দেশে কি পঁচাত্তরের আলামত দেখা দিয়েছে?

সম্প্রতি ঢাকার এক দৈনিকের সম্পাদকের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হচ্ছিল। তিনি দেশের কয়েকটি খারাপ ঘটনার উল্লেখ করে বললেন, তার ধারণা দেশে পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী অবস্থা বিরাজ করছে। আমি কি তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি? দেশের অবস্থার কথা শুনে আমার তখন মনে হয়েছিল, সম্পাদকের সঙ্গে সহমত পোষণ করা যায়। আমিও তাকে সে কথাই বলেছিলাম। পরে যখন টেলিফোন রেখে বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে বসেছি তখন মনে হয়েছে, না, দেশের পরিস্থিতি পঁচাত্তরের মতো মনে হতে পারে; কিন্তু তা অভিন্ন নয়। দুই সময়ের অবস্থার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
পঁচাত্তর সালের অবস্থার ওপর একটু দৃষ্টিপাত করা যাক। তখনকার সরকার স্থিতিশীল ছিল না। মাত্র বাকশাল গঠিত হয়েছে। শাসনব্যবস্থাও অস্থিতিশীল। মাত্র ট্রানজিশন চলছে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা থেকে বাকশালি ব্যবস্থায়। এই পরিবর্তনে আমলাতন্ত্র খুশি নয়। তারা তলে তলে ঘোঁট পাকাচ্ছে। সেনাবাহিনীর মধ্যেও হঠাৎ মেজর জেনারেল পদে প্রমোশন পাওয়া একাধিক মেজরের মনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কায়দায় ক্ষমতা দখলের গোপন বাসনা কাজ করছে। আওয়ামী লীগ থেকে বাকশালে রূপান্তরিত হওয়ার পর দলের সাংগঠনিক শক্তিও তখন গড়ে ওঠেনি।
সবচেয়ে ভয়ের কথা, আমেরিকার নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের চক্রান্তে তখন বাংলাদেশে (১৯৭৪) ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটে গেছে। অনাহারে মারা গেছে লক্ষাধিক লোক। বঙ্গবন্ধু জনপ্রিয়তা না হারালেও তার সরকারের ওপর সাধারণ মানুষ অসন্তুষ্ট। এই অসন্তুষ্টিকে উস্কে দেওয়ার জন্য নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িক দলগুলো চালাচ্ছে নিরন্তর গোপন প্রচার। আওয়ামী লীগকে ইসলামবিরোধী এবং ভারতের দালাল বলে প্রচার চালানো হচ্ছে। চীনপন্থি এবং মাওবাদী বলে পরিচিত সন্ত্রাসীরা গ্রামগঞ্জে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস চালাচ্ছে। প্রশাসনের ভেতরেও চলছে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ। বঙ্গবন্ধু সরকার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য বিদেশ থেকে যে সাহায্য ও খাদ্যদ্রব্য এনেছিল, প্রশাসনের ভেতরের লোকদের সুবাদেই তাতে শুরু হয় লুটপাট। রিলিফের অনেক মাল রহস্যজনকভাবে নদীতে ভাসতে দেখা যায়। চট্টগ্রামে আবির্ভূত হয় ম্যান ছেরু মিয়া নামে এক রহস্যজনক দুর্বৃত্তের।
বঙ্গবন্ধুর সরকারকে একঘরে করে ফেলার জন্য তখন চলছে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। পাকিস্তান, চীন, সৌদি আরব বাংলাদেশকে দীর্ঘকাল স্বীকৃতি দেয়নি। পাকিস্তান ১৯৭৪ সালে স্বীকৃতি দিলেও সৌদি আরবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উচ্ছেদের চক্রান্ত চালিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ও অন্যান্য নিষিদ্ধ দলের গোপন তৎপরতাকে সাহায্য জোগাচ্ছে। সামরিক বাহিনীকে অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মিত্র ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে চলছে অবিরাম প্রচার। চলছে এই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মৈত্রী বন্ধন ছিন্ন করার প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতা। ভারতেও বাংলাদেশবিরোধী একটি মহল এ ব্যাপারে তৎপর ছিল।
চিলির জনপ্রিয় আলেন্দে সরকারকে উৎখাত এবং প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে হত্যার জন্য মার্কিন সিআইএর যে দীর্ঘ রক্তাক্ত হাত কাজ করেছে, সেই একই হাত কাজ করেছে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের চক্রান্তে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির মূলে যে আমেরিকার ষড়যন্ত্র ছিল, তা পরবর্তীকালে প্রকাশ পায় ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘ফুড অ্যাজ উইপন’ নামক প্রবন্ধে।
আজ থেকে ৪০ বছর আগে যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ছিল তা এখন নেই। আমেরিকার প্রতিপক্ষ হিসেবে যে শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তা আজ আর নেই। দিলি্ল-মস্কো অক্সিসও আজ নেই। দিলি্ল এখন আমেরিকার মিত্র। চীনের সঙ্গেও আমেরিকার এখন মুখোমুখি বৈরিতা নেই। পাকিস্তান অন্তর্ঘাতে জর্জরিত। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ক্রমশ গুরুত্ব হারাচ্ছে। সৌদি আরবের রাজতন্ত্র এখন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ইরানকে নিয়ে ব্যস্ত। বাংলাদেশ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাদের নেই, সুযোগও কম। শেখ হাসিনার মধ্যপ্রাচ্য নীতি মোটামুটি সফল। বাংলাদেশ সৌদি আরবের বৈরিতা ক্রমশ কাটিয়ে উঠেছে। ইরানের সঙ্গেও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করার পথে এগিয়েছে।
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও হাসিনা সরকারের অবস্থা বঙ্গবন্ধুর সরকারের চেয়ে অনেক বেশি স্থিতিশীল। সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্র্যাসিকে শেখ হাসিনা মোটামুটি সন্তুষ্ট রেখেছেন। তাদের মধ্যে অসন্তুষ্ট অংশ অবশ্যই এখনও আছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র পাকানোর মতো লোকের সংখ্যা ও শক্তি কম। বঙ্গবন্ধুর আমলে দেশে ছিল খাদ্য ঘাটতি, দুর্ভিক্ষের দেশ; নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি। হাসিনা সরকারের আমলে সেই দেশ এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রিত। জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার সর্বত্র প্রশংসিত।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিরোধিতা আছে; কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা দমাতে হাসিনা সরকার সক্ষম হয়েছে। সমালোচনামুখর সুশীল সমাজ ও মিডিয়াও এখন অনেকটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমেরিকা এখন হাসিনা সরকারের পরম মিত্র না হলেও বৈরী নয়। ভারতের মোদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। চীন ও রাশিয়া_ দুই দেশের সঙ্গেই সহযোগিতা বাড়ছে। সৌদি আরবের নতুন বাদশা হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে চাইছেন। একমাত্র পাকিস্তান তার আইএসআইর তৎপরতা বাংলাদেশে এখনও একেবারে বন্ধ করেনি। কিন্তু তার নখরের ধার ক্রমশ ভোঁতা হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই হাসিনা সরকার বর্তমানে যে সমর্থন ও সহযোগিতা পাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে তা ছিল কষ্টার্জিত।
সুতরাং কোনোদিক থেকেই বলা যায় না, বাংলাদেশে পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী বা চুয়াত্তর-পঁচাত্তরের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তবে যে বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী এখন চিন্তিত এবং কিছুটা শঙ্কিত তা হলো, দেশের কিছু সহিংস ঘটনা এবং আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ অবস্থা। সম্প্রতি কুষ্টিয়া, মাগুরা ও হাজারীবাগে র‌্যাবের হাতে ক্রসফায়ারে যারা মারা গেছে, তারা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের লোক। এ সম্পর্কে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এই ঘটনার মধ্যে সকলের জন্যই একটা বার্তা আছে।’ অর্থাৎ আওয়ামী লীগের জন্যও বার্তা আছে। এই বার্তাটি কী হতে পারে?
বঙ্গবন্ধুর আমলে ঢাকা শহরে অবৈধ অস্ত্র ও অর্থ এবং অবৈধ রেশন কার্ড উদ্ধারের কাজে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালানোর জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিল আওয়ামী লীগের লোকই বেশি। বর্তমানেও তাই ঘটছে। র‌্যাবের হাতে উপর্যুপরি ক্রসফায়ারে মারা গেছে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের লোক। এই তুলনা টেনে কেউ কেউ ভাবতে পারেন, বাংলাদেশে ২০১৫ সালে ১৯৭৫ সালের আলামত দেখা যাচ্ছে।
ঢাকার এক দৈনিকের সম্পাদকের সঙ্গে টেলিফোন আলাপের পর আমিও বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি। আমার মনে হয়েছে, ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়; আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষীদের কিছু অংশের মধ্যেও সেই ভয় ঢুকেছে। এই ভয় দ্বারা আমি প্রভাবিত হইনি। কিন্তু শঙ্কিত হচ্ছি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ প্রভৃতি সংগঠনের বর্তমান অবস্থা দেখে।
প্রথমে আওয়ামী লীগের কথাই বলি। এর সাংগঠনিক অবস্থা বড়ই করুণ, দেশে এবং বিদেশেও। নেতৃত্বের কোন্দল, গ্রুপ রাজনীতি, স্বার্থের কোন্দল, দলে ক্রমশ অসাধু ব্যবসায়ীদের ও জামায়াতি বা জামায়াতি মনোভাবের লোকদের অবাধ অনুপ্রবেশ এবং নেতৃত্ব দখল সংগঠনটির অবস্থা একেবারেই দুর্বল করে ফেলেছে। দেশে কোনো খুন-জখম-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটলেই সাধারণ মানুষ মনে করে, এটা আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ ঘটিয়েছে। ছাত্রলীগের অতীতের সংগ্রামী ভাবমূর্তি এখন একেবারে বিনষ্ট। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ পুনর্গঠিত এবং তার নেতৃত্বও পরিবর্তিত হয়েছে। জানি না, এই নেতৃত্ব বদল ছাত্রলীগের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবে কি-না! আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এখনও আছেন। শুনেছি, তার মন্ত্রী-দপ্তর বদল হওয়ার পর তিনি মন্ত্রী হিসেবে আগের চেয়ে অনেকটাই সক্রিয়। তিনি দলের কাজেও যদি কিছুটা সক্রিয় হন, তাহলে ভালো হয়। শরীর যদি সবল না থাকে তাহলে যেমন যে কোনো সময় রোগাক্রান্ত হতে পারে, তেমনি রাজনৈতিক সংগঠন যদি দুর্বল থাকে, তাহলে সেই রাজনৈতিক সংগঠনের ওপর নির্ভরশীল কোনো রাজনৈতিক সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের জন্য পঁচাত্তর সালের আলামত খোঁজার দরকার নেই।
১৯৭৫ সালে যে স্বাধীনতার শত্রুরা অতি সহজেই বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে পেরেছিল তার একটি বড় কারণ, আওয়ামী লীগ তখন ভেঙে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া কয়েকটি দল মিলে বাকশাল গঠিত হয়েছিল। সংগঠনটি তখনও একেবারে প্রস্তুতি পর্বে। তার ভিত তখনও শক্তিশালী হয়নি। ঘাতকের দল এই অবস্থার সুযোগই গ্রহণ করেছিল। বাকশাল শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো থাকলে পঁচাত্তরের ট্র্যাজেডি সহজে ঘটানো সম্ভব হতো না।
বর্তমানে পঁচাত্তরের আলামত নেই। সরকারও যথেষ্ট শক্তিশালী। বিরোধী পক্ষ ভালোভাবে কোণঠাসা। কিন্তু শক্তিশালী সরকারের শক্তির যে ভিত্তি রাজনৈতিক সংগঠন, তা যদি দুর্বল ও অভ্যন্তরীণ স্বার্থদ্বন্দ্বে জর্জরিত থাকে, তাহলে সামান্য বিপদেও সরকারকে সে সাহায্য জোগাতে পারবে না। এ ধরনের অবস্থায় পঁচাত্তরের মতো বড় ঝড়ের দরকার নেই। ছোট ঝড়েই সরকার কুপোকাত হতে পারে। আর সেই ছোট ঝড়ের অপেক্ষাতেই প্রহর গুনছে সরকারের কোণঠাসা বিরোধী পক্ষ। ছোট ঝড় বড় হতে কতক্ষণ?
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে যদি একটি ক্লিনিং অপারেশন না চলে, নীতিনিষ্ঠ নেতাকর্মী নিয়ে দলটি শক্তিশালী ও পুনগঠিত না হয়, তাহলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যতই নিরাপদ অবস্থানে থাকুক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে কোনো সময় বিপজ্জনকভাবে তাদের প্রতিকূলে চলে যেতে পারে। তাতে পঁচাত্তরের আলামতের সন্ধান না-ও পাওয়া যেতে পারে। বিপদ কখনও একই বেশ ধারণ করে আসে না।
লন্ডন, শুক্রবার, ২১ আগস্ট ২০১৫