আছে দুঃখ আছে মৃত্যু

এক এক করে সবাই চলে যাচ্ছে। জানি এভাবে সবাই যাবে, আমিও। তারপরও কারও মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারি না। খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুরছি, কিন্তু যে মানুষটা নেই, কিছুদিন আগেই ছিল, তাকে মনে করতে করতে উদাস হয়ে যাই। ডানে যাবো, বাঁয়ে যাই। চা তো ঠাণ্ডা হয়ই, বইয়ের যে প্যারাগ্রাফে চোখ, সেই প্যারাগ্রাফেই সারাদিন চোখ পড়ে থাকে, মন অন্য কোথাও, মন মানুষটার থাকায়, না-থাকায় নয়। মৃত্যু জিনিসটাকে যদি কিছু দিয়ে মুছে ফেলা যেত! আমার মতো এমন আগাগোড়া বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের এত আবেগ থাকবে কেন, এমন প্রশ্ন অনেক শুনেছি। তারপরও আমি আমিই থেকে যাই। ধর্মে যাদের বিশ্বাস আছে, তারা কষ্ট পায় কম, তারা তো ভেবেই নেয়, মৃত্যুই শেষ কথা নয়, মানুষ আবার জেগে উঠবে, মানুষকে দাড়িপাল্লায় বিচার করবে কোনও এক সর্বশক্তিমান, তারপর মানুষ আর মরবে না। অথবা মৃত্যুর পর আবার এই পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসবে মানুষ, মানুষ নয়তো পশু পাখির রূপ ধরে। এসব বিশ্বাস থাকলে দুঃখ-টুঃখ পাওয়ার ব্যাপারটা কমই থাকে। আমার কষ্ট হয়, কারণ আমি জানি, যে গেছে সে একেবারেই গেছে, সে আর জাগবে না কোনওদিন, তার সঙ্গে আর কোনওদিন কারও দেখা হবে না।

মা চলে গেল। এরপর বাবা। মাঝে মাঝে বিশ্বাস হতে চায় না যে সত্যিই বাবা মা নেই। মামা খালারা যারা ভালোবাসতো, তারাও নেই। দেশে যদি কোনওদিন ফিরতে পারি, দেখবো দেশটা ফাঁকা। আগে যারা শুভাকাঙ্খী ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই আর নেই। শামসুর রাহমান, কে এম সোবহান, কবীর চৌধুরী, আহমেদ শরীফ, ওয়াহিদুল হক, কলিম শরাফী, কেউ নেই। কলকাতায় পাশে ছিলেন অন্নদাশংকর রায়, নিখিল সরকার, শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত, সবাই চলে গেলেন। কলকাতাও অনেকটা ফাঁকা। খুব স্নেহ করতেন মদনজিৎ সিং, মারা গেছেন। দিন দিন জগতটা ফাঁকা হচ্ছে। দুটো ভাই, দিব্যি বেঁচে ছিল, এর মধ্যেই একজনকে ধরেছে কর্কট রোগ, আরেকজনকে হৃদপিণ্ডের রোগ। কেউ জানে না হঠাৎ কী অসুখ কাকে থাবা দেবে। কাকে ধাক্কা দিয়ে কোন অতলে ফেলবে। আমিও ভাইদের মতো বাবা মা’র অসুখগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। দুই ভাইয়ের এক ভাই সেদিন চোখের সামনে মারা গেলো হাসপাতালে। ওর মৃত্যুটা সইতে পারছি না। যদিও কর্কট রোগে ভুগছিল, মারা গেছে হসপিটাল বাগে। আমি এখনও বেঁচে আছি। নির্বাসন জীবনে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছি, ঝড়ে ঝঞ্ঝায় দুর্যোগে দুঃসময়েও লেখাটা ছাড়িনি, এখনও লিখছি, যেমন লিখতাম, সেসব লেখাই যেসব লেখার জন্য ফতোয়া, নির্বাসন, হরতাল, আর লক্ষ লোকের মিছিল হয়। লিখতে লিখতেই হঠাৎ কোনও কঠিন অসুখ হবে, বুকে ভীষণ ব্যথা হবে, চুপচাপ মরে যাবো। একা একাই মরতে হবে। তাতে কী! মানুষ কি আর কাউকে সঙ্গে নিয়ে মরে! পাশে হয়তো থাকে লোক। মৃত্যুটাকে, মৃত্যুর যন্ত্রণাটাকে কেউ তো আর ভাগ করে নেয় না। মৃত্যু নিয়ে আমার কোনও স্বপ্ন টপ্ন নেই। অনেকের থাকে। আত্মায় বিশ্বাস করলেই ওসব থাকে। আমার ওই ঝামেলা নেই।

জগতটা ফাঁকা হলেই যে বেঁচে থাকার ইচ্ছে উবে যায়, তা নয়। যারা জানে জীবন একটাই, এবং জীবন একবারই, তারা কেবল পেছনে তাকিয়েই জীবন যাপন করে না, সামনেও তাকায়। আমি সামনে তাকাই, তাই বলে কি পেছনে তাকাবো না, মা’কে মনে করবো না, বাবার জন্য দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলবো না, শিবনারায়ণ রায়ের স্নেহ আর ভালোবাসার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলবো না, তা কি হয়? বিজ্ঞানে আর বিবর্তনে বিশ্বাস করলে মানুষ খুব নিষ্ঠুর হয়, ধর্মবাদীরা এমন কুৎসা সবসময়ই রটায়। আসলে জীবনে আমি উল্টোটাই দেখেছি। খুন করছে, শিশু-ধর্ষণ করছে, চুরি ডাকাতি করছে, মিথ্যে কথা বলছে, মানুষকে ঠকাচ্ছে– এমন ভয়ংকর বর্বর মানুষগুলোর বিশ্বাস ধর্মে আর ঈশ্বরে অগাধ। আর যে ধার্মিকগুলো ভালো, তারা যদি কোনওদিন জেনে যেতে পারে যে ঈশ্বর বলে কিছু নেই, তাহলে সর্বনাশ। তাদের বেশির ভাগই খুন খারাবী, লুট তরাজ, অন্যায় অত্যাচার করে পৃথিবীকে আস্ত একটা নরক বানিয়ে ছাড়বে। ঈশ্বরের শাস্তির ভয়ে যারা ভালো মানুষ, তারা সত্যিকার ভালো মানুষ নয়। সত্যিকার ভালো মানুষ তারা, যারা ঈশ্বর নেই জেনেও খারাপ কাজ করে না।

শত সহস্র কোটি গ্রহ নক্ষত্রের এই মহাবিশ্বে একটি ছোট্ট গ্রহে মানুষ নামক প্রজাতি অন্য প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছে। আরও লক্ষ প্রজাতির মতো আমরাও হয়তো একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবো। মহাবিশ্বের অযুত- নিযুত-কোটি বছরের ইতিহাসে মানবপ্রজাতির বিবর্তন এবং বিলুপ্তি সবই হয়তো এক পলকের ঘটনা। আমাদের বিলুপ্তিতে কিছু কি যায় আসে এই ব্রহ্মাণ্ডের? এ যেমন চলছে তেমন চলবে। গ্যাস ফুরিয়ে গেলে একদিন আমাদের সূর্যটাও চুপসে যাবে, আশে পাশে যা কিছু আছে, পৃথিবীসুদ্ধ সব কিছুকে শুষে নিয়ে, তবে। অত কোটি বছর অবধি কি আমাদের প্রজাতি বেঁচে থাকবে! হয়তো আরও নষ্টের দিকে যাবে, নয়তো অবিশ্বাস্য কোনও ভালোর দিকে। কে জানে আমাদের কোনও জল্পনা-কল্পনার ধারে কাছেই হয়তো যাবে না, মানুষই একদিন পারমানবিক বোমায় ধ্বংস করে দেবে পৃথিবীর সবকিছু। নয়তো কোনও একদিন মহাশূন্য থেকে কোনও একটা পাথর ছিটকে পড়ে ডায়নোসোরের জাতকে যেমন নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, তেমন আমাদেরও করবে। এত কিছু জেনেও কিন্তু এই অনিশ্চিত অকিঞ্চিৎকর অর্থহীন জীবনকে ভালোবাসি, একে অর্থপূর্ণ করার চেষ্টা করি। মানুষ সুখে শান্তিতে স্বস্তিতে বাস করুক তার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে কিছু মানুষ। অধিকাংশই নিজেকে ছাড়া কিছু ভাবে না, তারা আরামে এই জীবনটা কাটিয়ে ঈশ্বরকে উৎকোচ দিয়ে পরকালেও আরামে কাটানোর ব্যবস্থা করে নেয়। অন্যে কী খাবে, অন্যে কী পরবে, তা তাদের ভাবার বিষয় বলে তারা মনে করে না। অন্যের সমস্যা অন্যে ঘোচাবে। ধর্মবাদীরা যে দুঃস্থ দরিদ্রদের একেবারে সাহায্য করে না, তা নয়। করে, তবে স্বার্থের কারণে করে। ঈশ্বরের কাছ থেকে বিনিময়ে কিছু জুটবে বলেই করে। নিঃস্বার্থ আর ক’জন! অল্প কিছু মানুষই শুধু নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। চিরকালই। ও না হলে কি আর সমাজটা পাল্টাতো যতটুকুই পাল্টেছে বা যতটুকুই ভালো হয়েছে!

কুড়ি-কুড়ি বছর উড়ে যাচ্ছে এক তুড়িতে। জীবনের সময় বড় অল্প। ধর্মের রূপকথায় বিশ্বাস করি না বলে সময় আমার অহেতুক পুজোয় বা প্রার্থণায় নষ্ট হয়না। যতটুকু সময় আছে জীবনে, তা পুরোটাই চাই নিজের জন্য। নিজের যা ভালো লাগে, নিজের যা ইচ্ছে করে, তা করবো। সবাই যদি পারতো এমন! কী করতে নিজের ভালো লাগে, তা টের পেতে পেতেই অনেকের জীবন ফুরিয়ে যায়। কারও কারও ইচ্ছেগুলো ধার করা, নিজের নয়। কত কত মানুষের মুখের হাসিটা নকল, কথাগুলো নকল, কাপড়চোপড় নকল! অনেক সময় মনে হয় চারদিকের মানুষগুলো ঠিক মানুষ নয়, প্রাণহীন রোবট।

এসবের মধ্যে থেকেও প্রতিদিন ভালোবাসছি। প্রতিদিন স্বপ্ন দেখছি সমতার, সততার। স্বপ্ন দেখছি সুন্দর পৃথিবীর। যারা আমার মতো ভাবছে– তারা কে বলেছে সংখ্যায় খুব কম! পৃথিবীর সবখানে তারা ছড়িয়ে আছে। কেউ ভেড়া নই বলে মাথা গোণার উপায় নেই। না, আমরা কেউই একা নই। মাঝে মাঝে যে একা বলে নিজেকে ভাবি, ভুল ভাবি। বাড়িভর্তি লোক থাকলেই যেমন মানুষের একাকীত্ব ঘোচে না, এক বাড়িতে জীবনভর একা থাকলেও এ আসলে একা থাকা নয়।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
Alternative Textতসলিমা নাসরীন- র আরো পোষ্ট দেখুন