কত দূর যেতে হয় জানি না

নিঃসঙ্গতা ওর কাছে একটি শব্দ মাত্র নয়।

বন্ধুরা যখন ওকে জিজ্ঞেস করে তুই এত চুপচাপ থাকিস কেন? ও উত্তর দেয় না। কেউ কেউ বলে, তোর ভেতরে বোধ হয় একটি মাকড়সা আছে, যেটি অনবরত সুতো ছড়ায়। নাকি রে? ও উত্তর দেয় না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। ও তো জানে ও নিঃসঙ্গতা উপভোগ করে। যে বালকের শৈশব-কৈশোর বালকের মতো থাকে না নিঃসঙ্গতা তার বিনোদন। শৈশবে খাটুনির শুরু।

রোজগারের খাটুনি। শৈশবে যাকে উপার্জন করতে হয় সে তো বড় মানুষ হয়ে যায়। তার স্মৃতি থাকে না। শৈশবের বোধই হারিয়ে যায়। এখন এই বয়সে এসে ওর কাছে নিঃসঙ্গতা মানে নিজের সঙ্গে খেলা।

ও বলতে পারে না যে ও চুপচাপ থাকে না। ও নিঃসঙ্গতা ভালোবাসে। শৈশব থেকে শুরু করে তারুণ্যের এই সময় পর্যন্ত নিঃসঙ্গতার অনুভব নিয়ে বড় হওয়ার আনন্দ ওর ভেতরে আছে। ও যা কিছু বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে এসেছে সবটাই ওর অসাধারণ স্মৃতি। জীবনের ধানের গোলায় তার সবটুকুই অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। এই সবকিছু নিয়ে ও হেঁটে যাবে পৃথিবীর পথে পথে।

এখন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বয়স তেইশ।

ওর নাম ওসমান আলী। মা ডাকতেন ওসমু বলে। এখন এই নামে কেউ ডাকে না। হারিয়ে যাওয়া শৈশবের সঙ্গে নামটাও হারিয়ে গেছে। শুধু ও জমিয়ে রেখেছে স্মৃতির পাতায়। ওর কাছে ওসমু তিতপুঁটির আঁশের ওপর লাল রং। কৈশোরের পরে ওর আর তিতপুঁটি দেখা হয়নি। স্লুইস গেট হওয়ার কারণে খালের পানি শুকিয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার পরে ওর মনে হয়েছিল শৈশবে বাবা মারা না গেলে ওর জীবনটা হয়তো অন্য রকম হতো। তাই কি? বোধ হয় না। বাবাও তো দিনমজুর ছিল। সারা দিনের রোজগারের পরে চাল আসত বাড়িতে। মা সেই চাল হাতে নিয়ে চুলোয় বসিয়ে রাখা হাঁড়ির নিচে আগুন জ্বালাত। গামলায় চাল ঢেলে কলসির পানিতে ধুয়ে হাঁড়িতে ছাড়ত। টগবগিয়ে উঠত ভাত। এর বেশি আর ওর বাবা কি করতে পারত! কিচ্ছু না। ওর জন্য মা যা করেছে ওর বাবাও তাই করত। ওসমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে না। দীর্ঘশ্বাসকেও ও শৈশবে ছেড়ে এসেছে।

শৈশবে বাবা মারা যাওয়ার পরে মা পথের ধারে বসে ইট ভাঙার কাজ করত। নইলে ধানের কলে যেত ধান ভাঙার কাজ করতে। নইলে মানুষের বাড়ির ছাগল চরানোর কাজ করত। মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল ওসমুকে লেখাপড়া শেখানোর। ওই দিনমজুরির জীবনে হবে কি না সেটা ভাবতে ভাবতে একদিন সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেয়। ওকে নানা রকমের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে স্কুলের টিচার খুশি হয়। ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে, শাবাশ ছেলে। ওর মা হুরমুতুন বানুর দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার ছেলের মাথা আছে গো বুয়া।

হুরমুতুন বানু তো আগে থেকে খুশি হয়ে গিয়েছিল। দেখেছিল ছেলেটিকে যা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তার সব উত্তর দিতে পেরেছে-ও নদীর নাম বলতে পেরেছে। পূর্ব-পশ্চিম কোন দিকে তা দেখাতে পেরেছে। কোন উপজেলায় ও থাকে সেটাও দেখাতে পেরেছে। দশ পর্যন্ত মুখস্থ বলতে পেরেছে। কোনো দিন স্কুলে না গিয়ে যে ছেলে এত প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে পারে তাকে তো স্কুলে ভর্তি করবেই টিচার। হুরমুতুন বানুর খুশির অন্ত নেই।

টিচার হাসমত মিয়া বলেছিল, তোমার ছেলেকে আর ছাগল চরানোর কাজে নিও না বুয়া। ও লেখাপড়ায় ভালো করবে।

মাকে উত্তর দিতে দেয়নি ওসমান আলী। সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, আমি মায়ের লগে কাম করুম। নইলে মায়ের মেলা কষ্ট অইব। মা জিরানের টাইম পাইব না। মা জিরাইতে না পারলে ভাত রাঁধব কে?

টিচার ছেলেটিকে দেখে মনে মনে প্রশংসা করেছিল। মুখে কিছু বলেনি। অবাক হয়েছিল। মায়ের জন্য ওর এমন অনুভব দেখে বলেছিল, আল্লাহ তোরে রহম করুক রে ওসমান।

এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে ও শুনতে পায় মা ওকে ডাকছে, ওসমু, ওসমু রে-

আপনে কোনহানে মাগো, আপনেরে তো আমি খুঁইজা পাইতাছি না।

যার শৈশব হারায় সে আর কিভাবে কাকে খুঁজে পাবে। সবই তো হারিয়েছে। ওর এটুকুও মনে নেই যে থ্রি থেকে ফোরে ওঠার সময় ওকে ফার্স্ট হতে দেখে হাউমাউ করে কেঁদেছিল ওর মা। মাকে কাঁদতে দেখে কেঁদেছিল অন্য দুই ভাইবোন। টিচার বলেছিল, কাঁদ কেন ওসমানের মা। আজ তোমার খুশির দিন। তোমার পোলা ফার্স্ব হয়েছে। ওকে দিয়ে আমাদের স্কুলের সুনাম হবে।

হুরমুতুন বানু কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেছিল, ও আমার সোনার পোলা রে-তোরে দিয়া আমি আর কাম করামু না। তুই অহন থাইকা কেবলই স্কুলে যাবি।

মায়ের আদরের সঙ্গে বাস্তবতা ভিন্ন। ওকে ঠিকই কাজ করতে হয়েছে। কয়েকটা টাকা বেশি রোজগার হয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে স্কুলে গিয়েছে। রাতের বেলা হারিকেন জ্বেলে পড়া মুখস্থ করেছে। প্রতিবছর ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে। প্রাইমারি পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছে। টিচাররা প্রশংসা করেছে। বলেছে, গোবরে পদ্মফুল। না-না কুঁড়েঘরে চাঁদের আলো। নাকি উলুবনে মুক্তা একটা। ওসমানের এত কিছু বোঝার সাধ্যি ছিল না। টিচার ওর মাথায় হাত দিলে ও খুশিতে গদগদ হয়ে যেত। বুঝতে পারত না যে ওর দরিদ্র অবস্থার জন্য তাদের বিদ্রূপ আছে। ও যখন প্রবল তৃষ্ণায় ওর শৈশব খুঁজতে থাকে। বুঝতে পারে না যে শৈশব কোথায়? শৈশব কাকে বলে? কেমন করে শৈশব কাটাতে হয়? কে যেন ডাকছে, ওসমান ওসমান। বাবা তুমি কোথায়? তোমাকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কি ধানক্ষেতে নাকি রাস্তায় মাটি কাটছ? নাকি ঘরের চালে ছাউনি দিচ্ছ? বাবা গো-তুমি কেন এভাবে হারিয়ে যাও। তখন ভেজিয়ে রাখা দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে ঘরে ঢোকে বদরুল।

ওমা তুই তো ঘরেই আছিস। তবে কথা বলিস না কেন?

আমার ইচ্ছে হয়নি সাড়া দিতে।

জানি তো তুই এমনই। এভাবে থাকলে একদিন তুই সাইকিক হয়ে যাস কি না সেই ভয় পাই। এত চুপচাপ কি করে থাকিস? তোর মনে কি অনেক দুঃখ?

না। দুঃখ আবার কী। এই সব আমি বুঝি না।

ন্যাকা। প্রেমে পড়লে বুঝবি।

প্রেমে চটকি খেলে বুঝব, নইলে বুঝব কেন? সবই গা-সওয়া। ভাবিস না আমার কিছু হবে।

বেশি কথা বলিস। চুপ থাক বেটা।

এই না বললি, আমি কথা বলি না।

বাশার ওকে ঘুষি দেখায়। ও কিছু বলে না। ও জানে বন্ধুরা ওর সঙ্গে এমনই করে। বন্ধুদের নানা প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয় ওকে। কখনো উত্তর দেয়। কখনো চুপ করে থেকে এড়িয়ে যায়। নানা কথা উড়িয়ে দিয়ে আকাশে হাউইবাজি দেখে। ভাবে, বেঁচে থাকা দারুণ একটি খাল। স্বচ্ছ জলে ভেসে বেড়ায় তিতপুঁটি। সে পুঁটির আঁশে লাল দানা জ্বলজ্বল করে। সেই লাল রঙের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া শৈশব-কৈশোর মিশে থাকে। আসলে জীবন কাটানোকে উপভোগ করতে শিখতে হয়। শিখতে না পারলে বেঁচে থাকার নিঃসঙ্গতা উপভোগ করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে ও একটি ক্যামেরা কিনেছে। ক্যামেরায় ছবি তুলে ভরে রাখে। এটাও হারিয়ে যাওয়া বিষয়ের প্রতিবিম্ব। আয়নার মতো। যেদিকে তাকালে নিজের সময়কে দেখা যায়। ও ক্যামেরা নিয়ে ঘোরে। নতুন জায়গা এবং বিষয় খোঁজে।

খুঁজতে খুঁজতে শুনতে পায় মায়ের ডাক, ওসমু পান্তা খেতে আয়। পুঁটি মাছের তরকারি আছে।

তুমি তো জান আমি পুঁটি মাছ খাই না। ওই মাছ আমার দেখার জন্য। ছোট খালের পানিতে ভেসে বেড়ায়। আমি খালে নামলে ওগুলো হারিয়ে যায়। আমি আর খুঁজে পাই না।

কই গেলি ওসমু। তোর থালায় পান্তা বেড়েছি।

আমি পান্তা খাব না মাগো। আমি গরম ভাতে ঘি লাগিয়ে খাব। তোমার নিজের হাতে বানানো খাবি। তুমি কিন্তু আমাকে বলবে না যে তোমার বাড়িতে গরু নেই।

ওসমু কোথায় গেলি রে? আমি তো বসে আছি।

তুমি আমাকে ওসমু নামে ডাকবে না। পুরো নামে ডাক।

আমার ওসমান আলী। কোথায় গেলি?

আমি তিতপুঁটি ধরতে এসেছি। এখনো একটাও পাইনি। এগুলো যে কোথায় লুকিয়ে থাকে!

ওসমান আলী, ওসমান আলী-

মা আমি একটি ব্যাঙ খুঁজছি।

ব্যাঙ কী করবি?

ব্যাঙের ডাক শুনব। ওকে নিয়ে পৃথিবীর এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ঘুরব। ও ডাকতে থাকবে আর মানুষজন আমার দিকে তাকিয়ে বলবে, দেখ দেখ একটা পাগল যাচ্ছে। কেউ ঝোলায় ব্যাঙ নিয়ে পথে হাঁটে? হা হা। আমার হাসি পায়। আমি তো পাগলই হয়ে যাই যখন মা আমাকে পান্তা খেতে ডাকে। আমার মনে হয় পান্তা ভাতের হাঁড়িতে ব্যাঙ থাকে। হাজার রকম ব্যাঙ। সেগুলোর কোনোটাই এক রকম না। কেমন ঘোরের মধ্যে দিনের পাড়ি জমাই সূর্যাস্তের দিকে। তারপর আর একটি দিনের শুরু দেখি।

বদরুল বলে, চল ঘুরে আসি।

কোথায়?

চল, যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে যাই। কোনো জায়গা ঠিক না করে বের হলে সেটা একটা অ্যাডভেঞ্জার হয়।

এসব রোমান্টিক কথা আমার একটুও পছন্দ না। আমার পড়া আছে। এখন বের হব না।

সবাই জানে তুই ফার্স্ব ক্লাস পাবি। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবি। তোর ভাগ্যের গিঁটটু দেওয়া হয়ে গেছে। আমি হলাম গিয়ে ভ্যাগবন্ত। কোথায় গিয়ে যে ঠেকব, কে জানে!

তুই কি থামবি?

ওসমান আলী কড়া চোখে তাকায়।

এমন করে তাকিয়েছিস যেন গিলে ফেলবি।

মৃদু হেসে ওসমান বলে, তুই আমার বন্ধু রে। আমার টিউশনিটা তো তুই জোগাড় করে দিয়েছিস। নইলে তো গাঁয়ে ফিরে দিনমজুরি করতে হতো।

যেই মেধা নিয়ে এত দূর এগিয়েছিস তোর আর পিছিয়ে যাওয়ার পথ নেই রে। তোর রাস্তা এখন সামনে। যেতেই থাকবি যেতেই থাকবি। দেখবি তোর পথ আটকে দাঁড়িয়ে কেউ নেই।

ওসমান আলী দ্রুত উঠে বদরুলকে জড়িয়ে ধরে। বলে, তুই আমার মায়ের মতো কথা বললি। আমার মায়ের পান্তার হাঁড়িতে ব্যাঙ থাকত। আমি সেই ব্যাঙের ডাক শুনতে পাচ্ছি।

কি বললি, তোর মায়ের পান্তার হাঁড়ি-

আমার মায়ের পান্তার হাঁড়ি আমার মায়ের স্বপ্ন।

আর ব্যাঙের ডাক?

কানামাছি খেলা। কানামাছি ভোঁ-ভোঁ যারে পা তারে ছোঁ-।

তুই আসলে শালা একটা রংবাজ-বদরুল উঠে ঠেলে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। বসে থাক শালা। তোর কোথাও যেতে হবে না।

ওসমান আলী চেঁচিয়ে বলে, হবে।

কোথায় যাবি? তোর কোনো ইচ্ছে-পিচ্ছে আছে বলে তো মনে হয় না।

তোদের সাধ্য নেই আমাকে বোঝার। আমি ঠিক করেছি দেশের পাহাড়ি এলাকায় যাব। পাহাড়-ঝর্ণা দেখব। গাছ-পাখি-ফুল দেখব। খুঁজে দেখব ওখানে আমার শৈশব আছে কি না।

বুঝেছি, একা একা থেকে হাজার রকমের চিন্তা তোর মাথায় ঘোরে। চল বাইরে যাই।

আমি কিছু টাকা জমিয়েছি। দূরে কোথাও যাব।

বদরুল এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলে, তোর সঙ্গে আমিও যাব। চল আমরা সাজেক ভ্যালিতে যাব। রাঙামাটির সীমান্ত এলাকা। পাহাড় দিয়ে বর্ডার আছে ওই সীমান্ত এলাকায়। মেঘালয় বর্ডার।

এলাকায় বাড়িঘর আছে না খালি পাহাড়?

বাড়িঘর আছে। ওখানে লুসাইরা বাস করে। চমৎকার জায়গা। ওখানে গেলে ফিরে আসতে মন চায় না।

ঠিক আছে যাব। ওখানে গিয়ে আমি একজনকে খুঁজব।

কাকে? এখানে তোর কোন জনমের আত্মীয় আছে?

আত্মার আত্মীয় আছে। এখন তুই যা বদরুল। আমি দরজা বন্ধ করব।

বদরুল জানে ও আর কথা বলবে না। এই ওর এক স্বভাব। ঠাস করে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে। এক অদ্ভুত ছেলে। বদরুলের ভাবনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওসমান আলী ধড়াস করে দরজা বন্ধ করে। রুমমেট হাসিব দেশের বাড়িতে গেছে। এখন ওর একা থাকার পালা। তার পরও তো বলতে হবে যে জীবন ওর একার নয় সে জীবন ভাগ করবে কার সঙ্গে? ছেড়ে আসা পরিবারের বাইরে ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে? রুমমেটের সঙ্গে? টিচাররা ওকে ভালোবাসে। ওর পরীক্ষার খাতা নাকি টিচারদের গভীর আনন্দ দেয়। খাতায় লাল কালির দাগ পড়ে না। ও ইতিহাসের ছাত্র। পাশাপাশি ভালোবাসে সাহিত্য ও চলচ্চিত্র। খরচ কুলাতে পারে না বলে সব সিনেমা দেখা হয় না। সব বইও কেনা হয় না। কদিন আগে জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসটি কিনেছে। পড়ে শেষ করা হয়নি। খুব যত্ন করে রাখার জন্য বইটিতে মলাট দিয়েছে ক্যালেন্ডারের পাতা দিয়ে। ধবধবে সাদা মলাটের ওপর লাল কালি দিয়ে নিজের নাম লিখেছে। এক মুহূর্ত থেমে নিজে নিজে বলেছে, আপনি কোথায় আছেন জহির রায়হান? শেষ ঠিকানা কোথায় হলো আমাকে জানাবেন কি? একবার দেখে আসব, আপনাকে দু-চারটে কথা বলব? জিজ্ঞেস করব ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের কথা। হাজার হাজার হাজার বছর ধরে আপনাকে খুঁজতেই থাকবে এ দেশের মানুষ। কারণ সবাইকে সমবেত কণ্ঠে বলতে হবে স্টপ জেনোসাইড।

আকস্মিকভাবে ও চুপ করে যায়। ওর প্রশ্নের সাড়া দেওয়ার কেউ নেই। ও তো এক শৈশবহীন বালক। কত বয়সই বা হলো ওর? বয়সের হিসাব নিয়ে ও আর মাথা ঘামায় না। ওর বয়স শৈশবে থেমে গেছে বলেই ওর ধারণা। ও এর বাইরে যেতে চায় না। বয়স থেমে থাকুক বা বাড়তেই থাকুক তাতে কি আর আসে যায়। জীবনের হিসাব তো ওর এক বয়সে হয়েই গেছে। ও ঠিক করে আজ ও রাতের ঢাকা দেখতে বের হবে। ও তো জানে নিঃসঙ্গতা ওর কাছে কোনো শব্দ মাত্র নয়। নিঃসঙ্গতা, গল্প, সিনেমা। ইতিহাস, দর্শন। ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান। হা হা করে হাসতে হাসতে ঘরের চারদিকে তাকালে ওর মনে হলো এটি একটি আয়নার ঘর। দেয়ালজুড়ে চারদিকে ওর ছবি দেখা যাচ্ছে। ওকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। যেন ভিন্ন কোনো এক দেশের রাজকুমার। ওকে মায়ের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে। মা বলছে, তোর জন্য আজ বিরিয়ানি রান্না হয়েছে। স্কুল থেকে এসে খাবি। ওর বাবা গরজ আলী গাড়ি ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরেছে। বড় একটি পাজেরো। গাড়ি থেকে নামতে নামতে ডাইভারকে বলছে, বিকেলে মিটিং আছে। তুমি কোথাও যেও না। গটগট করে ঢুকে যাচ্ছে বাড়িতে। ওর একমাত্র বোন তুষা। স্টেজে গান গাইছে। ও এক পপ-তারকা। হলভর্তি লোক। ওর গানের শেষে করতালিতে ভরে উঠছে হল। শিস বাজাচ্ছে লোকেরা। তুমুল করতালি। শব্দ ওকে বিস্মিত করছে। এক সময় শেষ হয় অনুষ্ঠান। ওর বড় ভাই সবুর আলী। বিদেশ যাবে ব্যবসার কাজে। প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি করবে। ওকে বলছে, তোর জন্য কী আনব রে? ও বলছে, আমার কিছু লাগবে না। দেশেই তো সব আছে। বিদেশের জিনিসও দেশে পাওয়া যায়। সবুর আলী গরম করে বলে, তবু বল একটা কিছু। ও একমুহূর্ত ভেবে বলে, আমার জন্য ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ বইটা এনো। সবুর আলী দাঁত খিঁচিয়ে বলে, ফু, একটা বই মাত্র। ছেলেটা ভালো কিছু চাইতেও শেখেনি। ও বলেছিল, ভাইয়া বেশি কিছু চাইলে লোভ বাড়ে। আমি লোভ বাড়াতে চাই না। লোভ? এই বয়সে তুই লোভের কি বুঝিস? যেটুকু বুঝি সেটুকুই বলেছি। কাচের ঘরের চারদিকে গুমগুম ধ্বনি। ও জানে এই সেসব ওর নয়। তবে এমন ছবি কেন ঘরের দেয়ালে ভেসে ওঠে। ও নিজের ওপর রেগে উঠে পা দাপায়। ইলেকট্রিসিটি ফেল করে। ও আরো রেগে যায়। মানুষের যন্ত্রণার সঙ্গে রসিকতা! ও বিড়বিড় করে। রাষ্ট্রও অনেক সময় মানুষের যন্ত্রণার সঙ্গে রসিকতা করে। হা, রসিকতা সাপ নিয়ে খেলা। সেটা সব সময় সুন্দর থাকে না। অন্ধকারের রসিকতা বড় তীব্র-ভেদ করে অন্তরের অন্তস্তল। ঘুটে কুড়ানির ছেলে ঈশ্বর প্রদত্ত অলৌকিক মেধার জোরে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে পৌঁছেছে। লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়েছে ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’। তাতে তার হারানো শৈশব ফিরে আসেনি। পাঠের আনন্দ হয়েছে, কিন্তু আত্মার সুখ হয়নি। ইট ভাঙার দিনমজুর মা মরার সময় বলেছিল, মাথায় ইটের বোঝা টাইনা মাজা ভাঙছি রে বাজান, কইলজা ভাঙি নাই। তুই ম্যালা বড় হবি। আল্লাহ তোরে বড় হওয়ার লাইগা দিনমজুরের ঘরে পাডাইচে। তোর তো বেবাক দুনিয়া দেখা লাগব রে চান্দ।

মাগো তুমি নাই তো দুনিয়ায় আমার আর কেউ নাই।

একলা থাইকলে মনের জোর বাড়ে। তোর তো ভাই আছে, বইন আছে। আর মনের জোর আছে। বাজান রে তুই মাথা তুইলা খাড়া। তাইলে আমার ইট ভাঙার খাটনি আর খাটনি থাকব না। হেইডা সোনার মুথা হইব।

ওহ্ আল্লাহ রে। ওসমান আলী অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে আলনা থেকে নিজের হাফ শার্টটা টেনে নেয়। গত বছর ও একটা প্যান্ট একটা হাফ শার্ট পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করেছে। এ বছর আর একটা প্যান্ট ও শার্ট কেনা হয়েছে। ও শার্ট পরে দরজা খোলে। বিভিন্নজনে যারা বারান্দায় চলাফেরা করছে তাদের মোবাইলের আলো খানিকটুকু অন্ধকার কাটিয়েছে। ও ঘরে তালা দেয়। কেউ একজন পাশ থেকে বলে, বেরোচ্ছিস?

হ্যাঁ।

কোথায় যাবি?

দেখি কোনদিকে যাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকায় তো-

জানি। আন্ধার। আন্ধারেই তো বড় হলাম। আলো আর দেখলাম কই।

তোর সঙ্গে কথা বলে মজা নেই। কথা বলতে বলতে এমন এক জায়গায় চলে যাস যে কথা শুনতে ভালোলাগে না।

ওসমান হাত উল্টে মুখভঙ্গি করে বলে, ভালো না লাগলে শুনবি না। সে জন্য তো কথা বলি না। তোরাই আমাকে কথা বলার জন্য খোঁচাস। গেলাম।

ফিরবি তো? নাকি পার্কে রাত কাটাবি?

দেখি কী করি। তবে তোদের মতো নষ্ট হইনি।

তুই আমাদের হলের গুডি গুডি বয়।

অন্ধকারে কথা মিলিয়ে যায়। কারো কারো পায়ের শব্দ ভেসে আসে কিংবা বেসুরো গলার গান। ওসমান আলী কোনো কিছু গায়ে না মেখে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়।

রাত হয়েছে। যানবাহন কমেছে। পায়ে হাঁটা লোকের সংখ্যাও কম। ঘুরে ঘুরে এই শহরটাকে দেখা আমার নেশা। আমার প্রিয় বলতে যদি কিছু থাকে তবে তা এই রাতের শহর। আলো-আঁধারের মগ্নতায় আমি নিজের শৈশব খুঁজি একজন মানুষের মাঝে, যিনি একদিন এই শহর থেকে উধাও হয়ে গেলেন। তিনি সেলুলয়েডের ফিতায় নিজের চিন্তা গেঁথেছেন। আবেগ ফুটিয়েছেন। মানুষের সামনে হাজির করে বলেছেন, দেখ আমাকে। কোনো কোনো মানুষের রহস্য এমনই। মানুষ রহস্যের আড়াল থেকে দৃশ্যমান হয়ে উঠলে সেটাই কি তার বড় বৈশিষ্ট্য? আমি নিজেকে আমার শৈশব খোঁজা থেকে দূরে রাখতে পারি না। ছেলে বলে ভবিষ্যতে আমি একটা কিছু করতে পারব। দেশের মানুষ আমাকে চিনবে। আমি যেই পরিবেশ থেকে উঠে এসেছি, সেই আমার সামনে মুক্তা বিছানো পথ আছে। আমি পারব উঠতে। কি পারব আমি? কতটুকু পারব? এই ভাবনা মাথায় রেখে ও হাঁটতে থাকে। নীলক্ষেত পার হয়ে আজিমপুর গোরস্থানের সামনে এসে দাঁড়ায়। কবরস্তানের পাহারাদারদের সঙ্গে ওর খাতির জমে উঠেছে। গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই জমিরুদ্দিন এগিয়ে আসে।

কেমন আছেন আলী ভাই?

ভালোই আছি। তুমি?

কালকে আপনের পরীক্ষা নাই।

কাল আমাদের ছুটি।

কিসের ছুটি?

বুদ্ধপূর্ণিমা।

বুঝলাম না। কবরস্থানের ভিতরে ঢুইকবেন?

হ্যাঁ, সে জন্যই তো এসেছি।

দিনের বেলায় আইসেন না ক্যান?

ক্লাস থাকে। লাইব্রেরিতে থাকতে হয়। টিউটোরিয়াল লিখতে হয়।

মেলা কাজের কথা কইলেন। আমার মনে অয় কারণটা এই রহম না।

বল, কী রকম।

আপনে যা খোঁজেন তা দিনের বেলা দ্যাহা যায় না।

কথাটা খানিকটুকু ঠিক। সবটুকু না। আমি যা খুঁজি তা আমি কখনো পাব না। সে জন্য রাতে আসি।

তাহলে খোঁজেন কেন?

তুমি বুঝবে না। খোঁজা আমার ফিলসফি।

মানে? জমিরুদ্দিন রাতের আঁধার ভেদ করে তীক্ষ্ন শব্দ করে। আশপাশ থেকে একজন বলে, কী হইল রে জমির?

ওসমান জমিরের হাত টেনে ধরে বলে, চলো। ভেতরে যাই।

কোন দিকে যাইবেন? সোজা যামু।

না পশ্চিমে চলো।

ক্যান, পশ্চিমে ক্যান?

ঢাকা শহর থাইকা পশ্চিমে আমার বাবা-মায়ের কবর আছে।

তার লগে উডার কী সম্পর্ক?

তুমি বুঝবা না। চলো। ওসমান গেটের ভেতর ঢুকে হাঁটতে থাকে।

এমুন কইরা খুঁজা কি সহজ কাম?

রাতের অন্ধকারে জমিরুদ্দিনের কণ্ঠস্বর ভেসে যায়। ব্যাঙের ডাক শোনা যায়। থেমে থেমে সে ডাক আসে কবরস্তানের বিভিন্ন জায়গা থেকে। হয়তো ফোকরে কোনো পানি জমেছে। কিংবা ঘাস-লতাপাতার ভেতরে অপেক্ষায় আছে পুরুষ ব্যাঙ। জানান দিচ্ছে তার অবস্থান। ব্যাঙের ডাক শুনে এক মুহূর্ত দাঁড়ায় ওসমান। জানে ও কোনো ব্যাঙ দেখতে পাবে না। অন্ধকার চারদিকে কিংবা অন্ধকার না থাকা, অন্ধকারই তো ওর জীবনে আলো-কোথাও কিছু যায় আসে না। কবরের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে আসে ওসমান। দেখা পায় দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে জলফু। ওসমান ওকে সবুজ ব্যাঙ ডাকে। ওসমানকে দেখে আজ ও উঠে দাঁড়ায় না। নড়েও না। হাত বাড়ায় না। বলে না, আজ পেট ভরে ভাত খেয়েছি। কবর খুঁড়ে ভালোই টাকা পেয়েছি। দুই থালা ভাত আর দুই থালা গরুর গোশত জম্পেস খাওয়া। ওসমান আশপাশে তাকায়। জমিরুদ্দিন নেই। আজ ওর পিছু পিছু আসেনি। ওসমান গিয়ে ওর পাশে বসে।

কথা বলছিস না যে জলফু?

আপনি তো আমাকে খুঁজতে আসেননি।

তা তো আসিনি। তবু তোর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল।

কপাল। জলফু চেঁচিয়ে বলে, কপালে থাকলে যা হবার তা তো হবে। এ্যাঁ-

চেঁচাচ্ছিস কেন?

চেঁচাইনি। এটা সবুজ ব্যাঙের ডাক। ব্যাঙ খোঁজেন আর ব্যাঙের ডাক বোঝেন না।

তোর কি মন খারাপ জলফু?

হ্যাঁ, অনেক মন খারাপ।

আজ কয়টা কবর খুঁড়েছিস?

তিনটা। আমার বয়সী একটি মেয়ের বাবা মরে গেছে। মেয়েটি খুব কাঁদছিল। মনে হয়েছিল মেয়েটিকে বুকে টেনে বলি, কাঁদিস না রে। আমারও বাবা মরে গেছে। অ্যাকসিডেন্টে। তখন আমার বয়স ছিল ছয় বছর।

মেয়েটিকে এই কথা বলতে পারিসনি দেখে কি তোর মন খারাপ? সব কথা সবাইকে বলা যায় না। মনে অনেক কথা আসবে সেসব কথা মনের ভেতরেই রাখতে হবে। উপায় নেই।

উপদেশ দেন কেন আলী ভাই? পড়ালেখা বেশি শিখি নাই। কিন্তু অনেক কিছু বুঝতে পারি। কবর খোঁড়ার কাজ করে যেই ছেলে সে কি করে ক্লাস নাইনে পড়া মেয়েকে এমন কথা বলবে? এটা আমিই জানি। আপনাকে বলে দিতে হবে না।

আমি তো জানি যে তুই একজন পণ্ডিত।

পণ্ডিতই। দেখে দেখে শিখেছি। দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গেছি।

ওসমান হা হা করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে, তুই দশটা বুড়ো ব্যাঙ।

আপনার হাসিও ব্যাঙের ডাকের মতো লাগছে।

তাহলে আমি তোর গুরু। নাকি রে?

এবার জলফু হা হা করে হাসে। হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ায়। ওসমানের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলে, ভালো আছেন আলী ভাই?

ভালো তো আছি। বেশ ভালো আছি।

আজকে কবরস্থানে কেন এসেছেন?

একজন প্রিয় মানুষকে খুঁজতে।

যাকে আপনি কোনো দিনও পাবেন না।

পাব। পাব রে পাব। তুই বেশি ডেঁপোমি করিস না।

আবার হো হো হাসিতে নিজেকে মাতিয়ে তোলে ছেলেটি। কবরস্থানে রাতের অন্ধকারে হাসা যায় না, এমন ধারণাই সবার। কিন্তু ওসমানের মনে হয় প্রিয়জনের সঙ্গে তো হাসা যায়। তাদের অনুভব যদি বুকের ভেতর ঝড় তোলে তাহলে মৃত্যুকে সত্য মেনে হাসা যাবে না কেন? মৃত্যু তো জীবনের সত্য। আমার মা নেই, বাবা নেই- তাদের জন্য আমার ভালোবাসা আছে, হাসি-আনন্দ আছে। তাদের জন্য সবটুকুই আমার দুঃখ না। এই সিদ্ধান্তে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওসমানও হো হো হাসিতে যুক্ত হয় জলফুর সঙ্গে। এক সময় জলফু জিজ্ঞেস করে, আপনি হাসছেন কেন?

আমার মাকে ভালোবাসার কথা বললাম। মা না হলে আমি এত দূর আসতে পারতাম না।

এই কবরস্থানে আপনের মা নাই।

তাতে কী, মা যে কবরেই থাকুক না কেন, আমার হাসি শুনতে পাবে।

আর যে মানুষটিকে আপনি খোঁজেন তিনিও কি শুনতে পাবেন?

অবশ্যই পাবেন। আমার ভালোবাসাও তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। তোর কি খিদে পেয়েছে সবুজ ব্যাঙ?

আজ আমি দুপুরের পর থেকে কিছু খাইনি। পেট চোঁ চোঁ করছে। মাঝে মাঝে গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে পেটের ভেতরে।

ব্যাঙ ডাকছে মনে হচ্ছে?

খিদে ব্যাঙ হয়ে ডাকছে।

গুড বয়, আমার সবুজ ব্যাঙ। তুই এখানে কিছুক্ষণ বসে থাক। আমি কবরস্থান ঘুরে আসি।

কতক্ষণ লাগাবেন? আপনার তো অনেক সময় লাগে। যদি রাত দুপুর হয়ে যায়?

যেতে পারে। দুপুর রাতেও রেস্টুরেন্টে খাবার পাওয়া যায়। এসব রেস্টুরেন্ট রাতজাগা মানুষের জন্য খোলা থাকে। ওদের হাঁড়িতে যা থাকবে খেয়ে শেষ করে ফেলবি।

হাঁড়ি ভর্তি থাকলে?

এত রাতে হাঁড়ি ভর্তি থাকবে না।

গেটের দিকে যাই। আপনি কবরস্থান ঘুরে আসেন আলী ভাই।

ওসমানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ও হনহনিয়ে হেঁটে যায়। ওসমান ওর পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, ছেলেটি এমনই। স্মার্ট এবং স্পষ্ট বক্তা। এই মুহূর্তে ও ওসমানের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ভবঘুরে ছেলেদের জীবনে প্রশ্ন এবং উত্তর কোনো সমাধান নয়। ওরা নিজের ইচ্ছেমতো নিজেকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ওর বাবা-মা-ভাইবোন কামারাঙ্গীরচরে থাকে। ও বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। ওসমানকে বলেছে, ঘরের চেয়ে পথই ভালো। পথে থাকলে পথ ঘর হয়। না হলে অন্য জায়গা। কেমন এই কবরস্থান কিংবা পার্ক কিংবা ফুটপাথ কিংবা ওভারব্রিজ কিংবা ফ্লাইওভার। যেখানে খুশি সেখানে। ঝড়-বৃষ্টি-শীত-গ্রীষ্ম সবই আপন। হা হা হাসিতে নিজেকে ভরিয়ে দিয়ে ওসমানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমার কোনো দিন ঘর হবে না।

ওসমান বলেছিল, বউ চাস না? ছেলেমেয়ে? একটা বিছানা? একটা রান্নাঘর?

হ্যাঁ, চাই। তবে সবার মতো ঘর না।

তাহলে তোর ঘর কী?

মরণ। ওর মুখে মৃদু হাসি।

মরণ? কী বলিস? বুঝতে পারছি না।

আপনি বললে বলতেন মৃত্যু। আমার ঘর মৃত্যু। যে ঘুম আর কোনো দিন ভাঙবে না। ওই ঘরে আমি শুয়ে থাকব।

তারপর হঠাৎ করে বামে তাকিয়ে পাশের কবরের কোনা থেকে একটি ব্যাঙ ধরে ওসমানের চোখের সামনে দুলিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে দিল। ওসমান চমকিত হয়েছিল। ভেবেছিল, এমন একটি ছেলের গল্প নিয়ে জহির রায়হান সিনেমা বানাবেন। তাঁকে তো ওর খুঁজে পেতেই হবে।

ও পা বাড়ায় ডানে। খানিকটুকু এগোতেই দেখতে পায় তিনটে নতুন কবর। এর আগে কেউ এই কবরে ছিল। কবরস্থান শুরুর সময় থেকে এখন পর্যন্ত কতজন আছে এখানে? ওসমান মাথার ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। কোন কবরটি আপনার প্রিয় জহির রায়হান। আমি এখন আজিমপুরে। আমি জানি আপনার বেঁচে থাকার শেষ জায়গা ছিল মিরপুর। তারপর আপনি কোথায় গেলেন সে খোঁজ আর পাওয়া যাচ্ছে না।

ওসমান এটুকু ভেবে নিজের সিদ্ধান্তে আসে। ভাবে তিনি সর্বত্র আছেন। এমনকি ভবঘুরে জলফুর মস্তিষ্কেও। ওর চেতনার মধ্যমণিতে। ওর মেধার সরবরে কিংবা সমুদ্রের মতো বিশাল জগতে যেখানে জলফু মানব-সম্পর্কের বাইরের ছেলে হয়ে যায়। ওর ভেতরে একা থাকার কনসেপ্ট ডেভেলপ করে। সে কনসেপ্ট সামাজিক নয়। সমাজের বাইরের দলছুট চিন্তা। তবু জলফুর মতো কেউ কেউ এভাবেই জীবনের পৃষ্ঠা ভরাতে চায়। ওকে জিজ্ঞেস করলে ও বলবে, মানুষ তো মায়ের পেটে একাই থাকে। বের হয় একা একা। তার সঙ্গে তো আর কেউ বের হয় না।

ওসমান ওর এমন ধারণাকে ভেঙে দেয় না। ভাবে, সামাজিক বন্ধনে অন্যরকম মানুষ না থাকলে বন্ধন একপেশে হয়ে যেত। যেমন ছাত্রদের সবাইকে ওর ভালো লাগে না। বড় একরকম মনে হয়। তার চাইতে অনেক বৈচিত্র্যময় জলফুর মতো বালকেরা। বেঁচে থাকাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বলের মতো ছোড়ে-ধরে কিংবা মাটিতে গড়িয়ে দেয়। কৈশোর ছাড়িয়ে তারুণ্যের পথে যেতে শুরু করা এমন একটি ছেলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। ও হেঁটে যায় কবরস্থানের সরু পথে। মাথার ওপরে নানা ধরনের গাছের ডালপালার বিস্তার আছে। ছুঁয়ে দেয় ওর মাথা। এই স্পর্শও বেশ লাগে। ভাবে, মায়ের হাত কি? ওর হারানো শৈশবে মায়ের এমন একটা হাত ছিল। অনবরত মাথা ছুঁয়ে রাখত সে হাত-সেটা ডান না বাম হাত তা ও জানত না। ছুঁয়ে থাকাটাই আনন্দের ছিল। এখন মনে হয় কখনো ডান হাত থাকত, কখনো বাম। হাত ছিল অদৃশ্য অঙ্গ-মায়ের সেই হাত কখনোই তার নিজের চোখের পানি মোছায়নি। আমার মাথার ওপর মায়ের দুই হাতই ছিল। সে জন্য সেই হাত আর কোনো কাজে নড়েনি। চোখের পানি মোছার জন্যও না।

তখন ওর নিজের চোখেই পানি আসে। ও দুই হাতে পানি মোছে। হাঁটতে হাঁটতে আরো খানিকটুকু এগিয়ে গেলে ওর মনে হয়-ওর মা হুরমুতুন বানুও একটি সিনেমার চরিত্র হতে পারত। একজন ইটভাঙা দিনমজুর যার হাত আছে, তবু সেই হাত নেই। এমন এক মানসিক অবস্থায় মৃত্যুর কথা ভাবতে ভাবতে বলল, বাবা ওসমু রে তোর কি অইতে সাধ হয় ক আমারে।

সাধ আবার কী? শব্দটি শুনতে বিরক্ত লাগে ওর।

তোর কী অহতে ইচ্ছা অয়। বড় হইয়া কী হইবা?

সিনেমা বানামু। এমুন সিনেমা যে মানষে দেইখা চোখের পানি মুইছতে পারব না। চোখের পানির বান অইব। দুই কূল ভাসানো বান।

সেদিন হুরমুতুন বানু গুনগুনিয়ে কেঁদেছিল। ছেলে কী হতে চেয়েছিল তা সে বুঝতে পারেনি। ও যে বাজারে গিয়ে সিনেমা দেখত সে খবর তার কাছে ছিল। সিনেমা বানানো কারো ইচ্ছা হতে পারে তা হুরমুতুন বানুর মাথায় আসছিল না। নিজেকে বোঝার আপ্রাণ চেষ্টায় তার জান বেরিয়ে যাচ্ছিল। সেই কষ্ট বুকে নিয়ে সরে গিয়েছিল হুরমুতুন। মাত্র দুই দিনের মাথায়। ওসমান আলীর এসএসসি পরীক্ষা ছিল সামনে। মায়ের মৃত্যুতে ওর হারানো শৈশবের বাকিটুকু শূন্য হয়ে গিয়েছিল। বলে দিয়েছিল, ও আর পড়ালেখা করবে না। স্কুলে যাবে না। এসএসসি পরীক্ষা দেবে না। স্কুলের হেডমাস্টার ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, তুই আমাদের স্কুলের গর্ব। মায়ের জন্য কাঁদবি আবার পরীক্ষাও দিবি। তেমন হলে একদিকে চোখের পানি ফেলবি, অন্যদিকে পরীক্ষা দিবি। শুধু খেয়াল রাখতে হবে চোখের পানিতে যেন খাতা ভিজে না যায়। বুঝলি বাবা, বাবা-মা তো সবার জীবনে-

ওসমান আলী কাঁদতে শুরু করলে হেডমাস্টার কথা বলেননি আর। ওর হাত ধরে বলেছিলেন, আয় আমার সঙ্গে। তারপর তিনি ওর হাত ধরে বিভিন্ন পথে অনেকক্ষণ হেঁটেছিলেন। কখনো পাকা সড়কে, কখনো মেঠো পথে। কোথাও বসেননি, কোথাও দাঁড়াননি। এমনকি একটি কথাও বলেননি। শেষে ওদের বাড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন, তোর বড় ভাইয়ের কথা শুনবি। ঘরে থাকবি। লেখাপড়া করবি। ভালো রেজাল্ট চাই।

বোর্ডে স্ট্যান্ড করে ভালো রেজাল্টই তো করেছিল ও। সে জন্য এখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। পথের ধারে ছিটকে পড়েনি। দিনমজুর থাকতে হয়নি। হলে থেকে পড়াশোনার খরচ চালাতে কষ্ট হয়। মিরপুরে গিয়ে পড়াতে হয় একটি ছেলেকে। ওর বাপের বিত্ত আছে। কিন্তু ছেলের মেধা নেই। গাধার একশেষ। ওসমানের মনে হয় বড় হতে হতে ছেলেটি বখাটে হয়ে যাবে। বাপের টাকা ওকে সর্বনাশের মাথায় চড়িয়ে দেবে। একদিন ছেলেটির বাবাকে ও বলেছিল, শাওনের পড়ালেখায় মনোযোগ নেই। ও পর্নো ছবি দেখতে ভালোবাসে। আমাকেও দেখতে বলে।

তাতে তোর কি রে শুয়োরের বাচ্চা। আমার ছেলে যা খুশি তা করবে। একটা ভ্যানচালকের ছেলে তার আবার বড় বড় কথা। খবরদার আমার ছেলেকে যদি কিছু বলবি তো তোর দাঁত ফেলে দেব। মনে থাকে যেন।

ওই ভর্ৎসনার সময় ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল, ভানচালক বাবার মর্যাদার কথা ভাবেনি। মাথা সোজা করে বলেনি, ভ্যান চালায় তো কী হয়েছে, তিনি মানুষ হিসেবে অনেক বড়। কারো ক্ষতি করেননি। কারো টাকা মেরে দেননি। ভর্ৎসনা করে লোকটি চলে গেলেও চুপ করে দাঁড়িয়েছিল ওসমান আলী। দেখেছিল ঘরের দেয়ালজুড়ে আয়নায় ওর নিজের ছবি। সেই ছবিতে ফুটে আছে শৈশবে ইটের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে হেঁটে যাওয়া ছেলে। কৈশোরে ভ্যান চালিয়ে চলে যাওয়া একটি ছেলে। যৌবনে কবরস্থানে খুঁজতে আসা একজন শহীদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে। অস্পষ্ট হয়ে আছে ফেলে আসা দিনের ছবি। কত ধরনের ছবি যে তার, সবগুলোর আকার বোঝা যায় না। সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকেই বলেছিল, তুমিও একটি নষ্ট ছেলে। তুমি যাকে পড়াও তার চেয়েও বেশি খারাপ-এত কথা শোনার পরেও যে ছেলে ওই লোকের ঘরে টিউশনি করে, সে তো নষ্ট ছেলেই। এখন এই কবরস্থানে দাঁড়িয়ে মনে হয় শাওন কতটুকু নষ্ট হয়েছে তার চেয়ে ও বেশি নষ্ট। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ চালাতে হবে। সে জন্য ওই বাড়ির ছেলেটিকে পড়ানোর কাজ ছেড়ে চলে আসতে পারেনি। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দায় কাঁধে নেওয়া সহজ মনে হয়নি। যার জীবন থেকে শৈশব হারায় তার সাহসও কি দমে যায়? নিজের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই ওর। এই প্রশ্নের উত্তর ও খুঁজবে না। যার দ্রুত সমাধান নেই তার উত্তর খোঁজার দরকার নেই। একদিন ওই লোকের ঔদ্ধত্যের জবাব দিয়ে আসবে। সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

ও সব ভাবনা ঝেড়ে দ্রুত পায়ে সামনে এগিয়ে যায়-জহির রায়হান কদিন আগে আমি যে সিনেমাটি দেখেছি তার নাম ‘হোটেল রুয়ান্ডা’। রুয়ান্ডার গণহত্যার পটভূমিতে তৈরি। আপনি নির্মাণ করেছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’, তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার কথা। মানুষের ইতিহাস সংলগ্নতা মানুষকে কাছে আনে। মানুষের শিল্পবোধ সেই ইতিহাসকে মূর্ত করে। আমি আপনাকে খুঁজছি জহির রায়হান। কোথায় আছেন এখন? ওসমান আলী পুরো কবরস্থান ঘুরে আবার নিজে নিজে কথা বলে, আমি আপনার সঙ্গে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’ গানটি গাইতে চাই। শহীদ বরকত এই কবরস্থানে আছেন। আমি তাঁর কবরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। খুঁজছি এই গানের গীতিকারকেও। তিনিও হারিয়েছেন। কোথাও নেই তাঁর কবর।

ওসমান আলী ইলেকট্রিক বাতির আধো অন্ধকারে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। সময় এখানে কলমের খোঁচা মাত্র নয় যে টান দিলেই খাতার সাদা পৃষ্ঠায় ঢাকা পড়ে যাবে। সময় এখানে ধারাবাহিকতা-এই মুহূর্তে শহীদ বরকত থেকে আলতাফ মাহমুদ-জহির রায়হান। একাত্তরের গণহত্যা থেকে রুয়ান্ডার গণহত্যা। আরো হাজার হাজার বছরের ধারাবাহিকতা, যেখানে কেউ আঁচড় টানতে পারে না। স্রোত রুদ্ধ করতে পারে না। ওসমান আলী কবরের পাশে বসে বলে, আপনি ভালো আছেন তো শহীদ করকত? কোথায় আছেন? পুরো বাংলাদেশের সবখানে। আপনি তো এক জায়গার মানুষ মাত্র নন। আপনি দেশের-দেশের মানুষের। ওর মাথার ভেতরে রুদ্ধ আলোর ঝলকানি। ‘হোটেল রুয়ান্ডা’ সিনেমার নানা দৃশ্য মাথার ভেতরের এক কোনা থেকে অন্য কোনা অতিক্রম করে। ও নিজের ভেতরে সেই জায়গাটি খুঁজতে থাকে। যেখানে খানিকটা স্বস্তি আছে। কিন্তু খুঁজে পাওয়া কঠিন।

নিঃশব্দে পাশে এসে বসে জলফু। ওসমান জলফুর ঘাড়ে হাত রাখে। ওর দিকে তাকায় না। ও মাথা থেকে হাত সরিয়ে বলে, আলী ভাই আপনি কি আমার খিদের কথা ভুলে গেছেন?

না, ভুলিনি। যা কিছু হারিয়ে যায় তাকেও আমি মনে করি।

তাহলে এখানে বসে আছেন যে? রেস্টুরেন্ট তো বন্ধ হয়ে যাবে।

ওদের হাঁড়িতে ভাত-মাংস আছে?

আছে। আপনি খেলেও শেষ হবে না।

আজকে কি ওদের কাস্টমার কম হয়েছে?

আমি কেমন করে জানব, আমি কি ওখানে কাজ করি? নাকি দরজায় দাঁড়িয়ে দেখি?

তুই খুব রেগে যাচ্ছিস সবুজ ব্যাঙ।

খিদেয় আমার পেট চোঁ চোঁ করছে। রাগে আমার মাথায় আগুন জ্বলছে।

চল, চল। আমারই ভুল হয়েছে সবুজ ব্যাঙ। ওসমান আলী জলফুর হাত ধরে। আমারও খিদে পেয়েছে রে। হলে আমার ভাত তো এত রাতে আর পাব না। আমিও তোর সঙ্গে ভাত খাব।

ওই ছেলেটার বাবা আজ আপনাকে বেতন দিয়েছে?

মাস তো ফুরোয়নি। তুই ভুলে গেছিস। মাস শেষ না হলে বেতন দেবে কেন? এই শহরে দয়ার মানুষ কি আছে? তুই বল।

আমি মানুষের খোঁজ রাখি না। খোঁজ রেখে কী হবে?

তোর কাছে আমি কি মানুষ?

না, হি হি করে হাসে ও। হাসতেই থাকে। এক সময় হাসি থামিয়ে বলে, আপনি আমার কাছে জোনাকি আলী ভাই।

কেন, জোনাকি কেন রে?

জোনাকি যেমন জ্বলে আর নিভে, আপনিও তেমন জ্বলেন আর নিভেন।

ওরে পাজির পা-ঝাড়া। তবে একটি দামি কথা বলেছিস ব্যাঙের ছানা। তোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আজ আমি ভাত খাব।

দুজন রেস্টুরেন্টে ঢোকে। ওসমান বুঝতে পারে জলফু আয়োজন ঠিক রেখেই ওকে ডাকতে গেছে। একটি টেবিলে দুটি থালা, দুই গ্লাস পানি, নুনের বাটি দেওয়া আছে। ওদের দেখে ভাত-মাংস নিয়ে আসে রেস্টুরেন্টের মালিক। বলে, পেটভরে খান স্যার। আপনি আমার শেষ কাস্টমার।

আরো কেউ তো আসতে পারে।

আসবে না। তল্লাট খালি হয়ে গেছে।

তাহলে আপনিও আসেন। আমরা একসঙ্গে খাই। এই জলফু, যা ওনার জন্য একটা প্লেট নিয়ে আয়।

না, না, প্লেট আনতে হবে না। আমার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। আপনারা খান।

জলফু ততক্ষণে খেতে শুরু করেছে। ওসমান আলীও হাত লাগায়। এক লোকমা ভাত মুখে পুরলে মনে হয়, কয়েক দিন পরে সুস্বাদু মাংসের তরকারির ভাত ওর প্রাণ জুড়িয়ে দিল। খাওয়া নিয়ে ওর তেমন কোনো বাড়াবাড়ি নেই। তার পরও জিহ্বা এমন সুস্বাদু খাবার দাবি করে। আকস্মিকভাবে। কখনো কোনো একসময়ে। আজকের এই মধ্যরাতের সময় ওর কাছে অন্য রকম এ কারণে যে পথের ছেলে জলফু বলেছে, আপনি জোনাকির মতো জ্বলেন আর নিভেন। আশ্চর্য! ছেলেটি কত অবলীলায় ওকে একটি জায়গায় নিয়ে গেল। এক মুহূর্ত ভাবতে হয়নি। তাহলে ওর মাথার ঘিলুতে কি জোনাকির আলো জ্বলেই থাকে? যা ওর মগজে আলোর দীপ শিখা? তা-ই হবে। প্লেটের ওপর ওর হাত থেমে এসেছিল। সে হাত আবার দ্রুত হয়। মুখে উঠে যায় ঘন ঘন। ওর ভাবনা আবার জাগে। ভাবে, পথের ছেলের জ্ঞানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলের ছাপ আছে। যখন ও বর্তমানে থাকে তখন ও জ্বলে থাকে। যখন ও হারানো শৈশব খুঁজে পায় না তখন ও নিভে যায়। এই সরল সত্য ওকে আনন্দ দেয়। আজ রাতের খাবার গভীর আনন্দ হয়ে ওঠে। প্রতিদিন এমন খাওয়া হয় না। হোস্টেলের রান্না গতানুগতিক। কোনো মৌলিকত্ব নেই। দায়সারা রান্না বলতে যা বোঝায় তা-ই। ডাল মানে পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ মেশানো রঙিন পানি। বাবুর্চিকে বললে বলে, পানির মতো খান। মনে করেন স্যুপ। এত কম পয়সায় ভালো রান্না খোঁজা কি ঠিক!

তাই তো। শব্দটি ও জোরেই বলে। এবং সঙ্গে সঙ্গে জলফুর দিকে তাকায়। জলফু হাতের তালু চাটতে চাটতে বলে, আপনি কার সঙ্গে কথা বললেন আলী ভাই।

ধর তোর সঙ্গে? তুই ছাড়া তো কেউ নেই এখানে।

আমার সঙ্গে বললে তো আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতেন। আপনি তা করেননি। বলেছেন, তাই তো।

তাহলে ধরে নে আমি নিজের সঙ্গে কথা বলেছি।

তাহলে আপনার ভেতরে কেউ আছে?

আছেই তো, অনেক মানুষ আছে।

হি হি করে হাসতে হাসতে বলে, এ জন্য আমি আপনাকে জোনাকি বলি। জ্বলা আর নেভা। যাই, হাত ধুয়ে আসি। আপনার প্লেটও দেন, একসঙ্গে ধুয়ে আনব।

ও থালা নিয়ে চলে গেলে এগিয়ে আসে মালিক।

আমি হাত ধুয়ে এসে আপনার বিল দেব। পকেটে বেশি টাকা নাই। যদি কম হয় তাহলে বাকিটা কালকে এসে দিয়ে যাব।

পকেটে টাকা কম? দেখি। লোকটি ওকে আটকে দিয়ে ওর সব পকেটে হাত ঢোকায়। ওসমান আলী অবাক হয়ে বলে, করেন কী? আমার পকেটে হাত দিচ্ছেন কেন?

যা আছে সব নেব সে জন্য।

সব নিবেন? মগের মুল্লুক নাকি?

এত রাতে ভাত খেলে খেসারত দিতে হয়। ভাত বেশিও খেয়েছেন। একদম গলা পর্যন্ত। খাওয়ার সময় হুঁশ থাকে না?

ওসমান আলী বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এমন সুনসান হয়ে যাওয়া চারদিকে যখন নিঃশব্দ স্তব্ধতা, তখন কি ও হাইজ্যাকারের পাল্লায় পড়ল। লোকটি ক্রূর হাসি হেসে বলে, ভাবাভাবির কিছু নেই। টাকা বের কর।

তুমি করো। দ্যাখো কত আছে? ওসমান দুই হাত ওপরে তুলে দাঁড়ায়। ছুটে আসে জলফু।

আপনি আলী ভাইয়ের পকেট হাতড়ান কেন? তাঁর পকেটে টাকা না থাকলে আমি আপনার ভাত-গোশতের দাম খাটনি দিয়ে শোধ করব। খবরদার! ছাড়েন তাঁরে।

ওরে শয়তান, আমার ভাত খেয়ে আমার ওপর কথা।

লোকটা জলফুর গায়ে ঠাস করে চড় মারে। লম্বা-চওড়া শক্তিধর মানুষটির চড় খেয়ে উল্টে যায় জলফু। কোনো রকমে পাশে রাখা চেয়ার ধরে নিজেকে সামলায়। তারপর আবার রুখে দাঁড়াতে চাইলে লোকটি ওর হাত মুচড়ে ধরে বলে, তুই কি মরতে চাস? দিব শেষ করে।

তুমি কি তাহলে বাঁচবে শয়তান? পুলিশের প্যাঁদানি খেয়ে-

আবার চড় পড়ে ছেলেটির গালে। ও লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ওসমান আলী ওকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে টেনে সরায়। জোরে জোরে বলে, থাম রে জলফু, থাম। তারপর লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে, পকেট থেকে যা পেয়েছেন তাতে কি ভাতের দাম হয়েছে?

বেশিই হয়েছে।

বাকিটা ফেরত দেন। এই টাকা আমার হালাল রুজি।

এই সময়ে হারাম-হালাল বুঝতে চান মিয়া। আপনে কোন জনমের মানুষ? যান, বারান। ওইডারে ছাড়েন। ওইডারে রাইতে আমার লাগব।

মানে? ওসমান আলীর বিমূঢ় কণ্ঠস্বর থমকে যায়।

কথা বাড়াইয়েন না। যান বারান।

রেস্টুরেন্টের মালিক ওকে এক রকম ঠেলে বের করে দরজা বন্ধ করে দেয়। পুরো লাগানোর আগে ওসমান ধাক্কা দিয়ে খুলে ডাকে, সবুজ ব্যাঙ।

এখন আমার বিছানা পাতা লাগবে আলী ভাই।

এক বিছানায় ঘুমাবি?

হ্যাঁ। আপনি যান। আমার জন্য ভাববেন না। আমি ভালো থাকব।

তারপর অয় মালিকের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, তুই আলী ভাইয়ের টাকাটা ফেরত দে।

এই চুপ। বেশি কথা বলবি না।

বেশি কথা বলবি না। না দিলে আজ রাতে তোর কপালে দুঃখ আছে। দে, দে বলছি।

জলফু চিৎকার করে ওঠে। তারপর দরজার কাছে এসে বলে, আমি গেলাম পার্কে ঘুমাতে।

লোকটা ওর হাত চেপে ধরে রেখে পকেট থেকে টাকা বের করে ওসমানের দিকে ছুড়ে মারে। টাকাগুলো ছড়িয়ে যায় চারদিকে। ও দুই পা পিছিয়ে এসে হনহন করে হাঁটতে শুরু করে। তারপর দৌড়াতে থাকে। এক দৌড়ে ওর হলের গেটে এসে দাঁড়ায়। গেটের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দম নেয়। এতটা দৌড়াতে পেরেছে দেখে নিজের ওপর মায়া হয়। মধ্যরাতের এই শহর ওর চারদিকে কাচের দেয়াল হয়ে যায়। ও খুঁজতে বেরিয়েছিল একজন মানুষকে। যার সঙ্গে ও অনবরত ভাগাভাগি করে নিজের চিন্তা। আজ ওর চারদিকের আয়নায় নানা দৃশ্য ওকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যায়। দেখতে পায়, সময় কোথায় থেকে কোথায় চলে গেছে। ও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। দুই পা টনটন করছে। নিজের ভার ধরে রাখা কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে কখনো এমন কঠিন সময় ওকে দেখতে হয়নি। ও গেটের সামনে বসে পড়ে। কাচের দেয়ালে ভেসে ওঠে ওর ফেলে আসা জীবন। সেখানে ওর শৈশব নেই।

স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে একজন কিশোর বালক ওসমান আলী খুঁজে বেড়াচ্ছে ওর শৈশব। কিছুক্ষণ আগে ও দেখে এসেছে আর একটি বালক, যে হারাচ্ছে তার কৈশোর। এই কৈশোর ও আর কোনো দিন খুঁজে পাবে না। আগামীতে ও যদি নষ্ট মানুষ না হয়, তবে এই কৈশোরের জন্য ও কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবে। ওর আদরের সবুজ ব্যাঙ কৈশোর হারিয়ে যাওয়া বালক হবে, এটা ও দেখতে চায়নি। ওর ভেতরের সবটুকু গুঁড়িয়ে যায়। গুঁড়িয়ে সমান হয়ে যায় বুকের পাটাতন। ও প্রাণপণে ভুলতে চেষ্টা করে মধ্যরাতের ঘটনাটি। প্রাণপণ ভুলতে চেষ্টা করে লোকটির চেহারা। ভুলে যাওয়ার বিষয়টি ওর কাছে একদমই সহজ না। মধ্যরাতের দৃশ্যটি স্থির হয়ে যায় ওর মস্তিষ্কে। ছোটবেলা থেকে লোকের কাছে শুনেছে, ছেলেটির মাথা ভালো-এই ভালো মাথা নিয়ে ওর বুকের কষ্টে ধস। ও আস্তে আস্তে উঠে বসে। দেখতে পায়, আশপাশের ফুলগাছের ঝোপঝাড়ে জোনাকির আলো জ্বলছে আর নিভছে। শোনা যায় ওর কণ্ঠস্বর, আলী ভাই তুমি একটা জোনাকি। জ্বলো আর নেভো। আলী ভাই-ওসমান চিৎকার করে বলে, চুপ কর শুয়োরের বাচ্চা। তোর জীবনের জোনাকিরা কোনো দিন জ্বলবে না। আজ থেকে তুই আর আমার কাছে নেই। তোর আয়ু এখানেই শেষ। শুনতে পায় সেই একই কণ্ঠস্বর, আমার কী দোষ! আমার চারদিকে তো শুধু লড়াই। ভাতের লড়াই। ঘুমানোর লড়াই। তুমি কী করতে পারবে আমার জন্য? বড় কথা তোমার মুখে মানায় না। ছেলেটি ঠিকই বলেছে। ওসমান নিজেকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাল। ওর সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেটি যখন দুটো চড় গালে নিয়েছে, তখনো তো কিছুই করতে পারেনি। তাহলে ছেলেটিকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে কেন? কী রাইট আছে ওর?

ধীরে ধীরে ও উঠে বসে। গেট ধরে উঠে দাঁড়ায়। বুঝতে পারে, শরীর খানিকটুকু ধাতস্থ হয়েছে। কোথাও মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। এমনকি নিজের ভেতরের স্বরটিও স্তব্ধ হয়ে আছে। কারণ ও নিজেকেই এখন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। চারদিকে তাকিয়ে বিব্রত বোধ করে। বুঝতে পারে, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া খুবই কঠিন। যদি সেই বোঝাপড়া নিজেকে ফাঁকি না দেওয়া থেকে উঠে আসে। মানুষের ওপর অধিকার খাটানোর আগে মানুষকে বুঝতে হবে। তার ভালো-মন্দের সঙ্গে নিজের অবস্থানকে এক করতে হবে। নইলে অধিকার ফলাও করা জুলুমের শামিল হয়। এভাবে নিজেকে কিছুক্ষণ শাসিয়ে ও নিজের ঘরে যায়। তালা খোলে। ঘরে ঢুকে সুইচ টেপার সঙ্গে সঙ্গে এক শ পাওয়ারের বাল্বটি দপ্ করে জ্বলে উঠে নিভে যায়। ও বুঝতে পারে, বাল্বটি ফিউজ হয়ে গেল। অন্ধকার হাতড়ে কাপড় বদলায়। তারপর বিছানায় যায়। অল্পক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে পড়ে। ঘুম আসছে না। শুয়ে থাকতেও ভালো লাগছে না। জানালা খুলে চেয়ার টেনে বসে থাকে। কৈশোর হারিয়ে যাওয়া বালকটি এখন ওর মাথায়। ওর চোখ, ওর নাক, ওর কপাল, গাল, চুল ইত্যাদি সবুজ হয়ে গেছে এবং ও একটি ব্যাঙ হয়ে অল্প পানিতে লাফাচ্ছে। ওর স্বপ্ন নেই। বেঁচে থাকা অর্থহীন। এভাবেই কি ও বড় হবে? নাকি ওকে বাঁচানোর কোনো উপায় বের করা যাবে? ওসমান আলী চেয়ারে মাথা ঠেকায়।

ঘরের ভেতর নেংটি ইঁদুর ছোটাছুটি করছে। কিচকিচ শব্দে বোঝা যায় ওর ছুটে বেড়ানোর আনন্দ। একসময় ঘুম আসে ওর। চেয়ারে বসেই ঝিমোয়। তার পরও ওর বিছানায় যেতে ইচ্ছা করে না। অনেক দিন বিছানার চাদরটি ধোয়া হয়নি। নোংরা হয়ে আছে। রাতের অন্ধকারে নোংরা চাদর বোঝা যায় না। আসলে ও নিজেকে গোছাতে পারছে না। প্রবল অস্থিরতা ওকে কুরে খাচ্ছে। ও বদরুলকে নিয়ে সাদেক ভ্যালি যাবে বলে ঠিক করেছে। জলফুকে নিয়ে যাবে কি? নিতে চাইলেই কি নেওয়া যাবে? ও কি যেতে রাজি হবে? ওসমান আলী ক্লান্তিবোধ করে। মনে হয়, ইঁদুরটা দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কিচকিচ শব্দ নেই অনেকক্ষণ। মশা ভিড় করেছে। দুই হাতে মেরেও শেষ করা যাচ্ছে না। রাতে আর বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না। কাল একটি বাল্ব কিনতে হবে। ও ভাবে, এসব ভাবনার মানে কী? বুঝতে পারে, আসলে ও নিজেকে গোছাতে পারছে না। বড় কষ্ট। এই কষ্টের রাত ওর স্মৃতি। কোনো দিনই মাথা থেকে নামবে না। ও হাই তোলে। সোজা হয়ে বসে। বাথরুমে যাওয়ার জন্য ঘরের বাইরে আসে। মনে হয়, রাতের আর বেশি বাকি নেই। খুবই অস্পষ্টভাবে দিনের আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে। মশিরুল এই প্রথম নিজের তারুণ্যের জন্য ব্যথিত হয়। ভাবে, শুধু লেখাপড়া শেখাই যথেষ্ট নয়, যদি না তার সঙ্গে আরো নানা কাজ যুক্ত করা যায়। এই মুহূর্তে জলফু ওর সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল নাড়াচ্ছে। ওকে সবুজ ব্যাঙ ডাকা বা এক-দুবেলা ভাত খাওয়ানো যথেষ্ট নয়, যদি না ওর সবটুকু দেখভাল করা যায়। মশিরুল বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে করতে মনের ভেতরে নিজের জন্য করুণার পাহাড় গড়ে। বলে, হায় বেঁচে থাকা।

তিন দিন পরে দিনের বেলায় জলফুর খোঁজে কবরস্থানের গেটে গেলে জমিরুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়। ওর জন্য একটা টান লাগছিল সেদিনের পর থেকে। জমিরুদ্দিন ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে জমিরুদ্দিন?

আপনে তো রাইতে আসেন, আইজ দিনের বেলা আসছেন ক্যান?

জলফুকে খুঁজতে। ভাবলাম ওকে দেখে যাই। ও কেমন আছে?

কেমন আর থাকব? ভালাই আছে। কেমন আছে আপনেরে দেখাই। আহেন।

জমিরুদ্দিন কবরস্থানের ভেতরে ঢোকে। নতুন কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ দোয়া পড়ছে। কোথাও একজন নারী কেঁদেকেটে নিজের ভেতরটুকু নিঃশেষ করছে। বড় নিঃশব্দ কান্না। তার পরও ফোঁপানির শব্দ শোনা যায়। ওসমান চারদিকে তাকায়। কোথাও জলফু নেই। জলফু ওকে দেখলে দৌড়ে কাছে আসত। ও ঘাড় ঘুরিয়ে জমিরুদ্দিনকে বলে, জলফু তো এখানে নেই। দেখছি না তো?

আছে। আসেন। জমিরুদ্দিন নির্বিকার কণ্ঠে কথা বলে। যেন এই আবাসস্থলে যারা আছে তারা সবাই ওর চেনা। ও কখনো কাউকে হারিয়ে যেতে দেখেনি। ও জানে এখানে যারা আছে, তারা সবাই ভালো আছে। শান্তিতে আছে। একজীবনে যারা কষ্টভোগ করেছেন তাদের সেই জীবন আর নেই। সব কিছু অবসানের পরে এখন তাদের অপার শান্তি। জমিরুদ্দিন ওর আগে আগে হাঁটছে। শেষ মাথায় গিয়ে নতুন কবরটি দেখিয়ে বলে, এই যে এইহানে আপনার ব্যাঙ। ঘুমাইতাছে। বেওয়ারিশ লাশ হইয়া আসছে।

মানে! ওসমান হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে কবরের ধারে। জমিরুদ্দিনও বসে। হাত বাড়িয়ে কবরের মাটি ছোঁয়। ওসমানের কান্নার বেগ কমে এলে বলে, কেউ অর লাগি কান্দে নাই। আপনেই পত্থম।

ওসমান আলী দুই হাতে চোখ মোছে। তারপর মৃদুস্বরে বলে, ও তো বেওয়ারিশ হবেই। যার কেউ না থাকতে পারে; কিন্তু ওর তো এভাবে মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। কোথায় পাওয়া গেছে ওর লাশ?

কামরাঙ্গীরচরের খানাখন্দে। মানুষজন পুলিশরে খবর দিলে হেরা অরে মর্গে লইয়া গেছে। আধা বেলা ওইখানে পইড়া ছিল। হেরপর আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের গাড়িতে কইরা এখানে আইনলে আমি অরে চিনা ফালাই।

তুমি বলেছিলে আমি ওকে চিনি। ও আমাদের জলফু।

এবারও জমিরুদ্দিন নির্বিকার কণ্ঠে বলে, না কই নাই। কইয়া কী লাভ। মইরাই তো গেছে।

কেউ তাকে চিনত এটা প্রমাণ হতো।

থোন, এইসব ধানাইপানাই। পথের পোলার আবার পরিচয়। তয় অরে আমি যত্ন কইরা ধোয়াইছি। কাফনের কাপড় পরাইছি। আতর মাখাইয়া দিছি। নিজে অরে কবরে নামাইছি।

ওসমান আবার কাঁদতে কাঁদতে জমিরুদ্দিনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, শেষ বেলায় ও কারো যত্ন পেয়েছে। এটুকুই আমার জন্য সান্ত্বনা।

না, আপনের লাগি কনু সান্ত্বনা নাই। পথের পোলারে ভালোবাসতে কে কইছে আপনেরে?

ওসমান আলী সরাসরি তাকিয়ে বলে, তুমি কি আমাকে আরো দুঃখের কথা বলবে?

জমিরুদ্দিন অন্যদিকে তাকায়। ওসমান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, তুমি কি কাউকে সন্দেহ করো? কে ওকে মারতে পারে?

হেইডা আমি ক্যামনে কমু। জানি না।

তোমাদের আশপাশের কেউ? তুমি কি জানো ও কার সঙ্গে থাকত?

জমিরুদ্দিন নির্বিকার কণ্ঠে বলে, না, জানি না।

নাকি বলতে চাও না জমিরুদ্দিন?

আপনে আমারে পুলিশের মতো জেরা করেন ক্যান? আপনে কি পুলিশ? যত্তসব। চলেন বাইরে যাই।

ওর শরীরে কোথাও আঘাত ছিল জমিরুদ্দিন?

জমিরুদ্দিন চুপ করে থাকলে ওসমান আবার বলে, কোথায় কোথায় মেরেছিল জানলে-

আপনে তো অর কেউ না। এত কথা জিগান ক্যান? খবরদার আর কিছু জিগাইবেন না।

শুধু বলো ওর মাথা কি ফাটিয়ে দিয়েছিল?

না, মাথা ঠিক আছিল। চেহারা দেইখা মনে অইছিল ও ঘুমাইয়া আছে।

ওর বুক-পিঠ ঠিক ছিল?

হ, ঠিক ছিল। আপনে আমারে আর কিছু জিগাইবেন না। চলেন, বাইরে যাই।

তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছ। তুমি আমাকে তোমার শেষ কথাটা বলো ভাই জমিরুদ্দিন। জলফুর কেন মরতে হলো?

জমিরুদ্দিন চারদিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলে, শেষ গোসল দিবার সময় আমি দেইখলাম ওর অণ্ডকোষ থেঁতলানো। সব কিছু থেঁতলানো। যেন কেউ মুগুর দিয়া থেঁতলাইছে। না হইলে হাতুড়ি দিয়া। না হইলে ইট দিয়া থেঁতলাইছে।

ওহ মাগো! ওসমান আলী দুহাতে মাথা ঝাঁকায়। জমিরুদ্দিন নির্বিকার কণ্ঠে বলে, আর কিছু জিগাইবেন? জিগান? আইজ বেহানে পানি খান নাই? এত জ্বালা ক্যান?

আমি হোটেলের ওই লোকটাকে পুলিশে দেব।

আপনের পরমান কী? কিছুই পরমান কইরতে পাইরবেন না। পড়ালেখা করতাছেন পড়ালেখা শ্যাষ করেন। যেইটা মরছে হেরে শান্তিতে থাকতে দ্যান। আমি যত দিন বাঁইচা থাকমু তত দিন ওই কবরে দোয়া পড়মু। বেশি দিন তো ওইডা ওর একলার কবর থাকব না। আবার কারো কবর হইব ওই কবরে। যাই। দুনিয়াদারি অন্ধকার লাগে।

ওসমান আলী একা একা আবার ফিরে আসে কবরের কাছে। বসে দোয়া পড়ে। শেষে বলে, তুই জান্নাতবাসী হবি রে সবুজ ব্যাঙ। আল্লাহ তোকে বেহেশতবাসী করুক।

আত্মীয়স্বজনহীন এই ঢাকা শহরে একা একা বাস করতে থাকা ওসমান আলীর মনে হয়, আজ বুঝি ও নিজের কৈশোরও হারাল। কাকে বলবে এসব কথা? কার সঙ্গে ভাগাভাগি করবে? কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করার ইচ্ছা নেই। সবাই নিজ নিজ চিন্তায় ব্যস্ত। ও আবার নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়। মন দিয়ে ক্লাস করে। স্যারদের লেকচার শোনে। ফিরে এসে দোকানে গিয়ে চা খায়। টিউশনি করতে যায়। তার পরে নিজের লেখাপড়া। কোনো ছেলে নোট চাইলে দেয়। পড়াও বুঝিয়ে দেয়। এত কিছুর পরও ওসমান নিজের সময় কাটানো মুখ বুজে সেরে ফেলে। মাঝে মাঝে নিজের সঙ্গে পেরে ওঠে না। যাকে দিগন্তের কাছে যাওয়ার রাস্তা পায়ে হেঁটে পার হতে হয় তার তো শক্তির অবশিষ্ট কমই থাকে। গ্রামে বড় ভাই অপেক্ষা করছে ওর পরীক্ষা পাসের খবরের জন্য। চাকরি পেলে তার ছেলেমেয়ের পড়ালেখা হবে, এই আশায় দিন গুনছে বড় ভাই। ভালো রেজাল্টের পরে ভালো চাকরি-একটি অসাধারণ রেজাল্ট করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি হতে পারে। এই আশায় পাঠের সময় নিজেকে আর কোনো কিছুর কাছে সমর্পণ করে না। মোবাইল বাজলেও ধরে না। মোবাইলে শুধু ওর ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয় রোজ। মাঝে মাঝে মিরপুর থেকে ফোন আসে। যেদিন শাওনের পড়তে ইচ্ছে করে না সেদিন ও যেতে না করে। কিন্তু ওর কথা শুনে না গেলে চলবে না। ওর মা একটা খাতা দিয়েছে। সেই খাতায় সাইন করতে হয়। না গেলে সেদিনের টাকা কাটা হয়। তার পরও ও টিউশনিটা ছাড়ে না। কারণ অন্য জায়গার তুলনায় টাকার অঙ্ক বেশি। ওর প্রয়োজন মেটানোটাই ওর উদ্দেশ্য। গত বছর একটা প্যান্ট-শার্ট পরে ক্লাস করেছে। এখন আরো দুটো প্যান্ট-শার্ট হয়েছে। ওসমান আলী ঘরের দরজা বন্ধ করে দাঁড়ালে মনে হয়, ঘরের কাচের দেয়ালে ফুটে আছে ওর ফেলে আসা জীবনের সবটুকু। দেয়ালে ভিডিও চলছে। শোনা যাচ্ছে বাবার কণ্ঠস্বর, বাবা রে তোর জন্য কিছু করতে পারলাম না। তুই আমারে মাফ করে দিস। ও তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। ভ্যানচালক বাবার সাধ্যই বা কী। মানুষের সীমিত সাধ্যকেও স্যালুট করা উচিত। তাতে মানুষকে হেয় করা হয় না। মানুষকে হেয় না করতে শেখা উচিত সবার। ওসমান দেখতে পায় মাকে। কোমর বাঁকা করে ইটের ঝুড়ি টানছে। পোঁটলায় করে নিয়ে আসা রুটি-গুড় বের করে দিয়ে ওকে বলছে, বাবা এইটুকু খা। সইন্ধ্যাবেলা ভাত রাঁধুম। ও ভুলে যেত, দুপুরে একবার খাবার সময় হয়। সে কথা ভুলে থাকার জন্য মা ওকে কাছে টেনে আদর করে। আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়।

ও সেদিকে তাকিয়ে বলে, মাগো আমি পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাব। স্যার-ম্যাডামরা বলেন, আমার খাতায় লাল দাগ দেওয়া যায় না। মাগো তোমার ইচ্ছা আমি পূরণ করব, তুমি তা দেখে গেলে না। তোমাকে আমি খুঁজব না। আমি জানি তুমি কোথায় আছ। সেখানে আমি গিয়ে বলব, দেখো তোমার ওসমু এসেছে। তোমার হাত আমার মাথার ওপর রাখো মাগো।

খুশির হাসিতে ও নিজেকে গুটিয়ে নিলে কাচের দেয়াল সরে যায়। ছোট ঘরে অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে। পড়ার টেবিলে বসলে দরজায় টুকটুক শব্দ হয়। ও উঠতে চায় না। কে এলো এই সময়? যখন-তখন কেউ না কেউ আসবে-এটা ওর পছন্দ না। ওর একাকিত্বই তো সবার সঙ্গে ওর সঙ্গ। সামনাসামনি বসে বসে গ্যাঁজাতে হবে-এটা কোনোভাবে নিছক বন্ধুত্ব না। ওই গ্যাঁজানোতে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার হয় একেকজনের। এসব ও পছন্দ করে না। ও জানে কেউ কেউ বলে, ভ্যানচালকের পোলা তো, এই জন্য সবার সঙ্গে মিশতে পারে না। মেশার জন্য সোশ্যাল স্ট্যাটাস লাগে।

এসব কথা ও গায়ে মাখে না। ও জানে, যে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারে, তার পেছনেই সার বেঁধে দাঁড়াবে সোশ্যাল স্ট্যাটাসের মানুষ। যেমন জেলের ছেলে আবদুল কালাম ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তাঁর জ্ঞান দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে জয় করেছিলেন সোশ্যাল স্ট্যাটাস। আর এখন এই সময়ে চা-বিক্রেতা বালক ভারতের প্রধানমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ক্ষমতার রাস্তা। দুই পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোশ্যাল স্ট্যাটাসের লোকেরা। হ্যাঁ, সোশ্যাল স্ট্যাটাস।

তখন দরজার শব্দ জোরে বাজে। ও বুঝতে পারে এটা বদরুলের ডাক। ও সব সময় বন্ধুত্বের অধিকার খাটায়। তখন ভেসে আসে বদরুলের কণ্ঠ-ওই নেংটি ইঁদুর দরজা খোল। কী করছিস? বিদ্যার ধানের গোলা কাটছিস? দরজা খোল নেংটি ইঁদুর।

ওসমান আলী দরজা খোলে। বদরুলকে ওর পছন্দ। খোলামেলা, প্রাণখোলা। দরজা খুলেই বলে, চেঁচাচ্ছিস কেন?

দরজায় তালা নেই। তার মানে তুই ঘরে আছিস। তাহলে দরজা খুলতে এত দেরি হবে কেন?

কৈফিয়ত চাইছিস?

চাইতেই পারি। বন্ধুত্বের ভালোবাসা আছে না? আমি কি তোর কাছে বাইরের লোক? অ্যাঁ, কি বলিস? তোর জন্য ডালপুরি এনেছি।

আয়, ভেতরে আয় তুই আমার ঘরের লোক।

সে জন্যই তো তোর নোট পড়ে পরীক্ষায় পাস করি।

বদরুল বিছানার ওপর পা গুটিয়ে বসে ঠোঙা থেকে ডালপুরি বের করে ওসমানকে দেয়। ওসমান ওর মুখোমুখি চেয়ারে বসে। ডালপুরি খায়। পাঁচটা ডালপুরির তিনটাই ও সাবাড় করে। খেতে খেতে বদরুল বলে, সামনের ক্রিসমাসের ছুটিতে সাদেক ভ্যালিতে যাব। তুই বলেছিলি। ভাবলাম, আমারও ওই দিকে যাওয়া হয়নি। এবার যাব। কী বলিস?

ঠিক আছে যাব। শাওনের বাবা বলেছে, এই ছুটিতে ওরা সিঙ্গাপুরে বেড়াতে যাবে। আমি প্রায় পনেরো দিনের ছুটি পাব। এবারই যাওয়ার সময়।

গুড। তাহলে ব্যবস্থা নেই। কিভাবে যাব, এই খোঁজখবর আমি করব। তোর টিকিটের টাকা আমি দেব।

কেন, তুই দিবি ক্যান? আমি দেব আমারটা।

তুই আমাকে নোট দিস। এইটুকু খাতির তো আমি তোকে করবই। বাপের ভাঁড়ার থেকে পড়ালেখার খরচ পাই। আমার চিন্তা কী।

বদরুলের এই কথায় আনমনা হয়ে যায় ওসমান। কেউ যদি কারো বাবার কথা বলে, তখন উদাস হয়ে যায় ও। বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা তৈরি হওয়ার আগেই বাবা ওকে ছেড়ে চলে গেছে। বাবার গল্প ঠিকমতো জমেনি ওর জীবনে।

কী রে, চুপ মেরে গেলি যে?

সাদেক ভ্যালি তো অনেক দূর। যাব কি না ভাবছি।

ভাবাভাবির কিছু নেই। যেতে হবে। আমি বাসের টিকিট কাটতে গেলাম। তুই কি ঘরে থাকবি?

হ্যাঁ। ও নির্বিকার জবাব দেয়।

থাক। তোর সঙ্গী-সাথি তো বই। তোর একটা ল্যাপটপ থাকলে আরো মজা হতো।

ইন্টারনেট? না বাপু, অত মজার মধ্যে আমি নেই। যা, ভাগ।

বেরিয়ে যায় বদরুল। ভাবে, জলফুর জীবনে বই ছিল না, ল্যাপটপও না। জীবনের শূন্য জায়গাটা আর পূরণই হলো না। ছোটবেলায় একবার একটি রাস্তার কুকুরকে ও পথের ধারে কাতরাতে দেখেছিল। কুকুরটির জন্য এক টুকরো মাংস খুঁজতে বাজারে গিয়েছিল। পায়নি। বাড়ি বাড়ি গিয়েছিল। পায়নি। ফিরে এসে দেখেছিল, কুকুরটি মরে গেছে। তখনো মনে হয়েছিল, একটি প্রাণীর জীবনের শূন্য জায়গা পূরণ করা হলো না। ও টেবিলের ওপর রাখা একটি বই বের করে। পাঠ্যবই না। সাধারণ জ্ঞানের বই। বিশ্বের বড় মানুষের জীবনী আছে সেখানে। যেখানে একটি বাণী এমন : ‘রিয়াল লিভিং ইজ লিভিং ফর আদারস।’ জলফুর মৃত্যু যখন ওর সামনে আসে, তখন মনে হয় বেঁচে থাকা অর্থহীন। কিছুই তো করা হলো না এই জীবনে। না মানুষের জন্য, না প্রাণীকুলের জন্য। বেঁচে থাকার পরিসর তো কম হয়নি। আর কবে ও রিয়াল লিভিংয়ের মর্ম বুঝবে?

ওসমান আলী পড়ার টেবিলের সামনের খোলা জানালা দিয়ে তাকালে নিজেকে এক ধূসর পৃথিবীর বাসিন্দা ভাবে। তরুণ জীবনের এই পর্যায়ে বড় অর্জনের কোনো চিহ্ন নেই। আর কত দিনে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছাবে, যখন বলতে পারবে কিছু তো করতে পেরেছি-আমার এতটুকু সাধ্যই ছিল।

ও আর বদরুল এখন সাজেক ভ্যালির রাস্তায়। গতকাল খাগড়াছড়িতে এসেছে। রাতে একটি হোটেলে ছিল। পরদিন চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে বদরুল। ও এমনই ছেলে। যখন যা মাথায় ঢোকে তখন তা করেই ছাড়ে। অনেকে নিষেধ করেছিল যেতে। বলেছিল, দুর্গম এলাকা। পাহাড়ি-বাঙালি মারামারি লাগলে জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারবে না। বদরুল হাসতে হাসতে বলেছিল, পাহাড়ের একটি ঝরনার ধারে মারা পড়লে মন্দ হবে না। ঝরনার স্বচ্ছ পানিতে আমার শেষ গোসল হয়ে যাবে।

মাজেদ খোঁচা দিয়ে বলেছিল, গোসল হবে, কিন্তু কবর হবে না। কয় দিন পড়ে থেকে কাদায় মিশে যাবি। নইলে বন্য প্রাণী খাবে তোকে?

আমাকে খেয়ে প্রাণীকুলের পেট ভরলে মন্দ কী? ভাবতে পারব যে কারো খিদে মিটিয়েছি।

বানর একটা।

মাজেদ ক্রুদ্ধ স্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল।

হা-হা হো-হো করে হেসেছিল আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরা। হেসেছিল ওসমান আলী নিজেও। বলেছিল, ফিরতে যদি না পারি তাহলে অন্যের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়া হবে। আমরা যারা ফার্স্ট ক্লাসের লাইনে আছি, সেখানে আর একজন ঢুকতে পারবে।

ওরা বলেছিল, দুটোরই মাথা গরম হয়ে গেছে। ওদের সঙ্গে কথা বলা বৃথা। চল, সরে পড়ি। রমনা পার্কে গিয়ে ঝালমুড়ি খেয়ে আসি।

ওরা চলে গেলে দুজনেরই মনে হয়েছিল, ওরা অ্যাডভেঞ্চার বোঝে না।

এমন এই পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য অভিভূত করে দুজনকে। বাঘাইহাট আর্মি চেকপোস্ট পার হতে হলো। প্রথমে তারা যেতে দিতে চায়নি। বলেছিল, এই দুর্গম এলাকায় হারিয়ে গেলে আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হবে।

বদরুলের একটাই উত্তর-আমাদের খুঁজবেন না। ফিরতে না পারলে বুঝবেন, গভীর অরণ্যের কোথাও ঢুকে ছিলাম। বুনো হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়েছি। আমাদের জীবনের দায় আমরা অন্যের ওপর চাপাব না।

ব্রেভো। ওরা হাসতে হাসতে বদরুলের পিঠ চাপড়ে আমাদের ছেড়ে দিয়েছিল। ওসমান বলেছিল, আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ভালোয় ভালোয় যেন ফিরে আসতে পারি।

আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ওর নাম ওসমান আলী। খুব মেধাবী ছেলে। ফার্স্ট ক্লাস পাবে। বিভাগের টিচার হবে।

দাঁড়িয়ে থাকা চারজন সেনা ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলেছিল, কংগ্রাচুলেশনস।

আপনাদের অভিনন্দন নিচ্ছি। তবে এখনো পথ বাকি আছে। যেতে হবে শেষ মাথায়। আমি জানি না কতটা যেতে পারব।

ওসমানের বিষণ্ন কণ্ঠস্বর পাহাড়-বেষ্টিত এলাকায় গুমগুম করে। হয়তো কোথাও গিয়ে আছড়ে পড়ে কিংবা ঝরনার জলে ভেসে যায়। যে জ্বলে ব্যাঙ আছে, পোকা আছে, পতনের শব্দ আছে।

বিভিন্ন চেকপোস্ট পার হয়ে চাঁদের গাড়ি চলতে শুরু করে। কখনো ওপরের দিকে ওঠে, কখনো নিচের দিকে যায়। বদরুল বলে, ছোটবেলায় মুখস্থ করেছিলাম যাওয়া-আসার পথের ধারে। এখানে বলতে হবে ওঠানামার পথের ধারে।

ওর হাসির সঙ্গে নিজের হাসি মেলাতে পারে না ওসমান। অপলক তাকিয়ে থাকে। এত অপরূপ প্রকৃতি এ দেশেরই সম্পদ, এখানে না এলে জানা হতো না। অনেক দূরে দূরে দু-একটা বাড়ি দেখা যায়। বাড়ি ঠিক নয়, কুঁড়েঘরের মতো বসবাস উপযোগী। পরিচ্ছন্ন। সুন্দর। তবে লোক চলাচল কম। ওরা জানে, সাজেক ভ্যালিতে লুসাইরা থাকে। বড় দা নিয়ে জঙ্গলে মরা ডাল কাটতে দেখা যাচ্ছে দু-চারজনকে। গাড়ি যখন পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠে, তখন মনে হয় হাত বাড়ালেই আকাশ ছোঁয়া যাবে। ওরা এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চাঁদের গাড়ির ছাদে উঠে বসে। গাড়ির ভেতরে বসে যে দৃশ্যটি দেখা যাচ্ছিল ছোট আয়তনে, ছাদে ওঠার ফলে তার আয়তন বিশাল হয়ে যায়। দুজনের চোখের পাতা পড়ে না যেন।

চাঁদের গাড়ি যেখানে এসে থামে, সে জায়গার নাম লুইরুই। খাগড়াছড়ি ছাড়ার পরে ওরা পেরিয়ে এসেছে দীঘিনালা, বাঘাইহাট, মাসালাং বাজার। প্রায় দুই হাজার ফুট পাহাড়ে উঁচুতে লুইরুইপাড়া। দূরে দূরে আদিবাসীদের বসতি। ছবির মতো উপত্যকা। গাড়ি থেকে নামলে দেখা হলো বদরুলের পরিচিত অহনের সঙ্গে। এমন পরিচিত কাউকে পাওয়া যাবে সে কথা ও আগে ওসমানকে বলেনি।

ওসমান অবাক হয়ে বলে, তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে বলিনি। আমরা ওর বাড়িতে দুই রাত থাকব। ওর বাবা-মা-দাদু কংলাক গেছে। বাড়িতে ও একা।

ভালোই হয়েছে। নিজেরা যা পারি ব্যবস্থা করে খাব। কাউকে ডিস্টার্ব করা হবে না।

আমি আপনাদের জন্য চিঁড়া ভিজিয়ে রেখেছি। আর পাকা পেঁপে আছে।

আমাদের জন্য তোমার বেশি ভাবতে হবে না অহন। আমরা বেশ কিছু শুকনো খাবার নিয়ে এসেছি।

আমাদের এখানে সবচেয়ে বেশি সমস্যা পানি।

বাড়িগুলো এত দূরে দূরে কেন?

পানির জন্য। যেখানে ঝিরি আছে, তার চারপাশে মানুষ ঘর বানায়। লুইরুইপাড়া থেকে সারা দিন হেঁটে যাওয়া যায় কংলাকে। ওই যে দূরের দিকে তাকান, ওই দিকে আছে ভারতের মিজোরাম। ওখানে কয়েকটি ছোট-বড় পাহাড়ের মধ্যে কংলাক পাহাড় সবচেয়ে উঁচু। তাকিয়ে দেখে, ছোট একটি দল যাচ্ছে। ওরা ওখানে যাবে। আমার মা-বাবা, ভাই-বোনরা ওখানে গেছে। আপনারা চলে গেলে আমিও ওখানে যাব। কয়েক দিন থেকে আসব। এখন আমি আপনাদের লুইরুই পাহাড় হেডম্যানের কাছে নিয়ে যাব। আমি আপনাদের এখানে থাকার পারমিশন নিয়েছি। তার পরও আপনাদের হেডম্যানের সঙ্গে দেখা করতে হবে। এটাই এখানকার নিয়ম।

একটানা কথা বলে থামে অহন। বদরুল আর ওসমান গাড়ি থেকে ব্যাগটা নামিয়ে নেয়। তিনজনে হেডম্যানের কাছে আসে। তিনি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করেন। বলেন, আমাদের ভ্যালিতে দুদিন থাকা আপনাদের জন্য সুন্দর হোক। আপনারা সুস্থ থাকুন। আমাদের বন-ঝরনা-পানির ফোয়ারা-পশুপাখি আপনাদের জন্য আনন্দময় হোক। অহন, ওদের আতিথ্য দেওয়ার জন্য নিয়ে যাও। বদরুল বলে, থ্যাংকু। আপনিও ভালো থাকুন।

সবাই মিলে অহনের বাড়িতে যায়। ছিমছাম সুন্দর বাড়ি। বারান্দায় বসলে পুরো এলাকার মায়াময় দৃশ্য অভিভূত করে রাখে। ওরা অহনের জন্য আনা মিষ্টি ও শুকনো খাবার ব্যাগ খুলে বের করে। অহন বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, এত কিছু!

তোমার পরিবারের জন্যও এনেছি। শুকনো খাবারগুলো রেখে দিলে নষ্ট হবে না। আমরা এখন কী করব অহন?

আগে চিঁড়া-পেঁপে খাবেন। তারপর আমরা মিজোরামের দিকের পাহাড়ি এলাকায় যাব। এলাকাটা বেশ নিচু। পাহাড় বেয়ে নামতে আপনাদের ভালো লাগবে।

ওই পথে অনেক রকম গাছ আছে?

গাছই তো এখানকার প্রাণ। আপনারা দেখে শেষ করতে পারবেন না।

কত রকম পাখি আছে?

অনেক রকম। ময়নার ঝাঁক দেখতে আপনাদের ভালো লাগবে। কখনো এক-দুই শ ময়না একসঙ্গে থাকে। মনে হবে, ওগুলো ময়না না। গাছের পাতা।

সত্যি! ওসমান উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে। আমার জীবন ধন্য। বদরুল তোকে-

থাক থাক, আর ন্যাকামি করিস না।

অহন চিঁড়া আর পেঁপে নিয়ে আসে। তিনজনে বসে খায়। বেশ জমিয়ে খায়। ঢাকা থেকে আনা মিষ্টি খেয়ে অহন খুশিতে বাগবাগ। আকাশে উড়ে যায় টিয়া পাখির ঝাঁক। ওই দিকে তাকিয়ে ওসমান অহনকে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের ঝরনায় ব্যাঙ ডাকে অহন?

ব্যাঙ? অহন পুরো মিষ্টি মুখে ঢোকায়।

হ্যাঁ, সবুজ ব্যাঙ? তুমি কখনো দেখেছ?

ও প্রবলভাবে না-সূচক মাথা নাড়ে। তারপর মিষ্টি খেয়ে বলে, ঝরনার ধারে ব্যাঙ আছে। কিন্তু আমি কখনো সবুজ ব্যাঙ খুঁজে দেখিনি। আপনি খুঁজবেন?

হ্যাঁ, আমি খুঁজব। একটা সবুজ ব্যাঙ পেলে ছোট একটি মাটির ভাঁড়ে পানি দিয়ে ব্যাঙটিকে আমি ঢাকায় নিয়ে যাব। তারপর আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে পুকুরে ছেড়ে দেব।

বদরুল চোখ বাঁকা করে তাকিয়ে বলে, তাতে কী হবে? কোন উদ্ধারের জন্য ব্যাঙ নিয়ে যাবি এখান থেকে?

আমার শৈশব খুঁজে দেখার জন্য।

ব্যাঙের মধ্যে শৈশব খুঁজবি?

ওই রকমই। যাদের শৈশব হারায়, তাদের খোঁজার শেষ থাকে না।

এই এক প্যাঁচাল আর কতকাল পাড়বি?

ওসমান আলী বদরুলের কাছ থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আকাশের দিকে নিয়ে যায়। এতটা বয়স পর্যন্ত এভাবে আকাশ দেখা হয়নি ওর। পাহাড়ের কত উঁচুতে ওরা আছে, তার নিচ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তুলোর মতো মেঘ। মিজোরাম আর সাজেকের মাঝখানে জমে আছে মেঘ। পাহাড়ের মাথা থেকে অনেক নিচুতে। এসব অসাধারণ দৃশ্য একজীবনে দেখে শেষ করা যায় না। ছোটবেলায় যখন মায়ের সঙ্গে রাস্তার ধারে কাজ করেছে. তখন মনে হয়নি এমন দৃশ্য দেখার সুযোগ হবে এবং বেঁচে থাকার ধারণায় যোগ হবে রঙিন কিছু।

খাবারের বাটিবুটি ঘরের মধ্যে গুছিয়ে রেখে অহন বলে, চলেন, আমরা যাই।

কোন দিকে যাব রে?

মিজোরামের দিকে নিচু পাহাড়ি এলাকার দিকে যাব। ওখানে ঝিরি আছে। ঝিরিতে স্নান করতে পারবেন।

তাহলে তো হাপর নিয়ে যেতে হবে। স্নান তো করবই। ঝিরিতে না ভিজলে এলাম কেন?

অহন হাসতে হাসতে বলে, গায়ের কাপড় গায়ে শুকাবে। এটা আরো মজা হবে।

ঠাণ্ডা লেগে জ্বর আসবে না তো?

এমন রোদের মধ্যে থাকলে কাপড় তো তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে। ঠাণ্ডা লাগবে না।

ভালো বলেছ। চলো যাই।

বদরুল লাফ দিয়ে বারান্দা থেকে নামে। ওসমান খানিকটা হেঁটে সামনে এগিয়ে যায়। মনে করে, এমন সৌন্দর্য দেখার পরে ওর মৃত্যু হলে কোনো দুঃখ থাকবে না। ভাববে, মৃত্যু ঠিক সময়ে হয়েছে। পরক্ষণে ওর মনে হয়, মৃত্যু কি এমনই হবে যে ও কোনো কিছু ভাবার সুযোগ পাবে। ও চায় ঘুমের মধ্যে ওর নিঃশব্দ মৃত্যু হবে। যেমন ওর মায়ের হয়েছিল। ভোরবেলা মাকে ডাকতে গিয়ে দেখেছিল, মা সাড়া দিচ্ছে না। শরীরে হাত দিয়ে ঠেলে তুলতে গিয়ে দেখেছিল, মায়ের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। চিৎকার করে বড় ভাইকে ডেকেছিল ও। সবুর আলী ওকে কাছে টেনে বলেছিল, আমাগো মা মইরা গেছে। সেদিন থেকে ও মৃত্যু নিয়ে ভাবতে শিখেছিল। এখনো ভাবে। ‘হোটেল রুয়ান্ডা’ সিনেমা দেখে ওর মৃত্যু নিয়ে আতঙ্ক হয়েছিল। মৃত্যু এত ভয়াবহ হতে পারে, তা ওর অভিজ্ঞতায় ছিল না। ওই ছবি দেখে ও গণহত্যা বুঝেছে। সেই সঙ্গে মৃত্যুর ব্যাখ্যা করতে শিখেছে।

অহন এসে ওর পাশে দাঁড়ায়।

আলী ভাই, চলেন।

অহন, আমি ভাবছি পড়ালেখা শেষ হলে আমি সাজেক ভ্যালির মানুষের জীবন নিয়ে একটা সিনেমা বানাব। এত সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। আমি অনেক দিন বাঁচতে চাই, অহন।

আপনি এখানে সিনেমা করতে পারবেন না।

পারব না? কেন?

আর্মি ক্যাম্প থেকে পারমিশন পাবেন না।

ও, তাইতো। এখানে ঢুকতেও তো পারমিশন লাগে।

বিষণ্ন হয়ে যায় ওসমান আলী। কিন্তু মৃত্যু ওর মাথায় স্থির হয়ে থাকে। মৃত্যু-ভাবনা ও মাথা থেকে সরাতে পারে না। এ অবস্থায় ওরা তিনজন পাহাড় বেয়ে নামতেই থাকে। চারদিকে ঝোপজঙ্গল, গাছপালা। মাঝখান দিয়ে পায়ে চলার সরু পথ। ওসমানের মনে হয়, নামছে তো নামছেই। পাহাড়ের ঢালু ফুরায় না। কত ছোট ছোট খুদে প্রাণী চারদিকে ছোটাছুটি করছে! প্রজাপতির রঙে চমক লাগে। মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে।

বদরুল হাসতে হাসতে বলে, বেশ মজা পাচ্ছিস না রে, ওসমান?

পাচ্ছি তো। একটা প্রজাপতি ধরতে পারলে আরো ভালো লাগত।

প্রেমেই তো পড়তে পারলি না। কার খোঁপায় আর প্রজাপতি বসাবি?

ইয়ার্কি করিস না। আমি একটি সিনেমার কথা ভাবছি।

সিনেমা? এই বুনো পাহাড়ি এলাকাটাই তো একটি সিনেমা। হা হা করে হাসে বদরুল। ওর হাসি প্রতিধ্বনিত হয় পাহাড়ি এলাকায়। থমকে দাঁড়ায় ওসমান আলী। এখানে কোথাও কি জহির রায়হান আছেন? একাত্তর সালের একত্রিশে ডিসেম্বর বিহারিরা তঁাঁকে ধরে এনেছিল এখানে? কোন পাহাড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁকে? তখন ওর কানে আসে ঝরনার শব্দ। পাহাড় থেকে জলপ্রপাত বইছে। ও বদরুলের দিকে তাকিয়ে বলে, শুনতে পাচ্ছিস?

পাচ্ছি। চল দৌড়াই।

তিনজনে দৌড়াতে শুরু করে। বেশিদূর যেতে হয় না।

ঝরনাটি কাছাকাছিই ছিল। ওপর থেকে কলকল শব্দে নিজের কথা জানান দিচ্ছে। ওরা দূর থেকেই দেখতে পায়, একজন বুড়ো গোসল করছে। মনের আনন্দে পানির ধারায় ছেড়ে দিয়েছে নিজেকে। শুধু একটু গোসল করার জন্য এত পথ পাড়ি দিয়ে আসা! ওসমান বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকে। একমাথা সাদা চুল। হাড়গোড় বেরিয়ে আসা শরীর। বোঝা যায়, পানির সঙ্গে তার মনের আনন্দ অনিঃশেষ। ওদের দেখে ঝিরি ছেড়ে বেরিয়ে আসে। শরীর থেকে পানি গড়ায়।

দাদু, আপনি কখন এসেছেন?

অনেকক্ষণ। এখানে না আসতে পারলে শান্তি পাই না রে। পানি তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

ওরা আমার বন্ধু, দাদু। ঢাকা থেকে এসেছে।

বেশ বেশ। তা দাদুরা, তোমরা তো জলে ভিজবে?

ভিজব। আপনি কী করবেন?

আমি ওই পাহাড়খণ্ডের ওপর বসে থাকব। তোমাদের ভেজা শেষ হলে একসঙ্গে লুইরুইপাড়ায় ফিরব।

আপনি বসেন, দাদু। অহন তাকে হাত ধরে এগিয়ে দেয়। ফিরে এসে আস্তে করে ওদের বলে, দাদুকে একা একা এখানে আসতে নিষেধ করি, দাদু শোনে না। কোন দিন দেখত পাব পাহাড়ের ঢালুতে মরে পড়ে আছে। শেয়াল-কুকুরে টানাটানি করছে মরদেহ।

আহ্! অহন, চুপ কর। এভাবে বলিস না।

তিনজনে ঝিরির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। বদরুল বলে, আমি এই প্রথম ঝরনার পানিতে ভিজছি।

ভেজা দূরের কথা, আমি তো কখনো ঝরনাই দেখিনি। আমি যেখানে বড় হয়েছি, সেটা তো একটা সমতল ভূমি। আমি পাহাড় দেখিনি। অরণ্যও দেখিনি।

আমি সব দেখেছি। পাহাড়, অরণ্য, সমতল ভূমি, নদ-নদী-কিছু দেখা বাকি নেই।

তুমি আমাদের চেয়ে ভাগ্যবান। তোমার ভাগ্যের জন্য আমার ঈর্ষা হচ্ছে।

ওসমানের কথায় অহন বলে, ভাগ্যের কথা বলবে না তোমরা। তোমরাই ভাগ্যবান। তোমাদের চারদিকে তো এত আর্মি ক্যাম্প নেই।

বদরুল আর ওসমান দুজনেই চুপ করে থাকে। কথাটা তো সত্যি। প্রসঙ্গ ওঠালে নানা কথা উঠবে। এর অনেক বিষয় ওদের নিজেদের জানার মধ্যে নেই। অনেক বিষয় ওদের ন্যায্য দাবি। তখন ওরা সবাই দেখতে পায়, বুড়ো মানুষটি মাথায় গামছা পেঁচিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে।

অহন বলে, আমি দেখছি দাদু আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বসে থাকবে।

বয়সে বড় হলে কী হবে, শক্তিতে আমাদের চেয়ে যুবক।

আসলে তা নয়। এ পথে হঁাঁটতে হাঁটতে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমরা বারো শ ফুট নেমে ভাবছি কত না হাঁটলাম। তারা মনে করে, এই তো নামলাম আর উঠলাম। নাকি রে, অহন?

হ্যাঁ, অনেকটা এ রকমই। গতকালই আমার বাড়ির সবাই কংলাক গেল। লুইরুই থেকে কংলাক সারা দিন হাঁটার পথ। আমার দাদুও গেছে। আমরা তো এভাবেই চলাফেরা করি। এ ছাড়া আমাদের উপায় নেই।

পাহাড় কেটে রাস্তা তো হতে পারে।

পারে। পারবে না কেন? সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। আগে তো সাজেক পর্যন্ত আসার কোনো রাস্তাই ছিল না। মাসালং থেকে হেঁটে সাজেক আসতে হতো। এখন তো লুইরুই পর্যন্ত আর্মির জিপ চলাচল করে। চাঁদের গাড়িও আসে। এখানে পর্যটনকেন্দ্র হওয়ার তোড়জোড় চলছে।

কাজ শুরু হয়েছে দেখছি। আস্তে আস্তে অনেক কিছু হবে রে, অহন।

কে জানে কত কিছু হবে। কতকালেই বা হবে।

ওসমান বুঝতে পারে, নানা কিছু নিয়ে অহনের ক্ষোভ আছে। প্রকাশটা তীব্র নয়, হয়তো বন্ধুত্বের খাতিরে বলছে না। তবে যেটুকু বলছে, তা শ্লেষের সঙ্গেই বলছে।

তিনজনে ঝিরি ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এবার ফেরার পালা। ভেজা কাপড় গায়ে শুকাবে বলে কিছুক্ষণ পাহাড়খণ্ডের ওপর বসে থাকে। বেশ আরাম লাগছে। শরীর ঝরঝরে লাগছে। ঢাকা থেকে এ পর্যন্ত আসার পথের ক্লান্তি মুহূর্তে উবে গেছে।

এই স্বর্গ ছেড়ে যাব না। মনে হয় শুয়ে থাকি।

ওসমানের কথার রেশ ধরে বদরুল বলে, পাথরেরখণ্ডগুলো জোড়া লাগিয়ে চৌকির মতো করতে পারলে মন্দ হতো না।

কেন, ঘাসের বিছানা খারাপ কী?

খুদে পোকারা কানের ভেতর ঢুকে প্রেম করতে চাইবে, বুঝলি রে গাধা।

অহন হেসে গড়িয়ে পড়ে। বলে, তোমাদের এত ভালোলাগা দেখে ভাবছি তোমাদের অনেক দিন রেখে দিই।

তা রাখতে পারো। খেতে আর ঘুমুতে দিলে আমরা রাজি।

না, এত বোঝা টানতে পারব না। পায়ে অত জোর নেই।

তাহলে বলো, সাধ আছে সাধ্য নাই।

তিন তরুণের হা হা হাসিতে তিনজনই মনে করে, এই সময় আমাদের। ওরা সময়কে ঘাড়ে নিয়ে পাহাড় বাইবে, সমতলে হাঁটবে। রুখবে কে?

তিনজনের হাসি থেমে যায়। গায়ের জামা আলগা করে বদরুল বলে, প্রায় শুকিয়ে গেছে। এখন আমরা ঘাসে গড়াতে পারি।

তা পারো। এই ঝরনাটা আমাদের স্নানের জায়গা। সবাই আসে স্নান করতে। যার যখন খুশি। আবার একসঙ্গেও অনেকে আসে।

তাহলে এটাকে বলা যায় ঝিরি-আনন্দ।

হ্যাঁ, তা বলা যায়। কাপড় শুকানোর সময়টায় বাচ্চারা জামাগুলো ওড়াতে থাকে। রংবেরঙের জামাগুলো যখন ওড়ে, খুব সুন্দর দেখায়। বড়রা বসে তালি দেয়।

বদরুল হাসতে হাসতে বলে, আমাদের সামনে জামার বেলুন নাই। তবু আমরা তো তালি বাজাতে পারি।

তিনজনে মিলে তালি বাজায়। যার যার মতো গান গায়। একসময় ওসমান কান খাড়া করে বলে, কোথাও থেকে গুলির শব্দ শুনতে পেলাম?

শুনতেই পারো, অহন তীব্র কণ্ঠে বলে, তোমাদের বুকেও ঢুকতে পারে গুলি। কে জানে? তখন বেশ মজা হবে।

মজা কেন? বদরুলের কণ্ঠে বিদ্রূপ।

অহন নির্বিকার কণ্ঠে বলে, তখন আমরা তোমাদের লাশ নিয়ে মিছিল করব।

দুজনে চুপ করে থাকে। ওদের পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে অহনও আর কথা বাড়ায় না। বদরুল খানিকটা হেঁটে গিয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। প্রায় শুকনো জামা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে। একটু পরে জামা সরিয়ে বলে, আমাকে কেউ ডাকবে না। আমি যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ শুয়ে থাকব।

ঘুমিয়ে পড়লে?

তা-ও ডাকবি না। যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ ঘুমুব।

সন্ধ্যা হলে?

হলে হবে।

দেখা যাক কী হয়।

ওসমান অহনের হাত ধরে টেনে নিয়ে পাথরের ওপর বসে। মৃদ্যু স্বরে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি গুলিবিদ্ধ কাউকে দেখেছ, অহন?

দেখেছি।

তোমার নিজের কেউ?

সবাই তো আমার আপনজন। কাউকে বাদ দিয়ে কেউ না। আমাদের একজন কমলে মনে হয় দশজন কমে গেছে।

ওসমান অহনের কথায় স্তব্ধ হয়ে যায়। ও কাউকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেনি। ও জলফুর মৃত্যু দেখেছে। ওর বাবা-মায়ের সরল মৃত্যুর মতো মৃত্যু নয়। ও এমন মৃত্যু দেখতে চায় না। অহন যে মৃত্যু দেখেছে, সে মৃত্যু ও দেখতে চায় না। ওসমান নিজের মৃত্যু-ভাবনায় অন্যমনস্ক হয়ে যায়। দেখতে পায়, গাছের ওপর থেকে একটি বানর লাফ দিয়ে নেমে ওদের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। ওসমান হাততালি দেয়। বানরটি নড়ে না। অহন বলে, ও তোমাকে দেখছে।

দেখবেই। অপরিচিত মুখ তো। দেখুক। হাতে একটা কলা থাকলে ওকে দিতে পারতাম।

ও বনের কলা খেতে পারবে। ওর অসুবিধে নেই।

তাহলে ও কি পানি খেতে এসেছে?

হবে হয়তো। আমাদের দেখে আর এগোচ্ছে না।

তাহলে চলো, আমরা চলে যাই।

তা-ই চলো। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। বদরুলকে ডাকি।

অহন বদরুলের কাছে বসে গায়ে হাত দিয়ে ডাক দেয়।

কী রে, ঘুমিয়েছিস?

তোদের সব কথা শুনতে পাচ্ছি। পাখির ডাক শুনলে ঘুমাতে পারতাম। কিন্তু পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি না। সে জন্য মন খারাপ। এত ঘন বনে পাখি এত কম কেন?

ওরা বন্দুকের গুলি ভয় পায়।

অহন মাঝে মাঝে এমন নির্বিকার উত্তর দেয়।

বদরুল সঙ্গে সঙ্গে বলে, শহরের পাখি বন্দুকের গুলি ভয় পায় না। আমাদের হলের কাছের গাছে কোকিল ডাকে। টিয়া দেখা যায়। দোয়েল শালিক চড়ুই তো সব সময় দেখতে পাই।

ওরা বন্দুকের তফাত বোঝে।

বদরুল উঠে দাঁড়ায়। অহনের দিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে, বুঝেছি। চল যাই।

ওসমান বানরটির প্রায় কাছাকাছি গেলে বানরটি লাফ দিয়ে গাছে উঠে যায়।

ও হাততালি দিয়ে বলে, কী রে, ভয় পেলি কেন? আমার হাতে তো বন্দুক নেই। আমি তোকে মারতেও চাইনি, আয় নেমে আয়।

কী হবে ওকে ডেকে। ও আসবে না।

ঠিক আছে, না আসুক। আমরা তাহলে প্রজাপতি আর ফড়িং দেখতে দেখতে পাহাড় বাইতে শুরু করি।

খানিকটুকু এগোলে অনেক দূরে সেই বুড়োকে দেখা যায়। গায়ের জামাটা মাথায় বাঁধা। বেশ দ্রুত হেঁটেই উঠে যাচ্ছে।

ওসমান অবাক হয়ে বলে, বুড়োর গায়ে এখনো অনেক শক্তি। বাব্বা, কত দূর চলে গেছে!

বদরুল বলে, আমার মনে হয় এটা অভ্যাস। ছোটবেলা থেকেই এসব চেনা পথে ওঠানামা শুরু হয়েছে। আমাদের মতো তারা তো এই প্রকৃতির ভূমিতে স্ট্রেঞ্জার নয়।

হা হা করে হাসে অহন। বলে, ঠিক বলেছ। আমরা স্ট্রেঞ্জার নই। ফুল-ঘাস-লতাপাতা-পশুপাখি-সব আমাদের বন্ধু।

হাসে অন্যরা। হাসিতে মেতে উঠে ওসমান বলে, এমন বন্ধু পাওয়া কঠিন। আমাদের চারপাশের পাখিরা বন্ধু নয়।

অহন কথা লুফে নেয়। নির্দ্বিধায় বলে, ওরা তোমাদের হাত থেকে বাঁচার তাড়নায় অস্থির থাকে। বন্ধু হবে কী করে?

তোমার সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে। আমরা বেশ আনন্দে সময় কাটাচ্ছি। নিজের দেশের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আমাদের পুণ্যলাভ হয়েছে।

ওসমানের পুণ্যলাভের কথা শুনে উৎফুল্ল হয়ে বদরুল বলে, যেখানেই যাব সেখানেই এই পুণ্যের কথা বলব। তোমাকে আমরা ভুলব না, বন্ধু।

আকস্মিকভাবে অহনকে বুকে জড়িয়ে ধরলে ও হকচকিয়ে যায়। বলে, ছাড়ো ছাড়ো। পাহাড়ের ঢালে এমন জড়াজড়ি করলে গড়িয়ে পড়তে হবে।

মন্দ না, এটাও ভিন্ন মজা। গড়িয়ে গড়িয়ে ঝিরির কাছে পৌঁছে যাওয়া।

অহন বলে, চৈত্র মাসে এই সব ঝিরির কাছে বসে আমরা প্রার্থনা করি। কারণ শুষ্ক মৌসুম শুরু হলে পানির জন্য আমাদের হাহাকার শুরু হয়। তখন ঝরনাকে বলি, তুমি আমাদের মায়াবী ঝিরি। তোমার ঝরনা জলে ভরিয়ে দাও। তখন পাড়ার মানুষকে এক কলসি পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। রোদে-গরমে জল সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

হঠাৎ করে পাহাড়ি ময়নার ঝাঁক উড়ে আসে মাথার ওপরে। লাফিয়ে ওঠে বদরুল, পাখি! পাখি! উহ্, কী সুন্দর! তাহলে ওরা আমাদের বন্ধু, ভেবেছ অহন?

তোমরা পাখি নেই বলেছিলে, সে জন্য ওরা উড়ে এসে বলছে, দেখো আমাদের। আর একসঙ্গে এত শত পাখি তোমরা দেখতে পাও না। পাহাড়ি ময়না তো নয়ই।

ঠিক বলেছ। দুজনে মাথা পেছনে হেলিয়ে তাকিয়ে থাকে। বনের ওপর দিয়ে দূর আকাশের কত দূর চলে যায়, তা বোঝা ওদের সাধ্যে নেই। ওরা মাথা সোজা করলে অহন বলে, ওই দেখো তোমাদের আরেক বন্ধু তাকিয়ে আছে।

কাঠবিড়ালি। উহ্, কী সুন্দর! ওরা ঠিক আমাদের ভয় পাবে না। আমরা দূর থেকেই ওদের দেখব।

একে একে আরো চার-পাঁচটা কাঠবিড়ালি এক জায়গায় জড়ো হয়। ছোটাছুটি করে। গাছে ওঠে। আবার নামে। ওসমান বিড়বিড়িয়ে বলে, আমার কপালে এত কিছু দেখার ছিল! উহ্, কী যে সুন্দর! ওরাও একেকটা ঝরনা। শুধু পানি দেয় না। আনন্দ দেয়।

কাঠবিড়ালিগুলো বিভিন্ন দিকে চলে গেলে ওরা আবার উঠতে শুরু করে। ওরা জানত, নামার চেয়ে ওঠা কঠিন। তার পরও দম নেওয়ার জন্য দাঁড়ায় না। ওসমানের মনে হয়, তাহলে বয়সের কাছে হার মানা। অহনের সামনে হার মানা যাবে না। বোঝাতে হবে, আমরাও পারি। জীবনের সঙ্গে যা কিছু ওতপ্রোতভবে জড়িত, তাকে বরণ করে বুকে রাখা প্রকৃতির ধর্ম। নইলে এই পাহাড়ি এলাকায় বসতি গড়ে উঠত না। নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাট জীবন-দুমুঠো ভাত আর পানি যেমন চায়, তেমন চায় নিজেদের সংস্কৃতির মাঝে নিজেদের আনন্দ ধরে রাখতে। এও এক গভীর জীবনসত্য। মানুষ এ সব কিছুর বাইরে থাকতে পারে না। কৌম সমাজ বেঁচে থাকার আচরণ নির্ধারণ করে।

লুইরুইপাড়ায় উঠলে অহন বলে, আমাদের হেডম্যানের কাছে নিয়ে যাব তোমাদের। তাঁর সঙ্গে দেখা করা এখানকার রীতি। আমি অবশ্য তোমরা যে এক রাত থাকবে, সে অনুমতি নিয়ে রেখেছিলাম।

দুজনেই জানে যে এদের সমাজব্যবস্থা নিজেদের নিয়মে চলে। একজন হেডম্যান ও একজন কার্বারি থাকে। নিজস্ব নিয়ম যা আছে, তা সবাইকে মানতে হয়। হেডম্যানের বাড়ির পথে যেতে যেতে ওসমান বলে, আমি এখানে ব্যাঙের ডাক পেলাম না। আমার সবুজ ব্যাঙকে কোথায় খুঁজব আর? ‘স্টপ জেনোসাইড’ বলার কথা কে আমাকে শেখাবে?

এসব কথা এখন থাক, ওসমান। তোর কথা শুনলে অহনেরও মনে হবে, ওর জীবনেরও অনেক কিছু হারিয়েছে। কোথায় খুঁজবে তাকে।

যাদের আমি খুঁজছি, তারা আছে সবখানে। মাঝে মাঝে বুকের ভেতর প্রবল টান লাগে। সামলাতে কষ্ট হয় আমার। এখানে আসার পরে বারবারই মনে হয়, জহির রায়হান যদি এই পাহাড়ি জনপদ নিয়ে একটি সিনেমা বানাতেন, তাহলে আমরা গুলিবিদ্ধ লাশের স্বরূপ বুঝতাম।

বদরুল কথা বাড়ায় না। ওসমানের এমন অনেক কথার সঙ্গে ও নিজের ভাবনা যোগ করতে পারে না। বুঝতে পারে, দুজনের উপলব্ধিতে ফাঁক আছে। ওসমান যেভাবে ভাবতে চায়, সে ভাবনার সঙ্গে ওর সংযোগ নেই। তার পরও দুজন কাছাকাছি হতে পারে, যেটাকে কাছের বন্ধু হিসেবে দেখা যায়। সেই বন্ধুত্বের সঙ্গেই এখন বসবাস।

হেডম্যানের সঙ্গে কথা বলে দুজনে ফিরে আসে অহনের বাড়িতে। বারান্দাটি চমৎকার। এখানে বসে দূরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার তুলনা হয় না। অহন বলেছে, সন্ধ্যায় গির্জায় প্রার্থনা হবে। ও ওখানে যাবে। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে প্রার্থনা চলবে। ফিরে এসে হেডম্যানের বাড়িতে যাবে।

হেডম্যান ওদের রাতের খাবারের জন্য নেমন্তন্ন করেছে। ওদের বারান্দায় বসিয়ে অহন ওদের আনা মিষ্টি-বিস্কুট নিয়ে আসে। বলে, এখন এসব খেলে হবে না?

অবশ্যই হবে।

আমরা রাতে ভাত খাব। অহনের মৃদু হাসিতে দূরের তারার হাতছানি দেখা যায়। দূরের দিকে তাকিয়ে ওসমান কয়েকটি ঘর দেখতে পায়।

মানুষের ঘরবসতি অত দুর্গম জায়গায় কেন? যাওয়া-আসার রাস্তা আছে বলে তো মনে হয় না।

জল, জলের জন্য। যেখানে জল, সেখানে জীবন। জল ছাড়া তো মানুষ বাঁচবে না।

তাইতো। সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীর ধারে। মানুষ তো শুরুতে নদীপথে যাত্রা শুরু করেছিল। আবিষ্কার করেছে দেশ-মহাদেশ। ভাবনার মাঝে বিস্কুট-মিষ্টি খায়। নিজেদের খিদে লাগাকে ঠাণ্ডা করে। ওসমানের চোখের সামনে জেগে ওঠে জলফু। দাঁড়িয়ে আছে কবরস্থানের গেটে। বলছে, তুমি তো জোনাকি। জ্বলো আর নেভো। এখন তুমি কি জ্বলে আছ, না নিভে আছ?

আমি এখন জ্বলে আছি রে, সবুজ ব্যাঙ। তোর ডাক শোনার জন্য তোকে খুঁজছি। তুই ঝরনায় নাই, জঙ্গলে নাই, মাটিতে নাই, ঘরে নাই। তুই কি তাহলে মেঘে আছিস? নাকি চাঁদে?

শোনা যায় অহনের কণ্ঠস্বর, আমি গির্জায় যাচ্ছি। আপনারা অন্ধকারেই বসে গল্প করুন। প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার তো দরকার নেই?

না রে দাদা, একটুও দরকার নেই। এমন সুন্দর চাঁদনি রাত। চাঁদের আলোয় মাতাল হয়ে যাচ্ছি।

অহন চলে গেলে বদরুল বারান্দার ওপর চিতপাত শুয়ে থাকে। গুনগুনিয়ে গান গায়। আপন মনে গাওয়া। নিজেকে প্রকাশ করার সুখের বিলাস। ওসমান একমুহূর্ত শোনে। তারপর নেমে যায় নিচে। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের ঢালুর মাথায় এসে বসে। এমন অপূর্ব বনভূমি, এত সব নৃগোষ্ঠীর মানুষ, চারদিকে প্রাণবৈচিত্র্যের তোলপাড়। এর সবটুকু নিয়ে কি ঢাকায় ফিরতে পারবে? নিজেকেই বলে, না। এই জনপদ বোঝার জন্য বারবার আসতে হবে এখানে। দেখতে হবে খুঁটিয়ে। চিনতে হবে ঘাস লতা খুদে পোকার সবটুকু। শিখতে হবে আদিবাসী মানুষদের জ্ঞান। হাজার রকম শিক্ষা ছাড়া জানা কি এত সহজ হবে? ওসমান ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। কখনো নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। কখনো চোখ বন্ধ করে খুদে পোকার বার্তা শোনে। এই চোখ মেলা আর বন্ধ করে রাখার মধ্যে ও জোনাকির জ্বলা-নেভা অনুভব করে। সবুজ ব্যাঙ, আমি সাজেক ভ্যালির লুইরুই পাহাড়ে শুয়ে নিজেকে জোনাকি ভাবতে পারছি। তুই আমাকে জ্বলা-নেভার সত্যটা বুঝিয়ে দিয়েছিস।

ঢাকায় ফিরে ক্লাস-টিউটরিয়াল-পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওসমান। মুখ বুজে টেবিলে বসে থাকা এখন ওর ধ্যানমগ্ন সময়। বাইরে রাজনীতি উত্তাল। এসব থেকে ও নিজেকে দূরে রাখে। পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে না হলে অন্য বই পড়ে। বেগম রোকেয়ার লেখা পড়তে ভালো লাগে। বাংলা একাডেমি থেকে ‘রোকেয়া রচনাবলী’ কিনে এনেছে। পড়ার বইয়ের সঙ্গেই রেখে দিয়েছে। ইচ্ছা হলেই বের করে পড়ে। এই বইয়ের অনেক লাইন ও মুখস্থ করেছে। ‘জাগো গো ভগিনী জাগো’-এ কথা মনে হলে মায়ের কথা মনে হয়। ওর মা তো জেগেই ছিল। পড়ালেখা না-শেখা মানুষ, দিনমজুরি করে জীবন চালিয়ে ছেলের মাথার ওপর চাঁদ বসাতে চেয়েছিল। সেই মা হাজার ভগিনীকে জাগাতে পারে। মায়ের মুখটা ভেসে উঠলে ওর সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তখন ও বেগম রোকেয়ার লেখায় আশ্রয় খোঁজে।

সাজেক ভ্যালি থেকে ফিরে এসে বই পড়ার পাশাপাশি ওর দিনগুলো আরো নিমগ্ন সচেতন হয়ে যায়। মনে হয়েছে, ওদের জীবনে আছে গুলি ও মৃত্যুর সহবাস। এও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ।

স্নান করে ফিরে আসা সেই বুড়োর সঙ্গে দেখা হয়েছিল পরদিন ভোরবেলা ফিরে আসার সময়।

ওসমান হাত ঝাঁকিয়ে বলেছিল, দাদু, আজ স্নানে যাবেন না?

বৃদ্ধ মাথা নাড়িয়ে বলেছিল, আজ না। রোজ রোজ স্নান নিতে শরীর রাজি হয় না।

তাইতো, শরীরেরও রাজি-অরাজির ব্যাপার আছে। এটা তো কোনো দিন ওর ভাবা হয়নি।

তোমরা কোথা থেকে এসেছ, দাদুরা?

ঢাকা থেকে।

আমি কোনো দিন ঢাকা যাইনি। দু-চারবার রাঙামাটি গিয়েছি মাত্র।

ওসমান অবাক হয়। এত ছোট গণ্ডিতে কেমন করে বসবাস করে মানুষ? কতটা নিরুপায় হলে মানুষ এমন হয়, সেটা বোঝাই কঠিন। ওসমান চোখ বুজে সেই অপরূপ এলাকার কথা ভাবে। যদি ওখানে গিয়ে কিছুকাল থেকে আসতে পারত, তাহলে হয়তো বৃষ্টিধোয়া গাছের মতো সজীব হতে পারত। জীবন এখন নানাভাবে চুলোয় পোড়ানো এবং পোড়খাওয়া। এখন মনে হয়, সাজেক ভ্যালির সেই মানুষটির জীবনও পোড়খাওয়া। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অনেক সময় মানুষকে স্বস্তি দেয় না। সেখানে বন্দুকের নল গর্জন করে। সেখানে পানির অভাবে জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়।

দাদু বলেছিল, আমাদের এখানে বর্ষাকাল সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। কেন জানো?

কেন, দাদু? বসন্তকালে তো অনেক ফুল ফোটে।

মানুষ বর্ষা চায় জলের জন্য। সে সময় আমরা খাবার জল ধরে রাখি। খাবার জল টানার জন্য মেয়েরা যে কষ্ট করে, তার থেকে ওরা কিছুকাল শান্তি পায়।

ওসমান ভাবল, গুলি ও জল। আদিবাসী মানুষের জীবনযাপনের মাথার বোঝা। সেদিন দাদু ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, এখন বলো দাদু, জল দরকার, না ফুল দরকার? তুই বলবি দুটোই দরকার। তবে জল আগে দরকার, না রে?

হা হা করে হেসেছিল সেই খুনখুনে বুড়ো। ওসমানের মাথার ভেতরে হাসির শব্দ। ওর মনে হয়, ওর নিজের দম ফুরোনোর আগে এমন হাসিই ওর কাম্য ছিল। ও মাথার ভেতরে হাসির শব্দ ধরে রাখতে রাখতে ভাবে, তুমি শতায়ু হও, দাদু। তোমাকে মনে রেখে আমি দিন কাটাব। তোমার হাসির শব্দ হবে আমার জীবনের গান। সেখান থেকে শক্তি নেব।

ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই হা হা করে হাসে। হাসি যেন পরি-পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে উঠছে। ওসমানের জীবনেও গুলি ও জলের সত্য জীবন্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু ওর হাসি থামে না। ভাবে, ও হাসি খুনখুনে বুড়ো দাদুর হাসির সঙ্গে মিশে থাকুক। আমি এই মিশে থাকা নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। আমার তো বেশি চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই।

বাইরে মিছিল থেকে স্লোগান ভেসে আসে। কয়েক দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় অশান্ত। ছাত্ররাজনীতির দুই দলের কোন্দলের জের ধরে প্রতিদিনই নানা ঘটনা ঘটছে। হঠাৎ করে কখনো গুলির শব্দ শোনা যায়। চমকে ওঠে ওসমান। মাথা কাজ করে না। জানালা বন্ধ করে রাখে।

বদরুল বলে, এভাবে আর কত দিন চলবে, বুঝতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেবে কিনা অনির্দিষ্টকালের জন্য।

কে জানে কী হবে। যদি তেমন হয়, তাহলে বাড়ি চলে যাব। অনেক দিন বড় ভাইকে দেখি না। বোনটার শ্বশুরবাড়িও যাওয়া হয়নি। বোনের দুই মাস বয়সী ছেলেটিকেও দেখা হয়নি। আমার দিনমজুর ভাই এখন মুদির দোকান চালায়। এক ধাপ এগিয়েছে।

তুই বাড়ি গেলে আমিও তোর বাড়িতে বেড়াতে যাব। নিবি?

হা হা করে হাসে ওসমান।

এমন করে কেন বললি, নিবি? এই হলে তুই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু! সাজেক ভ্যালিতে যাওয়ার মতো দুজনে একসঙ্গে গ্রামে ঘুরব। মাছ ধরব। আমার ভাবি ছোট মাছ কলাপাতায় মুড়ে মাটির খোলায় এমন সুন্দর রান্না করে যে খেলে তুই সে রান্নার স্বাদ ভুলবি না।

হুররে, তাহলে আমার নীলগঞ্জ নদীর ধারে তালতলী গ্রামে যাওয়া পাকা হয়ে গেল।

বদরুল দুই হাত ওপরে তোলে।

এক কাজ করলে হয় না, আমরা চল ঘুরেই আসি। ইউনিভার্সিটি বন্ধ হোক আর না হোক।

না রে, এখনই যাব না। মাত্র কয়েক দিন আগে সাজেক দেখে এলাম। যাব আর কয় দিন পর।

যাবি না? ওসমান বিষণ্ন হয়ে যায়।

যাব না বলিনি। বলেছি কয়েকটা দিন যাক। পরীক্ষায় তো পাস করতে হবে। আর তোর নোট ছাড়া তো আমার গতি নাই। চলি রে, বন্ধু।

বদরুল চলে গেলে ওসমানের মনে হয়, চারদিক কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। এমন ভয়াবহ নির্জনতায় ও জীবনে পড়েনি। ওর ভয় করছে। ঠকঠকিয়ে হাঁটুকাঁপা ভয়। ভয় কেন? ভূমিকম্পের, নাকি দাঙ্গার, নাকি জলোচ্ছ্বাসের, নাকি ঘূর্ণিঝড়ের? ওর বুক ঢিপঢিপ করে। নিজের কপালে হাত দেয়। বুঝতে পারে, জ্বর এসেছে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে ওর জ্বর হয়নি। সর্দি-কাশিও না। ও বিছানায় শুয়ে পড়লে ঠকঠক করে কাঁপে শরীর। ওর আর কিছু মনে থাকে না। ও বালিশে মাথা গোঁজে।

দুদিন পার হয়ে যায়।

বদরুল ওকে নাপা খাইয়েছে। বলেছে, জ্বর না ছাড়লে আমাদের মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যাব। কিন্তু নাপা খেয়ে জ্বর ছাড়ে। খানিকটা স্বস্তি ফিরে পায় ও।

পরদিন রাত আড়াইটা।

ছাত্র সংঘর্ষের বাড়াবাড়ির একপর্যায়ে পুলিশ হলের ভেতরে ঢুকে লাঠিচার্জ শুরু করে। বদরুল ওর ঘরেই ছিল। শব্দ শুনে ওর হাত ধরে বলে, ওঠ।

কোথায় যাবি?

পায়ের শব্দ শুনে মনে হচ্ছে, ব্যালকনিতে অনেকে জড়ো হয়েছে। আমরাও ওখানে যাই। নইলে পুলিশ ঘরে ঢুকে পেটাবে। টিয়ার শেল ছোড়া হয়েছে।

চারপাশে এত ধোঁয়া যে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

আমার হাত ধরে রাখ।

আমার মাথা ঘোরাচ্ছে।

আমারও মাথা ঘোরাচ্ছে।

শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

কথা বলিস না। সবার সঙ্গে এখানেই দাঁড়াই আমরা। তুই দেয়ালে ঠেস দিয়ে থাক।

ওসমান চোখ বুজে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে রাখে।

কেউ কিছু বোঝার আগেই ওদের দিকে ছুটে আসে টিয়ার শেল। ধোঁয়ায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। বদরুল শুধু বুঝতে পারে, ওসমান কাত হয়ে পড়ে গেছে। ভাবে, পরিস্থিতি শান্ত হলে ওসমানকে ওঠাবে। হয়তো ওর মাথা ঘোরাচ্ছে। ও শুয়েই থাকুক।

একটু পরে মনে হয়, ওর পা ভিজে যাচ্ছে। ও খালি পায়েই দাঁড়িয়ে আছে। ওসমানও খালি পায়ে এসেছে। ভিজে যাওয়া পায়ের দিকে খেয়াল করার দরকার নেই। গ্যাসের দ্রবীভূত কোনো কিছু হয়তো পায়ে লাগছে। একসময় পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়। ধোঁয়া কমে গেলে ছেলেরা যখন এদিক-ওদিক সরে যেতে থাকে, তখন বদরুল খেয়াল করে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। কাত হয়ে পড়ে থাকা ওসমানের মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে।

ও চেঁচিয়ে ডাকে, ওসমান, ওসমান।

সাড়া নেই।

এতক্ষণের রক্তক্ষরণে জ্ঞান হারিয়েছে।

বদরুলের মনে হয়, ছোট ব্যালকনিটি এক বিশাল সাজেক ভ্যালি। ওসমানকে কাঁধে নিয়ে ও ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। একসময় ও টের পায়, ওর কাঁধের ওপর ওসমান নেই। ওসমান পাখি হয়ে উড়ছে। অল্পক্ষণে ওকে আর দেখা যায় না। ও আকাশের বিশালত্বে হারিয়েছে।

ওসমান এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

ইমার্জেন্সিতে বেড নেই। মেঝেতে রাখা হয়েছে ওকে। রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। জ্ঞানও ফেরেনি। শ্বাস-প্রশ্বাসের মৃদু প্রবাহ আছে মাত্র।

পাশে বসে থেকে বদরুলের মনে হয়, কিছুক্ষণ আগে পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা জলপ্রপাতের মতো ছিল ওসমানের মাথার রক্তক্ষরণ। এখন এটি ক্ষীণধারা হয়েছে। একটু পরে রক্তের ধারা বন্ধ হয়ে গেলে জলপ্রপাতে স্নানরত খুনখুনে বুড়োরা বলবে, ঈশ্বর আমাদের প্রতি সদয় নন। আমরা যা হারাতে চাইনি, তিনি তা নিয়ে গেছেন। আমাদের পাপ মার্জনা করবেন দয়াময়।

ডাক্তার এসেছেন।

ওসমানকে বেডে ওঠানো হয়েছে।

ডাক্তার মৃদস্বরে বললেন, রক্তক্ষরণে অবস্থার অবনতি হয়েছে। আল্লাহকে ডাকুন।

কাছের মানুষ কেউ নেই যে চিৎকার করে কাঁদবে। বিলাপ করে হাসপাতালের করিডরে আর্তনাদ করবে।

নিঃশব্দ রাতের প্রহর শেষ হয়।

দিনের আলো ছড়িয়েছে।

রাতে যারা হাসপাতালে আসতে পারেনি, সেসব ছেলে জড়ো হয়েছে ইমার্জেন্সির সামনে। বাইরে কোলাহল বাড়ে। কেউ এসে স্লোগানের মতো বলে, ওসমান হত্যার বিচার চাই। হত্যাকারীর ফাঁসি চাই।

চুপ। ওর শ্বাস আছে।

বল, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।

জিততেও তো পারে। মৃত্যুর কাছে সবাই হারবে কেন?

অল্প সময়ের জন্য ওর জ্ঞান ফিরেছিল।

কয়েকজন এসে বদরুলকে ঘিরে ধরে।

ও কি কিছু বলেছে?

না। কথা বলার মতো অবস্থা ওর নেই।

ডাক্তার কী বলছে?

তাঁরা তো চেষ্টা করছেন। দেখা যাক।

বদরুল হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। হাতঘড়ি শব্দ করে না। ছোটবেলা থেকেই ও ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনতে পছন্দ করত। বড় হয়ে ভেবেছে, ওই শব্দ সময়ের হৃৎপিণ্ডের শব্দ।

ওর সামনে দেয়ালঘড়ি নেই। হাসপাতালের ইমার্জেন্সির করিডরে দাঁড়িয়ে থেকে ওর অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না।

ছত্রিশ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শেষনিঃশ্বাস ছাড়ে ওসমান। নিভে যায় জীবনপ্রদীপ।

খবরটা শোনার পরে চোখ ভেজে না বদরুলের।

এমন মৃত্যুতে চোখ ভিজবে কেন? ক্রোধ হবে। হাত বারবার মুষ্টিবদ্ধ হয়। ও দেখতে পায়, ক্যাম্পাস বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।

ওসমানের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হবে। তার প্রস্তুতি চলছে।

কে যেন বদরুলের ঘাড়ে হাত রাখে। বলে, ও তো তেমন কারো সঙ্গে মিশত না। তুই ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ওর কাছ থেকে নোট নিয়ে পরীক্ষা দিতি।

বদরুল ঘাড় থেকে ছেলেটির হাত নামিয়ে দিয়ে বলে, আমি অকৃতজ্ঞ নই।

কৃতজ্ঞতার ঋণের দায় নিবি?

হ্যাঁ। আমি ওর লাশের সঙ্গে টাঙ্গাইলের মধুপুর গ্রামে যাব। দাফনের সময় থাকব।

লাশ নিয়ে গ্রামে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যায়। ওর খাটিয়া যে চারজন কাঁধে নিয়ে হাঁটছে, তাদের মধ্যে বদরুল একজন। ওদের বাড়ি পর্যন্ত অ্যাম্বুল্যান্স যাবে না। রাস্তা নেই।

অবারিত সবুজের মাঝে হেঁটে যেতে যেতে বদরুল নিজেকে বলে, ওসমান আপনাকে খুব ভালোবাসত, জহির রায়হান। ও ভাবত, একদিন আপনার সঙ্গে ওর কোথাও না কোথাও দেখা হবে। আপনি আছেন কি আশপাশে কোথাও? অন্যায়ভাবে লাশ হয়ে যাওয়া ওসমানকে নিয়ে তৈরি হবে কি কোনো চলচ্চিত্র?

এতক্ষণে বদরুলের চোখ ভিজে যায়। ও চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। অন্যরা বুঝতে পারে, এতক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে থাকা বদরুল বুকের ভেতর চোখের জল আটকে রেখেছিল। এখন ওর কান্নার শব্দ গুলির মতো ছুটছে।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সেলিনা হোসেন- র আরো পোষ্ট দেখুন