবাই মৃত। বোঝা যায় অসুররা মারেনি। সাদইদের মতই কোন ভাড়াটে দল মেরে গিয়েছে। এরা বেঁচে থাকলে আরো কত নগর নির্মাণ করতে পারত। হঠাৎ মৃত্যুস্তূপের ভিতর একটি শিশুর কান্না উচ্চকিত হয়।

.

০৪.

দুপুরে মরুভূমির উত্তাপ বেড়েছে। প্রকাশ্য দিনের বিপুল ক্ষমাহীন আলোয় মৃতদেহগুলি পড়ে আছে। খুব ভোরের দিকেই হয়ত খুন হয়ে গিয়েছে। ভাড়াটে সৈনিকরাই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। মরুযাত্রীরা ছিল সকলেই পায়ে হাঁটা মানুষ, সম্পূর্ণ নিরস্তু। অসুররা হত্যা করলে খুঁটায় টাঙিয়ে দিত মৃতদেহ। মুণ্ডু ছিন্ন করত । ঘাতকরা যখন তা করেনি, বুকে কেবল বশ বিদ্ধ করেছে, বোঝা যায় এরা কারা। মৃতদের সঙ্গে কোন গৃহপালিত পশুদল ছিল না, শস্যও ছিল না তেমন। মিস্ত্রী আর পাথরকাটিয়ে শ্রমিক এবং কিছু ভাস্কর পরিবার নিনিভে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল প্রাণের ভয়ে। অত্যন্ত লোভী, ভয়ানক বোকা আর স্বার্থপর নির্দয় কোন সৈন্যদল এই-ধারা নিরীহ মানুষদের হত্যা করে ফেলে গেছে।

সামান্য দু’চার রত্তি কানের সোনা আর কাপড়ের পুঁটুলি বাঁধা যবের দু’চার কুনকে ছাতুর লোভেই মানুষ মানুষকে হত্যা করতে পারে–যুদ্ধ আর নগর-সভ্যতা মানুষের জন্য এমনই পরিণাম রচনা করেছে। মরবার আগে এরা ভয়ে চেঁচাতেও পারেনি। শিশুটি কিন্তু আশ্চর্যভাবে জীবিত। মৃতা মায়ের চন্দ্রোদিত নগ্ন বুকে মুখ ঠেকিয়ে স্তন্যপানের চেষ্টা করছে। হঠাৎ কেন যেন সাদইদের মনে হল, দুধের বদলে শিশুর মুখে রক্ত উঠে আসবে।

দ্রুত হাত বাড়ায় সাদইদ। শিশুটাকে বুকে তুলে নেয়। ভাড়াটে সৈনিক মানেই খুব দয়ালু এমন ভাববার তেমন যোগ্য কারণ নেই। বরং তারা খাদ্যাভাবে, বস্ত্রাভাবে এইভাবে দুস্যুবৃত্তি পোষণ করে। সাদইদ ভাবছিল, কোথাও মানুষ সম্পর্কে আশার আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এই শিশুটিকে নিয়ে এখন সে কী করবে? গলায় শিশুটির একটি ঝকঝকে রূপার লকেট ঝুলছে। মৃতদেহের ভিতর পা ফেলতে বরাবরই সাদইদের খারাপ লাগে।

সমস্ত দৃশ্যটি চেয়ে চেয়ে প্রায় নিষ্পলক দেখছিল দেবতাদের দেহের মত শুভ্র অশ্বটি। মৃতদেহের তূপ দেখলেই ঘোড়াটা এভাবে স্থির হয়ে দাঁড়ায়–পুরনো নক্ষত্রের মত চোখ মেলে চেয়ে থাকে।

পায়ে পায়ে ঘোড়ার কাছে এগিয়ে এল সাদইদ। শিশুটিকে রিবিকার দিকে তুলে ধরে বললনাও। যুদ্ধের পাওনা। আজ আমার ভাগ্যটা খুব প্রসন্ন দেখছি । বিনে যুদ্ধে একটা আশ্চর্য নারী এবং অত্যাশ্চর্য শিশু উপহার পেলাম। শিশুটি মেয়ে নাকি ছেলে–ওহো ছেলেই বটে–তা বেশ। ওর গলায় এই লকেটটা ঝুলছিল। দাঁড়াও দেখি লকেটের খোপে কী রয়েছে!

মুখটা খুলতেই চোখে পড়ল খুদে খুদে লিপি-লকেটটা ছিনিয়ে নেবার আগে শিশুকে বিষ আর মধু দাও–ইতি হেরা। নিনিভের ভাস্কর হেরা–এ তারই পুত্র। সেই পরিচয় লিপিবদ্ধ রয়েছে।

–কী লেখা আছে সারগন?

সাদইদ খোপ বন্ধ করে শিশুর গলায় লকেটটা অত্যন্ত গম্ভীর মুখে ঝুলিয়ে দেয়। কথা বলে না। ধীরে ধীরে ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠে বসে। অশ্ব হাঁকিয়ে দেয়।

–বললে না কী লেখা আছে?

লকেটের ঢাকনা দু’টি প্রজাপতির পাখনার মত। অশ্ব থেকে সাদইদ সহসা নেমে পড়ে বলে–রিবিকা তুমি পিছনে বসে আমাকে দুহাতে ধরে থাকবে–পুত্রটিকে আমায় দাও–তুমি সামলাতে পারবে না।

সেইভাবে বিন্যস্ত হল দৃশ্য। অশ্ব ধাবিত হল। চোখের সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে জুম পাহাড়। চলতে চলতে সাদইদ রিবিকার প্রশ্নের জবাব দেয়। তারপর বলে–এই লকেটটা হেরার নিজের হাতের তৈরি। অথবা তারই নির্দেশে কোন মণিকার বানিয়ে দিয়েছে। ওই শব্যুপে এই শিশুর পিত্তা পড়ে রইল কিনা জানি নে। অথচ আমি এই শিশুকে মধু দিতে পারি, কিন্তু বিষ দিতে পারি না রিবিকা!

শিশুটিকে কোলে তুলে নেবার সময় সাদইদের বারবারই মনে হচ্ছিল আরো একটি শিশুর কথা। তার মা তাকে প্রসব করা মাত্র জিব্রিল মাকে হত্যা করে। সে ভেসে যেতে থাকে ঝুড়িতে। যে দ্বীপে তার জন্ম সেই দ্বীপ নাকি সমুদ্রের তলায় তারপর তলিয়ে যায়। কুফর দ্বীপে তার জন্ম–সে দ্বীপ আর নেই। তাকে তার ভিস্তি পিতা কাফেরের পুত্র বলে ডাকত। কুফর এক অভিশপ্ত দ্বীপ। এই শিশুটি তারই মত কাফের নিশ্চয়। কোন স্বপ্নদর্শী এই শিশুকে দেখলে হয়ত বলতে পারতেন, এ বেচারি ঈশ্বর বিশ্বাস করবে না, আকাশের দেবতাদের অবজ্ঞা করবে, নবীদের করবে উপহাস। কেননা এর জন্ম আর শৈশব মৃতদের তূপে এসে ঠেকেছে, এতদূর হতভাগ্য শিশু কোথাওই তার আস্থা এবং বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না–বরং সে নিজেকেই ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। সে তার নিজেরই মত করে একটি একটি আকাশ, সূর্য, চন্দ্র এবং অজস্র তারকাপুঞ্জ আর পাহাড় বন নদী সৃষ্টি করে আপন মনে। তার কেবলই মনে হয় এই আকাশ, বন, নদী, সমুদ্র কোন দেবতার সৃষ্টি নয়–এরা সূর্যের মত আপনাতে আপনি পূর্ণ–এদের কোন নির্মাতা নেই। মানুষও জন্মের পর নিজেকে বানায় নিজেকে সে খাদ্য দেয়, বস্ত্র দেয়, গৃহ দেয়–সে নিজেই তবে জীব-দেবতা।

জন্ম মৃত্যু অপরিজ্ঞাত, জীবনও রহস্যময়। চাঁদ, সূর্য, তারকার যেমন আকাশ রয়েছে, মানুষের রয়েছে জীবন। আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সূর্য-চন্দ্র, তেমনি মানুষও ভাসছে জীবনভর। একটি ঝুড়িতে করে শিশুর ভেসে যাওয়া কি কম কথা!

একবার পাহাড়, একবার আকাশ দেখল সাদইদ। দূরে সমুদ্র গর্জন করছে। সাদইদ শিশুর মুখের দিকে চেয়ে থেকে ভাবল, শিশুটা এখনও ভেসেই রয়েছে, তার রয়েছে মনের আকাশ–তার রয়েছে চন্দ্র-সূর্য, সমুদ্র, অরণ্য, পাহাড়, নদী এবং পিরামিড আর জিগুরাত–তাছাড়া রয়েছে অজস্র অহিংস পশুপাখি। সে ভাসছে।

এই শিশু যতদিন জীবন না পায় ততদিন ভাসে। যতদিন ভাসে ততদিন জীবন পায় না। জীবন মানে শ্রম, নির্মাণ, প্রতিষ্ঠা। জীবন মানে সুরক্ষা। নিজেকে বাঁচানো, খাদ্য বস্ত্র গৃহ এইসব দেওয়া, নিজেকেই দেওয়া–মানুষ যখন দেবতাদের আক্রোশ থেকে, ফোঁসানি থেকে, চোখ রাঙানি থেকে, ক্রোধ এবং অভিশাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে–তখনই তার সার্থকতা। এই সার্থকতার নাম জীবন। জীব এবং বীজকে রক্ষা করার নাম জীবন। মহাপিতা নোহ ছিলেন জীবনের দেবতা। নবী ছিলেন। মানুষ আসলে জীব-দেবতা।

শিশুর মুখপানে চেয়ে থাকতে থাকতে সাদইদের মনে হচ্ছিল, জীবন-দেবতাই যেন তার কোলে হাত-পা নেড়ে খেলা করছে।

শিশুর সঙ্গে হঠাৎ সে কথা বলে উঠল–শোন সারগন, দুষ্টুমি করো না। আমায় কিছু বলতে দাও।

সহসা এমন উক্তি শুনে আশ্চর্য হয় রিবিকা। সে সাইদের মনের থই পায় না। একদা সে আবীরুদের সঙ্গে অশ্বারোহণ করেছিল। পাশে প্রবাহিত নীল নদী। আজ সম্মুখে পাহাড়, নীল আকাশের গায়ে হেলানো, দূরে সমুদ্রের সংগীত ভাসছে। এ তার জীবনের দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা। সে সাদইদকে পিছন থেকে দু’হাতে আলিঙ্গন করে রয়েছে। পাশ দিয়ে মুখটা ঠেলে সে শিশুকে দেখবার চেষ্টা করছে। শিশু সাদইদের মুখে হাত বাড়িয়ে ঠোঁট আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করছে, কথা বলতে দিচ্ছে না।

বেলা পড়ে আসছে। পাহাড়-চূড়ায় আলো রাঙা হয়ে উঠছে। সাদইদ কথা বলে শিশুর সঙ্গে–। দ্যাখো ভাই, তোমার লকেটটা ভারী সুন্দর! প্রজাপতির দুটি ডানা যেভাবে পিঠের উপর খাড়া হয়ে জুড়ে যায়–এ ঠিক তাই। একটি প্রজাপতিকে বাঁচানো তেমন সহজ নয়, শিশুকে বাঁচানোও সমান শক্ত। পতঙ্গের। ডানায় যেমন ইন্দ্রধনু খেলে ওঠে, এটা সূর্যের বিষ–আর তোমার হাসিটাও তাই। নারীর বুকে চাঁদের বিম্ব, তোমার মুখে সূর্যের বিষ–তাহলে আকাশ থেকে। স্বর্গও নামতে পারে এখানে। দেবতাদের ক্ষুণ্ণ করব না শিশু-সারগন, তুমি বোঝে। সব কিছুর ছায়া থাকে হেরার পুত্র। তোমার দেহে নোহের ছায়া পড়বে, তুমি একটি জাহাজ বানাবে, তুমি পিরামিড গড়বে। তুমিই স্বৰ্গকে নামিয়ে আনবে মাটিতে।

বলতে বলতে সাদইদ শিশুকে আবেগে আহ্লাদে চুম্বন দিতে থাকে। শিশু হেসে ওঠে। সেই হাসির দোলায় যেন সাদইদ নিজেই আত্মহারা হয়ে আকুল হাসিতে স্ফূরিত হয়। রিবিকাও হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে ভাবে, এ কোন অশ্বারোহণ তার!

তবু ভয় করে তার। বিশ্বাস হয় না। অশ্বারোহী পুরুষটি শিশুর জন্য বরাদ্দ করছে একটি স্বর্গের, যা আকাশ থেকে মরুতে বিম্বিত হবে!

কীভাবে মরুতে স্বর্গ বিম্বিত হয় রিবিকা ভাবতে পারে না। হৃদয় কীভাবে এইসব চিন্তা করে তার জানা নেই। তবে সাদইদের কথা শুনতে শুনতে কেবলই তার মনে হচ্ছিল, পিরামিডের শবাধারলিপির কথাগুলি, যে সম্রাট অথবা অভিজাত মানুষটি শবাধারে শুয়ে চিরনিদ্রায় অভিভূত এবং নির্বাক সে কি

ঘোষণা করছে সে কখনও কারুকে আঘাত করেনি, কাউকে কাঁদায়নি, এমনকি একটা পশুকেও সে যাতনা দেয়নি–এভাবে আদর্শ মানুষ ঘুমিয়ে থাকে।

অথচ ওই কথাগুলি যে প্রতারণা, তা প্রমাণিত হয়েছে। জীবন একরকম। বাণী অন্যরকম। মানুষ দেবতা হওয়ার লোভে অমন বাণী রচনা করে। অশ্বারোহী পুরুষটি পতঙ্গের দাম দেয় অথচ সে মেষ-শিশুকে হত্যা করে। পতঙ্গের পক্ষধ্বনি শুনতে পায় অথচ নিনিভের মনুষ্য-আর্তনাদ তাকে বিচলিত করে না–শবস্তূপ থেকে জীব প্রাণ খুঁটে তুলে আনে অথচ সমেরুর মত কিশোরকে সে প্রবল যাতনার ভিতর নিক্ষেপ করে। আক্কাদই শুধু প্রতারক নয়, একজন ফেরাউন সম্রাটও ক্রীতদাসীর গর্ভ তল্লাশ করে শিশুহত্যার পরোয়ানা জারি করে। কতকাল মানুষ এইরকম দু’মুখো জীব–এক মুখে অহিংসা, অন্য মুখে যুদ্ধের শিঙা ফুঁকে চলেছে। শিশুর গলায় লকেট দেখে যে অভিভূত, সে আদৌতে একটি ক্ষুদ্র শিঙা লটকে রেখেছে গলায়।

–তুমি আমার শিশুমেষকে হত্যা করেছ সারগন–ক্ষমা করব না কখনও! আমার জন্য একটি সূর্যমন্দিরই যথেষ্ট। তাই দাও। তোমার কাছে যাচনা করার কিছু নেই।

আপন মনে বলে যেতে থাকে রিবিকা। কতকগুলি তাঁবুক্ষেত্র তারা অতিক্রম করে আসে। তারপর দেখতে পায় সার সার মন্দির। মন্দিরগুলি সব এক। ধরনের নয়। আকাশে আলো নরম হয়েছে। অশ্বের গতি অনেকক্ষণ খুবই মন্থর। শিশুকে পাওয়ার পর ঘোড়া যেন আর চলতেই চাইছে না। পাহাড় ক্রমশ আরো নিকটবর্তী হয়ে এল। দিনের আলোতেই দেখা গেল পাহাড়ের মাথায় রূপালি চাঁদ উদ্ভাসিত। মন্দিরের সিঁড়িতে দেবদাসীরা বুকের কাপড় ফেলে দিয়ে বসে আছে। সুগন্ধি পাতা চিবিয়ে চলেছে। পেয়ালা থেকে গড়িয়ে খাচ্ছে দ্রাক্ষাসব। পথের উপর মদপাত্র সাজিয়ে বসেছে মানুষ।

মাটির কাঁচা ইট মরুবালিতে শুকানো হয়েছে। তাই দ্বারা নির্মিত হয়েছে মন্দির। তাঁবুর আকৃতির এই ঘরগুলি খড়ো। যবের গমের বিচালি ছাওয়া। কোথাও পাথরের লেশমাত্র নেই। অবশ্য দু’একটি মন্দিরে কিছু তফাত রয়েছে। তাঁবু বলতে যেগুলি গোলাকার তাঁবু, মন্দির সেই আকৃতিবিশিষ্ট হওয়ার পর চুড়ো তুলেছে গোলার মত। দু’একটি মন্দির সহসা রাজকীয়। সম্পূর্ণ পাথর কেটে তৈরি, তা পিরামিড-সদৃশ।

রিবিকা বুঝতে পারছিল পরিচ্ছন্ন মন্দির বলতে কী বোঝাচ্ছিল সাদইদ। তাকে দেওয়া হবে পিরামিড মাকা কোন একটা মন্দির। সন্ধ্যার মুখে মন্দির প্রাঙ্গণে ঢোল আর বীণা বেজে উঠল। মরুভূমির একধরনের বুনো তীব্র গন্ধ ফুলের মালা কব্জিতে জড়িয়ে বেঁধে জুম পাহাড়ী সৈন্যরা তাঁবু থেকে নির্গত হতে লাগল। মুখে মদের ঝাঁঝালো গন্ধ, গায়ে আতর ছিটিয়েছে। পোশাক পরেছে মসীহদের মত। কিন্তু এমনভাবে তা পেঁচানো হয়েছে পরনে এবং গায়ে যে, একখানি পায়ের থাই অবধি চোখে পড়ছে। চোখে ঢুলু ঢুলু চাউনি আচ্ছন্নতা পীড়িত, ঈষৎ তির্যক । গোঁফ জুমরে মদের প্রলেপ দিয়েছে, চোখে কেউ কেউ সুমা পরেছে। আতরে মদে মাখামাখি বাতাস রূপালি চাঁদে হল্লা তুলে ছুঁয়ে নামছে মাটিতে। অত্যন্ত কম বয়েসী পাঁচটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে একটি ছোট মন্দিরের সামনে। পাথরের পাটাতন পাতা বদ্বার ঠাই, একে বলা হয় দীঘল কেদারা। এখানে বিশ-পঁচিশজন সেপাই মাথা নিচু করে বসে রয়েছে।

মাথা নিচু করে বসে থাকার কারণ যে সাদইদ, ক্রমে বুঝতে পারে রিবিকা। কচি মেয়েগুলি দাঁত বার করে হাসছে। বুকের জামা খুলে একটি কুঁড়ি দেখিয়ে জামার তলে ঢুকিয়ে রাখছে একটি পাজি মেয়ে। ক্রমাগত এই-ধারা করছে।

সাদইদ ঘোড়া নিয়ে গিয়ে ওখানে থেমে গেল। সুন্দরী রিবিকার দিকে সবাই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। কচি সেই পাজি মেয়েটি রিবিকাকে বুকটা দেখিয়ে জিভ ভেংচে বলল–নতুন নাগরী বুঝি! তা বেশ। ক’খানা ভেড়া দিয়ে খরিদ করল তোকে!

সাদইদ ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নেমে শিশুটাকে রিবিকার কোলে ছুঁড়েই দিল একপ্রকার। তারপর সটান কচিটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললকনানী ভাষাটা তো বেশ মজবুত করে বলতে পারো কিন্তু এইসব আদিখ্যেতা কেন? সহবত বোঝো না?

বলেই গালে একটা চটাস করে চড় মারল সাদইদ। তারপর ধমক দিয়ে উঠল–বেয়াদব! শরীর সামলে রাখো!

–আ বাপ! তিন ভেড়ার খরিদানা মাগী আমি, তুমি মিনসে হলে বতাই হবা নাকি ভিস্তির পো? জানি তুমি লোকটা অতি মন্দ নও, শুদু হিতেনের পেটোয়া বটো। আমায় একবার হারেমে দাও দিকিনি, ঘুরে আসি! আঙুর চটকালে মদ, মাগী চটকালে বদ–তা বুঝি জানো না!

বলেই সাদইদকে জিভ বার করে ভেংচে উঠল পাজিটা। সাদইদ রেগে গিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিতেই মেয়েটি পড়ে গিয়ে কেঁদে ফেলল ভয়ে।

একজন গামছাবালা সাদইদের কাছে এগিয়ে এসে বলল–হুঁজুর! ঘাট মাফ করবেন! ওটার মাথা খারাপ! খালি বকবে,যতই কেন বলুন! আসলে যুদ্ধে ওর বাপ-মা দুটিই খতম হয়েছে। পরে এক মদঅলা শুঁটকিঅলা ওকে তিন ভেড়ার। বদলি কিনে আনে, সেই গল্পটা ও করে! কী করে শুঁটকিঅলা-উটবালাকে ও নিজেই ওদের উঠানে ডেকে নিয়ে গেল। একটাই কেচ্চা কেবলই আউড়াবে। ওর কাকারা ওকে বেচে দিয়েছে! ওর দুখখু একটাই–ও কেন নিজেই ব্যাপারীকে ডেকে নিয়ে গেল! বিশদ করে বলা ওর স্বভাব। মাথাটা গেছে। হুজুর! মারলেও শুনবে না। আপনি চলে যান। আমি ওকে দেখছি!

গামছাবালা ঘাড় থেকে গামছা নামিয়ে হাতের মুঠোয় ধরে কপাল অবধি তুলে নাচিয়ে অভিবাদন জানালো সাদইদকে। সাদইদ সহসা ঘাড় নিচু করে ঘোড়ার লাগাম ধরে সামনে এগিয়ে চলল।

সেই যে সাদইদ ঘাড় নামালো, পথের উপর থেকে আর চোখ তুলল না। পাহাড়টা মনে হচ্ছিল খুব কাছে, কিন্তু মোটেই তত নিকটে নয়। সুদীর্ঘ সময় সাদইদ পথ হেঁটে এল। সন্ধ্যা ঘনাল। রিবিকা একটি কচি মেয়ের ভিতর তার অতীতকে এক ঝলকে প্রত্যক্ষ করল। হুবহু একই জীবন। তিনটি ভেড়া অবধি সঠিক। কচিটা যে নিজেই বণিকটিকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল না-বুঝে পথ থেকে, এই বেদনা তার কিছুতেই শেষ হতে চাইছে না।

কেউ আসার পথে প্রশ্ন তোলেনি বটে, তেমন খুব আশ্চর্যও হয়নি রিবিকাকে দেখে। কারণ তারা নিজেদের কাহিনীতেই অশেষ বিস্ময় সংগ্রহ করেছে। হঠাৎ এই অশ্ব যেন একটি উটের অবয়ব লাভ করে। কিছুতেই রিবিকা ভাবতে পারে না, এ উট নয়, ঘোড়া। দীর্ঘদেহী, সুউচ্চ ঘোড়াটা অতঃপর উট হয়ে যায়। লাগাম ধরা মানুষটিকে মনে হয় ফরাতের উটচালক। হঠাৎ চোখে পড়ে আর এক আশ্চর্য ছবি। বালির ঢিবির উপর বসে রয়েছে একটি একহাত কাটা ভয়ানক। রূপসী মহিলা, ফুলের মত বুক খুলে সে একটি কালো কেঁদো বাচ্চাকে স্তন্যদান করছে। দু’হাত তফাতে ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি লোক। ঘাড়ে গামছা, কিন্তু হাতে একখানা লাঠি। কে ওরকম দাঁড়িয়ে রয়েছে? ও যে চেনা চেনা কেউ।

মহিলার কাটা হাতটা স্তন্যদান করায় ক্রমাগত লাফাচ্ছে এক অনির্বচনীয় পুলকে আর বিষাদে। স্বর্ণালী সূর্য টলটল করছে। রূপালি চাঁদ অন্য গগনে ফটফটিয়ে হাহাকার করছে। কাটা হাতের প্রত্যেকটি কম্পন যেন কিছু একটা ধরতে চায়। চামড়ার ক্রমপ্রসারণ ও সংকোচন যেন কাটা নগ্ন হাতটির হৃদয়। অথবা ফুসফুস। যা কিনা বাতাস পাচ্ছে না। দম আটকে আসতে থাকে রিবিকার।

মন্দির ছেড়ে এখানে কী করছে মা, শিশু আর গামছাবালা চেনা চেনা লোকটি? বোধহয় এদিকে কোথাও এসেছিল, সন্ধ্যায় ফিরে যাওয়ার কথা, ফিরতে পারেনি।

ফর্সা কাটা হাত, কিন্তু কাঁধের পাশে ঝুলন্ত, কনুই-হীন, কনুইয়ের উপর অবধি কিছুদূর যুদ্ধের কোপে উধাও, কাটা অংশটি কালো আর অদ্ভুত দলা দলা কদর্য কোষযুক্ত, যেন-বা ফুসফুস। কালো ফুসফুস। বারবারই মনে হয় রিবিকার। সে ভয়ে শিউরে উঠে মুখে আর্ত শব্দ করে ফেলে। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। সেই শব্দে সচকিত হয় রুহা। স্তন ঢেকে ফেলে কাপড়ে। সন্তানকে স্তনচ্যুত করে কাঁধে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। লাঠিধারী গামছাবালা কিন্তু নড়ে না। যেন মূর্তি।

পশ্চিম আকাশে রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ডের আলো ক্রমশ ম্লান। অন্য দিগন্ত ক্রমে ব্যাপ্ত করে সাদা রূপার গলিত বিভা। তাই মহাঘোর এই বালুকাবিস্তীর্ণ পটভূমি-সম্মুখে খাড়া ভীষণ পাহাড়। পাহাড়ের পায়ের তলায় মসীহ ইহুদ মূর্তিবৎ স্থির। কাঁধে গামছা, হাতে জাদুকীর্ণ লাঠি একাভিমুখিতার প্রতীক এই দণ্ড। গামছাখানি তার আত্মার অপমান। অবধারিতা একারণে যে, অপমান চন্দ্রকলাকৃতি বঙ্কিমা প্রসারিত ভূখণ্ডের সমান। কোথাও লুকোবার ঠাঁই নেই। যবহ দেখছেন, তাঁর বান্দা কী অসীম বেদনায় অপমানে নির্বাক।

রুহা অশ্ব দেখে ছুটে আসে। সাদইদের প্রতীক্ষায় সে অস্থির হয়েছে। একদণ্ড থামে না। ককিয়ে ওঠে–আমার সেপাইকে দেখলেন হুজুর! খোঁজ পেয়েছেন! কোথায় আছে? কবে আসবে?

সাদইদ থেমে পড়েছে। মনে হচ্ছে এ দৃশ্য নতুন নয়। এই প্রতীক্ষা পুরনো হয়ে গিয়েছে। এই প্রশ্ন ধারহীন। এই বিড়ম্বনা সোয়াস্তিশূন্য। সাদইদ খাদে নামানো ঈষৎ ভেজা গলায় যতদূর সংক্ষিপ্ত সম্ভব জবাব করে–আসবে!

–কবে?

এতক্ষণে মুখ তোলে সাদইদ। হঠাৎ কড়া উত্তর–তোমাদের সমস্ত জবাব সামান্য ভাড়াটে সৈনিক দিতে পারে না রুহা!

–তুমি দেবে না তো কে দেবে তবে? ভিস্তির পোলা হয়ে আমার নাগরকে তুমিই কেড়ে খেয়েছ বদমাশ! নতুবা লুকিয়ে রেখেছ। দাও। ফিরিয়ে দাও। সাদইদ ফের মুখ অবনত করেছিল। ফের তুলল। বলল–আসবে রুহা!

–কবে!

–আমি স্বপ্নদর্শী নই। মসীহ নই। আমি নক্ষত্রবিজ্ঞান জানি না।

–তুমি পিঁপড়ের ভাষা বুঝতে পারো। পিঁপড়ের গতিবিধি দেখে কখন বৃষ্টি হবে বলতে পারো। তবে কেন বলতে পারবে না আমার সেপাইয়ের খবর? তুমি ওকে নিনিভের দিকে পাঠিয়েছ। একদল সেনা তো ফিরল না! কেন ফিরল না? কী হল ওর? লোটাই বা কবে ফিরবে?

–ফিরে আসবে নিশ্চয়।

–দেখা হয়েছে বল তাহলে?

–যা হয়েছে! এবার পথ ছাড়ো!

–কখন আসবে!

–কাল।

–রোজই তো বল কাল। আসে না কেন? আমার শিশু যে কাঁদে!

–মধু খেতে দাও।

–আমার বুকে কি গরল আছে বলছ?

–আমি সেকথা বলিনি রুহা। সামনে মরুভূমিতে শীত আসছে–আমি সেপাইদের বলেছি মৃতদেহ থেকে কাপড় সংগ্রহ করতে। এখানে নদী নেই! শস্যক্ষেত্র নেই। এমনকি সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় মাত্র, সমুদ্র উত্তাল হয়–কিন্তু বাতাস লাট খেয়ে কিনারা ছুঁয়ে সমুদ্রের ভিতর ঘুরে চলে যায়–কেবল একটা নির্দিষ্ট সময়ে সামান্য মেঘ উড়ে আসে। তখন সমুদ্র বাতাস খুলে দেয়। এই ঊষর জীবন কেবল যুদ্ধে খরচ হয় রুহা। মৃতদের পরিত্যক্ত খাদ্য বস্ত্রে জীবন বাঁচে। এ এক ধরনের চুরি। লুঠ নয়। পরাক্রম নয়। তোমার সেপাই আসবে একদিন প্রচুর বস্ত্র আর খাদ্য নিয়ে। সমুদ্র সর্বক্ষণ হাওয়া দেবে সেই জীবন তো আমরা পাইনি।

–আমি কী করব মা গো!

বলে উধ্বাকাশে মুখ তুলে রুহা আর্তনাদ করে উঠল।

আকাশে চন্দ্রকিরণ ঘনীভূত হচ্ছে, সূর্যালোক আর নেই। রুহা চাঁদের আলোর দিকে চেয়ে কেঁদে উঠল–আমার এই কাটা হাতটাকে কে আর ভালবাসবে! কেউ তো রইল না!

এবার অনড় মূর্তিটা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। রিবিকা ইহুদকে ধীরে ধীরে চিনতে পারে! একজন মসীহের এই পরিণাম অভাবিত। বোঝা যায় সাদইদ তাঁকে জীবনের একেবারে তলায় ঠেলে দিয়েছে। তাঁর এই-ধারা ঘাড় নিচু করে থাকা অবিচল মূর্তি প্রকৃতই এক সুতীব্র অপমানের দীনতম দশা–যার পর আর কিছু নেই।

সমুদ্র রয়েছে এখানে, কিন্তু সমুদ্র কিছুই দেয় না–বায়ু অথবা মেঘ। এ এক আশ্চর্য জমি। তেমনি জীবন এখানে রুদ্ধ হয়নি, কিন্তু তার কোন রূপ বা আকার নেই, একটা পিণ্ডবৎ পড়ে আছে, গর্ভনাশের ফলে মানবী যেমন পিণ্ড প্রসব। করে। এ উপমা রিবিকার মনে আসে কেন সে বুঝতে পারে না। সে আমারনায় থাকার সময় ওইধারা পিণ্ড প্রসব করেছিল। আবীরুদ তখন তার কাছে আসতে শুরু করেছে। সেই সময় তার তলপেট নড়ছে, নমরুর বাচ্চা ধরেছে সে। সে এক মর্মান্তিক অনুভূতি। গা সিরসির করে। পায়ের তালু সিরসির করে। মাথা ঘুরে ওঠে রিবিকার। সে শিশুসহ বালির উপর খসে পড়ে যায়।

তারপর সে যখন চেতনা ফিরে পায় দেখে অদ্ভুত একটি জায়গায় সে শুয়ে আছে। চোখ মেলেছে সে। প্রজ্বলন্ত চাঁদ টইটই করছে আকাশে। দু’একটি তারকা ভাসছে। বাতাস আসছে হু-হুঁ করে। অথচ চারপাশ পাষাণে মোড়া। ছাদবিহীন এ এক আশ্চর্য ঘর। জ্যোৎস্না আর হাওয়ায় যেন আকাশে ভাসমান। পাশে শায়িত শিশু। কেউ কোথাও নেই। এ তবে রক্ষঃপুরীর মত কোন স্থান।

মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সময় সে কি ‘বাবা’ বলে কোন আর্তনাদ করেছিল? তার গলায় কি কোন স্বর ফুটে ওঠেনি? জীবনই যেন তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে দিয়েছে। কান্না তার গলায় দলা হয়ে জমে উঠেছিল। সে মহাত্মা ইহুদকে ডেকে উঠতে পারেনি। তার মনে হয়েছিল ডাক শুনে মহাত্মা ইহুদ লজ্জা পাবেন। সমস্ত অপমানের শেষ দশায় পৌঁছেও কেন এই লজ্জা অবশিষ্ট থাকে–ভাবলে চরম অবাক হতে হয়। ভাবতে ভাবতে রিবিকা ঘুমে তলিয়ে যায়।

খুব ভোরে তিনতলা সুউচ্চ একটি সাঁজোয়া গাড়ি এসে দাঁড়ায় পাহাড়টির কাছে। তিনতলা পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে লাশ। চারটি অশ্ব টেনে এনেছে। অশ্বের গায়ে ঘাম, চোখগুলি তীব্রভাবে হলুদ–সবই কালো ঘোড়া। চারটি ঘোড়াই বুঝি মৃত্যুর ফেরেস্তা–আজরাইল।

সাঁজোয়ার পিছু পিছু ছুটে আসছে উন্মত্ত রোরুদ্যমান প্রবল জনস্রোত–জুমপাহাড়ী স্ত্রী-পুরুষ। মহাশক্তিমান লোটা এই সাঁজোয়া ভর্তি করে এনেছে সৈনিকের লাশ–এর মধ্যে কারা যে সাদইদের সেনা,স্থির করতে পারেনি। সে মনে করেছে, এরই ভিতর থেকে দেবদাসীরা তার আপন পুরুষটিকে চিনে নিতে পারবে। তাছাড়া শিশুরা তার জনককে চিনবে । এই ভয়াবহ দৃশ্যটি কেন রচনা করল লোটা,সাদইদ বুঝতে পারে না। অস্থির কান্নায় আকাশ উতলা হয়ে উঠল।

সেই আর্তরব কানে পৌঁছতেই রিবিকা ভয়ে শিশুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। গবাক্ষপথে সে চেয়ে দেখে দৃশ্য। কান্না যেন সমুদ্রের মত বিহ্বল। দেবদাসী আর। শিশুর আর্তনাদ। যাদের আত্মীয়-বিয়োগ হয়েছে সেই পুরুষাও কেঁদে ওঠে। সবাই তো আর এখানে নিঃসঙ্গ ছিল না। কারো ভাই কারো পিতা বিনষ্ট হয়েছে–তারা কাঁদছে। দেবদাসী, যারা কিনা রুহার মত ভালবাসা করেছে, তাদের কান্নাই সবচেয়ে উচ্চকিত। মথিত এ কান্না যেন মরু লু-এর মত দিগন্তপ্লাবী প্রহার।

সমস্ত বেগ এসে সাদইদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পাষাণবিধৌত জলরাশি যেভাবে সমুদ্র পাঠাতে থাকে এবং টেনে নেয়–ফের পাঠায় কান্নার তরঙ্গ সেইরূপ। জলপাহাড়ের মত ডুবে যেতে থাকে সাদইদ। সে যেন সমুদ্রের তলা থেকে কথা বলতে থাকে।–এমন কেন করলে লোটা?

সাঁজোয়া থেকে লোটা লাশ নামায় কাঁধে করে, একাকী। কেউ কিন্তু হাত লাগাচ্ছে না বলে তার কোন বিকার নেই। সে সাঁজোয়ার পিছু পিছু লাগামের দড়ি সাঁজোয়ায় বেঁধে টেনে এনেছে চারটি উট। সে সকলকে বলছে–দেখে নাও। কার কোনটা পুরুষ। কে বাপ, কে সন্তান, কেইবা পুত্র! যারা বিচ্ছেদ চাওনি, তারা দেখে নাও। আমি কিন্তু উটের পিঠে তুলে দেব!

নোটার ভাষা এখানে কেউ বোঝে না। বোঝে একমাত্র রিবিকা। কিন্তু রিবিকা সেকথা বুঝতে পারে না। লোটার ভাষা খুব পুরনো যে-ভাষায় একমাত্র আক্কাদের মা, সেবার মা কথা বলত। এ ভাষা শুনে রিবিকা কতকাল পর অসম্ভব চমকে উঠল। শিশুর লকেটটা ধরেছিল সে হাতের মুঠোয়। ঘর থেকে বেরিয়ে সে সাদইদের কাঁধের নিচে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল কখন,তার নিজেরই। অজান্তে।

সাদইদ মন্দ্রস্বরে বলে উঠল–তোমার মুখের ভাষা আমরা কেউ জানিনে লোটা! তোমার ব্যাকুলতা আমরা বুঝব না। কেবল তোমার ইঙ্গিত আমরা বুঝতে পারি!

লোটার আর্তনাদে, মন্ত্রজব্দ সমুদ্র যেভাবে স্তব্ধ হয়, তরঙ্গ হয় জমাট, এ ঠিক তাই, সেভাবে কান্না থেমেছে। সেই নিস্তব্ধতার ভিতর একটি কণ্ঠস্বর ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছে, সে লোটার দিগন্তবিদীর্ণ স্বর। সাদইদ আপন মনে বলে উঠল–তোমার ভাষা ঈশ্বরের মত। আমরা তো বুঝতে পারি না।

–আমি বুঝতে পেরেছি সারগন! বুঝতে পেরেছি!

বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল রিবিকা। আশ্চর্য হয়ে চমকে সাদইদ পাশে দাঁড়ানো রিবিকার মুখের দিকে চাইল। বিস্ময়-পীড়িত অভিভূত স্বরে বলল–তুমি জানো! তবে বলে দাও এদের!

রিবিকা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, যেতে লাগল আমার দেবতা একমাত্র দেবতা, যিনি জীবন এবং মৃত্যুকে বহন করেন। আমার ভাষা একমাত্র ভাৰা, যা। নবী সালেহ বলতেন। আমার উটগুলি সেই দেবভাষা ছাড়া কিছুই জানে না। আমি আজ প্রমাণ করতে চলেছি, আমার ভাষা আর ধর্ম অনশ্বর। চিরন্তন। এর ক্ষয় নেই। প্রতিটি মৃতদেহ আমার উট বহন করে নিয়ে যাবে দূর দিগন্তের দিকে ফেলে রেখে আসবে দেহ। আসলে নবী সালেহ যেখানে রয়েছেন, সেখানে লুকিয়ে ফেলবে উট,এই মৃতদেহগুলি। তোমরা আমার ভাষা বোঝে না। আমিও বুঝি না তোমাদের। যদি জানতে মৃত্যুকে বহন করার দেবতা একমাত্র উট! জীবনকে বইবার ক্ষমতা একমাত্র তারই। আমার ব্যাকুলতা যদি

বুক চাপড়ে চাপড়ে আর্তনাদ করতে থাকে লোটা। মৃতদেহ কাঁধে করে নামাতে থাকে, উটের পিঠে তুলে দিতে থাকে।

জুমপাহাড়ী ভাষায় অনুবাদ করে দিতে গিয়ে থেমে পড়ে সাদইদ। উট শব নিয়ে দিগন্তের দিকে রওনা হয়। রুহা তার প্রিয়তম মৃত্যুকে চিনতে পেরে আগলে বসে পড়ে। মৃতদেহ ছাড়তে চায় না। তার কোলের বাচ্চাটা মৃত পুরুষের বুকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে পড়তে চায়। সৈনিকপুরুষটি শিশুকে আদর দিয়েছে অনন্ত, সেকথা শিশু ভোলেনি। কেন তবে চোখ মেলছে না লোকটা? হাত বাড়াচ্ছে না কেঁদোটার দিকে?

রিবিকা আর সহ্য করতে পারল না। তার কণ্ঠস্বর বুজে এল। সাদইদ অসহিষ্ণুর মত বলল–থাক আর বলতে হবে না। লোটার উন্মাদনা প্রশমিত হবে না। ও কপাল চাপড়াবে। আপন বুকে কিল-ঘুষি ছুঁড়বে–এই ওর রোগ!

রিবিকা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। গুহায়িত ছাদবিহীন গৃহে শিশুকে বুকে করে ফিরে এসে লকেটটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আকাশে মুখ তুলে সজোরে বিলাপ করে উঠল–হায় দেবী! মা গো!

লকেটটাকে এখন স্পর্শ করতেও তার ভয় করছিল। শিশুর মুখে ঈশ্বরের মত হাসি নিঃশব্দে ঝরছে। যেন দেবতা আমন শিশুর মুখমণ্ডলকে উদ্ভাসিত করে রেখেছেন। রিবিকা সেদিকে চেয়ে দেখতে দেখতে ডুকরে ডুকরে উঠতে থাকল।

বাইরে মৃতদেহকে চেনার উপায় সহজ ছিল না। কারো দেহ স্বাভাবিক নেই। কারো চোখ দুটি ঝলসে দিয়ে মুখকে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে। কারো মুখেরই আধখানা কেটে নামিয়ে দেওয়া। কারো দেহ আছে, মুণ্ডু সাঁজোয়ায় তোলা। হয়নি। কারো মুখ সহজ নয়। তথাপি কিছু কিছু আশ্চর্য ঘটনা ঘটছিল। বহুকাল বাদে একজন তার স্বামীকে মৃতদেহের ভিতর আবিষ্কার করতে পেরে সহসা ভয়ানক আর্তনাদ করে উঠল।

উটের পিঠে তোলার আগে মৃতকে নগ্ন করা হচ্ছিল। কাপড় খুলে নিয়ে একদিকে জড়ো করে রাখছিল লোটা। ওগুলি জলে সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে শিবিরে বিলি করা হবে। এই সাঁজোয়ায় একেবারেই অচেনা পুরুষ কম নেই। কিছু নারীও মরেছে, অল্প শিশুও। সকলকে নগ্ন করে অন্তিম প্রস্থানে পাঠানো হচ্ছে। হঠাৎ একজন, নাম সুব্বা, ভয়ানক খেপে গিয়ে লোটাকে আক্রমণ করল! ঝাঁপিয়ে পড়ল লোটার উপর। কী হয়েছে? না, সুব্বা তার হারিয়ে যাওয়া কিশোর ভাইকে মৃতদেহের ভূপে আবিষ্কার করতে পেরেছে। আক্রান্ত লোটা আক্রমণ মুহূর্তে প্রতিহত করে হো-হো করে পাগলের মত উচ্চহাস্য করে উঠল।

সাদইদ ভাবল, কেন সে নোটাকে পাঠালো সৈনিকদের না-ফেরার খোঁজ নিতে? লোটা বহুদিন নিঃসঙ্গতা রোগে ভয়ানক হয়ে উঠেছিল। কীভাবে সে সাঁজোয়া ভর্তি করেছে, কেউ জানে না।

গবাক্ষে চোখ রাখে রিবিকা। শব বোঝাই উট চলেছে দূর দিগন্তের দিকে। লোটার নির্দেশই যথেষ্ট। মৃতদেহ নিয়ে ছুটে যাচ্ছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। শক্ত আংটা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে শব।

একে একে সমস্ত দেহ বহে নিয়ে গেল উটেরা। কোথায় ফেলে দিয়ে এল কেউ জানে না। এইভাবে নবী সালেহর মৃতদেহ উট বহে নিয়ে গিয়ে শূন্য পিঠে ফিরে এসেছিল। খালি পিঠে, প্রকাণ্ড গলা ভয়ানক দোলাতে দোলাতে ফিরছে। দিগন্ত থেকে উটেরা। কুঁজগুলি কবর। পায়ের আঘাতে বালিও উড়ছে। সমস্ত শরীর মৃত্যুর পর উটের ভিতর আশ্রয় পায়। একথা জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে লোটা।

লোটা বলছে–হা নবী! সমস্ত যুদ্ধ ওই কুঁজে থেমে যায়। যুদ্ধের অবশেষকে তুমিই বহন করো পিতা!

সূর্য মাথার উপর দীপ্যমান। কখন সে মধ্য আকাশে উঠে গেছে কারো খেয়াল নেই। কান্নার মন্থন পারাবার-প্রমাণ উত্তাল। মরুর বুক ঝড়ের মত হু-হুঁ করছে।

সূর্য চলে গেল দিগন্তে। শেষ দেহটি রুহার পুরুষটির উত্তোলিত হল। উট ক্লান্ত পায়ে অগ্রসর হল। রুহার হাত থেকে মৃতদেহ ছিনিয়ে নিয়ে লোটা উটের পিঠে বেঁধে দিল।

দিগন্তের কাছাকাছি চলে যেতেই রুহা বুকফাটা আর্তনাদ করে উটের দিকে ছুটে চলল। তার কেঁদোকে সে বালির উপর ফেলে রেখে ছুটল। কী আশ্চর্য! কেউ তাকে ধরবার চেষ্টাও করল না। হঠাৎ দেখা গেল ইহুদ দিগন্তের দিকে ছুটতে শুরু করলেন। উটকে আর দেখা যাচ্ছে না।

সহসা লোটা কী যেন চিৎকার করে বলল। কেউ বুঝল না। রিবিকা শুনতে পেল–আপনি যাবেন না মশায়! উট কোথায় যায় কেউ জানে না। মরুভূমির পাহাড়ের ওদিকে কোথায় যে যায়…ও মশায় যাবেন না।

তারপর স্বয়ং লোটা তীব্র বেগে দৌড়তে লাগল দিগন্তের দিকে। দেখতে দেখতে লোটা ইহুদকে অতিক্রম করে গেল। উট কোনদিকে ছুটেছে কেউ জানে না। সাদইদ শুভ্র অশ্বের পৃষ্ঠে লাফিয়ে উঠে অশ্ব ছুটিয়ে দিল, যখন একজন বলে উঠল–রুহা বাঁচবে না। ওকে আমনদেব ডেকেছেন!

অতঃপর সীমাহীন মরুর বুকে আর এক যুদ্ধ শুরু হল! মরুবাঘের মত লোটা পাগলিনী রুহার বেদনাকাতর দেহে ঝাঁপ দিল। মৃতদেহ পিঠে করে দাঁড়িয়ে রয়েছে উট। রুহা কঁকিয়ে উঠল–আমায় ছেড়ে দাও।

একটি পাহাড়গুহার ভিতর টেনে আনার চেষ্টা করছে একটি পুরুষ একটি নারীকে। দুজন দুজনের ভাষা বোঝে না। লোটার বিদ্বেষ আরো ভয়াবহ। পাহাড় নারীকণ্ঠে তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে। অশ্বারোহী সাদইদ সেই কান্না শুনতে পায়–কিন্তু কোথায় রুহা বুঝতে পারে না। ইহুদ তখনও পৌঁছতে পারেননি।

অত্যন্ত ছোট পাহাড় এটি। সাদইদ অশ্বকে দ্রুত পাহাড়ের চারপাশ প্রদক্ষিণ করে আনে। দেখতে পায় ওদের। লাফিয়ে নামে। ছুটে এসে ক্ষুধার্ত বাঘের মুখ থেকে শিকার কেড়ে নেয়। ইহুদ ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন।

সাদইদ প্রবল বলপ্রয়োগ করে লোটার গালে চপেটাঘাত করে। এই সময় উটটা খাদের কাছে গিয়ে গা ঝাড়া দিতেই আংটা ছিঁড়ে মৃতদেহ খাদে পড়ে যায়। পাহাড়ের নিচে খাদটা ভরে এসেছে। শবের গন্ধে চারিদিক ভারী হয়ে রয়েছে। দেরি না করে সাদইদ রুহাকে অশ্বের পিঠে তুলে নেয়। অশ্ব ছুটে আসে জুম পাহাড়ের মন্দিরের দিকে। অপমানিত লোটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ইহুদ এসে লোটার কাঁধে হাত রাখেন…

.

রাত্রি গম্ভীর হয়েছে। লোটা আর রুহার ঘটনা কী ঘটল রিবিকা জানে না। সে সাদইদকে জিজ্ঞাসা করতেও সাহস পাচ্ছে না। উটের শব বহনের দৃশ্য তার মনে এক নিরাশ্রয় ভয় সৃষ্টি করেছে। সাদইদ এখন রিবিকার চোখের সামনে চুপচাপ থুতনিতে হাত রেখে একটি বেদীর মত উচ্চ পাথরের আসনে বসে আছে। চাঁদের আলো সারা ঘরকে ভরিয়ে দিয়েছে সাদা পুষ্পের মত। শিশু ঘুমন্ত। সাদইদ একবারও রিবিকার মুখের দিকে মুখ তুলে চাইছে না। সামনে। বসে আছে অন্যমনস্ক–কী এক গভীর চিন্তায় মগ্ন বলে মনে হচ্ছে!

হঠাৎ বাইরে ঘোড়ার একটা চিৎকার শোনা যায়। একটু পরেই লোটা এসে ঢোকে। সাইদের সামনে পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে বলে আমায় ক্ষমা করুন সারগন! আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।… বলেই লোটা শিশুর মত উচ্চ গলায় কাঁদতে লাগল। পিঠে হাত রাখল সাদইদ। সস্নেহে বলল–আমি তোমার দুঃখ বুঝি না লোটা! তুমি চুপ করো, শিশু জেগে যাবে। জানি, বলপ্রয়োগে কখনও কারো হৃদয় পাওয়া যায় না। রুহা যাকে ভালবাসত সে তো। শেষ হয়ে গেল। তুমি তার চরম দুঃখের মুহূর্তে কেন ওরকম করলে! এ। তোমার ঠিক হয়নি। তুমি ব্রাত্য–তোমার ভাষা, ধর্ম আলাদা। তোমার জন্য কোন দেবদাসীর ব্যবস্থা আমি করে উঠতে পারিনি। তাই বলে তুমি রুহার উপর। বলপ্রয়োগ করবে? আমাকে দেখে তুমি শিখতে পারো না? আমার সব আছে মনে করো! অথচ কী আছে আমার? কোন দেবদাসীর প্রতি আমার কোনই। আগ্রহ নেই। আমিও তোমারই মত নিঃসঙ্গ। যদি তুমি বুঝতে!

কথাগুলি সে অনুভবে সমস্তই বুঝতে পেরেছিল বটে, তাই তার কান্না থেমে গেল। কী মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে রিবিকাকে দেখিয়ে ভয়ানক লোভার্ত চোখে লোটা বলল–ওই তো তোমার সব আছে। শিশু আর নারী! তোমার কপাল তো রাজচক্রবর্তীর কপাল! বন্ধু, আমি লোভ করছিনে। তবে আমি কোথাও চলে যেতে চাই। যুদ্ধ আছে, অথচ নারী নেই, এই অবাস্তব জীবন কত আর বইব! রুহার কাছে তবু আমি ক্ষমা চাইব! আমার ভাগ্যে একটা হাতকাটা মেয়েও জুটল না। আমি খুব ছোট জাত, আমার ভাষা বেদেজনের ভাষা–ঠিক আছে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে চলে যায় লোটা। যাবার সময় চোখে বিদ্যুৎ ঝলসে তালে–তীব্র কামাগ্নি! মনে হল, রিবিকা পুড়ে যাবে।

রিবিকা সমস্তই বুঝে ফেলেছিল। সাদইদ রিবিকার দিকে দৃষ্টি ফেরালো না। বলল–আমার ভয় হচ্ছে রিবিকা! লোটা যদি আত্মহত্যা করে! ভেবে দ্যাখ লোটা কি সাহসী! ওর জন্যই আমরা বেঁচে আছি। আচ্ছা! তুমি একটা কথা শুনবে! না থাক!

বলে আবার চুপচাপ বসে থাকল সাদইদ। সাদইদের উপর সহসা রিবিকার কেমন মায়া হচ্ছিল! কাছে এগিয়ে যায় রিবিকা।

–আপনি আমাকে সব কথা বলতে পারেন! আমি শুনব!

রিবিকা সাদইদের ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে প্রায় নিজেরই অজ্ঞাতে বলে ফেলে।

–যদি ধরো লোটা আত্মহত্যা করে! আমার তো কেউ নেই। লোটাই একমাত্র বন্ধু! অথচ ও আমার তৈরি ভাষা নিল না । ও আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছে। ও বলে, একদিন সে উটের পিঠে চড়ে বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ঝাঁপসা হয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাবে। ভাবতে পারিনে রুহার মত একটা সাধারণ মেয়ের ওপর।

সে পাহাড়ের ওদিকে…কী বলব…খুব খারাপ সেই দৃশ্য!

বলতে বলতে আবার থেমে পড়ে সাদইদ। আবার বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।

–আচ্ছা! লোটা এতক্ষণ তোমায় দেখিয়ে কী বলছিল, কোন মন্দ কথা বুঝি! তুমি কিছু মনে করো না!

ফের চুপ করে থাকে সাদইদ।

–আপনার কষ্ট কিসের! যুদ্ধই তো আপনার সর্বস্ব! নারীকে জোর করলে অন্যায় তো হয় না। দেবদাসীদের ঠাঁই দিয়েছেন তাই অনেক।

বলল রিবিকা।

সাদইদ বলল–কারো জন্য দয়া নয় রিবিকা। আমি ভাড়াটে সেনা! আগেই বলেছি, তোমার চেয়ে ভাগ্য আমার উর্বর নয়। শুধু অস্তিত্বের জন্যই সব, শুধু বাঁচা–আর কিছু নয়–কে আমায় চালিয়ে নিয়ে ফিরছে জানিনে। আজ সমস্ত দিন মনটা বিষণ্ণ হয়ে থেকেছে–কেন আমি মেষ-শিশুকে হত্যা করেছি! প্রতিনিয়ত যুদ্ধ দেখে দেখে হৃদয় নষ্ট হয়ে গেছে। আমি তো শৈরীর মানুষ। জন্মের আগে থেকে যুদ্ধ আমাকে নিয়তির মত অনুসরণ করেছে। অথচ আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হল না! একটি পতঙ্গ যা জানে আমি তা জানি না। একটি কুকুর কখনও বিশ্বাস ভঙ্গ করে না। প্রভুর জন্য প্রাণ অবধি ত্যাগ করে! সূর্যদেবতা সামাশের চেয়ে একটি শিশু অধিক পবিত্র। আমি তোমার বুকে ইন্দ্রধনুর রঙ। আর আলো দেখেছি রিবিকা!

বলতে বলতে স্বর যেন গলার ভিতর নিবে আসে সাদইদের।

–তোমার কেউ নেই?

–আমার জন্মের কথা আগেই বলেছি!

–মহাত্মা ইহুদকে এভাবে হীন কাজে নিয়োগ করলে কেন? উনি আমার পিতা।

–কে তিনি?

–যাঁর হাতে লাঠি রয়েছে!

যুদ্ধই তাঁকে নিয়োগ করেছে বিবিকা!

–এ তোমার চালাকি! তোমার সৈন্য ওঁকে বেঁধে এনেছে। আমাদের তামাম দলটাকে হত্যা করেছে।

–যুদ্ধ যে তাই করে আমনের বউ!

–তোমার শিশুবিলাসকে আমি ঘৃণা করি সারগন! শিশুকে স্পর্শ করার অধিকার তোমার নেই।

রিবিকা সাদইদের কাছ থেকে সরে চলে এসে হেরার পুত্রকে কোলে তুলে নিয়ে দুই চোখ মুদে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করতে থাকে।

সাদইদ সেই দৃশ্য দেখে ভাবে–এই ছবি একটি স্বর্গের ছায়া। তখনই একটি উট এসে গবাক্ষপথে গলা বাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গায়ে ওর শব বহনের ঘ্রাণ।

রিবিকা সুতীব্র ভয়ে শিশুকে বুকে সজোরে চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে। সাদইদ দ্রুত আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে গবাক্ষের কাছে সরে আসে। তারপর ত্বরিতে গবাক্ষের ঝাঁপ ফেলে দেয়।

বাইরে চলে আসে একাকী সাদইদ। তার মনে হয়, একটি প্রস্তাব উত্থাপন। করতে গিয়ে সে থেমে গেল কেন? লোটার ভাষা বোঝে রিবিকা। এই যুক্তিই যথেষ্ট। লোটাকে নিঃসঙ্গতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে রিবিকাই।

কিন্তু কেবলই তার চোখের উপর ভাসছে প্রজাপতি–অধিকৃত এক কোমল সৌন্দর্য। কী অপার সেই রূপ! পতঙ্গ যার সুরক্ষার দাবি করে তার জন্য কী করতে পারে একজন ভাড়াটে সৈনিক? কিছুই কি পারে না? মধু আর বিষ–ভাস্কর হেরা জগৎকে প্রশ্ন করেছে কী দেবে মানুষ শিশুর মুখে!

উটটা চলে যাচ্ছে জ্যোৎস্নার প্লাবনে ক্রমশ। কালো অষের পিঠে চড়ে একলা মরুর উপর অকারণ ছুটে বেড়াচ্ছে লোটা। এ যেন তার একলার উৎসব। লোটা মুখে স্ফূর্তির তীব্র চাপা এক-ধারা শব্দ করছে। এ তার কান্নাও হতে পারে!

হঠাৎ কখন পাশে এসে চুপটি করে দাঁড়িয়েছে রিবিকা। সাদইদ ঘাড় ঘুরিয়ে মায়াবতী রূপসী দেবদাসীকে দেখল। রিবিকার মাথার কাপড় বাতাসের ধাক্কায় কাঁধে খসে পড়ল। চাঁদের পানে মুখ তুলল রিবিকা। তার চোখের কোণে গড়ানো অশ্রু নিচের পাতার তলে বিন্দুবৎ জমেছে। চাঁদের আলো ঠিকরে এসে পড়ছে সেই বিন্দুর উপর।

জ্যোৎস্নায় এত মোহ, এত তীব্র ভাললাগা থাকে সাদইদ জানত না। সে ভাবল, এই নারী কেন চিরকাল থাকে না এই চন্দ্রকলাকৃতির দেশে! সে কেন ফুরিয়ে যায়?

ভাষা থাকে, ধর্ম থাকে, দেবতারা আকাশে থেকে যান, এমনকি পিরামিড ধ্বংস হয় না। এই নারী কেন এমন থাকে না চিরকাল? রিবিকা তুমি থাকবে–বলে হাত বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল সাদইদ। দেখল, উটটা দিগন্তে হারিয়ে যাচ্ছে, কালো ঘোড়া লাফাচ্ছে!

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আবুল বাশার- র আরো পোষ্ট দেখুন